আলো কমে সন্ধে হয়ে আসছিল। মানুষের অস্থিরতা বাড়ছিল আরও। আর বোমা পড়ছিল। কাজু দেখেছিল ফ্যাক্টরির পাঁচিল টপকে বোমাগুলো এসে পড়ছিল এদিকে। এ কী! মালিকরা তবে বোমা ফেলছে! ওদের পোষা গুন্ডারা এসব করছে! আর সেখানে পুলিশ তা হলে নিরীহ শ্রমিকদের ওপর লাঠি চালাচ্ছিল কেন? কাজুর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল। ও বুঝতে পারছিল ব্যাপারটা কী হচ্ছে! আস্তে-আস্তে পুলিশ বাড়ছিল সংখ্যায়। এরপর বিজনকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
আচমকা ফ্যাক্টরির গেট খুলে গিয়েছিল এবার। আর কাজু সন্ত্রস্ত হয়ে দেখেছিল, দশ-বারোজন লোক বেরিয়ে আসছে। হাতে রড, চপার আর সাইকেলের চেন! পরিস্থিতি যে কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা আঁচ করে কাজু আর দাঁড়ায়নি। ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে, মানুষজন পার হয়ে দৌড়েছিল বটগাছটা লক্ষ করে। আর তখনই বৃষ্টি নেমেছিল ফোঁটা-ফোঁটা। কাজু প্রাণপণে দৌড়েছিল বিজনের দিকে।
বটগাছের কাছে পৌঁছে কাজু দেখেছিল গেট থেকে বেরিয়ে আসা গুন্ডারা এদিকেই ধেয়ে আসছে! ওদের লক্ষ্য স্পষ্ট!
“কাজুদা, সাইকেল!” বিজন কাজুর হাত টেনে নিয়ে এসেছিল পাশের ঝোপটার দিকে। বলেছিল, “সতুদা বলেছিল সাইকেলটা এখানে লুকিয়ে রাখতে। বলেছিল এমন ঝামেলা হতে পারে। তুমি, তুমি চলো কাজুদা। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
সতু কোথায় গেল! যাদবদাদের নিয়ে ঠিকমতো পালাতে পারল তো! বিমলদা বলেছিল আসবে কিন্তু এল না তো!
আর-একটা বোমা এসে পড়েছিল কাছাকাছি। স্প্লিন্টার এসে লেগেছিল পাশের গাছে! হতভম্ব ভাবটা কিছুটা কেটেছিল।
“কাজুদা, ওরা তোমায় মারবে… পালাও!” বিজন ওর হাত ধরে টান মেরেছিল জোরে।
আর অপেক্ষা করেনি কাজু। দ্রুত সাইকেলটা টেনে নিয়ে উঠে পড়েছিল! বিজন লাফিয়ে পেছনের ক্যারিয়ারে বসেছিল। কাজু প্রাণপণে চালিয়ে দিয়েছিল সাইকেল!
পেছনে তেড়ে আসছিল লোকজন। বোমার শব্দ আসছিল। চিৎকার, গালিগালাজ আরও কী সব যে ভেসে আসছিল! কাজু কোনও দিকে না তাকিয়ে সাইকেল চালিয়ে দিয়েছিল গঙ্গার দিকে। নিজের জন্য খারাপ লাগছিল। এভাবে পালিয়ে এল ও! এভাবে চলে এল! সবাইকে ফেলে রেখে পালিয়ে এল! ওর ডাকেই তো আজকের গেট মিটিং হয়েছিল। বিমলদা তো করতে চায়নি। রাগ করেছিল। বলেছিল, “আবার তুই পাকামো শুরু করেছিস?”
পার্টি অফিসে বসে কথা বলছিল বিমলদা। সামনে রাখা চা-টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হুঁশ ছিল না বিমলদার। খুব রেগে গিয়েছিল, “তোকে কে বলেছে এসব করতে? আমি বারণ করিনি? মালিকরা যদি বন্ধ করে দেয় কারখানা, তা হলে শ্রমিকদের কী হবে? গোপেনরা বলবে, আমরা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি, বলবে আমরা শ্রমিক স্বার্থ দেখি না। সামনে ইউনিয়নের ভোট। সেখানে এসব বলে গোপেনরা প্রচার চালাবে। আমাদের অসুবিধে দেখবি না? তোকে আগেও একবার বলেছিলাম না?”
কাজু শুধু বলেছিল, “আমি শ্রমিকদের কথা ভেবেই এটা করেছি। যাদবকাকারাও আমাদের সঙ্গে আছে। আর আমরা তো স্ট্রাইক করছি না। জানাচ্ছি আমাদের কথা। সেটা আমাদের অধিকার বিমলদা। এটা কেউ কাড়তে পারবে না। আপনিও না। আমরা খারাপ বা ঋণাত্মক কিছু করছি না কিন্তু। আমি চাই আপনিও আসুন মিটিং-এ। আমরা ওদের পাশে আছি জানলে ওদের মনোবল বাড়বে। আর আপনি খালি ভোট নিয়ে চিন্তিত, সেটাও সফল হবে।”
পার্টি-অফিস তো আর চায়ের দোকান নয়। সেখানে বিমলদার একটা ইমেজ আছে। আর কাজুকে ভালবাসে এমন কর্মীর সংখ্যাও কম নয়!
বিমলদা কাজুর কথাটা গিলে নিয়েছিল যেন! তেতো গলায় বলেছিল, “ঠিক আছে, যাব না হয়। কিন্তু স্ট্রাইক বা কাজ বন্ধ করার কথা বলে উসকাবি না কাউকে! এটা যেন মনে থাকে!”
“মানুষের কথা বলা, তাদের অধিকার পাইয়ে দেওয়াটা কি উসকানো বিমলদা? আপনি দলের মাথা হয়ে এসব কী বলছেন?” কাজুর অবাক লেগেছিল খুব।
বিমলদা তাকিয়ে দেখেছিল কাজুর দিকে। তারপর চিবিয়ে-চিবিয়ে নিচু স্বরে, আশপাশের কেউ যেন শুনতে না পায় এমনভাবে বলেছিল, “শুয়োর, আমার অফিসে দাঁড়িয়ে আমায় জ্ঞান! তোর ব্যবস্থা হচ্ছে!”
কাজু হেসেছিল। তারপর সবাই যাতে শুনতে পায় এমন গলায় বলেছিল, “আপনার অফিস? সে কী! আপনি তাই ভাবেন নাকি? আর আমাদের কী ভাবেন, আপনার কর্মচারী? এটা পার্টির অফিস। আপনি কর্মী, আমরাও কর্মী। আপনি সিনিয়র। সম্মান সেটুকুই। তার বেশি নয়। আর যাতে আমরা আপনাকে সম্মান করতে পারি সেটা দেখার দায়িত্বও আপনার। জানবেন, আমরা বয়সে নবীন। আগামী পৃথিবী কিন্তু আমাদেরই হাতে।”
“কাজুদা, ক’টা বাজে!” বিজনের গলায় এখনও সতর্কতা!
কাজু ঘড়িটা দেখল। এখানটা বেশ অন্ধকার। তাও ঘড়ির কাঁটা জ্বলজ্বল করছে! সওয়া আটটা বাজে।
কাজু বলল, “চল, আমরা যাই। অনেকক্ষণ হল। মনে হয় সব ঠান্ডা হয়েছে।”
বিজন মাথা নাড়ল, “না, না, পাগল হয়েছ তুমি? পুলিশ তোমায় পেলেই ধরবে! জানো না এটা? আমি বাচ্চা ছেলে হয়েও জানি! আর তুমি বলছ, চল?”
কাজু চুপ করে গেল। পেখমের কাছে কি এই খবরটা পৌঁছেছে? নিশ্চয় পৌঁছেছে। ওর ছোটকা তো এখন জুটমিলের ম্যানেজার। আগে কাজুকে কী পছন্দ করতেন, কিন্তু এখন দেখা হলে এমন মুখ করেন! তা ছাড়া সবুজকাকু তো এসেছিলেন ফোর্স নিয়ে। আচ্ছা পেখমদের কী বলছে ওরা কাজুর নামে? কাজু গোলমাল পাকিয়েছে! কাজুর জন্যই এই গোলমাল হয়েছে! মিলের ভেতর থেকে যে বোমা মারা হয়েছে, সেটা কি ওরা জানে? মিলের ভেতর থেকে যে গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে ওদের ওপর, সেটাও কি জানে? কাজু জানে, পেখম কিছুই বিশ্বাস করবে না।