- বইয়ের নামঃ অভিযান
- লেখকের নামঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অভিযান
নেপথ্যে (গান)
ক্ষুধিতের সেবার সব ভার
লও লও কাঁধে তুলে –
কোটি শিশু নরনারী
মরে অসহায় অনাদরে,
মহাশ্মশানে জাগে মহামানব
আগুয়ান হও ভেদ ভুলে।
বৈজয়ন্ত নগর। সকাল। (দূরে কে যেন বলছে)
হে পুরবাসী ! হে মহাপ্রাণ,
যা কিছু আছে করগো দান,
অন্ধকারের হোক অবসান
করুণা-অরুণোদয়ে !
বালকদলের প্রবেশ
উদয়ন
ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, আসে ওই
আয় তোরা, ওর সাথে কথা কই।
ইন্দ্রসেন
নগরে এসেছে এক অদ্ভুত মেয়ে
পরের জন্য শুধু মরে ভিখ্ চেয়ে।
সত্যকাম
শুনেছি ও থাকে দূর দেশে,
সেইখান থেকে হেঁটে এসে
দেশের জন্য ভিখ্ চায়
আমাদের খোলা দরজায়।
উদয়ন
শুনেছি ওদের দেশে পথের ধারে
মরছে হাজার লোক বিনা আহারে,
নানান ব্যাধিতে দেশ গিয়েছে ছেয়ে,
তাইতো ভিক্ষা মাগে ওদের মেয়ে।
সংকলিতার প্রবেশ (গান ধরল)
গান
শোনো, শোনো, ও বিদেশের ভাই,
এসেছি আজ বন্ধুজনের ঠাঁই ;
দেশবাসী মরছে অনশনে
তোমরা কিছু দাও গো জনে জনে,
বাঁচাব দেশ অন্ন যদি পাই।
উদয়ন
শোনো ওগো বিদেশের কন্যা
ব্যাধি দুর্ভিক্ষের বন্যা
আমরাই প্রাণ দিয়ে বাঁধব –
তোমাদের কান্নায় আমরাও যোগ দিয়ে কাঁদব।
ইন্দ্রসেন
আমরা তোমায় তুলে দেব অন্ন বস্ত্র অর্থ
তুমি কেবল গান শোনাবে এই আমাদের শর্ত।
সত্যকাম
ওই দ্যাখ আসে হেথা রাজ্যের কোতোয়াল
ইয়া বড় গোঁফ তার, হাতে বাঁকা তরোয়াল ;
ওর কাছে গিয়ে তুমি পাতো দুই হস্ত
ও দেবে অনেক কিছু ও যে লোক মস্ত !
কোতোয়ালের প্রবেশ
সংকলিতা (আঁচল তুলে)
ওগো রাজপ্রতিনিধি,
তুমি রাজ্যের বিধি।
তুমি দাও আমাদের অন্ন,
আমরা যে বড়ই বিপন্ন।
কোতোয়াল
য চ’লে ভিখারী মেয়ে যা চ’লে
দেব না কিছুই তোর আঁচলে।
সংকলিতা
তুমি যদি না দেবে তো কে দেবে এ রাজ্যে ?
সবারে রক্ষা করা তোমাদের কাজ যে।
কোতোয়াল
চুপ কর হতভাগী, বড় যে সাহস তোর ?
এখুনি বুঝিয়ে দেব আমার গায়ের জোর।
সংকলিতা
তোমরা দেখাও শুধু শক্তি,
তাইতো করে না কেউ ভক্তি ;
করো না প্রজার কোনো কল্যাণ,
তোমরা অন্ধ আর অজ্ঞান।
কোতোয়াল
চল তবে মুখপুড়ী, বেড়েছিস বড় বাড় –
কপালে আছে রে তোর নির্ঘাত কারাগার।
(সংকলিতাকে পাকড়াও করে গমনোদ্যত, এমন সময় জনৈক পথিকের প্রবেশ)
পথিক
শুনেছ হে কোতোয়াল –
নগরে শুনছি যে গোলমাল ?
উদয়, ইন্দ্র ও সত্য (একযোগে)
ছাড়, ছাড়, ছাড় ওকে – ছেড়ে দাও।
কোতোয়াল
ওরে রে ছেলের দল, চোপরাও !
সংকলিতা
কখনো কি তোমরা ন্যায়ের ধারটি ধারো ?
বন্দী যদি করো আমায় করতে পারো,
করি নি তো দেশের আঁধার ঘুচিয়ে আলো
কারাগারে যাওয়াই আমার পক্ষে ভালো।
পথিক
ওগো নগরপাল !
রাজপুরীতে এদিকে যে জমলো প্রজার পাল।
পথিকের প্রস্থান
ইন্দ্রসেন
অত্যাচারী কোতোয়ালের আজকে একি অত্যাচার ?
এমনিতর খেয়ালখুশি করব না বরদাস্ত আর।
কোতোয়াল
(তরবারি উঁচিয়ে)
হারে রে দুধের ছেলে, এতটুকু নেই ডর ?
মাথার বিয়োগব্যথা এখুনি বুঝবে ধড়।
রাজদূতের প্রবেশ
রাজদূত
(চিৎকার করে)
রাখো অস্ত্রের চাকচিক্য
এদেশে লেগেছে দুর্ভিক্ষ
প্রজাদল হয়েছে অশান্ত
মহারাজ তাই বিভ্রান্ত।
কোতোয়াল
একি শুনি আজ তোমার ভাষ্য ?
মনে হয় যেন অবিশ্বাস্য,
মহামন্বন্তরের হাস্য,
এখানেও শেষে হল প্রকাশ্য ?
উদয়ন
আমরা তো পূর্বেই জানি,
লাঞ্ছিতা হলে কন্যা কল্যাণী
এদেশেও ঘটবে অমঙ্গল
উঠবেই মৃত্যুর কল্লোল।
কোতোয়াল
বুঝলাম, সামান্যা নয় এই মেয়ে,
নৃপতিকে সংবাদ দাও দূত যেয়ে।
রাজদূতের প্রস্থান
(সংকলিতার প্রতি)
আজকে তোমার প্রতি করেছি যে অন্যায়
তাইতো ডুবছে দেশ মৃত্যুর বন্যায় ;
বলো তবে দয়া করে কিসে পাব উদ্ধার
ঘুচবে কিসের ফলে মৃত্যুর হাহাকার ?
সংকলিতা
নই আমি অদ্ভুত, নই অসামান্যা,
ধ্বনিত আমার মাঝে মানুষের কান্না –
যেখানে মানুষ আর যেখানে তিতিক্ষা
আমার দেশের তরে সেথা চাই ভিক্ষা।
আমার দেশের সেই মহামন্বন্তর
ঘিরেছে তোমার দেশও ধীরে অভ্যন্তর।
মহারাজ ও পিছনে কুবের শেঠের প্রবেশ
মহারাজ
কে তুমি এসেছ মেয়ে আমার দেশে,
এসেছ কিসের তরে, কার উদ্দেশে ?
সংকলিতা
আমার দেশেতে আজ মরে লোকে অনাহারে,
এসেছি তাদের তরে মহামানবের দ্বারে –
লাখে লাখে তারা আজ পথের দুধার থেকে
মৃত্যুদলিত শবে পথকে ফেলেছে ঢেকে।
চাষী ভুলে গেছে চাষ, মা তার ভুলেছে স্নেহ,
কুটিরে কুটিরে জমে গলিত মৃতের দেহ ;
উজার নগর গ্রাম, কোথাও জ্বলে না বাতি,
হাজার শিশুরা মরে, দেশের আগামী জাতি।
রোগের প্রাসাদ ওঠে সেখানে প্রতিটি ঘরে,
মানুষ ক্ষুধিত আর শেয়ালে উদর ভরে ;
এখনো রয়েছে কোটি মরণের পথ চেয়ে
তাই তো ভিক্ষা মাগি এদেশে এ-গান গেয়ে –
গান
ওঠো জাগো ও দেশবাসী,
আমরা যে রই উপবাসী,
আসছে মরণ সর্বনাশী।
হও তবে সত্বর –
দুয়ারে উঠল মহাঝড়।
সংকলিতা
কিন্তু তোমার এই এতবড় রাজ্য
এখানে পেলাম নাকো কোনোই সাহায্য।
রাজদূতের প্রবেশ
রাজদূত
প্রজারা সহসা ক্ষিপ্ত হয়েছে যে মহারাজ –
রাজপ্রাসাদের পাশে ভিড় ক’রে আছে আজ।
প্রস্থান
মহারাজ
বলো মেয়ে তাদের আমি শান্ত করি কী দিয়ে ?
সংকলিতা
ধনাগার আজ তাদের হাতে এখুনি দাও ফিরিয়ে।
মহারাজ
তাও কখনো সম্ভব ?
অবশেষে ছাড়ব বিপুল বৈভব ?
কুবের শেঠ
(করজোড়ে)
শ্রীচরণে নিবেদন করি সবিনয় –
কখনই নয়, প্রভু কখনই নয়।
মহারাজ
কিন্তু কুবের শেঠ,
বড়ই উতলা দেখি এদের ক্ষুধিত পেট।
কুবের শেঠ
এ এদের ছল, মহারাজ !
নতুবা নির্ঘাত দুষ্ট চাষীদের কাজ !
মহারাজ
তুমিই যখন এদের সমস্ত,
এদের খাওয়ার সকল বন্দোবস্ত
তোমার হাতেই করলাম আজ ন্যস্ত।
কুবের শেঠ
(বিগলিত হয়ে)
মহারাজ ন্যায়পরায়ণ !
তাইতো সদাই সেবা করি ও চরণ !
মহারাজের সঙ্গে কুবের শেঠের প্রস্থান
ইন্দ্রসেন
বাঘের ওপর দেওয়া হল ছাগ পালনের ভার,
কোতোয়াল হে ! তোমাদের যে ব্যাপার চমৎকার !
কোতোয়াল
বটে ! বটে ! বড় যে সাহস ?
গর্দান যাবে তবে রোস্ !
সংকলিতা
ছেলের দলের সামনে সাহস ভারি,
যোগ্য লোকের কাছে গিয়ে ঘোরাও তরবারি।
কোতোয়াল
চুপ করে থাক্ মেয়ে, চুপ করে থাক্,
তুই এনেছিস দেশে ভীষণ বিপাক।
যেদিন এদেশে তুই এলি ভিখারিণী
অশুভ তোরঈ সাথে এল সেই দিনই।
সত্যকাম
কে বলে একথা কোতোয়াল ?
ও হেথা এসেছে বহুকাল ;
এতদিন ছিল না আকাল।
প্রজার ফসল করে হরণ,
তুমিই ডেকেছ দেশে মরণ,
সে কথা হয় না কেন স্মরণ ?
জমানো তোমার ঘরে শস্য,
তবু তুমি করো ওকে দূষ্য ?
কোতোয়াল
কে হে তুমি ? দেখছি চোরের পকেটকাটা সাক্ষী
বলছ কেবল বৃহৎ বৃহৎ বাক্যি ?
ইন্দ্রসেন
কোতোয়ালজী, আজকে হঠাৎ রাগের কেন বৃদ্ধি ?
তোমার কি আজ খাওয়া হয় নি সিদ্ধি ?
কোতোয়াল
চুপ্ কর, ওরে হতভাগা !
এটা নয় তামাসার জা’গা।
(দাঁতে দাঁত ঘষে সংকলিতার প্রতি)
এই মেয়ে বাড়িয়েছে ছেলেদের বিক্রম,
তাইতো আমাকে কেউ করে নাকো সম্ভ্রম।
সংকলিতা
চিরদিনই তরুণেরা অন্যায়ের করে নিবারণ,
এদের এ সাহসের আমি তাই নয়কো কারণ।
কোতোয়াল
আমি রামদাস কোতোয়াল –
চটাস্নি ভুলে, কাটিস্নি কুমিরের খাল।
সংকলিতা
ছি ! ছি ! ছি! ওগো কোতোয়ালজী,
আমি কি তোমাকে পারি চটাতে ?
শত্রুও পারে না তা রটাতে।
কোতোয়াল
জানে বাতাস, জানে অন্তরীক্ষ,
জানে নদী, জানে বনের বৃক্ষ,
তুই এনেছিস এদেশে দুর্ভিক্ষ।
সংকলিতা
ক্ষমা করো ! আমি সর্বনেশে !
পরের উপকারের তরে এসে –
মন্বন্তর ছড়িয়ে গেলাম তোমাদের এই দেশে।
উদয়ন
অমন ক’রে বলছ কেন ভগ্নী !
জ্বালছ মনে কেন ক্ষোভের অগ্নি ?
রাঘব বোয়াল এই কোতোয়াল
হানা দেয় এ রাজ্যে
একে তুমি এনোই না গেরাহ্যে।
কোতোয়াল
আমার শাসন-ছায়ায় হয়ে পুষ্ট
রাঘব বোয়াল বলিস আমায় দুষ্ট ?
ইন্দ্রসেন
বলা উচিত সহস্রবার যেমন তুমি নির্দয়।
নির্দোষকে পীড়ন করায় যেমন তোমার নেই ভয়।
কোতোয়াল
বার বার করেছি তো সাবধান,
এইবার যাবে তোর গর্দান।
সংকলিতা
চুপ করে থাক ভাই, কথায় নেইকো ফল,
আমার জন্যে কেন ডাকছ অমঙ্গল ?
রাজা ধনাগার যদি দেন প্রজাদের হাতে
ওর যে সমূহ ক্ষতি, ভেবে ও ক্ষুব্ধ তাতে।
কোতোয়াল
ওরে ওরে রাক্ষসী, ওরে ওরে ডাইনী,
তোর কথা আমি যেন শুনতেই পাই নি,
তোর যে ঘনাল দিন, সাহস ভয়ংকর,
দুঃসাহসের কথা বলতে নেইকো ডর ?
সত্যকাম
তোমার মতো দুর্জনকে করতে হলে ভয়
পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মোটেই উচিত নয়।
কোতোয়াল
তোদের মুখে শুনছি যেন ভাগবতের টীকা,
নিজের হাতে জ্বালছিস আজ নিজের চিতার শিখা।
ইন্দ্রসেন
একটি তোমার তলোয়ারের জোরে
ভাবছ বুঝি চিরকালটাই যাবে শাসন করে ?
সেদিন তো আজ অনেক কালই গত,
তোমার মুখের ফাঁকা আওয়াজ শুনছি অবিরত।
কোতোয়াল
(ইন্দ্রসেনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে)
বুঝলে এঁচোড়পাকা,
আওয়াজ আমার নয়কো মোটেই ফাঁকা।
সংকলিতা
(আর্তনাদ করে)
দরিদ্রের রক্ত ক’রে শোষণ
বিরাট অহংকারকে করে পোষণ,
তুমি পশু, পাষণ্ড, বর্বর
অত্যাচারী, তোমার ও হাত কাঁপে না থরথর !
কোতোয়াল
(হুংকার দিয়ে)
আমাকে বলিস পশু, বর্বর ?
ওরে দুর্মতি তুই তবে মর !
(তলোয়ারের আঘাতে আর্তনাদ ক’রে সংকলিতার মৃত্যু)
প্রজাদলের প্রবেশ ও কোতোয়াল পলায়নোদ্যত
জনৈক পথিক
কোথায় সে কন্যা, অপরূপ কান্তি,
যার বাণী আমাদের দিতে পারে শান্তি ;
দেশে আজ জাগরণ যার সংগীতে,
আমরা যে উৎসুক তাকে গৃহে নিতে।
(সংকলিতার মৃতদেহের দিকে চেয়ে আর্তনাদ ক’রে)
এ যে মহামহীয়সী, এ যে কল্যাণী
ধূলায় লুটায় কেন এর দেহখানি ?
ইন্দ্রসেন
(কোতোয়াল্কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে)
ওই দেখ, ভাই সব, ওই অপরাধী
সবার বিচার হোক ওর প্রতিবাদী –
জনৈক প্রজা
ওরে রে স্পর্ধিত পশু, কী সাহস তোর,
তুই করেছিস আজ অন্যায় ঘোর ;
কল্যাণীকে হেনে আজ তোর আর
পৃথিবীতে বাঁচবার নেই অধিকার।
ইন্দ্রসেন
রাজার ওপরে আর করব না নির্ভর –
আমাদের ভাগ্যের আমরাই ঈশ্বর।
সকলে
চলবে না অন্যায়, খাটবে না ফন্দি,
আমাদের আদালতে আজ তুই বন্দী !!!
(কোতোয়ালকে প্রজারা বন্দী করল)
যবনিকা
সূর্যপ্রণাম – অস্তাচল
প্রান্তিক
(আবৃত্তি)
বেলাশেষে শান্তছায়া সন্ধ্যার আভাসে
বিষন্ন মলিন হয়ে আসে,
তারি মাঝে বিভ্রান্ত পথিক
তৃপ্তিহীন খুঁজে ফিরে পশ্চিমের দিক।
পথপ্রান্তে
প্রাচীন কদম্বতরুমূলে,
ক্ষণতরে স্তদ্ধ হয়ে যাত্রা যায় ভুলে।
আবার মলিন হাসি হেসে
চলে নিরুদ্দেশে।
রজনীর অন্ধকারে একটি মলিন দীপ হাতে
কাদের সন্ধান করে উষ্ণ অশ্রুপাতে
কালের সমধিতলে।
স্মৃতিরে সঞ্চয় করে জীবন-অঞ্চলে;
মাঝে মাঝে চেয়ে রয় ব্যথা ভরা পশ্চিমের দিকে,
নির্নিমিখে।
যেথায় পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে অমর অরে
সেথায় কাদের আর্তনাদ বারংবার বৈশাখীর ঝড়ে।
আবার সম্মুখপানে
যাত্রা করে রাত্রির আহ্বানে।
ক্ষীণদীপ উর্বর আলোতে
চিরন্তন পথের সংকেত
রেখে যায় প্রভাতের কানে।
অকস্মাৎ আত্মবিস্মৃতির অন্তঃপুরে,
ভেসে ওঠে মানসকমুকুরে
উত্তরকালের আর্তনাদ,-
“কবিগুরু
আমাদের যাত্রা শুরু
কালের অরণ্য পথে পথে
পরিত্যক্ত তব রাজ-রথে
আজি হতে শতবর্ষ আগে
অস্ত গোধূলির সন্ধ্যারাগে
যে দিগন্ত হয়েছে রক্তিম,
সেথা আজ কারো চিত্তবীণা
তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজে কিনা
সে কথা শুধাও?
শুধু দিয়ে যাও
ক্ষণিকের দক্ষিণ বাতাসে তোমার সুবাস
বাণীহীন অন্তরের অন্তিম আভাস।
তাই আজ বাধামুক্ত হিয়া
অজস্র উপেক্ষাভারে বিস্মৃতিরে পশ্চাতে ফেলিয়া
ছিন্নবাধা বলাকার মতো
মত্ত অবিরত,
পশ্চাতের প্রভাতের পুষ্প-কুঞ্জ বনে
আজ শূন্য মনে।”
তাই উচ্চকিত পথিকের মন
অকারণ
উচ্ছলিত চঞ্চল পবনে।
অনাগত গগনে গগনে!
ক্লান্ত আজ প্রভাতের উৎসবের বাঁশি;
পুরবাসী নবীন প্রভাতে
পুরাতন জয়মাল্য হাতে
অস্তাচলে পথিকের মুখে মূর্ত হাসি।।
শেষ মিনতি
(গান)
ও কে যায় চলে কথা না বলে, দিও না যেতে
তাহারই তরে আসন ঘরে রেখেছি পেতে।
কত কথা আছে তার মনেতে সদাই,
তবু কেন রবি কহে আমি চলে যাই;
রামধনু রথে
বিদায়ের পথে
উঠিল মেতে।
রঙে রঙে আজ গোধূলি গগন
রঙিন কী হল, বিলাপে মগন।
আমি কেঁদে কই যেও না কোথাও,
সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও
বাড়ায়ে বাহু
মরণ-রাহু
চাহিছে পেতে।।
আয়োজন
(বর্ণনা)
হঠাৎ বুঝি তোমার রথের সাতটি ঘোড়া উঠল
হ্রেষা-রবে চঞ্চল হয়ে, যাবার ডাক শুনি?
অস্তপথ আজ তোমারই প্রত্যাশায় উন্মুখ, হে কবি,
কখন তুমি আসবে?
কবে, কখন তুমি এসে দাঁড়ালে
অস্তপথের সীমানায়, কেউ জানল না; এমন কী
তুমিও না!
একবার ভেবে দেখেছ কি,
হে ভাবুক, তোমার চলমান ঘোড়ার শেষ পদক্ষেপের
আঘাতে কেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠবে আমাদের
অন্তরলোক?
তোমার রচিত বাণীর মন্দিরে কোন্
নতুন পূজারী আসবে জানি না, তবু তোমার আসন হবে
শূন্য আর তোমার নিত্য-নূতন পূজাপদ্ধতি, অর্ঘ্য-উপচার
আর মন্দিরের বেদী স্পর্শ করবে না। দেউলের ফাটল
দিয়ে কোন্ অশত্থ-তরু চাইবে আকাশ, চাইবে তোমার
মন্দিরে তার প্রতিষ্ঠা, জানি না। তবু একদিন তা
সম্ভব, তুমিও জানো। সেই দিনকার কথা
ভেবে দেখেছ কি, হে দিগন্ত-রবি?
তোমার বেণুতে আজ শেষ সুর কেঁপে উঠল।
তুমি যাবে আমাদের মথিত করে। কোন্ মহাদেশের
কোন্ আসনে হবে তোমার স্থান? বিশ্ববীণার তারে আজ
কোন্ সুর বেজে উঠেছে, জানো? সে তোমারই বিদায়
বেদনায় সকরুণ ওপারের সুর। এই সুরই চিরন্তন,
সত্য এবং শাশ্বত। যুগের পর যুগ যে সুর ধ্বনিত হয়ে
আসছে, আবহমানকালের সেই সুর। সৃষ্টি-সুরের
প্রত্যুত্তর এই সুরের নাম লয়। তান-লয় নিয়ে তোমার
খেলা চলেছে কতকাল, আজ সেই লয়ের তান রণরণিত হচ্ছে
কোন্ অদৃশ্য তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, জানি না।
কোন্ যুগান্তরের পারেও ধ্বনিত হবে সেই সুর
কতদূর- তা কে জানে।
যাত্রা
(আবৃত্তি)
অমৃতলোকের যাত্রী হে অমর কবি, কোন্ প্রস্থানের
পথে তোমার একাকী অভিযান। প্রতিদিন তাই
নিজেরে করেছ মুক্ত, বিদায়ের নিত্য-আশঙ্কায়
পৃথ্বীর বন্ধন ভিত্তি নিশ্চিহ্ন করিতে বিপুল প্রয়াস
তব দিনে দিনে হয়েছে বর্ধিত। এই হাসি গান,
ক্ষণিকের অনিশ্চিত বুদ্বুদের মতো; নশ্বর জীবন
অনন্তকালের তুচ্ছ কণিকার প্রায় হাসি ও ক্রন্দনে
ক্ষয় হয়ে যায় তাই ওরা কিছু নয়, তুমিও জানিতে
‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন-যৌবন-ধন-মান’,
তবু তুমি শিল্পীর তুলিকা নিয়ে করেছ অঙ্কিত
সভ্যতার প্রত্যেক সম্পদ। সুন্দরের সুন্দর অর্চনা।
বিশ্বপ্রদর্শনী মাঝে উজ্জ্বল তোমার সৃষ্টিগুলি
পৃথিবীর বিরাট সম্পদ, স্রষ্টা তুমি, দ্রষ্টা তুমি
নূতন পথের। সেই তুমি আজ পথে পথে,
প্রয়াণের অস্পষ্ট পরিহাসে আমাদের করেছ
উন্মাদ। চেয়ে দেখি চিতা তব জ্বলে যায় অসহ্য
দাহনে, জ্বলে যায় ধীরে ধীরে প্রত্যেক অন্তর।
তুমি কবি, তুমি শিল্পী, তুমি যে বিরাট, অভিনব
সবারে কাঁদায়ে যাও চুপি চুপি এ কী লীলা তব।।
বিদায়
(গান)
ঝুলন- পূর্ণিমাতে
নীরব নিঠুর মরণ সাথে
কে তুমি ওগো মিলন-রাখী
বাঁধিলে হাতে?
শ্রাবণদিনে উদাস হাওয়া
কাঁদিল এ কী,
পথিক রবির চলে যাওয়া
চাহিয়া দেখি,
ব্যাকুল প্রাণে সজলঘন
নয়ন পাতে –
বিদায় নিতে চায় কে ওরে
বাঁধরে তারে বজ্রডোরে
আলোর স্বপন ভেঙেছে মোর,
আঁধার যেথায় শ্রাবণ-ভোর
ঘুম টুটে মোর সকল-হারা
এই প্রভাতে।।
প্রণতি
(সমবেত গান)
নমো রবি, সূর্য দেবতা
জয় অগ্নি-কিরণময় জয় হে
সহস্র-রশ্মি বিভাসিত,
চির অয় তব পরিচয় হে।
জয় ধ্বান্ত-বিনাশক জয় সূর্য,
দিকে দিকে বাজে তব জয়-তূর্য
অনুক্ষণ কাঁদে মন, অকারণ অকারণ
কোথা তুমি মহামঙ্গলময় হে।
কোথা সৌম্য শান্ত তব দীপ্ত ছবি
কোথা লাবণ্যপু হে ইন্দ্র রবি,
তুমি চিরজাগ্রত তুমি পুণ্য
রবিহীন আজি কেন মহাশূন্য
যুগে যুগে দাও তব আশিস অভয় হে।।
সূর্যপ্রণাম – উদয়াচল
আগমনী
(সমবেত গান)
পুবসাগরের পার হতে কোন পথিক তুমি উঠলে হেসে,
তিমির ভেদি ভুবন-মোহন আলোর বেশে।
ওগো পথিক, তোমার আলোর ঘুচুক জরা
ছন্দে নাচুক বসুন্ধরা
গগনপথে যাত্রা তোমার নিরুদ্দেশে।
তুমি চিরদিনের দোলে দোলাও অনন্ত আবর্তনে,
নৃত্যে কাঁপুক চিত্ত মোদের নটরাজের নর্তনে।
আলোর সুরে বাজাও বাঁশি,
চিরকালের রূপ-বিকাশি’
আঁধার নাশে সুন্দর হে তোমার বাণীর মূক আবেশে।।
আবির্ভাব
(আবৃত্তি)
সূর্যদেব,
আজি এই বৈশাখের খরতপ্ত তেজে
পৃথিবী উন্মুক্ত যবে তুমি এলে সেজে
কনক-উদয়াচলে প্রথম আবেগে
ফেলিলে চরণচিহ্ন, তার স্পর্শ লেগে
ধরণী উঠিল কাঁপি গোপন স্পন্দনে
সাজাল আপন দেহ পুষ্প ও চন্দনে
তব পূজা লাগি। পৃথিবীর চক্ষুদান
হল সেই দিন। অন্ধকার অবসান,
যবে দ্বার খুলে প্রভাতের তীরে আসি
বলিলে, হে বিশ্বলোক তোরে ভালবাসি,
তখনি ধরিত্রী তার জয়মাল্যখানি
আশীর্বাদসহ তব শিরে দিল আনি-
সস্মিত নয়নে। তারে তুমি বলেছিলে,
জানি এ যে জয়মাল্য, মোরে কেন দিলে?
কতবার তব কানে পঁচিশে বৈশাখ
সদূরের তরে শুধু দিয়ে গেল ডাক,
তুমি বলেছিলে চেয়ে সম্মুখের পানে
“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।”
বরণ
(বর্ণনা)
হঠাৎ আলোর আভাস পেয়ে কেঁপে উঠল
ভোরবেলা, কোন্ পুলকে, কোন্ অজানা সম্ভাবনায়?
রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করে অন্ধকার।
শিউলি বকুল ঝরে পড়ে শেষ রাত্রির কান্নার মতো,
হেমন্ত-ভোরের শিশিরের মতো।
অস্পষ্ট হল অন্ধকার; স্বচ্ছ আরও স্বচ্ছ
মৃতপ্রায়ের আগ্রহের মতো পাণ্ডুর আলো এসে পড়ে
আশীর্বাদের মতো ঝরা ফুলের মরা চোখে,
শুভ্র কপোলে,- ঘুমন্ত হাসির মতো তার মায়া।
পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা এল উচ্ছ্বসিত বন্যার বেগে,
হাতে তাদের আহরণী-ডালা;
তারা অবাক হয়ে দেখলে
একী! নতুন ফুল ফুটেছে তাদের আঙিনায়
রবির প্রথম আলো এসে পড়েছে তার মুখে,
ওরা বললে, ওতো সূর্যমুখী।
পিলু-বারোয়াঁর সুর তখনও রজনীগন্ধার বনে
দীর্ঘশ্বাসের মতো সুরভিত- মত্ততায় হা-হা করছে;
কিন্তু তাও গেল মিলিয়ে। শুধু জাগিয়ে দিয়ে
গেল হাজার সূর্যমুখীকে।
সূর্য উঠল। অচেতন জড়তার বুকে ঠিকরে
পড়তে লাগল, বন্ধ জানলায় তার কোমল
আঘাত, অজস্র দীপ্ততে বিহ্বল।
পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা ফিরে গেল উজ্জ্বল, উচ্ছল হয়ে
বুকে তাদের সূর্যমুখীর
অদৃশ্য সুবাস।
মঙ্গলাচরণ
(গান)
ওগো কবি, তুমি আপন ভোলা-
আনিলে তুমি নিথর জলে ঢেউয়ের দোলা,
মালিকাটি নিয়ে মোর
একী বাঁধিলে অলখ-ডোর
নিবেদিত প্রাণে গোপনে তোমার কি সুর তোলা,
জেনেছ তো তুমি সকল প্রাণের নীরব কথা,
তোমার বাণীতে আমার মনের এ ব্যাকুলতা
পেয়েছ কি তুমি সাঁঝের বেলাতে
যখন ছিলাম কাজের খেলাতে
তখন কি তুমি এসেছিলে, ছিল যে দুয়ার খোলা?
আহ্বান
(সমবেত গান)
আমাদের ডাক এসেছে
এবার পথে চলতে হবে,
ডাক দিয়েছে গগন-রবি
ঘরের কোণে কেই বা রবে।
ডাক এসেছে চলতে হবে আজ সকালে
বিশ্বপথে সবার সাথে সমান তালে,
পথের সাথী আমরা রবির
সাঁঝ-সকালে চলরে সবে।
ঘুম থেকে আজ সকালবেলা ওঠ রে,
ডাক দিল কে পথের পানে ছোট রে,
পিছন পানে তাকাস নি আজ চল সমুখে
জয়ের বাণী নূতন প্রাতে বল ও-মুখে
তোদের চোখে সোনার আলো
সফল হয়ে ফুটবে কবে।
স্তব
(আবৃত্তি)
কবিগুরু আজ মধ্যাহ্নের অর্ঘ্য
দিলাম তোমায় সাজায়ে,
পৃথিবীর বুকে রচেছ শান্তিস্বর্গ
মিলনের সুর বাজিয়ে।
যুগে যুগে যত আলোক-তীর্থযাত্রী
মিলিবে এখানে আসিয়া,
তোমার স্বর্গ এনে দেবে মধুরাত্রি
তাহাদের ভালবাসিয়া।
তারা দেবে নিতি শান্তির জয়মাল্য
তোমার কণ্ঠে পরায়ে,
তোমার বাণী যে তাহাদের প্রতিপাল্য,
মর্মেতে যাবে জড়ায়ে।
তুমি যে বিরাট দেবতা শাপভ্রষ্ট
ভুলিয়া এসেছ মর্তে;
পৃথিবীর বিষ পান করে নাই এখনো তোমার ওষ্ঠ
ঝঞ্ঝা-প্রলয়-আবর্তে।
আজিকার এই ধূলিময় মহাবাসরে
তোমারে জানাই প্রণতি,
তোমার পূজা কি শঙ্খঘণ্টা কাঁসরে?
ধূপ-দীপে তব আরতি?
বিশ্বের আজ শান্তিতে অনাসক্তি,
সভ্য মানুষ যোদ্ধা,
চলেছে যখন বিপুল রক্তারক্তি,
তোমারে জানাই শ্রদ্ধা।
অবশেষ
(বর্ণনা)
কিন্তু মধ্যাহ্ন তো পেরিয়ে যায়
সন্ধ্যার সন্ধানে, মেঘের ছায়ায়
বিশ্রাম করতে করতে, আকাশের
সেই ধূ ধূ করা তেপান্তরের মাঠ।
আর সুর্যও তার অবিরাম আলোকসম্পাত
ক’রে ঢলে পড়ল সাঁঝ-গগনে।
সময়ের পশ্চাতে বাঁধা সূর্যের গতি
কী সূর্যের পিছনে বাঁধা সময়ের প্রতি
তা বোঝা যায় না।
দিন যায় ভাবীকালকে আহ্বান করতে।
একটা দিন আর একটা ঢেউ,
সময় আর সমুদ্র।
তবু দিন যায়
সূর্যের পিছনে, অন্ধকারে অবগাহন
করতে করতে।
যেতে হবে!
প্রকৃতির কাছে এই পরাভবের লজ্জায়
আর বেদনায় রক্তিম হল
সূর্যের মুখ,
আর পৃথিবীর লোকেরা;
তাদের মুখ পূর্ব-আকাশের মতো
কালো হয়ে উঠল।
মিনতি
(সমবেত গান)
দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে,
যেও না চলে,
অরুণ-আলো কে যে দেবে
যাও গো বলে।
ফেরো তুমি যাবার বেলা;
সাঁঝ-আকাশে রঙের মেলা-
দেখছ কী কেমন করে
আগুন হয়ে উঠল জ্বলে।
পূব-গগণের পানে বারেক তাকাও
বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও
আঁধার যেন দৈত্য সম আসছে বেগে,
শেষ হয়ে যাক তারা তোমার ছোঁয়াচ লেগে।
থামো ওগো, যেও না হয়
সময় হলে।।