ওদের ছোট্ট বাড়িটায় পেখমদের সঙ্গে ওর ছোটকাকুরাও থাকে। ছোটকাকু মানে তপন মুখার্জি। সবাই কাকুকে রেফারি হিসেবে চেনে। কলকাতার মাঠে ফুটবল খেলায় রেফারি হয় ছোটকাকু, মানে ছোটকা। তবে সেটা করলে তো আর সংসার চলে না। কাছের সোনাঝুরি জুটমিলের ফোরম্যান হিসেবে চাকরি করে ছোটকা।
ছোটকাকিমা জামসেদপুরের মেয়ে। একটু চুপচাপ ধরনের। আর ওদের একমাত্র ছেলে, প্লাবন। প্লাবনকে টেটু বলে ডাকে সবাই। টেটু এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। লেখাপড়ায় ভাল ছেলেটা। আর পেখমের খুব ন্যাওটা।
পেখম নিজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। বি এ। মায়ের ইচ্ছে ছিল না পেখম পড়ুক। কিন্তু পেখম জেদ ধরেছিল। আর তাতে ঠাকুরদাও সায় দিয়েছিলেন।
ঠাকুরদা বলেছিলেন, “জীবনে লেখাপড়াই আসল। তুই যতদিন পারবি পড়বি।”
মা যতই রাগী হোক, ঠাকুরদার মুখের উপর কথা বলে না। কেউই বলে না। ঠাকুরমা মারা গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু তাতে সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেও অল্প দিনেই নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন ঠাকুরদা।
পেখম অবাক হয়েছিল, “তুমি তো খুব শক্ত মনের!”
ঠাকুরদা বলেছিলেন, “মৃত্যু তো কম দেখলাম না! দেশভাগের সময় কত জনকে মারা যেতে দেখলাম চোখের সামনে। তবে হ্যাঁ, রাণু আমার সবটা ছিল। ও ছিল বলেই এমন বয়সে দেশ, মাটি ছেড়ে এমন বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে বাস করতে পারলাম। এত মনের জোর আর তো কারও দেখলাম না! তাই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে? এক শহরের সামনে দিয়ে নদী কি অন্য শহরের দিকে বয়ে যায় না?”
পেখমের খুব ভাল লাগে ঠাকুরদার সঙ্গে গল্প করতে। রাত ন’টায় ঠাকুরদার দোকান বন্ধ হয়। ইন্দবাবু বলে একজন কারিগর আছেন ঠাকুরদার দোকানে। ন’টার সময় ইন্দবাবুই দোকান বন্ধ করেন। তারপর ঠাকুরদাকে চাবি দিয়ে চলে যান।
ঠাকুরদার দোকানটাও কাছে। হেঁটে দশ মিনিটের মতো লাগে। সোয়া ন’টার মধ্যে ঠাকুরদা বাড়ি চলে আসেন। তখন পেখম কিছুক্ষণ এসে বসে ঠাকুরদার কাছে। গল্প করে। ঠাকুরদাও সারা দিনের রোজগার থেকে বাঁচিয়ে এক টাকা করে দেন পেখমকে।
একটা ঘট আছে পেখমের। তামাটে রঙের। মাটির। গতবছর পুজোয় কিনে দিয়েছিল ঠাকুরদা। সেটাতেই ওই বড় কয়েনটা ফেলে দেয়। টাকা জমায় পেখম। কেন জমায় জানে না। কিন্তু ভাল লাগে। আসলে ওর তো তেমন খরচ কিছু নেই। কলেজের মাইনে, ট্রেনের মান্থলি সবটাই বাবা কেটে দেয়। মা বাড়ি থেকে টিফিন করে দেয়। তবে পথে কিছু সমস্যা হলে যাতে অসুবিধে না হয় তাই পাঁচ টাকা করে দেওয়া হয় পেখমকে।
তবে অসুবিধে আর কী হবে? ট্রেনে করে বালিগঞ্জ যেতে চল্লিশ মিনিটের মতো লাগে। সোনাঝুরি স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে ওরা। চার বোগির ট্রেন। স্টিম ইঞ্জিনে টানে। খুব বেশি ভিড় হয় না। ওর সঙ্গে নয়না বলে আর-একটা মেয়েও যায়। কয়েকটা ছেলেও যায় ট্রেনে। কিন্তু ওদের সঙ্গে কথা বলে না। নয়না বলে মনোজ কুমারের মতো দেখতে একটা ছেলে নাকি তাকায় খুব ওর দিকে। কিন্তু পেখম পাত্তা দেয় না। আসলে কাজু ছাড়া পৃথিবীতে আর কাউকেই তাকানোর মতো ছেলে বলে মনে হয় না ওর।
কাজুর পুরো নাম বেঞ্জামিন কূজন সরকার। ক্যাথলিক ক্রিশ্চান ওরা। গঙ্গার কাছে সাহেবপাড়ায় থাকে। তবে সাহেবপাড়া মানে বিরাট কোনও ব্যাপার নয়। আগে, যখন ভারত স্বাধীন হয়নি, তখন সোনাঝুরি জুটমিলে বেশ কয়েকজন সাহেব কাজ করত। তারা এখানে থাকত। সেই থেকে জায়গাটার নাম সাহেবপাড়া।
এখন অবশ্য সাহেবরা নেই। তাদের ফেলে যাওয়া অনেকটা জায়গা আর জঙ্গল নিয়ে চারটে বিশাল বড় বড় বাসি দুধ-চা রঙের বাড়ি পড়ে আছে। লোকে বলে জোনাক-বাড়ি! তবে বাড়িগুলো ময়লা, রং না-করা, ইটের পাঁজর বের করা। সেখানে গাদাগাদি করে বেশ কিছু পরিবার থাকে। কাজুও সেখানেই থাকে। দুটো ঘরের সংসার কাজুদের। বাবা, মা, এক ছোট ভাই, এক বোন, মায়ের এক আন্টি আর ঠাকুরমা। পেখম একবার গিয়েছিল কাজুর সঙ্গে ওদের বাড়ি। তবে লুকিয়ে। বাড়িতে জানে না। জানলে মা আর আস্ত রাখবে না।
ক্লাস নাইনে কাজু পড়াতে এসেছিল ওকে। এই সোনাঝুরিতে কাজুর খুব নাম। লেখাপড়ায় খুব ভাল। স্কুল ফাইনালে ফিফ্থ হয়েছিল। খবরের কাগজেও নাম বেরিয়েছিল। সেই থেকে সবাই সমীহ করে চলে কাজুকে।
কাজুর এক বন্ধু আছে, সতু। ভাল ফুটবল খেলে। তার সূত্রেই কাজুর আলাপ হয়েছিল ছোটকার সঙ্গে। বাবা তখন পেখমকে বাড়িতে পড়াবে এমন কাউকে খুঁজছিল। ছোটকার কথায় কাজু রাজি হয়েছিল পেখমকে পড়াতে।
যেদিন প্রথম কাজু এসেছিল পেখমদের বাড়ি, সেই দিনটা ওর আজও মনে আছে!
জানুয়ারি মাস ছিল সেটা। সকালের আলোর ভিতর কেমন যেন একটা পাতলা দুধের সরের মতো কুয়াশা পড়েছিল। পেখমদের ছোট্ট বাড়িটার পাশের পুকুরের জলে তখনও ভাল করে সূর্য এসে দাঁড়ায়নি। পেখম একটা লাল চাদর গায়ে দিয়ে দু’হাতে গরম দুধের গেলাস ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল।
কাজু এসেছিল একটা লাল হলুদ ডোরাকাটা মাফলার আর নীল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার পরে।
ওদের বাড়িতে ঢুকেই একদম পেখমের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল কাজু। আর কেন কে জানে, থমকে দাঁড়িয়েছিল। পেখমও গেলাস হাতে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। অমন হালকা দাড়ি। টানা চোখ। অমন শীতের রোদ্দুরের মতো দৃষ্টি! পেখমের বুকের ভেতরে যে কী হয়ে গিয়েছিল, সেও নিজেও বুঝতে পারেনি। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিল, আজ থেকে ওর জীবনটা আর শুধু ওর রইল না।