আইকার অবাক লেগেছিল! পুশকিন তা হলে এটা বলেনি কেন! শোভনের নাম তো বলতেই পারত! কিন্তু তাও বলেনি! কেন? বন্ধুকে বাঁচাতে! লয়ালটি!
বুকের ভেতর কেমন একটা কষ্ট হয়েছিল আইকার! বুঝতে পেরেছিল হিংসের চোটে বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে ওর! পুশকিনের দিকে দূর থেকে তাকিয়ে থাকত আইকা! দেখত কেমন একা হয়ে গিয়েছে ছেলেটা! রাতে শুয়ে পুশকিনের মুখটা মনে পড়লে কান্না পেত আইকার! এত কষ্ট হত যে মনে হত, এর থেকে কী করে নিস্তার পাবে! কে বাঁচাবে ওকে এই খারাপ লাগা থেকে! যাকে ও ভালবাসল তার ক্ষতি করে দিল! কেমন মানুষ ও!
এক বৃষ্টির দিনে লাইব্রেরির পাশের দেবদারু গাছের নীচে পুশকিনকে ধরেছিল আইকা! একটা সিমেন্টের বেঞ্চে বসেছিল পুশকিন। মাথায় ছাউনি ছিল বলে বৃষ্টি লাগছিল না ওর গায়ে! সামান্য হেঁটে, সামান্য ছুটে পুশকিনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল আইকা। পুশকিন মুখ তুলে ওকে দেখে কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল! কী করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল!
আইকা সময় নিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, “আমি সরি পুশকিন। আমি বুঝতে পারিনি। আসলে আমি…”
পুশকিন হাত তুলে থামিয়েছিল ওকে। তারপর বলেছিল, “কিন্তু কেন? কেন এমন করলি তুই! আমি রিয়াকে পছন্দ করি না! আমি তো… আমি… তুই এমনটা করতে পারলি! আমার জীবনে কত বড় দাগ পড়ে গেল বল তো!”
আইকাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে সেই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে চলে গেছিল পুশকিন! আর কোনওদিন কথা বলেনি ওর সঙ্গে!
তারপর কতবার ভেবেছে আইকা, পুশকিন কী বলতে গিয়ে বলল না! ওর কাকে পছন্দ ছিল! অসমাপ্ত বাক্যের শেষে কে দাঁড়িয়েছিল!
পুশকিনের রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, সেই রাতে পুরনো সব কথা এক নিমেষে মনে পড়ে গিয়েছিল! সেই পুশকিন ওর সামনে দাঁড়িয়ে! কফি করছে! আজও পুশকিনের কথা ভাবলে ওর মনের মধ্যে কী একটা যেন হয়! কিন্তু আইকা সেই বয়সে পৌঁছে গিয়েছে যেখানে ও বুঝতে পারে, সব হওয়াগুলোর পরিণতি নেই! কিছু মনে হওয়া একলা, নির্জন! তাদের কোনও বন্ধু নেই!
রুপিনের কথাটা সেই রাতে পুশকিনকে বলেছিল আইকা। বলেছিল, “আমি এখনও কিছু বলিনি জানিস! কী করব বুঝতে পারছি না!”
পুশকিন বলেছিল, “লোকটা ভাল হলে হ্যাঁ করে দে। কিন্তু কী কেস বল তো? আমার নোঈকে পছন্দ, তোর বসের তোকে পছন্দ! ব্যাপারটা কী? দেখবি, যখন তোর সঙ্গে অদ্ভুত কিছু ঘটবে, তখনই আশপাশে সিমিলার ইনসিডেন্টস চোখে পড়বে তোর! এটা অদ্ভুত একটা কোইন্সিডেন্স! তাই না?”
“কিন্তু কী করব বল!” আইকা জিজ্ঞেস করেছিল পুশকিনকে।
পুশকিন হেসে বলেছিল, “তোকে কে ভালবাসে জানবি, সেটাই বেশি ইমপর্ট্যান্ট। লোকটা তোকে ভালবাসলে গো ফর ইট। তোর একটা কম্প্যানিয়ান তো হবে। ওটাও খুব দরকার।”
আইকা হেসেছিল। তারপর আর বেশিক্ষণ বসেনি। শুধু চলে আসার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “পুশকিন, তোর সেই দেবদারু গাছের তলায় বৃষ্টির দিনটা মনে আছে?”
পুশকিন থমকে গিয়েছিল। কিছু না বলে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
আইকা সামান্য হেসে বলেছিল, “আমার মনে আছে। আচ্ছা, সেদিন একটা সেনটেন্স শুরু করেও শেষ করিসনি। রিয়াকে তোর পছন্দ ছিল না তুই বলেছিলি। কিন্তু কাকে পছন্দ ছিল তবে? সেটা বলতে গিয়েও বলিসনি।”
পুশকিন হেসে বলেছিল, “আর মনে নেই। কতদিন আগের কথা। প্লাস সেদিন এত বৃষ্টি হয়েছিল যে, সব ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে। সেই পুশকিনটা ধুয়েমুছে পৃথিবী থেকে মিলিয়ে গেছে রে আইকা! সে বা তার ইচ্ছেগুলোও আর নেই!”
নিঃশব্দে সামনে রাখা মোবাইলটা কড়কড় করে নড়ে উঠল। এখন কে ফোন করল, রুপিন? আচমকা রুপিনের নামটা মনে আসতেই নিজের লজ্জা লাগল আইকার। ও কি মনে মনে আশা করছে যে, ওর ই-মেল পেয়ে রুপিন ওকে ফোন করবেন? কেন করবেন? রুপিনকে ও উত্তর দেয়নি কিছু। একরকম ইগনোরই করেছে! তারপর রুপিনের অনুপস্থিতিতে ই-মেলে রেজিগনেশন পাঠিয়েছে! ও নিজেও তো রুপিনকে ফোন করতে পারত। ওর রাগের কথা, কষ্টের কথা বলতে পারত। তা তো করেনি! তা হলে রুপিন কেন ফোন করবেন? কিন্তু যদি করতেন? আইকার মনটা আবার না-মেলা অঙ্কের মতো হয়ে গেল। ও ফোনটা তুলল। আরে নোঈ! এখন! মেয়েটা তো ওর সঙ্গে কথা বলছে না! ওর ওপর রেগে আছে! তা হলে এমন সময় ফোন করল কেন!
আইকা চিন্তা করল একটু। তারপর ফোনটা ধরল, “বল।”
“দরজা খোল দি। আমার তোর সঙ্গে কথা আছে। বেল বাজালাম না। কারণ, মাসির ঘুম ভেঙে যাবে। খোল।”
আইকা ফোনটা রেখে দিল। বুঝতে পারল না ব্যাপারটা কী! হঠাৎ নোঈ কী বলতে চায়!
আইকার মনে পড়ল কিছুদিন আগে নোঈ আচমকা ওকে লিফটের সামনে ধরেছিল! ওদের অফিসের টাইমিং-এর জন্য আজকাল খুব একটা দেখা হয় না। তাই নোঈকে দেখে ভাল লেগেছিল আইকার।
বলেছিল, “কী রে? কেমন আছিস? পাত্তাই নেই তোর!”
নোঈ গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “কেমন আছি জানিস না দি? মায়ের কাছে যখন গিয়ে লাগিয়েছিস আমি আর পুশকিনদা কোনও রেস্তরাঁয় ঢুকছি, তখন জানিস না মা কেমন রাখতে পারে আমায়!”
“মানে?” নোঈর এমন ব্যবহারে খুব ঘাবড়ে গেছিল আইকা! নোঈ এমনিতে চুপচাপ থাকে। ব্যবহার খুব ভাল। সে এমন করে ওর সঙ্গে কথা বলছে কেন! ওর মনে হয়েছিল পুশকিন কি ওই রাতে ওর কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা বলেছে নোঈকে? কিন্তু পুশকিন সেটা বলার মতো ছেলে নয়! আর পুটুমাসির সঙ্গে তো নোঈকে নিয়ে কোনও কথাই হয়নি! তা হলে! পুটুমাসি কী বলেছে! নোঈ এমন করে কথা বলছে কেন!