তারই একটিতে চোখ রেখে আমি একটু চেঁচিয়ে বললাম, ৭টা ২৫ এখন।
–শ্-শ্-শ্স। আস্তে, বাবা। আই অ্যাভ টোল্ড ইউ দ্যাট অলরেডি। নন্দিন আবার দরজা একটু ফাঁক করে বলল, এখানে কেউ চেঁচিয়ে কথা বলে না বাবা।
আমরা পৌঁছেছি কাল রাত নটা নাগাদ। তাড়াতাড়ি একটু কিছু খাইয়ে দিয়ে, বাড়িটাও ভাল করে না দেখিয়ে, দুজনকে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে, কাল অধিক রাত পর্যন্ত নন্দিন আমাদের দুজনকে আমেরিকান সহবত সম্বন্ধে অনেক তালিম দিয়েছে, যে-সব উপদেশের অধিকাংশের শুরু এখানে কেউ দিয়ে। যেমন,
এখানে ভদ্রলোকরা কেউ সিগারেট খায় না। বিশেষ করে পুরুষরা কেউ খেলে এরা গার্ডেনারফার্ডেনার ভাবে। বুঝলে বাবা? বিশেষ করে ব্ল্যাকরা খেলে। তোমরা পিছনে সুইমিং পুলে গিয়ে খেয়ে আসবে।
এখানে কেউ সবার সামনে হাঁচে না। খুব অভদ্রতা। আর অন্য কেউ যদি হেঁচে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে বলবে গড় ব্লেস ইউ। বুঝলে বাবা?
তারপর ধরো, কেউ ছোটকাকা-কাকিমার ব্যাপারে সমবেদনা জানাল তোমাকে, সঙ্গে সঙ্গে বলবে আই অ্যাপ্রিসিয়েট, বুঝলে বাবা?,থ্যাঙ্ক ইউ বোল না, গ্রেটফুল এখানে কেউ বলে না, কাউকে প্রাণে বাঁচালেও। চাকর ভাববে। বুঝলে বাবা?
আর খবর্দার, ফোনে বা সাক্ষাতে কাউকে মিঃ বা মিসেস বলবে না। বলবে, হাই জনি। বা, হাই কিটি। যার যা নাম। বুঝলে বাবা? তা সে যত বুড়ো-বুড়ি বা ছোঁড়াছুঁড়িই হোক।
কাল রবিবার। কাল সকাল থেকেই অনেক মোনার আসবে। তাদের সঙ্গে ঠিকমত কথা বলবে, নইলে, কী ইম্প্রেশন হবে তাদের ছোটকাকার ফ্যামিলি সম্বন্ধে, বল তো?
এতগুলো ব্যাপার একসঙ্গে পয়লা রাতে না বুঝতে পারলেও একটা ব্যাপার বুঝতে অসুবিধে হয় ন! ৷ এক বছর বলার চান্স পায়নি। চুটিয়ে বাবা বলে নিচ্ছে নন্দিন। কারণে, অকারণে।
লেদুনন্দিনের থেকে বছর ছয়েকের বড়। কিন্তু নন্দিনের সঙ্গে ওর ব্যবহার সমবয়সীর। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়েছে। বাবার ব্যবসা কন্ট্রাক্টরি করে। লেদু বলল, থাম তো তুই। আর শেখাতে হবে না। এখন এক গ্লাস জল দে দেখি।
ঘরের মধ্যে ওর প্রায় দ্বিগুণ উঁচু একটা ফ্রিজ খুলল নন্দিন। ফুট জুস আর কোল্ড ড্রিঙ্কে ঠাসা। পেপসি কোলার একটা জ্যারিকেন বের করে সে টেবিলের ওপর এনে রাখে। এক গ্লাস গড়িয়ে লেদুর সামনে রেখে গম্ভীরভাবে বলে, এখানে কেউ জল খায় না। মিনারেল ওয়াটার খায়। জল চাইলে, গাঁইয়া ভাববে। ভূত ভাববে। সে দাদার টাকে একটা আদুরে চাঁটি মেরে বলে, বুঝলে লেদধুস!
তাই নাকি! জল খায় না, শুধু পেপসি আর সেভেন আপ? চোখ বড় বড় করে লেদু ওর দিকে সপ্রশংস চোখে তাকিয়ে। আমি বুঝতে পেরেছি, আসলে লেদু এসেছে আমেরিকায় তার স্বপ্নের দেশে। তাদের বড়লোকী দেখতে। প্লেনে ওঠার পর থেকেই তার হাবভাব বদলাতে শুরু করেছে। প্লেনে চিজ-মাখন-প্যাস্ট্রি যখন যা দিয়েছে ছোটখাটো প্যাকেজে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছে আর উচ্ছ্বসিতভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে গেছে, দ্যাখো, দ্যাখো খাঁটি ডেনিস প্যাস্ট্রিজেনিভার মাখন—একটু টেস্ট করে দ্যাখোনকাকা! হুইস্কির ছোট্ট উপহার-বোতলগুলো চেয়ে নিয়েছে। বারবার। প্লেন যত এগিয়েছে, তত তার উত্তেজনা বেড়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ায়, সে যখন গীত গাতা চল দেখার জন্য সামনের দিকে ভাল সিটে উঠে গেল, তখনও কিছু বলিনি আমি। ভেবেছিলাম, আহা, বয়স কম, প্রথম জেট প্লেন, প্রথম আমেরিকা—এমনটা তো হবেই কিছুটা। তবু, টোকিও থেকে জাপান এয়ারলাইন্সে উঠে সে যখন ডিনারের পর সিটে লাগানোইয়ারফোনে ছয়-চ্যানেলের গান শুনবে বলে আড়াই ডলার পে করতে যাচ্ছে, তখন তাকে মনে না করিয়ে দিয়ে পারিনি, শুনবে শুনুক, কিন্তু সে যেন ভুলে না যায় যে সে বা তারা কী জন্যে, কী উপলক্ষে কোথায় যাচ্ছে। তখনকার মতো গান শুনল না বটে লেদু, কিন্তু লাঞ্চের পর বেভার্লি হিল কপ-টু দেখবে বলে সামনের ব্লকে সোজা চলে গেল। আমাকে না বলে। কপ-ওয়ান তার কলকাতায় দেখা। সেই টোকিও এয়ারপোর্টে যা এককাপ কফি আড়াই ডলার দাম দিয়ে, তারপর বা আগে আমি একদিন দুরাত্রি জল ছাড়া কিছু খাইনি। খেতে পারিনি। পাশে বসে কেউ যদি খচর-কচর করে চিবিয়ে যায়, একটু অশ্লীল বা জান্তব আমার লাগারই কথা। প্লেনে লেদু আগাগোড়া তাই করে গেছে। কপ-টু দেখতে দেখতে সোৎসাহে উঠে এসে লেদু যখন বলল, নকাকা, ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন ক্রশ করছে। ঘড়ি মেলাও, ঘড়ি মেলাও… শোক অথবা ঘুমের আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠে, জল ছেড়ে অনেক দূর ডাঙার ভিতরে চলে আসা শামুকের মতো খোল থেকে বিষাদমাখা মুণ্ডু বের করে আমি তাকে না বলে পারিনি, লেদু, তুই কি শোকের টিকিট কেটে ডগমগপুরে যাচ্ছিস..
সত্যি কে বলবে এই সেই লেদু, কঘণ্টা আগেও যে ওভাবে হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিল! লেদু বলল, আরে, শোক-ফোকের ব্যাপার নয়। এটা ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন! একটা দিন হারিয়ে যাচ্ছে তোমার সারা জীবন থেকে… বলে সে অপ্রস্তুতভাবে কেন এমন হয় তা বোঝাতে বোঝাতে সিকোর মস্ত ঘড়ি দেখে নিজেরটার কাঁটা ঘোরাতে লাগল। এক্কেবারে ভুল। ডেটলাইন ব্যাপারে হাস্যকর তার ধারণা। এ বিষয়ে কিছু জানা না থাকলেও আমি বুঝতে পারলাম। যেমন বুঝতে পারলাম, সার্ভেন্টিসের মূল বইটি পড়া না থাকলেও, বিবেকবান দ্বিধাগ্রস্ত ডন কুইকজোটের সঙ্গে আসলে চলছে মাঠো, নির্বোধ অথচ প্র্যাগম্যাটিক এক সাঙ্কো পাঞ্জা। পারলে, একটা চড় কষাতাম তখন লেদুর গালে।