- বইয়ের নামঃ অস্তিত্ব, অতিথি তুমি
- লেখকের নামঃ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বীতে হুয়ে দিন
বহু, বাবুজি, চুনারের টাঙ্গাওয়ালা লাম্পু আমাকে বলেছিল, সব কুছ দেতা হ্যায়। জান ভি দে সকতা। লেকিন কান্ধা নেহি দেতা।
নভেম্বর, ১৯৭০। বিয়ের পর, কাশী থেকে একদিনের ট্যুরে আমরা গিয়েছিলাম চুনার ফোর্ট দেখতে। একটা গোটা পাহাড় জুড়ে লম্বায়-চওড়ায় সে এক এলাহি ব্যাপার। মৌলিক এবং অনন্য।
এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুর্গ-ঘরানা।
সব দুর্গেই যেমন, চুনারেরও প্রবেশদ্বার একটি মাত্র। এরও চারিদিকে পরিখা ও প্রাচীর অন্তত, যেতে যেতে, প্রায় শেষ পর্যন্ত এমনটাই ধারণা হয়, যে তাই। এরও তো সর্বত্র ছড়িয়ে সেই ভাঙা গম্বুজ, পড়ে-থাকা খিলান, ও জাফরিহারা গবাক্ষ। প্রহরীবিহীন,অনর্গল বন্দিশালা। এ আর নতুন কী। কিন্তু, একেবারে শীর্ষে উঠে এ ভুল ভাঙে। দেখা যায়, চার নয়, এর মাত্র তিনদিক জুড়ে ছিল প্রাচীর ও পরিখা; এবং দক্ষিণে, যেদিকে হাজার হাজার ফিট নিচে পড়ে আছে, শীতের পাতলা রোদে, ভূপাতিত গঙ্গার মাইল-মাইল জলছবি, সেই একটা দিক অবারিতভাবে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত!এ অবাক উন্মােচনের মুখোমুখি হয়ে সহসা, স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অপরিসর, কোথাও একজনের মতো পথ ও সিঁড়ি ধরে উঠে এসে আগাগোড়া গুমোটের পর এই হু-হু হঠাৎ হাওয়া–শুধু এইখানে শুধু এই দুর্গচূড়াটিকে ঘিরে!
দুটি ভাঙাচোরা আটপৌরে কবর শুধু। এখানে।
বস্তুত, এমন দুর্গও আমার এখনও দেখতে বাকি, যার ক্রমোচ্চ রাজপথ, দুই পাশে রেখে শত শত হৰ্ম, খিলান ও গম্বুজের ধ্বংস; এভাবে, ক্রমাগত, না থেমে, শুধু উঠেই গেছে এবং দুর্গের শীর্ষবিন্দুতে উঠে পেয়েছে পরিণতি, যেখানে পাশাপাশি শুয়ে আছে দুটি জরাজীর্ণ কবর, যাদের কেন্দ্র থেকেই হয়ত, যা আগে বলেছি, সেখানে হঠাৎ এমন অবোধ হওয়া। চাপা গুমোট-গরম ঠেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রমাগত ওপরে উঠে, নিচের পাতাল-গঙ্গা থেকে চোখ তু®, ঊর্ধ্বে স্বর্গ-নীলিমার দিকে প্রথমবার তাকালে যখন পায়ের কাছে দু-দুটি কবর–এরকম মনে হতেই পারে এবং আমারও হয়েছিল, যে, অতীতে ওই অন্তরীক্ষের সঙ্গে এই দুর্গ-স্থাপত্য নিশ্চিত একটা সুসম্পর্ক পাতাতে চেয়েছিল (নইলে আর চড়চড় করে ওভাবে উঠে এসেছিল কেন আকাশের দিকে), এমনকি পাতিয়েও ছিল–যে সম্পর্ক শের শাহরও ঢের পূর্বে, সেই প্রাক-মধ্যযুগ থেকে, যত ভেঙেচুরেই যাক, আজও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। অবশ্য, শুধুই মনে হওয়াহয়ির ব্যাপার এ যে; তাও নয়। পৃথিবীর সমস্ত রকম আবহাওয়া-প্রহৃত ভাস্কর্য বা স্থাপত্যের সঙ্গে মহাজগৎ তথা ব্রহ্মাণ্ড-চেতনার একটা পরোক্ষ সম্পর্কের কথা কখনই অস্বীকার করা হয়নি। এ-তত্ত্ব চুনারের ক্ষেত্রেই বা প্রযোজ্য হবে না। কেন?
ফোর্ট দেখা শেষ হতে সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঘোরাঘুরি আমিই করলাম বেশি, সঙ্গে লালু। দীপ্তি ওপরে কবরের পাশে বসে রইল। একবার ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে দেখি, কবরে মাথা রেখে বেচারা ঘুমিয়েই পড়েছে।
হাতে তখনও ঘণ্টা-দুই সময়। ফেরার ট্রেন সাড়ে সাতটায়। স্টেশনের পথে লালু বলল, জিন্দা পিরকা দরগা দেখিয়ে গা বাবুজি?
জিন্দা পির?
হ্যাঁ, বাবুজি। জিন্দা!
বলতে বলতে একটা ন্যাড়া ছোট পাহাড়ের ধারে সে টঃ-টঃ-টঃ-টঃ শব্দে টাঙ্গার অশ্বক্ষুরধ্বনি থামায়। পিরের কবর দেখতে হলে পাহাড়ে উঠতে হবে, সে আমাদের জানাল।
একবেলায় চুনারের যেটুকু দেখা বা বোঝা গেছে, তাতে একটা বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি। যে, গ্রামে নিঃসন্দেহে আলাদা করে কোনও গোরস্থান নেই। যে জন্যে, গোটা গ্রামটাই এভাবে, দিনে দিনে, একটা কবরখানার চেহারা নিয়েছে। দুর্গের মধ্যে তো বটেই, ফোর্টে ঢোকার আগে, পাহাড়ি পাকদণ্ডীর ধারে ধারে দুদিকে সারবন্দী কবর, পাহাড় ধরে গঙ্গার তীর পর্যন্ত নেমে গেছে। ফোর্টের বাইরে গ্রাম জুড়ে বাড়ির সামনে ও খিড়কিতে কবর। খেতের মধ্যে ও ধারে ধারে, গাছতলায়, কুয়োর ধারে–গ্রাম ছাড়িয়ে পথের পাশে–এখানে কবর নেই কোথায় যে। নুড়ির মত যত্রতত্র ছড়িয়ে।
বিয়ের প্রথম বছরটা দীপ্তি বোধহয় আমাকে অবজার্ভেশনে রেখেছিল। পিরের কবর দেখতে আমি আর লালু পাহাড়ে উঠলাম, সে বিশেষ আপত্তি করল না। না না, যাও না তুমি, দেখে এস, বলে অদূর অতীতের সেই রণ-ধর্ষিত প্রান্তরে, টাঙ্গার ওপর, একা বসে রইল। জোত খুলে লালু ঘোড়ার মুখে ঝুলিয়ে দিল জাবনার লম্বাটে থলে।
জিন্দা পিরের নাম পির সুলেমান। পিরের কবর একেবারে সেই পাহাড়ের টঙে।
টিলার ওপর সাঁই-সাঁই হাওয়া। পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে পৃথিবীর একমাত্র নতজানু পর্বতমালা: বিন্ধ্য। সূর্য এদিকেই অস্ত যাবে। দক্ষিণে, নদীর বিশাল বাঁক দিয়ে পেঁচানো দুর্গের গম্বুজগুলো… ঐতিহাসিক স্থানগুলি, এরকম অস্তরাগের আলোয়, দূর থেকে দেখতেই ভাল লাগে। বিমূর্ত দেখায়।
নিচে পথের ধারে বাচ্চাদের খেলনা-গাড়ির মতো লাল্লুর টাঙ্গা, পাশে এখন কুকুর-ছানা সাইজের ঘোড়াটা। ইতিহাস বইয়ের পাতায় একটা সাদাকালো ছবি যেন।
ভাবতে বেশ মজা লাগে যে ওই ছোট্ট খেলনা-গাড়ির মধ্যে দীপ্তি এখন একা বসে আছে। অলীক মনে হয় এখান থেকে। অবিশ্বাস্য! ওইটুকু গাড়ির মধ্যে? কিন্তু, সত্যিই তো তাই। দীপ্তি এখন ওই খেলনা-গাড়ির সঙ্গে মানানসইভাবে এই এতটুকু হয়ে ওরই মধ্যে বসে, যদিও, তার প্রমাণ সাইজের অস্তিত্ব-সহ।
যাই হোক, দরগা না ছাই। বেকার আসা এতদূর, আলো দিতে, এই বাঁশঝাড়ে! ভাগ্যিস, দীপ্তি আসেনি।
নীলবড়ি দিয়ে রঙ করা আয়তাকার সিমেন্টের বেদি একটা। তাকে ঘিরে শুকনো কঞ্চির বেড়া—এক থোকা ধূপ জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে উড়ে গেছে কখন। শুধু ধূপের গোড়াগুলো মাটির ডেলায় গাঁথা। নষ্ট ফুল।
একে ঘিরেই, লালু জানায়, হর সাল জানবারি মাসের প্রথম চাঁদের দিন হয় উর্স–জিন্দা পিরের মেলা, তখন এই দরগার মাথায় চাঁদোয়া লাগে। তখন এই ছোট্ট পাহাড় ঘিরে লোকে লোকারণ্য। সিনিমার তাম্বু পড়ে তখন। উর্স কমিটি এইসান ভারী ভারী হাণ্ডা লিয়ে আসে। খিচুড়ি বানায়। মেলা চলে সাত রোজ। সাত রোজই গোরের মধ্যে বসে মৃত পির আমজনতার সঙ্গে তিন দফে নমাজ আদায় করেন। কোনও কোনও রাতে বাজনার শব্দ ভেসে আসে। কবরের ভেতর থেকে।
বহুৎ সা আদমি শুনা হ্যায়, লাল্লু নামতে নামতে বলতে থাকে, হামারা বাপ-চাচা দোনো শুনা হ্যায়। হাম? মেরা নসিব মে তো আভিতক … লেকিন বাবু, খুদাকা রহম গিরেগা–তব না শুনেগা?
আধাআধি নেমে, পাহাড়ের একটা বাঁক নিতে, নিচে দীপ্তিকে স্পষ্ট দেখা যায়।
টাঙ্গা থেকে রাস্তায় নেমে সে হাত নেড়ে তাড়াতাড়ি নেমে আসতে বলছে। তার অতি ক্ষীণ কণ্ঠস্বরও এখানে ভেসে আসে। অবশ্য, সে নিরাপদ এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এখনও যথেষ্ট আলো রয়েছে। ঘোড়া ছাড়া ওর ধারেকাছে কেউ বা কিছু নেইও। হয়ত সাপটাপ। দেখেছে বড়জোর।
আমার মুখ জুড়ে তবু আশঙ্কার ছায়া ঘনিয়ে আসে।
জলদি আ-ও লাল্লু।–আমি বলি।
হাঁ! হাঁ, বাবুজি। চলিয়ে।
তারপর পাহাড় থেকে দ্রুত পায়ে নামতে নামতে, ঘোড়ার রাগী ছপটি দিয়ে ভেঙে একটা আকন্দের ডাল, হঠাৎ, কেন কে জানে, আমার উদ্দেশে লালু ওই বাক্য কটি বলে। যে, বহু, বাবুজি.. লেকিন কান্ধা নেহি দেতা।
ও যা বলতে চায় তার ভাবার্থ শোনামাত্র টের পাইনি, এমন কথা বলব না। কিন্তু, কান্ধা শব্দটি ইতিপূর্বে শোনা না থাকায় আমি খুব নিশ্চিত হতেও পারছিলাম না।
কান্ধা?
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে ওর কাছে জানতে চাই।
কান্ধা বাবুজি?
উত্তরে বাঁহাতের তর্জনী দিয়ে বাম কাঁধে টোকা মেরে সে ইঙ্গিত করে। তারপর কাঁধের পাশে হাতের মুঠি রেখে, হাসতে হাসতে, যেন হাতে কিছু ধরে আছে এমন ভাবে, একটা কিছু দোলায়। আমার চোখের সামনে চুনারের যুবক টাঙ্গাওয়ালা মুহূর্তের জন্য রূপও পোশাক বদল করে যেন এই মুর্দা-গাঁওয়ের এক শববাহকে পরিণত হয়। (ইয়ে তো মুর্দা গাঁও হ্যায় বাবুজি, কিতনা ফাইট হুয়া হ্যায় হিয়া পে, ইস চুনার মে। আপ তো সব কুছ জানতে হোঙ্গে।) কালো পাথর থেকে কুঁদে বের করা তার মুখের অগণন বসন্তক্ষতের মধ্যে সর্বজ্ঞ বৃদ্ধের দন্তহীন আবিল হাসি জমা হতে আমি দেখি।
আমি বেশ ভয় পাই। তাকে দেখে।
দীপ্তি রাগ করেছে। কিন্তু রাগ করে, না বুঝে, সে বসে পড়েছে এ কোথায়? না, একটি চারকোণা পাথরের ওপর। এটাও কি একটা কবর হতে পারে না?
যদি পুরুষের কবর হয়, এর স্ত্রীও শবানুগমন করেনি। কান্ধা দেয়নি। আমার মনে হল।
সেবার কাশীতে আমরা উঠেছিলাম পাড়ে হৌলিতে। সে অনেক বছর আগের কথা। তখনও আমাদের বিয়ের বছর ঘোরেনি।
বাঙালি ভদ্রলোকের আটপৌরে হোটেল। নাম সেন লজ। জানালার নিচে দিয়ে চৌষট্টি যোগিনী ঘাটের সিঁড়িশ্রেণী নেমে গেছে। দুদিকে বাড়িঘর, দেওয়াল। তার মধ্যে দিয়ে এক চিলতে প্রায়ান্ধকার গঙ্গা দেখা যায়। পাল-তোলা একটি বজরা গেলে, বোঝা যায়। ওপারে রামনগরের আলো।
ব্রিজে একটা মালগাড়ি ঢুকেছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি বলি, ওই যে টাঙ্গাওয়ালাটা, চুনারের। মুখটা আজ আমাকে কি বললে জানো দীপু?
দিনের তুলনায় রাতে এখানে দিব্যি শীত। হোটেল থেকে কম্বল ও খেশ দুই-ই দিয়েছে। অর্থাৎ রাতে খেশ, ভোরে কম্বল। যদি ভোরে ভুলে যায়, দীপ্তি এখন থেকেই কিছুটা কম্বল টেনে নিয়েছে।
দু-দুটান ধোঁয়া ছেড়েও উত্তর এল না দেখে আমি স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে বাকিটা বলে ফেলি।
ওই পিরের কবর দেখে নামছি যখন। ব্যাটার হাজার পাঁচেক বছরের ভারতীয় মুণ্ডু বলে কিনা, বহু বাবুজি, মানে বৌ আর কী…
বৌ আর কী?
বললে, স্ত্রীরা সব দিতে পারে স্বামীর জন্যে। এমনকি জানও দিতে পারে। কিন্তু তারা কান্ধা দেয় না।
তার মানে?
কান্ধা মানে, ওই কাঁধ আর কী!
মানে? কী বলতে চাইছে ও?
হায় রে অভিমানিনী নারী! এরও মানে? এখনও প্রাঞ্জল হল না? দীপ্তি কি কখনও নিজে কিছু ভাববে না! ভাববার যা, ফ্রয়েড আর ইয়ুং, ম্যাকদুগাল আর টিচনার, আগেই ওর হয়ে ভেবে রেখেছে।
তবে, অশিক্ষিত খোট্টা টাঙ্গাওয়ালা কী-আর এমন বলে থাকতে পারে যা না জানলে দীপ্তির চলবে না। আমি বুঝিয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু, আমাকে বাধা দিয়ে সে বলল, উহুহু।অর্থাৎ, শীত। তারপর বলল, তোমার সিগারেট খাওয়া হল?
অর্থাৎ, রাতের মেলামেশা করার যদি ইচ্ছা থাকে, ঝটপট এস। জলদি কর। লাল্লু কী ছাই-পাঁশ তোমাকে বলেছে, সেগুলো শোনানোর মতো কোনও কথা নয়। ভাববার মতো ভাবনা নয়। এখন ভাবনার বিষয় হল, আমার ঘুম। এবং, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। জীবনে
যে যত বেশি ঘুমোতে পেরেছে, তার তত জিত। এবং যার ঘুমে যত কম স্বপ্ন।
ব্লাউজের পিঠের দিকের হুক খোলায় তার সঙ্গে দাম্পত্য সহযোগিতা করার ফাঁকে আমি সাদা বাংলায় ওকে, একটু দেরিতে হলেও, এবার পুরোটা শুনিয়ে দিই, মানে হল গিয়ে, স্ত্রীরা। আর কি, স্বামীর শবযাত্রার সঙ্গী হয় না। লাল্লু বলছিল। তারা শ্মশানে যায় না।
তাদের কাজ শুধু স্বামীর বেঁচে থাকাটুকু নিয়ে বলতে বলতে কোমর জড়িয়ে ধরে আমি তাকে বুকে টেনে নিই।
দার্শনিকতা পুরুষদের ব্যাপার। কৃষ্ণ থেকে শঙ্করাচার্য, ডায়োজেনিস থেকে দেকার্ত–সবাই পুরুষ মানুষ। নইলে তো এক-আধটা মেয়ে থাকত। দীপ্তি কখনও কোনওপ্রকার দার্শনিকতার ফাঁদে পা দেয় না। সে মেয়েমানুষ।
তবু, এত তাড়াতাড়ি সে উত্তর দেবে, ভাবতে পারিনি।
তার রূঢ় স্তনবৃন্ত আমার বুকে খরখর শব্দ তুলে নিচু স্বরে জানায়, লাল্লু ঠিকই তো বলেছে।
০২. আঠারো বছর পরে
গত বছরের মতো এবারেও গরমের ছুটির কিছুদিন আগে থেকে দীপ্তি শুরু করেছে, এবার গরমের ছুটিতে আমরা কেদার-বদ্রী যাব।
বলছে মেয়েকে; কিন্তু আমাকে শুনিয়ে।
এবার এপ্রিলে আমাদের বিয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ১৮ বছর ধরে তার যাবতীয় কামনা ও বাসনার খবর আমি প্রথম দিকে দেওয়াল ও পরবর্তীকালে চৈতি মারফত পেয়ে থাকি। সে বলে আমাকে; মেয়েকে শুনিয়ে।
কিন্তু, নতুন বছর থেকে সে সুর বদলেছে। এবার সে যে রাগে গাইছে, তারই নাম বোধহয় আশাবরী। এর মিড-গমক-মূৰ্ছনা সবটাই আলাদা। ভাবখানা, যেন কেদার-বদ্রী সেরে এসে সে জনে জনে সুতোর তাগা আর চিনি-রোলার প্রসাদ বিতরণ করছে।
এর মধ্যে একদিন, দীপ্তি বেরিয়ে যাওয়ার পর, চৈতি তিন-তিনখানা রেনকোট আমার সামনে এনে রাখল।
কেন রে?
মা সেল-এ খুব সস্তায় পেয়েছে। কেদারের পথে যেতে লাগবে।
আমাকে দেখাবার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন সে বোধ করেনি। এবার তার আত্মপ্রত্যয় এত বেশি।
ওর কলেজের বীণাদি মনোরমাদিরা গত গ্রীষ্মে পাল স্পেশালে কেদারনাথ বদ্রীনাথ গিয়েছিল। সেই থেকে বলছে। ওদের সঙ্গে তখন যেতে পারত। তা নয়।
আমরা যাব। সামনের বছর পুজোয় আমরা ফ্ল্যাটের সেকেন্ড ইনস্টলমেন্ট দেব। শান্তিনিকেতনে, কোপাই নদীর একদম ধারেই, মাস্তৃপিসি ৫ কাঠা জমি ছেড়ে দিচ্ছে। এখন হাজার দুই দিয়ে বায়না করলেই হবে। আমরা কিনব।
এ ধরনের সঙ্কল্প সে করে মেয়ের কাছেই, তবে তখন, যখন আমি ধারেকাছে থাকি। অবশ্য, এইটুকু তিন-ঘরা ফ্ল্যাটে কত দূরেই বা যাব।
একটু জোরে ফিসফিস করেও যখন কিছু মেয়েকে বলে, এ ঘরে শোনা যায়। জানা যায় যে, সে যাবে। সে দেবে। সে কিনবে।
ভুল বললাম।
আমরা দেব। আমরা কিনব। আমরা যাব।
আমার সঙ্গে আদৌ কোনও পরামর্শ না করে, আমার সুবিধে-অসুবিধের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ না করে, সে এই সব সিদ্ধান্ত নেয় ও সেই সব অভিযানের তোড়জোড় করতে জমির দালাল বা পাল স্পেশালের ভূমিকায়, যখন যা, আমাকে অবতীর্ণ হতে বলে।
এখনও পর্যন্ত আমি তাকে একটি ব্যাপারেও না বলতে পারিনি।
দেব। যাব। খাব। করব। করাব। কিনব।
এ নয় যে ভবিষ্যবাচক এই সব ক্রিয়াকর্মের প্রতিটি ব্যাপারেই সে আমার মুখাপেক্ষী। বা, উচ্চারণ করে তার সকল কামনাই সে এভাবে ব্যক্ত করে। তা নয়। সে এতটা খেলো নয়। তার ব্যক্তিত্ব আছে। যেমন, ওই জামদানিটা কিনব। ফান মাঞ্চ খাব। এগুলো বলে না। আলমারি বা ফ্রিজে কমলা রঙ করাব। বলে না। বা, বাথরুম মোজায়েক, কী ডাইনিং টেবিলে সানমাইকা! রঙ, কাঠ ও রাজমিস্ত্রির ব্যাপারে সে আমার বদলি হিসেবে পাড়ার কন্ট্রাক্টর দত্তবাবুর সংস্পর্শে এসে গেছে। দীর্ঘ ১৮ বছরের দাম্পত্য-জীবনে গুণরাশিনাশি দারিদ্রদোষ থেকে আমরা যত মুক্তি পেয়েছি যতই দুধ-আনা, রেশন-আনা থেকে অব্যাহতি মিলেছে, ততই আমরা কবে থেকে যে ক্রমাগত আমি হয়ে গেছি, সরে এসেছি দুজনেই দুজনের কাছ থেকে, কত যে। কোনওদিন কাছাকাছি ছিলাম হয়ত। না পড়ুক মনে, সুখ অথবা দুঃখের কোনও কোনও ঘটনা আমাদেরও জীবনে নিশ্চয়ই ঘটেছিল। অন্তত, সিনেমা তো গেছি। দুজনে বেড়াতে গেছি অন্তত মিহিজামে। যাইনি? এক বিছানায় শুয়েছি কত না বার। কিন্তু, ওর ওই পরস্ত্রীমুখের দিকে তাকালে আজ আমার মনেও হয় না, যে, আমরা কোনওদিন পরস্পরকে হয়ত চুম্বনও করেছি। বড় ভুলো মন আমার, নিঃসন্দেহে।
তাই, সে যখন আমরা বলে, আমি দেখতে পাই লতা-পাতা-ঘাসফুলে ঢাকা এক নিখুঁত ফাঁদ। একটা গহ্বর। ফাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে, আমি তার নির্মিতির কৃৎ-কুশলতা তারিফ না করে পারি না।
এমনকি, মাঝে মাঝে আমি যদি তাকে এখনও কাছে ডাকি, আর ঘুমন্ত মেয়েকে পাশের ঘরে রেখে সে আমার সিঙ্গল বেডে আসেও আমাদের সেই শোয়া ব্যাপারটিও কখনও যুগ্মতায় পর্যবসিত হয় না। (হয়েছিল নাকি কোনওদিন?) এই কাজটিও মূলত একা-একা সে নিম্পন্ন করে নেয়, (নিয়েছে ও বরাবর নিয়েছিল) কত অনায়াসে, কী পেশাদারি শারীর পটুতায়! সে এসে সেক্স করে যায়, তার মান-মর্যাদা, এমনকি, বলা যেতে পারে, তার কৌমার্যটুকুও অক্ষুন্ন রেখে। কী নিপুণভাবে পারে যে! শিশুপাল বধ যেন দর্পহারী শ্রীমধুসূদনের। কুচুৎ করে গলাটা কেটেই, ওই, আবার তর্জনীতে সুদর্শন। বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে।
নাকি, কন্ট্রাক্টর দত্তবাবুর সূত্র ধরে ভাবব, ওর কাছে গোটা দাম্পত্য ব্যাপারটাই স্রেফ হিসেবের কড়ি। যে, রঙ করেছ, পারিশ্রমিক পেয়েছে। এবার এই ফ্রিজ আমার। আলমারি আমার।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি বাঁজা নয়, এ ছাড়া আর কিছু জানবার জন্যে সে একদিন মাথায় সিঁদুর ও গায়ে লাল বেনারসি ও মুখময় চন্দন পরেছিল বলে আমার মনে হয় না।
এই যেমন আজ এপ্রিল ১৭, ১৯৮৮। সোমবার। এখন বেলা সাড়ে ৯টা। দীপ্তি ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে। লেখক নই, তবু আমি এ ঘরে এই সব ছাইপাঁশ ভেবে যাচ্ছি। হঠাৎ, ডাইনিং স্পেশ থেকে, সি-শার্পে—ধূর! ইচ্ছে করে সব টান মেরে ফেলে দিই। হুশ-হুশ!
মেয়ে চৈতি এসে জানায়, জলের জাগের ওপর একটি আরশোলা দেখা দিয়েছিল। চলে গেছে।
আমি : তা, একটা আরশোলা গেরস্ত বাড়িতে মাঝে-মধ্যে দেখা দেবে না? ও কি সাধ করে বসেছিল জলের জাগে? ওর যদি সেই জ্ঞান থাকত যে ওটা জলের জাগ, পায়খানার মগ নয়, তাহলে কি ও…
চৈতি : হ্যাঁ। কিন্তু মাকে সেটা বোঝাবে কে?
আমি (চেঁচিয়ে) : যেভাবে আর্তনাদ করে উঠলে, জলের জাগ জড়িয়ে একটা সাপ উঠতে দেখলে, সত্যিকারের সর্বনাশ এলে, সেদিন তাহলে কীভাবে চেঁচাবে?
দীপ্তি (মুখে ভাত-তরকারি) : চৈতি, বাবাকে ভ্যাড়র-ভ্যাড়র করতে বারণ কর। আমি এখন কলেজে যাচ্ছি। এক ঘণ্টার পথ।
তা সত্যি। আমি চুপ করে যাই। সাজগোজ শেষ করে, শুধু পায়ে চটি পরার কাজটুকু বাকি রেখে, শেষকৃত্য হিসেবে সে বাথরুমে যায়। সোম আর শুক্র এই দুদিন পরপর প্রথম দু পিরিয়ড তার অনার্স ক্লাস। বাস-জার্নি ধরে ঝাড়া তিনটি ঘণ্টার ব্যাপার। কলেজে পৌঁছেই সোজা ক্লাসে। ক্লাসে যদি বাথরুম পায়, সে ভারি বিশ্রী। চৈতির সঙ্গে তার আলাপচারীতে এ কথা জানা গেছে যে, সে আজকাল ইলাবোরেশান অফ থট প্রপারপড়াচ্ছে। সাইকোলজির একটি রীতিমত জটিল বিষয়।
আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আসা যাক। যা বলছিলাম : আমরা। আমরা বলতে আমি আর দীপ্তি। স্বামী-স্ত্রী। আমাদের দুজনের যত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী সমাজ যাদের সংস্পর্শে আমরা এসেছি এবং আরও আসতে থাকব—সর্বত্র আমাদের পরিচয় তো একটাই। আমরা বিবাহিত। আমরা স্বামী-স্ত্রী। আইনের চোখে তো বটেই। অন্তত, ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত।
অথচ, আমরা জানি, জন্তু-জানোয়ারদের ক্ষেত্রে যেমন হয় না, আমাদের বিবাহ হয়নি।
প্রশ্ন : আচ্ছা, এ পৃথিবীতে সংজ্ঞার্থে কোনও নরনারীর বিবাহ কি এ যাবত কোথাও হয়েছে?
এটা আমার একটা আন্তরিক জিজ্ঞাসামাত্র। এর উত্তর আমার জানা নেই। তাই। শুধু জানি, আমাদের সেই অর্থে হয়নি। অর্থাৎ, সংজ্ঞার্থে।
এসপ্ল্যানেড টু চেতলা-১৭,৩বি, ট্যাক্সি বা মিনি যাতেই আসি, প্যারিস হলের সামনে দিয়ে নিত্য আসা-যাওয়া। পৌষ মাস-ভাদ্র মাস নেই সেখানে রোজ বিয়ে। দিনে দিনে প্যারিসের র্যালা যেন বেড়েই চলেছে। মাড়োয়ারিদের বিয়ে হলে তো কথা নেই। আলোর রোশনাই তখন ভিক্টোরিয়া মৃত্যু-সৌধকেও টেক্কা দিতে চায়। তোরণ-দ্বারে ইংরেজি নিয়ন অক্ষরে অনেকটা ডানলপ ইজ ডানলপ—অলওয়েজ অ্যাহেড ধরনে জ্বলে-নেবে বর কনের নাম: সুরেশ ওয়েড্স পদমিনি। ডিস্কো মঞ্চ থেকে ভেসে আসে হাসান জাহাঙ্গিরের গান:
হাওয়া, হাওয়া, এ হাওয়া, খুসবু লুটা দে
ইয়ার মিলা দে, দিলদার মিলা দে…
কিন্তু যত ফুলে-ফুলেই ভরে উঠুক বিবাহের মণ্ডপ, আলোর রোশনাই কি সানাই, কনের গা ভরে যাক গয়নায় চূড-ব্রেসলেট-নেকলেশ বাউটি ও বালায় কি লাল বেনারসিতে, সিঁথিতে যতই ঢালা হোক সিঁদুর–আদি যৌনধ্বনি উলু আর শাঁখে বর আর কনের শরীর যতই ভরিয়ে দিক মিলনোন্মত্ত বাঘ-বাঘিনীর গানে—বিবাহের উল্কি যতই করে পড়ুক তাদের সর্বাঙ্গে আমি জানি বা জানাতে চাই যে, কিছুই, কিছুই বোধহয় মানব-মানবীর বিয়েকে সে মন্ত্রমুগ্ধতা শেষাবধি দিতে পারে না যেখানে যদিদং হৃদয়ং তব। প্রকৃতপ্রস্তাবে, বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে প্রত্যেক মানব-মানবীর হয়ত একটাই সাধারণ অভিজ্ঞতা হয়। যে, এখানে। আর সব কিছুরই প্রয়োজন আছে, শুধু একটা জিনিসের নেই। আর সেটা হল, প্রেম।
আমার বিবাহিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে, জোড়ায় পেলে, আমি জনে জনে জানতে চেয়েছি, আচ্ছা, তোমরা কি, তোমরা কি, পরস্পরকে ভালবাস?
প্রত্যেকে মুখ-চাওয়াচায়ি করেছে। কেউ বলেনি, হ্যাঁ। প্রশ্ন তো এ নয় যে কাল ভোররাতে দুজনে মিলে খুব তুলো উড়িয়েছিস–হ্যায় না?
তাহলে বলতে পারত, তুমি একবচন এবং তৃতীয় ব্যক্তি, তোমাকে বলব কেন হে?
কিন্তু, এ তো একটা সামাজিক প্রশ্ন।
ফ্রয়েড, হ্যাভলক, এলিস, কিনস্ থেকে অধুনাতন মাস্টার্স অ্যান্ড জনসন জোড়ায় জোড়ায়। শত শত দম্পতিকে কাছে ডেকে কত না প্রশ্নোত্তর করল। যৌন প্রসঙ্গে কত কী নতুন তথ্য জানা গেল। মাস্টার্স অ্যান্ড জনসন তো পূর্বাপর অনেক ধারণাই ভেঙে দিল। কারা এদের সাহায্য করল?
না, সারা পৃথিবী থেকে চয়ন করা বিভিন্ন বয়স, ধর্ম ও জাতির পাঁচ শত ইচ্ছুক দম্পতি। কিন্তু, এই একটা ব্যাপারে, স্যাম্পল বা র্যানডম, কোনও প্রকার সার্ভেই আজও হল না। কেউ সাহস করল না করতে। যে, ওহে, ভাল কি বাস?
স্বীকার করি, এমন একটা বিষয়ে অনুসন্ধান করতে যাওয়া টুটেনখামেনের রত্নময় অন্ধকার সমাধিগৃহে প্রবেশ করার চেয়েও ঢের সাহসের কাজ। কারণ, উত্তরে যদি না পাওয়া যায়—সে হবে এপ-প্রজাতিতে দুবর্লতম হলেও বৃহত্তম জননাঙ্গধারী,সমস্তরকম আবহাওয়ায় যত্রতত্র (এমনকি বরফ-ঘর ইগলুর মধ্যে এস্কিমোরাও) সঙ্গম করতে সক্ষম মানব সমাজের পক্ষে চূড়ান্ত লজ্জার ব্যাপার। কেন না, প্রেমময় মনোগ্যামি, সে তো আজকের কথা নয়। সেই উদ্দালকের কাল থেকে চলে আসছে। মানব সভ্যতার সে টেংরি খুলে নেবে, এমন বাপের ব্যাটা কে! কেন না, প্রেম যদি সমস্ত দাম্পত্য মূল্যবোধের পিতা না হয়, তাহলে মেনে নিতে হয়, পৃথিবীর সমস্ত দাম্পত্য জারজ।
বিশেষত, যে-কোনও আত্ম-জিজ্ঞাসুনারীর পক্ষে এ-প্রেমহীনতা মেনে নেওয়া বড় লজ্জার কথা, আমি মনে করি। যে, প্রেমই যদি না থাকবে, তাহলে, যৌনতার অবসানে, মাতৃত্বের অবসানে, আমি তোমার কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত পেলামটা কী। শুধু বাথরুম-বেডরুম, এই বাড়ি আর গাড়ি, ফ্রিজ-টিভি-টেলিফোন-লকারে গয়না? শুধু প্রজন্ম রক্ষা–এ কাজ তো স্বামীর স্ত্রী-ভূমিকাবর্জিত রক্ষিতার দ্বারাও দিব্যি সম্পন্ন হত। হত না কি!
আসলে, প্রজাপতি ঋষির নামে ওই মন্ত্রগুলো। কবিতা, ছবি আর গানগুলো। ওই ভালবাসার গল্পগুলো। রোমিও-জুলিয়েট না হয় মিঠুন চক্রর্তী আর মাধুরী দীক্ষিত, অমন যে ডাকসাইটে রাসকলনিকভ, সেও কিনা, সোনিয়ার (যদিও বেশ্যা, স্ত্রী নয়) প্রেমে হ্যাঁ বলল। বা, পুতুলনাচের ইতিকথার শশী! সেও কি একবারটি জ্বলে উঠল না সেই অলীক শিখা হয়ে যার বাইরেটা হলুদ এবং ভেতরটা নীল—অর্থাৎ কিনা, রাধা এবং কৃষ্ণে-যখন সে জানতে চাইল, শরীর, শরীর! তোমার মন নাই কুসুম? (যদিও পরস্ত্রী)।এ পৃথিবীতে একজন সন্তও আজও দেখা গেল না, হায়, যার ঈশ্বরে প্রয়োজন নেই। অথচ, ঈশ্বর বিনা সন্ত হওয়ার সম্ভাবনা যদি না থাকবে, তাহলে প্রেম বিনা এত লক্ষ কোটি দম্পতি এই গ্রহের পিঠে এমন ড্যাং ডেঙিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কী করে।
তাই বলছিলাম, দীপ্তি যখন বলে আমরা, ঘাসফুল ও লতা-পাতায় ঢাকা নিপুণ হাতে ফদা সেই গহ্বরের সামনে আমি থমকে দাঁড়াই ও পাথরে দুবার খুর ঠুকি।
আমার মনে পড়ে, মধ্যিখানে-চরে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ কালোধূসর সেই বাইসনকে–যেবার, বিয়ের তৃতীয় বছরে ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে, আমরা গিয়েছিলাম মানস স্যাংচুয়ারিতে।
তখন বিকেলবেলা। তার পিছনে তিন দিকে কোথাও নীল, কোথাও সবুজ, কোথাও অস্তরাগে রাঙা ভুটান হিলস। তার দুপাশ দিয়ে কাকচক্ষু মানস নদী দ্বিধারায় বহে চলেছে। তার সামনে, নদীর ওপার। যেখানে, যতদূর দেখা যায় দিগন্ত পর্যন্ত হাতি-ঘাসের অরণ্য। সূর্য সেখানেই অস্ত যাবে।
হাতির পিঠে সামনে মাহুত, মাঝখানে আমি, পিছনে দীপ্তি।হঠাৎবাঁ-হাতের তর্জনী ঠোঁটের ওপর রেখে দক্ষিণবাহু অঙ্কুশ সহ তুলে মাহুত তিন-চারশো গজ দূরে অনন্ত স্থিরচিত্রে অর্পিত সেই তাকে, বাইসনটিকে, আমাদের দেখায়।
আমরা দেখলাম, তিন-চারটি বৃত্তে পাকানো তার দুটি শিঙে। (যা দৈঘে সাত থেকে ন ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং শুরু হয় কমপক্ষে আট ইঞ্চি প্রস্থ দিয়ে) জড়িয়ে আছে অনেকদিনের লতাপাতা, ঘাস ও ফুল–যা বিশাল ও বর্ণময় মুকুটের মতোই দেখাচ্ছিল। সে একা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল স্থির অথচ বিপন্ন এক মুগ্ধতার দৃষ্টান্ত হয়ে। পশ্চিম দিগন্ত থেকে বিধাতার শ্রেষ্ঠ আলোকসম্পাত ক্রমে এগিয়ে এসে তার একাকীত্বকে ঘিরে ধরে।
এমন দৃশ্য জীবনে কটা, যা আমৃত্যু মনে থাকবে? এটা ছিল তেমনি এক নিঃসঙ্গ অভিজ্ঞতা।
আমাদের সে দেখতে পেয়েছিল অনেক আগেই। তবু হঠাৎ একটা হাওয়া উঠে মনুষ্যগন্ধ তার নাকে নিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে নিশ্চিত হতে পারেনি। তারপর…
সেই প্রথম বোঝা গেল সে চলৎশক্তিহীন নয়।
সে দুবার পেছন পায়ের খুর ঠোকে। তারপর শুরু হল তার মৃত্যু-ভীতির সেই প্রবল ঝড়-দৌড়।
অমন ভয়াবহ ভয় পেল সে, কেন যে।
প্রথমে বালি, তারপর নুড়ি, তারপর ছোটবড় বোল্ডার–স্তরে স্তরে খুরধ্বনি বাড়িয়ে গোটা নদী-উপত্যকা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শোন ব্রিজের ওপর দিয়ে ডুন এক্সপ্রেসের আলো চলে যাওয়ার গতিদিব্যতায় সে নদী পেরিয়ে ছুটে চলল একটানা, ওপারের ওই ঘন ঘাসের জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে, বুঝি তার শিঙের নাড়া খেয়েই, দিগন্তে সূর্য উঠল ঈষৎ লাফিয়ে।
হাতির পিঠ থেকে মাহুত যেভাবে দেখিয়েছিল, সেভাবে, অশরীরী বিমুগ্ধ হাত তুলে আমি দীপ্তিকে দেখাই : লতাপাতা আর ঘাসফুলে তৈরি সেই বিশাল মুকুটটা নদী পেরোবার সময় কখন তার মাথা থেকে খসে পড়ে, আমি লক্ষ্যই করিনি। এখন স্বর্গস্রোতধারা ধরে ভেসে চলেছে। ওই যে।
দীপ্তি মাহুতকে বলল, বাংলোয় ফিরে চল।
বলবার দরকার ছিল না। মাহুত হাতির মুখ আগেই ঘুরিয়ে নিয়েছে। সূর্য ডুবে গেছে।
এখানে হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে।
দীপ্তি বলল মাহুতকে, দাঁড়াও। হাতি বৈঠাও। আমার দিকে চেয়ে, আমি পেছনে বসব না।
মাচান থেকে যখন হাতির পিঠে সবার পিছনে চাপে, আমি তখনই বলেছিলাম, এটা মথানগুড়ির বাংলো। কোর এরিয়া। এখানে বাঘ থাকে। আর বাঘে হাতির পিঠে লাফায় পেছন থেকেই।
মাকড়সায় ঘৃণা, আরশোলায় আতঙ্ক। কিন্তু তখন ভাবখানা ছিল, আমার বাঘের ভয় নেই। তাছাড়া আমি যখন জানি, কথাটা ভুল। এখানে বাঘ থাকে না। তাহলে কি বাংলো থাকত। মানুষ আসত। থাকলেও বাঘ পেছন থেকে লাফায় না। হাতির পিঠে।
আমি বলেছিলাম : আমি ছাপার হরফে পড়েছি। তাও বাংলায় নয়। ইংরেজিতে।
দীপ্তি তখন শোনেনি। সেই পিছনেই বসেছিল।
ফেরার পথে হাতি বসলে, এবার আমি পিছনে চলে এলাম। ওর কথাই ঠিক। হাতির পিঠে বাঘ পেছন থেকে লাফায় না। বরং এবার আমার কথায় সামনে বসার দরুন, মাঝখান থেকে, একটা ডালের ঝাপ্টা লেগে ওর কপালটা বেশ ছড়ে গেছে। বাংলোয় হাতি থেকে নেমেই দীপ্তি আমাকে অভিযুক্ত করল।
এসব ব্যাপারে বলতে হয় না কিছুই। বাংলোয় না ফিরে পাহাড়ি বনের ভিতর দিয়ে আমি অ্যান্টিসেপটিকের খোঁজে বিট অফিসার দেবেন্দর ঠাকুরের কোয়ার্টারের দিকে চললাম।
ভুটান এবং আসাম, মানস স্যাংচুয়ারি দুদিকেই ছড়িয়ে। ২৮৪০ স্কোয়্যার কিলোমিটার। আমি জানি। এখানে ১৮০টা বাঘ আছে, আসার সময় টাইগার প্রোজেক্টের দেববর্মা আমাকে বলেছে। আমি জানি।১৮০ ব্যাঘ্ৰসঙ্কুল মানসের কোর এরিয়া ভেদ করে, ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, দীপ্তির জন্যে দু-চার ফেঁটা স্যাভলনের খোঁজে এই ভরা সন্ধেবেলায় আমি এগিয়ে যাই।
আজ পূর্ণিমা। বিকেল এখনও ফুরায়নি। এর মধ্যেই চাঁদ উঠে এল এতটা! নিচে, নদীর বুকে, দিনের আলো আর জ্যোৎস্না মিশে স্বর্গরঙ। শেষ যাত্রী-নৌকা চলেছে ভুটানের দিকে।
বাংলোর বারান্দায় চা খেতে খেতে দীপ্তি নিশ্চয়ই এটা মিস করছেনা, ভেবে ভাল লাগল।
প্রথম রাতেই মথানগুড়িতে বাঘ ডাকল। খুব একটা দূর থেকেও নয়। কাঠের খুঁটির ওপর গোটা বাংলোটা কেঁপে উঠল। শার্সির ঝনঝন শোনা গেল। দীপ্তি ভয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। অমন নিবিড়, সপ্রেম আলিঙ্গন সেই প্রথম। এবং একবারই।
পরদিন সকালে একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে দেখি জিনিসপত্র গুছিয়ে স্নানটান করে দীপ্তি একদম রেডি। কী ব্যাপার!
এখানে আর থাকব না। শিলং যাব।
সে কী। গোল্ডেন লেঙ্গুর দেখবে না? নদীর ওপারে ভুটানে গেলেই সোনালি ল্যাজ ঝুলিয়ে সব… আর একদিন থাকা যাক না।
না।
ওই বিশ-তিরিশটা যা আছে এখানেই। জান? পৃথিবীতে এই স্পিসিসটা আর কোথাও নেই।
একটা জিপ বরপেটা যাচ্ছে। এখুনি। লেট আস মুভ।
এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্যাংচুয়ারি। আর একদিন থাকবে না?
এঃ। কী আমার ভূপর্যটক রে। জেলেপাড়ার ছেলে। নাও ওঠো তো। এরপর কবে ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যাবে…
বলেছিলাম, আমি পড়েছি। মোস্ট বিউটিফুল স্যাংচুয়ারি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।
ছাপার অক্ষরে?
ছাপার অক্ষরে।
ইংরেজিতে?
ইংরেজিতে। গ্রন্থের নাম : ই পি গির ওয়াইল্ড লাইফ ইন ইন্ডিয়া। তাতে মানস নিয়ে একটা পুরো চ্যাপ্টার আছে। সেখানে রয়েছে। এত সুন্দর জায়গা! তোমার প্রকৃতি ভাল লাগে
দীপ্তি? (আজ আমারও যাচ্ছেতাই লাগে।)।
তুমি থাক তোমার ই পি–কী বললে যেন গি নিয়ে? আমি চললাম–এত বলে সে তার স্যুটকেস তুলে নেয়।
চটি গলাবার আগে খালি পায়ের চেটোর ওপর ভর দিয়ে সে একবার ঈষৎ লম্বা হয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়। শিফনের সাদা প্রিন্ট শাড়ির মধ্যে দিয়ে দেখা যায় কালো ব্রেসিয়ার উদ্ধত স্তনের স্পর্ধা তার বোঁটাদুটি : রঙ করেছ। পারিশ্রমিক পেয়েছে। এখন এই স্তন, কটি, জঙ্খ, যোনিদেশ–এসব আমার।
বিয়ের মাত্র ৩ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, সেই প্রথম দীপ্তির সঙ্গে চোখে-চোখ কুৎসিত ঝগড়া। সেই প্রথম তার আমিত্বের ঘোষণা। আমি তার ঔদ্ধত্য দেখে স্তব্ধ। প্রস্তরীভূত। তার মধ্যে পর-স্ত্রী দর্শন, আমার সেই প্রথম।
দেন, গো টু হেল।
আমি পিছন থেকে তার পাছার উদ্দেশে বলি : আগুন যাকে পোড়াতে পারে না, অস্ত্র যাকে বিদ্ধ করতে পারে না তুমি কি সেই জিনিস?
আজ এমন ঘটনা ঘটলে বলি (মনে মনে), দেন, ফাঁক ইওরসেলফ।
মানসের একা বাইসন, সে বড় ভয়ঙ্কর। ই পি গির বইতে বারবার সতর্কীকরণ আছে। যে, যে-প্রাণভয়ে ভীত হয়ে সে ওভাবে পালাতে পারে, যে ভয় দেখায়, সেই একই অমিত প্রাণভয়ে সে তাকে আক্রমণও করে থাকে। সে যে কী করবে, পালাবে না গুঁতোবে, সেটা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। অরণ্যে তার চেয়ে ভীরু ও দুর্বল প্রাণী নেই। এবং তার চেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী প্রাণীও আর নেই।
আক্রমণ করার আগে, ই পি গি জানিয়েছেন, সে দুবার পিছন-পায়ের খুর আছড়ায়। পালাবার আগেও তাই করে। তার পলায়ন ও আক্রমণের ভঙ্গিমা একই। সে দুবার পিছনের পা আছড়ালে, তাই বাঘেও রিস্ক নেয় না। বোঝে না, সে পালাবে, না শিং নামিয়ে তেড়ে আসবে। বাঘ উভয়ত পালায়।
দীপ্তিকে কিছুকাল আগেও আমি মাঝে-মাঝেই বোঝাতাম, আচ্ছা,দীপু,এই যে দিবারাত্র এত খোঁচাখুঁচি কর, আঁ, সে কোন ভরসায়। আমি তো খাঁচার মধ্যে নেই। কিংবা, যদিই থাকি, যাকে তুমি খাঁচা বলে দেখছ, সেটা তো পাকাটিরও হতে পারে?
এত বলে আমি মানসের সেই ভীত বাইসনটির কথা না-ভেবে পারি না যে পা আছড়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেবার ভয়ে।
এ সব তোমার মালের টেবিলের বন্ধুদের বোলো। হাতোলি পাবে।
খুব একটা ভুল বলে না দীপ্তি। আজ আর।
তার ভাষা নেই। তাই তার হয়ে উত্তরটা আমি আজ নিজেই নিজেকে দিয়ে থাকি।
ষাঁড় বটে। কিন্তু তুমি ভাই দাগা। ধর্মের। ঘুরে বেড়াচ্ছ কাশীতে।
রাঁঢ় ষাঁড় ঔর সিঁড়ি-সন্ন্যাসী
যব তক বাঁচে
তব তক কাশী।
০৩. পরম পরমাণু বা সমুদ্রপাখির ডাক
প্রশ্ন : এই তাহলে ছিল তোমার বিবাহিত জীবন?
উত্তর : কোয়ার্ক!
প্রঃ : তবু তোমরা একসঙ্গে?
উঃ : কোয়ার্ক! কোয়ার্ক!
পৃথিবীর সব দম্পতিই এমন, আমি তা বলি না। আমাদের চেয়েও ঢের অমানুষিক সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত আছে।
এখন, আদালতের পরিভাষায়, আমি দু-একটি এক্সিবিট পেশ করব। দৃষ্টান্তগুলি কাল্পনিক নয়। নামটাম পাল্টে দিলেও ঘটনা অদলবদল করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমি লেখক নই এবং আমার কল্পনাশক্তি শূন্য (অবশ্য, লেখক না হলেও আমি এটা জানি যে, কল্পনাশক্তি যাদের থাকে তারা অতি হেঁদো লেখক)। অতএব, যে বা যাঁরা উদাহরণগুলির মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাবেন, তারা ভুলেও যেন না ভাবেন, আমি তাদের কথা হয়ত বলছি না। আমি ঠিক তাদেরই সাক্ষ্য দিতে ডাকছি। আত্মপক্ষ সমর্থনের খাতিরেই আমাকে এ কাজ করতে হচ্ছে, যা খুনিরও আছে। আমি নাচার।
দৃষ্টান্ত–১
—আপনার নাম বলুন।
–নীহার মজুমদার।
—পেশা?
—শিল্পী।
—পেইন্টার না স্কাল্পটর?
—পেইন্টার।
—স্ত্রীর নাম?
–হিমানী।
—মজুমদার?
–মজুমদার।
—আপনারা সুখী দম্পতি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আচ্ছা, গত ১৭ জানুয়ারি সকালবেলা। আপনি সদ্য ঘুম থেকে উঠে, রেডিওয় হারানো দিনের গান শুনছিলেন : গানের সুরে জ্বালব তারার দীপগুলি…। আপনার বিধবা, পরে মৃতা, ছোটবোন গাইতেন। তখন আপনার পরনে আন্ডারউইয়ার ছাড়া কিছু ছিল না, বিছানায় বসে চাদর মুড়ি দিয়ে আপনি গানটি শুনছিলেন। ওই সময় আপনার স্ত্রী ঠিকে-ঝি নন্দর মা আগের দিন আসেনি বলে তার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে গজগজ করছেন। আপনি আন্ডারউইয়ার পরে পরিচারিকার সামনে গিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলেন, এমন একটা সুন্দর গান হচ্ছে, বকুল গাইত… একটা পাখি উড়ে গেলে ভাগাড়েও ছায়া পড়ে তোমার ক্ষেত্রে কি সেটুকুও প্রযোজ্য হয় না!, প্রযোজ্যশব্দটি আপনি ইউজ করেছিলেন, যার আর্বান এফেক্টের দরুন, স্বীকার করি, এটাকে ঠিক খিস্তি বলা যায় না। কিন্তু, কনটেন্ট-ওয়াইজ, এ তো স্ত্রীকে তবে রে মাগী বলার প্রকারান্তর। নয় কি?
—আমি আগের দিন খুব মদ খেয়েছিলাম। হ্যাংওভারে ছিলাম।
—সত্যি কি না। হ্যাঁ, না, না?
–হ্যাঁ।
—তবে রে মাগী?
—হ্যাঁ। বিচারপতির প্রতি : প্লিজ নোট। ইওর অনার।
—আর একটু পিছিয়ে যাচ্ছি। আগের বছর। ৩ জুলাই। রবিবার। বেলা সওয়া ১২টা। আপনি তখন দোতলায় দক্ষিণের ঘরে। আপনার স্টুডিওয়। বিখ্যাত স্বপ্ন ও সাধনা ছবিটি শেষ করছিলেন যা বাইশ হাজার টাকায় সম্প্রতি বোম্বাইয়ের জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারি থেকে বিক্রি হয়েছে। আপনার স্ত্রী আপনাদের ড্রইংলবি থেকে ওগো শুনছ এই শুনছ বলে ডাকছিলেন। আপনি তৃতীয়বারে শুনতে পেয়ে উত্তর দেন, কী ব্যাপার? একবার এসো নাগো, উনি ডাকেন।
—হ্যাঁ, এমনটা তো হতেই পারে। কী ব্যাপার!
—আরও দু-একবার ডাকাডাকির পর আপনি চেঁচিয়ে উত্তর দেন, এখন কী করে যাব? এখন আমি ছবিটা শেষ করছি। হেগোপোঁদে যাব?তখন অবশ্য আপনাদের পরিচারিকা ছিলেন না। কিন্তু জাহাঙ্গির থেকে ওই ছবিটাই বুক করতে এসেছিলেন কোটিপতি কালেক্টর শ্রীশ্যাম ক্যাশপ ও, ওখানে আপনার তৃতীয় এগজিবিশনের ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে। যদিও বাংলা তিনি একদম জানেন না। এবং, যেহেতু আপনি তখন ওই মূল্যবান ছবিটি তৈরি করছিলেন–তখন লেফট হ্যান্ডার বলে আপনার বাঁ হাতে ব্রাশ ও ডানহাতে প্যালেট–আমরা কি ধরে নিতে পারি যে, আপনার স্বপ্ন ও সাধনার মধ্যে স্ত্রীর প্রতি ওই উক্তি বিশেষত হেগোপোঁদ শব্দটি অননুমেয়ভাবে মিশ্রিত হয়ে আছে?
—প্লিজ স্টিক টু দ্য পয়েন্ট লার্নেড ফ্রেন্ড। আদালত শিল্প সমালোচনার স্থান নয় : বিচারপতি।
—এক্সকিউজ মি মিলর্ড। (নীহারের প্রতি) বলুন!
—তখন আমার মাথায় একটা জেনারেটর পুড়ে যাচ্ছিল।
—হ্যাঁ অথবা না বলুন।
—হ্যাঁ। (দুশ্চিন্তিতভাবে) তা তো কিছুটা থাকবেই।
(বিচারপতির প্রতি ইঙ্গিত)
—আপনি পায়েলকে চেনেন?
—হ্যাঁ। আমার মডেল হিসেবে ছিল কিছুদিন।
—আপনাদের মাল্টি-স্টোরিডের পার্কিং জোনে গাড়ির মধ্যে আপনি তার সঙ্গে উপগত হন।
—আমি ড্রাঙ্ক ছিলাম।
—কিন্তু ড্রাইভার তেওয়ারি ছিল না। সে গাড়ি থেকে নেমে সোজা আপনার বারো তলার ফ্ল্যাটে উঠে যায় এবং আপনার স্ত্রীকে যা বলার বলে সে-ই, মধ্যরাতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। সে রাতেই স্ত্রী ওই প্রসঙ্গ তুললে, আপনি ছি ছি ছি, ড্রাইভারকে তুমি স্পাই হিসেবে লাগিয়েছ—ছি ছি-ছিঃ ছিঃছিঃবলতে বলতে তার কপালে ডাইনিং টেবিল থেকে ডিশ ছুঁড়ে মারেন। তারপর প্রহার করেন।
কিন্তু, তারপর, সারারাত আমি তার শুশ্রুষা করি। তাছাড়া ওসব আগে হত। এখন আর হয় না।
—এখন আর পরনারী করেন না?
–করি। কিন্তু এখন আমার স্ত্রী ওসব মেনে নিয়েছেন।
—এখন আপনারা সুখী?
—আমরা চিরকাল সুখী ছিলাম।
দৃষ্টান্ত–২
—আপনার নাম?
–ডাঃ ব্যোমকেশ বর্মন।
—আপনার স্ত্রীর নাম?
—শুভলক্ষ্মী বর্মন।
—পেশা ডাক্তারি?
—হ্যাঁ।
—আপনি একজন বিশেষজ্ঞ?
—হ্যাঁ।
–কীসে আপনার বিশেষজ্ঞতা?
—ব্রেস্ট ক্যানসারে। আমি হাত দিয়ে টিপে ব্রেস্ট টিউমার বিনাইন না ম্যালিগন্যান্ট বলে দিতে পারি।
-আপনি রোগ নির্ণয়ের জন্য কত নমর্দন করেছেন?
—দেশে না বিদেশে?
—বিদেশের কথাই আগে বলুন।
—হ্যাঁ, বিশেষ করে সুইডেন আর জাপান আমাকে কয়েকবার ডিমনস্ট্রেশন দিতে নিয়ে গেছে। ওখানে তো পেসেন্টরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ওদের কম্পিউটারে সমস্ত ডাটা আছে। তবে এদেশে
—এ-দেশে?
—এ-দেশে হিসেব রাখা হয় না।
—আপনি মারা যান কত সালে?
—১৯৮৬-র ২৯ সেপ্টেম্বর, ভোর পাঁচটা পাঁচ মিনিটে আই ব্রিড মাই ল্যাস্ট হ্যাফ।
—হোয়াইলাস্টহাফ?
—শেষ নিঃশ্বাসটা আমি আধখানার বেশি নিতে পারিনি।
—আই সি। আপনার কী হয়েছিল?
—মাল্টিপ হার্ট ব্লক।–আচ্ছা, অপারেশন করাবার আগে আপনি দশ লক্ষ টাকার একটা ইনসিওরেন্স করাবার চেষ্টা করেছিলেন। কেন?
—হ্যাঁ, অসুখটা কী আমি ৬ মাস আগেই বুঝতে পারি। তাই তাড়াতাড়ি যদি লক্ষ্মী কিছু পেয়ে যায়!
—অসুখটা ইনসিওরেন্স চেক-আপেই ধরা পড়ল?
–হ্যাঁ।
—ডাঃ জর্জ লুমিস আপনাকে স্টেটসে আসতে বলেছিলেন?
—হ্যাঁ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেলভিউতেই হল। বোম্বে থেকে এলেন ডাঃ ভরোসে। ভাবলাম, কলকাতায় হলে লক্ষ্মী পাশে থাকবে, ছেলেমেয়ে থাকবে—মনে জোর পাব। তাই এখানে করালাম। আমাদের একটা অভ্যাস ছিল। সেই শুভদৃষ্টির দিন থেকে। রোজ ঘুম থেকে উঠে আমরা বিছানায় দুজনে-দুজনকে জড়িয়ে, দুজনে-দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম এক মিনিট–চোখের পলক না ফেলে। পরে এটা তিন মিনিট পর্যন্ত বাড়ানো গিয়েছিল। এক ধরনের যোগা বলতে পারেন। ভাবলাম, মরে যাবার সম্ভাবনাই তো বেশি। ভেবেছিলাম, শেষবারের মতন ওর চোখে-চোখ রেখে……তাই বেলভিউ-এ।
—পেরেছিলেন?
–এন্-না। (হেসে) পারার কথাও নয়। তখন যা হয় আর কী। শেষ মুহূর্তে। সবাই যা করে। আরও আধখানা নিঃশ্বাস নিতে পারি কিনা সেই চেষ্টাই করেছিলাম।
-আচ্ছা, নার্সিংহোমে ভর্তির ডেট পিছিয়ে দিলেন কেন?
—শেষ কদিন তো উকিল, ইনকাম ট্যাক্স আর ব্যাঙ্কের লোকদের নিয়েই কাটল। তারা ছাড়বে, তবেনা যাব? যেখানে যা গোলমাল আছে সব ঠিকঠাক করাতে হল।সমস্ত অ্যাকাউন্ট লক্ষ্মীর নামে ও তার বেনামে ট্রান্সফার করাতে হল। কালো টাকা যা, যথাসম্ভব সাদা করতে হল। ট্রাস্ট, ডিড অফ গিফট এসব করাতে কটা দিন দেরি হয়ে গেল আর কী। আমি আর উইল-টুইলের ঝামেলায় যাইনি। প্রবেট করানো এক ঝামেলা। সে-সব লক্ষ্মী একা পেরে উঠবে না।
—আচ্ছা, বছর ঘোরার আগেই আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করলেন। কেন?
—ও, দ্যাট শি হ্যাড টু ডু। দেয়ার রিমেনড নো আদার অপশন ফর হার। হল কী, যার নাকি সহমৃতা হওয়ার কথা—অন্তত আমাকে তাই বলেই শাসিয়েছে বারবার, যে, যদি আমি আগে মরি তাহলে… বিধবা হওয়ার পর সে-ইদ্যাখ-দ্যাখ করে মোটাতে শুরু করল। বিশেষত, পাছায় ওর মাংস লাগল প্রচুর। গায়ের ফর্সা রং লাল হয়ে একদম যাকে বলে ফেটে বেদানা। একজন পতিগতপ্রাণা সদ্যবিধবার পক্ষে খুবই লজ্জার কথা বৈকি! সত্যি কথা বলতে কি, লক্ষ্মী আমার পুত্রবধূর চেয়েও সুন্দরী আর অ্যাট্রাকটিভ হয়ে উঠল, মাত্র মাস-ছয়েকও যেতে না যেতেই।
–তারপর?
–কথা হল, শরীর তো মিথ্যে বলে না! বৌ ঊর্মির প্ররোচনায় ছেলে একদিন মাকে বলে বসল, লজ্জা করে না! বিধবা মাগী মাছ-মাংস খাস! বন্ধুবান্ধবদের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। সেই দিনই পাখায় শাড়ি বেঁধে… আসলে, আমারই ভুল। আমার ছেলের নামেও কিছু টাকাকড়ি রেখে আসা উচিত ছিল। আমার ছেলেটা লুম্পেন।
—ভিনা শীতলবলকে আপনি চেনেন?
–-হ্যাঁ, আমার অ্যানাসথেসিওলজিস্ট।
–ভিনাকে উনি সেদিন বাড়িতে আসতে দেননি। শ্মশানেও যেতে দেননি।
—হ্যাঁ। ভিনা কাঁদতে কাঁদতে ফোন করলে, লক্ষ্মীও কাঁদতে কাঁদতে বিচহোর এই সব বলে বিশ্রী গালাগালি দিয়েছিল ওকে।
—আপনার অ্যাকাউন্ট্যান্ট আপনার বারো লক্ষ টাকা খরচের হদিশ করতে পারেননি।
—আ-হ্যাঁ। ওটা, ওটা আমি গলফ গ্রিনে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ভিনাকে দিই। আই আম গ্রেটফুল টু হার। লাভ-মেকিং-এর আগে ওই আমাকে বাথরুমে গিয়ে টু দা লাস্ট ড্রপ ব্লাডার খালি করে আসতে শেখায়। ডিউরেশন এতে সত্যিই বাড়ে। শি ইউজড টু হ্যাভ টু অর্গাজম অ্যাট ইচ অ্যান্ড এভরি অকেজন। আ, আই হ্যাভ টু এনডিওর টুয়েন্টি-টু ইয়ার্স অফ ম্যারেড লাইভ টু নো হাউ ইট ইজ টু গেট সাড বায় আ উওম্যান। মাই-মাই!
—আপনাদের এরকম দাম্পত্যকে কি সুখকর বলা যায়?
—হ্যাঁ। আমরা ছিলাম সুখী দম্পতি। প্রতিদিন লক্ষ্মী নিজের হাতে আমার গেঞ্জি ও ব্রিফ কেচে দিয়েছে। স্নান করে উঠে কোনওদিন ভোলেনি লোহা আর সিঁথিতে রাঙ্গাজবা লাগাতে।
—চুল উঠে যায় শোনার পর থেকে চীনে সিঁদুর ব্যবহার শুরু করলেন, শেষের দিকে।
—হ্যাঁ, মেটে-মেটে রং। বিশ্রী। কুৎসিত।
—আপনার অসুখটাও তার পরেই ধরা পড়ল।
—হ্যাঁ। যতদিন রাঙ্গাজবা সিঁদুর ইউজ করত—
—আপনারা সুখী দম্পতি?
—আমরা সুখী দম্পতি।
দৃষ্টান্ত–৩
—আপনার নাম কী? —–অনাদিপ্রসাদ।
–পুরো নাম?
—অনাদিপ্রসাদ।
–পদবি বলুন।
—আমি পদবি ব্যবহার করি না।
—এটা আদালত। বাবার পদবি বলুন। নইলে আদালতের অবমাননা করা হবে।
—আমার মা ব্রাহ্মণকন্যা। এবং বাবা জেলে। তাদের বিবাহ হয়নি।
–বাপের পদবি-সহ নাম জানা আছে?
—আছে।
—মা বলে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ–।
–বাপের এবং মার পদবি জুড়ে আপনার পুরো নাম বলুন।
—ডক্টর অনাদিপ্রসাদ সাঁতরামুখার্জি।
—আপনি কীসে ডক্টরেট?
—বাংলা সাহিত্যের মলমূত্র নামে আমার থিসিসের জন্য।
—স্ত্রীর নাম কী?
–সারদাময়ী।
–সাঁতরামুখার্জি?
–সাঁতরামুখার্জি।
—আপনি স্ত্রীকে ভালবাসেন?-
-অ্যাঁ-ম্যা…
—উত্তর দিন।
—এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
-আদালতে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কিছু নেই। হাঅথবা নাবলতে হবে। দুটোর একটা বলুন।
—এবং চলবে না?
–এবং বলতে?
–হ্যাঁ এবং না?
–না।
—শুধু অথবা?
—শুধু অথবা। হ্যাঁ অথবা না বলতে হবে।
–মনে হয় চলবে না?
—আপনার যা মনে হয় সেটা আপনার থিসিসে চলতে পারে। এখানে শুধু সাক্ষ্য অথবা প্রমাণ। হ্যাঁ, কিংবা না।
—আচ্ছা, হ্যাঁ।
—আচ্ছা-ফাচ্ছা চলবেনা।বলুন, হঁ্যা।নইলে আপনাকে এই মুহূর্তে হোস্টাইল ডিক্লেয়ার করব।
—হ্যাঁ।
—স্ত্রীর সঙ্গে আপনার যৌন সম্পর্ক নেই কতদিন?
—পনেরো বছর।
–এখন বয়স কত?
—পঁয়তাল্লিশ।
–তিরিশ থেকে?
—বিয়োগফল তাই।
—সম্পর্ক নেই কেন?
—হিস্টেরেকটমি, মানে ওই ওর ইউটেরাস রিমুভড হবার পর, ও যন্ত্রণার কথা বলত। কিছুতেই নিতে পারত না। উঃ, আঃ মাগো, মরে গেলাম এইরকম বলত। মাসখানেক চেষ্টা করলাম। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, ছিঃ, আমি না মানুষ। হাল ছেড়ে দিলাম।
—ডাক্তারের কাছে গেলেন না?
–না, তখন আমার ধারণা ছিল, হিস্টেরেকটমির পর বোধহয় আর সেক্স করা যায় না। লজ্জায় বন্ধুবান্ধবদের কাছে জানতে চাইনি যাদের স্ত্রীদের অমন হয়েছিল। তাছাড়া ওই সময় রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পাের যৌন ব্যাপারটার ভার পুরোটা আমার ওপর এসে পড়ল। সাহিত্য অকাদমির গ্রান্টে চলে গেলাম আর্জেন্টিনা। অনেককাল বাদে, একদিন রোববার দুপুরে রোয়িং ক্লাবে বিয়ার খেতে খেতে ব্যোমকেশ আমাকে বলল, সে কীরে। খুব প্রেমসে করা যায়, ব্যোমকেশ তখনও বেঁচে, আগের চেয়ে ঢের ভাল করা যায়। আমার শালা কাতুর বৌ এর তো হয়েছে। ফকিং-টকিং দিব্যি চলছে। তাছাড়া কনসিভ করার ভয়ও আর থাকে না। ফ্রি লাভ বলতে যা বোঝায় আর কি। একদম তাই। বলে ও খুব একচোট হাসল। কিন্তু, ততদিনে বছর চারেক পেরিয়ে গেছে। ততদিনে সারদা কেঠো, কড়ে বিধবা।
—সেক্স লাইফ কীভাবে কাটালেন। এতগুলো বছর?
–মাস্টারবেট করে। (রিমলেস গ্লাস নাকের ডগায় নামিয়ে) হ্যাঁ!
—আপনারা পাশাপাশি শোন না।
–নাঃ। ও পাশের ঘরে শোয়।
—অথচ, সবাই আপনাদের সুখী দম্পতি বলে জানে?
–অথচ, সবাই আমাদের সুখী দম্পতি বলে জানে।
—ইউ ডিডন্ট গো ফর এনি আদার উওম্যান, ডিড ইউ?
—এন-নো। আই ডিড নট।
বিচারপতি : স্টিল ইউ আর ইন বেস্ট অফ টার্মস?
—ইয়েস মি লর্ড।
—অ্যাজ হ্যাজবন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ?
—ইয়েস মি লর্ড। সুখী দম্পতি বলতে তো তাদেরই বোঝায় যখন সবাই তাদের সেভাবে দ্যাখে, তাই না? ইন পয়েন্ট অফ ফ্যাক্ট, মি লর্ড, আমার শ্বশুরবাড়ির তরফ থেকে আমাদের ২৫তম বিবাহবার্ষিকীর জন্যে ইল্লববারেট প্রিপারেশন হচ্ছে।
–আচ্ছা। এখন বলুন! আপনারা সুখী দম্পতি?
—দাম্পত্য জীবনের সুখ-অসুখের কথা আদালতকে বলা নিরর্থক ধর্মাবতার।
—কেন?
–কারণ, আদালত ক্লীবলিঙ্গ। আদালতের বিবাহ হয় না।
—ইফ দিস ইজ নট, দেন হোয়াট এলস্ ইজ কনটেম্পট অফ দ্য কোর্ট, মিলর্ড?
—হুজুর! মিলর্ড! ধর্মাবতার! দাম্পত্য জীবনের সুখ-অসুখ আমি আদালতকে বোঝাব কী করে? দাম্পত্য মানে তো শেকলে বাঁধা দুজন মানুষ একজন স্ত্রী আর আর-একজন পুরুষ যে যার নিজের শেকল চাটছে। কী করে আমি আদালতকে এটা বোঝাব, এতেও একটা সুখ আছে। (ক্রন্দন)
কৌঁসুলি : আপনি ইতিমধ্যেই কঠিন শাস্তিযোগ্য একটি উক্তি করেছেন আদালতকে ক্লীবলিঙ্গ বলে–
—(বিচারপতির প্রতি, কাঠ-গড়া চেপে ধরে, ঝুঁকে) সার, আপনি ব্যাকরণ দেখুন। বিচারপতি (হাতুড়ি ঠুকে) : আদালত ব্যাকরণ মানে না। বলুন, আপনি সুখী না অসুখী? অনাদিপ্রসাদ (শিকল ও অশ্রু একত্রে ঝেড়ে) : সুখী ধর্মাবতার।
দৃষ্টান্ত–৪
—আপনার নাম কী?
–কুবের হালদার।
—স্ত্রীর নাম?
—স্ত্রীর নাম মন্দিরা হালদার।
—আপনি কী করেন?
—শিয়ালদহর কাছে নুর মহম্মদ লেনে আমার হারমোনিয়ামের দোকান আছে। নাম : সুর-লক্ষ্মী।
—টেবিলের ওপর রাখা একটি উজ্জ্বল হারমোনিয়াম দেখিয়ে) এই হারমোনিয়ামটা চিনতে পারছেন?
—হ্যাঁ। ওটা মন্দিরার হারমোনিয়াম। একদিন ওটা সারাতে ভাই-এর সঙ্গে মন্দিরা আমার দোকানে নিয়ে এল। দেখলাম, কারিগরির দিক থেকে যন্ত্রটি খুবই ভাল। তবে, কালক্রমে এর উইন্ড চেম্বার, ভয়েসিং, টিউনিং সব নষ্ট হয়ে গেছে। খুব বেসুরে বাজছিল।
–বলে যান।
—রিডগুলো ঘষে ঘষে আমি সুর মেলালাম। জার্মান টিউনিং ফর্ক দিয়ে অনেক খেটেখুটে সা-টু-সা মেলালাম। সিঙ্গল রিডকে স্কেলচেঞ্জিং-এ পরিণত করলাম। পালিস-টালিসের পর কালক্রমে খুবই সুন্দর দেখাল। মন্দিরা এতটা আশা করেনি আমার কাছে। আমাদের বয়সেরও অনেক তফাত।
—সেই আপনাদের পরিচয়ের শুরু। তারপর?
–তারপর কালক্রমে আমার আর মন্দিরার বিয়ে হল। কালক্রমে আমাদের সন্তানাদিও হল।
—উনি গান গাইতেন?
—হ্যাঁ। তবে শেষ ছমাস আর গাইতে পারত না। সেই ছোটবেলা থেকে তানপুরা ধরত মালবিকা কাননের সঙ্গে। গান ওঁর কাছেই শেখে। তারপর কালক্রমে ওর গলায় ক্যানসার হল।
—কিন্তু এখন এই হারমোনিয়ামটা পাওয়া গেছে শেওড়াফুলির নিরাপদ মল্লিকের বাড়ি থেকে।
—হ্যাঁ। আমি ওকে বিক্রি করি। প্রথমটা করতে চাইনি। স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব ভেবেছিলাম। কালক্রমে করলাম।
—এটা কি সত্যি যে এই হারমোনিয়ামের সুরে গান গেয়ে গায়িকার গলায় ক্যানসার হয় বলে অনেকেই এটা কিনতে চাননি?
–কেউ না। কিন্তু মল্লিক বেপরোয়া লোক। ভজন ছাড়া ও কিছু গায় না।
—কত দাম পান?
—চার হাজার।
—স্ত্রীর মৃত্যুর কত দিন পরে বিক্রি করেন?
–ছমাসের মধ্যে।
–টিউনিং ইত্যাদির জন্যে আপনি নিরাপদবাবুর কাছে আরও পাঁচশোর জন্য খুব চাপাচাপি করেছিলেন?
–কালক্রমে সাড়ে চার হাজার পাই।
—আর স্ত্রীর তানপুরাটা। যা মালবিকা কাননের সঙ্গে বাজাতেন?
–কালক্রমে ওটাও বিক্রি হয়।
–কালক্রম বলতে কি পরে?
—ওটা হারমোনিয়ামের আগেই বিক্রি হয়ে যায়। এতে তো ক্যানসারের ব্যাপার ছিল না।
—ভাল দাম পেয়েছিলেন?
—ভাল দাম পেয়েছিলাম।
—আচ্ছা কুবেরবাবু, স্ত্রীর মৃত্যুর পর, ওষুধের আন-ইউজ ফয়েলগুলো–যা বেঁচেছিল…
—হ্যাঁ। ওগুলো আমি সব স্থানীয় প্যানাসিয়া ড্রাগ স্টোর্স-কে বিক্রি করে দিই।
—ভাল দাম পেয়েছিলেন?
—ভাল দাম পেয়েছিলাম। সবই দামি ওষুধ।
বিচারপতি : (কৌঁসুলির প্রতি) কুয়ো ভাদিস, মাই লার্নেড ফ্রেন্ড?
কৌঁসুলি : লিডিং টু দা পয়েন্ট, ইওর অনার।
বিচারপতি : (বিরক্ত মুখে): এ মামলার আসামি কে বা কারা? উইটনেসের পর উইটনেস বক্সে দাঁড়াচ্ছে–আসামিরা কই?
কৌঁসুলি : দে শ্যাল অ্যাপিয়ার অ্যাট দা রাইট মোমেন্ট, ইওর অনার। (সাক্ষীর প্রতি) আচ্ছা, আমার শেষ প্রশ্ন। হলদিয়া থেকে আপনারা বাসে ফিরছিলেন একবার। মনে আছে?
-হ্যাঁ। শালির ছেলের অন্নপ্রাশনে যাই।
—দুজনে বসার সিটে পাশাপাশি বসেছিলেন। বাসে আপনারা একটাও কথা বলেননি। সেদিন কি ঝগড়া হয়েছিল?
–না-না। ঝগড়া, মনোমালিন্য এসব আমাদের একদিনের জন্যেও হয়নি। এ জন্যে বন্ধুবান্ধব সবাই আমাদের হিংসে করত।
বিচারপতি : তাহলে? তিন ঘণ্টার পথ… বাসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটাও কথা হবে না?
–স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আর কী কথা হবে, ইওর অনার, বাজারে মাছ কাটিয়ে এনেছ, তবু গায়ে আঁশ লেগে কেন–এ-ছাড়া?
আদালতে হাস্যরোল।
বিচারপতি : চোপ! আদালত চলছে।
কৌঁসুলি : (বিচারপতির প্রতি) মিলর্ড। এবার আমি আসামিদের ডাকছি।
০৪. দূরাকাঙ্ক্ষের বৃথা ভ্রমণ
বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে, মিহিজামে, আমার সমস্ত আগ্রহে জল ঢেলে দিয়েছিল চৈতি। ওর তখন ৪ বছর বয়স।
সেই সত্তরের শুরুতে একবার যা চুনার কাশী, শর্ট অফ মধুচন্দ্রিমায়। পরের বছর দীপ্তি এক রকম জবরদস্তি নিয়ে গিয়েছিল গৌহাটি, ওর দিদি-জামাইবাবুর কাছে। ওঁরাই মানসে পাঠান। মথানগুড়ির বাংলোর মাথায় ব্যাঘ্র-গর্জনের রাতেই সে, হিসেব মতো, কনসিভ করে। সেই থেকে ব্যাঘ্রপ্রজাতির কাছে আমি ঋণী। চৈতির কারণে।
কাশী-চুনার আর মানস–তারপর গত ১৬ বছর ধরে বড় বাইরে বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেরকম কোথাও আমাদের যাওয়া হয়নি। হিসিটিসি তথা ছোট বাইরে করতে কলকাতার আশপাশে যেটুকু যেতে হয় গেছি। যেমন, শান্তিনিকেতন। গাদিয়াড়া কি বকখালি। তারপর ৭৭-এ, ট্রেনে চেপে, মিহিজাম।
দীপ্তির দাদা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে বেরোন। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। উঠেছিলেন একজন অ্যাডভোকেটের বাড়িতে। সেই সূত্রে সেবারের শীতে আমরা দীপ্তির দাদা-বৌদির কাছে দিনসাতেক থেকে আসি।
মিহিজামে, রেল লাইনের ধারে, একটা বিশাল ধানক্ষেতকে ঘিরে গোলাকারে রাস্তা। চেঞ্জারদের ভাষায়, মিহিজাম রাউন্ড। হাতলে হাতির দাঁতের কারুকাজ, মলাক্কা বেতের একটা সুন্দর ছড়ি হাতে উনি, দীপ্তির দাদা, রোজ বিকেলে গুনে তিন পাক হাঁটতেন। আমরা, সূর্য ডোবা পর্যন্ত, এক জায়গায় অপেক্ষা করতাম আলের ধারে বসে। ওঁর জন্যে। চৈতির তখন সেই বয়স যখন স্কুলে প্রমিস মানে কী জানতে চাওয়ায় ও মিসকে বলেছে, টুথপেস্ট।
একদিন ওইরকম বসে আছি। আর জজসাহেবের ইরেক্ট ও গম্ভীর হাঁটা হনহন করে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। পিছনে সূর্যাস্ত। যে কারণে, যত কাছে আসছেন, ছায়া আরও লম্বা হচ্ছে। আজকের মতো হাঁটা শেষ বোঝাতে উনি দূর থেকে ছড়িটা উঁচু করে নাড়া দিলে, ধানক্ষেতের ওপর ওজন-যন্ত্রের কাটার মতো কেঁপে ওঠে সাদা ছড়ি থেকে বেরিয়ে তার অস্থির ও অতিকায় কালো ছায়া।
সেদিকে তাকিয়ে চৈতি হঠাৎ জানতে চাইল, আচ্ছা, বাপি?
বল রে।
মামু এ-ভাবে ঘুরে ঘুরে রোজ হাঁটে কেন?
হাঁটতে হয়। শরীর ভাল হয়। দীপ্তি বলল।
চৈতি ফের আমার কাছেই জানতে চাইল, তাহলে মামু সোজা হাঁটে না কেন? তাহলে তো কতদূর চলে যেত, না বাবা?
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। সাধে কি ওকে ভাবি বাঘের বাচ্ছা!কী যে আঁচড়ানি ছিল ওইটুকু পুঁচকে মেয়ের কথায়, ক্রোধে দীপ্তির মুখ লাল– ওর বৌদির বিব্রত হাসি দেখতে না পেলে আমি যে তখন আরও কত হাসতাম তার আর ঠিক নেই। হাসির চোটে প্রাণ আমার সেদিন বেরিয়ে যাবার জোগাড়।
চুপ কর, বোকা মেয়ে কোথাকার, বলে দীপ্তি আমার নির্বোধ হাসির গালে একটা চড় কষায়, যদিও লাগে চৈতির গালে।
ঠোটঠোট ফুলিয়ে, চোখে জল, চৈতি আমার আরও কোল ঘেঁষে আসে, বারে! এতো, মামু তো, ঘুরে ঘুরে সেই একই জায়গায় বারবার ফিরে আসছে। না, বাবা?
ভাগ্যিস সেটাই ছিল সেদিন ওঁর সেদিনের শেষ পাক! আরও একবার ওঁকে (প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে) ঘুরতে দেখতে হলে, অন্তত সেদিন, নিশ্চিত তা আমার দেখা মানুষের নির্বোধতম কাজ বলে মনে হত।
লেকিন, বাত তো সহি। চৈতি তো বলেছে ঠিকই। যে, তাহলে হাঁটা কেন? সেই ফিরেই যদি আসব, তাহলে বাড়ি থেকে পালিয়ে বারবার, কেন ট্রেনে চাপা? কেন উড়ে যাওয়া প্লেনে?
ঐতিহাসিক স্থানগুলির কথা আলাদা। কিন্তু ইতিহাসনা জেনে তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে সবটাই তো ভূগোল। মানুষ বা ইতিহাস-সম্পর্কিত নয় এমন টাইগার-হিলে সূর্যোদয়-জাতীয় দৃশ্যগুলি কি নিরামিষ বা আলুনি লাগে না? অ-মানবিক লাগে না? নদী দেখলে স্নান টান করার কথা মনে পড়াই তো প্রাথমিক। তা না, এই কুলে আমি/আর ঐ কুলে তুমি/মাঝে নদী বহে গো…
ছ্যা-ছ্যা।
পরিষ্কার ঝর্না-জল দেখে অঞ্জলি ভরে একটু মুখে-চোখে দেব কি দু-চুমুক পান করব–তা না…
ঝর্না! ঝর্না!
সুন্দরী ঝর্না। তরলিত চন্দ্রিকা
চন্দন বর্ণা!
যত্তসব।
৫০-দশক পর্যন্ত, শীত পড়লে, এ-দেশি ড্যাঞ্চিবাবুরা সপরিবারে চলে যেত পশ্চিমে। তার একটা মানে হত। রাঁচি, কার্মাটার, কাশী, সাহেবগঞ্জ, ডেহরি-অন-শোন যেখানে যাও, সেঁটে থাক মাস খানেক পনেরো দিনের মধ্যে চেঞ্জ বা গত্তি লাগাও গায়ে—সারা দিনভর, সিনারি নয়–পাখি নয়–পরী নয়–কিছু নয় শুধু ডিম খোঁজ, খাঁটি দুধ খোঁজ মাছ-মাংস-ছানা–কী টাটকা শাকসবজি, যেখানে যা পাও, কে কত সস্তায় আনতে পার, আন দেখি। কালি কুয়া পাহাড়ের মাথায়। তাতে কী। পানীয় জল আসবে সেই সেখান থেকে। প্রচুর আয়রন! আর হ্যাঁ, যা কিনবে সবই যেন ড্যামড় চিপ হয়, হ্যাঁ।
এই জন্যেই তো ওসব দিকে চেঞ্জারদের নাম ছিল ড্যাঞ্চিবাবু!
ফেরার সময় হাওড়া স্টেশনে মাল-মাপর সেই ওজন-যন্ত্রে চাপো, যার ওপর একের পর এক চেপে, যাবার সময়, এমনকি শিশুদেরও শুইয়ে, ওজন নেওয়া হয়েছিল। বেড়ে থাকলে শাব্বাশ। নইলে এলেবেলে। দূরাকাঞ্জের বৃথা ভ্রমণ!
ছোটবেলায় মা বাবা হারিয়ে আমি মাসির বাড়ি কালিম্পঙে মানুষ। কালিম্পঙে দেখেছি, যেদিকে ঝর্না, পাহাড়, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত, খরস্রোতা তিস্তা ছুটছে বা কিশোরী রেলি নদী ফ্রক পরে এক্কা-দোক্কা খেলছে যেদিকে পাহাড়ি মানুষদের প্রত্যেকটি বাড়ির সেদিকেই পায়খানা। প্রতিটি সদর দরজা পথের ওপর, তাদের।সমতলের পরিযায়ী নেচার ক্যাংলাদের বাড়িগুলোর গেটই শুধু নিসর্গের পর নিসর্গের দিকে, যে জন্যে তাদের নাম তিস্তা-ভিউ, স্নাে-ভিউ—এমত। ললালেগাঁও-এর রাস্তায় জজসাহেব বাড়ির নাম রাখেন, গডস লিটল একার। আরস্কিন কন্ডওয়েলের উপন্যাস, কলেজে পড়ার সময় হাতে হাতে ঘুরত। উপন্যাসের নামেই যদি নাম রাখবেন, জজসাহেব ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট-এর দাবি ভুললেন কী করে, আজ ভাবি।
কালিম্পঙে রিংপিংটন রোডের ওপর ছিল ধনবাহাদুর সিং-এর প্যাকিং বাক্স দিয়ে তৈরি চা আর দই-এর দোকান। দই আনাতে মাসি প্রায়ই ওর কাছে পাঠাত। একদিন সকালবেলায় দেখি, কোথা থেকে জোগাড় করেছে কে জানে, হাতখানেক লম্বা মস্ত এক বায়নাকুলার চোখে লাগিয়ে, বুড়ো ধন দুরবিনদারা হিলের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন এদিকে টরটরে রোদুর, অথচ, শুধু দুরবিনদারার মাথায় ঘন মেঘ। ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে শুধু তার সর্বাঙ্গে।শরৎকালে ওই দিকে এমনটা খুব হয়। স্বচ্ছনীল স্ফটিক বাথরুমের মধ্যে না জানি দেবতার সে কী অনিবৰ্চনীয় শাওয়ার-বাথ ধন দেখছে, এমনটাই ভেবে আমি জানতে চাই, কেমন দেখাচ্ছে ধনবাহাদুর, সুন্দর, না?
কেয়া দেখায়গা খোকাবাবু। আভি তো বরখা হো রহা হ্যায়।
সুন্দর দেখাচ্ছে, না?
ম্যায় তো হামারা বকরি চুঁড় রহা হ্যায় খোকাবাবু, কপালে দূরবিন দিয়ে টোকা মেরে ধন বলেছিল, শালহা উধারই কঁহা ভাগ গিয়া হোগা।
চৈতি কিছুটা আমার ধাত পেয়েছে। এই বয়সেই ঘরকুনো। যা গেছে, গেছে। বকরি খুঁজতে পাহাড়ে, অরণ্যে, সমুদ্রে কোথাও সে আর কিছুতে যাবে না। বেঁচে থাক তার টিভি আর ভি-সি-আর। কলকাতা ছেড়ে সে আর স্বর্গেও যেতে চায় না।
তবে দীপ্তি যাবে। কেদার ও বদ্রী এ-যমজ সে প্রসব করবে। এবং এবার, এই সামারেই।
ঋতুক্ষান্তির পরেও এ যেন অবুঝ নারীর গর্ভ-উন্মাদনা।
যেন তার হক।
অন্তত, আমি ব্যাপারটা সেভাবেই নিয়েছি।
যে, সে যাবে। এবং, যদি যেতে হয়, একা কেন যাবে।
আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবে।
০৫. আসামি হাজির
দীপ্তি আমাকে বলেছিল, কোনও ট্রাভেল এজেন্ট ঠিক করতে।
আমাদের অফিসে একটা হিমালয় লবি আছে। নেতা অ্যাকাউন্টসের দ্বিজেনবাবু। ছোটখাট গাঁট্টাগোট্টা টাইপের দ্বিজেনবাবুকে, সবাই বলে, অনেকটা নাকি যতীন চক্রবর্তীর মতো দেখতে। সামান্য বাকিটুকুকে সম্পূর্ণতা দিতে উনি হাফ-পাঞ্জাবি পরলে পারতেন, পকেটে মোটা কলম কি মুখে লম্বা চুরোট রাখা যেত–আর-এস-পি করলে তো কথাই ছিল না। তা না, উনি ভালবাসলেন হিমালয়কে।
দ্বিজেনবাবু শুনেটুনে বললেন, হ্যাঁ, চলে যান। কে কে যাচ্ছেন?
উইথ ফ্যামিলি।
ক জন?
স্ত্রী, মেয়ে–আর আমি।
একটা নোট শেষ করে নিচে সাবমিটেড লিখে তার ওপর মিয়ার ইনিসিয়ালের বদলে জবরদস্ত ডি কে মুখার্জি পুরোটা দস্তখৎ করে, জের মাথার ফুটকির বদলে এক আউট সাইজ শূন্য বসিয়ে, স্বাক্ষরের নিচে একটা আনুভূমিক ইংরেজি এস টানলেন দ্বিজেনবাবু। তারপর মুখ তুলে কালো লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমা খুলে রাখলেন টেবিলে।
তারপর, দীপ্তির স্টাইলে, যেন যাওয়া হয়েই গেছে এমনভাবে বললেন, তা চলে যান।
না, মানে দেখুন, আমার স্ত্রী বলছিলেন, কোনও ট্রাভেল এজেন্ট-টেজেন্ট ঠিক করতে। যেমন ধরুন, পাল স্পেশাল।
এন্না-না-না-না। ছোট ছোট দুবাহু বাড়িয়ে ঘোর আপত্তি করলেন দ্বিজেনবাবু, নেভার। ট্রাভেল এজেন্সি তো ঘণ্টা নেড়ে আর হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে বলে যাবে, কেদার দেখো। বদ্রী। দেখো। তারপর ঝপ করে দেবে ঢাকনাটা বন্ধ করে। প্রশস্ত টেবিলের ওপর দিয়ে মুণ্ডুটা যথাসাধ্য এগিয়ে এনে, গলা নামিয়ে, যেন গোপন খবর, দ্বিজেনবাবু বললেন, আপনার যদি বদ্রিবিশালে দুদিন বেশি থাকতে ইচ্ছে করে, আপনি থাকবেন না? যদি অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গমে দশ মিনিট বসতে ইচ্ছে করে, রুদ্রপ্রয়াগে, ব্রিজের ঠিক নিচেই– আহা, সে কী দৃশ্য—আপনি কি বসবেন না? দেখবেন, সেদিনটা হয়ত রুদ্রপ্রয়াগেই থেকে গেলেন। সঙ্গমেই জগদম্বার মন্দির। পাহাড়ের মাথায় রুদ্রনাথ।এত বলে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজলেন তিনি। ধ্যানস্থ ক মুহূর্ত!
কিরণদাকে তুমি দ্যাখোনি, না?হঠাৎ তুমি-তে নেমে পড়লেন দ্বিজেনবাবু, তোমাদের সেন্ট্রাল সেকশানেই তো ছিলেন। রুপোর গোল চশমা পরতেন–
কিরণদা…
ডায়েড নাইন্টিন সিক্সটি ফাইভ। টোয়েন্টি থ্রি ইয়ার্স ব্যাক। দ্যাখোনি?
আমি তখনও জয়েন করিনি…
সিক্সটি টু থেকে হিমালয় যাচ্ছি। ছাব্বিশ বছর। প্রথমবার নিয়ে গিয়েছিলেন কিরণদা। পরপর তিন বছর উনি ছিলেন আমাদের লিডার। ওঁর একটা পা-ই ছিল না, জানো তো? প্রথম বছর রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে বসে রইলেন। পরের বছর থেকে তো ক্রাচ-বগলে আমাদের সঙ্গে কেদার-বদ্রী-মদমহেশ্বর-ত্রিউগিনন্দনকানন-তপোবন, যেবার যা, সব ঘুরেছেন। এমন। কত কিরণদাকে যেতে দেখবে কেদারের পথে। কত অন্ধ চলেছে, চক্ষুম্মানের হাত ধরে।… তখন যোশিমঠ থেকে হাঁটতে হত বদ্রী ওখান থেকে ৪০ কিলোমিটার বেশি তো কম। নয়। পৌঁছতেই তিন দিন লাগত। শুধু বদ্রীতে। রুদ্রপ্রয়াগে ফের নেমে এসে কেদার। কেদার যেতে চার দিন। এখন তো– দ্বিজেনবাবুর চশমার উঁটির জয়েন্টে স্কু খুলে গেছে। এতক্ষণ চেষ্টার পর একটা আলপিন ঢুকিয়ে সেটা নিজেই মেরামত করার তৃপ্তি ফুটে উঠল তাঁর মুখে, বদ্রী অব্দি সোওজা বাস যাচ্ছে। ওই কেদারেই যা গৌরীকুণ্ড থেকে পনেরো কিলোমিটার হাঁটা।ও কিসসুনা!বলতে বলতে হঠাৎ আমাদের কথা মনে পড়ল তার,বেশ তো, ফ্যামিলি নিয়ে যাচ্ছেন। না হয়, কেদার এবার বাদ দিলেন।
দেখুন দ্বিজেনদা, আমি তাড়াতাড়ি বলি. সে হবার নয়। কেদারে ও যাবেই।
বেশ তো। উনি ডান্ডি করবেন একটা। চেয়ার-পাল্কির মতো। ভ্রূ কুঁচকে একটু ভেবে বললেন, এখন এই মে-জুনে ফুল সিজন। তা, যাতায়াত হাজারের মধ্যে ওঁর হয়ে যাবে। চার বেহারার কাঁধে চেপে দুলতে-দুলতে যাবার এক্সপিরিয়েন্সটাও আগে থেকেই হয়ে যাবে। হ্যা-হ্যাঁ।
পথে অসুখ-বিসুখ–অ্যাকোমডেশন–অ্যাটাচড বাথ ছাড়া ওর চলবে না বলেছে…
ধূর মশায়।তুমি থেকে রাগ করে ফের আপনিতে উঠে গেলেন দ্বিজেনবাবু, আপনারা কেদার যাবার লোক না যাচ্ছেন বাবার কাছে, চাইছেন অ্যাটাচড বাথ। সে তো তাহলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। আপনি ট্রাভেল এজেন্টই দেখুন। আপনাদের পক্ষে সেটাই ভাল হবে।
তাড়া থেকে ও বাবা, এ আবার কখন এল বলে ক্র্যাশ প্রায়োরিটি ছাপ মারা একটা ফাইল টেনে নিলেন দ্বিজেনদা।
দ্বিজেনদার কাছে তাড়া খেয়ে বেজায় চটে গেলাম দীপ্তির ওপর। আজ বাড়ি ফিরে আচ্ছাসে ঝাড়তে হবে। মহাপ্রস্থানের পথে একি কুকুর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ নাকি যুধিষ্ঠির! অ্যাটাচড বাথ চাও তো সঙ্গে যেতে বাথরুমকে ডাক। হোয়ায় মি, অ্যাঁ, আমাকে কেন!
এখানে-ওখানে গিয়ে আমি টুকটাক কেদারবদ্রীর খবর জোগাড় করতে লাগলাম। যেখানেই যাই, বিশেষত কেদার প্রসঙ্গ একবার তুলি। কেদারই টাফ। গৌরীকুণ্ড ৬০০০ মিটার। কেদার সাড়ে ১১। গৌরী টু কেদার একটানা বিরতিহীন চড়াই। পথ ১৫ কিলোমিটার। সরু, ঘোড়ার গু আর শ্যাওলায় পিচ্ছিল পাকদণ্ডীর হাঁটা পথ। পথের পাশে ডানদিক জুড়ে পাতাল।
যদি ডান্ডি না পাওয়া যায় ভাল।দীপ্তি ঘোড়ায় মরে গেলেও চাপবেনা জানিয়েছে। তাহলে গৌরীকুণ্ড থেকে ফিরে আসবে। এক আমি যদি কান্ধা দিয়ে নিয়ে যাই, সেকথা স্বতন্ত্র।
বুলবুল! বুল ছাড়া কী, আমি যেদিন টেলিফোন ভবনে গেলাম, তরফদার তখন সহকর্মী কাঞ্জিলালকে চিৎকার করে বোঝাচ্ছে, ওয়ার্ল্ড কাপে মারাদোনার ওই সেকেন্ড গোলটা! পাঁচজনকে গুতিয়ে যেভাবে গোলটা দিল, শিং না থাকলে, দু-পেয়ে মানুষের পক্ষে ও-গোল দেওয়া সম্ভব? হঠাৎ আমাকে দেখে বলে উঠল, কী ব্যাপার। বিলটা এনেছ?
গত মাসে ভুতুড়ে টেলিফোন-বিল এসেছে। তিন হাজার তিনশো তিরিশ টাকা। তদন্ত সাপেক্ষে অ্যাভারেজ বিল দেবার অর্ডার কদিন আগে তরফদার করিয়ে দিয়েছে।
আরে,না-না। বিল নয়।আমি বললাম, তা, তোমাদের কী নিয়ে ফাইট? ট্যাকটিক্স ভার্সাস পাওয়ার ফুটবল?
না-না। প্রাক্তন নকশাল নেতা সিরিয়াসলি জানাল, আমাদের কথাটা শুরু হয়েছিল হাউ টু শেক-অফ কাঁধ ঝাঁকিয়ে, দিস ব্লাডি বামফ্রন্ট। এই নিয়ে। আবার বলল, বিলটা আনলে না কেন?
আমি বিল আনিনি। এসেছি, ও রিসেন্টলি গেছে শুনে, কেদার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। জেনে, ওর মুখচোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কোথা কেদার আর কোথায় বিল হাতে স্পেশাল কমপ্লেন সেলের নায়ারকে তেল-মারা।
কেদার যাচ্ছ? বলে ড্রয়ার থেকে একতাড়া ছবি বের করে সে টেবিলে রাখল, এই দ্যাখো। লাস্ট অক্টোবরের কেদার। কেদার, বদ্রিনারায়ণ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী–চারো ধামের ছবি! বাট কেদার ইজ কেদার। সিম্পলি আনবিটেবল! আহা–হ্যাঁ। তুষার রায়ের শেষ কবিতাটা মনে আছে তোমার–
ঘণ্টার শব্দ শুধু ভেসে আছে তিব্ৰতী গোস্ফার।
ব্যস আর কেউ নয়, কিছু নয়, শুধুই তুষার,
ফার ও পাইনবনে তুষার ঝরছে শুধু, শুধুই তুষার..
বোধহয় একটু মিসকোট করলাম। কিন্তু, একজন কবির শেষ কবিতার শেষ লাইনের শেষ শব্দ নিজের নাম দিয়ে… পৃথিবীর সাহিত্যে এমন দৃষ্টান্ত দুটো দেখাতে পারবে? লিখছে কখন? না, যখন হেভি হেমোপটিসিস হচ্ছে–মুনলাইট গ্রোভের সাদা বেসিন লালে-লাল করে দিচ্ছে দার্জিলিঙে–
তরফদার সাহিত্য ভালবাসে, নিজেও লেখেটেখে। তুষার রায় ছিল ওর বন্ধু।
লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল ডান হাতের রোঁয়া বাঁ-হাতের তালু দিয়ে সস্নেহে শোয়াতে শোয়াতে ও প্রসঙ্গে ফিরে এল, আর পথের সৌন্দর্য… কী করে বোঝাব তোমাকে। তুলনা হয় না। পাহাড়ের গায়ে যে কত রকমের সবুজ। পরপর দশটা হয়ত শেড দেখতে পাবে সবুজের…
তবে বিউটির শুরু তোমার রামবাড়া চটির পর থেকেই। তারপর তো শুধুই তুষার… শুধু তুষার রায়ের শেষ কবিতা।
বুঝলাম, ভুল জায়গায় এসেছি। আর যাই হোক, তরফদারের কাছে কোনও ইনফর্মেশান নেই। অন্তত এখন। লাঞ্চের সঙ্গে, গোটা দুই বিয়ার আজ সে নির্ঘাত পেঁদিয়েছে।
তবে তরফদারও ট্রাভেল এজেন্টের বকলস গলায় বাঁধতে বারণ করল। সে একটা চিঠি করে দিয়ে বলল বিড়লার হেড অফিসে যেতে ওই যেনীলাট হাউসের পাশে। ডালহৌসিতে। কেদার ও বদ্রীতে বিড়লার গেস্ট হাউসে যথাক্রমে দুটি ঘর সে বুক করতে বলল।
অ্যাটাচড বাথ আছে নাকি? আমি ভয়ে ভয়ে বলি।
আছে মানে? উইথ গিজার অ্যান্ড এভরিথিং। বিয়ারের ফেনার চেয়েও উচ্ছ্বসিতভাবে তরফদার টেবিলে ঘুসি মারল। বলল,
বাংলো মন্দিরের একদম গায়ে। নিচে মন্দাকিনী। মন্দিরের একেবারে পিছন থেকে উঠে গেছে চিরতুষার–কেদার পাহাড়।
০৬. এক প্লেট ল্যাংড়া, কটি সন্দেশ এবং …রু আফজা!
তার জন্যে রাখা ১০ ভাগ দিয়ে দীপ্তি যদি শেষ পর্যন্ত উড়িয়ে না দেয়, তাহলে আমরা নিজেরাই যাচ্ছি স্বাধীনভাবে কমবেশি ৯০ ভাগ এরকম মনস্থ করে রাত ৯টা নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখি, দীপ্তির দাদার গুরুদেব এবং যদিও এখনও দীক্ষা নেয়নি, তথাপি দীপ্তিরও পূজ্যপাদ শ্রীবাগীশ্বর ভট্টাচার্য এক প্লেট কাটা ল্যাংড়া ও কয়েকটি সন্দেশের সামনে বসে আছেন। পাশেই। এক গ্লাস রু আফজা, আইস-কিউবগুলো সব এখনও গলে যায়নি।
হরিদ্বার সেরে উনি এখন সবে কণখলে।
এ-সব দেবীপুরাণের কথা, বুঝলে মা। গুরুদেব বলছেন, সেই যখন ভগীরথ গঙ্গাকে নিয়ে আসছেন। খল নামে এক দানব থাকত এখানে। ঋষিদের যজ্ঞ নষ্ট করত। সারাদিন প্রস্তরস্থূপ হয়ে পড়ে থাকে। সন্ধ্যায় প্রকটিত হয় তার রাক্ষসরূপ। ভগীরথ শঙ্খধ্বনি করে গঙ্গাকে নিয়ে পৌঁছলেন এখানে। স্রোতধারা থেকে এক ফোঁটা জল গিয়ে লাগল প্রস্তরস্থূপে। ব্যস, খল উদ্ধার হয়ে গেল!কণ মানে কণিকা। আর খল তো শুনলে। এই দুয়ে মিলে কণখল। আনন্দময়ী মার আশ্রম এখানেই।
একটা সন্দেশ ভেঙে মুখে দিয়ে বললেন, এ কী, এ তো গিরীশের!
সত্যিই বুঝি তাই। দীপ্তি, কী করে বুঝলেন চোখে ওঁর বিভূতির দিকে তাকিয়ে। গিরীশ প্রসঙ্গ রহস্যাবৃত রেখে, সাধকোচিত প্রসন্ন হেসে উনি ফের হরিদ্বারে ফিরে এলেন। চৈতিকে বললেন, হরিদ্বারে মথুরাবালার দোকানে মালাই সন্দেশ খেতে ভুলো না যেন।
বলতে বলতে ঈষভাবে পাছা তুলে, ছোট করে, প্রায় নিঃশব্দে, উনি উইন্ড পাস করলেন মাত্র একবার।
তরফদার ছবিগুলো সঙ্গে দিয়েছিল। আমি সেগুলো বের করে এই যে কেদার বদ্রীর ছবি বলে চৈতিকে দিতে যাচ্ছি, উনি হাত বাড়িয়ে একরকম ছোঁ মেরেই সেগুলো নিয়ে নিলেন।
ঠিক যা চাই, তখুনি হাতে এসে যায়। পাঠিয়ে দেন। সিলিং-এর দিকে ভ্র তুলে উনি দুবার নাচালেন। মানে, সেই যে, সেই লোকটা! ওপরওয়ালা।
এই দেখুন নীলকণ্ঠ পর্বত।(ছবি দেখিয়ে), আপাদমাথা বরফে ঢাকা ত্রিকোণ এই পাহাড়। সর্বঋতুতে এর অঙ্গে ওই শ্বেত গরদবস্ত্র। স্বয়ং বদ্রিনারায়ণ! সামনে দুদিকে সবুজ নর ও নারায়ণ পর্বত—এঁরা এর প্রহরী। এই যে অলকানন্দা! স্বর্গের নদী। এর তীরে মাহেন্দ্ৰমুহূর্তে গিয়ে দাঁড়ালে নীলকণ্ঠ থেকে সঙ্গীতের ঐকতান ভেসে আসে।
নিয়ে যান। মাকে নিয়ে যান। পিওর সিল্কের থানের ভেতর থেকে ধবধবে পা লাল বিদ্যাসাগরীতে গলিয়ে গুরুদেব উঠে দাঁড়ালেন।
দীপ্তি তখন গলায় আঁচল জড়িয়ে ওঁর চটির ওপর। দীপ্তিকে দেখিয়ে আমাকে বললেন, এঁরাই সাক্ষাৎ পার্বতী। যতক্ষণ আমাদের এখানে এঁদের রুনুঝুনু নিজের বামস্তনের নিপল নাড়িয়ে কোনখানে তা দেখালেন হাত দিয়ে, অর্থাৎ হার্ট, শুধু ততক্ষণই আমরা শিব হয়ে আছি।
বলতে বলতে ওঁর চোখ কপালে উঠে গেল।
খাওয়া দাওয়ার পর টিভি খুলে একশো গ্রামকা টিকিয়া দেখছি, চৈতি বাবা বাবা বলে ওদের ঘর থেকে ছুটে এল। ওর হাতে নীলকণ্ঠ পাহাড়ের ছবিটা, মুখচোখ বিস্ময়ে ফেটে পড়ছে।
দ্যাখোও! বলে ছবিটা ও আমার নাকের ওপর এমন চেপে ধরে যে নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়।
ওরে, ছাড়, ছাড়। কিন্তু, আশ্চর্য তো। এ যে সত্যিই একটা সুগন্ধ ভেসে আসছে ছবির ভেতর থেকে।
দীপ্তিও দৌড়ে এল। ছবিটা কানে রেখে সে চৈতিকে বলল, ওমা, একটা খুব মিষ্টি টুং টাং সুরও ভেসে আসছে রে। চৈতি ছবি কানে রেখে বলল, কই, আমি পাচ্ছি না তো।
কিছু শুনতে আমিও পেলাম না। তবে সুগন্ধ একটা ভেসে আসছে এতে কোনও সন্দেহ নেই।
সবই গুরুদেবের লীলা। অনেকদিনের মধ্যে এই প্রথম বিনা নিমন্ত্রণে দীপ্তি আমার ঘরে শুতে এল। অবশ্য, কাল রবিবার। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল শনিবারগুলোও সে বাদ দিচ্ছে। বিনা ট্রাভেল এজেন্টে কেদার-বদ্রী যেতে সে রাজিও হয়ে গেল এক কথায়। তবে, দায় দায়িত্ব সব আমার।
পান পচে যায় যাক। কিন্তু চুন খসা চলবে না, এই তো।
এ ধরনের কথা আমি বুঝি না। বলেছি তো, বলবে না।দীপ্তির বুকে এখনও ব্রেসিয়ার। কোমরে শায়া। বরাবরের মতো এ দুটির গিট আমাকে খুলতে হবে। এবং এ-ব্যাপারে কোনও সাহায্য আমি ওর কাছ থেকে পাব না। বিবাহের ১৮ বছর পরেও কেন এ অবুঝ কুমারী ব্রত! কেন এই বিরক্তিকর প্রতিরোধ? সম্পূর্ণ নারী কি সেই উদাসিনী নয়, ছোট্ট হাই তুলে ও শব্দহীন তুড়ি মেরে যে বলতে পারে (মৃদু হেসে), কবে যে কুমারী ছিলাম, সে আমার একটুও মনে নেই ভাই! শাড়ি-শায়া ব্লাউজ এবং ব্রেসিয়ার–শীতে সোয়েটার এর প্রত্যেকটির সঙ্গে সমস্ত প্রতিরোধ মাটিতে ফেলে রেখে যারা বিছানায় ওঠে না, আমি তাদের, আমি তাদের, নারী বলে মনে করি না–না!
ওর এখনও পর্যাপ্ত নিতম্বের নাটকীয় উত্থানের সানুদেশে আমার হাত। কিন্তু, বড় বহুমূল্য দিয়ে আমি জানি, এ উত্থান অনতিক্ৰমণীয়। বাঁ হাতে কমণ্ডলু, গায়ে গেরুয়া, দক্ষিণ বাহু আশীর্বাদী মুদ্রায় তুলে, আহা, আমি সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে। দাড়িগোঁফ বুক ছুঁল। সব সাদা হয়ে গেল। তবু এ বিন্ধ্য কোনওদিন নতজানু হল না। এ-উত্থানের মধ্যে কোনওদিন জেগে উঠল না নিজের পতন কামনা।
না বোঝার কী আছে।
যা বোঝার আমি বুঝে নিয়েছি।
কী সেটা?
শুধু আমি নয়। ইউ হেট উওমেন অ্যাজ এ ক্লাস। তুমি মেয়েদের লেসার মর্টাল মনে কর। কর কি না!
জানি না। উমমম। তবে তোমার গুরুদেবের মতো ওর নিল্ল নাড়া দিয়ে আমি বলি, যতক্ষণ রুনুঝুনু যে মনে করি না, সেটা ঠিক। উমমম।
শাট আপ ইউ! এক ঝটকায় নিজেকে খুলে নিয়ে দীপ্তি তীক্ষ্ণ চিৎকার করে বলল, গুরুদেবের নাম তুমি মুখে আনবে না।
দীপ্তি বিছানায় উঠে বসেছে।একটা চাদর টেনে নিয়েছে বুকে। মাছের রক্তের মতো জোলো লাল নাইট-ল্যাম্পের আলোয় তার খোলা চুলের তোড় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আজও মেদহীন, ওর কুমারী ওয়েস্ট লাইনের ওপর। কপালের মত সিঁদুর-টিপ এখন ব্রাশের ক্রুদ্ধ স্ট্রোক। ওর ভরা ঠোট থেকে চুষে তোলা খুনখারাবি ল্যাকমে এখন ওরই মুখময় আমার চুম্বনের লালা-সহ বীভৎস উল্কি। ক্র, পাতলা হাসিতে ভরে যায় আমার মাথা! বলো, বলো ওগো অপমানিতা, আগে বলো, তুমি নারী না প্রেতিনী?
যে গন্ধটা আসছিল নীলকণ্ঠর গা থেকে ওটা তোমার খুব চেনা সেন্টের : ব্রুট! নাম মাহাত্ম্যের কারণে কতবার কিনে দিয়েছ আমাকে। তোমার মনে পড়ল না? কিন্তু বাজনাটা? বাজনাটা এল কোথা থেকে শুনি। বাজনাটা বাজেনি। হ্যাঁ, বেজেছে। না, বাজেনি।
বাজনাটা তুমি শোনোনি। হ্যাঁ, শুনেছি। না, শোনোনি।
হ্যাঁ, বেজেছে। না, বাজেনি। হ্যাঁ, শুনেছি। না, শোনোনি।
হাঁ এবং না। রাজা দুজনেই। দুই পাগলা রাজার আদেশে যুযুধান দুই রক্তাক্ত সৈন্যশ্রেণী… এক সময় অস্ত্রত্যাগ করে আরও একবার আমরা পরস্পরের মধ্যে মিশে যাই।শমিত্র আর চেনা যায় না। কিছুক্ষণ।
০৭. দ্য র্যাট ট্র্যাপ
দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে মাঝে মাঝে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে যাই। আমার অফিসের কাছেই।
ডালহৌসির ব্যাঙ্ক অফ টোকিও থেকে মাঝে মাঝে হেঁটে আসে চন্দন দেবরায়। কাল চন্দন ওখানে আমাকে দুটো-একটা কথা যা বলল, তাতে এ যাবৎ পাওয়া আমার সব আক্কেল ওর এক গুলিতে গুড়ুম হয়ে গেল। ওকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাইভ স্ট্রিটে গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের অফিস থেকে ৭ দিনের ট্যুরের তিনটে টিকিট কাটতে গেলাম। পি আর ও বললেন, যাত্রা হৃষীকেশ থেকে। টুর অনেক রকম আছে। তবে আপনারা এই দুনম্বর টুরে যান। চিলা ফরেস্ট আর পাউড়িতে একদিন করে থাকতে পারবেন। তবে কেদার-বদ্রী হয়ে ফেরার পথে বিটুয়িন ওখিমঠ অ্যান্ড রুদ্রপ্রয়াগ পানওয়ালি কান্থা বলে একটা নো ম্যানস ল্যান্ড পড়বে। ওখানে, মন্দাকিনীর তীরে, টেন্ট কলোনিতে আমরা একদিন ট্যুরিস্টদের রাখি। কেদারবদ্রী ভুলে যাবেন, কিন্তু এটা আপনার জীবনের সুইটেস্ট মেমারি হয়ে থাকবে।
পি আর ওর নাম হরেদও সিং তিওয়ারি। বৈদ্যনাথধাম থেকে ঠাকুর্দা গিয়ে হরিদ্বারে সেট করেন। ওখানে কম্বলের কারখানা আছে ওঁদের।
পানওয়ালিমে একরাত তেওয়ারিজি বললেন, হাম গাড়োয়ালিকে লিয়ে ভি আনফরিগটএবেল হ্যায়।
ঠিক হল, কাল আগে রেলের টিকিট কেটে, আমি নিগম-ট্যুরের টিকিট সেইমতো কাটতে আসব। মে মাসে খুব একটা যাত্রী নেই এখনও। চারা ফেকা গিয়া হ্যায় লেকিন,ওঁর ভাষায়, আভি তক মাছ মছলি নেহি লাগা। বাস ফাঁকা যাচ্ছে।
কখনও ট্র্যাপে পড়েছেন?
বিস্তৃত বিবরণ শুনব বলে সন্ধ্যাবেলা ওকে ডেকার্স লেনের পুলিস ক্লাবে আসতে বলেছিলাম। ওখানে রাম খুব সস্তা। চন্দন চিত্তদার দোকান থেকে ফিশ ফিঙ্গার আনাল।
লোডশেডিং। দরদর ধারায় ঘাম গড়িয়ে আসছে তার দুই রগ থেকে। রামে মাত্র দুটি চুমুক দিয়েই অমনি নাটকীয়ভাবে শুরু করেছিল চন্দন।
কঁল পেতেছেন কখনও? রুটির টুকরোর লোভে নেংটি ইঁদুরকে ঢুকতে দেখেছেন কলে? প্রথমে সতর্ক। ঢুকবে কি ঢুকবে না। যেন ভাবছে, ফিরে যাবে কি যাবে না। যেন-ফেন নয়, ওরা ভাবে। আমি দেখেছি। আমাদের ফ্ল্যাট দোতলায়। নিচে মানিকতলা বাজার। আমাকে প্রচুর ইঁদুর ধরতে হয়। এবং আমি ধরি। আমি প্রত্যেকটা ইঁদুরকে চিনি। তারা আমাকে চেনে। একটা ধাড়ি ইঁদুরকে এখনও ধরতে পারিনি। যেদিনই দেখা হয়, নর্দমায় ঢুকে যাবার আগে সেও আমাকে দেখে। দেখে রাখে।
হ্যাঁ। কিন্তু বদ্রীনাথের অভিজ্ঞতা তুমি যা বলতে চাইছিলে—
বদ্রীনাথের কথাই তো বলছি।চন্দন গ্লাস শেষ করে বলল, নো থ্যাঙ্কস। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।
হ্যাঁ। তা বল।
তাঁরপর শেষ পর্যন্ত তার বুদ্ধিনাশ হয়। চন্দন বলল, সে কলে ঢুকে পড়ে। বদ্রীনাথে ঢুকে পড়ে আমাদের অবিকল সেই ইঁদুর-অভিজ্ঞতা হয়েছিল।হঠাৎ শুনলাম–ঘ্যাচাং। পিছনে কলের দরজা পড়ে গেল!
এ-ভাবে একবার ইদুর ও আরবার বদ্রীনাথের কোর্টে বল ফেলতে ফেলতে শেষ পর্যন্ত সে যে-ভাবে স্ম্যাশ করল, তা কিন্তু সত্যিই ভয়াবহ।
কেদারবদ্ৰীতে সবাই যায়। যায় তার চেয়েও বিপদসঙ্কুল দুর্গম জায়গায়। হাসতে হাসতে ফিরেও আসে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই চন্দনের মতে, নিপুণ হাতে পাতা একটা ফাঁদ।
সে-হরি যাকে নেবে, তার আর রক্ষা বলে কিছু নেই।
ওরা গিয়েছিল ১৯৮৬-তে। মাত্র দুবছর আগে। তাও জুনের গরমে।
মোট শদুয়েকের বেশি যাত্রী সেদিন বদ্রী যায়নি। অপারেশন করানো সত্ত্বেও, জন্মত গন্নাকাটা বলে চন্দনের দু-একটা শব্দ এখনও আনুনাসিক হয়ে যায়। ঠিক কোনটা যে হবে, আগে থেকে বলা কঠিন। চন্দন বলল, গোবিন্দঘাট পর্যন্ত ফাসক্লাস গেলাম। বৃষ্টি পড়ছিল আগাগোড়াই। সেই কর্ণপ্রয়াগ থেকে। গোবিন্দঘাটের মিলিটারি ব্রিজ পেরুতে বরফ পড়া শুরু হল, বুঝলেন দাদা। চোখের সামনে দেখতে দেখতে সব সাদা হয়ে গেল। অথচ, এ তো ঠিক বৃষ্টি নয়, বরফ। পুরো আলো রয়েছে। কিছু আলো বরফের ভেতর থেকে আঁসছিল, বিশ্বাস করুন দাদা বলতে বলতে সে কেঁপে উঠে আমার হাত চেপে ধরল।
বাস তো হনুমান চটিতে কোনওমতে স্কিড করতে করতে পৌঁছল। তারপর বলল, আর যাবে না। হয় বদ্রীনাথ যাও, না হয় গোবিন্দঘাট ফিরে যাও। হয় সামনে যাও ৮-১০ কিলোমিটার। না হয় পিছনে যাও ২৩ কিলোমিটার। তখন বেলা বারোটা। এগারো হাজার ফুট খাদের ধারে হিমালয়ের পেটের মধ্যে আমরা তখন। বরফে হাঁটু ডুবে রয়েছে। সঙ্গে বৌ, শালী আর ভায়রাভাই ব্রজেন। আমাদের শাশুড়ি।
হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ। জাস্ট এনজয় দা ফান অফ ইট।
চন্দন বলে ভাল। কলকাতায় টকার হিসেবে, রেডিওর পরেই নাকি তার স্থান। তার মাথায় অ্যালোপেশিয়া, গ্লেসিয়ারের মতো সহসা ঝাঁ-চকচক করে উঠল মাথাভরা টাক, যখন। বার-এ হঠাৎ আলো এল।
দেখতে কুচ্ছিত হলেও শুনতে সে সত্যিই ভাল। কিন্তু, আসল কথায় আসবে কখন।
আমি সেকেন্ড রাউন্ড বলি।
তোমরা কোন দিকে গেলে?
বদ্রীনাথে, আবার কোথা! একটু বঁরফ হবে না?
তারপর… গ্লাসে বরফ না ঢালা পর্যন্ত সে একদম চুপ। স্পিকটি-নট।
চন্দন বলল, আমরা সবাই বললাম, ফিরে যাব। কিন্তু শাশুড়ি! দেহরক্ষা করবেন কিন্তু নারায়ণ-দর্শন না করে উনি ফিরবেন না। এজ কত বলুন তো। সেভেনটি ফাইভ।বর্ননাইনটিন ইলেভেন। এবার একটা য-ফলা লাগিয়ে সে হাসে, হ্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা।
আর এক রাউন্ড কি বলব? চন্দনের গল্প কি তাতেও শেষ হবে?
দাদা, আপনি খাচ্ছেন না?
আমার একটু তাড়া আছে।
না-না। ঘড়ি দেখে চন্দন বলল, সবে সাড়ে আটটা। বেঁয়ারা!
সে এক রাউন্ড বলল। ম্যানার্স-জ্ঞান থাকলে এটার দাম সে নিশ্চয়ই, অন্তত দিতে চাইবে।
তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরতে রাত বারোটা হয়ে গেল।ক্লাব থেকে চন্দন নিয়ে গিয়েছিল এলফিনে। থার্ড রাউন্ড থেকে সব খরচ সে করেছে।
এত আগ্রহ নিয়ে জীবনে বোধহয় কারুকে কিছু বলিনি, বলতে চাইনি, যেভাবে, ঝুঁকে, বেঁকে, টেবিলে মাথা রেখে, কখনও তুলে, দীপ্তিকে বলছিলাম, জানো, ওরা আটকে পড়েছিল। বদরীতে। সাতদিন বেরুতে পারেনি। ঘ্যচ্যাং! বরফ কলের দরজা পড়ে গিয়েছিল। বদ্রীনাথে আটকে পড়েছিল ওই ওরা।কারা আমি মনে করতে পারি না কিছুতে। তাই তিন আঙুল তুলে বলি, তিনশ ইদুর! ঘোড়াসুদ্ধ একটা মেয়ে, ওদের দলের, খাদে পড়ে। গেল…
টিকিট কেটেছ? গায়ে হাত দিও না।
টিকিট? কাল কাটব। ও হ্যাঁ, আমরা গাভোয়ালের বাসে যাচ্ছি। বুঝলে। বেস্ট ট্রাভেল এজেন্ট। বুঝলে। সব ব্যাবোস্তা করে এস্ছি।
মালে কত টাকা ওড়ালে আজ–ফের?
চোদ্দ টাকা। যাসস্…স্ট্যাক্সি ভাড়া! সগৌরবে এত বলে আমি বোধকরি ফের গায়ে হাত দিয়েছিলাম। গায়ে হাত দিয়েছিলাম বলতে, মূলত, কাছেই তো ডেকেছিলাম। তাই না? স্ত্রী পাঠকরা কী বলেন? মারতাম তো আর না। আদরই করতাম। ভালবাসতে গেলে, যারা ভালবাসার বাইরে, তারা একটু মদ খায়। তাদের খেতে হয়। নইলে তাদের খুন করতে হয় বৌকে। স্বামী মদ খায় না বলে যাঁরা নিশ্চিন্ত, তাদের জানাই, বৌ খুন তারাই বেশি করে। যারা টিটোটেলার। স্ট্যাটিসটিক্স তাই বলে। আস্ক লালবাজার বধূহত্যা স্কোয়াড। ওরা কনফার্ম করবে।
মর মুখপোড়া। ড্রিল মাস্টারের ছেলে!
দীপ্তি আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল। সারারাত মেঝেয় পড়ে থাকলাম। তবে মিথ্যে কথা কেন বলব? পাখাটা ফুলফোর্সে চালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। যে জন্যে সে রাতে প্রগাঢ় ঘুম হয়।
সকালে বাজার গেলাম। ওই একটা ছেলের কাছেই আমি মাছ কিনি। নাম সন্ন্যাসীচরণ ভক্ত। আজ ওর স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, হেডমাস্টার বন্ধুবাবু খলবলে নর্দমার দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছেন, ও সন্ন্যাসী, তোমার একটা শিঙ মাছ নর্দমায় পড়ল যে!
থাকুক স্যার কিছুক্ষণ ওখানে, হেসে সন্ন্যাসী উত্তর দেয়, নেকাপড়া শিখুক।
দীপ্তি অধ্যাপিকা। অনার্সে উচ্চ-দ্বিতীয় এবং এম-তে প্রথম শ্রেণী পেয়েছিল। আমার তখনও রাগ যায়নি। হ্যাঙওভার কাটেনি। মাছটা মাদি নাকি?
০৮. সুহানা সফর
সফরসূচি শেষ পর্যন্ত এইরকম ঠিক হল :
১৭ মে – ডুন এক্সপ্রেস।
১৯ মে–ভোরে হরিদ্বার।
১৯-২০ মে – হরিদ্বারে দুদিন। হর-কি-পাউড়িতে সন্ধ্যারতি দর্শন ও চৈতির প্রদীপ ভাসানো। কণখল : আনন্দময়ী মার আশ্রম। রোপওয়েতে মনসা পাহাড়। নীল ধারা। ভারতমাতা মন্দির। পবন মন্দির (কাচওয়ালা)। মথুরাবালার মালাই সন্দেশ।
২১-২২ মে—হৃষীকেশ। শিবানন্দ আশ্রম। লছমনঝোলা। স্টিমারে গীতা ভবন। পরমার্থ ভবন ঘাটে লোহার চেন ধরে স্নান (নইলে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে)। ছাইবাবার ঝোপড়ি।
২৩ মে – মুনি-কি-রেতির সংযুক্ত বাস আড্ডা থেকে ভোর ৬.৩০ মিনিটে গাড়োয়াল নিগমের বাস (GTT 7009)।
২৩-৩০ মে – চিলা—পাউড়ি বদ্রী-কেদার। টেন্ট কলোনি। এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় কিছু নেই। (আপলোগ গোড়ায়াল নিগমকা সাত রোজকা মেহমান হ্যায়।)
৩১ মে–হৃষীকেশ। মুনি-কি-রেতিতে ওরা ছেড়ে দেবে।
১ জুন – মুসৌরি। (একদিনের বেশি নয়। দিল্লির সামার ক্যাপিটাল। হেজিপেজি হোটেল এখন ৪০০ টাকা। গলা কেটে নেবে।)
২ জুন – দেরাদুন থেকে ডুন এক্সপ্রেস।
৪ জুন – কলকাতা। যাবার আগের দিন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মতো দীপ্তির মাথা ধরা থেকে জ্বরজারি, সর্দিকাশি, মায় ফুড পয়েজনের যাবতীয় ওষুধ কিনে, কর্পোরেশন থেকে পাওয়া কলেরার ভুয়ো সার্টিফিকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু কেনাকাটি এখনও বাকি আছে।দীপ্তি সেজন্যেই আসবে। যেমন, দুটো হাওয়া বালিশ (একটা আছে), টর্চের ব্যাটারি, ক্যামেরার ফিল্ম। যেমন, পকেটওলা ড্রয়ার, যদি পাওয়া যায়। হাজার দশেক টাকা ক্যাশ সঙ্গে যাচ্ছে, বেশিটা দীপ্তি সেখানে রাখবে। শায়া ও শালোয়ারে সে ইতিমধ্যে ইনসাইড পকেট করে নিয়েছে। ট্রাভেলার্স চেক? ধূর, ওদিকে ব্যাঙ্ক-ফ্যাঙ্ক কোথা? টাকা আমার কাছে থাকবে না। হারিয়ে ফেলব। গত বছরে একদিন,হ্যাঁ, সপ্তমীর দিন, এক প্যাকেট উইলস ফিল্টার কিনে, হা, রাসবিহারীতে চোদ্দ টাকা ফেরত নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। মনে নেই? কনট্রাসেপটিভস? ছিঃ। স্বর্গে গিয়েও ধান। ভানবে? চেঁকি কোথাকার।
৬টায় আসার কথা মেট্রোর সামনে।
চৈতি যোধপুর পার্কে মামার বাড়িতে। সেখান থেকে ওকে তুলে ফেরা। ৮টা বেজে গেল, দীপ্তির দেখা নেই। বাড়ির ফোন খারাপ। যোধপুরে ফোন পেয়ে চৈতি বলল, সে কী। তুমি সোজা বাড়ি চলে যাও। আমি আজ এখানেই থেকে যাচ্ছি। কিন্তু, তুমি আমাকে ফোন করবে। ফোন না পেলে এখানে এসে খবর দিয়ে যাবে। যত রাতই হোক। বুঝলে?
চৈতি একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছে মনে হল।
০৯. নো এন্ট্রি
রাসবিহারী গুরদোয়ারায় উৎসব। চেতলা সেন্ট্রাল রোডে নো এন্ট্রি।
ট্যাক্সি সদানন্দ রোডে ঢুকে ঘুরপথ দিয়ে ব্রিজে উঠল। ড্রাইভার বলছিল, দেখুন সার। এরকম একটা ইমপর্টেন্ট রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে।
আমি বললাম, ইমপর্ট্যান্ট নয়? সাউথ আর এনটায়ার সাউথ-ওয়েস্ট, আলিপুর, হেস্টিংস, খিদিরপুর, বেহালা–সব কিছুকে তো এই একটা রাস্তাই কানেক্ট করছে।
সার।ব্রিজের ওপর উঠে ড্রাইভার বলল, তাছাড়া একটা ইমপর্টেন্ট শ্মশানও রয়েছে।
হ্যাঁ। মাঝে মাঝে শবপোড়া বা মড়াদাহর গন্ধ নাকে লাগে বটে। মাছির মতো উড়িয়ে দিয়েছি বরাবর। কই, এ প্রশস্ত রাজপথের এই কানেকশনটির কথা তো কোনওদিন ভাবিনি। চুনারের লালুর কথা মনে পড়ল।
লোডশেডিং না থাকলে, রাস্তায় নেমেই চারতলার দিকে তাকানো আমার অভ্যাস। যে, আছে, না, নেই। আজ ট্যাক্সি থেকেই দেখতে পেলাম, বাকিটা অন্ধকার, কিন্তু শোবার ঘরে আলো জ্বলছে : অর্থাৎ আছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, আমার মনেও পড়ে গেল, ও, হ্যাঁ, রিডার্স ডাইজেস্টের একটা আর্টিকেলে। মানুষ সারাজীবন যত অ্যাংজাইটিতে ভোগে তার শতকরা ৮০ ভাগের কোনও ভিত্তি নেই। বাকির ৮ ভাগের মধ্যে দুভার্গ্য চেহারা নিতে পারে বটে, কিন্তু ওই ৮ ভাগের শতকরা ৭৫ ভাগ ক্ষেত্রে নেয় না। কার্যত, মানুষের জীবনভর দুশ্চিন্তার শতকরা মাত্র ২ ভাগ নাকি পোটেনশিয়াল। এদিক থেকে সারাজীবন বিপদগ্রস্ত হতে হতে কী হাস্যকর বিপজ্জনকভাবেই না আমরা বেঁচে আছি।
বেল বাজছে না। এই তো কদিন আগেই সারিয়ে দিয়ে গেল। আবার খারাপ হয়েছে। আবার কুমুদ মিস্ত্রিকে ধরে আনা। উঃ, আবার একটা কাজ।
ল্যাচে চাবি ঢোকাতে দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। সেই যথাবিহিত কাঁচশব্দে আজ তার অস্তিত্বের জানান দিল না তো।
দরজা খুলে কমুহূর্ত? দুই-তিন-চার-পাঁচ?
আমি বাইরে থেকে দরজাটা ধীরে টেনে দিলাম,নাকি, আমাকে বাইরে রেখে সেটা নিজেই ওভাবে বন্ধ হয়ে গেল, তা আজ আর বলতে পারব না। এটা নিয়ে আমি পরেও ভেবেছি। সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। পরে এ-টুকু মাত্র বুঝেছি যে, ওই কমুহূর্ত আমার চেতনা খুন হয়ে পড়ে ছিল। নিশ্চিত বন্ধ ছিল হৃৎস্পন্দন। কতক্ষণ আমি তা জানি না। কিন্তু, টেকনিক্যালি আমি ছিলাম মৃত। ততক্ষণ।
হাওয়াতে স্রোতের মতো আরও একটা স্রোতের হাওয়া আছে। ভয়ের। সে হাওয়াও ফুরফুর করে গায়ে এসে লাগে। টের পাওয়া যায়।
তারপর…সেই ভয়াবহ ভয় এসে আমার হাত ধরল।
প্রথমে চুলের গোড়াগুলো ভিজে উঠল। পরমুহূর্তে সারা গা ঘামে জবজবে হয়ে উঠল। তৃতীয় মুহূর্তে, একি, আমি শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে! ঘাম আমার পায়ের পাতা মৌন স্রোতধারায় ভিজিয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ জমতে লাগল।
এখন আমি কী করব। আমি কি বন্ধ দরজার পাশে এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। নাকি, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাব। আমি ছাদে উঠে যাব কী! আর-একবার দরজা খোলা, খুলে দেখা, সেটা কি আমার পক্ষে ভাল হবে?
মুখোমুখি সামনের ফ্ল্যাটে তালা। ওপরে বা নিচে ২ বা ৬ নং ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল টিপব? আমি কি পালাব?
একটা ভাবনারও শেষ পর্যন্ত আমি ভাবতে পারছিলাম না। বাস্তবতা নেই, কোনও গঠন বা চেহারা নেই, এরকম কিছু বিমূর্ত বিপদগ্রস্ততার মধ্যে তারা বারবার জন্ম-মুহূর্তেই মরে যাচ্ছিল।
একসময় দেওয়াল ধরে আমি সিঁড়িতে বসে পড়ছি দেখি। এবং, পরে ভেবে বুঝেছি, সেই বসে পড়তে পড়তেই আমি প্রথম বুঝতে পারি, এখন আমাকে কিছু করতে হবে। কী আমি তা জানি না। কিন্তু আমার কিছু করণীয় থেকে গেছে। এবং, এই মুহূর্ত থেকে তা শুরু করতে হবে। যদি না করি, এবং এখনই, অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস আমার সামনে।
ধ্বংস এড়াতে আমি আর-একবার ধ্বংসের দরজা ফাঁক করি।
ডাইনিং স্পেস অন্ধকার।
ডাইনিং টেবিলের পাশে চিত হয়ে দীপ্তি পড়ে আছে। ডালা-খোলা ফ্রিজ থেকে জেনারেটরের হু-হু হাওয়ার সঙ্গে বেরিয়ে এসে মৃত্যুর ঠান্ডা আলো পড়ে রয়েছে ওর মুখে চোখে।
এবার দেখলাম, দীপ্তির নীলাভ মুখের পাশে ফান-মাঞ্চের একটা খালি প্যাকেট পড়ে আছে। পাখা চলছে। হাওয়ায় দু-একটা হলুদ আরশোলা আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি ওয়েফার্স।
দীপ্তির মাথার নিচে জমাট, স্তব্ধ রক্তস্রোত।
লাল চালচিত্র।
তার গলা কাটা।
ওকে কি একটু আগে আমিই খুন করে যাইনি?
হঠাৎ, আমার দাঁতের পাটি কাপতে শুরু করে কিটকিট করে। দেখলাম, একে থামাবার সাধ্য আমার নেই। আমি খুন করিনি, একথা ভাববার সাধ্য আমার নেই।
খোলা দরজা দিয়ে ফ্রিজের ঠান্ডা হাওয়া ফুরফুর করে আমার গায়ে এসে লাগে।
১০. লিল্লিহো!
আপনি আমাকে অ্যারেস্ট করছেন না কেন?
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার সত্যবান মণ্ডল লালবাজারে বসেন। দোতলায়। একতলায় একসারি হাজত ঘর পেরিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে, করিডোরের পর করিডোর পার হয়ে তার কাছে পৌঁছতে হয়। রাস্তা ধরে এগোলে ততক্ষণে রাধাবাজার এসে যেত।
সত্যসাধনবাবু অকৃতদার। বয়স চল্লিশে রেখেছেন। থাকেন বেকার রোডের পুলিস কোয়ার্টারে, নিঃসন্তান বিধবা বোনের সঙ্গে। (আসুন না একদিন রোববার দেখে। আড্ডা দেওয়া যাবে –সত্যবান)।
পুলিস বলতে এতদিন যা জেনে এসেছি, ভদ্রলোক গত বারো দিনে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তা ছিল পুরোটাই ভুল। অশিক্ষিত সে গ্রাম্য ধারণার তিনি মূর্তিমান প্রতিবাদ। ইউনিফর্ম নেই; কোমরে রিভলভার কখনও থাকে না; চোখে গোল্ড মেটালের চশমা; তীক্ষনাসা, ছিপছিপে ও ছ-ফিট কবি হিসেবেই তাকে মানাত ভাল, এত সহৃদয় ও এমন সজ্জন। ভদ্রলোকের গায়ের রঙ একদম বিলেতি। এত ফর্সা যে চোখ দুটি দেখে মনে হয়, নীল হলেই তারা যথাযথ হত। কথা বলেন যখন, পাখির ডিমের মতো গল-অস্থিটি ওঠানামা করে। মোট কথা, পুলিস অফিসার হিসেবে, দৃশ্যত, তিনি একেবারেই অবিশ্বাসযোগ্য।
খুব না বলে, বলা উচিত, তিনি মুহুর্মুহু সিগারেট খান।
যার-পর-নেই মৃদু ও মার্জিত ভাষায় যিনি আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন, আপনি কনফেস করুন, আজ ১১ পেরিয়ে ১২ দিন হতে চলল, সেই তিনি আমাকে এখনও অ্যারেস্ট করেননি।
দীপ্তির মৃত্যুর পর ওর জন্যে শোক করা দূরে থাক, ওকে নিয়ে একটা মিনিটও ভাববার সময় পাইনি। আর ভাববই বা কী করে। ওকে নিয়ে একটা কিছু ধরে ভাবতে গেলেই এক শব্দহীন বিস্ফোরণ হয় মাথার মধ্যে। দুঃস্বপ্নে যেমন, একটা থেকে একটা থেকে আর একটা, অন্য থেকে অন্য থেকে অন্য ভাবনা-জগৎ তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। পরমাণুর চারিদিকে দুর্ভাবনার ইলেকট্রন মেঘ যেন, যার মধ্যে রয়েছে পরম-পরমাণু অনির্ণেয় কোয়ার্ক এবং অ্যান্টিকোয়ার্কের মতো মাসহীন ভরশূন্য মৌলকণা, যারা, তত্ত্বের খাতিরে, মহাবিশ্বের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারে—যদি তার প্রান্ত থেকে থাকে। গত দশ বারো দিনে এই দুর্ভাবনার জগৎ আমার অভ্যস্ত ভাবনা-জগৎ থেকে অনেক, অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সুপরিচিত ইমেজ থেকে এখানে জেগে ওঠে স্বেচ্ছাচারী আবেগ, আবেগের স্বেচ্ছাচার থেকে জন্ম নেয় ইমেজের স্বাধীনতা। এরা আমাকে লুটিয়ে টেনে নিয়ে চলে। এ উন্মত্ততার মধ্যে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকার সাধ্য আমাদের অনেকেরই নেই।
এমনিতে ঠিক আছি, কিন্তু, দীপ্তিকে নিয়ে কোনও ভাবনার শুরু হলেই, এমনটা হয়। আজ ফেরার সময় এসপ্ল্যানেড স্টেশনে দরওয়াজা বন্ধ হো রহা হ্যায় শুনতে শুনতে মেট্রো রেলের উজ্জ্বল সন্ধ্যা কখন যে পরিণত হয়ে গেল কবেকার কোনও এক শীতের ভোরবেলায়…দীপ্তির গলায়, এই, তোমরা কে কে চা খাবে উঠে পড়, এর পর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবেনা দিয়ে যে বিশ্বাসযোগ্য ভাবনার শুরু হল, মুহূর্ত পরে খেয়াল হতে দেখি, সেটাই আমার জীবনে সূর্যাস্ত তো দিনে একটা হয় না। অনেক সূর্যাস্ত হয় সারাদিনে। এই যেমন এখুনি একটা হল। সব অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু এখন তো দুপুরবেলা …এই ভয়াবহ জলপ্রপাতের পরিণতিকামী খরস্রোত ধরে কুটোর মতো ভেসে চলেছে।
নাআ!
সহযাত্রীদের চমকে দিয়ে চিৎকার করে উঠে আমাকে তা থামাতে হয়। ট্রেন তখন আমার গন্তব্য ছাড়িয়ে পরবর্তী ও অন্তিম স্টেশন টালিগঞ্জ–এই ঘোষণার মধ্যে! ল্যাম্পপোস্টের দড়ির আগুনে সিগারেট ঠেকাতেই একদিন গানের স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা আমার মেয়ের পা-দুটি জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি দেখি। তার হাতে স্বরলিপির খাতা। সেখান থেকে শুরু হয়। তারপর একটা থেকে একটা থেকে একটা। অন্য থেকে অন্য থেকে অন্য। স্বাধীন ইমেজ ও আবেগের অসহ্য স্বেচ্ছাচার।
নৃপেনের যোধপুর পার্কের বাড়িতে দীপ্তির শ্রাদ্ধ-শান্তি নমোনমো করে চুকে গেছে। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল, সকলের, দৃষ্টিভঙ্গি দেখছি একটাই। যে, যে যাবার, সে গেছে। এখন যা আছে, তাকে বাঁচাও। অর্থাৎ, আমি আর চৈতি। নৃপেন তো এটাকে স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে। তার শুধু একটাই জিজ্ঞাসা। খুন হল দুপুরে। আমি ফিরলাম রাত ৯টায়। অফিসে যাইনি। আমি তাহলে সারা দুপুর ছিলাম কোথায়?
প্রাইমারি স্টেজে মার্ডার কেস আমার কোর্টে অনেক এসেছে। স্ট্রং আলিবাই থাকলে মামলা কখনও হায়ার কোর্টে পাঠাইনি। নৃপেন বেশ কবার আমাকে জানিয়েছে।
দীপ্তি বসুরায় খুনের ঘটনায় কেউ এখনও অ্যারেস্টহয়নি। এ নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হচ্ছে। নৃপেনের মুখে শুনলাম, সত্যবান মণ্ডলের ক্ষেত্রে এমনটা আগেও হয়েছে। এ তো সবে ১১ দিন, বাসনা সেন মার্ডার কেসে সে নাকি ছিল দেড় মাস চুপচাপ। তারপর একদিন খপ করে ওদের পুলিসেরই এক আই পি এস-কে ধরল। অকাট্য প্রমাণ হাতে আসার আগে। সত্যবান কখনও সাসপেক্টকে কাঠি দিয়েও ছোঁয় না-নৃপেন জানিয়েছে। তাকে ছেড়ে রাখে। ওয়াচ করে। আই জি ক্রাইমের অগাধ আস্থা ওর ওপর।
চৈতির অবস্থাও আমার মতো। মাতৃশোক ওকে এখনও স্পর্শ করেনি।
যখনই যা কথা হয়, টেলিফোন আসে, চৈতি পাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটি কথা শোনে। সিলেবেল ভাগ করে তীক্ষ্ণ স্বরে সে জানতে চাইল, কিন্তু। আমার। বাবা তো। খুন। করেনি।
তা তো করেইনি মামণি। নৃপেন সাদরে হাত ধরে ওকে কাছে টেনে আনে, সে তো আমি জানি। আর সেইজন্যেই তো তোমার বাবাকে এখনও ধরেনি।
এখনও? চৈতি মিস করলেও, আমি শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ্য না করে পারি না।
রোজ সকালে সাড়ে ১১টার সময় লালবাজারে সত্যবান মণ্ডলের কাছে আমাকে একবার হাজিরা দিতে হয়। আমি রোজ ঘণ্টাখানেক বসে থাকি। উনি চা খাওয়ান। কোনওদিন লিমকা। আসল কথা একটাও হয় না।
শেষ সিগারেটটা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে, দারওয়াজা বলে ডেকে একসঙ্গে পাঁচ প্যাকেট উইলস ফিল্টার আনতে দিয়ে, প্রথম দিনটা উনি কাটিয়ে দিলেন শুধু সিগারেট খাওয়ার অপকারিতা নিয়ে কথা বলে। প্রথম দিনেই নামটা ভুলে গেছেন এমন একজন ইটালিয়ান লেখকের একটা বই রেফার করলেন, জেমস জয়েস তাকে ইংরেজি শেখাতেন, বললেন, বইটার নাম দা কনফেশন অফ জেনো, ওঁর মনে পড়ল। প্রতি রাত্রে শেষ সিগারেট খেয়ে জেনো ডায়েরি তে লিখে রাখত, আর সিগারেট নয় এবং পরদিন ভোরে উঠেই দিনের প্রথমটি ধরাত। তার ডায়েরিতে প্রতিদিন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর শুধু ওই একটা সেনটেন্স : নো মোর সিগারেট!
পুলিস অফিসারের মুখে জেমস জয়েস শুনে, সত্যি কথা বলতে কি, আমি প্রথম দিন ওঁকে চালবাজ ভেবেছিলাম। কিন্তু, পরে ধারণা পাল্টাতে হয়। আমি অটোমোবিল ক্লাবের মেম্বার। এক সময় ওখানে খুব আসতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর দলবল। রাত বাড়লে। সুনীলবাবু গান ধরতেন।
লালপাহাড়ির দেশে যা
রাঙামাটির দেশে যা
হেথায় তোরে মানাইছে না গ
ইক্কেবারে মানাইছে না গ…
আমাদের দলটা ছিল মূলত ব্যাঙ্কারদের। কিন্তু রাত বাড়লে বার-এব্রাহ্মণে-চণ্ডালে কোনও ভেদাভেদ থাকে না। আমরাও উঠে গিয়ে লাস্ট রাউন্ড হাতে ওঁদের সঙ্গে গলা মেলাতাম। তা, ওঁদের মুখেও তো কোনওদিন জেমস জয়েস শুনিনি।
কোনওদিন কথা হয় দেশের অবস্থা নিয়ে, কোনওদিন টিভি সিরিয়াল। ওঁর কথাবার্তার লেভেল নিঃসন্দেহে উঁচু মানের। রীতিমতো ইন্টেলেকচুয়াল। মহাভারত বিষয়ে ওঁর বক্তব্য হল–এই সিরিয়ালের আসল উদ্দেশ্য হল, হিন্দু ফান্ডামেন্টালিস্টদের একটা প্ল্যাটফর্মে এককাট্টা করা। সারা ছবি জুড়ে শুধু পিতাশ্রী, ভ্রাতাশ্রী, মাতাশ্রী মায় মামাশ্রী। আগাগোড়া চেস্ট তদ্ভব হিন্দি। বিজয়ী ভব আর চিরঞ্জীবী ভব–ভাঞ্জে, অতহ, অ্যান্ড পরন্তু! লক্ষ্য করেছে কি, একদম বলেই দেওয়া হয়েছে স্ক্রিপ্ট রাইটারকে, ডায়ালগে যেন, খবর্দার, একখানা মোচরমান শব্দও না থাকে!
দেশের অবস্থার কথা বলতে গিয়ে উনি যা বললেন, তার মর্মার্থ ভারতবর্ষের কপাল এখন, অবশেষে, সত্যি পুড়ছে এবং চচ্চড়িয়ে।
রাজা নবম চার্লসের সময়, বুঝলেন, সেই কোন সিক্সটিনথ সেঞ্চুরিতে, উনি সিগারেট ধরালেন, একবার অ্যান্টার্কটিক থেকে চারটে ক্যানিবালকে ধরে আনা হয়। শহরের জৌলুস। আর রাজকীয় জাঁকজমক দেখিয়ে ইন্টারপ্রেটার মারফত রাজা তাদের কাছে জানতে চাইলেন, সব তো দেখলে। এখন বল, কোনটা তোমাদের সবচেয়ে বেশি অবাক করল?
সভ্যতার সঙ্গে সেই তাদের প্রথম সংস্পর্শ! বোকাহাঁদা নরখাদকরা বলল, তারা তিনটে অবাক কাণ্ড দেখেছে। তারা কী বলেছিল জানেন? তৃতীয়টা, আমি ভুলে গেছি। কিছুতেই মনে পড়ে না। কোথায় যে পড়েছিলাম। বইটার নামও মনে নেই।
প্রথমটা কী ছিল?
তারা বলেছিল, দ্যাখো রাজা, আমরা প্রথমত অবাক হয়েছি তোমার মতো একটা পুঁচকে ছেলেকে এইসব সা-জোয়ান লোকগুলো (সশস্ত্র গার্ডদের দেখিয়ে)নতজানু হয়ে কুর্নিশ করছে কেন? তারা তোমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলে নিজেদের মধ্যে কারুকে সিংহাসনে বসাচ্ছে না কেন?
আমার এত বড় দুঃসময়েও একটু না হেসে আমি পারিনা, তারপর? রাজা নিশ্চয়ই দ্বিতীয় প্রশ্ন আর করেননি?
না-না। রাজা তো বাচ্চা ছেলে। দ্বিতীয়ত, তারা বলেছিল, শহর ঘুরে তারা দেখল, কিছু লোক প্রাসাদে থাকে আর বেশি লোক ফুটপাতে। কিছু লোক সেঁড়েমুসে খায়। বাকি লোক খেতে পায় না। কিছু লোক গাড়ির ওপর। কিছু লোক তাদের টানতে টানতে ধুকছে। কই, তাদের দেশে তো তারা এমনটা কোথাও দেখেনি।
সত্যবান আর-একটা সিগারেট ধরালেন।
আসলে কী, ওদের দেশে তো আমাদের মতো পুলিস নেই। বিচার নেই, আইন নেই, তাই জেলখানাও নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য কী তারা জানে না। তাদের ধনসম্পদ নেই, তাই দারিদ্রও নেই। প্রভু নেই, অতএব চাকরও নেই। এরা তো সব নন-স্টার্টার–হাঃ হাঃ–এদের খেলায় হারজিত নেই। এরা তো সব ন্যাংটা, হোঃ হোঃ, এখানে বাটপাড় কোথায়। লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, উচ্চাভিলাষ, দম্ভ, চরিত্রহনন—এই সব শব্দের যারা… যারা… যাদের প্রতিনিধি, কী বলবেন তাদের, এক কথায় স্বাস্থ্যবান নপুংসক বলা যাক? এই জিনিসটা–এই পুরুষত্বহীনতা–এ তো তাদের মধ্যে জন্মই নেয়নি।
সেদেশে বেশ্যা নেই। তারা রাজাকে বলেছিল। কারণ, নারীর পূর্ণ যৌন স্বাধীনতা সেখানে আছে। কুমারী মাতা সেখানে সন্তান হত্যা করে না–বাবু! বলা শেষ হয়েছে বলেই কি সত্যবান এখানে চুপ করলেন, নাকি এখানে শেষ করবেন বলেই আজকের টপিকটা শুরু করেছিলেন? (পরে বুঝেছি, উনি তখন মারি স্টোপস ক্লিনিকে ভ্রণ-হত্যার ব্যাপারটা জানতেন। জানবারই কথা।)
ক্যানিবালদের তৃতীয় উত্তরটা কী ছিল, সে সম্পর্কে অবগত হবার কৌতূহল অচরিতার্থ রেখে আমি উঠে পড়লাম। এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। আজকের মতো ছুটি। সেদিনও আসল কথা কিছুই বললেন না সত্যবানবাবু।
বেশ চলছিল। কিন্তু আজ, দ্বাদশ দিনে, উনি এমন একটা সাবজেক্ট নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করলেন যে হা-হুঁ করা দূরে থাক, শ্রুতিমাধ্যমে তাতে অংশগ্রহণ করাও আমার পক্ষে আর সম্ভব হল না।
আজ সত্যবান শুরু করলেন পুলিস-টর্চার নিয়ে।
ধরুন, ধোঁয়া ছেড়ে, কনফেশান আদায়ের এই যে পুলিসি মেথডলজিটা। অত্যাচার, টর্চার—এটা..এটা কি ইন ইটসেলফ সাব-হিউম্যান নয়? ধোঁয়া ছেড়ে, আপনি সহ্য করছেন, সহ্য করছে……করছেন, করছেন, করছেন, করছেন—ব্যস, তারপর আর পারলেন না।বলে ফেললেন! অনেক ক্ষেত্রে সলিটারি কনফাইনমেন্টও দেওয়া হয়। একদিন, সাতদিন, একমাস পরে আপনি বলবেন, আমাকে মুক্তি দাও এই নিঃসঙ্গতা থেকে। হ্যাঁ, আমি খুন করেছি।জানেন। কি, খুনের পর খুনিরা কখনও একা থাকে না? তারা মানুষের ভিড়ে মিশে থাকে? ধোঁয়া ছেড়ে, ক্রিমিনোলজিস্টরা বলবেন, এখানে খুনির বিবেক শেষ পর্যন্ত কথা বলল। তাই কি? ধোঁয়া ছেড়ে, আমি অনেক খুনিকে হ্যান্ডেল করেছি। আমি জানি, খুন করার পর খুনির পৃথিবী দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটায় থাকে সে, আর একটায় থাকে বাকি পৃথিবী। খুনির পৃথিবীতে ওসব বিবেক-ফিবেক থাকে না। বানের তোড়ের বিরুদ্ধে বিষধরের ফণা জেগে থাকা দেখেছেন কখনও, বাবু? ভেসে যেতে যেতে খুনির মধ্যেও ওভাবে জেগে থাকে একটাই চেতনা আর তা হল—রাইট টু লিভ। ধোঁয়া ছেড়ে, মৃত্যু পর্যন্ত দড়িতে ঝুলতে যাবার আগে প্রত্যেকটি খুনি সেই মানবতাবাদী ফাঁসুড়েদের অভিসম্পাত দিয়ে গেছে–আমরা যাদের গালভরা নাম দিয়েছি—বিচারপতি! সহ্যশক্তির তো একটা শেষ আছে। ব্রেকিং পয়েন্টে হ্যাঁ বলায় কত নিরাপরাধকে যে খুন করেছে ওই বিচারপতিরা, তার হিসেব কে রেখেছে?
তারপর ধরুন, ধোঁয়া ছেড়ে, আর একটা দিক। সহ্যশক্তির একটা সীমা আছে; আবার মানুষের ক্ষেত্রে, তা নেইও। জন্তুজানোয়ারদের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে বড় জন্তু কিনা। মানুষের সহ্যশক্তি তো অসীম–অনন্ত! বিশেষত যে খুন করেনি, তার! ধোঁয়া ছেড়ে, বার্লিনে ঢুকে দ্বিতীয় দফার নিউ জেনারেশন সৈন্যরা কী করেছিল, রাশিয়া তো তা স্বীকার করেনি। রেড আর্মি কিছু করতে পারে না, যথা রেপ।ইটালিতে ঢুকে ভারতীয় সৈন্যরা রেপ করেনি। আমার বন্ধু অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর মত কি জানেন? মেম বলে ভরসা পায়নি। কিন্তু, আমেরিকানরা। করেছে। অনিচ্ছুক এনলিস্টেড জি আইরা ভিয়েতনামে কি করেছিল, তার অন্তত ছিটেফোটা ল্যান্সডেলের দ্য পেন্টাগন পেপার্সবইতে আছে। আমার কাছে আছে বইটা–পড়ে দেখবেন।
বীভৎস! মাই-লাইতে বাড়ি-বাড়ি ঢুকে জি আই-রা মেয়েদের ন্যাংটো করে সার্চ করত। তারপর বলত, একটুও বাড়িয়ে বলছিনা, এ-সবই সরকারি নথি, এবার তোমাদের ভ্যাজাইনা সার্চ হবে। বলে রেপ করত। ধোঁয়া ছেড়ে, একজন জি আই খুনের ব্যাপারে মা আর মেয়েকে উলঙ্গ করে ক্যাম্পে হাঁটিয়ে এনেছে : কনফেস করো কিন্তু মেয়েটা তো খুন করেনি। সে কিছু জানে না। একজন সৈন্যের হাতে জ্বলন্ত লাইটার তুলে দিয়ে লেফটেন্যান্ট বললেন, ওর পিউবিকহেয়ারগুলো জ্বালিয়ে দাও। মা মেয়েকে বলল, বল, খুন করেছি। কিন্তু মেয়েটা দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। কী বলবে। তার তো বলার কিছু নেই! তখন দিল জ্বালিয়ে।
কী হল, কাঁপছেন কেন আপনি? দারওয়াজা, এক গ্লাস পানি ল্যাও।
জল এলে এক চুমুকে আমি সবটা খেয়ে ফেললাম। বেশ খানিকটা উপচে পড়ল টেবিলে।
সেদিকে দৃকপাত না করে সত্যবান বলে চললেন, সেদিন সেল মিটিং-এ ঘটনাটা রেফার করে বললাম, তা একজন ইন্নোসেন্টের যদি এতখানি এনডিওরেন্স থাকে, একজন কালপ্রিটেরই বা থাকবে না কেন। সেও তো মানুষ। মেটাবলিজম একই। কাজেই ওসব টর্চার মেথড ফেথড একদম বাজে। অবসোলিট। ধোঁয়া ছেড়ে, আই জি ক্রাইম আমার বক্তব্য খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করলেন। মুসৌরির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশানে ওঁকে লেকচার দিতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দেখলাম, ওদের কাগজে যা বেরিয়েছে, উনি আমার লাইনেই বলছেন।
প্রকাণ্ড অ্যাশট্রেতে সিগারেট পিষতে পিষতে স্লিভ সরিয়ে সত্যবান কজিতে ঘড়ি দেখলেন।মনে হয়, একঘণ্টা বহুক্ষণ পেরিয়ে গেছে। সত্যবান হেসে জানতে চাইলেন, কী! আজ আপনি কিছু বললেন না যে!
পিউবিক হেয়ারে অগ্নিসংযোগের পর থেকে আমি আর কিছু শুনতে পাইনি। শুধু ওঁর গল-অস্থির ওঠানামা দেখে গেছি।
আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
এমন একটা ইশারার জন্যেই যেন এতক্ষণ গুটিয়ে চুপ করে শুয়ে ছিল আমার সকল স্নায়ু। উনি লিলিহহা! বলামাত্র নেড়ি কুকুরের মতন তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওঁর ওপর।
আপনি আমাকে কবে অ্যারেস্টকরছেন? ওঁর চোখে চোখ রেখে আমি জানতে চাইলাম।
১১. দ্য কন্টিনেন্ট অফ সার্সি
উনি এটা আশা করেননি। এই অসৌজন্য।
একটু থতমত হয়ে গেলেন বটে। তা বলে পাঁচপেঁচি, গড়পড়তা পুলিস অফিসারের মতন ওঁর চোখের তারাদুটো যে হঠাৎ পাথরে পরিণত হল, তা না। এদিক-ওদিক ওঁর দৃষ্টি ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ। তারপর যখন তাকালেন, দেখলাম দৃষ্টি আরও কোমল হয়েছে। সস্নেহে বললেন, এত তাড়া কীসের?
আমি বললাম, দেখুন আমার অ্যালিবাই নেই।
না থাক। সেটাই নেসেসারিলি প্রমাণ করে না যে, আপনিই ক্রাইমটা করেছেন।
কিন্তু যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আজ আমি তোমায় ছাড়ব না।
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে জানতে চাইলাম, কাগজে বেরিয়েছে আমিই প্রাইম সাসপেক্ট। কেন? আমি এর কৈফিয়ত চাই।
তাতে কী হয়েছে। জবাবদিহির সুরে সত্যবান বললেন, তাতে কী হয়েছে। ছাগলে কী না খায় আর কাগজে কী না বলে। আমিই বলেছি কাগজকে।
কেন? যেন আমার হক, আমি উত্তর দাবি করি।
আমার আজকের রুখে-দাঁড়ানো দেখে উনি এখনও অপ্রস্তুত। ওঁর দৃষ্টি ব্যথিত। এঁর এতদিনের সৌজন্য ও সকল সহৃদয়তাকে চ্যালেঞ্জ করে আমি কি অবিচার করছি তার ওপর? নাকি, এটা ওর মুখোশ? এমন তো নয় যে, খুনিকে না ধরতে পারলে শেষ পর্যন্ত, সাবস্ট্যানসিয়াল ক্ল তথা সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্সের জোরে চালান দেবে বলে ও আমাকে এভাবে জিইয়ে রেখেছে? যদি তাই হয়, তাহলে এই ঢ্যামনামির আমি আজ শেষ দেখব।
সত্যবান বললেন, ওটা একটা ক্ল্যাসিকাল মেথড আমাদের। এখনও কাজ দেয়। রিয়েল কালপ্রিট নিশ্চিন্ত থাকে। অন্তত, অ্যালার্ট আর থাকে না।
আজকের ইভিনিং স্টারে বেরিয়েছে, আমি নাকি কনফেস করেছি বিদ্রুপে সরু হয়ে আসে আমার ঠোট, এটাও কি আপনি বলেছেন? আপনার মেথডটা ক্ল্যাসিকাল না মর্ডান সার?
ওরা একটু বাড়িয়ে লিরেছে। কিন্তু কনফেস তো আপনি করেছেন।
এই তো মুখোশ খুলছে। একটু একটু করে। এসো, বাছাধন।
কনফেস? আমি! টেবিল ছেড়ে কাঁপতে কাঁপতে আমি উঠে দাঁড়াই, হোয়াট ডু ইউ মিন!
বেশ খানিকটা গ্যাপ দিয়ে সত্যবান আবার একটা সিগারেট ধরালেন। প্যাকেটটা সেই থেকে টেবিলে পড়ে। যখন ইচ্ছা আমি নিতে পারি, উনি বলে রেখেছেন।
স্ত্রীকে মার্ডার করার জন্যে একটা ব্লু-প্রিন্ট তো আপনি তৈরি করেছিলেন — বাবু। সত্যবান বলে গেলেন, করেননি? ব্যাঙ্ক অফ টোকিওর চন্দনবাবু যেদিন এলফিনে আপনাকে বললেন, ওদের দলের একজন মহিলা বদ্রীনাথ থেকে নামার সময় ঘোড়াসুদু খাদে পড়ে গিয়েছিল, পরের দিন ফোন করে আপনি চন্দনবাবুকে, আজকাল একটা ঘোড়ার দাম কত জেনে আপনাকে জানাতে বলেছিলেন। বলেননি? চন্দনবাবু রেসে যান। রেসের মাঠ থেকে জেনে চন্দনবাবু আপনাকে জানান। জানাননি? আসলে এলফিনেই আপনার মাথায় এটা ফ্ল্যাশ করে যে তাহলে তো আপনার স্ত্রীও ওভাবে পড়ে যেতে পারেন, ঘোড়াসুদু! তাই না?
এসব কী উন্মাদের মতো বলছেন আপনি? এতদিন পরে!
দাঁড়ান। বাধা দিলেন সত্যবান, লেট মি ফিনিশ। আপনি স্ত্রীকে না জানিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে এক লাখ টাকা তুলে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
হ্যাঁ। পথে কোনও বিপদ-আপদ…
এক লাখ টাকা! না। মানতে পারলাম না। আমি ধরে নিতে পারি এবং নিয়েছি যে, এটা ছিল আপনার একটা হিসেব। ঘোড়া বিশ আর খুন পঞ্চাশ। যদি রাজি হয় কোনও ঘোড়াঅলা। আপনারা—আমি আপনাদের মোডাস অপারেন্ডি বা থট-প্রসেস নিয়েই বলছি—মশাই ভারি চ্যারিটেবল। এমন ছেলেমানুষের মতো ব্লু ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে যান, প্রিয় অভিভাবকের মতো হাসতে হাসতে সত্যবান জানতে চাইলেন, আচ্ছা, আচ্ছা। মানছি, এগুলো সব ডাইডাক্টিভ কু। কিন্তু মার্কেটে ক্ষেমচাদ ভাটিয়ার দোকান থেকে আপনি আমেরিকান ছুরিটা তো কিনেছিলেন? এটা তো কনফেস্ করেছেন?
কিন্তু, দেখুন, ওটা তো হঠাৎ একদিন রাগের মাথায় কিনে ফেলেছিলাম। ওর পাঞ্জার জোর কত বেশি টের পেতে পেতে শুকনো টোক গিলে আমি বলি, কিন্তু তারপর দীপ্তি যেদিন সকালে একটা কিচেন নাইফ আনতে বলল, সেদিন সন্ধেবেলা আমিই ওর হাতে সেটা তুলে দিই। দিয়ে বলি, সস্তায় পেয়ে গেলাম। এতে তোমার পাউরুটি আর আমার গলা দুটোই স্লাইস করতে পারবে। সবই তো বলেছি আপনাকে।
হ্যাঁ। কিন্তু, আমি যেটা আপনাকে বলিনি, সেটা হল ওই ছুরিটা দিয়েই আপনার স্ত্রীর গলা কাটা হয়।
আঁ!
হ্যাঁ।
কিক-কিন্তু আমি তো খুন করিনি। মামুর কাছে প্রতিবাদের সময় চৈতির তীক্ষ্ণ গলায় আমি চিৎকার করে উঠলাম।
খাপে ছুরি ঢুকিয়ে নেওয়া রণত্যাগীর আত্মসমর্পিত গলায় আমি শান্তভাবে বললাম, কিন্তু, আমি তো খুন করিনি।
অনেস্টলি, আমি এখনও তাই মনে করি।
এখনও?
এখনও। আর তাই আপনি বাইরে।
কিন্তু, কে খুনি তা কি আপনি গেস করতে পারছেন না। এখনও? এতদিনেও!
এটা ট্রেড সিক্রেট। সত্যবান বললেন, এ বিষয়ে কিছু জানতে চাইবেন না। প্লিজ।
কিন্তু, আমি যদি পালিয়ে যাই?
পালাবেন না। পালাবেন না। আপনার মতো লোকরা পালায় না। সত্যবান প্রথম ড্রয়ার খুললেন : রিভলভার। দ্বিতীয়, তৃতীয়, একেবারে শেষ ড্রয়ারে খুঁজে পেলেন ডায়েরিটা, এই যে আপনার ডায়েরিটা দেখছিলাম। উঃ, মশাই, আগাগোড়া বন্দীর একি ভয়াবহ কারাবন্দনা! এক জায়গায়, এই যে, পেজ মার্ক ধরে ডায়েরিটা খুলে উনি পড়তে শুরু করলেন, দীপ্তি, তুমি যেটাকে ভাবছ খাঁচা, সেটা খাঁচা সত্যিই, কিন্তু, পাকাটির। দীপ্তি : পাকাটির তো ভেঙে বেরিয়ে যাওনা কেন? আমি : কারণ, ভেঙে বেরুলে কী, খাঁচার বাইরে কী, আমি তা জানি না। পদচিহ্নহীন সে অজানার চেয়ে, এই জানা বন্দিদশা, এ আমারই পছন্দ। সপ্তাহে বার দুই এই চেনা দানাপানি বলে আমি পাকা পোনার পেটের মতো নরম দীপ্তির… সরি। অবভিয়াসলি, এ-সব পিলো-টক। স্ত্রীকে আপনি কিন্তু, খুব ভালবাসতেন মশাই, যাই বলুন।
ওগো তোমরা কে কে চা খাবে উঠে পড়। কারণ, এরপর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবে না…
অ্যান্ড শি ওয়াজ আ রিমার্কেবল উওমান ইনডিড। কলেজের কলিগ এবং ছাত্রীরা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন, আপনার বন্ধু এবং বন্ধুপত্নীরা যেখানে গেছি সবাই, সবাই ওঁর গুণমুগ্ধ। তবু কেন যে আপনারা এ-ভাবে ঘর পোড়ালেন, সাইকিয়াট্রিস্টরা হয়ত বলতে পারবেন। এ আমাদের পুলিসের কর্ম নয়।
হ্যাঁ। কিন্তু খাঁচা পাকাটি, এসবের সঙ্গে আমার না-পালানোর সম্পর্ক কী, কই কিছু বললেন না তো?
বললাম তো। ওই যে জানা-অজানা? গোটা লালবাজারটাই তো আপনার একটা পাকাটির খাঁচা, উনি হাত ঘুরিয়ে দেখান, কই, কেউ কি ভাঙছে? হাজতের দরজা খোলা রাখলেও আপনার মতো লোকরা পালাবে না মশাই। হুইচ ইজ ওয়ান থিং আই ক্যান টেল ইউ ফর শিওর।
এই প্রথম আমি বুঝলাম, এঁর কুহক-এলাকা থেকে পালাবার উপায় আমার নেই। নিশ্চিত পরাজয়ের নিশ্চেষ্টতা আমার পাঞ্জায়, উনিও টের পেয়েছে। ধীরে, কিছু বা সস্নেহে, উনি আমার বিফল প্রতিরোধ টেবিলে শুইয়ে দিলেন।
সত্যবান তখন বলে যাচ্ছেন, এই যে ছেড়ে রেখেছি আপনাকে। আইভি সোমের ব্যাপারটা তো সেইজন্যেই জানতে পারলাম। তাই না?
১২. কান্ধা নেহি দেতা
নিজের হাতে কেবিনের পর্দা টেনে দিয়ে আইভি বলল, আমাকে ফোন না করলে হত না।
খুন হয়েছে শনিবার। সোমবার দুপুরে আইভিকে আমি বাম্বু-ভিলায় ওর অফিসে ফোন করে ওয়ান-টানে আসতে বলি। এবং এর বেশি কিছু ফোনে বলিনি। নিশ্চয় কাগজে সব পড়ছে।
যোধপুর পার্ক থেকে ট্যাক্সি নিয়ে লেক গার্ডেনস-এ ঢুকে ল্যান্সডাউন-মার্কেটে আমি ট্যাক্সি ছেড়ে দিই। ফোর-সেভেন এক্সচেঞ্জের বুথ থেকে ডায়াল করেছি। কেউ আমাকে ফলো করেনি। কেউ জানবে না।
খুনের কথা শুনতে শুনতে সেই একবার যা একপলক আমাকে দেখে নিয়েছিল আইভি, তারপর আর চোখের দিকে তাকায়নি। আস্তে আস্তেবলে উঠে দাঁড়িয়ে টেনে দিয়েছিল পর্দা, যেন সারা পৃথিবী আমার কথা শুনতে পাচ্ছে, যদিও আমি কথা বলছিলাম ফিসফিসিয়ে, শুধু ওর জন্যে।
আইভি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। নিজের কাপে চিনি মিশিয়ে নাড়তে লাগল। আমারটায় দিতে ভুলে গেল এই প্রথম।
মাথা নিচু করে সে বলল, তাহলেও…
আইভি থাকে দাদা-বৌদির সঙ্গে। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ৪০ তো হলই। (বিয়ের পর তো আর দাদা দাদা থাকে না। হয়ে যায় স্বামী, জামাই, জামাইবাবু, ভায়রাভাই, এইসব। —আইভি।) এদিকে আমার কাছেও তার পাবার কিছু নেই।
আজ থেকে ১০ বছর আগে আলাপের প্রথম দিনেই আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম, আমাদের বাড়িতে এক ৫ বছরের মেয়ে–তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে চৈতি আছে। ওই মেয়ের মা আমাদের বাড়িতে থাকে। এক কথায়, আমি বিবাহিত।
আরও স্পষ্ট করে বলা যেত, আমার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরির মতো, টিল সুপারঅ্যানুয়েশন, আমি এটাও ছাড়তে পারব না। আরও স্পষ্ট করে বলা যেত, আমি গাছেরও খাব এবং তলারও কুড়োব। তবে, এসব ক্ষেত্রে পুরোটা বলতে হয় না। বোঝা যায়। মোট কথা, আমার কাছে আইভির কোনও প্রত্যাশা নেই। এক, আমি দীপ্তিকে ভালবাসি না—এ ছাড়া। সে শুধু সেই কুটোটুকু সম্বল করে ভেসে আছে।
কিন্তু খুন হয়েছেদুপুরে। সারা দুপুর তুমি তো আমার সঙ্গে। সদর স্ট্রিটের হোটেল রিলাক্স এর রুম নম্বর থার্টিনে। আমি তো জানি, তুমি খুন করোনি। আইভি জানাতে চাইল, তোমাকে সন্দেহ করছে কী করে?
যা চাইছিলাম। এত তাড়াতাড়ি আইভি স্বীকার করবে আমি আশা করিনি।
আমি বললাম, আইভি, তুমি আমার সঙ্গে চলো। এই কথাটা তুমি পুলিসকে বল।
আইভি আঁতকে উঠল, কোন কথাটা?
আমরা সারা দুপুর ১৩ নম্বর ঘরে ছিলাম। হোটেল রিলাক্স-এ৫টায় চেক আউট করি।
ছিঃ। এ কী করে বলছ তুমি। ও যেন ভূত দেখে পিছিয়ে যাচ্ছে, এ আমি কী করে বলব। দাদা-বৌদির কাছে শেষ আশ্রয়টুকুও যাবে। তাছাড়া…
আইভি দ্রুত হাঁটে। যেখানেই সে উপস্থিত হোক না কেন, মনে হবে, সে বুঝি দৌড়ে এল। এতক্ষণ কেউ তাকে তাড়া করেছিল। পৌঁছে সে হাঁফায়। তার গোল চোখদুটি জ্বরো রুগীর মতো সব সময় বিস্ফারিত আর ছলছলে হয়ে থাকে। তার চোখের তারা আরও বড় হয়ে উঠল যখন সে বলল, তা-ছাড়া সবাই জানবে। কাগজে তো রোজ বেরুচ্ছে। সব বেরুবে। আমি চাকরি করব কী করে?
যা ভেবেছিলাম। প্রাণের চেয়েও বেশি ভয় ওর চাকরি যাবার। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি। পুলিস কেসে জড়ালেই সাসপেনশন। আর এ তো খুনের মামলা। অবশ্য, চাকরি ছাড়া ওর আছেই বা কী।
গত দশ বছরের একটানা নিরবচ্ছিন্ন চেনাশোনা। সুদীর্ঘ গোপন যোগাযোেগ। ভালবাসে বলেই তো। কেবিনের ভারি নিচ্ছিদ্র পর্দার এদিকে ওর কোমরের পেটি, ঊরুর রাং বা বাঁটের মাংসের বদলে অনেক দিনের মধ্যে এই প্রথম–৪০ বছরের বাড়ি মহিলার ১০ বছর আগেকার যুবতী হাত আমি কোলে টেনে নিই। দুই হাতে তার পাণিগ্রহণ করে আমি বলি, প্লিজ ডু নট। ডু নট লেট মি ডাউন। ব্যাপারটা চুকে গেলে আমি তোমাকে বিয়ে করব। এখন তো আর কোনও বাধা নেই।
আমার মুখ বিবর্ণ। কিন্তু, আইভি সেদিকে এখনও তাকাল না। আমার কাঁপা কাঁপা হাতের ভেতর থেকে সে ধীরে খুলে নিল তার দক্ষিণ বাহু।
তা-ছাড়া, আইভি পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গেল, ব্যাপারটা আরও জটিল হবে। আমার অস্তিত্বের কোনও মূল্যই তোমার কাছে এতদিন ছিল না। কিন্তু, পুলিসের কাছে আজ এর মূল্য অনেক। পুলিস তোমার মতো কামু পড়েনি। ভাল না বেসেও একটা অ্যাবসার্ড সম্পর্ক থাকতে পারে নরনারীর মধ্যে–যা তুমি বল–এতে তারা বিশ্বাস করে না। আমার চেয়ে কনুই থেকে কাঁধ পর্যন্ত নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে আইভি বলল, আমার চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য খুনের মোটিভ আর কী হতে পারে পুলিসের কাছে? নিজের স্বার্থেই আমার ব্যাপারটা তোমার সম্পূর্ণ গোপন রাখা উচিত।
কিন্তু আমার তো একটা অ্যালিবাই দরকার আইভি। আর পুলিস তো সেটাই চাইছে।
আর বেঁচে-থাকার জন্যে আমার বুঝি অ্যালিবাই দরকার নেই, আইভি ঝঝর করে কেঁদে ফেলল, তুমি যখন যা বলেছ, করেছি। সেখানে নিয়ে গেছ, গেছি। মেরি স্টোপস-এ গিয়ে একা একা প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট করিয়ে এসেছি। প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট! রুমাল বের করে বিশ্রীভাবে সে বেপরোয়া নাক ঝাড়তে থাকে, হাঃ। এর চেয়ে হিপোক্রিট কয়েনেজ তুমি আর-একটা দেখাতে পারবে? আমি তো, আমি তো, দু-হাত দেখিয়ে খুনই করেছি আমার চার মাসের ছেলেকে। তখন প্লাসেন্টা ফর্ম করে গেছে। তুমি সঙ্গে যাওনি! যে কাজ দুজনে মিলে করেছি, তার শাস্তি আমি একা মাথা পেতে নিয়েছি। তুমি আর কী চাও?
ওয়েটার লি ইয়ং পর্দা তুলেছে। আইভি তাকে আর একপট চা দিতে বলল। টেবিলে এক প্লেট চিলি প্রন সেই থেকে পড়ে আছে।
এই ওয়ান টান রেস্তোরাঁর প্রত্যেকটি ওয়েটার আমাদের চেনে। বিশেষত, এখন যে চা দিয়ে যাবে, সেই লি ইয়ং। এখানে আমরা গত দশ বছর ধরে আসছি। আমাদের বিলম্বিত চুম্বনের সময় লি ইয়ং যে কতবার পর্দা তুলে নিঃশব্দে নামিয়ে দিয়ে গেছে, আমরা তা জানি না। তবে একদিন, যেদিন সরি বলে ফেলেছিল, সেদিন আমি আইভির খোলা বুকের নীপ সাক করছিলাম, যেজন্যে, সেই সেদিন থেকে, সার্ভিসে থাকলে, সে আইভির কাছ থেকে ৫ টাকা টিপ্স পেয়ে আসছে। গোড়ার দিকে কত কাণ্ডই না হয়েছে ওয়ান টানের জোনাকির মতো ঝরঝবে এই ছোট ছোট সাদা ঘরে।
আমার চায়ে চিনি দিয়ে ও নাড়তে নাড়তে আইভি শান্ত করল নিজেকে। বলল, জানি, আমার ফেঁসে যাবার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো তোমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়। কিন্তু, তুমি ডুববে। অন্তত নিজের স্বার্থে তোমার আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ চেপে যাওয়া উচিত।দুজনেই চুপচাপ। বোধহয় আর কিছু বলার নেই আমাদের। আমি চুলের মধ্যে মাথা নিচু করে আঙুল চালাতে থাকি। পাখা ঘুরে চলেছে। চা ঠান্ডা হচ্ছে।
তুমি খুন করেনি। যেন ভূত-ভবিষ্যৎ সব দেখতে পাচ্ছে এমন অকম্পিত স্থিরনিশ্চিত গলায় আইভি বলল, অ্যালিবাই থাক না থাক, তুমি শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে যাবে। হোটেলের কথা বলে, মাঝখান থেকে আমাকে ধ্বংস করে দিও না, প্লিজ।
কিন্তু, আমি তো তোমাকে বিয়ে করব?
কুমারী-মাতা গলা টিপে ভ্রণ-হত্যা সম্পূর্ণ করে উঠে দাঁড়াল। এই প্রথম চোখে চোখ রাখল আমার। কখনও কখনও চোখ থেকে তারা সরে যায়। থাকে শুধু দুটি সাদা প্রস্তরখন্ড।
কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করব না। আইভি উঠল, চলি।
এই, পূর্বাপর সস্নেহে ভ্যানিটিতে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল একবার, তোমার কিছু টাকা লাগবে?
কাউন্টারে আইভি বিল পে করছে।
সো আর্লি মিস সোম?ম্যাডাম হুয়া জানতে চাইছেন। উনি আইভিকে খুব ভাল চেনেন। ওঁর ইনকাম ট্যাক্স ফাইল আপডেটেড করার ব্যাপারে আইভির অবদান আছে।
আই অ্যাম ইন আ হারি। হ্যাভ টু গো টু অফিস।
আমি মনে মনে দেখতে পেলাম যথারীতি একগাল হেসে ও কথাগুলো বলল। ভুলে গেছে, ও এসেছে সাড়ে পাঁচটায়। এখন সাতটা বাজে।
আমি কেবিনে বসে রইলাম। বুঝলাম, আমার কেউ নেই। এ সময় কেউ পাশে দাঁড়ায় না।
কেউ কান্ধা দেয় না।
১৩. অপারেশন ফান মাঞ্চ
ভোরের স্বপ্ন।
স্বপ্নটা আমি এই নিয়ে কমপক্ষে দশবার দেখলাম। ঘাটশিলায় ফুলডুংরি পাহাড়ের ওপাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যার অস্তিত্ব আমার স্বপ্ন বাস্তবে রয়েছে (অনেকটা আমাদের কলকাতার নদী তীরে গোয়ালিয়র মনুমেন্টের মতন), কিন্তু, বাস্তবে যা কোনওদিন দেখতে পাইনি। আজকের স্বপ্নে যোগ হয়েছিল একটা নতুন মাত্রা। স্বপ্নের দীপ্তি আজ আমাকে ঠেলে ঠেলে ডাকছিল : এই শুনছ। উনি আবার দেখা দিয়েছেন। অর্থাৎ, স্মৃতিস্তম্ভটি।
দুঃস্বপ্নের তুলনায় সুখস্বপ্নগুলি কত ক্ষণস্থায়ী!
শনিবার,৩০ মে স্বপ্নভঙ্গ হল নৃপেনের বাড়ির চারতলার সেই সিলি ঝুমঝুমিটার ত্রিকালজ্ঞ আওয়াজে : ঝিকি-ঝিনি, ঝিকি-ঝিনি, ঝিনিক-ঝিনি… চারতলার চিলেকোঠায় যে থাকে, তার ঘুম ভাঙাতে বা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, একতলা থেকে সিল্কের কর্ড টেনে পুলি-সংলগ্ন এই ঝুমঝুমিটা বাজানো হয়। আমি সহ্য করতে পারি না এর ঠাট্টার সুর। মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত গম্ভীর ঘটনাকে ব্যঙ্গ করার জন্যেই এমন চোখ-মারা ফিচেলভাবে এটা বাজে। এর ফানি . আওয়াজ আমি সহ্য করতে পারি না। কতবার আমি নৃপেনকে বলেছি, এটা হাটাও। এ শুধু। টুনটুনির সেই কেয়া মজা, কেয়া মজা/রাজা খাবে ব্যাঙ ভাজার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হতে পারে। নৃপেন কর্ণপাত করেনি। তার মতে এটা একটা মিড-ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ড পিস, এমনকি এর দড়িটিও নাকি ওরিজিনাল। (হ্যাঁ, আর তুমি ছিলে রানীর সেই খাসবেয়ারা ভারতবর্ষীয় আবদুল, রাত দুপুরে বুড়ি মাগির দরজায় দাঁড়িয়ে দড়ি খেচতে আর কি! আমি তাকে উত্তরে বলেছি, মনে-মনে।)
দরজা খুলতেই নিচে থেকে চৈতির ব্যাকুল কণ্ঠস্বর কানে এল, বাবা! বাবা! শিগগির নিচে এস। খুনিরা ধরা পড়েছে।
কদিন ধরে আবহাওয়া সংবাদে ৯০ কিলোমিটার বেগে আসন্ন সাইক্লোনের কথা বলা হচ্ছিল। ছাদে বেরিয়ে দেখি, সারা আকাশ জুড়ে শোল মাছের গায়ের মত পাঁশুটে মেঘ। বৃষ্টি এখনও দুর্বল, কিন্তু হাওয়া জোরালো। দক্ষিণ-সমুদ্র থেকে উড়ে আসছে মেঘের পরে মেঘ। তারা, জলভারে, হুস হুস করে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
একদিন নৃপেন সমস্ত কাগজ নিচ্ছিল। কেউ পারেনি, শুধু আজকাল-ইখটি এক্সকুসিভ করেছে। তবে, খবরটি ছোট।
খুনি চারজন। চারজনই নাবালক। জানা গেছে, তারা সকলেই শিক্ষিত, সচ্ছল পরিবারের ছেলে। তারা সবাই এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে। স্কুলে কৃতী ছাত্র হিসেবে তাদের নাম আছে। তাদের ধরা হয়েছে বদ্রীনাথের পথে। বাড়ি থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর, কেদারবদ্রী যাবার পাথেয় সংগ্রহের জন্য এরা খুন করে বলে জানা গেছে। বদ্রীনাথ থেকে ২৩ কিলোমিটার আগে, গোবিন্দঘাটে নেমে পড়ে, এরা গিয়েছিল সেখান থেকে ১৭ কিলোমিটার দূর ও ১৫০০০ ফুট উঁচু হেমকুণ্ড সাহেব গুরুদোয়ারায়। তুষার হ্রদ হেমকুণ্ড থেকে দুর্লভ ব্ৰহ্মকমল তুলে আনাই ছিল এদের সঙ্কল্প। যাত্রী সেজে পুলিস গোবিন্দঘাটে অপেক্ষা করছিল। আজ কালকা মেলে এদের কলকাতায় আনা হচ্ছে।
রিপোর্টে খুনিদের নাম, ছবি এ-সব কিছুই নেই। পুলিস দেয়নি। এক্সক্লসিভ বলে, এইটুকু খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে আজকাল। চার কলমের অ্যাঙ্কার স্টোরি করেছে। হেডিং: দীপ্তি বসুরায়ের খুনিরা ধরা পড়ল মহাপ্রস্থানের পথে।
এতদিন অনেকেই খোঁজখবর নেয়নি। সকাল থেকে ফোনের পর ফোন। অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি হিল্লোল রায় বললেন, আপনি আজই জয়েন করতে পারেন। হিরোজ ওয়েলকাম অ্যাওয়েটস ইউ।
সব শেষে সত্যবান মণ্ডলের ফোন এল। তখন বেলা ১০টা। বললেন, সকাল থেকে চেষ্টা করছি। লালবাজারে চলে আসুন। কালপ্রিটরা এসে গেছে।
ফোনে সত্যবানের সঙ্গে প্রথমে আমার, তারপর নৃপেনের অনেকক্ষণ কথা হল। আমি আগাগোড়া হুঁ-হাঁ করে গেলাম। কারণ, আমার সঙ্গে সত্যবান শুধু আইভির কথা বলছিলেন। সেদিনের পর আইভির সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দেখলাম, আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে জল গড়িয়েছিল বহুদুর।
সেদিন ওয়ান-টান থেকে বেরনো মাত্র আইভি সোমকে ধরা হয়। পুলিস আগাগোড়া শ্যাডো করেছিল। অ্যান্ড, শি কনফেসড এভরিথিং। আপনার ছবি এবং মিস সোমকে নিয়ে আমি হোটেল রিলাক্স-এ যাই।সো, ফ্রম দা ভেরি থার্ড ডে অফ দা ইনসিডেন্ট অফ মার্ডার, ইউ হ্যাভ বিন এনজয়িং অ্যান ইমপ্রেগনেবল অ্যালিবাই, ইউ সি! আপনি খুন করেননি, এটা আমি অবশ্য তার আগে থেকেই জানতাম।
যখন নৃপেন কথা বলছিল, এই প্রথম আইভির সঙ্গে আমার বিয়োগান্ত নাটকের কয়েকটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আইভি, পর্দা তুলে, সে সবও দৃশ্য সত্যবানকে দেখিয়েছে নাকি! খুনের তদন্তে সেসব তো কোনও কাজেই লাগবে না। বরং যা বলেছিল সত্যবান, সাইক্রিয়াট্রিস্টদের উৎসাহ থাকতে পারে। সে মরা খাঁড়ি ধরে এগিয়ে গেলে যে কোনও অসুখী দম্পতির ম্যাল-অ্যাডজাস্টমেন্টের উৎসে পৌঁছনো যেতে পারে। সেই সব রোমহর্ষক প্রাপ্তবয়স্ক বিছানা-দৃশ্যের জন্য আমি আইভির কাছে কৃতজ্ঞ।
যখন হোটেল ছিল না, আইভি সেই গোড়ার দিকে দু-একবার আমাদের ফ্ল্যাটেও এসেছে। একবার হল কী, বাড়ি ফিরে, বিছানার পাশে দীপ্তি একটা ছোট্ট টিপ কুড়িয়ে পেল। এটা কোথা থেকে এল, এ তো আমাদের টিপ নয় জানতে চাইলে আমি খুব রাগ করে তাকে বলেছিলাম, তা আমি কী করে জানব। নন্দর-মা ঘর মোছে, তার হতে পারে।
পুরুষ মানুষের রাগ। দেখে ভড়কি খাবে না, এমন মেয়ে পৃথিবীতে কমই। কিন্তু, দীপ্তি তাদেরই একজন।
কিন্তু এ তো বেশ দামি টিপতর্জনীর ডগায় টিপ-পর্যবেক্ষণ করে তার ভ্রূ কুঁচকে আসে, শিপার। নন্দর-মা তো সিঁদুরের টিপ পরে।
আশ্চর্য তো। তোমার বীণাদি-মনোরমাদি কত লোক আসে, অন্য ফ্ল্যাটের মেয়েরা আসে, বাসনউলি আসে, চৈতির স্কুলের বন্ধুরা আসে টিপটা পা দিয়ে সরিয়ে মোজা পরতে পরতে আমি বলেছিলাম, খেতে দেবে না বাইরে খেয়ে নেব? আমাকে অফিস যেতে হবে। এটা মেয়েদের কলেজ নয় যে আজ দিদি এ ক্লাসটা নেবে না। এটা ব্যাঙ্ক।
তা, এরাও তো এক-একটা অ্যালিবাই। এই বীণাদি-মনোরমাদি এরা। মায়, নন্দর-মা কি বাসনউলি। এরা না থাকলে ওর অন্তত একটা বিশ্বাসকে দশ বছর ধরে খুন করে যাবার ইতিহাসটা সেদিনই ধরা পড়ে যেত।
ঘরে জানালার শার্সি সব বন্ধ। তোড়ে বৃষ্টি নেমেছে। সাইক্লোন শুরু হয়েছে। হাওয়ায় মোটর-গ্যারেজের টিনের চাল বাজছে ঝনঝন করে। গলি দিয়ে মাঝে মাঝে গাড়ি যাবার ছা শুনে বোঝা যায়, জল জমেছে। যাই বলি, অল সেড অ্যান্ড ডান, আমার এই একটা ব্যাপার—এই ফাইডেলিটির ব্যাপারটায়–সে খুবই আস্থা রাখত। ভেবে, আমার মনে মৃতা স্ত্রীর জন্য স্বামীর সহানুভূতি জাগে।
ফান মাঞ্চ? আঁ-আঁ, বলেন কি, আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, গিয়ে সব শুনব, রেখে দিচ্ছি, বলে রিসিভার নামিয়ে রেখে নৃপেন আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ডেডবডির পাশে ফান মাঞ্চের একটা খালি প্যাকেট দেখেছিলে?
লাল চালচিত্র। তাতে গাঁথা কয়েকটি ওয়েফার্স। সে-যাবৎ অদেখা, অশাস্ত্রীয় প্রতিমার সেই গলাকাটা মুণ্ডু!সহসা আমি আবার সেই মুহূর্তে গিয়ে দাঁড়াই যখন হৃৎপিণ্ড জমে বরফ। যখন, টেকনিক্যালি, আমি মৃত। আমার মাথার মধ্যে ইলেকট্রন মেঘ। তার তড়িৎচৌম্বক-ক্ষেত্র থেকে ভরশূন্য সমুদ্রপাখির ডাক–কোয়ার্ক! কোয়ার্ক! কোয়ার্ক!
এই যে, আমার মাথার চুলের গোড়ায় ফের ঘাম জমছে।
ওগো তোমরা কে কে চা খাবে উঠে পড়। কারণ, এরপর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবে না…
হ্যাঃ হ্যাঃ-হ্যাঃ-হ্যাঃ। আর ওই ফান মাঞ্চই কিনা তোমাকে বাঁচাল, আঁ! নৃপেন হাসতে হাসতে বলল, নাও, চটপট তৈরি হয়ে নাও। আমার সঙ্গে বেরুবে। আই শ্যাল ড্রপ ইউ ডাউন। কোর্ট অ্যাডজোন করে যত তাড়াতাড়ি পারি, আমি লালবাজারে আসছি।
গাড়িতে নৃপেন বলল, লোকটা জিনিয়াস। ওই ফান মাঞ্চের প্যাকেট দেখেই ও বুঝে গিয়েছিল, তুমি খুনি নও। কোনও প্রফেসনালের কাজও এ হতে পারে না। কারণ, কোনও স্বামী স্ত্রীকে খুন করে, বা ফর দ্যাট ম্যাটার কোনও প্রফেসনাল, ডেড বডির পাশে দাঁড়িয়ে ফান মাঞ্চ খেতে পারে না। এ নিশ্চয়ই কোনও জুভেনাইল ডেলিংকোয়েন্টের কাজ এবং তারা একজন নয়–ফার্স্ট স্পট এনকোয়ারিতে ও বুঝে গিয়েছিল।
লোকটির পুলিস মেডেল পাওয়া উচিত নৃপেন জানাল।
ল্যান্সডাউন মার্কেটের পর থেকে হাঁটুজল। গাড়ি ঘুরে রমেশ মিত্র দিয়ে চলল। পূর্ণ-য় উঠবে।
১৪. ওগো, তোমরা কে কে চা খাবে…
আমি তখন সঞ্জয়কে বললাম, গলাটা কেটে দে। কট্ট্ররর।
ঘরে একটা টেপ চলছিল ফুল ভলুমে। আমাকে দেখেই সত্যবান রেকর্ডারটা বন্ধ করলেন।
চিনতে পারছেন!
কৌশিক, তুই?
যা অবিশ্বাস্য, তার মুখোমুখি হতে হলে, আমার প্রবণতা হল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেনে নেওয়া। কিন্তু এজন্যে আমাকে যে কী দাম দিতে হয়, সে শুধু আমি জানি আর জানে আমার ক্রীতদাস স্নায়ুমণ্ডল, যারা অ্যাজবেস্টস দিয়ে তৈরি। আগুন যাদের পোড়াতে পারে না।
হাতে-হাতকড়া, কৌশিককে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে দীপ্তির কাটা গলা দেখেও যা হয়নি এই প্রথম তারা শরীর ছেড়ে পালাতে থাকে। আমার হুকুম তারা আর শোনে না। ভাঙতে ভাঙতে আমি একটি স্কুপে পরিণত হচ্ছি, আমি দেখি। প্রশ্নটা আমি করতে চেয়েছিলাম ডান হাতের তর্জনী তুলে। দেখলাম, সেটুকু ক্ষমতাও অন্তর্হিত হয়েছে। কোনও মতে চেয়ার ধরে তবু, আমি দাঁড়িয়ে।
আ-হ্যাঁ। কৌশিক।সত্যবান বললেন, চেনেন তো আপনি। পাড়ার ছেলে! প্রসেনজিৎ আর রাকেশ ভিকটিমকে ধরে রাখে। বুকের ওপর বসে কৌশিক মুখে টেবিল ক্লথ খুঁজে দেয়। তারপর সঞ্জয় গলা কাটে। যেন বাহাদুর ছেলে, কৌশিকের পিঠে হাত রাখলেন সত্যবান, মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে দ্য চ্যাপ হ্যাজ কাম আউট উইথ দা এনটায়ার স্টোরি। উইথ এভূরি বিট অফ ডিটেলস্। কোনও বেগ দেয়নি। একটুও টর্চার করতে হয়নি। গলাটা কাটলি কেন রে কৌশিক? সত্যবান স্নেহ ভরে জানতে চাইলেন, তার আগেই তো মরে গিয়েছিল।
কৌশিক কিছু বলল না।
ওরা ভেবেছিল, হয়ত পুরোটা মরেনি। সত্যবান আমাকে জানালেন, আগে খুন করেনি তো। আগে দ্যাখেনি। তাই, টু বি সিওর, কৌশিক সঞ্জয়কে গলাটা কেটে দিতে বলে। ওই আপনার কেনা ছুরিটা দিয়েই। খোলে কাঠি নেই দেখে বাক্সটা টুক করে লিটার ক্যানে ফেলে দিয়ে সত্যবান হেঁকে বললেন, দারওয়াজা, এক ম্যাচিস ল্যাও! গলা নামিয়ে, ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ে ছিল।
কৌশিকের পরনে জিন্স। গায়ে ব্যাগি জামা। চুলে ক্রু ছাঁট। সানগ্লাস টেবিলের ওপর পড়ে আছে। পাপপূণ্যের বাইরে কী শুদ্ধ, শান্ত, শূন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে এই মুক্ত বন্দী!
তুই কাকিমাকে খুন করলি কেন রে কৌশিক, দীপ্তির মৃতদেহ দেখেও যা হয়নি, কৌশিককে দু-চোখ ভরে দেখতে দেখতে আমার তাই হল। চোখ জলে ভরে এল। টপ করে একফোটা, আমার হাতের ওপর পড়ল যেন আকাশ থেকে, কেন রে।
সে জবাব দিল না।
ওই যে আপনার মেয়ে চৈতি। তার কাছেই কৌশিক প্রথম শোনে আপনারা কেদার বদ্রী যাচ্ছেন। চৈতি ওদের ভ্রমণ সাথী বইটাও পড়তে দেয়। তাতেই হেমকুণ্ড আর ব্রহ্মকমলের কথা ছিল। কৌশিক বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে। যে, ওরা যাবে। ব্রহ্মকমল আনবে। উইদাউট রিজার্ভেশন ওরা ফার্স্ট ক্লাসে উঠে পড়ে। ওদের সঙ্গে ছিল, আমার দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকিয়ে, এক লক্ষ টাকা। আপনার বুক র্যাকের পিছন থেকে ওরা হঠাৎই টাকাটা পেয়ে যায়। দা গ্রিনিং গোরিলা বইটা দেখতে গিয়ে রাকেশই প্যাকেটটা দ্যাখে। আলমারি টালমারি খুলতেই হয়নি। তবে ওরা হাজার দশের বেশি নেয়নি।
এই যে ব্ৰহ্মকমল, প্রথম ড্রয়ার খুলে উঁটিসুদ্ধ একটা প্রকাণ্ড পদ্মকুঁড়ি বের করলেন সত্যবান, ড্রয়ারে আপহোলস্টারের মধ্যে রিভলভার, বললেন, পাঁচ-ছদিন পরেও দেখুন কত ফ্রেশ রয়েছে। অ্যান অলমোস্টএক্সটিঙুট স্পিসিজ অ্যামংস্টদা ইন্ডিয়ান ফ্লোরা। টাটকা অবস্থায় একটা লাল আভা বেরোয় এর গা থেকে। যদিও দেখুন, কোনও গন্ধ নেই। বলে উনি নিজে এঁকে দেখলেন।
বরফের মধ্যে দিয়ে সাঁতরে কৌশিক এটা নিজে তুলে এনেছে।
আমি চুপ করে আছি দেখে সত্যবান বলে চললেন, এরা সবাই সাউথ স্টার আর বীরেন্দ্রপুরের ছেলে। শুধু রাকেশ কনভেন্ট স্কুলের। স্কুল ফাইনালে প্রত্যেকে হাই ফাস্ট ডিভিশনে পাস করেছিল। কৌশিক তো লেটারই পেয়েছিল চিারটে। আপনার মেয়ের বন্ধু। জানেন নিশ্চয়ই।
ম্যাচেস এসে গেছে। হুস-হুস করে বার তিনেক ধোঁয়া ছেড়ে সত্যবান বললেন, আপনি এর বাবাকেও চেনেন। কী নাম তোমার বাবার, কৌশিক।
কৌশিক উত্তর দিল না।
আর একবার বলবে না? ঠিক আছে। ঠিক আছে। এর বাবার নাম বন্ধুবিহারী মুখার্জি। আলিপুর বয়েজ-এর হেড মাস্টার। খবর দেওয়া হয়েছে।এসে পড়বেন। নাচিয়ে সত্যবান জানালেন, বাকি তিনটে লকআপে। এক-এক করে ডাকছি আর কী। সোমবার কোর্টে প্রোডিউস করব।
আমার সঙ্গে সুদীর্ঘ বারো দিনের সেমিনারে সত্যবান মণ্ডলের একদিনের বিষয় ছিল খুন। উনি সেদিন বলেছিলেন—
পৃথিবীর যে-কোনও খুনকে আমি জীবনবিরোধী বলে মনে করি। টু মার্ডার ইজ ইনহিউম্যান। অ্যান্ড স্টুপিড।
অথচ দেখুন, পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে কোথাও না কোথাও একটা করে খুন হয়ে যাচ্ছে। এটা পরিসংখ্যান। বছরে ৫ লক্ষ ২৫ হাজার ৬০০। কেন এত খুন! কারণ একটাই। আমি চুরি করব না, আমি বলাৎকার করব না, এগুলো বলা যায়। কিন্তু আমি পাগল হব না, আমি খুন করব না–এগুলো বলা যায় না। এ দুটো ব্যাপারে মানুষ বড় অসহায়, জানেন।
পৃথিবীর শতকরা ৯৮টা খুন হয় চূড়ান্ত উত্তেজনার মাথায়। যে কোনও আমি বাবা-ওসবে নেই মানুষই তো ওগুলো করে ফেলে? পাগল হয় সুস্থ মানুষেই, তাই নয় কি? ছেড়ে দিলে এরা কেউ আর-একবার খুন করবে না।
এগুলোকে আধুনিক অপরাধ-বিজ্ঞানে বলা হয় নিরপরাধীর অপরাধ।৩৪ উপধারা-সহ পঠিতব্য ৩০২ ধারায় এদের যারা ফঁসি দেয় সেই সব বেতনভূক বিচারককে আমি ফাঁসুড়ে ছাড়া কিছু মনে করি না। ইন্ডিয়ান পিনাল কোর্টের বকলস বাঁধা পুলিসের কুকুর-মরালিটিকে আমি ঘৃণা করি।
তাহলে তো, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, জুলিয়স সিজর—এরা সবাই খুনি।বা, রাসকলনিকভ! তাই নয় কি?
সেদিন মাত্র একবার ওঁকে বাধা দিয়ে আমি বাকিটু পার্সেন্টের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম।
হ্যাঁ। শূ-শূ করে সিগারেটে টান মেরে সত্যবান বলেছিলেন, বাস্তবের সেই টু পার্সেন্ট খুনি–যারা প্রিমেডিটেটেড মার্ডার করে। যেখানে মোটিভ থাকে। যেমন, খোকা গুন্ডা। তার প্রেমিকা রামবাগানের মলিনা ভালবাসত তার তবলচি রোগা, তিংখাডু পাগলাকে। থোকা পাগলাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে গেল। বলল, পাগলা, যা স্নান করে আয়। শীতকাল। তখন শেষ রাত। পাগলা জানতে চাইল, দাদা, তুমি কি আমাকে সত্যিই খুন করবে? খোকা বলল, পাগলা, যা, স্নান করে আয়।
ইউরোপের মর্ডান ক্লাসিকগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। জ্যাক দ্য রিপার, মনস্টার অফ ডুসেলডর্ফ, পিটার কার্টেন ব্লু বিয়ার্ড ল্যানডু পৃথিবীর সবচেয়ে অমানুষিক মার্ডার যেগুলো—এদেরও তো মানুষ হিসেবে একটা সহানুভূতি প্রাপ্য ছিল। যে, খুন না করে এরা পারেনি। পাগল না হয়ে পারেনি। পাগলের যদি বেঁচে থাকার অধিকার থাকে, খুনির থাকবে না কেন? আমার প্রতি চূড়ান্ত অবিচার করলে, হে ঈশ্বর, এই ধারণায় বিশ্বাস রেখেই কি এরা প্রত্যেকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়নি? এরা কি অভিসম্পাত দিয়ে যায়নি খুনিদের খুনি প্রতিটি বিচারপতিকে। বিশ্বাসঘাতক ঈশ্বরকে!
কিন্তু আমার ভাবনা এদের নিয়েও নয়। আমি ভাবি তাদের কথা, যারা এই টু পার্সেন্টের মধ্যেও আসে না। সত্যবান পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, আমি ভাবি, মারসোর মতো খুনিকে নিয়ে। আপনি তো আউটসাইডার পড়েছে, আমাকে বলেছিলেন? আচ্ছা বলুন তো, মারসো কেন খুন করল। কী অপরাধ ছিল আরব ছেলে দুটোর। সে তো তাদের চিনতই না। ডস্টয়েভস্কির খুনিদের তবু একটা সাফারিং ছিল। মারসোর তাও নেই। এর প্রেম নেই, দুঃখ নেই, জিজ্ঞাসা নেই—জিঘাংসা তো ছিলইনা। প্রতীতি নেই, কাজেই ভাল-মন্দ নেই। হৃদয়ের ঝড় আর বাইরের ঝড় মিলেমিশে তার মধ্যে কবেই একাকার হয়ে গিয়েছে। এই যদি তার অবস্থা হয়, তাহলে এখান থেকে তো এভরিথিং ইজ পারমিটেড। তাই নয় কি? কেননা, জীবনই তাকে জীবন থেকে বের করে দিয়েছে। আর, এজন্য সে দায়ী নয়! আরব ছেলে দুটোকে খুন করে, সে তো তার জীবনের ভেতরে থাকার সার্বভৌম অধিকারকেই প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছে তাই না বাবু? একে শাস্তি দেবে কোন আহাম্মক।
আমাদের একজন বিদ্বান সেক্রেটারি, আই এ এস পার্থসারথি চৌধুরি, বোধহয় ঠাট্টা করেই আমাকে বলেছিলেন, মারসো ওয়াজ সিম্পলি স্ট্রাক বাই দা ডেজার্ট সান। বোধহয় আমারই বোঝার ভুল। তার পার্সোনাল লাইব্রেরির ১৫০০০বই-এর মধ্যে বসে আমি তাকে সিরিয়াসলি বলেছিলাম, না, সার। রাসকোলনিকভ খুন করেছিল অন্ধকার ঘরে। সূর্য ছিল না।
কৌশিক তুই আমাকে বললি না কেন রে! আমি তোকে নিয়ে যেতাম।
কৌশিকের মুখময় একটা হাসির আভা জেগে উঠে কোথাও মিলিয়ে গেল, আমি দেখতে পেলাম। যদিও জন্মমুহূর্তেই তার মৃত্যু।
সে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
আচ্ছা, একে এবার ছেড়ে দিই? সত্যবান অনুমতি চাইলেন। হাত নেড়ে ইঙ্গিত করলেন ধুতি-শার্ট পরা দুজন পালোয়ানকে। নিয়ে যাও।
গম্ভীর ইরেক্ট ভঙ্গিতে কৌশিক উঠে দাঁড়াল। একবার স্ট্রেচ করে নিল শরীরটা। তারপর ওদের সঙ্গে মার্চ করে কিছুটা গেল। তারপর ঘুরে দাঁড়াল।
সঙ্গে সঙ্গে, হাতলে দুই থাবায় ভর রেখে, সত্যবান চেয়ার থেকে ঊধ্বাঙ্গ কিছুটা তুলে, স্থির।
চশমাটা। কৌশিক বলল।
ভঙ্গিটা দেখুন।ওর চলে যাবার দিকে তাকিয়ে সত্যবান বললেন, যেন কোনও অন্যায়ই করেনি। চারটে ছেলে। অ্যাটিচিউড কিন্তু একটা। যে, উই হ্যাভ মেড ইট। আমরা পারি। এবং পেরেছি। আমরা ব্ৰহ্মকমল এনেছি। কী আর বলব। মাথা নেড়ে কিছুটা হতাশভাবে, কিছু বা দুঃখিত, বললেন, সচ্ছল, শিক্ষিত পরিবারের কৃতী ছাত্র সব। খুন করলেও এরা ভাবে, তা ঠিক আর পাঁচটা খুনের মত নয়। কিছুটা রেসপেক্টেবল!
ওরা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুইং ডোরের দুলুনি থেমে আসে। টেবিলের ওপর আমার অশৃঙ্খলিত হাতদুটি রেখে, সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম–
দেখুন, সত্যবানবাবু–
বলুন।
দেখুন, মানে আমি … যাক গে, থাক।
না-না। বলুন না। একটা লিমকা খান। দারওয়াজা, এক লিমকা ল্যাও। নিন, বলুন–
দেখুন, সত্যবাবু। দীপ্তিকে তো আমিও খুন করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু পারেননি।
না। কেদারে হোক, বদ্রীতে হোক, এবার আমি দীপ্তিকে খুন করতাম।আমি ধীরে ধীরে বলি, দীপ্তি ফিরে আসত না।
ওগো তোমরা কে কে চা খাবে, উঠে পড়। কারণ, এরপর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবে না…
হ্যাঁ। এটা, ইন বিটুয়িন লাইনস, আপনার ডায়েরিতে আমি লক্ষ্য করেছি। আইভি সোম আসার পর থেকেই কমবেশি এই লাইনে আপনি ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু, সত্যবান হাসতে লাগলেন, করেননি। বা, করতে পারেননি। বা, দেরি করে ফেলেছেন। তার আগেই যে করার, সে কাজ করে দিয়ে গেছে। প্রেমিক বলুন, বিশ্বাসঘাতক বলুন, খুনি বলুন–সকলকেই ইন লাইফ, ওয়ান হ্যাজ টু অ্যাক্ট। তাই না — বাবু?
বহুদিন আমি আইভিকে ফ্ল্যাটে এনেছি, যখন ওরা নেই। দীপ্তির নিজের হাতে পেতে যাওয়া বিছানা ইউজ করেছি।
আমি সব জানি। শি হ্যাজ কনফেসড এভরিথিং। টানা দশটি বছর ধরে আপনি মিস সোমের সঙ্গে অ্যাফেয়ার চালিয়ে গেলেন, অথচ, স্ত্রী তা টেরও পেলেননা এত বিশ্বাস করতেন আপনাকে…
যে এটা পারে, এতটা ক্ললেস রাখতে পারে গোটা ব্যাপারটা–আই এগ্রি, হি ইজ আ পোটেনশিয়াল মার্ডারার। হি ইজ ওয়ান, ইনডিড। হি কুড হ্যাভ, অলমোস্ট সার্টেনলি, মেড আ ক্ললেস পারফেক্ট মার্ডার।
তাহলে আমাদের লাইন অফ ডিফারেন্সটা কোথায়? প্রায় তো নেই-ই। আমি কেন শাস্তি পাব না?
নেই মানে? সত্যবান হাসতে হাসতে বললেন, হেল অ্যান্ড হেভেন ডিফারেন্স। বললাম তো। আপনি ভেবেছিলেন, কিন্তু, করেননি। বা, পারেননি। আরে মশায়, আপনার মতো লোকরা, আগেই তো বলেছি আপনাকে, শুধু ভাবে। শুধু ভেবে যায়। কিছু করে না। ইউ পিপল সিম্পলি রিড নিউজপেপার্স অ্যান্ড ফরনিকেট। অ্যান্ড টক। অ্যান্ড দ্যাট ইজ অ্যাবাউট অল। আপনারা কিছু করেন না। …অথচ, এদের দেখুন। এরা খুন করল। বসে বসে এক প্যাকেট ফান মাঞ্চ খেল। চতুর্দিকে ক্লু ছড়াতে ছড়াতে এরা কেদার আর বদ্রীনাথের দিকে গেল। হেমকুণ্ডসাহেব থেকে ব্রহ্মকমল আনল। এটাও তো একটা আদর্শ হতে পারে, দিগন্ত পেরিয়ে একটু বেশি দূরে যাওয়ার এই ইচ্ছা। অন্তত, এখনও যাদের গোঁফ ওঠেনি ভাল করে, সেই কিশোরদের কাছে? একটা স্বপ্ন হতে পারে। একটা মূল্যবোধ হতে পারে। আর আদর্শ যোগ হলেই তো সে শহিদ, তাই না –- বাবু?
এদের কীরকম শাস্তি হবে? বেনাবনে মুক্ত ছড়াবার হতাশা ফুটে উঠল সত্যবানের মুখে। সাত কাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতা কার বাবা? বিরক্তমুখে বললেন, ওরা জুভেনাইল কোর্টে প্রোডিউসড হবে। এই তিন, চার কি পাঁচ বছর করে, আর কত। গলা কেটেছেসঞ্জয়। কিন্তু কৌশিকের হাতে সাফোকেশানে মিসেস বসুরায়ের আগেই মৃত্যু হয়। ওর একটু বেশি হতে পারে। মেরে কেটে ছয় ম্যাক্সিমাম? কারেকশান হোমে খুব একটা খারাপ থাকবে না।
কারেকশান হোম! মাত্র ছবছর!আমি আর্তনাদ করে উঠি, কী বলছেন আপনি? এদের ফাঁসি হবে না?
অপ্রত্যাশিত। তবু অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। অন্তত আমার কাছে। ওঁর গল-অস্থির ওঠা-নামা দেখতে দেখতে এর আগে আমি তিনবার চেষ্টা করেছি। পারিনি।
হঠাৎ, সত্যবানের টেবিলের ওপর আমি জ্বলন্ত চিতার লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ি। খোলা ড্রয়ারে ব্ৰহ্মকমলের পাশে রাখা রিভলভারটা তুলে নিতে চেষ্টা করি।
বজ্রমুঠিতে আমার হাত চেপে ধরে আছেন সত্যবান। আমি হাত খুলে নেবার চেষ্টা ছাড়ি না। ক্রমে বুঝতে পারি, আমার সর্বশক্তির চেয়ে উনি কিছু বেশি শক্তিমান। তাছাড়া, ধুতি শার্ট পরা অনেকগুলো লোক আমাদের ঘিরে ধরেছে।
সত্যবান হাত ছেড়ে দেবার পরেও আমি চিৎকার করতে থাকি, ছেড়ে দিন। আমাকে ছেড়ে দিন। দীপ্তির মতো ইনোসেন্টকে যারা খুন করল, যারা এ-ভাবে সর্বনাশ করল আমার, চৈতি মাতৃহারা হল, তাদের কারও ফাঁসি হবে না? মাত্র ছবছর? ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমি টেবিলে মাথা ঠুকতে থাকি, গেট মি দ্য রিভলভার, প্লিজ। প্লিজ, ডু মি দিস ওয়ান অ্যাক্ট অফ ফেবার। আই শ্যাল শ্যুট দেম। শ্যুট ইচ ওয়ান অফ দেম। শ্যুট ওয়ান বাই ওয়ান।
টেবিলে মুণ্ডু রেখে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম আমি জানি না। খেয়াল হল তখন, যখন পিঠে হাত রেখে নৃপেন আমাকে বলছে, যে গেছে, তাকে যেতে দাও -–। যারা আছে তারা থাকুক।
. অনেকক্ষণ পরে আমি আবার বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেলাম। সেই ৯০ কিলোমিটার বেগে সাইক্লোন, আমার অজান্তে, কলকাতার ওপর দিয়ে কখন বহে গেছে। এখন হাওয়া নেই। এখন শুধু অনর্গল বৃষ্টি। আকাশের স্টপকল খুলে গেছে।
***
———–
উল্লেখ থাকে যে এই রচনায় অধ্যায়ক্রমে কাজী নজরুল ইসলাম, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, আলোক সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত ও শেষ অধ্যায়ে শঙ্খ ঘোষের কাব্যপঙক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
উপন্যাস মানেই যা কল্পনাপ্রসূত। তবু যদি কোনও পাঠক এই কাহিনী ও/বা এর কোনও চরিত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান, তা হবে, তার নিজস্ব বিনির্মাণ। কৃতিত্বও একান্তভাবে তারই। –লেখক