- বইয়ের নামঃ সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. অহংটা এখনও বেশ আছে
অহং। অহংটা এখনও বেশ আছে। বয়সে একটু স্তিমিত হয়ে এসেছে ঠিকই। সবসময়ে আগের মতো ফণা তুলে দাঁড়ায় না। সংসারের নানা প্রকাশ্য ও চোরা মারে বারবার আহত হয়েছে বটে, কিন্তু এখনও আছে। কে জানে হয়তো অহংকারটুকুই আছে, আর তার কিছু নেই। তার বউ শিখা বলে, এত আমি-আমি করো বলেই আর কারও দিকে তাকিয়ে দেখলে না কখনও। অত অহংকার বলেই ছেলেটা পর হয়ে গেল, জামাই আসা-যাওয়া বন্ধ করল। এখন অহং ধুয়ে জল খাও। এই শিখার সঙ্গে একটা জীবন বনিবনা হল না তার। অন্তত দু’বার তাদের সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ভেঙে যাওয়ার মুখে এসেছিল। টিকে আছে বটে। সম্পর্কটা, তবে ওপর ওপর। ভিতরে কোনও টান নেই, সমবেদনা নেই। দুটো মানুষ এক ছাদের তলায় বাস করেন মাত্র।
আজ ওই অহংবোধই তাকে প্ররোচনা দিয়েছিল হঠকারিতার। সন্ধেবেলা রুটিনমতোই সান্ধ্যভ্রমণ সেরে ফিরে দেখলেন, লিফটটা খোলা। দু’জন মিস্ত্রি গোছের লোক খুটখাট করে কিছু সারাচ্ছেটারাচ্ছে।
বাসুদেব জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে হে?
লিফটের ভিতর থেকে মিস্ত্রিদের একজন বলল, সার্ভিসিং হচ্ছে।
কতক্ষণ লাগবে?
দু-তিন ঘণ্টা। আজ নাও হতে পারে।
বাসুদেব চিন্তিত হলেন। তার ফ্ল্যাট আটতলায়। হার্ট ভাল নয়। উচিত হবে কি সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। এমন অবস্থায় ইচ্ছে করলে তিনি গরচায় মণিময়ের বাড়ি চলে যেতে পারেন। মণিময় অনেক দিনের বন্ধু। কিন্তু শিখাকে জানানো দরকার। কীভাবে জানাবেন? তার ফ্ল্যাটে ফোন নেই।
দারোয়ানকে একটু খুঁজলেন বাসুদেব। সে ব্যাটার টিকিও দেখা গেল না। আসলে ফ্ল্যাটবাড়িটা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। কাজ চলছে। বেশিরভাগ ফ্ল্যাটেই এখনও লোক আসেনি। দশতলার এই বাড়িতে আজ অবধি মাত্র চার-পাঁচটা ফ্ল্যাটে লোক ঢুকেছে। এখনও দারোয়ানদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়নি। মাত্র একজনকে দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। ফ্ল্যাটের মালিকরা সবাই এসে গেলে কমিটিটমিটি হবে, তারপর পুরোদস্তুর দারোয়ানদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার কথা।
বাসুদেব এদিক ওদিক দারোয়ানটাকে একটু খুঁজে হতাশ হলেন। এ ব্যাটা প্রায় : ময়েই ছুতোনাতায় কোথায় যেন চলে যায়। সিঁড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালেন। আধুনিক ফ্ল্যাটগুলোর তলা তেমন উঁচু হয় না। পারবেন কি? যৌবনে ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে ফুটবল এবং ক্রিকেট দুই-ই খেলেছেন। খেলা থেকেই তার জীবনের প্রথম চাকরি। এখনও দেওয়াল আলমারি ভরতি তার খেলার ট্রফি। অহংটা মাথাচাড়া দিল। পারবেন না? তাই কি হয়? মাত্র ছেষট্টি বছর বয়স। এখনও তার সেক্স কার্যকর। এখনও দু’বেলা মাইল দুয়েক করে হাঁটেন। শরীর নিয়ে তার অহংকার আছে। মাস চারেক আগে হার্টের গণ্ডগোল ধরা পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নয়। অন্তত তিনি মনে করেন না।
ঢাকুরিয়ার বাড়িটা নিয়ে গণ্ডগোল করছিল ভাইপোরা। আইন বাসুদেবের পক্ষে ছিল বটে, কারণ বাড়িটা তার নামেই। কিন্তু নৈতিক দিকটা তার দুর্বল ছিল। কারণ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এজমালি সম্পত্তি বেচা টাকা তার বাবা এবং ভাইরা কিছু কিছু পাঠাত। সেই থেকেই বাড়িটার সূত্রপাত। বাবার ইচ্ছে ছিল বড় বাড়ি করে সব ভাই একসঙ্গে থাকবে, যেমন দেশের বাড়িতে ছিল। কথা ছিল বাড়িটা নিজের নামে করলেও বাসুদেব পরে দলিলে অন্যদেরও নাম ঢোকাবেন।
বাসুদেবেরও তাতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু কালক্রমে দেখা গেল, দেশের বাড়ি থেকে যে টাকা এসেছিল তার চেয়ে বেশি টাকা বাসুদেবের তবিল থেকে বাড়ির পিছনে খরচ হয়েছে। বাবা আর এসে পৌঁছতে পারলেন না, ও দেশেই মারা গেলেন। দাদাদের মধ্যে একজন এলেন। এল ভাইপো-ভাইঝিরা। বাড়িতে এসেই উঠল সবাই। তারপর শুরু হল তাগিদ, বাড়ির ভাগ লিখে দাও।
বাসুদেব সেজদার সামনে হিসেব ফেলে দিয়ে বললেন, আমার আড়াই লাখ টাকা দিয়ে দাও, লিখে দিচ্ছি।
গণ্ডগোলের সূত্রপাত সেখান থেকেই। এত টাকা তিনি খরচ করেছেন এটা কেউ বিশ্বাস করল না! ঝগড়াঝাটি শুরু হল এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটতে লাগল। বাসুদেবের জোর বেশি, কারণ তিনি এখানকার লোক। তিনি হুমকি দেওয়ায় সেজদা রাগ করে ভাড়া বাড়িতে গেলেন। ভাইপোরাও বিদায় নিল। মামলা মোকদ্দমার তোড়জোড় চলতে লাগল। দেশ থেকে বড়দাও কয়েকবার আসা-যাওয়া করতেন। বাসুদেব সাফ জানিয়ে দিলেন আড়াই লাখ টাকা না পেলে তিনি বাড়ির ভাগ কাউবে দেবেন না।
মামলা হলে বাসুদেবের জয় অনিবার্য ছিল। তা ছাড়া এদেশে দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি হতে এত সময় নেয় যে যুবক বুড়ো হয়ে যায়। এক পুরুষে হয়তো নিষ্পত্তি হয়ও না। এসব ভেবেই বোধহয় ওরা আর মামলা করেনি, কিন্তু দাবিও ছাড়েনি। অন্তত দুটি ভাইপো শিবশঙ্কর আর গোপাল নাগরিক কমিটি, রাজনৈতিক দল আর স্থানীয় মস্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রায়ই ঝামেলা পাকাত। বাসুদেব এক বছর আগে বাড়িটা তাই প্রমোটারকে দিয়ে দিলেন। নিয়মমতো প্রমোটার ফ্ল্যাট তৈরি করে সেখানে তাকে ফ্ল্যাট দেবে। কিন্তু বাসুদেব প্রমোটারকে বললেন, আমি এখানে থাকব না, অন্য জায়গায় আমাকে ফ্ল্যাট দিতে হবে। তবে এ বাড়িতেও আমার এক আত্মীয়ের জন্য একটা ফ্ল্যাট চাই।