আইকা বিরক্ত হল। কে এমন করে বেল বাজাচ্ছে! ভেতরের ঘরে মা ঘুমোচ্ছে, উঠে পড়লে মায়ের শরীর খারাপ করবে।
ও নোঈকে ছেড়ে দ্রুত গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দেখল, ভীত-সন্ত্রস্ত মুখে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফ্ল্যাটের দারোয়ান সুশান্তর স্ত্রী, মালতী।
আইকার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। মাগোর কিছু হয়েছে কি? সুশান্ত পা ভেঙে বসে আছে। তাই মালতী হয়তো ওর কাছে এসেছে।
“কী হয়েছে রে?” আইকার গলা কেঁপে গেল।
“বিটিয়ার, মাথা… মাথা ফেটে গেছে…” মালতি কেঁদে ফেলল কথা বলতে গিয়ে।
“সে কী!” আইকা চিৎকার করে উঠল। তারপর বুঝল এখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন-উত্তর খেলে লাভ নেই। ও দ্রুত ঘরের ভেতরে গিয়ে মোবাইল আর টাকার ব্যাগটা নিল। তারপর গাড়ির চাবিটা নিতে গিয়ে থমকে গেল। আরে, গাড়িটা তো দু’দিন আগে গ্যারাজে দিয়েছে ঠিক করতে। ক্লাচটা কাজ করছিল না বলে। এখন কী হবে?
নোঈ নিজেকে সামলে নিয়েছে এসবের মধ্যে। ও বলল, “একটা অ্যাপ ক্যাব ডেকে নেব। নীচে চল তুই।”
আইকা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল। মাকে জাগানোর মানে হয় না। ঘুমোক। ও ঘরের চাবিটা দরজার পাশের টেবিলটা থেকে তুলে বাইরে পরার জুতোটা গলিয়ে নিল পায়ে। জামাকাপড় পালটানোর সময় আর নেই।
আইকা আর নোঈ দরজাটা টেনে দ্রুত বেরোল। মালতী আগেই লিফটের কল-সুইচ টিপে লিফটটাকে ওপরে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল।
আইকা লিফটে উঠে নোঈর দিকে নিজের মোবাইলটা বাড়িয়ে দিল, “দ্রুত একটা গাড়ি বুক কর।”
লিফট নীচে নামতেই আইকা ছিটকে বেরোল।
সুশান্ত বসে ছিল মেয়েকে ধরে। মাগো কাঁদছে। সুশান্ত মাথার কাছে একটা গামছা চেপে ধরেছে। লাল হয়ে গেছে সবুজ গামছা!
আইকার শরীরটা কেমন করে উঠল। মাগো ছটফট করছে। ওকে দেখে জল এসে গেল আইকার চোখে। ও কী করবে বুঝতে পারল না।
“দি, একটাও গাড়ি নেই। আজ বড়দিন না! কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না! শেয়ারও বলছে পনেরো মিনিট লাগবে!” নোঈ টেন্সড গলায় বলল।
“তা হলে?” আইকার কেমন লাগল শরীরটা। এবার কী করবে ও। কাছের যে পলিক্লিনিক আছে সেটা প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এখন এই ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ও যাবে কী করে?
এমনিতেই আইকা রক্ত দেখতে পারে না। সেখানে এখন কী হবে? ফ্ল্যাটের অন্য কারও হেল্প নেবে? কিন্তু তারা কি এখন হেল্প করবে?
আচমকা ফ্ল্যাটের মেন দরজার কাছে একটা গাড়ির হর্ন শুনতে পেল আইকা। এত রাতে কে এল? যেই হোক গাড়িটা যদি পাওয়া যায়?
আইকা দ্রুত সুশান্তর ছোট ঘরটা থেকে বেরিয়ে মূল ফটকের কাছে এল আর এসেই থমকে গেল একদম! দেখল, সাদা একটা ভাড়া করা সেডান থেকে নামছেন রুপিন!
আইকা কী বলবে বুঝতে পারল না। ও থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রুপিন! এখানে! এখন! কেন?
“স্যার প্লিজ়, গাড়িটা ছাড়বেন না!” নোঈ পাশ থেকে দৌড়ে গেল রুপিনের দিকে।
রুপিন, আইকা আর ওর পাশে নোঈকে দেখেই বুঝেছেন যে, কিছু একটা হয়েছে! সঙ্গে-সঙ্গে গাড়িওয়ালাকে জানলা দিয়ে বললেন, গাড়িটা লাগবে আরও।
আইকা দেখল, নোঈ ওই অবস্থায় মাগোকে নিয়ে এল। মালতীও এসেছে সঙ্গে। সুশান্ত খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। আইকা নিজেকে ঠিক করল।
মালতী উঠেছে গাড়িতে। মাগোকে ওর কোলে দিল নোঈ।
“তুই থাক এখানে। আর, এই নে আমার ফ্ল্যাটের চাবি, আমরা যাচ্ছি!” আইকা চাবিটা নোঈর হাতে দিয়ে মালতীর পাশে উঠে বসল।
নোঈ একবার দেখল রুপিনকে। ও অবাক হয়ে তাকাল। স্বাভাবিক। ও তো বুঝতে পারছে না কে লোকটা। কেন এভাবে এলেন! কেন কিছু না জেনে গাড়িটাকে দাঁড়াতে বললেন!
আইকা নোঈর দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলল, “আমার বস!”
রুপিন সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশে বসতে-বসতে আইকার মতো একই সুরে বললেন, “এক্স বস!”
মাগো ঘুমোচ্ছে এখন। বাচ্চাদের ওয়ার্ডে মাগো আর মালতীকে রাখা হয়েছে আজ রাতের মতো। মাথায় লেগেছে, তাই একটু অবজ়ার্ভ না করে তো আর ছাড়তে পারে না!
আইকা দেখে এসেছে মাগোকে। চারটে সেলাই পড়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে। মালতীও ওর পাশেই শুয়ে।
রিসেপশনে এসে দাঁড়াল আইকা। কাচের রিসেপশন। দেখা যাচ্ছে বাইরেটা। সামনে বড় রাস্তা শুনশান। রিসেপশনেও একজন বসে ঝিমোচ্ছে। ও মোবাইলটা দেখল। আড়াইটে বাজে।
রুপিন কোথায়! এখানেই তো ছিলেন। গেলেন কোথায়! এদিক-ওদিক তাকাল আইকা। আর তখনই দেখতে পেল রুপিনকে। রাস্তার ওপার থেকে আসছেন মানুষটা। কী করছে কী লোকটা! আইকা রিসেপশনের কাচের দরজা খুলে বেরোল রাস্তায়। দেখল, রুপিন হাতে দুটো মাটির খুরি নিয়ে আসছেন!
আইকা এগিয়ে গেল কাছে। রুপিনের সঙ্গে কথাই বলা হয়নি একটুও। সময়ই পায়নি। ও বলল, “স্যার, আপনি! এখানে এভাবে! সরি, এতক্ষণ কথাই বলতে পারিনি!”
রুপিন হাসলেন। আইকার হাতে একটা চায়ের খুরি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “আর স্যার কেন? তুমি তো রিজ়াইন করেছ। ওরা হয়তো রেজিগনেশন নিয়েও নেবে। ফলে টেকনিকালি আমি তোমার স্যার নই আর।”
“তা হলে এখানে কেন?”
রুপিন চায়ে চুমুক দিলেন একটা, নাক কুঁচকে বললেন, “মিষ্টি বেশি! কিন্তু এত রাতে যে পেলাম এই অনেক! তাই না!”
আইকা দেখল রুপিন হাসছেন।
“কী হল?” আইকা বিরক্ত হল এবার, “কী জিজ্ঞেস করছি?”
“সোনম বলত আমার উদ্যোগের অভাব আছে, জানো! তাই আমার দ্বারা কিছু হবে না! তাই ভাবলাম অনেক হয়েছে। যার জন্য মনখারাপ করছে সে কেন রিজ়াইন করল, একবার জেনে আসি।”