- বইয়ের নামঃ অস্তিত্ব, অতিথি তুমি
- লেখকের নামঃ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বীতে হুয়ে দিন
বহু, বাবুজি, চুনারের টাঙ্গাওয়ালা লাম্পু আমাকে বলেছিল, সব কুছ দেতা হ্যায়। জান ভি দে সকতা। লেকিন কান্ধা নেহি দেতা।
নভেম্বর, ১৯৭০। বিয়ের পর, কাশী থেকে একদিনের ট্যুরে আমরা গিয়েছিলাম চুনার ফোর্ট দেখতে। একটা গোটা পাহাড় জুড়ে লম্বায়-চওড়ায় সে এক এলাহি ব্যাপার। মৌলিক এবং অনন্য।
এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুর্গ-ঘরানা।
সব দুর্গেই যেমন, চুনারেরও প্রবেশদ্বার একটি মাত্র। এরও চারিদিকে পরিখা ও প্রাচীর অন্তত, যেতে যেতে, প্রায় শেষ পর্যন্ত এমনটাই ধারণা হয়, যে তাই। এরও তো সর্বত্র ছড়িয়ে সেই ভাঙা গম্বুজ, পড়ে-থাকা খিলান, ও জাফরিহারা গবাক্ষ। প্রহরীবিহীন,অনর্গল বন্দিশালা। এ আর নতুন কী। কিন্তু, একেবারে শীর্ষে উঠে এ ভুল ভাঙে। দেখা যায়, চার নয়, এর মাত্র তিনদিক জুড়ে ছিল প্রাচীর ও পরিখা; এবং দক্ষিণে, যেদিকে হাজার হাজার ফিট নিচে পড়ে আছে, শীতের পাতলা রোদে, ভূপাতিত গঙ্গার মাইল-মাইল জলছবি, সেই একটা দিক অবারিতভাবে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত!এ অবাক উন্মােচনের মুখোমুখি হয়ে সহসা, স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অপরিসর, কোথাও একজনের মতো পথ ও সিঁড়ি ধরে উঠে এসে আগাগোড়া গুমোটের পর এই হু-হু হঠাৎ হাওয়া–শুধু এইখানে শুধু এই দুর্গচূড়াটিকে ঘিরে!
দুটি ভাঙাচোরা আটপৌরে কবর শুধু। এখানে।
বস্তুত, এমন দুর্গও আমার এখনও দেখতে বাকি, যার ক্রমোচ্চ রাজপথ, দুই পাশে রেখে শত শত হৰ্ম, খিলান ও গম্বুজের ধ্বংস; এভাবে, ক্রমাগত, না থেমে, শুধু উঠেই গেছে এবং দুর্গের শীর্ষবিন্দুতে উঠে পেয়েছে পরিণতি, যেখানে পাশাপাশি শুয়ে আছে দুটি জরাজীর্ণ কবর, যাদের কেন্দ্র থেকেই হয়ত, যা আগে বলেছি, সেখানে হঠাৎ এমন অবোধ হওয়া। চাপা গুমোট-গরম ঠেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রমাগত ওপরে উঠে, নিচের পাতাল-গঙ্গা থেকে চোখ তু®, ঊর্ধ্বে স্বর্গ-নীলিমার দিকে প্রথমবার তাকালে যখন পায়ের কাছে দু-দুটি কবর–এরকম মনে হতেই পারে এবং আমারও হয়েছিল, যে, অতীতে ওই অন্তরীক্ষের সঙ্গে এই দুর্গ-স্থাপত্য নিশ্চিত একটা সুসম্পর্ক পাতাতে চেয়েছিল (নইলে আর চড়চড় করে ওভাবে উঠে এসেছিল কেন আকাশের দিকে), এমনকি পাতিয়েও ছিল–যে সম্পর্ক শের শাহরও ঢের পূর্বে, সেই প্রাক-মধ্যযুগ থেকে, যত ভেঙেচুরেই যাক, আজও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। অবশ্য, শুধুই মনে হওয়াহয়ির ব্যাপার এ যে; তাও নয়। পৃথিবীর সমস্ত রকম আবহাওয়া-প্রহৃত ভাস্কর্য বা স্থাপত্যের সঙ্গে মহাজগৎ তথা ব্রহ্মাণ্ড-চেতনার একটা পরোক্ষ সম্পর্কের কথা কখনই অস্বীকার করা হয়নি। এ-তত্ত্ব চুনারের ক্ষেত্রেই বা প্রযোজ্য হবে না। কেন?
ফোর্ট দেখা শেষ হতে সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঘোরাঘুরি আমিই করলাম বেশি, সঙ্গে লালু। দীপ্তি ওপরে কবরের পাশে বসে রইল। একবার ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে দেখি, কবরে মাথা রেখে বেচারা ঘুমিয়েই পড়েছে।
হাতে তখনও ঘণ্টা-দুই সময়। ফেরার ট্রেন সাড়ে সাতটায়। স্টেশনের পথে লালু বলল, জিন্দা পিরকা দরগা দেখিয়ে গা বাবুজি?
জিন্দা পির?
হ্যাঁ, বাবুজি। জিন্দা!
বলতে বলতে একটা ন্যাড়া ছোট পাহাড়ের ধারে সে টঃ-টঃ-টঃ-টঃ শব্দে টাঙ্গার অশ্বক্ষুরধ্বনি থামায়। পিরের কবর দেখতে হলে পাহাড়ে উঠতে হবে, সে আমাদের জানাল।
একবেলায় চুনারের যেটুকু দেখা বা বোঝা গেছে, তাতে একটা বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি। যে, গ্রামে নিঃসন্দেহে আলাদা করে কোনও গোরস্থান নেই। যে জন্যে, গোটা গ্রামটাই এভাবে, দিনে দিনে, একটা কবরখানার চেহারা নিয়েছে। দুর্গের মধ্যে তো বটেই, ফোর্টে ঢোকার আগে, পাহাড়ি পাকদণ্ডীর ধারে ধারে দুদিকে সারবন্দী কবর, পাহাড় ধরে গঙ্গার তীর পর্যন্ত নেমে গেছে। ফোর্টের বাইরে গ্রাম জুড়ে বাড়ির সামনে ও খিড়কিতে কবর। খেতের মধ্যে ও ধারে ধারে, গাছতলায়, কুয়োর ধারে–গ্রাম ছাড়িয়ে পথের পাশে–এখানে কবর নেই কোথায় যে। নুড়ির মত যত্রতত্র ছড়িয়ে।
বিয়ের প্রথম বছরটা দীপ্তি বোধহয় আমাকে অবজার্ভেশনে রেখেছিল। পিরের কবর দেখতে আমি আর লালু পাহাড়ে উঠলাম, সে বিশেষ আপত্তি করল না। না না, যাও না তুমি, দেখে এস, বলে অদূর অতীতের সেই রণ-ধর্ষিত প্রান্তরে, টাঙ্গার ওপর, একা বসে রইল। জোত খুলে লালু ঘোড়ার মুখে ঝুলিয়ে দিল জাবনার লম্বাটে থলে।
জিন্দা পিরের নাম পির সুলেমান। পিরের কবর একেবারে সেই পাহাড়ের টঙে।
টিলার ওপর সাঁই-সাঁই হাওয়া। পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে পৃথিবীর একমাত্র নতজানু পর্বতমালা: বিন্ধ্য। সূর্য এদিকেই অস্ত যাবে। দক্ষিণে, নদীর বিশাল বাঁক দিয়ে পেঁচানো দুর্গের গম্বুজগুলো… ঐতিহাসিক স্থানগুলি, এরকম অস্তরাগের আলোয়, দূর থেকে দেখতেই ভাল লাগে। বিমূর্ত দেখায়।
নিচে পথের ধারে বাচ্চাদের খেলনা-গাড়ির মতো লাল্লুর টাঙ্গা, পাশে এখন কুকুর-ছানা সাইজের ঘোড়াটা। ইতিহাস বইয়ের পাতায় একটা সাদাকালো ছবি যেন।
ভাবতে বেশ মজা লাগে যে ওই ছোট্ট খেলনা-গাড়ির মধ্যে দীপ্তি এখন একা বসে আছে। অলীক মনে হয় এখান থেকে। অবিশ্বাস্য! ওইটুকু গাড়ির মধ্যে? কিন্তু, সত্যিই তো তাই। দীপ্তি এখন ওই খেলনা-গাড়ির সঙ্গে মানানসইভাবে এই এতটুকু হয়ে ওরই মধ্যে বসে, যদিও, তার প্রমাণ সাইজের অস্তিত্ব-সহ।