নোঈ আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বলল, “এবার চলুন!”
ট্যাক্সিওয়ালা বৃদ্ধ মানুষ। নোঈর হাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হেসে বলল, “মা, আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আমার বয়স এখন প্রায় ষাট। এই পঞ্চাশ টাকাটা না হলেও আমার চলবে। যা ভাড়া তাই দিয়ো। কেমন?”
নোঈ বলল, “সরি কাকু। আমি সেটা মিন করিনি। আমি খুব তাড়ায় আছি। খুব।”
লোকটা হেসে গাড়ি স্টার্ট করল।
ডোরবেলটা বাজিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিল না নোঈ। বহু বছরের অপমানের জবাব আজ দিতে পেরেছে। বাবা বলে, যেমন গাছ লাগাবে, তেমন ফল পাবে। আজ জয় বুঝতে পারছে এর মানে। পুশকিনকে না দেখলে ও বুঝতে পারত না, আসলে মানুষ কেমন হয়। সত্যিকারের ভালমানুষ কেমন হয়।
দরজটা খুলে পুশকিন অবাক হয়ে তাকাল নোঈর দিকে। নোঈ আর অপেক্ষা না করে হাতের ছাতাটা মাটিতে ফেলে দিয়ে প্রায় লাফিয়ে জড়িয়ে ধরল পুশকিনকে।
“আরে!” পুশকিন থমকে গেল।
নোঈ পুশকিনকে কথা বলতে দিল না একটুও। নিজের ঠোঁট চেপে ধরল ঠোঁটে! হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল ওর পিঠ!
শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রায় মিনিটখানেক পর নোঈ ছাড়ল পুশকিনকে!
পুশকিন মাটি থেকে ছাতাটা তুলল। এদিক-ওদিক একবার দেখল। তারপর বন্ধ করে দিল দরজাটা। ছাতাটা হেলিয়ে রাখল এক পাশে।
নোঈ উজ্জ্বলভাবে হেসে পুশকিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আজ জয়কে যা দিয়েছি না!”
“নোঈ!” পুশকিন হাত তুলে পিছিয়ে এল।
নোঈ থমকে গেল। পুশকিনের মুখচোখ এমন কেন? কী হয়েছে? বাইরের সমস্ত মেঘ যেন এসে জমেছে পুশকিনের ভেতরে!
“কী হয়েছে? আপনি এমন করে সরে যাচ্ছেন কেন? আপনি আমায় পছন্দ করেন না? ভালবাসেন না?” নোঈ তাকাল পুশকিনের দিকে! আচমকা চোখ জ্বালা করছে ওর! পুশকিন এমন করছে কেন?
পুশকিন তাকাল নোঈর দিকে। তারপর বলল, “তোমায় একটা খবর বলার ছিল।”
“কী?” প্রশ্ন করতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল নোঈর।
পুশকিন সময় নিল। তারপর বলল, “আমায় বুদাপেস্ট চলে যেতে হচ্ছে। জানুয়ারির ছ’তারিখ।”
“কী?” নোঈ কী বলবে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল।
পুশকিন বলল, “প্রজেক্টটা থ্রু হয়ে গিয়েছে! তাই…”
পুশকিন বলে চলল আরও কথা। কিন্তু কিছুই যেন ঢুকছে না কানে! সব পার করে পুশকিনের দিকে তাকিয়েই রইল নোঈ। মেঘ আরও ঘনিয়ে এল কলকাতায়! বৃষ্টির জোরও বাড়ল কি? নোঈ জানতে পারল না কিছু। শুধু ধীরে-ধীরে আবছা হয়ে গেল এই ঘর, এই দুপুর, আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুশকিন! মনে হল সব কিছু কেমন যেন নষ্ট হয়ে গেল! শেষ হয়ে গেল! আর কিছুই যেন অবশিষ্ট রইল না নোঈর জীবনে!
ভালবেসেছে ও পুশকিনকে। নিজের ভেবেছে। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়েছে। স্পর্শের মধ্য দিয়েই কি তবে পুশকিনের ভেতরের মেঘ এসে বৃষ্টি হয়ে নামল নোঈর চোখে? ভালবাসলে কি এভাবেই পরস্পরের রোদ আর ছায়াগুলো জড়িয়ে যায়? মাটি আর শিকড় জড়িয়ে যায়? এভাবেই কি মেঘ আর বৃষ্টি বদল হয়ে যায় পরস্পর? নোঈ জানে না। শুধু জানে আজ ঘোর বৃষ্টির দিন! নোঈর এক জীবন থেকে অন্য জীবন শুরু হওয়ার দিন!
নোঈ চশমা খুলে চোখ মুছল এবার। তারপর তাকাল সোজা। এগিয়ে গিয়ে বলল, “বারবার তুমি পালিয়ে যেতে, সরে যেতে পারো না। ভালবাসলে তার দায়িত্বও নিতে হবে তোমায়। জানবে, মেয়েদেরও ইচ্ছে আর চাওয়ার দাম আছে পুশকিনদা। অধিকার আছে। আমি সেটাই চাইছি। আজ তুমি তোমার নিজেকে আমায় দাও। তোমার সবটা আমায় দাও।”
ঘষা কাচে বৃষ্টি এসে টোকা মারছে। বাইরে গাছেরা মাথা নাড়ছে হাওয়ায়। মেঘ নেমে আসছে শহরের দিকে। নোঈ এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে পড়ল পুশকিনের সঙ্গে। আর এই আবছা মনেও বুঝল, আজ আবার সেই আফটার শেভটা মেখেছে পুশকিন!
.
৩৯. নিশান
আলো-আলো অন্ধকার। অন্ধকার-অন্ধকার আলো। ঝাপসা চৌকো আলো। সরে-সরে যাচ্ছে… মাথার ওপর দিয়ে সরে যাচ্ছে মেঘলা একটা করিডরের ছাদ। ঠান্ডা! আর কী গরম! অন্ধকার অন্ধকার যন্ত্রণা! অবশ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি! কোথায় যাচ্ছে নিশান? কোথায় এখন ও? চোখ বুজে আসছে। মাথা ফাঁকা! শুধু দূর আকাশে যেন চিল উড়ছে একটা। আকাশ-আকাশ আলো। কারা ঝুঁকে পড়ছে সেই আকাশ থেকে? কাদের মুখ এগুলো? ফোঁটা ফোঁটা মুখ। চেনা লাগছে। তাও মনে পড়ছে না। চোখ বুজে আসছে নিশানের। ক্লান্ত লাগছে। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে যেন। ডাকছে, সিঁড়িগুলো ডাকছে নিশানকে। ওকে যেতে হবে। দূরে যেতে হবে। একা। নিশান সিঁড়িতে পা রাখল এবার। আর, কে যেন ডাকল পেছনে! মুখ তুলে দেখল নিশান। মা! মা এসে দাঁড়িয়েছে! অন্ধকারে ছোট্ট আলোর মতো মা! কী বলছ তুমি, মা?
“নিশান আজ তোকে বেরোতেই হবে? এই ঠান্ডায়, এমন বৃষ্টিতে… বেরোতেই হবে?”
নিশান সোয়েটারটা পরে নিল। তারপর আলনার পাশে ঝোলানো রেনকোটটা তুলে নিয়ে গায়ে চাপাল। বলল, “মা, বিজনদা ডেকেছে। সেই সকালে যেতে বলেছিল। কিন্তু যেতে পারিনি। আর, ক’টা বাজে এখন? সবে রাত ন’টা। কিছুই রাত হয়নি।”
মা মুখ ভার করে বলল, “আমার কথা একদিন শুনলে কী হয়! আজ তোর বাবার জন্মদিন। আমি বিরিয়ানি বানিয়েছি। তোর বেরোনো মানে তো মাঝরাতের আগে ঢুকবি না! ততক্ষণে তো ঠান্ডা হয়ে যাবে সব!”