বিজন স্মরণকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, “তোমরা যোগাযোগ করো। আমি যাব। কথা বলব। পেখমদিরও তো একটা অধিকার আছে।”
নোঈ বসার পরে জয় হাসল শব্দ করে। নোঈ একঝলকে দেখে নিল চারপাশ। চেয়ার-টেবিল ছাড়াও কাচের জানলা দিয়ে বাইরের মেঘলা বৃষ্টির শহরটা দেখা যাচ্ছে।
জয় নিজের হাসির রেশ ধরে বলল, “মা বলছিল, তুমি আসবে না। আমি বললাম আসবেই। নোঈ আমার কথা ফেলতে পারে না। ঠিক কি না?”
নোঈ হাসল।
জয় আবার বলল, “ফর্মালি কি আলাপ করাব?”
নোঈ মাথা নাড়ল, “কাকিমা, আমি নোঈ। জয় বলেছিল বলে আজ এলাম। আপনি নাকি দেখা করতে চেয়েছিলেন!”
কাকিমা গম্ভীর মুখে তাকালেন। তারপর কোনওরকম ভূমিকা না করে সরাসরি বললেন, “তুমি জয়কে পছন্দ করো? খুব ফলো করতে শুনলাম। কান্নাকাটি করতে নাকি! জয় বলছিল, নোঈ ওকে খুব ভালবাসে। তাই?”
নোঈ চোয়াল শক্ত করে জয়ের দিকে তাকাল। এসব বলেছে জয়! ওর সম্বন্ধে এসব কথা বাড়িতে বলেছে!
জয় সামান্য অপ্রস্তুত হলেও দ্রুত সেটাকে সামলে নিল। বলল, “মা ওসব ছাড়ো। পুরনো কথা আর ভেবে কী হবে! লেটস অর্ডার সাম ফুড!”
কাকিমা হাত তুলে চুপ করতে বললেন জয়কে। তারপর নোঈর দিকে তাকিয়ে বললেন, “জানো বোধহয় তোমার পরেও জয়ের একটা রিলেশন ছিল। একজন ডিভোর্সি মহিলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। তার মেয়েও আছে। মহিলা তো খুব চেপে ধরেছিল ওকে বিয়ে করবে বলে। আমরা ব্যাপারটাকে সামলাই। আর ঠিক করি ওর বিয়ে দিয়ে দেব। তখন জয় বলল, তোমার কথা!”
“হ্যাঁ, স্বাভাবিক তো,” জয় হাসল, “তাকেই বিয়ে করা উচিত যে তোমায় ভালবাসে! তুমি তাকে ভালবাসো কি না, সেটা ইমপর্ট্যান্ট নয়। তাই না!”
কাকিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমায় দেখতে তো ঠিকঠাক। এখন তোমার বাড়ির লোকেরা কেমন সেটাও দেখতে হবে। বিয়ে তো আর প্রেম নয় যে, লেকে বসে গুজুরগুজুর করে এলাম দু’ঘণ্টা!”
“মা,” জয় কাকিমাকে থামাল, “আরে, নোঈ তো আছে। তুমি এসব কথা পরে বোলো! এখন কিছু অর্ডার করি।”
“প্লিজ়,” নোঈ হাত তুলে থামাল জয়কে। এবার আর নিতে পারছে না। সেই নন্দনের বিকেলটা থেকে নিজে সামলে রেখেছিল, আর জাস্ট পারছে না। ও বলল, “আমি কিন্তু এখানে খেতে আসিনি। আমি এসেছি তোমার মায়ের সামনে তোমাকে কিছু কথা বলতে!”
“মানে?” অবাক হয়ে জয় তাকাল ওর দিকে।
নোঈ বলল, “মানে, আমি তোমায় বিয়ে করব এটা ভাবলে কী করে? আমি ভালবাসতাম তোমায় একসময়। কিন্তু তুমি এমন ব্যবহার করেছ যে, আমার মধ্যে আর ভালবাসার কিছু অবশিষ্ট নেই!”
“কী বলছ?” জয় তাকাল ওর দিকে।
“মানেটা তো সহজ। আমি এটাই বলতে এসেছিলাম। আর তো কোনও কারণে আসিনি। লাঞ্চ আমি এখানে করব না।”
জয় থতমত খেয়ে গেল একদম, “কী বলছ কী? আরে, মাকে আনলাম, মা বলল…”
নোঈ বলল, “নিজেকে অত বড় কিছু ভাবার কী আছে! আমি তোমার জন্য মরতাম! তোমার জন্য আমি মরিনি। দিব্যি আছি। কাকিমা সরি। কিন্তু ও আমাকে যে কী অপমান করেছে সেটা আপনি জানেন না! যখন ইচ্ছে দূরে ঠেলবে যখন ইচ্ছে কাছে টানবে, আমি কি পুতুল কাকিমা? সেটা তো ঠিক নয়। সেটাই বলতে এলাম আজকে। জয়ের মানসিক সমস্যা আছে কি না আমি জানি না। কিন্তু আচমকা ওর এমন কেন যে মনে হল, ওই জানে! আমার কিন্তু এসব মনে হচ্ছে না। আমি আসি। জয়, হ্যাভ আ নাইস লাইফ।”
রেস্তরাঁর বাইরে বেরিয়ে নোঈ হাঁপ ছাড়ল। সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে! নিজেকে এতক্ষণ কী করে যে ও সংযত রেখেছিল ও-ই জানে! সকাল থেকে এই সময়টা নিয়ে ও টেনশনে ছিল। মাকেও কিছু বলেনি। কাউকেই কিছু বলেনি। ওর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল যে, একবার যদি সু্যোগমতো পেত, তা হলে জয়কে ঠিক মজা দেখিয়ে ছাড়ত। ও ভাবতেই পারেনি এমনটা হতে পারে। এভাবে সুযোগটা আসতে পারে ওর সামনে। জয় বারবার ওকে দূরে ছুড়ে ফেলেছে! একবার করলে মানা যায়, মানুষ ভুল করল। কিন্তু বারবার যদি কেউ করে, তা হলে তো সেটা সে জেনেবুঝে করছে বলেই ধরতে হবে! আর জেনেবুঝে কেউ ওর সঙ্গে এমন করে যাবে, আর নোঈ তাকে ছেড়ে দেবে! আগে জয়ের দেওয়া দশ টাকাটা চিকলেট কিনে খরচ করেছিল, আর আজ গোটা জয়কেই জীবন থেকে খরচ করে ফেলে দিল।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এখনও। টিপটিপ করে পড়েই চলেছে। কিন্তু ছাতা খুলতে একটুও ইচ্ছে করছে না। বরং আজ ভিজতে ইচ্ছে করছে। মন খুলে সেই ছোটবেলার মতো করে ভিজতে ইচ্ছে করছে। আর ইচ্ছে করছে পুশকিনকে দেখতে। সেই সকাল থেকে মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটা এখন যেন আরও ফুটে বেরোচ্ছে। যেন আর কিছুতেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছে না নোঈ। এখান থেকে সামান্য কিছু দূরত্বে নিজের ফ্ল্যাটে এখন বসে আছে পুশকিন। আর কী এক অদৃশ্য টান সেখানে নিয়ে যেতে চাইছে নোঈকে!
বহুদিনের চাপা রাগ আর অপমান আজ সরে গেল ওর বুক থেকে। মায়ের সামনে নিজের স্বরূপ প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার পর জয় যেভাবে তাকিয়েছিল ওর দিকে, সেটা মনে পড়তেই আনন্দটা বেশি হচ্ছে। জয়ের ভেতরের ফাঁপা মানুষটা আজ বেরিয়ে এসেছে!
নোঈ হাত বাড়িয়ে একটা হলুদ ট্যাক্সিকে দাঁড় করাল। গাড়িটা দাঁড়াতেই দরজা খুলে উঠে পড়ল ও। বলল, “রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের কাছে।”
“আরে, এটুকু কেউ যায় নাকি?” বয়স্ক লোকটা অবাক হয়ে তাকাল নোঈর দিকে।