সুপ্রতীকের সম্বন্ধে মণীশ খবরটা নিয়ে এসেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করেনি নিশান। কিন্তু তারপর মণীশ এমন-এমন ঘনিষ্ঠ ছবি দেখিয়েছে যে, আর কিছু বলতে পারেনি নিশান।
রাধিয়া কথাটা শুনে প্রথমে কেমন যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল! বলেছিল, “কী বলছ তুমি?”
নিশান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিল রাধিয়ার দিকে। তারপর মোবাইল খুলে দেখিয়েছিল ছবিগুলো।
রাধিয়া প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। ভাল করে কথাও বলতে পারছিল না। শুধু কোনওমতে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী করে পেলে ছবিগুলো?”
নিশান বলেছিল, “মণীশ। এই দুটো ছেলের একজনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে এগুলো নিয়ে এনেছে তার থেকে।”
রাধিয়াকে সেদিন একা ছাড়েনি নিশান। পৌঁছে দিয়ে এসেছিল ওদের বাড়ি অবধি।
“ছবিগুলো কি আছে না ডিলিট করে দিয়েছ!” রাধিয়া জিজ্ঞেস করেছিল দ্বিধার সঙ্গে!
“নেই, দ্যাখো!” নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিয়েছিল নিশান।
রাধিয়া নিয়ে ইতঃস্তত করেছিল সামান্য।
নিশান বলেছিল, “আমার মোবাইলে কিছু নেই। আমার গোপন কিছু নেই রাধি। তুমি দ্যাখো।”
“না থাক, আই বিলিভ ইউ,” রাধিয়া ফেরত দিয়ে দিয়েছিল মোবাইলটা!
নিশান মোবাইলটা খুলে ওকে দেখিয়েছিল। বলেছিল, “আমি চাই তুমি দ্যাখো।”
নিশানকে জড়িয়ে ধরেছিল রাধিয়া। কিছু বলেনি। শুধু জড়িয়ে ধরে রেখেছিল অনেকক্ষণ। তারপর মুখ তুলে বলেছিল, “আমায় ছেড়ে যাবে না তো!”
নিশান পালটা বলেছিল, “তুমি হয়তো চলে যাবে!”
রাধিয়া বড় করে তাকিয়েছিল নিশানের দিকে। তারপর বলেছিল, “গিয়ে দ্যাখো, মেরে ফেলব! সেই পরিটা নেই আর। এখন আমি রক্তমাংসের রাগী, বাজে কথা বলা, পালটা মার দেওয়া মানুষ! মনে থাকে যেন!”
বৃষ্টিটা বাড়ল আরও। গায়ে জলের ছিটে এসে লাগছে।
নিশান বলল, “এই ফোন করব ভাবছিলাম। আসলে খুব দরকারি একটা কাজে বেরিয়েছি! আমি রাতে ফিরে ফোন করি?”
রাধিয়া বলল, “এত তাড়া কীসের? কার কাছে যাচ্ছ যে, এত তাড়া?”
“আরে!” নিশান শব্দ করে হাসল, “কী যে বলো না! বিজনদার কাছে যাচ্ছি। খুব বৃষ্টি পড়ছে। কী এক ডিপ্রেশন হয়েছে কে জানে!”
“ঠিক আছে,” রাধিয়া হাসল সামান্য, “ফিরে রাতে মিস্ড কল দিয়ো। কথা হবে।”
নিশানও হেসে বলল, “এই রাখাল ছেলে ফোনের খরচ চালাতে পারে রাজকুমারী! ফোনই করব!”
“দাঁড়াও কাছে পাই, তারপর দেখছি তোমায়!” রাধিয়া গরগর করল রাগে।
কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল নিশান। একটাও রিকশা নেই। তা হলে কি হেঁটেই যাবে! সারা শরীর যদিও রেনকোটে ঢাকা, তাও, হাঁটা বেশ মুশকিল এমন বৃষ্টিতে!
আচমকা একটা গাড়ি শব্দ করে, জল ছিটিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল। সামান্য ঘাবড়ে গেল নিশান! পিছিয়ে এল দু’পা! তারপরেই বড় এসইউভি গাড়িটাকে চিনতে পারল ও। তারক চক্রবর্তীর গাড়ি।
তারক সামনে, ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিল। কাচটা নামিয়ে বলল, “কী রে, এখানে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কোথায় যাবি?”
নিশান ইতস্তত করল। এটা কি বলা ঠিক হবে? কিন্তু তারপর ভাবল ও তো কোনও ভুল করছে না। বলবে না-ই বা কেন!
বলল, “বিজনদার কাছে যাব!”
“অ! ভীমরতির কাছে! চলে আয়, নামিয়ে দিয়ে যাব। আমার বাড়ির রাস্তাতেই পড়বে।”
নিশান ভাবল এক মুহূর্ত। যাবে? এই লোকটাকে সহ্য করতে পারে না! কিন্তু এখন উপায়ই-বা কী! নিশান এগিয়ে গিয়ে গাড়ির মাঝের দরজা খুলে উঠে পড়ল।
তারক বলল, “শালা, রেনকোটের জল সব ভাসিয়ে নিল। মোতি, কাল আর গাড়ি ধুতে হবে না বুঝলি!”
মোতি বসেছিল সবার পেছনে! এই কথার জবাবে শুধু হাসল।
গাড়ি চলছে আবার। রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। এত বড় গাড়ি, তাও দুলছে নৌকোর মতো! গাড়ির ভেতরে বেশ সুন্দর একটা গন্ধ। খুব লো ভলিউমে গান বাজছে। গাড়িতে তারক, ড্রাইভার আর মোতি ছাড়া শুধু নিশান বসে রয়েছে।
তারক সামনের দিকে তাকিয়েই বলল, “শালা, তুই আমাদের ব্যাবসা গোটাবি মনে হচ্ছে! তোকে বললাম, ওই সব না করতে। গেল তো একটা পার্টি পালিয়ে! আইকা বলে একটা মেয়ে আসত। শালা জ্বলতি জওয়ানি টাইপ! সেও কাটল! তুই গান্ডু আমার অনেক টাকার লোকসান করালি! মেয়েটাকে যে পটাব, সেটাও হতে দিলি না! আমার সঙ্গে তোর কোন জন্মের শত্রুতা আছে বল তো!” কথাটা শেষ করে হা হা করে হাসল তারক।
নিশান চোয়াল শক্ত করে বসে রইল। মনে মনে বলল, প্রতিটা জন্মের!
ও বৃষ্টি-ঘষা জানলা দিয়ে দেখল গাড়ি মল্লিকবাজার পেরোচ্ছে। এর পরে মজদুর ইউনিয়নের গলি, তারপরে ভাঙা রেললাইন। ব্যস, ওই ভাঙা লাইন ধরে ডান দিকে একটু গেলেই গেলেই ওদের পার্টি অফিসের পাশে বিজনদার আস্তানা।
বিজনদাদের বেশ বড় বাড়ি আছে চ্যাটার্জিপাড়ায়। কিন্তু সব ছেড়ে লোকটা কেন যে এইখানে থাকে!
তারক বলল, “শোন নিশান। দাড়ি রাখলেই কেউ বিপ্লবী হয় না! পেছনে অন্য দম লাগে। লেকে বসে মাগিবাজি করবি, আবার গেটে দাঁড়িয়ে বিপ্লব মারাবি! হয় না! শুনলাম দু’দিন পরে আবার তোদের ওই ঢ্যামনামি আছে! এসব করিস না বাবু। ভাল কথায় বলছি। কাজ হতে দে। তুইও কেকের ভাগ পাবি। প্লাস মালিকের মেয়ের সঙ্গে তো লটঘট শুরুই করেছিস! কেন বেকার উঙ্গলি করছিস! চেপে যা!”
নিশান দেখল আর চুপ করে থাকা যায় না! ও বলল, “আমার পারসোনাল লাইফে আমি কী করছি, সেটা আপনাদের দেখার কথা নয়! আর কেউ গোটা সোনাঝুরিকে নিজের সম্পত্তি বলে বিক্রি করে দেবে, সেটা হয় নাকি? খারাপ কাজ হলে প্রতিবাদ হবে!”