নিশান রেনকোটের চেনটা গলা অবধি টেনে বলল, “মা, তুমি বড্ড ভেবে নাও। আমি তাড়াতাড়ি ফিরব। ডোন্ট ওয়ারি।”
“তা হলে বাড়িতে এলি কেন?” মা রাগের বলায় জিজ্ঞেস করল।
নিশান হাসল। বলল, “আরে, কলকাতায় গিয়েছিলাম পত্রিকার আর্টওয়ার্কটা নিয়ে আসতে। সেটা নিয়ে এই বৃষ্টিতে ঘুরব নাকি? তাই তো রাখতে এলাম। আমি চলে আসব ঠিক সময়ে। ডোন্ট ওয়ারি!” নিশান মায়ের গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে হেসে বারান্দায় এল। সাইকেল আর নেবে না। বড়রাস্তা থেকে একটা রিকশা নিয়ে নেবে। কেন বিজনদা ওকে ডাকল কে জানে!
মা বলল, “মাথাটা ভাল করে ঢাকা দে। পরে আবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ করবি!”
রাস্তাটা পিছল বেশ। পাড়ার ভেতরের রাস্তাগুলো কংক্রিট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার মাঝে মাঝে কিছু-কিছু জায়গা ভাঙা। জল জমে আছে। নিশান খুব সাবধানে হাঁটতে লাগল।
দূরের লাইটপোস্টের হলুদ আলো কেমন একটা সেপিয়া রং লেপে দিয়েছে সব কিছুর ওপর। ওদের পাড়াটা একটু পুরনো। বাড়িঘরগুলো কেমন বয়স্ক আর থমথমে। এই শীতের বৃষ্টিতে গোটা তল্লাটটাই কেমন কুঁকড়ে রয়েছে যেন।
নিশান সরু রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে বড়রাস্তায় উঠল। এটা স্টেশন রোড। এই আবহাওয়ার জন্য আজ এই রাস্তাটাও ফাঁকা। ও এদিক-ওদিক তাকাল। কিছু নেই। সাধারণত রিকশা থাকেই। কিন্তু আজ নেই। তবে কি হাঁটবে? অনেকটা পথ! আর এখন বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়াও দিচ্ছে! কাছেই গঙ্গা, তাই জলের ওপর থেকে ভেসে আসা হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা। হাড় অবধি পৌঁছে যাচ্ছে! নিশানের একটু শীত বেশি। তাই ওর কষ্ট হচ্ছে বেশ। ও হাত দুটো ঘষে মুখের কাছে এনে গরম ভাপ দিল। বিজনদা কী বলবে? হঠাৎ এভাবে ডাকল কেন?
পকেটে আচমকা নড়ে উঠল ফোনটা। এখন আবার কে ফোন করল! এই বৃষ্টিতে কথা বলবে কী করে! নিশান একটা শেডের তলায় সরে গিয়ে ফোনটা বের করল। স্ক্রিনে দেখল নামটা। আরে রাধিয়া! নিশান হাসল নিজের মনে। এই ফোনটা আবহাওয়া নিরপেক্ষ।
“হ্যাঁ রাধি!” নিশান কানে লাগাল ফোনটা।
“বাড়ি পৌঁছে গেছ?” রাধিয়ার গলায় সামান্য উদ্বেগ।
“হ্যাঁ, পৌঁছে আবার বেরিয়ে পড়েছি। কেন?”
“কেন মানে?” রাধিয়ার গলায় রাগ টের পেল নিশান, “বলেছি না বাড়ি ঢুকে আমায় একবার মেসেজ করে দেবে!”
তা ঠিক। আজকেও রাধিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিল নিশান। চলে আসার আগে মেয়েটা বলেছিল এই কথাটা!
কলেজ স্ট্রিট থেকে আর্টওয়ার্কটা নিয়ে রবীন্দ্র সরোবর লেকে গিয়েছিল নিশান। রাধিয়া বলেছিল দেখা করতে চায় ও। সেই বড়দিনের পরে আর দেখা হয়নি।
লেকে আজ ভিড় ছিল না। বেশ ফাঁকাই ছিল। পদ্মপুকুরটা পার হয়ে মাথায় ছাউনিওয়ালা একটা সিটে বসেছিল দু’জন! রাধিয়া একদম নিশানের গায়ের সঙ্গে লেগে বসেছিল। নিশানের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে জড়িয়েছিল লতানো গাছের মতো।
রাধিয়ার শরীর থেকে কী অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ যে আসছিল! নিশানের মনে হচ্ছিল সবটাই কেমন যেন অবাস্তব! রাজকুমারী আর রাখালের গল্প! এই মেয়েটা কেন ওকে ভালবাসল? কতদিন ভালবাসতে পারবে? যদি পরে ওকে ছেড়ে চলে যায়, তা হলে নিশান কী করবে?
রাধিয়াকে ও জিজ্ঞেস করেছিল, “বলো, কী বলবে?”
“কিছু না তো!” রাধিয়া সামনে, জলের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল!
“মানে?” নিশান হেসেছিল, “কিছু বলবে না তো ডাকলে কেন?”
“এমনি, ইচ্ছে হল!” রাধিয়া ওর কাঁধে মাথা রেখেছিল, “দেখতে ইচ্ছে করছিল। তোমায় ধরতে ইচ্ছে করছিল।”
“তাই?” নিশান হেসেছিল। আসলে ওর এত ভাল লাগছিল যে, বিশ্বাস হচ্ছিল না রাধিয়ার মতো মেয়ে ওকে ভালবাসে!
“খুব ভাও খাচ্ছ না?” রাধিয়া কুট করে চিমটি কেটেছিল নিশানের হাতে, “মেয়েদের কী মনে হয়!”
“যাঃ” হেসেছিল নিশান, “কিছুই মনে হয় না! কী আবার মনে হবে?”
রাধিয়া সোজা হয়ে বসেছিল, “কিছু মনে হয় না মানে? শভিনিস্ট পিগ নাকি তুমি?”
নিশান সামান্য ঘুরে বসেছিল, “ও এবার বুঝেছি! পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে ডেকেছ! আমি ঝগড়া করতে পারি না!”
“নাঃ, পারে না!” রাধিয়া মুখ বেঁকিয়েছিল সামান্য, “আমাদের কোম্পানির সঙ্গে ঝগড়া করছ না! ওইসব আন্দোলন অ্যান্ড অল।”
“আচ্ছা আচ্ছা!” হাত তুলে দিয়েছিল নিশান।
রাধিয়া বলেছিল, “আমিও পারি! আমার এখন সাহস বেড়ে গিয়েছে। কাউকেই ছাড়ি না উচিত কথা বলতে!”
নিশান চুপ করে ছিল। আসলে ও জানে রাধিয়ার বাড়িতে কী হয়েছে। ঘটনার দিন রাতে রাধিয়াই ওকে ফোন করে জানিয়েছিল সব কিছু। নিশানের মনে এই নিয়ে একটা খারাপ লাগা আছে। আসলে ও বলতে চায়নি ব্যাপারটা। কিন্তু বাধ্য হয়েছিল বলতে। সেদিন রাধিয়া এমন করে ওকে চেপে ধরেছিল যে, ও বাধ্য হয়েছিল। আর শুধু তাই নয়। ওর মনে হয়েছিল, একটা লোক বাড়িতে তার স্ত্রী ও মেয়েকে কিছুতেই ঠকাতে পারে না। তার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন যা খুশি হতেই পারে। ওটা মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ ও অপছন্দ, কিন্তু সে কখনওই নিজের স্ত্রী বা মেয়েকে ধোঁকা দিতে পারে না। আসলে একটা জিনিস আজকাল খুব দেখতে পায় নিশান। মানুষের মধ্যে লয়ালটি আর ডিভোশন কমে যাচ্ছে। এই সব সোশ্যাল সাইটের জন্যই হোক বা কমিউনিকেশনের বাড়বাড়ন্তর জন্যই হোক, মানুষকে সে অপশন ভেবে ফেলছে! লোকের একটা রিলেশনে টিকছে না বেশিদিন! সারাক্ষণ তাদের ‘কী নেই কী নেই’-টা যেন বেড়ে গেছে। প্রেম ব্যাপারটা চলে গিয়ে কেমন যেন ইগো মাসাজ, লোকের মনোযোগ পাওয়া, এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সবাই যেন নায়ক হবে, নায়িকা হবে! সবাইকে ঘিরে গ্রহ-তারা ঘুরতে হবে! উল্কাপাত হতে হবে! নিজের ইচ্ছেটাই যেন বড়! অন্যের যে খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে, সে ব্যাপারে কারও কোনও হুঁশ নেই!