- বইয়ের নামঃ অপ্রচলিত রচনা
- লেখকের নামঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
কবিতা : আজিকার দিন কেটে যায়
আজিকার দিন কেটে যায়,—
অনলস মধ্যাহ্ন বেলায়
যাহার অক্ষয় মূর্তি পেয়েছিনু খুঁজে
তারি পানে চেয়ে আছি চক্ষু বুজে৷
আমি সেই ধনুর্ধর যার শরাসনে
অস্ত্র নাই, দীপ্তি মনে মনে,
দিগন্তের স্তিমিত আলোকে
পূজা চলে অনিত্যের বহ্নিময় স্রোতে৷
চলমান নির্বিরোধ ডাক,
আজিকে অন্তর হতে চিরমুক্তি পাক৷
কঠিন প্রস্তরমূর্তি ভেঙে যাবে যবে
সেই দিন আমাদের অস্ত্র তার কোষমুক্ত হবে৷
সুতরাং রুদ্ধতায় আজিকার দিন
হোক মুক্তিহীন৷
প্রথম বাঁশির স্ফূর্তি গুপ্ত উৎস হতে
জীবন–সিন্ধুর বুকে আন্তরিক পোতে
আজিও পায় নি পথ তাই
আমার রুদ্রের পূজা নগণ্য প্রথাই
তবুও আগত দিন ব্যগ্র হয়ে বারংবার চায়
আজিকার দিন কেটে যায়॥
এই কবিতাটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এটি ১৯৪০-এর আগের রচনা।
কবিতা : চরমপত্র
তোমাকে দিচ্ছি চরমপত্র রক্তে লেখা;
অনেক দুঃখে মথিত এ শেষ বিদ্যে শেখা৷
অগণ্য চাষী-মজুর জেগেছে শহরে গ্রামে
সবাই দিচ্ছি চরমপত্র একটি খামে :
পবিত্র এই মাটিতে তোমার মুছে গেছে ঠাঁই,
ক্ষুব্ধ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত ‘স্বাধীনতা চাই’৷
বহু উপহার দিয়েছ,—শাস্তি, ফাঁসি ও গুলি,
অরাজক, মারী, মন্বন্তরে মাথার খুলি৷
তোমার যোগ্য প্রতিনিধি দেশে গড়েছে শ্মশান,
নেড়েছে পর্ণকুটির, কেড়েছে ইজ্জত, মান!
এতদিন বহু আঘাত হেনেছ, পেয়ে গেছ পার,
ভুলি নি আমরা, শুরু হোক শেষ হিসাবটা তার,
ধর্মতলাকে ভুলি নি আমরা, চট্টগ্রাম
সর্বদা মনে অঙ্কুশ হানে নেই বিশ্রাম৷
বোম্বাই থেকে শহীদ জীবন আনে সংহতি,
ছড়ায় রক্ত প্লাবন, এদেশে বিদ্যুৎগতি৷
আমাদের এই দলাদলি দেখে ভেবেছ তোমার
আয়ু সুদীর্ঘ, যুগ বেপরোয়া গুলি ও বোমার,
সে স্বপ্ন ভোলো চরমপত্র সমুখে গড়ায়,
তোমাদের চোখ-রাঙানিকে আজ বলো কে ডরায়?
বহু তো অগ্নি বর্ষণ করো সদলবলে,
আমরা জ্বালছি আগুন নেভাও অশ্রুজলে৷
স্পর্ধা, তাইতো ভেঙে দিলে শেষ-রক্তের বাঁধ
রোখো বন্যাকে, চরমপত্রে ঘোষণা : জেহাদ॥
কবিতা : চৈত্রদিনের গান
চৈতীরাতের হঠাৎ হাওয়া
আমায় ডেকে বলে,
“বনানী আজ সজীব হ’ল
নতুন ফুলে ফলে৷
এখনও কি ঘুম-বিভোর?
পাতায় পাতায় জানায় দোল
বসন্তেরই হাওয়া৷
তোমার নবীন প্রাণে প্রাণে,
কে সে আলোর জোয়ার আনে?
নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া;
তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তেরই হাওয়া৷
ওঠ্ রে আজি জাগরে জাগ
সন্ধ্যাকাশে উড়ায় ফাগ
ঘুমের দেশের সুপ্তহীনা মেয়ে৷
তোমার সোনার রথে চ’ড়ে
মুক্তি-পথের লাগাম ধ’রে
ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে৷
রক্তস্রোতে তোমার দিন,
চলেছে ভেসে সীমানাহীন৷
তারে তুমি মহান্ ক’রে তোল,
তোমার পিছে মৃত্যুমাখা দিনগুলি ভোল॥”
‘চৈত্রদিনের গান’ কবিতাটি বিজনকুমার গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ছোটদের ‘শিখা’ পত্রিকার জন্য রচিত৷ রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪০৷
কবিতা : জবাব
আশংকা নয় আসন্ন রাত্রিকে
মুক্তি-মগ্ন প্রতিজ্ঞায় চারিদিকে
হানবে এবার অজস্র মৃত্যুকে;
জঙ্গী-জনতা ক্রমাগত সম্মুখে৷
শত্রুদল গোপনে আজ, হানো আঘাত
এসেছে দিন; পতেঙ্গার রক্তপাত
আনে নি ক্রোধ, স্বার্থবোধ দুর্দিনে?
উষ্ণমন শাণিত হোক সঙ্গীনে৷
ক্ষিপ্ত হোক, দৃপ্ত হোক তুচ্ছ প্রাণ
কাস্তে ধরো, মুঠিতে এক গুচ্ছ ধান৷
মর্ম আজ বর্ম সাজ আচ্ছাদন
করুক : চাই এদেশে বীর উৎপাদন৷
শ্রমিক দৃঢ় কারখানায়, কৃষক দৃঢ় মাঠে,
তাই প্রতীক্ষা, ঘনায় দিন স্বপ্নহীন হাটে৷
তীব্রতর আগুন চোখে, চরণপাত নিবিড়
পতেঙ্গার জবাব দেবে এদেশের জনশিবির॥
‘জবাব’ কবিতাটি কার্তিক ১৩৫০-এর পরিচয় পত্রকায় প্রকাশিত হয়েছিল৷ কবিতাটি অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর সৌজন্যে প্রাপ্ত৷
কবিতা : দেবদারু গাছে রোদের ঝলক
দেবদারু গাছে রোদের ঝলক, হেমন্তে ঝরে পাতা,
সারাদিন ধ’রে মুরগীরা ডাকে, এই নিয়ে দিন গাঁথা৷
রক্তের ঝড় বাইরে বইছে, ছোটে হিংসার ঢেউ,
খবরে কাগজ জানায় সেকথা, চোখে দেখি নাকো কেউ॥
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রচিত এই কবিতাটি খুলনার ‘সপ্তর্ষি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ শয্যাশায়ী সুকান্ত ‘রেড-এড কিওর হোম’ হাসপাতালের রাইটিং প্যাডে এটি লিখে পাঠান৷ কবিতাটি মনীশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত৷
কবিতা : নব জ্যামিতির ছড়া
Food-Problem
(একটি প্রাথমিক সম্পাদ্যের ছায়া অবলম্বনে)
সিদ্ধান্ত :
আজকে দেশে রব উঠেছে, দেশেতে নেই খাদ্য;
‘আছে’, সেটা প্রমাণ করাই অধুনা ‘সম্পাদ্য’৷
*
কল্পনা :
মনে করো, আসছে জাপান অতি অবিলম্বে,
সাধারণকে রাখতে হবে লৌহদৃঢ় ‘লম্বে’৷
“খাদ্য নেই” এর প্রথম পাওয়া খুব ‘সরল রেখা’তে’,
দেশরক্ষার ‘লম্ব’ তোলাই আজকে হবে শেখাতে৷
*
অঙ্কন :
আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীর ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে,
প্রতিরোধের বিন্দুতে নাও ঐক্য-রেখা এঁকে!
‘হিন্দু’-‘মুসলমানে’র কেন্দ্রে, দুদিকের দুই ‘চাপে’,
যুক্ত করো উভয়কে এক প্রতিরোধের ধাপে৷
প্রতিরোধের বিন্দুতে দুই জাতি যদি মেলে,
সাথে সাথেই খাদ্য পাওয়ার হদিশ তুমি পেলে৷
*
প্রমাণ :
খাদ্য এবং প্রতিরোধ উভয়েরই চাই,
হিন্দু এবং মুসলমানে মিলন হবে তাই৷
উভয়ের চাই স্বাধীনতা, উভয় দাবী সমান,
দিকে দিকে ‘খাদ্যলাভ’ একতারই প্রমাণ৷
প্রতিরোধের সঠিক পথে অগ্রসর যারা,
ঐক্যবদ্ধ পরস্পর খাদ্য পায় তারা॥
‘নব জ্যামিতির ছড়া’ সাপ্তাহিক জনযুদ্ধের কিশোর বিভাগে প্রকাশের জন্যে রচিত হয়েছিল৷ রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪৩৷