কাজু মনে মনে এমনিতেই মরে আছে। নয়নার সঙ্গে সেই রাতে কী যে হয়েছিল! পেখমের বিশ্বাসই তো ভেঙেছে। কিন্তু সেটা বলতে আর পারল কই পেখমকে! ও তো বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা শুনতেই চাইল না। কী করে যে এর প্রায়শ্চিত্ত করবে কাজু! কতদিন এই অপরাধ সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকবে ওর বুকের ওপর! কিন্তু তাই বলে তো পেখমকে ও ছেড়ে দিতে পারে না! মানুষের জীবনের না-বলা কথা হয়েই না হয় থেকে যাবে এই ঘটনাটা। অমীমাংসিত অপরাধের মতো।
ও আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টি আর হচ্ছে না। তবে আকাশ লাল হয়ে আছে। চৌধুরীদের পোড়োবাড়ির ঝোপে ওরা বসে রয়েছে এখন। গঙ্গার বাঁধের পাড়ে এই বিশাল খণ্ডহর ধরনের বাড়িটা দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত। কেউ আসে না এদিকে। সাপখোপের ভয় থাকলেও তাই এদিকে এসেছে কাজু!
বিজন বলল, “কাল তোমার যাওয়া আছে, মনে আছে তো!”
কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে তো আছে। কিন্তু আজ ব্যাপারটা এমন হয়ে যাবে, সেটা বুঝতে পারেনি। ওর প্ল্যান ছিল আজকে গেট মিটিংটা করে দিয়ে ও বাকি ব্যাপারটা সতুকে বুঝিয়ে দেবে। তারপর কাল বেরিয়ে যাবে পেখমের সঙ্গে। হাজারিবাগের কাছে আন্টিবাডুর এক বান্ধবী থাকে। সেখানেই যাবে আপাতত। এই যে ওরা চলে যাচ্ছে, সেটা বাড়িতে জানিয়েছে কাজু। বাবা, মা আর আন্টিকে জানিয়েছে। বাবা-মা আপত্তি করলেও আন্টি বলেছে, “ঠিক আছে। তোর লাইফ। ইউ হ্যাভ এভরি রাইট টু ডিসাইড। আমাদের কিছু বললে আমরা দেখে নেব। বলব আমরা জানি না।”
মা যদিও ভয় পাচ্ছে খুব, কিন্তু কাজু বুঝিয়েছে। বাবাও সব ভেবে শেষমেশ বলেছে, “ওর যাতে আনন্দ, সেটাই ও করুক!”
কিন্তু মুশকিল হল এখানে এভাবে যে সব গন্ডগোল হয়ে যাবে, সেটা বুঝতে পারেনি কাজু। এখানে কতক্ষণ বসে থাকবে ও? খবরও পাচ্ছে না কী হয়েছে!
এই বাড়ির সীমানা পার হয়ে বাঁধের ওপরের কাঁচা পথ। তারপরেই নদী। সেদিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে।
কাজু কাঁধের ঝোলাটার ভেতর হাত ঢোকাল। ডায়েরিটা আছে। সঙ্গে পেখমের দেওয়া কার-বাঁধা রুপোর লকেটটাও। সেটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরল ও।
বিজন বলল, “সতুদা কি জানে তুমি আর পেখমদি কাল…”
“না, জানে না। ওকে আমি বলেছি বাড়ির কাজে আমি কয়েকদিনের জন্য মেদিনীপুর যাচ্ছি। বাইরের লোকেদের মধ্যে তুই জানিস শুধু।”
আসলে মুক্তার সিংহের ট্যাক্সিটা বিজনই ঠিক করে রেখেছে। সেটা করেই ওরা হাওড়া চলে যাবে। মুক্তার অল্পবয়সি ছেলে। একুশ-বাইশ বছর বয়স। কলকাতায় ট্যাক্সি চালায়। বিজনের সঙ্গে ভাল ভাব আছে।
বিজনের বয়স হয়তো অল্প, কিন্তু এই বয়সেই খুব কাজের ছেলে। কত লোকের সঙ্গে যে আলাপ! সবার দায়ে-দফায় গিয়ে হাজির হয়। তাই সবাই ভালওবাসে। কাজু জানে, ভবিষ্যতে বিজন অনেক বড় হবে।
কাজু বলল, “তুই এবার আয় বিজন। আর থাকিস না এখানে। তোর বাড়িতেও লোকজন চিন্তা করবে!”
বিজন কী একটা ভাবল। বলল, “ঠিক বলেছ। আমি বেরোচ্ছি। সাইকেলটা নিয়ে যাচ্ছি। বাইরের পরিস্থিতি কী একবার দেখি। ঘণ্টাখানেক পরে আমি আসছি আবার। খবর নিয়ে আসছি। তুমি কিন্তু এখান থেকে নড়বে না, আমি খবর নিয়ে এসে যদি সব ঠিক আছে দেখি, তা হলে বেরোবে। আর তেমন হলে সতুদা, যাদবকাকাকে বলব আজ রাতের মতো তোমায় কোথাও থাকার জায়গা করে দিতে!”
কাজু আবছায়ায় বিজনের দিকে তাকাল। ছেলেটা অনেক করছে ওর জন্য। বলল, “সাবধানে যাবি। আর রিস্ক নিবি না। কেমন? বাইরে কী পরিস্থিতি কেউ জানে না। আর নিজে না এসে সতুকেও আসতে বলতে পারিস। আর পারলে পেখমকে একটা খবর দিস যে, আমি ঠিক আছি। আচ্ছা আয় এবার।”
আবছায়া অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে কাজুর। ও দেখল, বিজন ওর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। তারপর সামনে রাখা সাইকেলটা নিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। চারিদিকে ঝিঁঝি আর রাতপাখির আচমকা চিৎকারের মাঝে কিটকিট করে সাইকেলের চেনের শব্দ আর ঘাসপাতার ওপর বিজনের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল কিছুক্ষণ। তারপর আবার সবকিছু যেন কেউ ঢেকে দিল স্তব্ধতার কালো নরম কাপড় দিয়ে।
আকাশের দিকে তাকাল কাজু। লালচে রং ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। মেঘলা হয়ে আছে। কেমন একটা স্যাঁতসেঁতে বিষণ্ণতা। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। এবার ঘাড় ঘোরাল কাজু। একটু দূরে জোনাক-বাড়ির পেছনের দিকে বড়-বড় গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে। চৌধুরীদের এই জায়গার কোনাকুনি গেলে জোনাক-বাড়ির পেছন দিকের একটা অংশ পড়ে। কিন্তু জায়গাটা এতটাই জঙ্গলে ঢাকা যে, যাওয়া সম্ভব নয় কারও পক্ষে।
কাজু জানে এখন কিছু করার নেই। বাড়িতে যে যাবে, সেটাও সুরক্ষিত নয়। সত্যি যদি ওকে পুলিশ খোঁজে, তা হলে বাড়িতেও ওরা হানা দেবে। আর, একবার ধরা পড়লে খুব মুশকিল। পেখমের সঙ্গে যাওয়াটাই আর হবে না। পেখম যে অন্য কারও হয়ে যাবে, এটা ভাবতেই পারে না কাজু। এটা মনে করলেই কেমন একটা করে শরীরে! মনে হয় এক্ষুনি সাংঘাতিক কিছু একটা হয়ে যাবে। কেমন কান্না পায়। পেখম এই পৃথিবীতে থাকবে আর ওর হবে না, এটা হয় নাকি! তাই কোনও ঝুঁকি ও নেবে না। বিজন বা সতু এসে বাইরের ‘সব ঠিক আছে’ ধরনের খবর দিলে তবে বেরোবে।
সামনে তাকিয়ে রইল কাজু। দেখল, জোনাকি উড়ছে। ঝিরঝির আলো জ্বালিয়ে জোনাকিরা উড়ছে। কী সুন্দর দেখতে লাগছে! মনে মনে গুনল কাজু। প্রায় কুড়িটা জোনাকি। ও ভাবল, ওদের জোনাক-বাড়িতে তো আরও আছে! এমন ঠান্ডা সুন্দর আলো আর কোথাও দেখেনি ও। হঠাৎ নয়নার কথা মনে পড়ল কাজুর!