দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তোমার কৃষ্ণর চরিত্র তা হলে পালটাল কেন?
কে বলেছে পালটাল? তোরা তাকে বুঝতেই পারলি না বলে ওসব কথা বলিস। মন্ত্রী হয়েছিল বলে ওরই যেন সব দোষ। আমি তো বলি বাপু, কৃষ্ণর যা পাওনা ছিল তা দেশ ওকে দেয়নি। তোরা সেদিনের ছোড়া ওসব বুঝবি না। যা, গিয়ে মানুষটার পায়ের ওপর পড়ে থাক।
বলছ?
বলছি কি সাধে? বলাচ্ছিস বলে বলছি। ওর সম্পর্কে কেউ আকথা কুকথা বললে তার জন্যই আমার দুঃখ হয়। আহা বেচারা তো জানে না।
শোনো ঠাকুমা, আমি কৃষ্ণকান্তর মুখে কালি মাখাতে চাই না।
সত্যিই চাই না।
তবে কী চাস? ঠিক তোমরা যে চোখে লোকটাকে দেখে সেই চোখেই দেখতে চাই। কিছুতেই সেটা পারছি। আমারও ইচ্ছে হয় লোকটাকে শ্রদ্ধা করতে, ভালবাসতে পারি না। কেন পারি না বলল তো!
সেটা তুই বোঝ গিয়ে। আমাকে জ্বালাস না।
তোমার নাতবউ রেমিও অসম্ভব ভালবাসে শ্বশুরকে। নিজের বাপের চেয়েও বেশি। আমি অনেক বলেও টলাতে পারিনি।
তবেই বুঝে দেখ কৃষ্ণ কেমন মানুষ।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, তুমি বা রেমি বা আর-সবাই লোকটার কেবল একটি দিক দেখতে পাও, দিকটা আলোকিত। কিন্তু ওঁর একটা অন্ধকার দিকও তো আছে। তোমরা সেটা দেখতে পাও না
কেন?
কৃষ্ণর নামটাই কৃষ্ণ। তাছাড়া ওর মধ্যে আর কোনও অন্ধকার নেই। চিরকাল লোকে ওকে ঠকিয়েছে, ন্যায্য পাওনা দেয়নি, কলঙ্ক রটিয়েছে। কৃষ্ণ নির্বিকার। ভোগসুখ বলে ওর জীবনে কিছু নেই। কাশীতে গিয়ে আমার কাছে যখন ছিল তখন ভালমন্দ বেঁধে খাওয়াতে গেলে খুব বকত। বলত, দেশের লোক যতদিন…
আঃ ঠাকুমা, তোমার ঝাঁপ খুললে বন্ধ করা বড় মুশকিল।
তা হলে খোলাস কেন? বোস, চা করে আনি। মুখখানা তো শুকিয়ে আমের আঁটি হয়েছে দেখছি।
চা দাও।
আর কী খাবি?
যা দেবে।
রঙ্গময়ি কষ্টে উঠলেন। চা আর জলখাবার নিয়ে এসে ফের বসে বললেন, কী যে তোর হয় মাঝে মাঝে বুঝি না। বাপ যার অমন পিতৃভক্ত তার ছেলের এ দশা কেন হয়?
ধ্রুব আস্তে আস্তে আনমনে খাচ্ছিল। জবাব দিল না। খাওয়া শেষ করে বলল, একটা কথা, ঠাকুমা।
বল না।
অনেক ভেবেচিন্তে মনে হচ্ছে, আমারই কোথাও একটা ভুল হয়ে থাকবে, দোষ কৃষ্ণকান্তর নয়, আমার।
তোদের কারওরই দোষ নয়, দাদু। মনটাকে পরিষ্কার কর, বুঝতে পারবি। কৃষ্ণ কখনও দশজনেরটা মেরে নিজের ঘর গোছায়নি। বরং নিজেরটা দিয়ে দশজনকে খুশি করতে চেয়েছে। আমার তো মনে হয় কৃষ্ণর আর-একটু স্বার্থপর হওয়া উচিত ছিল। তাতে ভাল হত।
ধ্রুব বসে রইল চুপ করে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ঠাকুমা, নোটন এ বাড়িতে আসে?
নোটন! কেন বল তো!
বলোই না।
রঙ্গময়ির মুখে ভ্রুকুটি দেখা দিল। মাথা নেড়ে বললেন, নোটনের অত সাহস নেই।
তুমি কি তাকে ঘেন্না করো?
ঘেন্নার কাজ করে বেড়ালে তো ঘেন্না করাই উচিত।
তুমি কি জানো নোটনের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব উঠেছিল বলে—
রঙ্গময়ি ধমক দিয়ে বললেন, সব জানি। পাপ।
তার মানে?
নোটনের সঙ্গে তোর বিয়ে হয় নাকি? আত্মীয়তায় আটকায় না?
লতায়-পাতায় আত্মীয়। সেকথা বলছি না। বলছিলাম বিয়ের প্রস্তাব উঠেছিল বলে তার দাদাকে কৃষ্ণকান্ত কী করেছিলেন জানো? লোকটার আজও কোনও খোঁজ নেই।
বললাম তো, সব জানি। কৃষ্ণ নিজে এসে জানিয়ে গেছে। ঠিক করেছে।
দোষটা কী বলল তো!
বিয়ের প্রস্তাব তোলাই দোষের।
নোটন যে জীবন যাপন করে তার জন্য কি সে দায়ি? না দায়ি কৃষ্ণকান্ত?
রঙ্গময়ি বার্ধক্যের তেজহীন দুই চক্ষু যথাসম্ভব তীক্ষ করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বললেন, নোটনকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। সে তার কর্মফল ঠিক ভোগ করবে।
ধ্রুব ধীরে ধীরে উঠল। তারপর বলল, তুমি নোটনকে যত ঘেন্না করো কৃষ্ণকান্ত ততটা করেন না। তিনি নোটনকে…
ধ্রুব মাঝপথে থামতেই রঙ্গময়ী ব্যঙ্গের স্বরে বললেন, তিনি নোটনকে…বল, বল না, থামলি কেন?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে বলা যাবে না। কিন্তু শুনে রাখো, তিনি নোটনকে আমার পিছনেও লেলিয়ে দিয়েছেন।
রঙ্গময়ী অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, তাই যদি হয় তবে জেনে রাখ, ওর মধ্যেও কিছু মঙ্গল আছে।
নোটন না তোমার নাতনি? আত্মীয়?
বটেই তো। এমন আত্মীয় যে পরিচয় দিতে ঘেন্না হয়। এখন বল তো ঘটনাটা কী? নোটন তোকে পেল কোথায়?
আর-একদিন ঠাকুমা। আজ চলি।
বললে বলিস না। কিন্তু নোটনের মুখ থেকে কথা আমি টেনে বার করবই।
ধ্রুব ম্লান হেসে বলে, তোমাদের নিয়ে পারা যাবে না ঠাকুমা, কিছুতেই পারা যাবে না। যতদিন যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে দিস ওয়ার্ল্ড বিলংস টু কৃষ্ণকান্ত, ওনলি কৃষ্ণকান্ত। আমরা তোমাদের কাছে ফাউ, ফালতু। আজ চলি ঠাকুমা, আবার আসব।
ধ্রুব বাড়ি ফিরল একটু গাঢ় রাতে। ঘড়িতে বোধহয় দশটা। ফটকের ধারেই দাঁড়িয়ে ছিল জগা। নিঃশব্দ শ্বাপদের মতো। বলল, এই ফিরলে?
ফিরলাম। কিছু বলবে, জগাদা?
একটু ওপরে যাও। কর্তাবাবু তোমার জন্য বসে আছেন।
হঠাৎ কী ব্যাপার?
কী করে বলব? আমরা চাকরবাকর মানুষ।
চাকর বলে চিনতে পারছ নিজেকে এতদিনে?
বরাবরই চিনি।
চিনলে অনেকদিন আগেই নিজের ভিতরের চাকরটাকে নিকেশ করে কৃষ্ণকান্তর তাঁবেদারি ছেড়ে চলে যেতে। তুমি যে চাকর, তোমাকে যে চাকর করে রাখা হয়েছে সেটা বুঝতেই পারোনি।
বুঝলাম। এখন ওপরে যাও। কর্তাবাবু তোমার জন্যই বসে আছেন। সকালেব প্লেনে দিল্লি যাবেন। তাড়াতাড়ি ঘুমোনো দরকার। যাও।
ধ্রুব ধীর পায়ে ওপরে উঠে কৃষ্ণকান্তর অফিসঘরে উঁকি দিল। কৃষ্ণকান্ত একখানা বই পড়ছিলেন। চোখ তুলে তাকালেন।