মা ভুরু কুঁচকে তাকাতে গিয়েও হাসল। ওর হাতে একটা দু’হাজার টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলল, “ভাল মিষ্টি কিনে নিবি লেক মার্কেটের ওই নতুন বড় দোকানটা থেকে।”
“আরে!” নোঈ অবাক হল, “টাকা দিচ্ছ কেন?”
মা বলল, “এটা দিতে হয়। নে। ব্যাগে ঢোকা!”
নোঈ টাকাটা ব্যাগে ভরে বলল, “মা তুমি আমায় খুব ভালবাসো, না?”
“তোর কী মনে হয়?”
“আমি যাতে ভাল থাকব সেটা তুমি চাও?”
মা অবাক হল, “এসব বলছিস কেন?”
নোঈ বলল, “এমনি বলছি। আমি আসি এখন।”
নোঈ আর অপেক্ষা না করে বাবার ঘরে উঁকি মারল, “আমি আসছি বাবা।”
বাবা তাকাল। হেসে মাথা নাড়ল শুধু। মা দরজা অবধি এগিয়ে এল ওর সঙ্গে! বলল, “পাগলামি করবি না কিন্তু। সাবধানে যাস।”
লিফটে নামতে-নামতে মোবাইলে গাড়িটা বুক করে নিল নোঈ। কাছেই আছে। দু’মিনিট দেখাচ্ছে।
নোঈ একবার সুশান্তর ঘরের দিকে এগোল। একবার দেখে যাবে মাগোকে। সেদিন রাতে যা হয়েছিল! নোঈর তো হাত-পা কাঁপছিল থরথর করে। ভাগ্যিস আইকাদির বস এসে গেছিলেন।
নোঈ গিয়ে দরজায় দাঁড়াল। মালতী বসে আছে মাটিতে। রান্না করছে কিছু একটা। সুশান্ত বিছানায় বসে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আছে। মাগোর মাথায় ব্যান্ডেজ। কিন্তু মুখে হাসি। সুশান্তর গলার লকেটটা ধরে খেলছে!
“সুশান্তদা, কেমন আছে মাগো?”
সুশান্ত তাকাল। মালতীও ঘুরে তাকাল নোঈর দিকে। মাগো নোঈর গলা চেনে। ও চারটে দাঁত দেখিয়ে খিলখিল করে হেসে, ঠেলে আসতে চাইল ওর কাছে।
নোঈ চোখ বড়-বড় করে মাগোর দিকে তাকিয়ে বলল, “খালি দুষ্টুমি! চুপ করে থাকো। আমি ফিরে এসে কোলে নেব।”
সুশান্তদা হাসল। মাগোকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল, “এখন ভাল আছে দিদি।”
“গুড,” নোঈ হাসল, “আমি আসি।”
রাস্তায় বেরিয়ে এক মিনিট দাঁড়াতে হল নোঈকে। গাড়ি এসে গেল তার মধ্যেই।
রাস্তা ভিজে আছে বেশ। ছিপছিপে বৃষ্টি হচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে না নোঈর। শুধু একটা অস্বস্তি হচ্ছে। এই যে ও যাচ্ছে, এটা কি ঠিক হচ্ছে! শ্বেতার সঙ্গে কথা বলার সময় গোটা ব্যাপারটা কাটিয়ে দিলে পারত না!
কিছুদিন আগে অফিস থেকে ফেরার সময় শ্বেতাকে দেখেছিল, দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাড়ির গলির মুখে। কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল নোঈ। এ কী চেহারা হয়েছে মেয়েটার! সেই যে শেষ কথা হয়েছিল তারপর আর শ্বেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি নোঈ। কেন ও গাল বাড়িয়ে চড় খেতে যাবে? তাই বিয়েতেও যায়নি।
নোঈ শ্বেতাকে দেখে থমকে গিয়েছিল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। শ্বেতাও থমকে গিয়েছিল প্রথমে। তারপর প্রায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিল নোঈকে।
নোঈ বুঝতে পারছিল কিছু একটা হয়েছে। ও বলেছিল, “কী হয়েছে তোর! এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঘরে চল!”
সেদিন বাবা আর মা ছিল না। একটা অনুষ্ঠানে বেরিয়েছিল। বাড়ি ফাঁকাই ছিল। ঘরে ঢুকে জুতো খুলতে-খুলতেই নোঈকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল শ্বেতা। নোঈ কিছু বলেনি। কাঁদতে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে মনের ময়লা দূর করতে হলে কান্নাটা দরকার।
কিছু পরে শ্বেতা সামলেছিল নিজেকে। নোঈর আনা জল খেয়ে ধাতস্থ হয়েছিল।
নোঈ শান্ত গলায় বলেছিল, “কী হয়েছে তোর?”
শ্বেতা বলেছিল, “আমায় ক্ষমা করে দে নোঈ। আমি তোকে খুব বাজে কথা বলেছিলাম। আমি বুঝিনি যে, ববি একটা জানোয়ার! আমি… আমি…”
“আরে, আবার কাঁদছিস?” নোঈ শক্ত করে ধরেছিল শ্বেতাকে।
শ্বেতা অনেক কষ্টে আটকেছিল নিজেকে। বলেছিল, “বিয়ের সাত দিনের মধ্যে ঝামেলা শুরু করেছিল জানিস! আর গতকাল আমি ছিলাম না। বাড়ি ফিরে দেখি অন্য মেয়ে নিয়ে শুয়ে আছে! আর সেটা বলেছি বলে আমায়… আমায় লাথি মেরেছে! আমি… আমার জীবনটা…”
নোঈ তাকিয়েছিল শ্বেতার দিকে। কষ্ট হয়েছিল ওর। মেয়েটা যেন টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে! নোঈ ভেবেছিল, কেন এমন হয়? শ্বেতা তো ভালইবেসেছিল। তা হলে এমন করে কষ্ট পাচ্ছে কেন! অধিকাংশ মানুষ আসলে ভালবাসতে চায়, কিন্তু সেটার জন্য যে-একাগ্রতা, ডেডিকেশন আর সততার দরকার হয় সেটা তাদের থাকে না। দু’মিনিটের চাউমিন খেতে খেতে সব কিছুই আসলে দু’মিনিটের কনসেপ্টের মতো হয়ে গেছে।
“তুই ঠিক বলেছিলি নোঈ। আমি ওকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি! আমি আর থাকব না ওর সঙ্গে। আগে তো সম্মান। তারপর প্রেম ভালবাসা!”
নোঈ কিছু না বলে চুপ করে তাকিয়েছিল শ্বেতার দিকে।
শ্বেতা আবার বলেছিল, “তবে জয় খুব হেল্প করেছে আমায়! আজ গেছিলাম ওর কাছে। আমার চাকরি দরকার। তাই ওর কথা মনে হয়েছিল।”
জয়! নোঈ চমকে উঠেছিল আবার ওর কথা কেন!
“জয় খুব ভাল ছেলে!” শ্বেতা বলেছিল, “ও বলেছে আমায় কাজ দেখে দেবে। তবে ওর একটা ফেভার চাই। বন্ধুর কাছ থেকে বন্ধুর মতো। তাই আমি তোর কাছে এসেছি।”
“আমার কাছে!” অবাক হয়েছিল নোঈ। কেমন একটা ভয়ও করছিল।
শ্বেতা বলেছিল, “জয় তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়। একবার দেখা কর। প্লিজ়। বড়দিনের বিকেলে নন্দনে। আমাদের ইউজ়ুয়াল জায়গায়। প্লিজ়।”
নোঈ অবাক হয়ে গিয়েছিল, “আমার সঙ্গে? কেন?”
শ্বেতা বলেছিল, “আমি ডিটেল জানি না। আই গেস হি ইজ় রিপেন্টেড। তুই প্লিজ় একবার যাস। এটা আমার জন্য করিস। আমার কাজটা খুব দরকার। আমি আর ববির সঙ্গে থাকতে পারব না।”
নোঈ চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করেছিল, “শ্বেতা, তোকে কি জয় বলেছে যে, এটা না করে দিলে তোর কাজ হবে না? মানে সাম কাইন্ড অব বার্টার?”