“মনখারাপ!” আইকা অবাক হল, “আর, ফোনও তো করা যেত। তাই না!”
রুপিন বললেন, “ফোন করলে মজা কই! প্লাস তোমার মাগোর কী হত! আর…”
“আর?” আইকা তাকাল এবার রুপিনের দিকে।
“আর, আমার কী হত আইকা! আমার যে খুব মনখারাপ করছিল তোমার জন্য। চাকরি ছেড়ে দিলে তো আর দেখতে পাব না তোমায়! তাই… ভাবলাম… শেষবার একবার দেখে আসি। আমি জানি আমার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। এসব ছেলেমানুষি করার আর বয়স নেই। কিন্তু তুমি বলো তো, আমরা কি সত্যি কোনওদিন বড় হই! এখনও তো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, স্কুলে যাওয়ার আগে মা আমার ভাত মেখে দিচ্ছে। এখনও তো পাহাড় দেখলে সেই কুড়ি বছর বয়সের মতো মনের মধ্যেটা কেমন করে। এখনও তোমার কথা মনে পড়লে আর সব কিছু বেকার, ফালতু মনে হয়। মনে হয় সদ্য কলেজে ওঠা আমিটা আবার কষ্ট পাচ্ছে। আমরা কি সত্যি কোনওদিনও বড় হই! বড় হওয়ার অভিনয় করতে করতে আমরা শেষমেশ সেটাকেই বিশ্বাস করতে শুরু করি মাত্র! আসলে আমরা বড় হই না। আমি জানি তুমি হয়তো বিরক্ত হচ্ছ। কিন্তু তাও আমায় ফিরিয়ে দিলেও এটা তো মনে রাখবে যে, একটা লোক এসেছিল তোমার জন্য সারা ভারতবর্ষ টপকে!”
আইকা কী বলবে বুঝতে পারল না। স্ট্রিট বাল্বের আলো এসে পড়েছে রুপিনের সাদা-কালো চুলে! ফরসা চামড়ায় আলো পিছলে যাচ্ছে! রুপিন হাসছেন ওকে দেখে। আর পুশকিনের কথা মনে পড়ছে আইকার— আমাদের যারা ভালবাসে, তাদেরও একবার সুযোগ দিতে হয়! তাদেরও একবার বলতে হয়, ‘রাজি!’
আইকা ঠোঁট কামড়ে তাকাল রাস্তার দিকে, শীতে, কুয়াশার তলায় কুঁকড়ে যাওয়া কলকাতার দিকে। শীত সত্যি কি শুধু সব কিছু নষ্টই করে দেয়? সব কিছু শেষ করে একা চণ্ডালের মতো জেগে থাকে ধ্বংসের মাঝে? নাকি শীত গত সময়ের ব্যবহৃত আবর্জনা সরিয়ে পৃথিবীকে নতুন করে বাঁচার জায়গা করে দেয়? আসলে শীত সেই জীবন তৈরি করে দেয়, যেখানে নতুন স্কুলের জামায় আবার ধুলো-মাটি লাগে। নতুন ব্ল্যাকবোর্ডে আবার শুরু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অঙ্ক, বিজ্ঞান আর নতুন দিনের বেঁচে থাকা। শীত আসলে সেই টবের মাটি তৈরি করে দেয় যাতে, আবার আগামী গ্রীষ্মের সন্ধের আবছায়ায় জেগে ওঠে বেলফুলের সুবাস। শীত মানুষকে নতুন শুরুর কথা বলে। পৃথিবীর দুর্লভ ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ আবার সামনে এনে দেয়। সুযোগ দেয় আগের ভুল শুধরে নেওয়ার, আবার নতুন করে ভাল থাকার। শীত সব বাধা আর খসে-পড়া গত পৃথিবীর অতিরিক্ত যা কিছু সমস্ত সরিয়ে মানুষকে দেয় আর-একবার চেষ্টা করার সুযোগ। জীবনে ফিরে আসার সু্যোগ।
আইকা দেখল, রুপিন তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। মুখে সামান্য হাসি। হয়তো হেরে যাওয়ার হাসি। রুপিন কি হেরে যাবেন? আইকার মনে হল তা হলে তো সেই মানুষগুলোও হেরে যাবে যারা কষ্ট পেয়েও, সব ভুলে আবার বিশ্বাস করেছিল। আবার হাত বাড়িয়েছিল। আবার চেষ্টা করেছিল। আইকা ভাবল রুপিন হেরে গেলে ও নিজেও তো হেরে যাবে।
আইকা এগিয়ে গেল এবার। রুপিনের চায়ের খুরিটা নিয়ে ফেলে দিয়ে হাত ধরল ওঁর। তারপর নরম গলায় বলল, “এসব খেতে হবে না। আর ভেতরে চলুন। ঠান্ডা লেগে যাবে। এই শীতটা ভাল নয়।”
রুপিনও আইকার হাতটা চেপে ধরলেন এবার। সামান্য হাসলেন। তারপর বললেন, “শীতের চেয়ে আর ভাল কিছু হতেই পারে না আইকা! ইট ব্রিংস পিপল হোম!”
.
৩৭. কাজু
প্রথম বোমাটা কে মেরেছিল সেটা ঠিক বুঝতে পারেনি কাজু। ফ্যাক্টরি গেটের সামনের কাঁঠালচাঁপা গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে মাইকে কথা বলছিল সতু। সামনে প্রায় হাজারদেড়েক লোক জটলা করছিল। সব শ্রমিক আসেনি। কিন্তু যা এসেছিল তাই অনেক। শেষ বিকেলের দিকে কথা ছিল কাজুও কিছু বলবে। কিন্তু ঠিক তখনই প্রথম বোমাটা পড়েছিল।
বোমার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কাজু দেখেছিল, ওর সামনের দুটো লোক হঠাৎ কেমন যেন দম শেষ হওয়া পুতুলের মতো টলে পড়ে গেল মাটিতে। মানুষজন দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিয়েছিল। চিৎকার, পুলিশের লাঠিচার্জ আর যন্ত্রণায় কাতরানো মানুষের ভিড়ে কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন দিশাহারা লাগছিল কাজুর। এই ভিড়ে তো বিজনও আছে। ওকে বারণ করা সত্ত্বেও তো এসেছিল। কাজুর মনে হয়েছিল বিজন কই! কোথায় গেল ছেলেটা! ওর যদি কিছু হয়ে যায়! বোমা পড়ছিল আরও। মানুষের আতঙ্ক বাড়ছিল সঙ্গে সঙ্গে। পুলিশ লাঠি নিয়ে নেমে পড়েছিল। কারা বোমা মারছে? কেন মারছে? ওরা তো শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত করছিল। ওদের অসহায়তা আর দাবির কথা বলছিল। সুদর্শন মালিক তো ওদের কোনও কথাই শুনছে না। তাই তো ওরা বাধ্য হয়ে জমায়েত করেছিল। সেখানে হঠাৎ বোমা পড়ল কেন! কারা ফাটাল? এইভাবে কি আন্দোলন ভেস্তে দেওয়া যাবে! না দেওয়া যায়?
কাজু ভিড় থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়েছিল। কোথায় গেল বিজন! এই ভিড়ের মধ্যে দৌড়োদৌড়ির চাপে পড়ে বিজনের কিছু হয়ে গেলে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
আর ঠিক তখনই দূরে একটা বটগাছের আড়ালে বিজনকে দেখেছিল ও। সতু ছিল কাজুর পাশে।
কাজু সতুকে বলেছিল, “তুই যাদবকাকা আর বাকিদের মিলের গলির পাশ দিয়ে বের করে দে। আমি বিজনকে নিয়ে যাচ্ছি!”
“পালা কাজু!” সতুর গলা কাঁপছিল উত্তেজনায়, “ওরা তোকে পেলে কিন্তু বিপদ হবে। তুই পালা!”