পুশিদি! মানে আইকাদির মা,ওই ম্যান্ডেভিলার রেস্তরাঁর কথা বলেছিল মাকে। আর ও কিনা সেই নিয়ে আইকাকে আজেবাজে কথা বলেছে! লজ্জা আর খারাপ লাগায় নোঈ চুপসে গিয়েছিল একদম। শুধু মনে হচ্ছিল এবার কী করবে ও? কীভাবে আইকাকে বলবে?
নোঈ মায়ের কথা শেষ করার হওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করেনি। সোজা মেসেজ করেছিল আইকাকে। ওর নিজের ‘সরি’ বলার সময়ও যে এসেছে বুঝতে পারছিল।
লেক মার্কেটে গাড়ি দাঁড় করায়নি নোঈ। সোজা নজরুল মঞ্চের উলটোদিকের বড় রেস্তরাঁর সামনে গিয়ে গাড়ি থেকে নামল। এটার কথাই জানিয়েছিল জয়। ও চোয়াল শক্ত করে ঠিক করেছিল নিজেকে। জয় দিনের পর দিন ওকে কষ্ট দিয়েছে। এখন সেই জয় কী বলে ও দেখবে।
রেস্তরাঁটা যে বড়, বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চওড়া ফুটপাথের সামনে একটা বেঞ্চ রাখা। আর ঢোকার দরজার পাশে ডেস্ক নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে।
নোঈ সামনে যাওয়ামাত্র লোকটা এগিয়ে এসে দরজা খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করল। নোঈ ভেতরে ঢুকল। ঝলমল করছে চারিদিক। ঢুকেই বাঁ দিকে রিসেপশন। সেখান থেকে ওকে সবাই স্বাগত জানাতে শুরু করেছে। এতজন একসঙ্গে স্বাগত জানাচ্ছে! নোঈর মজা লাগল। খুব ঝকঝকে করে সাজানো জায়গাটা। সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সিলিং-এ হলুদ আলো। দেওয়ালে বিটন উড প্যানেল। কোণে কোণে গাছ রাখা। সিঁড়ির প্রথম ল্যান্ডিং-এর পাশে একটা বসার জায়গা। নোঈ ওর সামনে দাঁড়ানো একজন হস্টেসকে বলল, “আই হ্যাভ বিন ইনভাইটেড। আ ইয়ং ম্যান উইথ…”
নোঈকে সবটা বলতেও হল না। একটি মেয়ে “দিস ওয়ে ম্যাম,” বলে ওকে ওপরের দিকে নিয়ে গেল।
ওপরে বসার জায়গাটা আরও বড়। দু’পাশে মাখন রঙের সোফা। গ্লাস টপ টেবিল।
“হিয়ার!” দূর থেকে জয় হাত তুলে ডাকল নোঈকে।
আর ঠিক তখনই আবার পুশকিনের কথা মনে পড়ল ওর। কেন মনে পড়ল? এই রাস্তার ওপরেই সামান্য দূরে পুশকিনের ফ্ল্যাট। তাই কি মনে পড়ল? এখানে যে আসবে সেটা পুশকিনকে জানায়নি ও। কেন জানায়নি? জয়ের কথা পুশকিন জানে, কিন্তু আজ যে জয়ের সঙ্গে ও দেখা করছে, এখানে আসছে, এসব জানে না।
আজও সকালে পুশকিনকে ফোন করেছিল নোঈ। জেনেছে আজ আর বাবার কাছে যাবে না পুশকিন। নিজের ফ্ল্যাটেই থাকবে। অফিসের অন্য একটা প্রজেক্টের কাজ আছে। তারই ইভ্যালুয়েশন করতে হবে।
নোঈ কথা বাড়ায়নি আর। কারণ, কেন যেন মনে হচ্ছিল, আর-একটু কথা বললেই আজকের এই ব্যাপারটা ও বলে ফেলবে!
পুশকিনের ওপর যে খুব চাপ যাচ্ছে সেটা ও জানে। বস খুব ভরসা করেন পুশকিনকে। সোনাঝুরির কাজটাও যেন একটা সুতোয় ঝুলছে। বিজনবাবু রাজি হয়েছেন দীপমালাদেবীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে। কিন্তু দীপমালাদেবী এখনও সময় দেননি। অফিস থেকে ওরা জেনেছে, ওঁর ছেলে সুপ্রতীকের নাকি শরীর ভাল নেই। দীপমালাদেবী সেই নিয়ে ব্যস্ত।
পুশকিনের ব্যাপারটা বোঝে না নোঈ। এই চাপেও কেমন যেন ছাড়া-ছাড়া থাকে। সারাক্ষণ, দেখলে মনে হয়, লোকটা যেন এই পৃথিবীতে ছুটি কাটাতে এসেছে। কোথাও যাওয়ার নেই। কোনও তাড়া নেই। সারাক্ষণ ইজ়ি।
সেদিন বিজনবাবু পুশকিনকে দেখে কী যে খুশি হয়েছিলেন! কত গল্প করেছিলেন পুশকিনের বাবার আর ওঁর নিজের ছেলেবেলার। সেই পুরনো সোনাঝুরি। পুরনো জোনাক-বাড়ি। সতুদা। বিমলদা। অজানা কত নাম। কত স্মৃতি।
সব শুনে পুশকিন বলেছিল, “কাকু, আমি এসেছি আপনার হেল্প নিতে। বাবা বলেছে আমাদের সমস্যার সমাধান একমাত্র আপনি করতে পারবেন।”
বিজন বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, “আমি? মানে?”
“মানে, দীপমালাদেবীর সঙ্গে আপনাকে একবার কথা বলতে হবে।”
“পেখমদি!” বিজন যেন চমকে উঠেছিলেন, “ওরে বাবা, আমি! পেখমদির তো মনে হয় আমাকে মনেও নেই! চিনতেও পারবে না!”
“প্লিজ় কাকু। আপনাকে একবার কথা বলতেই হবে। বাবা বলল, পারলে আপনি ওঁকে জোনাক-বাড়ি বিক্রি করতে বলতে পারবেন।”
বিজন মাথা নিচু করে নিয়েছিলেন। নোঈর মনে হয়েছিল, লোকটা হঠাৎ যেন এখান থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! যেন এখানে নেই!
“কাকু, প্লিজ়…”
পুশকিন সবিস্তারে বলেছিল ওদের প্ল্যানের কথা। কী-কী ওরা করতে চায়, ওদের লক্ষ্য কী, ওদের লাভের পাশাপাশি সোনাঝুরিরও কী লাভ হবে, সব বলেছিল বিজনকে। এমনকী এটাও বলেছিল যে, একটা প্রফেশন্যাল ব্যাপার নিয়ে দীপমালাদেবী ছেলেমানুষের মতো করছেন। কী প্রশ্ন, কী উত্তর এসব বলছেন।
পুশকিন বলেছিল, “বাবা বলল, আপনি দীপমালাদেবীকে চিনতেন। আপনাকে নাকি খুব স্নেহও করতেন। তাই আপনি একটু যদি বলেন। প্লিজ়!”
বিজন মাথা নিচু করে বসেছিলেন বেশ কিছুটা সময়। তারপর তাকিয়েছিলেন পুশকিনের দিকে। বলেছিলেন, “ঠিক আছে! কিন্তু কী জানো, সেই সময়টা অন্যরকম ছিল। মানুষগুলো, তাদের মূল্যবোধ সব অন্যরকম ছিল। এখনকার দৃষ্টিতে তাদের দেখলে হবে না। তোমাদের মতে যা প্রফেশনাল, তাই হয়তো অন্যের কাছে পারসোনাল,” সামান্য থেমেছিলেন বিজন। তারপর কিছুটা যেন স্বগতোক্তির মতো করে বলেছিলেন, “তা ছাড়া আমিও ক্লান্ত। শরীর ভাল নেই। ক’দিন আর থাকব কে জানে! তাই আমিও বলে দিতে চাই কিছু। আমি আর বইতে পারছি না।”
“মানে?” পুশকিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
স্মরণ বলেছিল, “কী বইতে পারছেন না জেঠু? কার কথা বলছেন আপনি? সেই…”