অদ্ভুত মেয়ে নয়না। সেদিন সন্ধেবেলা একটা কাচের বোতল নিয়ে এসেছিল ওদের বাড়িতে। কী আবদার, না জোনাকি ধরবে!
কাজুর সেদিন পড়ানো ছিল না। ভেবেছিল, একবার পার্টি-অফিসে যাবে। সেই মতো মুড়ি-চানাচুর খেয়ে বেরিয়েছিল। কিন্তু যেতে পারেনি। গেটের কাছে দেখা হয়েছিল নয়নার সঙ্গে!
নয়না! সেই ছাদের ওপর আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনাটার পরে নয়নার কথা ভাবলেই কেমন একটা অপরাধবোধ এসে ঘিরে ধরে কাজুকে। মনে হয়, পেখমের ওপর রাগটা এভাবে বেরোল ওর মধ্য দিয়ে। কেন ওভাবে নয়নাকে ধরল ও। এটা তো পেখমকে ঠকানো হল। ব্যাপারটা যতটা সম্ভব মন থেকে ভুলে যেতে চায় কাজু। কিন্তু নয়না মাঝে মাঝে ওর কাছে এসে কিছুতেই ভুলতে দেয় না ওকে কিছু।
সেদিনও জোনাক-বাড়ির গেটের কাছে নয়না এসে পথ আটকেছিল কাজুর। এই সময়টা তেমন লোকজন থাকে না ওখানে। নয়না সোজা এসে কাজুর জামার কলারটা ধরে টেনে ঠোঁট রেখেছিল ঠোঁটে! কাজু ঘাবড়ে গেছিল। কী করছে কী মেয়েটা! কেউ দেখে ফেললে! এখানে কেউ নেই ঠিক আছে, কিন্তু বাড়ির জানলায় তো কেউ থাকতেই পারে।
নয়নাকে ও ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল।
নয়না হেসে বলেছিল, “কী হল? লজ্জা লাগছে? কেউ দেখে ফেলবে? সেদিন যেভাবে বুকে কামড়ে দিলে মনে আছে? এখনও নীল হয়ে আছে! জানো?”
“তুই চুপ কর। ওটা ভুল হয়ে গেছে আমার। আর হবে না। প্লিজ়, ওটা ভুলে যা,” কাজু কাতর স্বরে বলেছিল।
“ভুল! অতক্ষণ ধরে ভুল!” নয়না চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, “ও, পেখম সেদিন তোমার সঙ্গে দেখা করার পরে এসব এখন ভুল লাগছে তোমার?”
কাজু কী বলবে বুঝতে পারছিল না। নয়না কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না। কাম আর প্রেম তো এক নয়। ওটা একটা দুর্ঘটনা। ওটা কাজুর কাছে জীবন নয়।
নয়না ওর হাতে ধরা কাচের বোতলটা দেখিয়ে বলেছিল, “এতে জোনাকি ধরব বলে এসেছিলাম কাজুদা। কিন্তু এখন দেখছি তোমায় ধরতে হবে। সেই তোমায় একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?”
“কোন কথা?” কাজু অবাক হয়েছিল।
নয়না তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। তারপর বলেছিল, “তুমি আমার সব কথা ভুলে যাও, না কাজুদা?”
কাজু কী বলবে বুঝতে পারেনি। আসলে ওর মাথার ওপর অনেক চাপ। এসব মনে রাখবে কী করে! আর নয়নার সঙ্গে যা হয়েছে, তাতে মরমে মরে গেছে ও। তাই সচেতনভাবে ও নয়নার কথা মনে আনতে চায় না।
নয়না বলেছিল, “আমার দিদির একটা পুতুল ছিল। খুব সুন্দর। সেটা আমায় ধরতে দিত না। তখন সাত বছর বয়স আমার। আমি বলতাম একবার শুধু ধরব। কোলে নেব। কিন্তু কিছুতেই দিদি আমার কথা শুনত না। একদিন লুকিয়ে কোলে নিয়েছিলাম বলে দিদি আমায় মেরেছিল খুব। মায়ের কাছে মিথ্যে নালিশ করিয়ে আমায় মারও খাইয়েছিল। মা খুব ভালবাসে দিদিকে।”
কাজু কী করবে বুঝতে পারছিল না। নয়না কেন এসব বলছে ওকে? কী বলতে চায় আসলে?
নয়না বলেছিল, “একদিন বিকেলে দিদি ছিল না বাড়িতে। আমি সেই সুযোগে পুতুলটাকে মায়ের উনুনে গুঁজে দিয়েছিলাম। উনুনটা আঁচে বসিয়েছিল মা। আমি পুতুলটা নিয়ে সোজা গুঁজে দিয়েছিলাম উনুনের তলায়। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল সব। দিদি এসে খুব কেঁদেছিল। মা এমন মেরেছিল আমায় যে, মাথা কেটে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই দাগ আজও আছে। কিন্তু জানো কাজুদা, আমি খুব কিছু কাঁদিনি। রাতে শুয়ে দেখেছিলাম, মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মায়ের চোখে জল। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘দিদি আবার এমন করলে আমিও কিন্তু এমনই করব!’ কাজুদা বুঝলে কিছু? আমি কিন্তু এমনই করব। মনে থাকে যেন।”
কাজু কী বলবে বুঝতে পারছিল না। হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল সব। নয়নার চুল উড়ছিল। আধো-অন্ধকারে কেমন লাগছিল নয়নাকে।
“আমার বুকে মুখ দিয়েছ তুমি কাজুদা। তুমি আমার। পেখমের নও। দাগ আছে এখনও। চিহ্ন। তুমি যে আমার, তার চিহ্ন!” নয়না কথাটা বলে হেসে হাত ধরেছিল কাজুর, “চলো, জোনাকি ধরে দেবে আমায়। আমি আমার কাছে রাখব তোমার জোনাকিদের।”
কাজু বলেছিল, “যা তোর নয়, তা কিছুতেই তোর নয়। এটা মনে রাখিস নয়না। জোর করে এসব হয় না। আমার জোনাকি তোর নয়। পেখমের।”
জোনাকিরা উড়ছে সামনে। কুড়িটা জোনাকি। কাজুর অদ্ভুত লাগছে। বিন্দু-বিন্দু তারা যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে! মা ছোটবেলায় বলত, জোনাকিরা নাকি পরি! ছোট-ছোট পরি। ওদের কাছে ভাল মনে কিছু চাইলে ওরা ঠিক দেয়।
এখন মনে পড়লে হাসি পায় কাজুর। পরি! পরি বলে কিছু হয় না পৃথিবীতে। কিন্তু তাও মায়ের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে ওর। মনে হচ্ছে বলে, ওর জীবনের সব কষ্ট দূর করে দেয় যেন পরিরা। সব বাধা কাটিয়ে পেখম যেন আসে ওর জীবনে। কাজুর মাঝে মাঝে মনে হয়, বড় হওয়ার সবচেয়ে মুশকিল হল লজিক তৈরি হওয়া। এই জল-কাদা, মনখারাপ-করা আধো-অন্ধকার পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে বাচ্চাদের মতো সরল মনের বিশ্বাসের খুব দরকার। রূপকথার খুব দরকার।
আচমকা সামনের দিকে কীসের একটা শব্দ হল। কীসের শব্দ এটা! কাজু সচকিত হয়ে নড়েচড়ে বসল। ঘড়ি দেখল একবার। বিজন গিয়েছে আধঘণ্টার মতো হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল ও!
“কাজু, কাজু! তু হ্যায় কেয়া!”
সামনে থেকে যাদবকাকার গলার স্বর শোনা গেল।