শ্বেতা থমকে গেছিল, “না, মানে তা ঠিক নয়। কিন্তু হি ইজ হেল্পিং মি আউট! আমিও কিছু করতে চাই। প্লাস তুই ওকে ভালবাসিস। আমি জানি সেটা। তাই প্লিজ়।”
নোঈ বলেছিল, “প্রেমের চেয়ে সম্মান বড়, কথাটা তুই একটু আগে বললি না?”
শ্বেতা বলেছিল, “প্লিজ় জানু। প্লিজ়। আমার জন্য। আমার জীবনটা তো শেষ। আমি যে সময় নিয়ে কিছু কাজ খুঁজব তার উপায় নেই। আমি… আমি প্রেগন্যান্ট!”
“ফাক!” নোঈ নিজের অজান্তেই বলে ফেলেছিল, “আর ইউ নাটস? কী করেছিস?”
“আমার চাকরিটা খুব দরকার। আমি জেদ করে বিয়ে করেছিলাম ববিকে। বাড়িতেও তাই কিছু বলতে পারছি না। জয় আমার ইমিডিয়েট হোপ! প্লিজ়।”
আবার সেই জয়! আবার সেই টেনশন! টানাপোড়েন! কান্নাকাটি! মনখারাপ! নোঈ শ্বেতাকে দেখছিল।
শ্বেতা আশা নিয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে। মানুষ কী অদ্ভুত! এই শ্বেতা সেদিন ওকে খারাপ কথা বলছিল আর আজ যেই নিজের দরকার পড়েছে সঙ্গে-সঙ্গে এসে প্রায় পায়ে ধরছে! এরা কি বন্ধু! বন্ধু বলে কি আদৌ কিছু হয়?
নোঈ বলেছিল, “ঠিক আছে। যাব।”
শ্বেতা আবার জড়িয়ে ধরেছিল ওকে, “মাই বেস্টেস্ট জানু!”
হাজরা মোড় বেশ ফাঁকা আজ। বৃষ্টির বিকেলে সবাই কেমন একটা নেতিয়ে গেছে। কেমন একটা আড়মোড়া ভাঙা ভাব সবার মধ্যে। নোঈ ঘাড় ঘুরিয়ে সেই দোকানটা দেখার চেষ্টা করল। পান, কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকান। এখানেই জয় ওকে দশ টাকার নোটটা দিয়েছিল না! অন্য সময় এটা দেখলে বুকের ভেতরে কেমন একটা মোচড় মেরে উঠত। কিন্তু আজ যেন কিছুই হল না। নোঈ ইচ্ছে করে দেখছিল দোকানটাকে। যদি কিছু মনে হয়! কিন্তু না। আর-পাঁচটা দোকানের মতোই লাগল! বৃষ্টি ভেজা, নীল প্লাস্টিক টাঙানো, কোল্ড ড্রিঙ্কের ফ্রিজ দাঁড় করানো যে-কোনও একটা দোকান যেন!
নোঈর মনে পড়ল, সেদিন জয়কে নন্দন চত্বরে দেখেও ঠিক এমনটাই মনে হয়েছিল। ঠান্ডা, নিঃসাড় আর সাধারণ।
জয় এসেছিল ঠিক সময়ে। দেরি করেনি। এমনিতেই উৎসবের দিন ছিল সেটা। চারিদিকে লোকের ভিড়ও ছিল খুব। তার মধ্যে ওদের দেখা করার জায়গা, সেই বড় গাছটার নীচে দাঁড়িয়েছিল নোঈ। জয়কে দেখতে পেয়েছিল দূর থেকে।
আর-একজনকেও দেখেছিল। নিশান। নীল পাঞ্জাবির ওপরে হাতকাটা সাদা কোট পরেছিল নিশান। এমন সাজগোজ করতে সেভাবে নিশানকে দেখেনি ও। নিশান কাছে আসেনি। দূর থেকে হাত দেখিয়ে হেসে এগিয়ে গিয়েছিল অন্যদিকে। নোঈ কিছু বলেনি। ওর বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না।
“হাই!” জয় এসে হাসিমুখে তাকিয়েছিল নোঈর দিকে। জয়কে স্মার্ট লাগছিল। যত্ন করে রাখা দাড়িতে সাজানো মুখে একটা চকচকে ভাব ছিল, “শুড উই সিট সামহোয়্যার? কাছেই ওই ময়দানের দিকে যেতে একটা ওল্ড ক্যালকাটা টাইপ চাইনিজ় রেস্তরাঁ আছে। বেশ গ্রিজ়ি ফরবিডন টাইপ অফ ফুড পাওয়া যায়। ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম। যাবে?”
জয় এত কথা কেন বলছিল বুঝতে পারছিল না নোঈ। ও বলেছিল, “কী বলবে বলো। আমার তাড়া আছে।”
নোঈর স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে, জয় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। ও বলেছিল, “না মানে… আমি আসলে তোমার সঙ্গে খুব রুড বিহেভ করেছিলাম। তাই… মা বলছে বিয়ের কথা। আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি নেক্সট জ্যান-এ। তাই… মানে, মাকে বলেছি নোঈ বলে একটা মেয়ে আছে। আমায় খুব ভালবাসে। আমার জন্য পাগল। মা তো জানোই খুব রাগী। অর্থোডক্স! কিন্তু আমি যেহেতু চলে যাচ্ছি, তাই এবার একটু নরম হয়েছে। বলছে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করবে। নেক্সট সানডে বাইরে আমরা তিন জনে লাঞ্চ করি চলো।”
নোঈ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তারপর বলেছিল, “লাস্ট টাইম কী বলেছিলে তোমাদের অফিসে মনে আছে? মনে আছে কী ভাবে তাড়িয়েছিলে! আর এখন তোমার মা ডাকছেন!”
জয় হাত জোড় করে ঝুঁকে পড়েছিল, “প্লিজ় নোঈ! আয়্যাম সরি! প্লিজ়। আমি বুঝতে পেরেছি আমারও তোমাকেই পছন্দ। আমার তোমার কথাই মনে পড়ে। প্লিজ় আন্ডারস্ট্যান্ড! আমি মাকেও বলেছি নোঈ খুব ভাল মেয়ে। একবার দেখা করো। আমি বলেছি নোঈ আমার কথা ফেলবে না। প্লিজ়।”
নোঈ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করেছিল। সবাই ‘সরি’! সারাক্ষণ সবাই কিছু করে ফেলেই বলে ‘সরি’! আরে বাবা, ‘সরি’ বলতে হবে এমন কাজ করা কেন? শ্বেতা সরি! জয় সরি! আর কে কে সরি কে জানে!
“প্লিইইইজ়!” জয় বলেছিল, “এবার না বললে কিন্তু আমি মাটিতে বসে পড়ব হাঁটু গেড়ে! সামনের রবিবার। প্লিজ়।”
জয়ের দিকে তাকিয়েছিল নোঈ। ওর কিছু মনে হচ্ছিল না। মৃত সম্পর্ক যেন। জয় আরও কিছু বলছিল। কিন্তু কানে ঢুকছিল না কোনও কথা। বরং আচমকা ওর পুশকিনের মুখটা মনে পড়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল দূর থেকে পুশকিন যেন তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।
“ঠিক আছে, যাব,” নোঈ আর কথা বাড়ায়নি। ও ভাবছিল জয়ের সামনে থেকে ওকে সরে যেতে হবে এক্ষুনি!
জয় খুশিতে হাত ধরতে চেয়েছিল ওর। নোঈ সরে গিয়েছিল। বলেছিল, “জানিয়ে দিয়ো কোথায়, কখন।” ওর শরীরের ভেতরে আগুন জ্বলছিল যেন! মনে হচ্ছিল জয়কে ছিঁড়ে রুটির টুকরোর মতো ছড়িয়ে দেয় পথে! মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছিল নোঈ। পরের রবিবারের জন্য।
রাতে খেতে বসে নোঈ জয়ের কথা গুছিয়ে বলেছিল মা আর বাবাকে। মা শুনে প্রথমে কোনও কথা বলেনি। তারপর কী যে নাচানাচি শুরু করেছিল! বলেছিল, “একদম ঠিক করেছিস। অবশ্যই যাবি রবিবার। যাক বাবা, ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন আমার দিকে। পুশিদি আমাকে যেদিন থেকে বলেছিল যে, তোকে আর ওই লোকটাকে একসঙ্গে দেখেছে, আমার তো রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। আমি ঠাকুরের কাছে খুব কাঁদতাম। তোর যেন মতি ফেরে। যাক, ঠাকুর মুখ তুলে তাকিয়েছেন!”