নোঈ বলেছিল, “যা বলার আমাকে বললেই পারতিস! মায়ের কাছে গিয়ে এসব বলার কী ছিল! আর, আমি তো বড় হয়েছি। কার সঙ্গে কোথায় যাব সেটা কেউ ঠিক করে দেবে কেন?”
“কী বলছিস তুই নোঈ?” আইকা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
নোঈ আর লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে সিঁড়ির দিকে যেতে-যেতে বলেছিল, “এভাবে কারও পেছনে স্পাইয়ের মতো নজর রাখার কোনও মানে হয় না। এতটা চিপ তো তুই ছিলি না দি! আই পিটি ইউ।”
আইকার খারাপ লেগেছিল খুব। নোঈ এমন করে বলল! ও স্পাইগিরি করেছে! ওর নামে পুটুমাসির কাছে লাগিয়েছে! এসব কী করে বলল ও? পুটুমাসি কি এসব বলেছে ওকে? কষ্টে আর অপমানে আইকার ভেতরটা কেমন গুটিয়ে গিয়েছিল। নোঈকে কত ভালবাসে ও! ওর জন্য পুশকিনের কাছে গিয়েছে বলতে যে, পুশকিন কী ভাবছে। নোঈ যেন কোনও কষ্ট পুশকিনের কাছ থেকে না পায়। আর সেখানে নোঈ ওর সঙ্গে এমন করল! আইকার একবার মনে হয়েছিল পুটুমাসির কাছে যায়। কিন্তু মত পালটেছিল। কেন যাবে? ও যা করেনি, সেটা ওকে কেন গিয়ে প্রমাণ করতে হবে? না, ও যাবে না। তার জন্য যদি ওর সঙ্গে কেউ কথা না বলে, না বলুক! নোঈ কোনওদিন যদি ভুল বুঝতে পারে, তা হলে কথা হবে, না হলে হবে না। ওর আর সেই বয়স নেই যে, জনে-জনে গিয়ে ওকে লোকের ভুল ভাঙাতে হবে।
কিন্তু আজ নোঈ কী বলতে চায়! আরও খারাপ কিছু বলবে নাকি?
আইকা চেয়ার থেকে উঠে চটিটা গলাল পায়ে। বেশ ঠান্ডা আজ। কট্সউলের ওভারকোট পরেও ঠান্ডা লাগছে!
ও দরজার সামনে গিয়ে ‘কি-হোল’-এ চোখ রাখল। দেখল, নোঈ দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। চোখে চশমা।
দরজাটা খুলে আইকা দাঁড়াল। নোঈ কী বলতে চায়?
নোঈ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আইকার দিকে। তারপর আচমকা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আইকাকে!
ঘটনার আকস্মিকতায় আইকা আর-একটু হলে পড়ে যাচ্ছিল! কিন্তু দরজার ফ্রেমটা ধরে নিজেকে সামলাল।
ও বুঝল নোঈ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে কাঁদছে! নোঈর শরীরটা কাঁপছে থরথর করে!
“কী হল? নোঈ? আরে নোঈ… কী হয়েছে তোর? এই দ্যাখো পাগলামি করে! কী হয়েছে বলবি তো?” আইকা নোঈকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল। তারপর কোনওরকমে দরজাটা বন্ধ করল। নোঈ কিছুতেই ছাড়ছে না ওকে। কেমন বাচ্চাদের মতো আঁকড়ে ধরে আছে!
ও এবার জোর করে নোঈকে ছাড়াল। সোজা করে দাঁড় করাল। নোঈর চশমা বেঁকে গেছে। সারা মুখ লেপটে আছে কান্নায়। নোঈ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে!
আইকা জোর করে থুতনিটা ধরে মুখ তুলল ওর, “কী হয়েছে?”
নোঈ কাঁপছে। হেঁচকি তুলছে। তার মধ্যেও বলল, “আমি… সরি দি… আমি না জেনে… আসলে মাসি বলেছে মাকে… আমাকে আর পুশকিনদাকে… মানে…”
আইকা বুঝল এবার। সেদিন নোঈ আর পুশকিনকে রেস্তরাঁয় ঢুকতে শুধু ও নিজেই দেখেনি। মা-ও দেখেছিল। আর মা সেই ঘটনাটা পুটুমাসিকে বলেছে। কোনও মানে আছে! মা আইকাকে পুরো ব্যাপারটাই চেপে গিয়েছে। জানে, আইকা জানলে বকবে।
আইকার হাসি পেল হঠাৎ। নোঈটা খুব ছেলেমানুষ। এই রাগ করছে! এই কাঁদছে! কী যে করছে ঠিক নেই। পুটুমাসিও পারে! নিশ্চয় খুব আজেবাজে কথা বলেছে!
আইকা নোঈকে দু’হাতে ধরে বলল, “ও! এখন কান্নাকাটি করে ম্যানেজ করা হচ্ছে? এবার যদি আমি বকি? কান মুলে দিই তা হলে? তখন কী হবে?”
নোঈ আইকার হাতটা ধরে নিজের গালে থাপ্পড় মারার চেষ্টা করল। বলল, “আমায় মার তুই, আমায় মার…”
“আবার এসব করে!” আইকা হাসি চেপে নিজের গলাটা কড়া করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। হেসেই ফেলল, “পাগলি একটা! এমন কেউ করে? আরে, তোর ভুল হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছিস, এনাফ। আর কিছু বলতে হবে না!”
নোঈ চশমা খুলে জামার হাতায় চোখ আর গাল মুছল। এখনও মেয়েটা হেঁচকি তুলছে অল্প। আইকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সত্যি কী বলে ক্ষমা চাইব জানি না। আজ দিনটা আমার কাছে খুব ইমপর্ট্যান্ট, জানিস দি। আজ আমায় ডিসাইড করতে হবে আমি জীবনে কোন দিকে, কার দিকে যাব। আর আজ মায়ের কাছে এটাও জানলাম যে, তুই কিছু বলিসনি। আমি যে কী খারাপ বিহেভ করেছি তোর সঙ্গে!”
“আমার সঙ্গেই তো করেছিস। আমায় নিজের ভাবিস বলেই তো করেছিস। তা হলে! এখন এসব রাখ।”
নোঈ চোখ মুছে বলল, “মা বলল, তুই নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস কাল। সত্যি?”
আইকা হাসল। খবরটা ঠিক পেয়ে গিয়েছে! মায়ের পেটে যদি কিছু খবর থাকে! ও বলল, “হ্যাঁ রে। ভাল লাগছিল না। ম্যানেজমেন্ট এমন একটা ডিসিশন নিল!”
“কেন?” নোঈ চোখ মুছল। কথার ভেতর এখনও একটা হালকা কাঁপন আছে কান্নার।
“আরে, ওই সোনাঝুরির প্রজেক্টটা আর আমরা করছি না। আমায় আবার ফিল্ড থেকে সরিয়ে গোডাউনে দিয়ে দিয়েছে। মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু ভাবটা এই যে, আমার জন্য প্রজেক্টটা হয়নি। আরে, মালিকরাই ডিসাইড করতে পারছে না তো আমি কী করতে পারি! কিন্তু ওরা কথাই শোনেনি। এটা তো ইনসাল্ট! আমি তাই ছেড়ে দিয়েছি। আমার কাছে দু’-একটা অফার আছে। দেখি।”
“কিন্তু একটা কাজ পেয়ে ছাড়লে হত না! আর এভাবে হঠাৎ…”
আইকা বলল, “তুইও তো হঠাৎ ছেড়েছিলি, মনে আছে? কিছু জিনিস ইমপালসে করতে হয়! না হলে…”
আইকা কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই আচমকা ডোরবেলটা টিংটং টিংটং করে কয়েকবার বেজে উঠল। শুনেই বোঝা যাচ্ছে কারও খুব তাড়া আছে।