অঞ্জন ফিরেছে। ছন্দা বাড়ির পিছন দিকে একটা প্রকাণ্ড আলো-জ্বলা ঘর দেখিয়ে বলল, ওই ঘরটা ছিল সুমি আর রঞ্জনদার। এখন অঞ্জন থাকে।
ঘরের ভেতর থেকে বাজনার শব্দ। জ্যাজ। সো জেঠ। ইউ আর হিয়ার…কাল সন্ধেবেলা সেই একটাই কথা হয়েছিল অঞ্জনের সঙ্গে। তারপর ও বেরিয়ে গেল বন্ধুদের সঙ্গে। আজ সকাল থেকে দেখা পাইনি। কী করছে ছেলেটা। কোথায় যাচ্ছে। আজ ওর সঙ্গে কথা বলব। ওকে আটকাব। রঞ্জন নেই। সুমি নেই। আমি আছি। আমি ওর গার্জেন। ওর দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে।
সূর্য নেভাদা পর্বতমালার পিছনে অস্ত গেছে। আমার অজান্তে কখন যে সব অন্ধকার হয়ে গেল! মাঠের ধারে ধারে, কোর্ট-ইয়ার্ড, ড্রাইভওয়ে, সামনেরলন সর্বত্র বাতিস্তম্ভগুলি জ্বলে উঠেছে। ফেরার পথে দেখলাম জীয়নের একটা খেলনা মোটরগাড়ি মার্সেডিজের বনেটের ওপর। দূরে, আল কাপিতান।
অন্ধকারেও দেখা যায়। ছন্দা বলল, সাদা তো।
০৮. হিরোসিমা, মাই লাভ
১ মে।
কাল ফিউনারাল। জেফ সত্যিই কামাল করেছে। কলকাতায় ওদের কোনও আমেরিকান সমস্যার কথা উঠলে রঞ্জন সুমিতাকে বলত, ও নিয়ে ভেবো না। জেফ জানে। ও ঠিক ম্যানেজ করবে। সুমিতা বিশ্বাসও করত। তা, সে খুব ভুল করত না।
আজ গোটা বে-এরিয়ার এবং এখানকার সমস্ত কাগজে ফিউনারালের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়ে গেছে। সকলকে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে অঞ্জনের নামে। জেফ আমার নাম দিতে চেয়েছিল। আমি বারণ করি। ফিউনারালের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে আইভার্স অ্যান্ড অ্যালকর্ন ফিউনারাল হোম। আজ ১টার সময় ফিউনারাল সার্ভিস হবে মে-ফেয়ার গ্রাউন্ডের কাউন্টি হলে। সেখানে তিনটি ক্যাসকেটের মধ্যে থাকবে তিনটি কফিন। ডাঃ চ্যাটার্জি ও মিসেস চ্যাটার্জির জন্য জেফ ৭৫০ ডলার দামি দুটি ক্যাসকেট কিনতে বলেছে, যা ওদের মর্যাদার উপযুক্ত। জীয়নের জন্য ৩২৫ ডলারের ক্যাসকেট। সাক্ৰামেন্টো থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের অনাথানন্দ স্তোত্রপাঠ করতে আসছেন। খ্রিস্টীয় মতেও কিছুটা হবে। পাদ্রী আসবেন। স্কুলের মেয়েরা শোকগীতি গাইবে।
অতিথিদের রাত্রিবাসের জন্য একটা মোটেল পুরোটা ভাড়া করা হয়েছে। ২০টা ঘর। “কাছেদূরে বেকার্সফিল্ড, ওকল্যান্ড, ফ্রেজনো, হেওয়ার্ড, বার্কেলে, হ্যামেট, সানহোজে, সানফ্রান্সিসকো, ডেভিস, মারিপোজে, মডেরা—সর্বত্র থেকে ওদের বন্ধু ও গুণগ্রাহীরা কাল থেকেই আসতে শুরু করেছে। ডেভিস থেকে আসছেন ডাঃ গ্রেওয়াল এবং তাঁর স্ত্রী সুজানা। উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়াটল থেকে রঞ্জনের বেলুড়ের বন্ধু চুনী ফোন করেছিল। সেই হরি সিং ট্রাভেল এজেন্ট যেচারমূর্তিকে থার্ড ক্লাসে তুলে ১৯৬১-তে বিলেত পাঠায়, তাদের একজন। বিলেতে ১০ বছর একসঙ্গে ছিল, শীতে দুজনে একটা কালো ওভারকোট ভাগাভাগি করে পরেছে, চুনী বলল, সে আসছে। ইস্ট কোস্ট থেকেও একটি দম্পতি আসছে। দেবেন ব্যানার্জি ও তাঁর স্ত্রী অমিয়া। এরা আটলান্টা থেকে প্লেন ধরেছে বলে ওদের মেয়ে একটু আগে আমাকে জানিয়েছে। গত দুদিনে ইন্টারস্টেট ফোন বেজেছে বার কুড়ি। সবাই ফিউনারালে আসতে পারা বা না-পারার কথা জানাচ্ছে। খাবারে আর ফুলে দুটি ঘর ভরে গেছে।
ফ্রিমন্ট থেকে এসেছে ধূর্জটি পালিত। বিকেল ৪টের সময় ৭০ মাইল দূরে মডেস্টো শহরের ক্রিমেশান হোমে ইলেকট্রিক চুল্লিতে শবদাহ। রাতে এ বাড়ির আউট-ইয়ার্ডে শ্মশানবন্ধুদের একটি বুফে-টাইপ ডিনারে নিমন্ত্রণ। এত কিছু ব্যবস্থা সে, জেফ, একা করেছে। এ ছাড়া কামপারাটা আমি যাতে ব্যবহার করতে পারি, সে জন্যে সুবিবেচক সে একজন ড্রাইভার নিয়োগ করেছে। মুভমেন্ট ব্যাপারে কারও ওপর নির্ভর করা আমার পক্ষে উচিত হবে না, ছন্দারা ফিউনারালের পরদিন চলে যাচ্ছে। তাছাড়া, অ্যাজ ইট গোজ হিয়ার, ইউ নো, ইফ ইউ ডু নট পজেস ইওর ওন কার, ইউ আর নট নেসেসারিলি অ্যান আন-আমেরিকান জেফ রসিকতা করে বলল, বাট ইউ সার্টেনলি আর অ্যান আন-ক্যালিফোর্নিয়ান।
এহ বাহ্য, অঞ্জনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মল-এর বিখ্যাত দোকান পারভিন্স থেকে একদিনের মধ্যে কালকের দিনের জন্য একটা কালো স্যুট করিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু অঞ্জন আমাকে ধরাছোঁয়া দিচ্ছে না। পাত্তা দিচ্ছে না একদম। অলমোস্টইগনোর করছে। ডাকলে সাড়া দিচ্ছে, নইলে কথা বলছে না। ও আমাকে বরাবরই পছন্দ করে না। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনও সেই পোর্ট অফিসেই চাকরি করছ? ঠেসটা হল, অর্থাৎ কিনা, সেই গরিবই আছ? এত দূর স্পর্ধা! আমি ওকে অনেক চিঠি দিয়েছি, উত্তর দেয়নি। কলকাতায় এলে অনেক ভালবাসার চেষ্টা করেছি, উপহার দিয়েছি, কিন্তু সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেনি। বাবার গরিব আত্মীয়দের ও পছন্দ করে না। এবং অপছন্দ বা ঘৃণা করার চেয়ে যা বেশি, ওর মনে তাদের সম্পর্কে কোনও কৌতূহল নেই। জিজ্ঞাসা নেই।
ও নন্দিনের সঙ্গেও আগাগোড়া খুবই খারাপ ব্যবহার করেছে। নন্দিন আমাকে লিখত। তুমি কেন এসেছো? এই ছিল ওর মুখের বুলি।
আমি জানি, এর জন্যে দায়ী রঞ্জন। সে দেশ ও আত্মীয়দের তথা দেশজ কোনও কিছুকেই ছেলেদের শ্রদ্ধা করতে শেখায়নি। আমরা যা গরিব ছিলাম না! বাক্যটিকে ভূরিভোজনের পর ভাজামৌরি হিসেবে ব্যবহার করতে করতে, শুধু দারিদ্র্য নয়, ও ছেলেদের ওর দেশের দরিদ্রদের ঘৃণা করতে শিখিয়ে গেছে। নিজের হঠকারিতাকে জাস্টিফাই করার জন্যে ওকে এটা করতে হয়েছে, আমি ভাল করেই জানি যে, যারা দেশে আছে তারা ভাল নেই। সুখে নেই। কারণ, তারা গরিব। আমরা সুখে আছি। আমরা ভাল আছি। কারণ, আমরা বিদেশে থাকতে বাধ্য হলেও, বড়লোক। দেশের গরিবের চেয়ে বিদেশের বড়লোক ভাল।