কাজু হাঁপ ছাড়ল। যাক যাদবকাকা। ও নিজের জায়গা থেকে উঠে শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে গেল কিছুটা। লালচে মেঘ থেকে ছিটকে আসা আবছায়া আলোয় দেখতে পেল ও মানুষটাকে। যাদবকাকার হাতে একটা টর্চ।
“এই যে আমি!” কাজু সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“ওঃ!” যাদবকাকা আশ্বস্ত হল, “আরে, মেরেকো ডর লগ রাহা থা! বিজনের কাছ থেকে শুনলাম তুই এখানে আছিস। যাক। তু চল অব।”
কাজু জিজ্ঞেস করল, “কোথায়?”
“আরে, বাওয়াল হয়ে গেছে! বোমায় দু’জন স্পট ডেড। পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি এখনও। তুই যেহেতু মিটিং ডেকেছিলি তোকেও খুঁজছে। তাই এখানে থাকা সেফ নয়।”
“যাবটা কোথায়?” কাজুর গলা কেঁপে গেল। দু’জন মারা গেছে। পুলিশ খুঁজছে। এবার কী হবে? কাল যে ওর পেখমের সঙ্গে যাওয়ার কথা!
“আরে, সে নিয়ে চিন্তা করিস না। আজ রাতটা গা-ঢাকা দিয়ে থাক। কাল গোপেনদা আর বিমলদাকে বলে একটা রফা করা যাবে। কিন্তু আজ বাইরে আসিস না। মেথরপট্টির পেছনে পবনের বাড়িতে আজ থাকবি। এখান থেকে এখন চল। মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া হবেই। তব অর এক মুসিবত। চল।”
কাজু কাঁধের ব্যাগটাকে সামলে নিয়ে যাদবকাকার সঙ্গে বেরিয়ে এল চৌধুরীদের জায়গা থেকে। চারপাশে অন্ধকার। পথ দেখাচ্ছে ওই ছোট্ট একরত্তি একটা টর্চ। যাদবকাকা হনহন করে হাঁটছে। কাজুও যাচ্ছে, কিন্তু হাওয়াই চটিটা বিকেলে দৌড়োনোর সময় কিছুটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তাই খুব একটা জোরে হাঁটতে পারছে না।
“যাদবকাকা, আস্তে!” কাজু বলল।
ওরা বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটছে। সামনে পথের বাঁক দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে যাদবকাকা। কাজু যতটা সম্ভব জোরে সেই বাঁকের দিকে এগোল। ওই তো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সামনে বড় একটা গাছ আবছায়ার মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ডাল বেশ নিচু। কাজু মাথা ঝুঁকিয়ে গাছের ডালটা এড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
থাড করে একটা ভোঁতা শব্দ হল হঠাৎ! কাজু থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। তারপর মনে হল ওর মাথার ভেতরে যেন বোমা ফাটল! ও বুঝল মাথার ডান দিক দিয়ে গরম কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে। সামনের দৃশ্য আবছায়া হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কাজু কথা বলতে পারছে না। মাথার ব্যথাটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। হাত কাঁপছে ওর। পা অবশ হয়ে আসছে। গরম স্রোত ক্রমশ ভিজিয়ে দিচ্ছে জামা। কী হল এটা? কেউ কি মারল? নাকি মাথায় গাছের ডালটা লাগল? এটা কী? কাজু মাথায় হাত দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে আবার থাড করে আর-একবার বোমা ফাটল ওর মুখের ওপর! কাজু ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে!
নাকটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে! মুখে নোনতা স্বাদের রক্ত! সামনের দৃশ্য প্রায় আবছা! একটা চোখ দিয়ে কিছুটা দেখা যাচ্ছে আর অন্য চোখের সামনে শুধু মেঘ!
তবু সেই আধখোলা চোখ দিয়ে কাজু দেখতে পেল পাঁচ-ছ’টা আলোর রেখা। টর্চ। কয়েকজোড়া পা।
শুনল কে যেন বলছে, “শাবাস যাদবসাহাব! একদম পারফেক্ট আছে!”
যাদবকাকা! কাজুর মাথা নিভে আসছে দ্রুত! তবু জোর করে নিজেকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে ও। যাদবকাকা ওকে এভাবে… দৃশ্য গুলিয়ে যাচ্ছে। পাগুলো ঘিরে ধরছে ওকে। টর্চের আলো এসে পড়ছে ওর ওপর।
কার একটা গলা, “শেষ করে দে এবার! শালার পুড়কি ছিল খুব! মার বাঞ্চোতকে!”
কাজু হাত তুলল। কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু এবার ধারালো কিছু এসে লাগল ওর কাঁধে! মনে হল, শরীর ছিঁড়ে গেল একদম! আঃ, কী যন্ত্রণা! এবার গোটা শরীর নিভে আসছে দ্রুত!
কাজু অস্ফুটে বলল, “মা… মা… পেখম…”
“শুয়োর! আমার বউয়ের নাম নিচ্ছে! শালাকে…”
কথা শেষ হওয়ার আগে আর-একটা কিছু এসে পিঠ থেকে কাজুর শরীর ভেদ করে ওকে গেঁথে দিল মাটির সঙ্গে। কাজু একবার ওপরের দিকে তাকাল। সারা শরীরে আর কিছু নেই! শুধু মাথাটা যেন নড়ছে! আবছাভাবে একবার সামনে তাকাল ও।
“শেষ হয়েছে?” চেনা একটা গলা কানে এল কাজুর। ও কোনওমতে তাকাল। টর্চের আলো এসে পড়েছে লোকটার মুখের একপাশে। আলোছায়ায় লোকটা তাকিয়ে আছে কাজুর দিকে। কাজু স্থির হয়ে গেল একেবারে! এ কাকে দেখল ও! তারপর অবসন্নভাবে মুখ গুঁজল মাটিতে। আবছাভাবে একটা ধাতব শব্দ পেল ও। তারপর আর-একটা শব্দ এল…
আর জোনাকিরা উড়ছে। সব অন্ধকার চিরে বেরিয়ে আসছে অনেক-অনেক জোনাকি! ওদের ছোট্ট মফস্সলের মাথার ওপর উড়ছে তারা। আর সেই আলোয় মাকে দেখতে পেল কাজু। দেখল, ছোট ভাইটা গাছ লাগাচ্ছে। আন্টিবাডু ইজিচেয়ারে বসে হেসে কথা বলছে কোন একটা ছেলের সঙ্গে যেন। আর সে মুখ ফেরাতেই চিনতে পারল। বিজন! তুই এখানে! কে যেন হাসল এর উত্তরে। আর পেছন ফিরল কাজু। দেখল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে পেখম। আজ আবার জোনাকিদের আলো জ্যোৎস্নার মতো ভাসিয়ে নিচ্ছে চরাচর। কাঠালচাঁপার গন্ধ চৌধুরীদের লম্বা পাঁচিল টপকে, ঝুমাদিদের কলতলা ঘুরে, হেমন্তকাকুর সাইকেলের কেরিয়ারে বসে চলে আসছে এই এত দূরে! চ্যাটার্জিপাড়ার জলট্যাঙ্কির পেছন থেকে হাওয়া ভেসে আসছে আজ। হাওয়া ডুবিয়ে দিচ্ছে এই ছোট্ট মফস্সলটাকে। কাজু দেখছে পেখমকে। পেখম হাসছে। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর দিকে। আর এই অন্ধকার নদীবাঁধে শুয়ে কাজু শেষবারের মতো সেই স্পর্শ অনুভব করল। শেষ জোনাকিটা নিভে যাওয়ার আগে সেই ছোঁয়াচটুকু ধরে রইল কাজু। অস্ফুট হাওয়ার স্বরে এই নদী, এই হাওয়া, এই রাত্রি আর পৃথিবীর নিভে-যাওয়া সমস্ত জোনাকিদের কানে কানে বলল, “আমরা দু’জন, মাত্র দু’জন…”