.
৩৮. নোঈ
ডিসেম্বরেও এমন মেঘ করে! মনে হচ্ছে কলকাতা যেন বাইসনের পেটের তলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে! জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল নোঈ।
ডিসেম্বরের প্রায় শেষ এখন। নতুন বছর চলে এল প্রায়। শহরের চারিদিকে ছুটির আমেজ। তার ওপর রবিবারের দুপুর। শীত, মেঘ আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এমন দিনে গল্পের বই নিয়ে লেপের তলায় শুয়ে থাকার চেয়ে আর কী ভাল হতে পারে! গতবছর শীতের নোঈ হলে সেটাই করত ও! কিন্তু এই শীতের নোঈ অন্য, আলাদা।
ও নিজেকে একবার দেখে নিল আয়নায়। আজ জিনস আর উলেন টপ পরেছে। সঙ্গে মাফলার। নোঈর ঠান্ডা কম। মা বলে, আগের জন্মে নাকি ও পেঙ্গুইন ছিল! হতেও পারে। কিন্তু ঠান্ডা ব্যাপারটা খুব ভাল লাগে নোঈর।
শুধু বৃষ্টিটাই যা গোলমাল পাকাল আজ।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল নোঈ। মা বসে রয়েছে বাইরের ঘরে। টিভিতে কী একটা সিরিয়াল দেখছে! বাবা যে নিজের ঘরে সেটা আর বলে দিতে হবে না।
মা তাকাল নোঈর দিকে। মুখটা হাসি-হাসি! বলল, “যাক, রেডি তা হলে? গাড়ি বুক করেছিস তো? আর এ কী! এভাবে কেউ হবু শাশুড়ির সামনে যায়!”
“প্লিজ় মা!” নোঈ মাথা নাড়ল, “কে হবু শাশুড়ি?”
মা উঠে এসে ওর জামাটা টেনে ঠিক করতে করতে বলল, “অবশ্য এখনকার ব্যাপারই আলাদা। আর যা বাজে ওয়েদার! অন্য কেউ হলে আমি যেতে না বলতাম। হ্যাঁরে, ও কবে যেন আমেরিকা যাচ্ছে?”
“জানুয়ারির দশ তারিখ,” নোঈ মায়ের হাতটা সরিয়ে দিল।
মা সামান্য বিরক্ত হল, “কী হল, এমন করছিস কেন! উলের টপটা একটু ঠিক করে দিচ্ছি। পেছনের দিকটা কেমন হয়ে আছে। শোন, টেরাবাঁকা উত্তর দিবি না। আর, একটা জিনিস জিজ্ঞেস করবি, আমরা কবে যাব ওদের বাড়ি?”
“তোমরা?” নোঈ অবাক হল, “পারো বটে বাবা!”
“কত ভাল ছেলে!” মা নোঈর মাথায় হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করার চেষ্টা করল, “যখন তুই নিজে মা হবি, তখন বুঝতে পারবি কী জ্বালা আর চিন্তা।”
নোঈ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে এখনই আমি বুঝতে পারছি।”
মা ছোট্ট করে একটা চড় মারল নোঈর হাতে। হেসে বলল, “খালি আজেবাজে কথা! আমার খুব নিশ্চিন্ত লাগছে আজ জানিস। আমি আইকাদেরও বলেছি। ওরা তো খুব খুশি শুনে। শুধু আইকা কেমন যেন অবাক হল! যাক বাবা, ওই লোকটার ভূত যে তোর মাথা থেকে নেমেছে এই অনেক! আমার যা চিন্তা হচ্ছিল! আমি তোর বাবাকে বলেছি, আমার মেয়ে যখন, তখন ও কোনও ভুল করতে পারে না। তোর দিদিরা আছে আমেরিকায়। তুইও যাবি! ভালই হবে, কাছাকাছি থাকবি দু’জনে। আমরা আর ক’দিন বল! নিজেদের লোকই কাজে আসে জীবনে।”
মা এত কেন কথা বলে কে জানে! নোঈ মায়ের কাছ থেকে সরে গেল একটু।
মা বলল, “টিপ পরলি না? তোকে টিপ পরলে এত সুন্দর দেখায়! পর না!”
“মা,” নোঈ মাথা নাড়ল, “আমি ঠিক আছি। প্লিজ় এবার আমি যাই? দেড়টা বাজে। ওরা বলেছিল দুটোর মধ্যে যেতে!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আর, লজ্জা করে খাবি না। সকালে মাত্র দুটো টোস্ট আর জুস খেয়েছিস একটু। আচ্ছা, ওরা কবে বিয়ের ডেট ঠিক করতে চায় বলে তোর মনে হয়? জানুয়ারিতে যদি ছেলে আমেরিকা যায়, ছ’মাসের মধ্যে আসতে পারবে বলে তো মনে হয় না, না? নেক্সট ইয়ারের শেষে কি তবে ওরা ভাবছে? নাকি শ্রাবণ মাসে?” মা চিন্তিতভাবে তাকাল নোঈর দিকে!
নোঈ আর কথা বাড়াল না। মায়ের মনোলগ চলতেই থাকবে। ও বেশ বুঝতে পারছে, মা পারলে ওর সঙ্গে যায়।
পায়ে এতক্ষণ ঘরের চটি ছিল। সেটা কার্পেটের পাশে খুলে রাখল নোঈ। স্নিকারটা মা বের করে রেখেছে আগেই। ও সোফায় বসে মোজা আর জুতো পরে নিল।
মা এবার বড় ঢাউস ছাতাটা বের করে দিল, “এটা নিয়ে যা। ওই ফ্যান্সি ছোট ছাতা নিতে হবে না। ভিজে যাবি।”
এটা ছাতা না পোল ভল্টের পোল, সেটা বুঝতে পারে না নোঈ। ইয়া বড়। সামলানোই দায়। খুব ঝড়ের ভেতর এই ছাতা নিয়ে হাঁটলে আকাশে উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল!
নোঈ বলল, “এটা নিয়ে যেতে হবে? এটা আমার চেয়ে বড়। এটা নিয়ে অসুবিধে হবে।”
মা বলল, “না, এটা নিয়ে যা। ভিজলে জ্বর আসবে। কথা শোন। সব কিছুতে তর্ক করবি না। সব কিছু নিয়ে তর্ক করতে নেই। আমরা কোনওদিন বাবা-মায়ের মুখের ওপর কোনও কথা বলিনি আর তোদের কী চোপা, কী চোপা!”
নোঈ মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল। ওর আটপৌরে, রাগী, জেদি আর ছেলেমানুষ মা। সারাক্ষণ সংসারের জন্য ভাবে। কাজ করে। সবাইকে নিজের মতো করে ঠিক রাখতে চায়। সারা জীবন এর বাইরে আর কিছু ভাবলই না। মায়ের দিকে তাকিয়ে আচমকা কেমন একটা কষ্ট হল ওর। মনে হল মা গোটা জীবন তো দিয়ে দিল ওদের জন্য। নিজে তো কিছুই করল না। মা ভাল গান জানত। ভাল নাচতে পারত। ফিজ়িক্সে অনার্স নিয়ে ভাল নম্বর পেয়েছিল। চাকরি করতে পারত অনায়াসে। কিন্তু করল না। অনেকে মাকে হাউস ওয়াইফ বলে মনে মনে একটু খাটো করে দেখে। কিন্তু সারা জীবন একদিনও তো নিজের কাজ থেকে ছুটি নিল না মা। সারা জীবন সারাক্ষণ এই মানুষটা অন্যের জন্য করে গেল।
নোঈ আচমকা এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে। তারপর গালে জোরে চুমু খেল একটা।
মা ঘাবড়ে গেল সামান্য, “কী হল হঠাৎ?”
নোঈ হাসল, বলল, “এমনি। আগেকার দিনে তোমরা বাবা-মাকে প্রণাম করতে না? এখন আমরা তার বদলে চুমু খাই, বুঝলে?”