- বইয়ের নামঃ দূরবীন
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০১. হেমকান্ত চৌধুরী
১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে হেমকান্ত চৌধুরীর হাত থেকে দড়ি সমেত কুয়োর বালতি জলে পড়ে গেল। অসহনীয় শীতের সেই নির্জন ব্রাহ্মমুহূর্তে অন্ধকারে হেমকান্ত অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে শুনলেন জলে দড়ি ও বালতির পড়া ও ড়ুবে যাওয়ার শব্দ। তার জীবনে এরকম ঘটনা এই প্রথম।
একটু দূরে উঁচু বারান্দার ধারে হ্যারিকেনটা রাখা। তার আলো কুয়োর পাড়ে খুব ক্ষীণ হয়ে আসছে। হেমকান্ত সেই একটুখানি আলোয় নিজের দুখানা হাতের পাতার দিকে চেয়ে দেখলেন। এই বিশ্বস্ত হাত থেকে গতকাল পর্যন্ত কখনও কুয়োর বালতি পড়ে যায়নি।
হেমকান্ত বিস্ময় ও অবিশ্বাসভরে নিজের দুখানা হাতের দিকে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর সিদ্ধান্তে এলেন, তিনি বুড়ো হয়েছেন। যথেষ্ট বুড়ো।
বাড়িতে দড়ি আছে, বালতি তোলার কাঁটাও মজুত। ইচ্ছে করলে হেমকান্ত কেউ জানবার আগেই বালতিটা তুলে ফেলতে পারতেন। কিন্তু সে চেষ্টা আর করলেন না। কেনই বা করবেন? জীবনের অনেক কাজকেই আজকাল তার তুচ্ছ বলে মনে হয়।
১৯২৯ বা তদানীন্তন কালে বয়স ত্রিশ পেরোলেই গড়পড়তা বাঙালি পুরুষ নিজেকে বুড়ো। ভাবতেন। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়সে অনেকেরই নাতি-নাতনি হতে শুরু করত। কাজেই নিজেকে বুড়ো ভাবার দোষ ছিল না। সেই হিসেবে হেমকান্তকেও বুড়োর দলে ফেলা যায়। ঘটনার সময় তার বয়স কমবেশি পঁয়তাল্লিশ। উনিশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় কিশোরগঞ্জের মোক্তার সুধীর চক্রবর্তীর মেজো মেয়ে সুনয়নীর সঙ্গে। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তিনি ছয় সন্তানের জনক হন। সাঁইত্রিশে বিপত্নীক। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র কনককান্তির বয়স চব্বিশ। বিবাহিত এবং দুই সন্তানের পিতা। মেজো সন্তান মেয়ে সবিতা। তার বরিশালে বিয়ে হয়েছে। তৃতীয় জন ছেলে জীমূতকান্তি। সেও বিবাহিত, তবে সন্তান হয়নি। চতুর্থ ও পঞ্চম পর পর দুই মেয়ে ললিতা ও বিশাখা। ললিতার বিয়ে দিয়েছেন কলকাতায়। ষষ্ঠটি পুত্র সন্তান। বয়স দশের বেশি নয়। তার নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল কৃষ্ণকান্তি। হেমকান্ত পরে নিজের নামের আদলে কান্তির বদলে কান্ত যোগ করায় এখন সে কৃষ্ণকান্ত। বিশাখা ও কৃষ্ণকান্ত ছাড়া হেমকান্তর কাছে কেউই থাকে না। প্রকাণ্ড বাড়ি হা-হা করছে। আছে বিশ্বস্ত কয়েকজন দাস-দাসী, একটা বশংবদ দিশি হাউন্ড জাতীয় সড়ালে কুকুর। একটা বুড়ো ময়ূর। কয়েকটা পোষা পাখি। গোটা দশেক গোর। কয়েকটা কাবলি বেড়াল।
জমিদার-সুলভ কোনও বদ অভ্যাস হেমকার বংশে কারও নেই। হেমকান্তও সেসবের ঊর্ধ্বে। মদ ছেন না, বাইজি নাচান না, ইয়ারবন্ধুও বিশেষ নেই। এমনকী পাশা তাস ইত্যাদিরও নেশা নেই তার। বড় ভাই বরদাকান্তর বাল্যকাল থেকেই একটা উদাসী ভাব ছিল। যৌবনে ভাল করে পা দেওয়ার আগেই সে একদল সন্ন্যাসীর সঙ্গে ভিড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বরদাকান্তর পরিত্যক্তা স্ত্রী প্রভা ঢাকায় তার বাপের বাড়িতে আজও জীবন ধারণ করে আছেন। কেমন আছেন তা হেমকান্ত জানেন না। তার ছোট এক ভাই ছিল। নলিনীকান্ত। তার পরোপকারের নেশা ছিল। ব্রহ্মপুত্রে এক ঝড়ের রাত্রে তার নৌকাড়ুবি হয়। নৌকোর অন্যান্য যাত্রীরা বেঁচে গেলেও নলিনীকান্তর লাশ পাওয়া যায় ঘটনাস্থল থেকে তিন মাইল উঁটিতে। তিন ভাইয়ের স্বভাবেই মিল আছে। কেউই খুব বিষয়াসক্ত নন। এসরাজ বাজানো ছাড়া হেমকান্তর কোনও আমোদ-প্রমোদও নেই। একসময়ে ফুটবল খেলতেন। ব্যস, আর কিছু নয়। তিনি স্বাবলম্বী, আত্মনির্ভরশীল, শান্ত ও হিসেবি মানুষ। কোনও ব্যাপারেই তিনি অসতর্ক নন। তাঁর জমিদারি খুব বড় নয়। অন্যান্য জমিদারের তুলনায় তিনি নিতান্তই চুনোখুঁটি। তবে হেমকান্ত কারও সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করেন না। তাঁর চাল-চলতিও জমিদারের মতো নয়। দাপট নেই, রাগ নেই, কর্তৃত্ব নেই। তাঁর কথা কম, হাসি কম, ভালবাসা বা আবেগও নগণ্য।
হেমকান্ত হ্যারিকেনটা বাইরে রেখে ঘরে ঢুকলেন। অন্যান্য দিন এই সময়ে তিনি আহ্নিক করতে বসেন। আজ বসলেন না। তাঁর শান্ত ও ভাবলেশহীন মন আজ কিছু চঞ্চল। বিলিতি টেবিল ল্যাম্পের সলতে ধরিয়ে তিনি বসলেন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে।
ইহাই কি বার্ধক্য নহে? পেশির দৌর্বল্য দেখা দিয়াছে, স্নায়ু আর আগের মতো সতেজ নাই। ক্রমে ক্রমে স্থবিরতা আসিবে। আয়ু ফুরাইবে। যৌবনে প্রায় কেহই মৃত্যুকে ভয় করে না। কিন্তু রক্তের তেজ কমিয়া আসিলে দিনান্তে একা বসিয়া প্রিয় ও মৃতদের কথা ভাবিতে গিয়া কখন যেন পৃথিবীর সহিত আসন্ন বিরহের কথা মনে করিয়া হৃদয় ভাবাক্রান্ত হইয়া উঠে। সেদিন কোকাবাবুকে দেখিতে গিয়াছিলাম। উদুরিতে পেটটা ফুলিয়া ঢাক হইয়াছে। পিঠভরা বেডসোর। হাঁ করিয়া কষ্টে খাস লইতেছেন। একেবারে শেষ অবস্থায় তাঁহাকে বাড়ির পিছন দিকে একটি ঘরে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে। ঘরে ঢুকলেই মনে হয় চারিদিক মৃত্যুর বীজাণুতে ভরা। ঘরের এক কোণে একটি ভাড়াটিয়া কীর্তনীয়া ছোট্ট করতাল লইয়া ক্লান্ত ও যান্ত্রিক স্বরে তারকব্রহ্ম নাম করিতেছিল। গুণ্ঠনবতী এক দাসী কেবল তাহার পরিচর্যা করিতেছে। বাহিরের ঘরে তাহার দুই পুত্র উদ্বিগ্ন মুখে বসা। মেয়েরাও আসিয়াছে। কান্নাকাটিও কিছু কিছু চলিতেছে। কোকাবাবুর স্ত্রী চিররুগ্না। তাহাকে আমি বিশেষ হাঁটাচলা করিতে দেখি নাই। সেদিনও তিনি শয্যাশায়িনী ছিলেন। কোকাবাবুর জন্য যে বিশেষ শোক অনুভব করিতেছিলাম তাহা নহে। তাহার যথেষ্ট বয়েস হইয়াছে। কিন্তু সেই সময় একটি ঘটনায় সমস্ত চিত্রটিরই এক অন্যরূপ অর্থ প্রতিভাত হইল। কোকাবাবুর নাতি শরৎ অকস্মাৎ এক হাতে বন্দুক ও অন্য হাতে গোটাকয় মৃত বেলেহাস লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। বলিল, চর থেকে মেরে আনলাম বাবা, আজ আর খালিহাতে ফিরিনি। তোমাকে কী বলিব। সেই ঘোষণায়। এবং বেলেহাঁস দেখিয়া বাড়ির লোকজনের মধ্যে যেন একটা উত্তেজনা বহিয়া গেল। শরৎ কিশোর বয়স্ক। তাহার টিপ যে কী সাংঘাতিক হইয়াছে এবং তার সাহসও যে কত তাহাই তাহার বাবা গগন আমাকে বুঝাইতে লাগিল। শুনিতে শুনিতেই টের পাইলাম, ভিতরবাড়িতে বেলেহাঁস তরিবৎ করিয়া রাঁধিবার নানা তোড়জোড় চলিতেছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন কোকাবাবুকে সকলেই ভুলিয়া গেল। বার্ধক্যে ও মৃত্যুতে যে মানুষ কতটা একা ও নিঃসঙ্গ তাহা সেদিন বুঝিলাম। এও বুঝিলাম কোকাবাবুর আত্মীয়-পরিজনের মুখে যে উদ্বেগ ও আগাম শোকের ছাপ পড়িয়াছে তাহার সবটাই খাটি নয়, ছদ্মবেশও আছে। সেইদিনই মনে প্রশ্নের উদয় হইল, আমাদের প্রিয় পরিজনদের মধ্যে যে ভালবাসা সমবেদনা ও প্রেম দেখিতে পাই তাহার অনেকটাই বোধহয় আমাদের চোখের ভ্রম। সচ্চিদানন্দ, এবার একবার লম্বা ছুটি লইয়া আস। তোমারও আমার মতোই বয়স হইয়াছে। জীবনের মেকি ও খাঁটিগুলিকে বাছাই করার জন্য তোমার সঙ্গে দীর্ঘ পরামর্শ আছে।… পরদিন এই চিঠি হেমকান্ত লেখেন তার আবাল্য সুহৃদ সচ্চিদানন্দ বিশ্বাসকে।
হেমকান্তর দেশভ্রমণের নেশা নেই। বস্তুত বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাঁর ভীতি ও অজ্ঞতা সর্বজনবিদিত। নিজের জমিদারিরও সর্বত্র তিনি যাননি। অপরিচিত পরিবেশ ও অচেনা মানুষজনের মধ্যে তিনি বড় অস্বস্তি বোধ করেন। হেমকান্তর বন্ধু হোমিয়োপ্যাথ যোগেন্দ্র সিংহ প্রায়ই বলেন, তোমার বাপু এটি একটি মানসিক রোগ। পুরুষ মানুষের ঘরকুনো স্বভাব খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
কিন্তু হেমকান্ত ভাবেন, ঘরের বাইরে যে বিশাল পৃথিবী তার যত বৈচিত্র্যই থাকুক, নিজের গণ্ডিবদ্ধ জীবনেও যে তিনি বৈচিত্র্যের শেষ পান না। দুর্গাবাড়ির মণ্ডপের পিছনে একটি পোডড়া জমি আছে। এদিকটায় কেউই বড় একটা আসে না। এই ছাড়া-জমির একপাশে একটি শুকনো খাদে বাড়ির আবর্জনা ফেলা হয়। এই জমিটায় এক সময়ে হয়তো বাগান ছিল। এখন আগাছার নীচে মাটিতে মখমলের মতো শ্যাওলা পড়েছে। বাগানের শেষপ্রান্তে একটি ভাঙা ব্রহাম গাড়ি পড়ে আছে কবে থেকে। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে উঠেছে লতানো গাছ। হেমকান্ত মাঝে মাঝে কামলা ডেকে কিছুটা করে পরিষ্কার করান। তাই জঙ্গল খুব ঘন হতে পারেনি। কিন্তু এই জায়গাটার বন্য ও পরিত্যক্ত ভাবটিকে কখনও নষ্টও হতে দেন না হেমকান্ত।
কেন এই জায়গাটা হেমকান্তর প্রিয় তার সুস্পষ্ট কোনও উত্তর তার নিজেরও জানা নেই। তবে এই জায়গায় পা দিলেই তার ভিতরটায় একটা সুবাতাস বয়ে যায়। প্রায় আড়াই বিঘের এই ভূমিখণ্ডটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের গায়ে গায়ে চিরুনির দাঁড়ার মতো রুজু রুজু ঢ্যাঙা পাম। গাছ। পৃথিবী থেকে আলাদা করে নেওয়া এই ভূমিখণ্ডে হেমকান্তর মন অবাধে বিস্তার লাভ করে। কত দার্শনিক চিন্তা আসে। বুহাম গাড়িটার একটি পাদানি ঝেড়েঝড়ে রোজ পরিষ্কার করে রেখে যায় চাকর রাখাল। হেমকান্ত বিকেলের দিকে প্রায়ই এসে সেই পাদানিতে বসেন। চারধারে কীট-পতঙ্গ পাখিদের শব্দ। বনজ একটা গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কাশী বৃন্দাবন, হিমালয় বা সমূদ্র কোথাও যাওয়ার কোনও প্রয়োজন বা তাগিদ তিনি বোধ করেন না। তার মনে হয়, এই তো বেশ আছি। মানুষের মন এক অদ্ভুত চিত্রকর। চেনা পরিচিত জায়গাতেও সে কত নিপুণ হাতে তুলির একটু-আধটু টানে কত অপরিচিত দৃশ্যই না ফুটিয়ে তোলে। ব্রহাম গাড়ির পাদানিতে বসে হেমকান্ত তাঁর মনটিকে কাজ করে যেতে দেন। ধীরে ধীরে তার সামনে ফুটে ওঠে অভ্রভেদী পাহাড়, তরঙ্গক্ষুব্ধ সমুদ্র, কনখলের রাস্তা বা ইংলন্ডের মফসসল।
মনোরাগ? না, তার কোনও মনোরোগ নেই তো! তবে একটা দুঃখ আছে। খুব গোপন দুঃখ। কিংবা হয়তো তা গোপন এক সুখই আসলে। সেই দুঃখ বা সুখের কথা তিনি বড় একটা কাউকে বলেননি কখনও। শুধু সচ্চিদানন্দ জানে।
যেদিন কুয়োর বালতি হাত থেকে পড়ে গেল, সেদিন ভারী ও বিপুল বেলজিয়ামের কাচে তৈরি তিন খণ্ডের পূর্ণাবয়ব আয়নার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন তিনি। স্ত্রী-বিয়োগের পর একবার মৃত্যু-চিন্তা এসেছিল তাঁর। সেটা স্থায়ি হয়নি। বিসর্জিত অই সেই মৃত্যু-চিন্তা ও শ্মশানবৈরাগ্যকে ধুয়ে নিয়ে গিয়েছিল। হেলে পড়া গাছ যেমন ঠেকনায় ভর দিয়ে বেঁচে থাকে, তেমনি স্ত্রী-বিয়োগের সময় তাকে ঠেকা দিয়ে রেখেছিল রঙ্গময়ি। শুধু রঙ্গময়ি বলেই পেরেছিল। নইলে তখনই হেমকান্তর সংসার ছাড়ার কথা।
বেলজিয়ামের খাঁটি ও মহান আয়না তাকে কিছুই বলল না। তিন খণ্ডে তাকে ভাগ করে বিশ্লেষণ করল, তার তিনটি প্রতিবিম্বকে কোলে নিয়ে ভাবল অনেকক্ষণ কিন্তু কিছুই বলল না। সব কথা বলতে নেই। হেমকান্ত বিষণ্ণবদনে এসে বসলেন সেই ব্রহাম গাড়ির পাদানিতে।
বিকেল হয়েছে। ফার্ন জাতীয় কিছু সুন্দর গাছ গজিয়েছে ব্রহাম গাড়িটার আশেপাশে। ভারী সুন্দর গাছগুলি। হেমকান্তর পায়ে মোজা এবং তালতলার চটি। সেই চটির ডগা দিয়ে তিনি গাছগুলিকে একটু আদর করলেন।
একটা আবছা ধোঁয়ার আস্তরণ হালকা মেঘের মতো ভেসে আছে সামনে। দুর্গাবাড়ির পিছনের অংশটা দেখা যাচ্ছে না। যে ঘাসে-ছাওয়া শ্যাওলায় পিছল আঁকাবাঁকা পায়ে-চলা পথটি ধরে রোজ তিনি বুহাম গাড়িটার কাছে আসেন সেটাও আজ ওই আবছায়ায় অর্ধেক আড়াল। সেদিকে চেয়ে তিনি ভোররাত্রির ঘটনাটা আবার তৈরি করতে লাগলেন মনে মনে। তুচ্ছ ও সামান্য একটা ঘটনা।
ইঁদারার মধ্যে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন হেমকান্ত। বাঁ হাতে দড়ির লাছি সতর্ক মুঠোয় ধরা, ডান হাতের আলগা মুঠির ভিতর দিয়ে পিছল সাপের শরীরের মতো নেমে যাচ্ছে পাটের মজবুত দড়ি। শীতকালে জল নেমে যায়। বালতি সেই অনন্ত গহ্বরে নামছিল তো নামছিলই। কোথাও অন্যমনস্কতার কোনও কারণ ছিল না। আর কেউ খবর রাখে না, শুধু হেমকান্তই জানেন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজেও তাঁর মতো সতর্ক লোক দ্বিতীয়টি নেই। এই গুণের জন্য গোপনে একটু গর্ববোধও আছে তার। আচমকা দড়ির প্রান্তে বাঁধা বালতি জল স্পর্শ করল। শব্দ পেলেন হেমকান্ত। বহিরাগতের স্কুল স্পর্শে নিথর ঘুমন্ত জলে কুমারী-শরীরের মতো শিহরন। বাঁ হাতের শক্ত মুঠিতে ছিল দড়ির লাছি এবং শেষ গিট। ডান হাতও সতর্ক ছিল। তবু কেন তার দুটি হাতের কোনওটাই ধরে রাখল না দড়িটাকে? অসতর্কতা নয়, অন্যমনস্কতা নয়। হেমকান্তর মনে হয়, তার দুটি হাত ছেড়ে দিতে চেয়েছিল দড়িটাকে, তাই দিল। হেমকান্তর কিছু করার ছিল না।
সেই দুটি হাতের দিকে শীত অপরাহের পড়ন্ত স্নান আলোয় কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন হেমকান্ত। শ্রমের কাজ জীবনে কমই করেছেন। হাত দুটি কোমল ও লাবণ্যময় এখনও। হাতের চেটো এখনও তুলতুলে, এখনও রক্তাভাময় লম্বা ও পুরন্ত শিল্পের আঙুল। ময়লাহীন নরুনে সুন্দর করে কাটা নখ। এ দুটি হাতের কোনও আলাদা সত্তা নেই, হেমকান্ত জানেন। তবু আজ ভাঙা ব্রহাম গাড়ির পাদানিতে বসে তার মনে হল, এ দুটি হাত তাকে কিছু ইঙ্গিত করছে। বলছে, ছেড়ে দাও, পার্থিব যা কিছু আছে ছেড়ে দাও। বাঁধনে থেকো না তুমি। চলো।
কিন্তু চলো বললেই তো আর যাওয়া যায় না। কোথায় যাবেন বাইরের ধূসর অচেনায়? এই তো তিনি বেশ আছেন। সংসারে কোনও বন্ধন তার কখনও ছিল না, এখনও নেই। ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাউকেই তার কোলেপিঠে মানুষ করতে হয়নি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ঘোট দুটি ছেলেমেয়ের ভার নিয়েছিল পুরনো ও বিশ্বাসী দাসীরা। আর দশভুজার মতো রঙ্গময়ি। এমনকী নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও এক অপরিমেয় দূরত্ব ছিল তার। অন্দরমহল ও সাংসারিক কাজেই ব্যস্ত থাকতে হত সুনয়নীকে। শেষ কয়েক বছর দুরারোগ্য ক্ষতে শয্যাশায়ি ছিলেন। সুতরাং হেমকান্তর বন্ধন বলতে কিছু নেই। কেউ তাকে ধরে রাখেনি। তবু হেমকান্তের কোথাও যাওয়ার নেই। এই পোড়ো জংলা ভূমিখণ্ডই তাকে অনন্তের আস্বাদন দেয়।
কুয়াশার ভিতরে অস্পষ্ট এক ছায়ামূর্তিকে দেখে অন্যমনস্ক হেমকান্ত একটু চমকে উঠলেন। উত্তরের পরিত্যক্ত দেউলের ভেঙে পড়া দেওয়ালের এক অংশ দিয়ে ছায়ামূর্তি ঢুকল। ওদিকে রাস্তা নেই। চারদিকে ইট ছড়িয়ে পড়ে আছে। লম্বা ঘাসের জঙ্গল। সাপের প্রিয় সে পথ ধরেই এগিয়ে আসছিল সে। চকিত পায়ে।
হেমকান্ত হাতের লাঠিটায় থুতনির ভর রেখে সকৌতুকে চেয়ে রইলেন। রঙ্গময়ি এখনও চকিত-চরণা, চকিত-নয়না, চকিত-রসনা।
রঙ্গময়ির বয়স ত্রিশের আশেপাশে। তাকে হঠাৎ সুন্দরী বলা যায় না। একপলক তাকিয়ে দেখলে তাম্রাভ গাত্রবর্ণের মেয়েটিকে তেমন নজরে পড়বে না। রঙ্গময়ির শরীর কৃশ এবং কিছু দীর্ঘ। চোখ দুটি বড় এবং মাদকতাময়। সবচেয়ে সুন্দর তার ব্যাকঝকে দাঁত। লম্বাটে মুখোনায় একটু আপাত-কঠোরতা আছে বটে, কিন্তু বিন্দুমাত্র পুরুষালি ভাব নেই। গম্ভীর থাকলে রঙ্গময়িকে ওরকম দেখায়। হাসলে মুখের আশ্চর্য রূপান্তর ঘটে। আশ্চর্য তার চোখ। একবার তাকালে আঠাকাঠির মতো চোখ লেগে থাকে। ফেরাতে ইচ্ছে করে না। কী গভীর মায়া, কত ছলছলে আর করুণ!
শীতের পোশাক বলতে রঙ্গময়ির অঙ্গে শুধু একটা মোটা সুতির চাদর জড়ানো। পায়ে চটি নেই। এই শীতে রঙ্গময়ির পায়ের চামড়া ফেটে একাকার কাণ্ড। ফিতে-পেড়ে সাদা খোলর একটা শাড়ি পরনে।
হেমকান্তর স্নিগ্ধ মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটল। বললেন, বড় ঠাণ্ডা পড়েছে, খালি পায়ে ঘোরা ঠিক নয়।
রঙ্গময়ি বলল, আয়দের কথা পরে হবে। ওসব তোমার মুখে মানায় না। শরৎ খবর দিয়ে গেল কোকাবাবুর শ্বাস উঠেছে। একবার যাও।
হেমকান্ত নড়ে উঠলেন, খুব খারাপ অবস্থা নাকি?
এখন আর খারাপ নয়, একেবারে শেষ অবস্থা। একবার যাও।
হেমকান্ত গম্ভীর হলেন। বললেন, আমি গিয়ে কী করব? বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। গোটা কয়েক সান্ত্বনার বুলি আউড়ে যেতে হবে। এ ছাড়া আর কী?
রঙ্গময়ি খুব শান্ত স্বরে বলল, সেটুকুও তো করা দরকার।
আজ আমার শরীর ভাল নেই মনু। মনটাও খারাপ।
তা হলে যাবে না?
নাই গেলাম। এসব সামাজিকতা আমার ভাল লাগে না।
না কি চোখের সামনে কাউকে মরতে দেখতে চাও না!
হেমকান্ত একটু হাসলেন। বললেন, তাও বটে।
রঙ্গময়ি হেমকান্তর দুহাত দূরত্বে দাঁড়ানো। তার গা থেকে একটা আঁচ আসছে বলে মনে হল হেমকান্তর। রঙ্গময়ি বলল, তুমি আমি সবাই একদিন না একদিন তো মরবই। মরতে দেখা ভয়ের কী?
হেমকান্ত অন্য পন্থা ধরে বললেন, কোকাবাবু যদি মরেন তা হলে আমাকে তো আবার স্নান করিয়ে ঘরে ঢুকতে দেবে না।
স্নান করবে। তাতে কী? গরম জল করা থাকবে। আগুন আর লোহা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকবে। আমি সব তৈরি রাখব।
রাখবে জানি। কিন্তু আজ আমার অত হাঙ্গামা ভাল লাগছে না।
রঙ্গময়ি একটু হতাশার গলায় বলে, কোনওকালেই তো কোনও হাঙ্গামা পোয়ালে না। এমন জড়ভরত হয়ে দিন কাটাতে ভাল লাগে তোমার?
হেমকান্ত বিষণ্ণ গলায় বললেন, সংসার বাস্তবিকই বড় জটিল জায়গা, মনু। সুনয়নী গেছে, ভেবেছিলাম এরপর আর লোক-লৌকিকতা, ভদ্রতা-অভদ্রতার ধার ধারতে হবে না। আপনমনে থাকব। এখন দেখছি, নিজের মতো করে থাকবার উপায় নেই।
অত রেগে যাচ্ছ কেন? ব্যাপারটা খুব সামান্য। কোকাবাবু তোমাদেরই জ্ঞাতি। এক শহরে বাস। না গেলে কেমন দেখাবে? এ সময়ে শত্রুও তো যায়।
মনু, তুমি কোনওদিন আমার কোনও অসুবিধে বুঝলে না। কোনটা আমি ভালবাসি, কোনটা বাসি না, সেটা জেনেও তুমি সবসময়ে অপছন্দের কাজটাই আমাকে দিয়ে করাতে চাও। মরার সময় নাই বা গেলাম, কোকাবাবুর অসুখের সময় তো আমি প্রায়ই দেখতে গেছি।
রঙ্গময়ি হাসল না বটে, কিন্তু তার মুখে কিছু কোমলতা ফুটল। যেমন শিশুর অসহায়তা দেখে মায়ের মুখে ফোটে। রঙ্গময়ি খুব মৃদু স্বরে বলল, সঙ্গে আমি গেলে?
হেমকান্ত একথায় হঠাৎ মুখ তুলে রঙ্গময়ির দিকে তাকান। বিভ্রান্তের মতো বলেন, তুমি গেলে–তুমি গেলে–
সহিসকে গাড়ি জুততে বলো গে, আমি তৈরি হয়ে আসছি।
হেমকান্ত হঠাৎ বললেন, খারাপ দেখাবে না, মনু?
রঙ্গময়ি যেতে যেতে মুখ ফেরাল। মুখে একটু হাসি। কী অপরূপ হয়ে গেল মুখটা! বিহুল হেমকান্ত চেয়ে রইলেন।
রঙ্গময়ি বলল, দেখাবে। তবু তোমার জন্যেই যেতে হবে।
বরং খবর পাঠিয়ে দাও, আমার শরীর খারাপ।
সেটা অজুহাত হল, অজুহাত কি ভাল?
মানুষের শরীর খারাপ হয় না?
হয়। তোমার হয়নি।
কে বললে হয়নি?
রঙ্গময়ি একটু ভ্রু কুঁচকে চিন্তান্বিত মুখে বলে, সত্যি বলছ নাকি? শরীর সত্যিই খারাপ?
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, তোমরা তো কেউ আমার কোনও খবর রাখো না মনু। সে না হয় নাই রাখলে, কিন্তু মুখের কথাটুকু অন্তত বিশ্বাস কোরো।
রঙ্গময়ি এই অভিমানের কথায় মুচকি হেসে বলল, শরীর খারাপ তা বুঝব কী করে? দিব্যি তো ফুল-ফুল সেজে কুঞ্জবনে এসে বসে আছ।
হেমকান্ত ডাক-হাঁক বা প্রচণ্ড প্রতাপের মানুষ নন। তবে বন্ধ কপাটের মতো তার একটা নিরেট গাম্ভীর্য আছে। সেইজন্য সকলেই তাকে সমীহ করে। তার মুখের দিকে চেয়ে তরল কথাবার্তা কেউই বলে না। অবশ্য রঙ্গময়ি তার ব্যতিক্রম। হেমকান্তও রঙ্গময়ির কাছেই কিছু প্রগলভ হয়ে ওঠেন। রঙ্গময়ির একথাটায় তিনি হাসলেন না। বোধহয় পুরনো ক্ষতে ব্যথাতুর স্পর্শ পেলেন। বললেন, আজকের দিনটা আমার ভাল যাচ্ছে না, মনু। মনটা মুষড়ে আছে। এর ওপর যদি কোকাবাবুর মৃত্যুটা চোখে দেখতে হয় তবে সারা রাত আর ঘুম হবে না।
রঙ্গময়ি তার মায়াবী চোখ দিয়ে যতদূর সম্ভব খুঁটিয়ে লক্ষ করে হেমকান্তকে। তারপর বলে, মনের আর দোষ কী? পুরুষ মানুষরা হাঁটে, বেড়ায়, আড্ডা দেয়, তাস পাশা খেলে। তোমার তো সেসব কিছু নেই। কেবল বসে বসে আকাশ পাতাল কী যে ভাবো।
হেমকান্ত একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, আমি কি কেবল বসেই থাকি? কিছু করি না?
তা বলিনি। নিজের সব কাজ তুমি নিজেই করে নাও। কিন্তু সেটাও কি বাপু পুরুষ মানুষকে মানায়? নিজের ছাড়া কাপড় ধুচ্ছ, নিজের জল গড়িয়ে নিচ্ছ, নিজের মশারি টাঙাচ্ছ বা জুতো বুরুশ করছ, পুরুষ মানুষের এ কেমন ধারা? অত দাসদাসী তবে আছে কেন?
তা হলে কিছু করি বলছ?
করো, কিন্তু ওসব করে বলে আমি তোমার প্রশংসা করতে পারব না।
তোমার প্রশংসা! ওরে বাবা! সে তো নোবেল প্রাইজ পাওয়ার শামিল।
আমার প্রশংসা তো বড় কথা নয়। তোমার বউও দুঃখ করে বলত, উনি যে কেন সকলের এত ছোয়াচ বাঁচিয়ে চলেন।
বলত নাকি?
বলবে নাই বা কেন? তাকে তো তুমি স্বামীসেবার সুযোগই দাওনি। জ্বর হলে মাথাটা পর্যন্ত টিপে দিতে ডাকতে না।
সেটা ভাল হয়নি বুঝি?
ভাল কি মন্দ সে জানি না। মেয়েমানুষের বুদ্ধি অল্প, তার ওপর আমি মুখ মানুষ। আমাদের চোখে ভাল লাগে না বলেই বলি।
রঙ্গময়ির স্বরে একটু অভিমানের সুর ছিল কি? হেমকান্ত মনে মনে একটু উদ্বিগ্ন হলেন। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তার নিজস্ব যে মতগুলি আছে তা তিনি কদাচিৎ লোকের কাছে ব্যক্ত করেন।
তর্ক করতে কেউ তাঁকে দেখেনি কখনও। হেমকান্ত মৃদু স্বরে বললেন, তোমার বুদ্ধি অল্প নয়। মূখও তোমাকে কেউ বলেনি। আমার সম্পর্কে তোমার সিদ্ধান্তও সঠিক। আমি নিজে আমার ত্রুটিগুলি খুব ভাল বুঝি। কিন্তু মনু, দোষ জেনেও কি সব সময়ে মানুষ সে দোষ ছাড়তে পারে?
রঙ্গময়ি ভ্রুকুটি করে বলে, তোমার দোষ দেখে বেড়ানোই বুঝি আমার কাজ? সেসব নয়। কিছু মনে কোরো না আমার কথায়। শরীর খারাপের কথা বলছিলে, কী হয়েছে তা তো বললে না।
এখনও তেমন কিছু হয়নি। হয়তো শরীর ততটা খারাপ নয়। মনটা খারাপ। আর মন খারাপ বলেই শরীরটাও ভাল লাগছে না।
চুপচাপ বসে থাকলে কি মন ভাল হবে? একটু বেড়িয়ে এসে গিয়ে। কোকাবাবুর বাড়িতে না যাও, অন্য কোথাও তো যেতে পারো।
হেমকান্ত হঠাৎ দাঁড়ান। বলেন, না, তার দরকার নেই। চলো, বরং দুজনেই কোকাবাবুর বাড়িতে যাই।
একথায় রঙ্গময়ি যেন একটু খুশি হয়। একটা দীপ্তি ক্ষণেক খেলা করে যায় মুখে। চোখের গভীর দৃষ্টি যেন বলে, এই তো চাই।
রঙ্গময়ির সঙ্গে হেমকান্তর বাইরের সম্পর্কটা খুবই পলকা। প্রায় কিছুই নয়। রঙ্গময়ি এ বাড়ির পুরুতের মেয়ে। পুরুত বিনোদচন্দ্র এখন খুবই বুড়ো হয়ে পড়েছেন। তার ছেলে লক্ষ্মীকান্তই এখন পুজো-আর্চা করে। বিনোদচন্দ্রের অনেকগুলি ছেলেমেয়ে। তাদের অধিকাংশই লেখাপড়া শেখেনি। ভাল করে খাওয়াই জুটত না তাদের। রঙ্গময়ি বিনোদচন্দ্রের চতুর্থ কন্যা। তার আশা ছিল জমিদার শ্যামকান্তর মধ্যমপুত্র হেমকান্তর সঙ্গে এই মেয়েটির বিয়ে হবে। শ্যামকান্তর স্ত্রী মেয়েটির সুলক্ষণ দেখে একবার এরকম অভিমত ব্যক্ত করেন। কষ্টেসৃষ্টে তিনি মেয়ের বিয়ে দিলেও চতুর্থ রঙ্গময়ির জন্য বিনোদচন্দ্র অন্যত্র বিয়ের চেষ্টা করেননি। বয়সে রঙ্গময়ির চেয়ে হেমকান্ত প্রায় পনেরো বছরের বড়। কিন্তু রঙ্গময়ির যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন হেমকান্তর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর বিনোদচন্দ্র নলিনীকান্তর আশায় বসে রইলেন। কিন্তু শ্যামকান্ত বা তার স্ত্রীর তরফ থেকে তেমন কোনও আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত পেলেন না। তার বড় তিনটি মেয়েই গরিবের ঘরে পড়েছে। তাদের একজন আবার অকাল-বৈধব্যের কবলে। ছেলেরা কেউই মানুষ হয়নি। বিনোদচন্দ্র তখন রঙ্গময়িকে জমিদারের ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া। পুরোহিত হলেও তাঁর নীতিজ্ঞান প্রখর ছিল না। গলগ্রহ এক বালবিধবা বোন তার সংসারে আছে। কনকপ্রভা। কনকের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, তবে বাঁকা। কনক একদিন বিনোদচন্দ্রকে বলল, সোনাভাই, যদি চৌধুরীবংশেই মনুকে দিতে চাও তো সোজা পথ ছাড়ো। বিনোদচন্দ্র সোজা পথ ছাড়তে রাজি, কিন্তু বাঁকা পথ পেলে তো!
কনক সেই বাঁকা পথের সন্ধান দিল না। তবে নিজেই দায়িত্ব নিল।
নলিনী বড় দালানে থাকত না। কাছারিঘরের পাশে খাজাঞ্চি মুহুরি বা ওই ধরনের কর্মচারীদের জন্য যে এক সারি ঘর ছিল তারই একটায় থাকত। বিলাসব্যসনের ধারে কাছেও ঘেঁষত না সে। ঘরে একটি তক্তপোশ, তাতে দীন বিছানা। কয়েকটা বইয়ের আলমারি আর লেখাপড়ার জন্য একটা টেবিল আর চেয়ার ছিল। অনেক রাত অবধি জেগে সে পড়াশুনো করত সেই ঘরে।
সেই ঘরে মাঝে মাঝে কনক রঙ্গময়িকে পাঠাত। রঙ্গময়ির কাজ ছিল গিয়ে জিজ্ঞেস করা, আপনার কি কিছু লাগবে?
এরকম নিরীহভাবে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। নলিনীর ঘরে মাঝে মাঝে খাওয়ার জল বা ঘোলের শরবত দিয়ে আসত রঙ্গময়ি। কাজটা তাকে দিয়ে কেন করানো হচ্ছে তা অবশ্য সে বুঝত না। নলিনীর প্রতি সে কোনও যুবতীসুলভ আকর্ষণও বোধ করত না।
নলিনীও ছিল হৃদয়চর্চা থেকে বহু দূরের মানুষ।
কিন্তু কনক ধৈর্য হারাচ্ছিল। মেয়েটা হাবা, ছেলেটা গবেট।
সুতরাং আর-একটু বাঁকা পথ নিতে হল কনককে। একদিন একটু বেশি রাত্রে সকলে ঘুমোনোর পর রঙ্গময়িকে ঠেলে তুলে দিল কনক, যা তো, নলিনীর বোধহয় খুব জ্বর এসেছে। দেখে আয় তো।
রঙ্গময়ি ঘুমচোখে একটু অবাক হলেও তড়িঘড়ি গিয়ে ঢুকেছিল নলিনীর ঘরে। নলিনী পড়তে পড়তে মুখ তুলে অবাক হয়ে চাইল। এত রাত্রে রঙ্গময়ি!
কিছু বুঝবার আগেই বাইরে থেকে দরজা টেনে শিকল তুলে দিল কনক।
নলিনী চমকে উঠল।
আর থরথর করে কেঁপে উঠল রঙ্গময়ি!
০০২. টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান
টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান খুব শ্লথ গতিতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ধরে উত্তরমুখো এগিয়ে আসছে। হেডলাইটের সামনে ফুটপাথ ধরে দুজন মাতালকে দৌড়াতে দেখা যাচ্ছে। একজন লম্বা, ফিট চেহারা। অন্যজন কিছু থলথলে। দুজনেই দৌড়োচ্ছ ল্যাং ল্যাং করে, টলোমলো পায়ে। পড়ছে, আবার উঠছে। পিছু ফিরে দেখছে বারবার। ভ্যানটা তাদের ঠিক তাড়া করছে না, কিন্তু অনুসরণ করছে। লেগে আছে আঠার মতো পিছনে।
হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশান্ত বলে, রোজ ন্যাকড়াবাজি! শালা, রোজ ন্যাকড়াবাজি! আমাদের পেয়েছেটা কী? আই ধ্রুব, আয় কেলো করি সেদিনের মতো।
লম্বাজন ধ্রুব। হাইড্র্যান্টের উঠে-থাকা ঢাকায় একটা হোঁচট খেয়ে খানিক দূর ভারসাম্যহীনভাবে পড়ো-পড়া হয়ে গিয়েও দাঁড়ায়। কোমরটা চেপে ধরে বলে, মাইরি! মাইরি! রোজ পিছনে ভূতের গাড়ি! আর পারা যায় না।
অনেক রাত। ফাঁকা রাস্তায় হকারদের উঠে-যাওয়া অস্থায়ি দোকানপাটের ইট পড়ে আছে ফুটপাথে। প্রশান্ত একটা ইট তুলে নিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, ঝাড়ব?
কেস খারাপ হয়ে যাবে। সেদিনের কথা মনে নেই?
আজ ফুটো করে দেব। দেব?
দাঁড়া, একটু ভাবি।
গাড়িটা কিছু দূরে হেডলাইট জ্বেলেই দাঁড়িয়ে আছে। তারা দৌড়োলে আবার পিছু নেবে।
ধ্রুব সেদিকে চেয়ে বলল, এটা পুলিশের ভ্যান নয়।
তা হলে?
এটা মাইরি ভূতের গাড়ি।
তোর বাপের মাথা। দুটো ইট ঝাড়, ভাগবে।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, কালুর দোকানে হুটোপাটা করাটা আজ ঠিক হয়নি।
আলবাত ঠিক হয়েছে। শালা মাল বেচে খায়, তার আবার টাইম লিমিট কীসের? বারোটার পর সেল ক্লোজড, ইয়ার্কি পেয়েছে?
তা বলে ভাঙচুর করবি? সিভিলাইজেশন নেই?
আমি তো সেকথাই কালুকে বললুম, ঘর থেকে বার করে দিচ্ছিস, এটা কোন দেশি ভদ্রতা! বল, প্রথমে আমি রং দেখিয়েছি? ওই শালাই তো রং নিচ্ছিল।
ক্ষমাও তো করতে পারতি!
ক্ষমা?–প্রশান্ত একটু বেকুব বনে চেয়ে থাকে। তারপর জিভে চুক চুক দুটো শব্দ করে বলে, ইস শালা, তখন কথাটা মাথায় আসেনি মাইরি। অথচ দ্যাখ ধু-ধ্রুব, আমি শালা লোককে ক্ষমা করতে কত ভালবাসি। হাজার হাজার লোককে রোজ ক্ষমা করে দিচ্ছি শালা, আর কালুটাকে পারলুম না! এঃ!
ধ্রুব কিছু গম্ভীর হয়ে বলে, কোথায় আমাদের একটা গোলমাল হচ্ছে বল তো! রোজ গণ্ডগোল! একটা না একটা গণ্ডগোল। আর রোজ শালা পিছনে ভূতের গাড়ি।
এঃ। আমার দুগালে দুটো থাপ্পড় মারবি ধ্রুব? কেন শালা আমি রোজ ক্ষমা করতে ভুলে যাই বল তো! মারবি থাপ্পড়!
মারাই উচিত। তোর সঙ্গে মেশাও উচিত নয়।
প্রশান্ত একটু থতিয়ে যায়। ধরা ধরা গলায় বলে, তুইও ওর অনেকগুলো বোতল ভেঙেছিস। টেবিল চেয়ার উলটে ফেলেছিস।
সে তো তোরটা দেখে।
গাড়িটা সামান্য একটু এগিয়ে আসে।
প্রশান্ত বিস্ফারিত চোখে চায়। বলে, আসছে! ধু-ধ্রুব! দৌড়ো!
ইট মারবি না?
না, না। ক্ষমা! ক্ষমা! দৌড়ো!
পারবি না। গাড়ির সঙ্গে কোনও হিউম্যান বিয়িং দৌড়ে পেরেছে?
তা হলে?
ফেস কর। বিবেকানন্দ বলেননি, বর্বরদের মুখোমুখি হও!
কে?
গ্রেট ম্যান।
বিবেকানন্দ? কোথায় বলেছে বল তো!
কোথায় যেন।–বলতে বলতে ধ্রুব একটা ইট তোলে।
প্রশান্ত চাপা উত্তেজিত স্বরে বলে, মার! ফুটো করে দে! হুই-হুই-হু–ই-ই—
ধ্রুব ইটটা ছুড়তে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে উবু হয়ে পড়ে যায়। ইটটাও প্রায় তার সঙ্গেই পড়ে।
এঃ মিস।-বলে প্রশান্ত নিজের হাতের ইটটা খুব নিশানা করে ছুড়ে মারে। অদূরের হাইড্রান্টের জল ছিটকে ইটটা নিরাপদে অবতরণ করে।
গাড়িটা থেমে যায় ফের। সামনের দরজা খুলে একজন নামে। হেডলাইটের আলোর আড়ালে দাঁড়িয়ে নোকটা অনুচ্চ স্বরে বলে, ধ্রুববাবু, হাল্লা মাচাচ্ছেন কেন? বাড়ি যান।
প্রশান্ত চোখ মিটমিট করে গাড়ির আলোর দিকে চেয়ে থেকে বলে, বাড়ি যাব কি না তাতে ওর বাবার কী?
ধ্রুব ওঠে। কাঁকালে হাত দিয়ে একটা ব্যথার শব্দ করে বলে, বাড়ি যেতে বলছে?
বলছে। বাট দ্যাট ইজ নট হিজ বিজনেস। মার ইট। রোজ পিছু নেওয়া! রোজ ন্যাকড়াবাজি! দে ফুটো করে।–বলতে বলতে আর-একটা ইট তোলে প্রশান্ত।
ধ্রুব কর্তৃত্বের একটা হাত তুলে বলে, দাঁড়া, কী হয়েছিল যেন কালুর দোকানে! হাল্লাবাজি?
ও মালের আড্ডায় একটু-আধটু হয়। কালু শালা মাল বেচে খায়, ওর অত ন্যাকড়া কীসের? ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, আজ আমাদের মাল খাওয়ার কথা ছিল না। কাল আমরা প্রমিস করেছিলাম, আজ মাল খাব না।
আজকের কথা হয়নি। কথা ছিল, হপ্তায় একদিন বাদ দেব। সেটা আজ হতে পারে, কাল হতে পারে, পরশু হতে পারে।
আজকের কথাই হয়েছিল। আজ ড্রাই ডে না?
আজ! ওফ, মনেই ছিল না মাইরি! ইস, ছিঃ ছিঃ!
ওই ভূতের গাড়িটার দোষ নেই। ক্ষমা করে দে।
দেব? মাইরি?
দে। ক্ষমার মতো জিনিস নেই।
প্রশান্ত হাতের ইটটা ফেলে দেয়। গাঢ় স্বরে বলে, ক্ষমার মতো জিনিসই হয় না। আমি রোজ হাজার হাজার লোককে ক্ষমা করি। যেদিন কাউকে ক্ষমা করতে ভুলে যাই সেদিন ভাল করে খেতে পারি না, ঘুমোত পারি না, মাল খেলেই কান্না পায়। তোর?
আমারও ওসব হয়। সকলের হয়।
হবেই। ক্ষমা করতে আমি এত ভালবাসি যে, মাঝে মাঝে নিজেকেও ক্ষমা করে দিই।
বহুত মাতলামি করছিস প্রশান্ত! আজ ব্যাপারটা শুরু হল কী করে বল তো!
কোন ব্যাপারটা?
আমাদের মাল টানাটা! উই ব্লাক দা প্রমিস, কী করে শুরু হল?
নার্সিংহোম থেকে। তোর বাচ্চাটা অপয়া। দারুণ অপয়া।
আমার বাচ্চা!–বলে ধ্রুব ভ্রু কোচকায়, তারপর ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে, আমার বাচ্চা! হাঃ হাঃ–
প্রশান্ত সন্দেহের গলায় বলে, তোরই তো! ঠিক বলিনি?
দূর শালা! তোকে একটা কথা বলে রাখি। তোকে বলেই বলছি। বাচ্চাটা আমার নয়।
তবে কার?
অত আমি জানি না। তবে লাস্ট টু ইয়ারস আমি বউয়ের সঙ্গে শুইনি।
মাইরি বলছিস?
মাইরি।
সামনের মোড়ে আর-একটা জিপগাড়ি বাঁক ফেরে এগিয়ে এসে ভ্যানটার পিছনে থামে। দু-একজন লোক নামে। কিন্তু ভ্যানটার হেডলাইট এখনও জ্বলছে বলে কাউকে দেখা যায় না।
একটু অপেক্ষা করে ধ্রুব আর প্রশান্ত।
ভ্যানের কাছ থেকে একজন চেঁচিয়ে বলে, ধ্রুববাবু।
প্রশান্ত আবার ফেলে-দেওয়া ইটটা তোলে। বলে, শালারা বহুত ভ্যানতারা করছে।
ধ্রুব হাত তুলে প্রশান্তকে থামায়। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য লোকটার উদ্দেশে বলে, কেন ঝুটমুট ঝামেলা করছেন? আমরা কিছু করিনি।
লোকটা হেঁড়ে গলায় বলে, বাড়ি যাবেন, না ধরে নিয়ে যাব?
ধ্রুব কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখটা বিকৃত করে একটু। তারপর বলে, যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি।
হেডলাইটের আড়াল থেকে লোকটা আবার বলে, আপনার বাবা একটু আগেই থানায় টেলিফোন করেছিলেন। বলেছেন, এমনিতে না গেলে হাসপাতালে গিয়ে পাম্প করে পেট থেকে মাল বের করে তারপর ভ্যানে করে পৌঁছে দিতে।
ধ্রুব বলে, যাচ্ছি। কিছু করতে হবে না। আপনারা ডিউটিতে যান।
লোকটা নাছোড়বান্দা। বলে, যাচ্ছি বললে হবে না। আপনি ভ্যানে এসে উঠুন। আমরা পৌঁছে দেব।
ধ্রুব দুপা পিছিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে, ভ্যান লাগবে না। আমরা ট্যাকসি ধরে নেব।
তা হলে ধরুন। যতক্ষণ না ট্যাকসিতে উঠছেন ততক্ষণ আমরা ফলো করব। আমাদের ওপর স্ট্রিকট অর্ডার আছে।
প্রশান্ত বিড়বিড় করে বলে, তোর বাপটা বহুত খচ্চর। ভি আই পি আছে তো কী আছে? ছেলে বলে কি চাকর?
ধ্রুব চাপা স্বরে বলে, সিভিলাইজেশন বলে একটা কথা আছে প্রশান্ত। আজ আমরা খুব গণ্ডগোল করেছি।
মাল খায় তো লোকে একটু গণ্ডগোল করবে বলেই গুরু।
ধ্রুব গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলে, আজ গণ্ডগোলের দিন ছিল না। কালুর দোকানে হুটোপাটা করা ঠিক হয়নি।
হুটোপাটা হত না মাইরি। একটা কালো মতো রোগা মতো লোক আজ কালুর দোকানে বসে ছিল। ভেজা বেড়াল শালা। খুব নজর করছিল আমাদের।
বটে! ঠিক দেখেছিস?
খুব ঠিকসে দেখেছি গুরু। গায়ে একটা ফান্টুস জ্যাকেট ছিল। খুনিয়া রঙের জ্যাকেট। শেষদিকে ওই লোকটা কালুকে চোখ মারায় কালু ঝাঁপ ফেলে দিল।
ভূতের বাচ্চাটা কে বল তো!
পুলিশের খোঁচড় হবে। ধ্রুব একটা হাই তোলে। বলে, ঠিক আছে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। চল। লিন্ডসে স্ট্রিটে মোড় নিয়েই দুজনে দাঁড় করানো ট্যাকসি দেখতে পায়। ট্যাকসির সামনে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে।
প্রশান্ত একটা হতাশার শ্বাস ফেলে বলে, অ্যারেনজমেন্ট! মাইরি, তোর সঙ্গে ফুর্তি করে সুখ নেই।
মুখটা একটু বন্ধ রাখবি বাবা? কনস্টেবলটা ট্যাকসির পিছনের দরজা খুলে ধরে। বলে, উঠুন। ড্রাইভারকে বলা আছে।
ধ্রুব একটু লজ্জিত মুখ করে গাড়ির ভিতরে গড়িয়ে চলে যায়। প্রশান্ত উঠবার আগে কনস্টেবলটার দিকে কটমট করে একটু চেয়ে থাকে। কনস্টেবল দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ট্যাকসি চলতে থাকে।
প্রশান্ত বুক-পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এ পকেট ও পকেট হাতড়ে বলে, আমার দেশলাই?
ধ্রুব অলস গলায় বলে, আমারটাও কালুর দোকানে পড়ে আছে। এই যে ড্রাইভার, আপনার দেশলাইটা দেখি।
ড্রাইভার জবাব দেয় না, তবে একটা হাতে একটা দেশলাই এগিয়ে দেয়। সিগারেট ধরাতে যাতে অসুবিধে না হয় তার জন্যই বোধহয় গাড়ির গতিও ধীর করে দেয়।
দুজনে সিগারেট ধরানোর পর প্রশান্ত বলে, ভি আই পি-দের হাত লম্বা হয় ঠিক শালা ভূতের হাতের মতো। সেই যে ঘর থেকে হাত বাড়িয়ে লেবু গাছ থেকে লেবু ছিঁড়ে এনেছিল, মনে নেই? ঠিক সেইরকম।
ধ্রুব ঝিমোতে ঝিমোতে বলে, মুখটা বন্ধ করবি বাপ! আমার মনটা ভাল নেই। আমি একটু চোখ বুজে ভাবছি।
কী ভাবছিস? যে বাচ্চাটা তোর বউ আজ পয়দা করল সেটা তোর নয়?
ওটা আমার নয় ঠিকই, কিন্তু ওটা নিয়ে ভাবছি না।
তবে কী নিয়ে ভাবছিস?
অনেক সিরিয়াস প্রবলেম আছে। তুই সব বুঝবি না। মুখ বুজে থাক। ভবানীপুর এলে নামিয়ে দেব।
প্রশান্ত একটু গম্ভীর হয়ে বিজ্ঞের মতো বলে, তোর প্রবলেম কোনটা জানিস?
আমার অনেক প্রবলেম।
তোর প্রবলেম আসলে একটাই। সেটা হল তোর বাপ।
বাবাও একটা প্রবলেম বটে।
বহুত গভীর কঠিন প্রবলেম। বাপের জন্যই তোর লাইফটা বিলা হয়ে যাচ্ছে। শালা পাবলিকের কাছে ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে, ভোটে টান পড়বে, তাই তোর বাপ তোর পিছনে হরকত লোক লাগিয়ে রেখেছে। তুই বাঁচতে চাস তো পালা। ফোট।
ধ্রুব দুহাতে কান ঢেকে বলে, ওঃ এমন চেঁচাচ্ছিস! মাথা ধরে যাচ্ছে!
চেঁচালুম? আচ্ছা, ক্ষমা।
ধ্রুব একটু বিরক্তির গলায় বলে, সিগারেটের ফুলকি আসছে। ঠিক করে ধর। জানালার কাচটা পুরো তুলে দে।
দিচ্ছি গুরু।
প্রবলেমের কথাটা শুনতে চাস? তোকে বলেই বলছি।
বল না।
কাউকে বলবি না। বাবা রিসেন্টলি এনিমি প্রপার্টির অনেক টাকা পেয়ে গেছে। কয়েক লাখ টাকা।
এনিমি প্রপার্টি? সেটা কী জিনিস?
ধুস শালা! ইস্টবেঙ্গলে আমাদের মেলা প্রপার্টি ছিল না?
ওঃ, সে প্রপার্টি!
সেই প্রপার্টি।
টাকা পেলে আর প্রবলেমের কী?
আছে। টাকাটা আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হওয়ার কথা।
তোর ভাগে কত পড়বে?
ঠিকমতো ভাগ হলে অনেক। কিন্তু হচ্ছে না।
কেন?
বাবারা যে চার ভাই। দলিল বাবার কাছে ছিল বলে বাবা পেয়ে গেছে। কিন্তু টের পেয়ে আমার জ্যেঠতুতো ভাইরা অবজেকশন দিয়েছে।
গাড্ডা। কিন্তু তোর বাপ ঠিক বেরিয়ে আসবে। খচ্চর লোক।
ধ্রুব মাথা নাড়ে। বলে, পারছে না। বহুত গাড্ডা। এখনকার আইনের অনেক প্যাঁচ। বাপের প্রপার্টিতে মেয়েদেরও দাবি আছে। তাই পিসিরাও নেমে পড়েছে।
তোর বাপ তা হলে করছে কী?
বাবা খুব খেপে আছে। আমি ভেবেছিলাম এ টাকাটা হাতে পেলে কেটে পড়ব। একদম হাওয়া হয়ে যাব।
কোথায় যাবি?
যেখানেই যাই, তোর বাপের কী? —ধ্রুব ধমকে ওঠে।
প্রশান্ত খিলখিল করে হাসে, ন্যাকড়াবাজি শালা?
ধ্রুব সিগারেটে একটা টান মেরে বলে, আরে বাবা, এ সেই বাড়ি থেকে পালানো নয়, আমার বাবাও সিরিয়াসলি চাইছে, আমি কেটে পড়ি।
মাইরি?
চাইবেই। আফটার অল হি ইজ এ লিডার। আমি থাকলে বাবার কনস্ট্যান্ট হেডেক। আমাকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা একটা অ্যারেনজমেন্ট করেছিল। নাসিকে বাবার এক বন্ধু আছে। তার সঙ্গে আমাকে ভেড়াতে চাইছে বাবা। আমি বাবাকে বলেছি, রাজি আছি তবে লাখ দুই টাকা ছাড়ুন।
দু লাখ! সে তো অনেক টাকা!–প্রশান্ত চোখ বড় করে।
দুর শালা! ঘরের টাকা নাকি? বাবা তো এনিমি প্রপার্টির টাকাটা ফালতু পেয়ে গেছে। সেটা থেকেই দেওয়ার কথা ছিল। ঘরের টাকা হলে বাবা রাজি হত নাকি?
সে কেসটা তো বিলা হয়ে গেছে বলছিস!
হ্যাঁ। দারুণ কিচান হচ্ছে। মামলা-টামলাও হতে পারে। তবে বাবাকে সবাই ভয় খায় বলে এখনও তেমন কিছু করছে না।
তোর বাবা পুরো টাকাটা ঠিক হজম করে দেবে। লিডাররা সব পারে।
যা বুঝিস না, জানিস না, তা নিয়ে কথা বলিস কেন?
এ আর না বোঝার কী আছে গুরু?
আছে। সম্পত্তিটা আসলে বাবারই ছিল। শেষ বয়সে দাদু বাবার নামে সব লিখে দিয়ে যায়। উইলের প্রবেটও আছে। কিন্তু উইল কেউ মানছে না বলে ঝামেলা। বাবা সকলের সঙ্গে নেগোশিয়েসন চালাচ্ছে, আত্মীয়দের বলছে, কিছু ছাড়ছি, তোমরা মেলা ঝামেলা কোরো না।
তোর বাপকে সব দিয়ে গেল কেন?
বাবা ছিল যাকে বলে ড্যাডিজ ব্লু আইড বয়। সে অনেক কথা। আমাদের ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার তোর অত জানার কী দরকার?
প্রশান্ত একটা হাই তুলে বলে, কে জানতে চাইছে গুরু? তখন থেকে তুইই তো ফ্যাচ ফ্যাচ বকে যাচ্ছিস। আমার মাথা ধরে গেছে। পাকিস্তানে তোদের ক পহার সম্পত্তি ছিল রে? তোর বাপ লিডারি করে তার চেয়ে ঢের বেশি কামিয়েছে। ওসব বাত ছোড়।
কামিয়েছে তা কী? আমার বাবা সাফারও করেছে। হি ওয়াজ এ পোলিটিক্যাল সাফারার।
প্রশান্ত আবার খিক খিক করে হেসে বলে, জানি বাবা জানি। ব্রিটিশ আমলে তিন দিন যে জেল খেটেছে তারও এখন রবরবা। তামার তকমা পাচ্ছে, মাসে মাসে পেনসন। বিজঘুট্টি কারবার। ওয়াঃ ওয়াঃ।
মুড়ি মিছরির কি এক দর রে শালা? আমার বাবার নাম স্বাধীনতার ইতিহাসেও লেখা আছে। পড়ে দেখিস। বাপ তুলে কথা বলিস শালা? আমার বাপ যখন জেল খাটছে তখন তোর বাপ কী করত জানিস? ধুতির মধ্যে শার্ট খুঁজে পরে হাফ সাহেব সেজে সাহেবদের তেল দিত। ইয়েস স্যার, নো স্যার, ভেরি গুড স্যার।
প্রশান্ত একটু মাথা চুলকে বলে, তা হতে পারে। তবে আমাদের ফ্যামিলিতে অত ঝুট ঝামেলা নেই। ফালতু কেউ চুলকে ঘা করতে যেত না।
চামচা ফ্যামিলি।
ঠিক কথা। কিন্তু স্ট্রেট ফ্যামিলি। চামচা তো সবাই চামচা। তোর ফ্যামিলিটা জগাখিচুড়ি, একটা চামচা, একটা বিপ্লবী, একটা কেপ্লন তো আর-একটা হাড় বজ্জাত।
সবচেয়ে বজ্জাত কোনটা জানিস?
কোনটা?
লালটুদা।
আরে বাবা! যে লোকটা ইস্টবেঙ্গলে খেলত সে-ই না?
সে-ই। এখন ব্যাংকের অফিসার। সাপের পাঁচ পা দেখেছে।
বহোত খানেপিনেওলা লোক মাইরি।
খায়। আবার খাওয়ায়ও। ওসব ঠিক আছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে যে সবচেয়ে বেশি লড়ে যাচ্ছে সে হল লালটুদা।
প্রশান্ত হঠাৎ একটু ঝুঁকে রাস্তাটা দেখে নিয়ে ড্রাইভারকে বলে, আরে ব্যস, ব্যস। আমার গাড়ায় এসে গেছে।
ট্যাকসি থামে। প্রশান্ত নেমে যায়। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলে, গুড নাইট গুরু! ফির মিলেঙ্গে।
চোখ বুজে মাছি তাড়ানোর মতো একবার হাত নাড়ে ধ্রুব। কোথায় যেতে হবে ড্রাইভার জানে। সুতরাং সে আর বাকি রাস্তাটা মুখ খোলে না।
ধ্রুব যখন তাদের কালীঘাটের বাড়ির সামনে এসে ট্যাকসি থেকে নামে তখনও তিনতলার একটা ঘরে আলো জ্বলছে। অনেক রাত পর্যন্ত সেই ঘরে আলো জ্বলে।
বাড়ির সামনে একটু বাগান আছে। ফটক পেরিয়ে ঢুকলে ঘোরানো রাস্তা। তারপর গাড়িবারান্দা। সিঁড়ি, বৈঠকখানা। বাড়িটার চেহারা বেশ পয়মন্ত। নিজেদের বাড়ি হলেও ধ্রুব মাঝে মাঝে নিরপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তির চোখে বিচার করে দেখেছে। তার মনে হয়েছে, এ বাড়ির মালিকের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় টিকে থাকার মতো এলেম আছে।
বৈঠকখানার দরজায় জগাদা দাঁড়িয়ে। মাথায় সেকেলে লেঠেলদের মতো ঝাকড়া চুল। জোয়ান চেহারা। গায়ে এই শীতকালেও একটা ফরসা গেঞ্জি আর ধুতি। বয়স ষাটের ওপরে হবে, কিন্তু বিপুল স্বাস্থ্যে চাপা পড়ে বয়স চি চি করছে।
আরে জগাদা!
জগা এক ধরনের নিষ্পলক চোখে তাকে দেখছিল। এখন জগাকে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। ধ্রুবর। তবে সে যখন ছোট ছিল, এবং জগাদা যখন আরও কমবয়সি এবং আরও স্বাস্থ্যবান তখন চড়-চাপড়টা মাঝে মাঝে খেতে হত। আশ্চর্য এই, এ বাড়ির কাজের লোক হয়েও জগাদার সেই অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করত না। এখন আর ভয় খায় না ধ্রুব, বরং পিছনে লাগে।
জগা বললে, এতক্ষণে এলে?
খুব রাত হয়ে গেছে নাকি? —ধ্রুব একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলে।
জগা মাথা নেড়ে বলে, ফুর্তির পক্ষে রাত হয়নি মোটেই। কিন্তু আজকের দিনটা রাত না করলেও পারতে।
কেন, আজ কী?
আজ কী সে তো তোমারই জানার কথা।
ওঃ!–ধ্রুব মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বলে, সব ব্যাপারে তোমরা অত সিরিয়াস কেন বলল তো! দুনিয়াটা গোমড়ামুখোয় ভরে গেল মাইরি।
জগা একটু চাপা গলায় বলে, জোরে কথা বোলো না। বাড়িসন্ধু সবাই জেগে আছে।
কেন? জেগে আছে কেন? আমার বিচারসভা বসবে নাকি?
সে কে জানে। তুমি ঘরে যাও! বেশি শব্দসাড়া কোরো না।
যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। চতুর্দিকে এত গার্জিয়ান থাকলে বড় মুশকিল। তোমাকে এখানে খাড়া থাকতে বলেছে কে?
কেউ বলেনি। তুমি ঘরে যাও।
জগাদা, তুমি কি এখনও এ বাড়ির চাকর?
জগা একটু হাসে, তোমার কী মনে হয়?
মনে হয় তুমি চাকর হয়েই জন্মেছ। এ জন্মে আর স্বভাবটা ছাড়তে পারবে না।
না হয় নাই পারলাম।
কেন পারছ না? ম্যাকিনেল বেরীতে তুমি আটশো টাকা মাইনেব চাকরি করো। বাগনানে তোমার জমিজিরেত বউ-বাচ্চা আছে। এই সমাজব্যবস্থায় তুমি যথেষ্ট ভদ্রলোক, তবু চাকরের মতো হাবভাব কেন?
চেঁচিয়ো না, বলছি না, সবাই জেগে আছে।
ধ্রুব চট করে জিভ কেটে বলে, তাই তো। ভুলে যাচ্ছিলাম। আসলে তোমাকে দেখলে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি না। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি এ বাড়ি তোমার রক্ত মজ্জা মেদ মাংস শুষে খেয়েছে। তোমার গায়ে, চরিত্রে, স্বভাবে স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে চাকর বলে। আমার চোখের সামনে একবার তোমাকে সোনাজ্যাঠা চটিপেটা করেছিল। আজও তবে কেন তুমি এ বাড়ির গোলামি করো? তোমার ভিতরে আগুন নেই? বিদ্রোহ নেই?
একতলার একটা লম্বা প্যাসেজ পেরোচ্ছিল তারা। অনেকগুলো সারিবদ্ধ ঘর। বেশির ভাগই খালি এবং তালা দেওয়া। শেষ প্রান্তের ঘরটায় আলো জ্বলছে। এ ঘরটাই ধ্রুবর। ধ্রুবর একার। তার বউ এ ঘরে থাকে না। এখন অবশ্য সে নার্সিংহোমে।
জগা কথা বলছিল না। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল শুধু।
ধ্রুব নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জগার দিকে ফিরে বলল, ভাঙো জগাদা, ভাঙতে শুরু করো।
কী ভাঙব?
এ বাড়ির বনিয়াদ। হাতের কাছে যা পাও তাই দিয়েই ভাঙতে শুরু করে। বাড়ি ভাঙো, মানুষ ভাঙো, সিস্টেম ভেঙে উড়িয়ে দাও।
জগার কাছে এসব কথা নতুন নয়। বহুবার শুনেছে। পেটে জিনিস পড়লেই ধ্রুব একটু বিপ্লবী হয়ে যায়। জগা হাত ধরে ধ্রুবকে ঘরে টেনে ঢোকাল। তারপর দরজাটা আবজে দিয়ে বলল, আজকের দিনটা বাদ দিতে পারলে না? তোমার আজ প্রথম ছেলে হল!
কার ছেলে? আমার? মাইরি জগাদা, সব জেনেশুনে তুমিও একথা বললে!
চুপ!–আচমকাই জগা একটা বাঘা গর্জন করে ওঠে।
ধ্রুব দুপা পিছিয়ে যায়, কী যে চেঁচাও না! মাথা ধরে যাচ্ছে! চেঁচাচ্ছ কেন? এমন কী বলেছি?
যা বলেছ তা আর বোলো না।
কেন বলব না?
জগা একটা গভীর হতাশার চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, বউমার অবস্থা ভাল নয়।
তার মানে?
নার্সিংহোম থেকে একটু আগেই টেলিফোন এসেছে। ছোটবাবু খবর পেয়েই চলে গেছেন।
ধ্রুব চুপ হয়ে যায়। তার আর কিছু বলার থাকে না।
০০৩. কিশোরী রঙ্গময়ি
চোখের পলকে অবস্থাটা বুঝে নিয়েছিল কিশোরী রঙ্গময়ি। মেয়েদের বাস্তববুদ্ধি একটু বেশিই দেন বিধাতা। রঙ্গময়ি বুঝেছিল, ওই বন্ধ কপাট তার জীবনের সব সম্ভাবনার পথে খিল তুলে দিল। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল বন্ধ দরজার ওপর। চেঁচানোর উপায় নেই, করাঘাত করা বিপজ্জনক। দরজায় মৃদু কিল দিতে দিতে সে চাপা গলায় বলতে লাগল, দরজা খোললা, পিসি, দরজা খোলো! ও পিসি…
নলিনীকান্ত বজ্রাহতের মতো বসে অবাক চোখে দৃশ্যটা দেখছিল, কিছুক্ষণ সে বোধহয় মানুষ ছিল না, পাথর হয়ে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী হয়েছে বলো তো! কে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করল?
রঙ্গময়ি তখনও থরথর করে কাঁপছে। নলিনীকে তার ভয় ছিল না। সে জানত, নলিনী নারীমুখী নয়। মেয়েমানুষের প্রতি তার কোনও আগ্রহ নেই। রঙ্গময়ির ঢের বেশি ভয় সমাজকে, কলঙ্ককে। কাপতে কাপতে জ্বরগ্রস্ত রুগির গলায় সে বলল, পিসি, আমার পিসি। ওপাশে শেকল তুলে দিয়েছে।
কেন? বাইরে থেকে শেকল তুলে দেওয়ার মানে কী?
জানি না। আপনি দরজাটা খুলে দিন।
নলিনী অনুচ্চ স্বরেই কথা বলছিল। কিন্তু সেই মৃদু স্বরও রাগে থমথম করে উঠল, এত রাতে তুমিই বা আমার ঘরে এলে কেন?
রঙ্গময়ি সেই রাগের আভাস দেখেই অপরাধবোধে কেঁদে ফেলল। ভাঙা বিকৃত গলায় বলল, আমি তো আসিনি। পিসি বলল, আপনার কিছু দরকার আছে কি না জিজ্ঞেস করতে। পিসি সঙ্গে এসেছিল।
হঠাৎ নলিনীর মুখ রুদ্ধ রোষে টকটকে লাল হয়ে গেল। বলল, তোমার পিসি?
হ্যাঁ, আমি কিছু জানি না।
নলিনী রাগলেও সেই রাগ রঙ্গময়ির ওপর প্রকাশ করল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে সম্ভবত পরিস্থিতিটা একটুক্ষণ ভেবে নিল। তারপর হঠাৎ হাসল। তার হাসি বরাবর সুন্দর। অমলিন, সরল। দাঁতের ঝিকিমিকির ভিতর দিয়ে তার হৃদয় দেখা যেত।
মাথাটা একটু নেড়ে সে বলল, এভাবে কি হয়?
রঙ্গময়ি ভীত গলায় বলল, কী হয়?
নলিনী মাথাটা আগের মতোই নাড়তে নাড়তে বলল, এভাবে হয় না। তোমার পিসিকে সুযোগমতো বোলো, এভাবে হয় না। তুমি বড় ছোট, ঠিক বুঝবে না। তোমার পিসি ভুল করেছেন।
আপনি দরজাটা খুলে দিন।
ভয় পেয়ো না রঙ্গময়ি। চেয়ারটায় বোসো। দেখি আমি কী করতে পারি।
রঙ্গময়ি আর্ত গলায় বলল, পিসি দরজা বন্ধ করে দিল কেন?
সেটা তোমার পিসিকেই জিজ্ঞেস কোরো। তিনি যদি বলতে নাও চান তা হলেও ক্ষতি নেই, রঙ্গময়ি। বয়স হলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।
রঙ্গময়ি হয়তো বুঝতে পারছিল, আবার পারছিলও না। কিশোরী বয়সের বয়ঃসন্ধি। আলো-আঁধারির সময়। পিসি একটা অঘটন ঘটাতে চাইছে, টের পাচ্ছিল সে। কিন্তু কেন, তা ভেবে তার মাথা কুল-কিনারা হারিয়ে ফেলছিল। এত রাতে একা পরপুরুষের ঘরে কী করে পিসি ঠেলে দিতে পারে তাকে?
তবে নলিনীকে রঙ্গময়ি জানত। এ পুরুষ বটে, কিন্তু বিপজ্জনক নয়। না, কথাটা ঠিক হল না। নলিনী হয়তো বা বিপজ্জনকই ছিল। পরবর্তী কালে তার জীবনের একটা গোপন দিক প্রকাশ হওয়ার পর সেটা জানা গিয়েছিল। কিন্তু সেই বিপদ মেয়েদের জন্য নয়, ইংরাজদের জন্য। তাই রঙ্গময়ির সেই রাতে ভয় করেনি। লজ্জা ও আত্মগ্লানিতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে গিয়ে নলিনীর টেবিলের সামনে কাঠের চেয়ারে বসল।
বুদ্ধিমান নলিনী দরজা খুলবার চেষ্টা করল না। শান্তভাবে ফিরে এসে সেও বসল নিজের চেয়ারে। রঙ্গময়ি দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। নলিনী ধীর স্বরে বলল, দরজার পাল্লাটা খুব ভারী। জোর করে খুলতে গেলে শব্দ হবে। কাউকে তো এ অবস্থায় ডাকাও যায় না।
রঙ্গময়ি ভীত স্বরে বলল, তা হলে?
তোমার পিসি খুব নিশ্চিন্তে বসে থাকবেন না নিশ্চয়ই। এক সময়ে এসে ঠিকই দরজা খুলে দেবেন। ততক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সে কতক্ষণ?–রঙ্গময়ি আকুল গলায় প্রশ্ন করে।
নলিনী তেমনি ঝকঝকে হাসি হেসে বলে, তোমার পিসির তো মাথায় গোলমাল। বিকারগ্রস্ত লোক। তিনি কখন এসে দরজা খুলবেন তা কে জানে! হয়তো একা আসবেন না, সঙ্গে লোক জুটিয়ে আনবেন।
লোক জোটাবেন কেন?
তুমি বড় বোকা, রঙ্গময়ি। আমার যতদূর ধারণা, উনি তোমাকে আর আমাকে ফাদে ফেলতে চাইছেন।
সর্বনাশ!
নলিনী মাথা নেড়ে বলল, কিছু সর্বনাশ নয়। চিন্তা কোরো না। বসে বসে বই পড়ো বরং। কী পড়বে? বঙ্কিম?
রঙ্গময়ির বই পড়ার মতো মনের অবস্থা নয়। সে মাথা নেড়ে জানাল, বই পড়বে না।
তা হলে কী করবে?
বসে থাকব। ওই জানালাটার শিক ভাঙা যায় না?
যায়। তবে তার জন্য একটা ছোটখাটো হাতি লাগবে। দেখছ তো, কী মোটা শিক!
রঙ্গময়ি ভারী হতাশ হয়ে আবার মুখ ঢাকল। ফোঁপাতে লাগল।
নলিনী এবার আর তাকে বাধা দিল না। কাঁদতে দিল। নিজে যে বইখানা পড়ছিল সেটা ফের তুলে নিয়ে চঞ্চলভাবে পাতা ওলটাতে লাগল। কিন্তু পড়ার মতো মনের অবস্থা নয়। এক সময়ে বইটা টেবিলে রেখে শান্তভাবে রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে বলল, মানুষের মনের নোংরামি দেখলে আমার ভারী ঘৃণা হয়। পৃথিবীতে তোমার পিসির মতো মানুষের কোনও প্রযোজন নেই, তবু এরা জন্মায় কেন বলো তো?
রঙ্গময়ি কী জবাব দেবে? তার পিসি কনকপ্রভা খারাপ না ভাল তা সে কখনও বিচার করে দেখেনি। পিসি পিসিই। কোলেপিঠে করে তাদের মানুষ করেছে। আদরে সোহাগে শাসনে। শুদ্ধাচারী বিধবা। তার বিচার রঙ্গময়ি কি করতে পারে? তাই কথাটা তার কানে লাগল। কিন্তু পিসির পক্ষ হয়ে তো কিছু বলারও নেই। তাই চুপ করে নখ দিয়ে টেবিলক্লথের এমব্রয়ডারির একটা ফেঁড় খুঁটতে লাগল সে।
নলিনী উঠে চঞ্চল পায়ে পায়চারি করতে করতে বলল, তোমার পিসি এর আগে আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাবও এনেছেন। আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বলেছি, বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কখনও নাবীচিন্তা করি না। সংসারধর্ম পালনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। তোমার পিসি সেটা শুনেছেন, কিন্তু বিশ্বাস করেননি।
একথা শুনে রঙ্গময়ির মরে যেতে ইচ্ছে করছিল লজ্জায়। পিসি তার অজান্তে এত কাণ্ড করেছে, সে জানত না। টেবিলের দিকে আরও ঝুঁকে পড়ল সে।
নলিনী বলল, তিনি ভাবলেন আমি বোধহয় গরিবের মেয়ে বলেই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি নই। আশ্চর্য! গরিবিয়ানা তো একটা অবস্থার ভেদ মাত্র। নিত্য পরিবর্তনশীল সমাজে ধনী ও দরিদ্র কারও স্থায়ি পরিচয় তো নয়। তা ছাড়াও একটা কথা আছে রঙ্গময়ি।
রঙ্গময়ি এক পলক তাকাল নলিনীর দিকে। তারপর আবার মুখ নামিয়ে নিল।
নলিনী ধীর স্বরে বলল, তোমাকে বা আর-কোনও মেয়েকে আমার কোনওদিনই বিয়ে করার সম্ভাবনা নেই। আমি ভিন্নতর এক কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
রঙ্গময়ির বুক কাঁপছিল। ভয় সব সময়ই অজানাকে ঘিরে। সে তো জানে না নলিনী কী জিজ্ঞেস করবে। সে শক্ত হয়ে রইল।
নলিনী জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কারও প্রতি আসক্ত, রঙ্গময়ি?
রঙ্গময়ি আকাশ থেকে পড়ল। আসক্ত? কই না তো! কিন্তু তবু তার মুখ রাঙা হয়ে উঠল লজ্জায়। কণ্ঠ রোধ হল। এ কী কথা! এ কেমন কথা!
নলিনী তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিল।
রঙ্গময়ি মাথা নেড়ে জানাল, না।
নলিনী মৃদু স্বরে বলল, তুমি হয়তো জানো না। বয়স কম বলে হয়তো আসক্তিটা ঠিক বুঝতেও পারছ না। এমন কি হতে পারে?
আপনি এসব কী বলছেন?–রঙ্গময়ি আর্তনাদ করে ওঠে।
তোমাকে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য বলছি না। আমি বলছি, কোনও মেয়ে যদি কোনও পুরুষের প্রতি আসক্ত হয় এবং বর্ণে, ধর্মে, শিক্ষায় দীক্ষায় যদি মিল থাকে তবে তাকেই তার বিয়ে করা উচিত। যদি বিবাহ সম্ভব নাও হয় তবে অন্য কোনও পুরুষকেও তার গ্রহণ করা উচিত নয়।
রঙ্গময়ি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। মাথা তুলতে পারল না। বুকের মধ্যে একটা ঝোড়ো বাতাসের দোলা। সেই বয়ঃসন্ধির সময়ে তার কোনও বোধবুদ্ধিই পরিণত ছিল না। মনে একটা আলো-আঁধারির আবহাওয়ায় কত চিন্তার ছবি ভেসে যেত। সত্য বটে, সেই বয়সে যখন তার বিয়ের কথা চলছে তখন সে মাঝে মাঝে তার সম্ভাব্য স্বামীর রূপ কল্পনা করেছে। কিন্তু সেই রূপ, সেই চেহারা ছিঃ ছিঃ। রঙ্গময়ি দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল অপ্রতিরোধ্য লজ্জায়। কিন্তু সেই গভীর গোপন কথা তো আর কারও জানা সম্ভব নয়।
নলিনী মৃদু স্বরে বলল, তোমাকে কিছু বলতে হবে না রঙ্গময়ি। কেউ কিছু জানবে না। আমি তোমাকে খুবই স্নেহ করি। মাঝে মাঝে আমার মনে ইচ্ছে হয় তোমাকে একজন আদর্শ নারী হিসেবে প্রস্তুত করে দিই। কিন্তু সেটা হয়তো আর সম্ভব নয়। এখন থেকে তোমার সংস্রবও আমাকে এড়িয়ে চলতে হবে। তবে একটা কথা বলি, বয়সকালে তোমার প্রখর ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটবে। সেই তেজ। তোমার মধ্যে আছে। কিন্তু যার প্রতি তোমার এক রহস্যময় আকর্ষণ জন্মেছে সেই পুরুষটি ব্যক্তিত্বহীন। যদি সম্ভব হয় তবে তাকে পাহারা দিয়ে রেখো।
নলিনী সেই পুরুষটির কথা আর ভেঙে বলেনি। তবে রঙ্গময়ি অনেকক্ষণ বাদে চোখের ঢাকনা খুলে যখন টেবিলক্লথের নকশার দিকে অবোধ চোখে চেয়ে ছিল তখন তার মনে হয়েছিল, নলিনী বোধহয় অন্তর্যামী।
নলিনী তার চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসল, অনেক শান্ত সে। স্থির। বলল, কনকপ্রভাকে বোলো আমাকে বাঁধা তার পক্ষে সম্ভব নয়, কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। নারীমাত্রই আমার কাছে মা।
একথায় চমকে উঠেছিল রঙ্গময়ি। নলিনী যুবাপুরুষ। বংশের ধারা অনুযায়ি তার চেহারাও সুন্দর ও সুঠাম। সুপুরুষ এক যুবা পৃথিবীর সব নারীকেই মা ভাবে, এ কেমন অলক্ষুনে কথা? নলিনীর সবকিছুই একটু অন্যরকম বটে, কিন্তু এতটাই যে অন্যরকম তা রঙ্গময়ির জানা ছিল না। কথাটা শুনে রঙ্গময়ি হঠাৎ নলিনীর মুখের দিকে চাইতে আর সংকোচ বোধ করল না।
নলিনী মৃদু একটু হাসি মাখানো মুখে বলল, তুমিও আমার মা।
অস্ফুট একটা শব্দ করল রঙ্গময়ি। তবে বাবা শব্দ, ভাষা ছিল না তাতে। একটা ঘোর ঘোর আচ্ছন্নভাবের ভিতর থেকে নলিনী বলল, মাতৃভাব হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত না হলে স্ত্রীলোককে ছুঁতে নেই। যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল, এমনকী মুখদর্শন না করা আরও ভাল। কিন্তু এইভাবে ভাবিত হওয়া খুব সহজ নয়। বুকের জোর চাই। ফল পাকলেই যেমন পাখিতে ঠোকরাতে শুরু করে আমার এখন তেমন অবস্থা। কেন এত জ্বালায় বলো তো সবাই! আমাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না।
রঙ্গময়ি তার রুদ্ধ কণ্ঠে অতি কষ্টে বলল, কারা জ্বালায় আপনাকে?
নলিনী ঘোর-ঘোর আচ্ছন্ন ভাব থেকে জেগে উঠে মৃদু হেসে বলল, যে সুযোগ পায় সে-ই। এই তো দেখো না, তোমার পিসি কী কাণ্ডটাই করে গেছে। কনকপ্রভার মাথার ঠিক নেই। কত কাণ্ডই যে সে কর।
রঙ্গময়ি উদগ্রীব হয়ে বলল, কী কাণ্ড?
নলিনী একথার জবাব দিল না, শুধু মৃদু মৃদু রহস্যময় হাসতে লাগল। অনেক পরে বলল, বালবিধবার বড় কষ্ট।
রঙ্গময়ি বোকা নয়। নলিনীর কথার মধ্যে যে গভীরতার ইঙ্গিত ছিল তা বুঝল সে। কিন্তু আর প্রশ্ন করল না। তবে নিজের পিসি সম্পর্কে যে কৌতূহলহীন নির্বিকারত্ব ছিল, সেটা কেটে গেল। কনকপ্রভাকে সুন্দরী বলা চলে না। তবে পূর্ণ যুবতী এই মহিলার মধ্যে যৌবনোচিত আকর্ষণ কিছু কম ছিল না। সে থান পরে, নিরামিষ সামান্য কিছু ব্যঞ্জন দিয়ে অবেলায় পাথরের থালায় দিনে একবার মাত্র ভাত খায়, আচার-বিচার মেনে চলে। সে রূপটান মাখে না, সাজে না। কিন্তু তবু তার দুকূল ছাপানো যৌবনও তো ক্রিয়াশীল। তার খাজনা মেটাতে পিসি কোনও পন্থা নিয়েছে কি? রঙ্গময়ি উদগ্রীব হল জানতে। তবে সরাসরি প্রশ্ন করল না। মৃদু স্বরে বলল, পিসি আজ খুব খারাপ কাজ করেছে।
নলিনী হেসে হেসেই বলল, হ্যাঁ, খুব খারাপ। যদি আমি ইচ্ছে করি তবে এর জন্য তোমাদের হয়তো এই বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিতে পারি। অন্তত কনকপ্রভাকে তো বটেই।
রঙ্গময়ি এই দিকটা ভেবে দেখেনি। নলিনী পরোপকার করে বেড়ায়, দেশের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কখনও জমিদারের মতো ব্যবহার করে না কারও সঙ্গে। এ সবই ঠিক। কিন্তু তবু সে তো এই বংশেরই ছেলে। ইচ্ছে করলে সামান্য পুরোহিতকে উচ্ছেদ করা তার পক্ষে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। রঙ্গময়ি তাই ভয়ে একটু জড়োসড়ো হয়ে গেল। মৃদু স্বরে বলল, আমাদের তো কোনও দোষ নেই। পিসি…।
নলিনী মাথা নেড়ে বলল, আমাকে কিছু বলতে হবে না রঙ্গময়ি। আমি তোমাদের তাড়াব না। কনকপ্রভাও যেমন আছে থাকুক। তবে আমাকেই হয়তো দূরে সরে যেতে হবে।
রঙ্গময়ি ব্যাকুল হয়ে বলল, আপনি যাবেন কেন? আপনি যাবেন না। এরকম আর হবে না। আমি পিসিকে বলব।
বলে লাভ নেই। বললাম না, তোমার পিসির মাথার ঠিক নেই। হুট করে আবার হয়তো আর-একটা বিপজ্জনক কাণ্ড করে বসবে।
হঠাৎ অত্যন্ত দুঃসাহসভরে বুদ্ধিমতী রঙ্গময়ি প্রশ্ন করল, আপনি তো সবাইকেই মা বলে ভাবেন, পিসিকে ভাবতে পারেন না?
কেন এই কথাটা সে বলল তা রঙ্গময়ি আজও সঠিক জানে না। মানুষের মন বড়ই রহস্যময়। কোনও গন্ধে গন্ধে তার অনুভূতিশীল মনের মধ্যে এইরকম একটা সন্দেহের বীজ অংকুরিত হয়ে উঠেছিল হঠাৎ।
নলিনী গম্ভীর হয়ে উঠতে পারত, রেগেও যেতে পারত। কিন্তু হল ঠিক উলটো। সামান্য শব্দ করে হেসে ফেলল সে, চোখে হঠাৎ একটু বিস্ময়বোধও ফুটে উঠল তার। সে বলল, তুমি বড় পাজি মেয়ে। বুদ্ধিও রাখো।
রঙ্গময়ি বায়না ধরার গলায় বলল, না। আগে বলুন, আপনি যাবেন না!
নলিনী বলল, শুধু এই কারণই তো নয়। আমাকে যে অন্য কাজের জন্যও দূরে চলে যেতে হতে পারে।
রঙ্গময়ি কথাটা বিশ্বাস করল না। বলল, না, আপনি আমাদের জন্যই চলে যেতে চাইছেন। আমি পিসির কথা বাবাকে বলে দেব। বাবা বকে দেবে।
নলিনী বলল, অত কিছু করতে হবে না।
তা হলে বলুন, আপনি যাবেন না।
আগে তুমি একটা কথার জবাব দাও। তোমার পিসিকে আমি মা বলে ভাবতে পারি না একথা তোমার মনে হল কেন?
রঙ্গময়ি লজ্জায় অপোবদন হয়ে বলল, আমি সেভাবে বলিনি।
তা হলে কীভাবে বলেছ?
আমি কিছু ভেবে বলিনি। হঠাৎ কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
নলিনীর উজ্জ্বল চোখে কৌতুক খেলা করছে। সে লঘু গলায় বলল, না কি আমার কথাটা তোমার বিশ্বাস হয়নি! আমি পৃথিবীর সব মেয়েকেই মা বলে ভাবতে পারি এটা অবশ্য অনেকেরই কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়।
রঙ্গময়ি তখন শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছে।
নলিনী অবশ্য আর ঘাঁটাল না। একটা হাই তুলে বলল, কনকপ্রভাও তাই ভাবে। মেয়েদের প্রতি মাতৃভাবটা একটা ভড়ং মাত্র। কনকপ্রভা মা ডাক শুনতে ভালবাসে না।
রঙ্গময়ি চুপ।
নলিনী বলল, এবার ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো গে যাও।
রঙ্গময়ি বলল, যাব? দরজা যে বন্ধ।
নলিনী মৃদু হেসে বলল, বন্ধ ছিল। এখন আর নেই। তোমার পিসি বোধহয় দরজায় শিকল তুলে এতক্ষণ কান পেতে আমাদের কথা শুনছিল। তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি দেখে এইমাত্র শিকল খুলে চলে গেছে। তুমি শব্দ পাওনি, কিন্তু আমি পেয়েছি। খালি পায়ে সে যে বারান্দা পেরিয়ে চলে গেল তাও টের পেয়েছি।
রঙ্গময়ি উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়ে পাল্লা টানতেই সেটা খুলে এল। রঙ্গময়ি একটু দ্বিধাজড়িতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, যাই?
যাও।
আর আসব না কখনও?
আসবে না কেন? তবে রাতবিরেতে নয়।
রঙ্গময়ি ধীর পায়ে বেরিয়ে আস্তে আস্তে চলে এল ঘরে। পিসিব সঙ্গেই এক বিছানায় সে শোয়। বিছানায় পিসি ওপাশ ফিরে শুয়ে ছিল। রঙ্গময়ি লেপ দিয়ে মুখ ঢেকে চুপ করে জেগে পড়ে রইল বিছানায়। ঘুম আসার কথা নয় সহজে। শুয়ে শুয়ে টের পেল, পিসি কাঁদছে। ফুলে ফুলে।
রঙ্গময়ি কোনও প্রশ্ন করল না। তার চোখও তখন ভেসে যাচ্ছে জলে।
আজ ঘোড়ার গাড়িতে হেমকান্তর মুখোমুখি বসে রঙ্গময়ির সেই রাতের কথা মনে পড়ে। শুধু আজ নয়, এতদিন ধরে প্রায় রোজই কখনও না কখনও সেই অদ্ভুত রাত্রিটির স্মৃতি এসে হানা দিয়েছে।
নির্জন সন্ধ্যা। ব্রহ্মপুত্রের ওপর প্রগাঢ় কুয়াশা জমে আছে। নদীর ধার দিয়ে ইট-বাঁধানো এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি চলেছে। কুয়াশায় মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে বড় বড় গাছের ভুতুড়ে চেহারা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। জোনাকি পোকার ফুলঝুরির মতো থোকা থোকা আলো ছাড়া নদীর দিকটায় আর কোনও আলো নেই। কুয়াশা না থাকলে নদীর ওধারে শম্ভুগঞ্জের পতিত জলা জমিতে দপদপিয়ে উঠতে দেখা যেত আলেয়ার অদ্ভুত আলো। জলে পাট ও মুলি বাঁশ পচছে। তার কটু গন্ধে বাতাস মন্থর। এই ব্রহ্মপুত্রেরই কোনও বাকে নলিনীর প্রাণহীন দেহ পাওয়া গিয়েছিল। সেও কবেকার কথা। তবু মনে পড়ে।
রঙ্গময়ি তার পাশের জানালাটা তুলে দিল। উত্তরে ভয়ংকর বাতাস আসছে। হেমকান্ত জানালা তুলবেন না। বন্ধ কপাট, বন্ধ জানালা হেমকান্তর সহ্য হয় না। অস্থির বোধ করেন তিনি। আজ অস্থিরতা কিছু বেশি। যদিও তার দেহখানি নিস্পন্দ এবং স্থির, চোখ বাইরের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার নিসর্গে মগ্ন, তবু তার অস্থিরতা টের পায় রঙ্গময়ি। বড় বেশি স্বাবলম্বী এবং ততটাই অসহায় এই একটি মানুষ।
কালীবাড়ির গায়ে কতগুলো দোকানের আলো ঝলমলিয়ে মিলিয়ে গেল। গাড়ি বাঁক ফিরছে। নদী চলে গেল চোখের আড়ালে।
হেমকান্ত মুখ ফেরালেন। বললেন, না এলেই ভাল হত।
রঙ্গময়ি মাথা নেড়ে বলে, ভাল হত না। তুমি শক্ত হও।
হেমকান্ত শক্ত হলেন কি না বলা শক্ত। তবে চুপ করে বসে রইলেন। নর্দমার গন্ধের সঙ্গে ঘোড়ার গায়ের গন্ধ মিশে বাতাসটা কিছু ঘোলা। ওডিকোলোনে ভেজানো রুমালটা পকেট থেকে বের করে নাকে চেপে ধরলেন হেমকান্ত।
অন্ধকারে হেমকান্তকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবু রঙ্গময়ি মাঝে মাঝে অস্পষ্ট হেমকান্তর মুখের দিকে চাইছে। বড় দুর্বল এই মানুষটি। আবার খুবই আত্মনির্ভরশীল। রঙ্গময়ি আর কোনও পুরুষমানুষ দেখেনি হেমকান্তর মতো, যার চরিত্রে এমন বিপরীত সব গুণাবলী আছে।
সে বলল, আমরা এসে গেছি। শোনো, আমি গাড়িতেই চুপ করে বসে থাকব। তুমি গিয়ে কোকাবাবুকে দেখে এসো।
একা?
একা কেন? ও বাড়িতে এখন গিজগিজ করছে লোক।
তুমি তো যাবে না।
আমি সঙ্গে না গেলেই কি তুমি একা?
তা বটে।
রঙ্গময়ি মৃদু শব্দে হেসে ফেলে। বলে, লোকে হয়তো কিছু বলবে। আমার না যাওয়াই ভাল।
সহিস নেমে এসে দরজাটা খুলে ধরে আছে। হেমকান্ত ধীরে ধীরে নামলেন।
কোকাবাবুদের বাড়িটা প্রকাণ্ড। সামনে মস্ত ফটক, নহবতখানা। ভিতরে বাগান। তারপর পুরনো আমলের দুই মহলা বাড়ি। ফটক আজ হাঁ হাঁ করছে খোলা। ভিতরে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভিতরে গাড়ি ঢোকাতে আগে থেকে সহিসকে বারণ করে রেখেছিলেন হেমকান্ত। কিন্তু এখন গাড়ি থেকে নেমে তার দ্বিধা এবং জড়তা দেখা দিল।
গাড়ির জানালা দিয়ে নির্নিমেষ চোখে দৃশ্যটা দেখতে থাকে রঙ্গময়ি। ফটক দিয়ে হেমকান্ত ভিতরে ঢুকছে। এক হাতে কোঁচাটি ধরা। ঢুকবার আগে বার দুই ফিরে তাকালেন। হাতে ছড়িটা অনির্দিষ্টভাবে কয়েকবার আস্ফালন করলেন। গলা খাঁকারি দিলেন। যদিও কারুকাজ করা শালে দিব্যকান্তি হেমকান্তকে খুবই অভিজাত দেখাচ্ছে, তবু তার ভাবভঙ্গিতে আজ সহজ স্বাভাবিক ভাবটি নেই। বড় বড় গাছপালায় ভরা বাগানটার মধ্যে মিলিয়ে গেলেন হেমকান্ত।
রঙ্গময়ি তবু যাত্রাপথের দিকে চেয়ে রইল। চোখে কোনও দৃষ্টি নেই। চোখ স্মৃতিভারাক্রান্ত। বহুদিন আগেকার একটা দৃশ্য দেখছে।
সুনয়নী বাপের বাড়ি যাবে বলে ঘাটে বজরা তৈরি। সাজ শেষ করে সুনয়নী এসেছে বিগ্রহ প্রণাম করতে। অনেকক্ষণ উপুড় হয়ে বিড় বিড় করে কী যেন বলো। তারপর উঠে চরণামৃতের জন্য অভ্যাসবশে হাত বাড়াল। তামার পাত্রটি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল রঙ্গময়ি। দিতে গিয়ে কী কারণে কে জানে এক ঝলক পড়ে গেল মেঝেয়।
সুনয়নী উপুড় হয়ে আঁচলে মেঝেটা মুছে নিয়ে বলল, হাত কেঁপে গেল ঠাকুরঝি?
রঙ্গময়ি তটস্থ হয়ে পড়ল। সে জানে তার হাত কঁপেনি। যদি কেঁপে থাকে তবে তা সুনয়নীরই হাত। কিন্তু সে কিছু বলল না।
সুনয়নী উঠে দাঁড়িয়ে রঙ্গময়ির চোখে চোখে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল একটুক্ষণ। বলতে নেই, সুনয়নী ডাকের সুন্দরী। চোখ দুখানা বড় বড়। অনেকক্ষণ সেই দুখানা বড় বড় চোখে চেয়ে নিঃশেষ করে দেখল সে রঙ্গময়িকে। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলল, তোমার সঙ্গে পারলাম না।
কী পারলে না?
তোমার সঙ্গে কি পারা যায়? রঙ্গময়ি কত রঙ্গই জানে।
রঙ্গময়ি হতবাক, বিব্রত, কুণ্ঠিত। বলল, কী বলছ তুমি?
বেরোবার সময় কর্তাকে বললাম, ওগো যাচ্ছি, ভালমতো থেকো। উনি কী বললেন জানো? বললেন, ও নিয়ে ভেবো না। রঙ্গময়ি তো আছে।
রঙ্গময়ি অপ্রতিভ হয়ে একটু হাসল, এই কথা!
এই কথাটুকু বড় কম নয়। অন্য বউ হলে এই ব্যাঙের গর্ত থেকেই চ্যাং মাছ বের করত। যাই, দুজনে রইলে কিন্তু।
এই রহস্যময় ইঙ্গিত সেই প্রথম নয়। আগেও শুনেছে রঙ্গময়ি। বহুবার, নানা প্রসঙ্গে। গায়ে মাখেনি।
সেদিন মাখল। বড় লজ্জা হল, ঘেন্না এল নিজের ওপর।
সেইদিনই বিকেলবেলা হেমকান্ত একা বসে ছিলেন তার কুঞ্জবনে ভাঙা গাড়িটার পাদানিতে। রঙ্গময়ি হানা দিল সেখানে।
শোনো, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
বলো রঙ্গময়ি, বলো। হৃদয়ের অবারিত দ্বার খুলে দাও।
তখন হেমকান্ত ওরকমই ছিলেন। কখনও কখনও তরল আবেগ বেরিয়ে আসত, চটুল ইয়ার্কিও করতেন মাঝে মাঝে।
রঙ্গময়ি ভ্রু কুঁচকে বলল, হঠাৎ এত খুশি-খুশি ভাব কেন? বউ বাপের বাড়ি গেছে, এখন তো তোমার বিরহদশা চলার কথা।
হেমকান্ত মৃদু হেসে বললেন, তা বটে। তবে কী জানো, মাঝে মাঝে একটু বিরহ ভাল। বউ সবসময়ে কাছে থাকলে কেমন একঘেয়ে লাগে।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমার জীবনটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করছ কেন তুমি?
আমি!–হেমকান্ত বিস্মিত, ব্যথিত।
তুমি নও তো আর কে? বউঠান আজ বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় সেইসব ইশারা ইঙ্গিত করে গেল।
কোন সব?
তোমাকে আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে যা রটে।
সুনয়নী তো সেরকম নোংরা মনের মেয়ে নয়।
আহা গো। তোমার বউকে নোংরা মনের মেয়ে বলেছি নাকি? সে কেমন তা আমি ভালই জানি। সেভাবে সে বলেওনি। একটু রসিকতা করেছে। কিন্তু কথাটা আমার আজ লাগল খুব।
হেমকান্ত বিব্রত মুখ করে বলে, কিন্তু আমি তার কী করব বলো তো? সুনয়নী এলে বরং-~-
কী বুদ্ধি! বউয়ের কাছে বলবে যে রঙ্গময়ি তার নামে নালিশ করেছে? বললে আমার মুখ খুব বাড়বে বুঝি?
তা হলে কী করব?
আমাকে দূর করে দাও। সেটাই ভাল হবে।
তোমাকে দূর করার আমি কে? দূর করবই বা কেন?
লোকে মিথ্যে রটাবে আর আমি তাই মুখ বুজে সয়ে যাব চিরকাল? আমার নামে কেন এত মিথ্যে রটনা হবে বলো তো!
হেমকান্তর মুখ শুকিয়ে গেল ভয়ে। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, রাগ কোরো না রঙ্গময়ি। লোকের কথা ধরতে নেই।
রঙ্গময়ির সেদিন বড় জ্বালা করছিল বুক। নলিনীর ঘবে পিসি কনকপ্রভা সেই যে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল এক রাত্রে তার জের সহজে থামেনি। কিছু কান ও চোখ জেগে ছিল ঠিকই। নলিনী যে তাকে না বলে ডেকেছিল তা কে বিশ্বাস করবে? কেবল যুবকের ঘরে নিশুতিরাতে এক কিশোরীর অভিসারটাই ধরে নিয়েছিল লোকে। পাঁচকান হয়ে সে কথা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে গেল। বিনোদচন্দ্র বহু চেষ্টা করেও মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ জোগাড় করতে পারলেন না আর। টাকার জোর থাকলে কলঙ্কের ওপর চুনকাম করা যেত। দুর্ভাগ্যবশে বিনোদচন্দ্রের তাও নেই। নলিনীর মৃত্যুর পর রঙ্গময়িকে আজকাল জড়ানো হয় হেমকান্তর সঙ্গে।
রঙ্গময়ি বলল, লোকের কথা না ধরলে তোমাদের চলে, আমি গরিবের মেয়ে, আমার চলে না। আমি কাল থেকে আর তোমাদের ঘরদোরে যাব না।
যাবে না?
না। যতদিন বউঠান নেই ততদিন না।
লোকে কী বলে রঙ্গময়ি? তোমার আর আমার মধ্যে ভালবাসা আছে?
তাই বলে, লোকে তো জানে না যে, কথাটা কত বড় মিথ্যে!
ব্যথিত ও বিমর্ষ হেমকান্ত উঠে দাঁড়ালেন। শরবিদ্ধ হরিণের মতো কাতর একটা শব্দ করে বললেন, আমার বুকের বাঁ দিকটা বড় ব্যথা করছে, রঙ্গময়ি। আমাকে একটু ধরে নিয়ে ঘরে পৌঁছে দাও।
০০৪. ধ্রুব
খবরটা কতখানি গুরুতর তা বুঝতে খানিক সময় নিল ধ্রুব। ফ্যালফ্যাল করে জগার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, মরে গেছে?
না। তবে অবস্থা খুব খারাপ।
কতটা খারাপ?
আমি অত জানি না। তবে বাবু ফিরে এলে তার কাছে গিয়ে শুনে আসতে পারো।
তুমি আসল খবরটা লুকোচ্ছো না তো!
আরে না। তেমন খারাপ খবর হলে কি আর বাসা এত চুপচাপ থাকত?
রেমির বাপের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ, তারা সব নার্সিংহোম-এ আছে।
আমারও কি একবার যাওয়া দরকার?
জগা বলে, গেলে বোধহয় ভালই করতে। তবে তোমার যা অবস্থা দেখছি তাতে গিয়ে আবার একটা কেলেঙ্কারি বাঁধাবে। তার চেয়ে রাতটা কাটিয়ে দাও। সকালে যেয়ো।
ততক্ষণ যদি রেমি না বাঁচে?
আমরা তো খবর নিচ্ছিই। লতু টেলিফোনের সামনেই বসে আছে। তা ছাড়া গেলেও দেখা করতে তো আর পারবে না। দেখা করা একদম বারণ করে দিয়েছে ডাক্তার।
ধ্রুব একটা চেয়ারে বসে পড়ে।
খুবই চিন্তিতভাবে দুহাত জড়ো করে তাতে থুতনির ভর রেখে কিছুক্ষণ শূন্য চোখে চেয়ে থাকে সামনের দিকে। তারপর বলে, তুমি আজ রাতটা আমার ঘরে শোবে জগাদা?
কেন?
শোও না, খবরটা শোনার পর থেকে গা-টা কেমন ছমছম করছে।
জগা অবাক হয়ে বলে, কীসের ছমছম?
রেমি আমাকে পছন্দ করে না, জানোই তো। যদি আজ রাতে রেমি মরে যায় তবে ঠিক ওর ভূত আমার গলা টিপতে আসবে।
জগা কানে আঙুল দিয়ে বলে, ছিঃ ছিঃ, এ কী কথা তোমার মুখে! অমন অলক্ষুনে কথা বলতে আছে?
ধ্রুব বলে, তুমি জানন না তাই বলছ। ও যে আমাকে কী ভীষণ ঘেন্না করে।
তা বলে জ্যান্ত মানুষটাকে ভূত বানাবে?
তুমি শোবে কি না বলো।
শোবোখন। কিন্তু তোমরা লেখাপড়া শিখে কী হলে বলল তো!
ধ্রুব বিবর্ণ মুখে একটু কাঠ কাঠ হাসি হেসে বলে, বই-পড়া বিদ্যে জীবনে কোনও কাজে লাগে। এ তো জানোই জগাদা। থিওরেটিক্যালি আমি ভূতে বা ভগবানে বিশ্বাস করি না, কিন্তু ইন প্র্যাকটিস অন্য ব্যাপার।
তাই তো দেখছি। রাতে কিছু খাবে তো? নাকি খেয়ে এসেছ?
খাওয়া? ও বাবা খাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না।
রাতে তো প্রায় দিনই খাচ্ছ না। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। শুকিয়ে যাবে।
ধ্রুব ঠ্যাং ছড়িয়ে বলে, তুমি বরং আলমারিটা খুলে দেখো। একটা ব্র্যান্ডির বোতল আছে। চার আঙুলের মতো ঢেলে দাও।
জগা চোখ গোল করে বলে, আরও খাবে?
নইলে ঘুম আসবেনা। অমনিতেই আজ নেশা জমেনি, একটা হুজ্জোত বেঁধে গিয়েছিল। তারপর রেমির এই খবর।
হুজ্জোত বাঁধালে কেন?–জগা ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে।
ধ্রুব মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলে, সে অনেক ব্যাপার।
বাবুর নাম তুমিই ডোবাবে।
ধ্রুব মুখের একটা বিকৃতি ঘটিয়ে বলে, কেন, সেটা বাবা নিজে পারে না?
তার মানে?
যা সব করে বেড়াচ্ছে তাতে নিজের নাম নিজেই ডোবাবে। ছেলের দরকার হবে না।
জগা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলে, আজ কী হয়েছিল?
কালুর দোকানে একটু গণ্ডগোল, তেমন কিছু নয়।
কতটা গণ্ডগোল?
বললাম তো। বেশি নয়।
দেখো কুট্টি, আমার কাছে লুকিয়ো না।
ধ্রুব হঠাৎ উঠে তার ট্রাউজারস ছাড়তে ছাড়তে বলে, পায়জামাটা কোথায় দেখো তো। শোবো। মাথা ঘুরছে।
জগা কথাটার জবাব দেয় না। তবে এক ধরনের বিপজ্জনক জ্বলজ্বলে চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, যা কিছু করে বেড়াচ্ছো তা বাপের খুঁটির জোরেই। না হলে এতদিনে কয়েকবার জেল খেটে আসতে হত, তা জানো?
ধ্রুব ছাড়া প্যান্টটা একটা লাথি মেরে উড়িয়ে দেয়। সেটা গিয়ে দরজার কাছে পড়ে। গায়ের আঁটো পুলওভারটা খুলতে গিয়ে বগলের কাছ বরাবর আটকে গেল। জগার দিকে ঘুরে সে বলে, একটু টেনে খুলে দাও তো।
জগা একটা প্রকাণ্ড হাত বাড়িয়ে এক হ্যাঁচকাটান মেরে সোয়েটারটা খুলে আনে। সোয়েটাবটা খুলে আসে বটে, কিন্তু হ্যাচকা টানে টাল খেয়ে অবলম্বনহীন ধ্রুব দুটো হাত ওপর দিকে তুলে অসহায়ভাবে পড়ে একটা কাতর শব্দ করে। জগা হাত বাড়িয়ে তাকে আর-একটা হ্যাচকা টানে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলে, বাপের নাম বংশের নাম ডোবাতে এ বাড়ির ছেলে হয়ে তোমার লজ্জা করে না, কিন্তু আমরা চাকর হয়েও তোমার কাণ্ড দেখে লজ্জা পাই।
ধ্রুব একটু হাঁফাচ্ছিল। মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে বলল, ওঃ। এত কথা বলো কেন? একটু ব্র্যান্ডি দাও, নেশাটা পুরো না হলে আমার মাথাধরাটা ছাড়বে না।
চাবিটা দাও।
কীসের চাবি?
লোহার আলমারির। তাইতেই তো ব্র্যান্ডি আছে বললে।
ওঃ সেই চাবি। ওই চেস্ট অফ ড্রয়ার্সের ওপরের ড্রয়ারটা দেখো।
জগা গিয়ে ড্রয়ার খুলে চাবিটা বের করে নেয়। তারপর ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, আমি যাচ্ছি। খেয়ে আবার আসব। ততক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।
ধ্রুব তাড়াতাড়ি ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। জগা দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দেয় সাবধানে।
ধ্রুব আতঙ্কিত চোখে দরজাটার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অবোধ দৃষ্টি। তারপর ফাঁকা ধরটার চারদিকে চায়। হঠাৎ খুব শীত করতে থাকে তার। নাভির কাছ থেকে একটা কাঁপুনি উঠে আসছে। সে গিয়ে কাঠের ওয়ার্ডরোব খুলে একটা বোয়া পায়জামা বের করে খুব কষ্টে পরে নেয়। গায়ে একটা আলোয়ান জড়ায়। তারপর দরজা খুলে বেরোয়। আস্তে আস্তে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকে। নেশাটা খুব একটা টের পাচ্ছে না এখন।
তার বাবার লাইব্রেরি ঘরটা জিনিসে ঠাসা। চারদিকে লম্বা লম্বা বইয়ের আলমারি। মস্ত বড় ডেস্ক আর রিভলভিং চেয়ার। একটা ডিভান এবং তার সামনে একটা টুল! বসবার জন্য আরও গোটা চারেক গদি আঁটা চেয়ার রয়েছে। কয়েকটা টেবিলে রয়েছে বাঁকুড়ার ঘোড়া থেকে শুরু করে হরেক রকমের শিল্পকর্মের নিদর্শন। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসও রয়েছে। রিভলভিং চেয়ারটায় বসে লতু একটা বই পড়ছে। তার বয়স কুড়ির মধ্যে। চোখে চশমা, অত্যন্ত ফরসা রং, মুখশ্রীও সুন্দর। তবে মুখচোখ তার সবসময়েই ভীষণ সিরিয়াস এবং বিরক্তিতে ভরা। সে যে হাসে খুবই কম তা তার মুখের দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায়। বোঝা যায়, এই পৃথিবী বা এই মানবীজন্ম সে একটুও পছন্দ করছে না।
ধ্রুব ঘরে ঢুকতেই লতু চোখ তুলে চাইল।
ধ্রুব তার বোন লতুকে যে ভয় পায় তা নয়, কিন্তু এর সামনে সে একটু অস্বস্তি বোধ করে। মেয়েটা যেন কেমনতরো। তা ছাড়া রেমির সঙ্গে লতুরই ভাব কিছুটা গাঢ়।
ধ্রুব শীতে কাঁপছিল। সেই কাঁপুনি তার গলাতেও প্রকাশ পেল, কিছু খবর আছে নাকি রে, লতু?
লতুর গলা খুবই নির্বিকার। বলে, অবস্থা ভাল নয়।
কী হয়েছে? আজ বিকেলেও তো নরমাল ছিল।
হেমারেজ। অপারেশন করা হতে পারে।
আমি একটু বসব এখানে?
বোসো।–বলে লতু দাদার দিকে একটু যেন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতেই তাকায়, কখন ফিরেছ?
একটু আগে।–বলে ধ্রুব টেবিলের ওপর টেলিফোনটার দিকে ইশারা করে বলে, কতক্ষণ আগে লাস্ট খবরটা এসেছে?
আধ ঘণ্টা।
কে ফোন করেছিল?
বাবা।
কী বলল?
ওই তো যা বললাম। তুমি গিয়ে শুয়ে থাকে না। আমরা খবর নিচ্ছি।
কেন, আমি এখানে বসে থাকলে কি তোর অসুবিধে হবে?
না, তা হবে কেন?
তবে? ফোনটা আমাকে দে, আমি একটু কথা বলব।
লতু টেলিফোনটা ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বলে, বলতে পারো, তবে লাভ নেই। বাবা ওখানে আছেন। খবর কিছু থাকলে উনিই টেলিফোন করবেন বলেছেন।
ধ্রুব তবু টেলিফোনটা তুলে নেয়। লতুর দিকে চেয়ে বলে, নার্সিংহোমের নম্বরটা বল তো।
লতু জবাব দেয় না, একটা প্যাড এগিয়ে দেয়। তাতে লাল পেনসিলে নম্বরটা লেখা।
ডায়াল করতে করতেই ধ্রুব টের পায়, সে কোনও খবর জানতে চায় না। রেমির জন্য চিন্তা করার অনেক লোক আছে। রেমিকে নিয়ে যে উদ্বেগ ও ব্যস্ততা চলছে তার মধ্যে নিজেকে ভেড়াতেও সে চাইছে না। সে চাইছে এই সময়টা একা ঘরে বসে ভয়ংকর সব চিন্তার আক্রমণ থেকে কিছুক্ষণ দূরে সরে থাকতে।
একটা মোটা গলা নার্সিংহোমের নামটা উচ্চারণ করল ওপাশ থেকে।
ধ্রুব খুব দায়িত্বশীল এবং উদ্বিগ্ন স্বামীর মতোই বলল, রেমি চৌধুরীর কনডিশন কেমন? কেবিন নম্বর ফাইভ।
একটু ধরুন।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর তাকে চমকে দিয়ে ভারী গলাটা বলে, হ্যালো।
বলুন।
কনডিশন একই রকম।
অপারেশন হবে?
হ্যাঁ। ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে কিছুক্ষণ বাদে।
খুব চিন্তার কিছু আছে কি?
ডাক্তাররা বলতে পারেন। আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
ডাক্তার মজুমদারকে একটু দিতে পারেন টেলিফোনে?
উনি এখন ভীষণ বিজি।
আচ্ছা শুনুন, রেমি চৌধুরীর একটা বাচ্চা হয়েছিল আজ বিকেলে। সেই বাচ্চাটা কেমন আছে?
বাচ্চা ভাল আছে।
আর ইউ সিয়োর?
হ্যাঁ।
থ্যাংক ইউ।
এতক্ষণ লতু একবারও দাদার দিকে তাকায়নি। বই পড়ছিল। এবার তাকিয়ে একটা হাই তুলে আবার বইয়ে মুখ গুঁজল।
ধ্রুবর একটু লজ্জা করছিল। রেমির জন্য যে তার কোনও উদ্বেগ আছে তা বোধ হয় লতু এখনও বিশ্বাস করে না। আর বসে থাকার মানে হয় না। ধ্রুব উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার বারান্দাটায় দাঁড়ায়। দোতলায় গোটা সাতেক ঘব আছে। লাইব্রেরি ছাড়া আরও চার-পাঁচটা ঘরে আলো আছে! বাইরে থেকে বাড়িটাকে যতটা ঘুমন্ত পুরী মনে হয়েছিল ততটা নয়।
কিন্তু এখন ওইসব ঘরের কোনওটাতেই গিয়ে দুদণ্ড বসবার বা সময় কাটাবার উপায় নেই।
বোমা মেরে মাঝে মাঝে এই বাড়িটাকে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে তারা সেটা পারছে না বলেই অন্যভাবে সে প্রতিশোধ তুলে নিচ্ছে।
তাতে কাজ হচ্ছে কি? বনেদি বাড়ি এবং ভি আই পি বাবার ভিত একটুও নড়াতে পেরেছে কি সে? ঠিক বুঝতে পারছে না।
ধ্রুব আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নীচে। আসার পথে দু-একজন চাকরবাকর শ্রেণির লোকের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় তার। প্রত্যেকের মুখেই একটা উদ্বেগ ও গাম্ভীর্য লক্ষ করে সে। তবে তার সঙ্গে কেউই কথা বলে না বা অভিবাদনও করে না কোনওরকম। এ বাড়ির সবাই বুঝে গেছে, ধ্রুব ফালতু লোক।
নিজের ঘরের ভেজানো দরজাটার সামনে এসে ধ্রুব দাঁড়ায়। ঘরে ঢুকতে কেমন অস্বস্তি আর ভয়-ভয় করছে তার। আশ্চর্যের বিষয়, ভয়টা ভৌতিক। কিন্তু সেরকম ভয়ের কোনও কারণ ঘটেনি। রেমি এখনও মরেনি এবং হয়তো মরবেও না। তা হলে ভয়টা কীসের?
ধ্রুব খুব ভাল ব্যাখ্যা করতে পারছিল না ব্যাপারটা। শরীরের অবস্থা পরিষ্কার চিন্তা করার মতো নয়। আধখাচড়া নেশা করার ফলেই বোধহয় ভয়টা থাবা গেড়ে আছে মাথায়। নেশা না করলে বা পুরো নেশা করলে এরকম হয়তো হত না। এক অদ্ভুত শীতে তার শরীর এখনও থরথর করে। কাঁপছে, সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
দেয়ালে শরীরের ভর রেখে সে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। চোখ বুজতেই দেখতে পেল রেমির মুখ। নার্সিংহোমের বালিশে আধো-ড়ুবন্ত সেই মুখ শীর্ণ, সাদা এবং তৎসত্ত্বেও সুন্দর। চোখ বোজা, চোখের পাতায় একটা হালকা নীল ছোপ পড়েছে। ঠোঁট শুকনো। দৃশ্যটা দেখে শিহরিত হয় ধ্রুব। চোখ খোলে।
প্যাসেজ ধরে একটা লোক আসছে। বগলে গোটানো বিছানা। চাকর। এ বাড়িতে চাকর অনেক। পুরনোদের চেনে ধ্রুব। কিন্তু আজকাল অনেক নতুন রিক্রুট হয়েছে, তাদের নামও ধ্রুব জানে না। এই লোকটাও তাদের দলে। বয়স বেশি নয় ছোরার। ধ্রুবকে দেখে উলটোদিকের দেয়াল ঘেঁষে সভয়ে চলে যাচ্ছিল।
ধ্রুব ডাকল, এই শোনো।
ছেলেটা দাঁড়িয়ে যায়।
জগাদা কোথায় বলো তো?
খাওয়ার ঘরে।
যাও তো, গিয়ে বলল আমি তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি।
উনি তো হাসপাতালে যাবেন।
সে কী? হাসপাতালে কেন?
বউদির জন্য?
কেন?
বলছিলেন যদি রক্ত দিতে হয় তাই যাবেন।
ধ্রুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। জগাদা নার্সিংহোমে যাচ্ছে, তার মানে কত রাতে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি না তার ঠিক নেই। কিন্তু একা ঘরে তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। ধ্রুবর মাথায় চকিতে একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সে ছোকরাটাকে বলে, তুমি কোথায় শুতে যাচ্ছ?
আজ্ঞে, ওই পিছন দিককার সিঁড়ির নীচে।
আজ ওখানে শুতে হবে না। তুমি বরং আজ আমার ঘরে শুয়ে পড়ো।
ছেলেটা অবাক হয়। বলে, কিন্তু বাবা আমাকে ওখানেই শুতে বলেছেন।
বাবা! তোমার বাবা কে?
আজ্ঞে শ্রীজগবন্ধু রায়। যাকে আপনি জগাদা বললেন।
জগাদার ছেলে তুমি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ধ্রুব হঠাৎ একটু চটে গিয়ে বলে, জগাদার ছেলে হয়ে তুমি এ বাড়িতে চাকরের কাজ করতে ঢুকেছ কেন? আর কাজ পেলে না?
ছেলেটা একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলে, আমি আর-এক জায়গাতেও কাজ করি।
কোথায়?
বাবার কোম্পানিতে। বেয়ারা।
কী পাশ করেছ?
হায়ার সেকেন্ডারি।
কোন ডিভিশন পেয়েছিলে?
সেকেন্ড ডিভিশন।
আর পড়োনি কেন?
পড়ছি তো।
পড়ছ?–ধ্রুব অবাক হয়।–কী পড়ছ?
নাইট কলেজে বি কম ক্লাসে ভর্তি হয়েছি।
এ বাড়িতে কী কাজ করতে হয়?
এই ফাইফরমাস।
সম্মানে লাগে না?
ছেলেটা মুশকিলে পড়ে গিয়ে বলে, কিছু অসুবিধে হয় না।
তুমি যে বি কম পড়ছ তা বাড়ির মালিক জানে?
জানে।
তা সত্ত্বেও ফাইফরমাস করে?
ছেলেটা এবার একটু হেসে বলে, বাবাও তো এ বাড়িতে কাজটাজ করে। তাই আমিও করি।
আর অফিসে যে বেয়ারার চাকরি করে সেটা কেমন লাগে করতে?
খারাপ লাগে না। খাটুনি তত বেশি নয়। আমি পড়ার বই নিয়ে যাই, অফিসে বসে পড়ি।
ধ্রুবর একটু ক্লান্তি লাগে।
জগাদার এই ছেলেটিকে সে কখনও দেখেনি। ছেলেটা জীবনের মোড় ফেরানোর জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়ছে। নিজের শ্রেণিকে ছাড়িয়ে উচ্চতর শ্রেণিতে প্রবেশের ছাড়পত্র একদিন পেয়ে যাবেই। কিন্তু এত পরিশ্রম এরা করে কী করে? দিনে বেয়ারা, সকালে বিকেলে বাড়ির চাকর আর রাত্রে কলেজের পড়ুয়া। আরেব্বাস!
ধ্রুব একটু হেসে বলল, তুমি আজ আমার ঘরেই শোও। আমি জগাদাকে বলে দিচ্ছি। আমার শরীরটা আজ ভাল নেই, ঘরে একজন লোক থাকা দরকার।
ছেলেটা একথায় মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল।
ধ্রুব দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। পিছনে ছেলেটি, সসঙ্কোচে।
ওই কোণের দিকে বিছানাটা পেতে নাও। মশারি আছে?
আছে।
আমি জগাদাকে বলে দিয়ে আসছি।
ছেলেটা বিছানাটা কাঠের আলমারির সামনে নামিয়ে রেখে বলল, আপনাকে যেতে হবে না, আমিই বাবাকে বলে আসছি। বাবা বলেছিলেন, দরকার হলে আমাকেও রক্ত দিতে যেতে হবে।
দরকারের সময় যদি আমাকে খুঁজে না পান তা হলে রেগে যাবেন!
ধ্রুব বিছানায় বসে নিজের কপাল চেপে ধরল। মাথা নেড়ে অস্ফুট গলায় বলল, আচ্ছা।
ছেলেটা যাওয়ার সময় সাবধানে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেল।
ধ্রুব নিজের হাতঘড়িটা দেখল। বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। এতক্ষণে কি রেমিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে? বোধ হয়। না, রেমির জন্য তার কিছু করার নেই। তাকে কেউ কিছু করতে বলছে না। এমনকী রক্ত দেওয়ার জন্য বাড়ির কাজের লোকদের প্রস্তুত রাখা হচ্ছে, তাকে নয়। তার রক্ত বোধ হয় অশুচি।
খুবই দুঃখ হতে লাগল ধ্ৰুবর। আসলে নেশাটা আধখাচড়া হলেই তার দুঃখ-টুঃখ উথলে ওঠে। সে ভেবে দেখল, রেমির জন্যই শুধু নয়, পৃথিবীর কারও জন্যই তার কিছু করার নেই।
একটা মশা ডান পায়ের গোড়ালিতে কামড়াল। বসে বসে একটু ঢুলুনি এসেছিল ধ্রুবর, মশার কামড়ে চমকে উঠল। না, ছেলেটা এখনও আসেনি। বিছানাটা তেমনি গোটানো অবস্থায় পড়ে আছে।
এ বাড়িতে আগে মশা ছিল না। আজকাল হয়েছে। কিন্তু ধ্রুব নিজের মশারিটা টাঙানোর কথা ভাবল না। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করে টেবিলে রেখেছিল। প্যাকেটটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরায় সে। ঘুম আসবে না। বড় শীত করছে।
দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে না? ধ্রুব স্থির হয়ে গেল। খুব জোরে রেলগাড়ি দৌড়তে লাগল বুকের মধ্যে।
হ্যাঁ, দরজাটা খুলে যাচ্ছে একটু একটু করে। কোনও দরজাই এত রহস্যময়ভাবে খোলা উচিত নয়। কোনও অশরীরী, কোনও অচিন বাতাস কি খুলছে দরজা?
কে?–বলে বিকট একটা চিৎকার করে ওঠে ধ্রুব।
দরজাটার ফাঁক হওয়াটা থেমে যায়। মৃদু মোলায়েম একটা মিয়াও আওয়াজ ক্ষীণ এসে পৌঁছয় ধ্রুবর কানে।
আশ্চর্য! সাদা আর বাদামিতে মেশানো সেই কাবলে বেড়ালটা না? রেমির বেড়াল। এটাকে কোনওকালে দুচক্ষে দেখতে পারে না ধ্রুব, কী চায় বেড়ালটা? এ ঘরে তো কখনও আসে না!
ধ্রুব বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিল। মনের মধ্যে অনেক উলটোপালটা যুক্তিহীন কার্যকারণ কাজ করে যাচ্ছে। রেমির বেড়াল কখনও এ ঘরে আসে না, কিন্তু আজ এল কেন? এর মানে কি কোনও অশুভ ইঙ্গিত? না কি বেড়ালটি মৃতপ্রায় রেমির প্রতিনিধি হয়ে কিছু বলতে এসেছে তাকে?
বেড়ালটা নির্নিমেষ চোখে চেয়ে ছিল ধ্রুবর দিকে। মৃদু আর-একটা মিয়াও আওয়াজ করল সে।
আতঙ্কিত ধ্রুব কিছুতেই বেড়ালটার চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল বেড়ালটা তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। খুব ধীরে ধীরে তার বাহ্যচেতনা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
অসহায় ধ্রুব বিকারগ্রস্তের মতো ডাকল, জগাদা! জগাদা!
দরজাটা হাট করে খুলে গেল হঠাৎ। জণর বিশাল চেহারাটা দাঁড়াল দরজা জুড়ে।
কী ব্যাপার! এখনও শোওনি?
ধ্রুব বেড়ালটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওটা এখানে কেন? কী চায়?
জগা বেড়ালটাকে দেখে নিচু হয়ে কোলে তুলে নিয়ে একটু আদর করে বলল, আহা, বউমা নেই বলে ভারী একা হয়ে পড়েছে বেচারা। ঘুরে ঘুরে খুঁজছে।
ধ্রুব একটা বড় শ্বাস ফেলল। ভয়টা বেরিয়ে গেল শ্বাসের সঙ্গে। বলল, তোমার ছেলেকে এখানে শুতে বলেছি।
হ্যাঁ, বলছিল আমাকে। কিন্তু শোওয়ার কি কারও সময় হবে আজ? বউমার অপারেশন শুরু হল বলে। বাবু ফোন করেছিল, রক্ত দিতে পারে এমন কয়জন লোক চাই।
ধ্রুব হঠাৎ নড়েচড়ে বসে বলল, সে তো আমিও দিতে পারি।
জগা হাসল, সে তো ভাল কথা। বউমার জন্য যদি কিছু করতে পারো তাহলে বুঝব মরদ। কিন্তু যা মাল টেনে বসে আছ এ অবস্থায় ডাক্তাররা কি তোমার রক্ত নিতে চাইবে?
তবু আমি সঙ্গে যাব।
তুমি খুব ভয় খেয়েছ কুট্টি। কীসের এত ভয় তোমার?
জানি না। তবে ভয় খাচ্ছি ঠিকই। জগাদা চাবি দাও। আর খানিকটা না খেলে আমি মরে যাব।
জগা ট্যাঁক থেকে চাবিটা বের করে ধ্রুবর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, কুট্টি, তোমার সব সাহস বিপ্লব আর তেজ গিয়ে এখন বোতলে জমা হয়েছে। এটা কিন্তু খুব কেরানির কথা নয়। যাও, গিলে পড়ে থাকো। মা বাপ বউ বা দুনিয়ার জন্য কিছু তোমাকে ভাবতে হবে না। কিছু ভাল লোক দুনিয়াকে চালিয়ে নেয়, আর তোমার মতো কিছু ফালতু লোক বসে বসে খায় আর ফুর্তি করে।
তুমি আমাকে ঘেন্না করো, জগাদা?
না, কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, ঘেন্না করতে চাইলেই বা পারব কেন?
আমি তোমাদের সঙ্গে যাব। তার আগে একটু মেরে নিই, দাঁড়াও।
০০৫. ধনীর বাড়িতে শোক
ধনীর বাড়িতে শোকের তেমন উচ্ছ্বাস থাকে না। অর্থ, আরাম, বিলাস ও ব্যসন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে একটা দূরত্ব রচনা করে। আত্মীয়তার বন্ধন সেখানে শিথিল হতে বাধ্য। কোকাবাবুর বাড়িতে শোকের একটা সৌজন্যসূচক স্তব্ধতা বিরাজ করছে বটে, কিন্তু প্রকৃত শোক যে এ নয় তা বারবাড়ি পার হয়ে গাড়িবারান্দা অতিক্রম করে বৈঠকখানায় ঢুকতে ঢুকতেই অনুভব করলেন হেমকান্ত।
কোকাবাবুর এস্টেটের কর্মচারীরা অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত হয়েই ছিল। প্রৌঢ় নায়েব বিশ্বেশ্বর এগিয়ে এসে জোড়হাতে বলল, আসুন, আসুন।
হেমকান্তর বুকে এক প্রগাঢ় যন্ত্রণা থাবা গেড়ে আছে। না, কোনও ব্যথা বা বেদনা নয়, জ্বালা নয়। যেন একসেরি একটা লোহা তাঁর হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে লেগে ঝুলে আছে। বৈঠকখানায় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি সময়োচিত গাম্ভীর্য মুখে মেখে বসে আছেন। প্রায় সকলকেই হেমকান্ত চেনেন। নীরবে দু-একজন হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন তাঁকে। দু-একজন হতাশাভরে মাথা নাড়লেন। মোক্তার রাজেনবাবু উঠে এসে হেমকান্তর সঙ্গে ভিতরবাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, কোকাবাবুর বিষয়-সম্পত্তির অবস্থা খুবই খারাপ।
হেমকান্তকে খবরটা স্পর্শ করল না। নির্বিকার মুখে বললেন, তাই নাকি?
কেন, আপনি জানেন না?
তো। ইদানীং প্রায় সবই গোপনে বিক্রি করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু নগদ টাকাও কিছু দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ছেলেতে-ছেলেতে তুমুল হচ্ছে।
হেমকান্ত আর-একটু বিবর্ণ হয়ে গেলেন। রাজেনবাবু ফের বৈঠকখানায় ফিরে গেলেন। বিশ্বের আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে হেমকান্তকে কোকাবাবুর ঘরে হাজির করে দিল।
আশ্চর্য, আজও কোকাবাবুর ঘরের এক কোণে বসে ক্লান্ত এক কীর্তনীয়া তারকব্রহ্ম নাম করে যাচ্ছে, মৃদু করতালের সঙ্গে। ডাক্তার সূর্যকান্ত সেন একটি চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আর একটি চেয়ারে কোকাবাবুর বড় ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বসা। দু-একজন দাসী ও চাকর উদ্দেশ্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোকাবাবুর শ্বাস উঠেছে। জ্ঞান নেই। গলায় আজ একটা নতুন জিনিস দেখতে পেলেন হেমকান্ত। সোনার একটা চেন ছিল। সেটি নেই। তার জায়গায় একটা কাঠির মালা পরানো।
কী একা, কী আত্মীয়-পরিজনহীন আজ কোকাবাবু! মৃত্যু মানেই কি একাকীত্ব ও পরিজনহীনতা? মুমূর্ষ ওই মানুষটি কি এই মুহূর্তে টের পাচ্ছেন যে, তার স্ত্রী আছে, পুত্রকন্যা আছে, বিষয়-সম্পত্তি আছে? এমনকী দেহ বা অস্তিত্বই কি অনুভব করছেন? সেই ফরসা ও সুন্দর চেহারাটির আজ কী দশা! এই দেহটি একটু পরেই অগ্নিতে সমর্পিত হবে। তখন কোকাবাবু কোথায়?
কে একজন একটি চেয়ার এগিয়ে দিল। কিন্তু হেমকান্ত বসলেন না। তাঁর মনে হল বসতে গেলেই তিনি মূৰ্জিত হয়ে পড়ে যাবেন।
তিনি সূর্য ডাক্তারের চেয়ারের হাতলটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। সূর্য ডাক্তার ধীরে ধীরে উঠে তার কানে কানে বললেন, আর কয়েক মিনিট। হয়ে এসেছে।
হেমকান্ত জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু জিভটাও শুকনো এবং খড়খড়ে। মানুষ এত নিষ্ঠুরভাবে আর-একজন মানুষের মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে কী করে? নিজের মৃত্যুর অমোঘতার কথা তার মনে পড়ে না?
কোকাবাবুর অস্বাভাবিক শ্বাসের শব্দ ক্রমেই ঘরখানা ভরে তুলছিল। এত বিশাল ও বিষণ্ণ শব্দ হেমকান্ত আর কখনও শোনেননি। তার পায়ের নীচে মৃদু একটা ভূমিকম্প টের পাচ্ছিলেন তিনি। আসল ভূমিকম্প নয়, তার নিজেরই শরীরের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন। তার শিথিল হাত থেকে কুয়োর বালতির দড়ি অন্তহীন নেমে যাচ্ছে। তিনি ঠেকাতে পারছেন না সেই নিম্নগতি।
হেমকান্ত যে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন সেই শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। তিনি স্থবির ও প্রস্তরীভূত হয়ে গেছেন। কোকাবাবুর জড়বৎ দেহটি এক প্রবল সম্মোহনে তাকে আটকে রেখেছে। তিনি দৃশ্যটি দেখতে চাইছেন না, কিন্তু না দেখেও যেন উপায় নেই।
সূর্যকান্ত গিয়ে কোকাবাবুর হাতখানা তুলে নাড়ি দেখলেন। কিছু কুঞ্চিত, মুখে যথাযথ উদ্বেগ। কোকাবাবুর গলায় একটা ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছিল, সেটা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এল। একটা হেঁচকি ওঠার মতো শব্দ হল কি? কিন্তু ঘরটা অকস্মাৎ শব্দহীন হয়ে গেল। সূর্যকান্ত কোকাবাবুর হাতখানা নামিয়ে রাখলেন। গগন মুখ তুলে তাকাল। সূর্যকান্ত ডাইনে বাঁয়ে মৃদু মাথা নাড়লেন।
এ সবই বুঝতে পারছেন হেমকান্ত। ইঙ্গিত স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। নিস্তব্ধ ঘরে ক্লান্ত কীর্তনীয়া হঠাৎ তার নামগান চৌদুনে তুলে দিল। একজন দাসী সরু স্বরে কেঁদে উঠে ভিতরবাড়িতে ছুটে গেল।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন হেমকান্ত। ঘরখানা যখন আত্মীয়-পরিজন ও অতিথিতে ভরে উঠল তখন খুব আস্তে আস্তে তিনি বেরিয়ে এলেন।
ঘোড়ার গাড়িতে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে রঙ্গময়ি। অপলক চোখে চেয়ে আছে হেমকান্তর আসা-পথের দিকে। হেমকান্ত গাড়ির কাছে আসতেই কোচোয়ান দবজা খুলে দেয় এবং রঙ্গময়ি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে।
হেমকান্ত তার দুদিকের জানালা তুলে দিলেন। গাড়ির ভিতরটা গভীর অন্ধকারে ড়ুবে গেল।
রঙ্গময়ি কোনও কথা বলল না। কিন্তু এই নিভৃত অন্ধকারে লোকচক্ষুর অগোচরে সে নির্লজ্জের মতো হেমকান্তর একখানা হাত ধরে রইল।
হেমকান্তর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছিল না। হাত থরথর করে কাঁপছে। গা বড় বেশি ঠান্ডা। স্বরভঙ্গ ঘটেছে। ভাঙা গলায় হেমকান্ত হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, মনু, তুমি আছ তো?
থাকব না তো কোথায় যাব? বড় অন্ধকার। জানালা খুলে দিই?
না, জানালা খুলো না। আমার বড় শীত করছে। কাঁপছি।
বীজমন্ত্র জপ করো। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
হেমকান্ত ফিস ফিস করে বললেন, সুনয়নীকে আমি চোখের সামনে মরতে দেখিনি। তুমি দেখেছ, না?
সে কথা হঠাৎ আজ কেন?
আজ প্রথম একজন মানুষকে আমি নিজের চোখে মরতে দেখলাম।
তাতে কী হয়েছে? ডাক্তাররা তো অনবরত মানুষকে মরতে দেখছে। প্রথম-প্রথম হয়তো খারাপ লাগে, তারপর আর অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না।
তুমি সুনয়নীকে মারা যেতে দেখেছ, মনু?
দেখেছি। আমি আরও মৃত্যু দেখেছি।
তোমার খারাপ লাগে না?
মৃত্যু মাত্রই খারাপ।
ওঃ মনু!-বলে হঠাৎ হেমকান্ত রঙ্গময়ির হাত চেপে ধরেন। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, আমি কেন আজ এত একা, মনু? কেন আমার এত একা লাগছে? তোমরা কেউ কি নেই আমার কাছে?
রঙ্গময়ি এক হাত বাড়িয়ে জানালা খুলে দেয়। ব্রহ্মপুত্রের হিমশীতল বাতাস আসে হু-হু করে। সঙ্গে পচা মুলি বাঁশ আর পাটের গন্ধ।
হেমকান্ত আস্তে হাতটা টেনে নেন। তারপর বলেন, কাজটা তুমি ঠিক করোনি।
কোন কাজটা?
এই কোকাবাবুর কাছে আমাকে নিয়ে আসাটা।
তুমি পুরুষমানুষ, এত ভয় পেলে চলে?
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বলেন, ভয় নয়। এ অন্য একরকম অনুভূতি। তুমি ঠিক বুঝবে না। শৈশব গেছে, কৈশোর গেছে, যৌবন গেছে, এখন এল বার্ধক্য। এই বার্ধক্যকে আমি সইতে পারছি না।
তোমার বার্ধক্য?–রঙ্গময়ি অবাক হয়।
তুমি জানো না। তুমি জানো না। রঙ্গময়ি চুপ করে থাকে।
গাড়ি একটা বাঁক ফেরে। তারপর খানিকটা ঢালু বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে দেউড়ি পেরিয়ে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে।
হেমকান্ত নামেন। বাড়ির সব ঘরে আজকাল আলো জ্বলে না। এক বৃহৎ অন্ধকারে ড়ুবে আছে তার পিতৃপুরুষের এই বাসস্থানটি। তিনি সেই অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। মৃত্যু তার কাছে নতুন নয়। এ বাড়িতে তার মায়ের মৃত্যু ঘটেছে, বাবার মৃত্যু ঘটেছে। ব্রহ্মপুত্রের জলে ভেসে গেছে নলিনীর মৃতদেহ। সুনয়নী গেল এই তো সেদিন। কিন্তু সেদিনের হেমকান্ত আজ আর নেই।
রঙ্গময়ি নেমে হেমকান্তব পাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল, তুমি ঘরে যাও। আমি একটু বাদে আসব।
হেমকান্ত মাথা নাড়লেন। একজন চাকর লণ্ঠন হাতে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে সসম্রমে। হেমকান্ত আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে উঠলেন। ঢুকবার মুখেই বাঁ ধারের ঘরখানায় কৃষ্ণকান্ত তার গৃহশিক্ষক প্রতুলের কাছে পড়াশুনো করছে। হেমকান্ত কদাচিৎ এই ঘরে ঢোকেন। আজও ঢুকলেন না। দরজায় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকান্তর দিকে চেয়ে রইলেন।
কৃষ্ণকান্ত বালক মাত্র। ভারী সুদর্শন। তার ছেলেদের মধ্যে এই কৃষ্ণকান্তর আদল কিছু আলাদা। অন্যদের চেহারায় জৌলুস আছে কিন্তু বুদ্ধির এত দীপ্তি নেই। দশ-এগারো বছর বয়সেই কৃষ্ণকান্তর মুখে ধারালো বুদ্ধি ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। বলাবাহুল্য, কৃষ্ণকান্তর প্রতি হেমকান্তর দুর্বলতা কিছু বেশি। আর সেইজন্যই অন্যান্য ছেলের নামে কান্তি যোগ করলেও কৃষ্ণকান্তর কান্তি ঘেঁটে দিয়ে নিজের নামের কান্তটুকু তিনি যোগ করেছেন।
কৃষ্ণকান্ত তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে তাকাল এবং উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে প্রতুল। প্রতুল খুব মেধাবী এবং দরিদ্র। সে বি এ পড়ে। হেমকান্তর সাহায্য না পেলে সেটুকুও পারত না। কৃষ্ণকান্ত ও প্রতুল দুজনেই জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। হেমকান্ত একটু লজ্জা পান। মাথা নেড়ে বলেন, কিছু নয়। পড়ো তোমরা, পড়ো।
ধীরে ধীরে চাকরের লণ্ঠনের আলোয় পথ দেখে দেখে তিনি নিজের ঘরে আসেন। সেখানে অবশ্য উজ্জ্বল সেজবাতি জ্বলছে।
আর-একজন চাকর তার পোশাক ছাড়িয়ে দেয়। ধুতি, মোজা ও বালাপোষের কোট পরে তিনি মস্ত খাটের বিছানায় একটা শাল জড়িয়ে বসেন। আজ তার মনে হয় একটা কোনও নেশা থাকলে বেশ হত। এখন একটু বেশি মাত্রায় হুইস্কি বা ব্র্যান্ডি খেয়ে শুয়ে পড়লে গাঢ় ঘুম হত তার।
এ কী? তুমি ঘরে যে!—-রঙ্গময়ি হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে বলে।
কেন, কী হয়েছে?
মড়ার ঘরে ঢুকেছিলে। চানটান করোনি! আগুন ছোওনি! কী অশুচি কাণ্ড! ওঠো, ওঠো! বিছানাপত্তর সব ফেলতে হবে। মশারিশুদ্ধ। ঘরে গঙ্গাজল দিক। ওঠো শিগগির।
হেমকান্ত ওঠেন। কিছু তটস্থ, কিছু অপ্রতিভ।
“কত আদরের এই দেহ। তবু যখন দেহ মরে তখন তাহা অশুচি হইয়া যায়। প্রিয়জন যতক্ষণ জীবিত থাকে, ততক্ষণ কত সমাদর, কত আদর ও সোহাগ। সেই প্রিয়জন যখন মৃতদেহে পর্যবসিত হইল তখনই তাহা অস্পৃশ্য। দেহ পোড়াও, গোর দাও, যত শীঘ্র পারো তাহা বিনাশ করিয়া ফেলল। তাহার সংস্পর্শে যত কিছু ছিল তাহা কাচিয়া, গঙ্গাজল, গোবরছড়া দিয়া শুদ্ধ করিয়া লও। এরূপ নিয়ম আমার ভাল লাগে না, কিন্তু বুঝি ইহার কিছু প্রয়োজন আছে। মৃতদেহ রোগজীর্ণ, জীবাণুযুক্ত, পচনশীল। কিন্তু যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণ তাহার আদর।
“এই চিন্তা হইতে আমি প্রাণের প্রশ্নে উদ্বেলিত হইলাম। প্রাণ কী? আত্মা কী? দেহের সঙ্গে প্রাণ বা আত্মার যোগসূত্রই বা কী? দেহমুক্ত আত্মার অবলম্বনই বা কী?
“আমি এইসব প্রশ্ন লইয়া একজন জানবুঝওয়ালা লোকের সঙ্গে আলোচনা করিবার ফিকির খুঁজিতেছিলাম। তুমি কাছে নাই। বিজ্ঞ বয়স্যের একান্তই অভাব। অগত্যা আমাদের কুলপুরোহিত বিনোদচন্দ্রের শরণ লইতে হইল। বিনোদচন্দ্র পুরোহিত হিসাবে কেমন তাহা কখনও খোঁজ করি নাই। তিনি আবার বাবার নিযুক্ত পুরোহিত। কিন্তু হা হতোস্মি! বিনোদচন্দ্র আমাকে যাহা বুঝাইবার চেষ্টা করিল তাহা বাসাংসি জীর্ণানির অধিক কিছু নহে। আমি তাহাকে বলিলাম, জীর্ণ বাস পরিত্যাগ করে যে শরীর তাহা তো একটি বস্তু। কিন্তু শরীর ছাড়িয়া যে বাহির হয়, যাহাকে প্রাণ আখ্যা দেওয়া হইয়া থাকে তাহা কোন বস্তুতে নির্মিত? আত্মার পদার্থই বা কীরূপ? উনি বলিলেন, বায়ু জাতীয় পদার্থ।
“আমি তাঁহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি আত্মাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন কি না। উনি জবাবে বলিলেন, বহু আত্মা দেখিয়াছি। পরিষ্কার জলে ক্ষুদ্র মাছেরা যেরূপ সন্তরণ করে আমাদের চতুর্দিকে সেরূপ বহু আত্মা সন্তরণ করিতেছে। তবে দেখিবার জন্য চক্ষু ও মনকে প্রস্তুত করিতে হয়।
“আমি চক্ষু ও মনকে প্রস্তুত করিতে রাজি। বিনোদচন্দ্র তখন ফাঁপরে পড়িলেন। বলিলেন, এখন কিছুদিন শুদ্ধাচারে জপতপ করুন, পরে পদ্ধতি শিখাইব। কিন্তু তাহার হাবভাব দেখিয়া মনে হইল, পদ্ধতি তিনিও বড় একটা জানেন না।
“কোকাবাবু গত হইলেন। তাঁহার দেহ পঞ্চভূতে মিশিয়াছে। আমার দেহও মিশিবে। সেইজন্য বড় একটা চিন্তিত নহি। আমি মৃত্যুর স্বরূপকে জানিতে চাই। এই আকাঙ্ক্ষা নিতান্ত তত্ত্বগত নহে। এই আকাঙ্ক্ষা আমার অন্তরে নিরন্তর রক্তক্ষরণ ঘটাইতেছে।
“মানুষের সহিত এই পৃথিবীর একটা সম্পর্ক তাহার জীবৎকালে রচিত হয়। আমাদের আয়ুষ্কাল মহাকালের তুলনায় পদ্মপত্রে নীরবৎ ক্ষণস্থায়ি। এত জানি বুঝি, তথাপি এই পৃথিবীর সহিত নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিবার আয়োজন বড় কম করি না। কিন্তু এই দৃশ্যমান জগৎ ও জীবনের অতিরিক্ত আর একটি নীরব প্রবাহ আছে। তাহার কথা কি কখনও তোমার মনে হয়?
“আমার প্রিয় কুঞ্জবনটির কথা তুমি নিশ্চয়ই ভুলিয়া যাও নাই। আজকাল রোজ অপরাহে, সেইখানে বসিয়া কত কথা ভাবি। সেই যে একদিন স্খলিত হাত হইতে কুয়ার বালতি পড়িয়া গেল সেই হইতেই এই আন্দোলনের সূত্রপাত। তোমার মতো আমি কাজের মানুষ নহি। বলিতে কী, সারাটি জীবন আমি নিজেকে লইয়াই আছি। বড় জোর নিজের কাজটুকু নিজে করিয়া লই। কিন্তু বৃহৎ জগৎ ও জীবনের সহিত আমার সম্পর্ক নাই। তাই বোধ হয় আমার মনটিও কিছু নিষ্কর্মা। এইসব চিন্তা করিবার অবকাশ পাই।
“কিন্তু ভায়া সচ্চিদানন্দ, চিন্তা বড় সুখের নহে। আমার দাদা কেন সংসারত্যাগী হইয়াছিল তাহা আমার সঠিক জানা নাই। সংসার ছাড়িয়া সে কোন পরমার্থ লাভ করিয়াছে তাহারও সংবাদ পাই নাই। আমার তো সন্ন্যাস গ্রহণেরও দরকার নাই। সংসারে আমি তো সন্ন্যাসীর মতোই বসবাস করিতেছি। আজকাল সেই বৈরাগ্য তীব্রতর হইয়াছে। কিন্তু ভাই, আমি সংসার ছাড়িয়া বনেজঙ্গলে যাইতে পারিব না। আমার সেই সাহস নাই।
“আমার এই অসময়ে তোমাকেই আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তুমি কাছে থাকিলে হয়তো। দু-একটি কথার ফুঙ্কারে আমার অন্তরের জ্বালা নিবারণ করিতে পারিতে। তোমার সাহচর্যই হয়তো আমার বহু জটিল প্রশ্নের মীমাংসা করিয়া দিত। কিন্তু তুমি ব্যস্ত মানুষ, আমার পূর্ব পত্রের জবাবটাই এখনও দিয়া উঠিতে পারো নাই।
“আজকাল নিজেকে বড়ই স্বজনহীন মনে হয়।…”
কোকাবাবুর শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এসে হেমকান্ত সচ্চিদানন্দকে এই চিঠি লিখলেন।
বাড়ির মধ্যেই বাঁধানো পুকুর। চারধারে মস্ত মস্ত পাম গাছ। ৩ার ছায়া জলে এত দীর্ঘ হয়ে পড়ে যে, পুকুরটিকে অতল গভীর বলে মনে হয়। বাস্তবিক পুকুরটি গভীরও। জলে ঘোর গভীরতার একটি কৃষ্ণ রং আভাসিত হয়। বাঁধানো সিঁড়ির ধাপ বহু দূর নেমে সেই কালো জলে কোথায় হারিয়ে গেছে।
পুকুরের ধারেই বাঁধা থাকে দুটি হরিণ। অনেকখানি দড়ির ছাড় দেওয়া থাকে। তারা ইচ্ছেমতো চরে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে জল খায়। কখনও গাছের তলায় বিশ্রাম করে।
এ বাড়ির বড় বউয়ের বাবা মস্ত শিকারী। মেয়ের বিয়ের সময় কথা দিয়েছিলেন, একজোড়া হরিণ আর হরিণী কোনও সময় উপহার পাঠাবেন। অবশেষে কিছুকাল আগে এই দুটি চিত্রল হরিণ আর হরিণী এসে পৌঁছেছে।
বিশাখা এই দুটি অবোধ জীবকে বড় ভালবাসে! প্রথমে ওরা ভয় পেত তাকে। আজকাল পায়। বিশাখা তাদের কমলালেবুর খোসা ও রেয়া, লেবু গাতা, ভেজানো আতপচাল, ছোলা খাওয়ায়। হরিণের চেহারা যত সুন্দর, ডাক এত সুন্দর নয়। কিন্তু পৃথিবীতে সব তো একসঙ্গে পাওয়া যায় না। হরিণ দুটিকে দেখেই বিশাখার চোখ জুড়িয়ে যায়। আর-একটা ব্যাপারও হয়। তার গা কেমন করে।
কেমন করে?
রাজেন মোক্তারের মেয়ে সুফলাকে সে একদিন জিজ্ঞেস করল, হরিণ দুটো দেখে তোর কেমন মনে হয় রে?
খুব সুন্দর। কী সরু সরু পা! অথচ কোন দৌড়োয়!
সে তো জানি। কিন্তু আর কিছু মনে হয় না?
সুফলা অবাক হয়ে বলে, আর কী মনে হবে?
তোর গা কেমন করে না?
কেমন করবে?
কেমন যেন শিরশির শিরশির। আমার করে কিন্তু।
না বাবা, আমার সাপ দেখলে গা শিরশির করে। আর কেঁচো।
সে তো আমারও করে। এ তা নয়। অন্যরকম শিরশির।
কীরকম শিরশির?
তোর কেবল প্রশ্ন। তাকিয়ে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখ, তোরও করবে।
দোতলার বারান্দা থেকে পুকুরের পাড়ে বাঁধা হরিণদুটোকে অনেকক্ষণ ধরে দেখল সুফলা। তারপর বলল, যাঃ।
কিন্তু বিশাখা অন্যরকম জানে। দিঘল চেহারার ছিমছাম দুটি হরিণ তার ভিতরে এক অনুভূতির কম্পন তোলে। একটা অস্ফুট কিছু যেন তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।
বিশাখা লেখাপড়া করেছে সামান্য। খানিকটা বিনোদচন্দ্রের কাছে, আর খানিকটা রঙ্গময়ির কাছে। ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন অপেক্ষা বিয়ের।
এই বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়িতে চলে যেতে বিশাখার যে খুব কষ্ট হবে, তা নয়। এ বাড়িতে তার সত্যিকারের আপনজন কেউ নেই।
দুপুরে বিশাখা স্নান করতে এসেছিল ঘাটে। সঙ্গে তেল, গামছা, শাড়ি নিয়ে দাসী। স্নানে কোনও বাধা নেই। উঁচু দেয়াল দিয়ে চারদিক ঘেরা। ঘাটের পাটায় বসে কিশোরী বিশাখা তেল মাখল। গায়ে ঝঝঅলা সর্ষের তেল। মাথায় ফুলেল।
বিশাখার রূপ সাংঘাতিক! রং যেমন দুধে আলতায়, তেমনই তার লম্বা ডৌলের চমৎকার প্রতিমার মতো মুখ। মাথায় চুলের বন্যা। তবে কেঁকড়ানো বলে চুল খুব দীর্ঘ হয়ে পড়েনি। কোমর অবধি মেঘের মতো ঘনিয়ে থাকে। হেমকান্তর সন্তানদের মধ্যে বিশাখারই রূপ সবচেয়ে বেশি।
চুনী দাসী হলেও সখীর মতোই। বিশাখার কাছাকাছি বয়স। তেরো বা চোদ্দো। দুজনে একসঙ্গেই পুতুল খেলে, লুডো খেলে। একটু দূরত্ব থাকে মাত্র। অর্থাৎ বিশাখার সব কথাতেই চুনীকে সায় দিতে হয়। তার মাও এ বাড়ির দাসী। সেই মেয়েকে শিখিয়ে দিয়েছে, মনিবের মেয়ের মুখে মুখে কখনও জবাব দিবি না।
দুজনেরই পরনে ড়ুরে শাড়ি। বিশাখারটা কিছু দামি। চুনীরটা আটপৌরে। চুনী কিছু স্বাস্থ্যবতী। বিশাখা রোগার পর্যায়ে।
বিশাখা কালো জলে পাম গাছের লম্ববান প্রতিবিম্ব দেখছিল। গভীর নীল আকাশ। জল প্রায় নিথর। মাঝে মাঝে একটু হাওয়া এসে কাপিয়ে দেয় ছায়া। কখনও বড় বড় মাছ ঘাই দেয়। সেটুকু ছাড়া জল বড় স্তব্ধ ও গম্ভীর। পুকুরের বিপরীত ঘাটের কাছে কামিনী ঝোপের নীচে বসে আছে একটা হরিণ। আর-একটা চরছে একটু দূরে।
কী সুন্দর!–বিশাখা বিমুগ্ধভাবে বলো।
কী সুন্দর? কীসের কথা বলছ?—চুনী তার শাড়ির পাড়ে বাঁধা খোঁপা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল।
বিশাখা বলল, দেখছিস না, জলে কেমন ছায়া! আকাশটা! আর হরিণ!
হ্যাঁ গো, সত্যি ভারী সুন্দর। জল যা ঠান্ডা না! স্নান করলে বুঝবে। আজ আমার খুব কাঁপুনি হবে।
তোর এত কাঁপুনি হয় কেন আজকাল?
চুনী একটা লজ্জার হাসি হেসে বলে, সেই যে সেদিন স্নানের সময় ঢিল পড়েছিল সেই থেকে।
বিশাখা একটু ভ্রু কোঁচকায়। ঢিল পড়েছিল ঠিকই। সে বলল, কে ছুঁড়েছিল জানিস?
না, কী করে জানব? দেয়ালের ওপিঠ থেকে এসেছিল। কী বড় ঢিল!
লক্ষ্মণকে বলেছিলাম। সে খোঁজ করেছিল। কাউকে পায়নি।
দুপুরবেলা যারা ঢেলা ছেড়ে তারা তো আর মানুষ নয়।
তবে কি ভূত?
তা নয় তো কী?
বিশাখার বয়স এমন নয় যে, ভূতে বিশ্বাস করবে না। ভূতে তার অবিচল বিশ্বাস। তবু তার কেন যেন মনে হয় সেদিনকার সেই ঢিলটা কোনও ভূত ঘেঁড়েনি।
বিশাখা কিছু বলল না। তেল মাখা হয়ে গেছে। উদাস চোখে সে সামনের দিকে চেয়ে ছিল। ঠিক উদাসও নয়। তার চোখে মায়ার এক অঞ্জন মাখা। আজকাল সে যা দেখে তাই সুন্দর বলে প্রতিভাত হয়।
হঠাৎ চুনী চাপা গলায় বলে উঠল, ওই দেখ! ওই দেখ ছোড়দি! দেয়ালের ওপর ও কার মুণ্ডু!
০০৬. নার্সিংহোমে রক্তের অভাব নেই
নার্সিংহোমে রক্তের অভাব নেই। টাকা ফেললেই বোতল-বোতল রক্ত পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষ্ণকান্তের সেইসব অজ্ঞাতকুলশীল রক্তে আস্থা নেই। সেইজন্য পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে রেখেছেন, বউমার অপারেশন, রক্ত দরকার, তোমরা এসো।
প্রথমেই ট্যাকসি হাঁকড়ে এসে গেল লালটু। ভিতরে ভিতরে যত বিরোেধই থাক, পরিবারের কেউ বিপদে পড়লেই সে আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
লাউঞ্জে বসে কৃষ্ণকান্ত একটা কোল্ড ড্রিংক খাচ্ছিলেন। ভিতরে প্রচণ্ড উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা, গলা শুকিয়ে কাঠ। নার্সিংহোমের কর্তৃপক্ষ অবশ্য তিনি উঠতে বললে উঠছে, বসতে বললে বসছে, কিন্তু তাতে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। জীবন-মৃত্যুর ওপর কোনও খলিফারই তো হাত নেই।
লালটু ঢুকল বুনো মোষের মতো। তেমনই প্রকাণ্ড চেহারা, বেশ বড়সড় একটা ভুঁড়ি, বড় বড় শ্বাস ফেলে, প্রচণ্ড জোরে কথা বলে। ঢুকেই বলল, সেই হারামজাদাটা কোথায়?
কৃষ্ণকান্ত একটু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। হারামজাদা এক ও অদ্বিতীয় ধ্রুব। ছেলেটা তাকে কতদুর ডোবাবে তা তিনি এখনও জানেন না। মতিগতি ফেরানোর জন্য একটু অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়েছিলেন। লাভ হয়নি।
লালটু বলল, আপনি বাড়ি চলে যান কাকা। আমরা তো আছি। আপনি বুড়ো মানুষ, রাত জেগে বসে থাকার কী দরকার?
কৃষ্ণকান্ত একটু গা ঢিলে দিয়ে একটা সোফায় বসে আছেন। পাশে নার্সিংহোমের সুপারিনটেনডেন্ট ও আর-একজন উচ্চপদস্থ গোছের লোক খুব সতর্ক মুখচোখ নিয়ে উপবিষ্ট। কৃষ্ণকান্ত কোল্ড ড্রিংকের ঔ-তে আর-একটা মৃদু টান দিয়ে বললেন, যাব। রক্ত দেওয়ার লোকজন সব আসুক।
আর কে আসবে?
কৃষ্ণকান্ত লালটুর কথার জবাব দেওয়ার আগেই সুপারিনটেনডেন্ট বিনীতভাবে বলল, ব্লাড উইল বি নো প্রবলেম স্যার।
কৃষ্ণকান্ত একথাটায় বিরক্ত হলেন। মাথা নেড়ে বললেন, প্রবলেমটা তোমার বোঝার কথা নয়, মিত্র। তোমরা সব আপ টু ডেট লোক। ব্লাডের ব্যাপার বোঝো না। আমার একটু সংস্কার আছে। আই ওয়ান্ট ব্লাড অফ মাই ওন ক্ল্যান। এটা সায়েন্টিফিক ব্যাপার কিছু নয়, কিন্তু সংস্কার।
মিত্র কথা বাড়াল। শ্রদ্ধার সঙ্গে চুপ করে রইল।
লালটু বলল, কত রক্ত লাগবে? ধ্রুবর বউ তো একটা চিংড়ি মাছের মতো। যা লাগবে আমিই দিতে পারব।–বলে একখানা অতিশয় বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে দেখাল।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, যা লাগার লাগবে। প্রস্তুত থাকা ভাল। ওই তো বোধহয় কানু আর চানু এল। দেখ তো লালটু।
লালটু লাউঞ্জের সিঁড়ি দিয়ে নামে। একটা ট্যাকসি থেকে কানু আর চানু নামছে। তার খুড়তুতো ভাই। বড় কাকার ছেলে। দুজনই ব্রিলিয়ান্ট। একজন শিবপুরে বি ই, অন্যজন এম বি বি এস পাশ করে এম এস করছে। তাদের সঙ্গেই এসেছে বড় পিসির ছেলে সুশান্ত। সে ব্রিলিয়ান্ট নয় বটে, কিন্তু দুর্দান্ত মস্তান। হাঁক-ডাকে ওস্তাদ লোক। লালটু তিনজনকে তাড়া দিয়ে বলল, যা যা ভিতরে যা। আমি একটু এগিয়ে দেখি আর কে আসে।
তিনজনই দৌড় পায়ে ভিতরে চলে গেল। লালটু বাইরে এসে দাঁড়াল। সামনেই একটা তেমাথা। পেট্রল পাম্প। রাত গভীর হওয়ায় রাস্তায় লোকজন নেই। মাঝে মাঝে এক-আধটা মোেটর বা ট্যাকসি দারুণ জোরে বেরিয়ে যাচ্ছে। মধ্যরাত্রির কলকাতার একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে। এই কলকাতাকেই লালটুর বেশি পছন্দ। লালটুর বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। মাত্র ছ-সাত বছর আগেও সে কলকাতার হার্স্ট টিভিশনে ফুটবল খেলেছে। দুবছর ইস্টবেঙ্গলেও ছিল। জীবন এখনও তার কাছে ফুটবলের মতোই উপভোগ্য, টানাপোড়েন ও উত্তেজনায় ভরা। লালটু ফুর্তি করতে ভালবাসে, মারপিট করতে ভালবাসে, মড়া পোড়াতে ভালবাসে। তার ভালবাসা বিচিত্র ও বহুমুখী। তার রাগ সাংঘাতিক, ভালবাসাও সাংঘাতিক। যাকে ভালবাসে তার জন্য জান দিতে পারে, যার ওপর রাগ। হয় তার গলা কেটে ফেলার কথা ভাবে। এই চরমপন্থী মনোভাব তাকে বহুবার বহু সমস্যায় ফেলেছে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে সে টিকে থাকতে পারেনি এই স্বভাবের দরুন। এই স্বভাবের জনাই যে মেয়েটিকে সে সত্যিকারের ভালবাসত তাকে বিয়ে কবতে পারেনি। সবচেয়ে যেটা গুরুতর সেটা হল, উগ্র মেজাজের জন্য বহুবার তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। এখন সে ব্যাংকের অফিসার বটে, কিন্তু আরও একটু উঁচু জায়গায় তার এতদিনে থাকার কথা ছিল। আত্মীয়স্বজনরা বলে, লালটুর পাতিল কালা হয় না। বাঙাল ভাষার কথাটার সাদা অর্থ হল, তার হাঁড়ি কালো হয় না। তবে সে যে দিলদরিয়া লোক এটা সবাই স্বীকার করে। নিজেদের বৃহৎ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি তার আনুগত্য নিরেট ও অটল। ছোটকাকার সঙ্গে তার একটা কাজিয়া চলছে বটে, কিন্তু কাকা কাকাই। রক্তের গভীর সম্পর্ক।
লালটু বাইরে দাঁড়িয়ে ফাঁকা বাস্তাঘাট লক্ষ করছিল। আরও লোক আসবে। তাদেরই জ্ঞাতিগুষ্ঠি সব। রেমির অত রক্ত কিছুতেই লাগবে না। কিন্তু ছোটকাকার স্বভাবই হল ওই। যে কোনও উপলক্ষে নিজের বৃহৎ পরিবারটির সকলকে জড়ো করে ফেলবেন। গোষ্ঠীপতি হিসেবে তিনি নিজের ক্ষমতাটা এইভাবেই যাচাই করতে ভালবাসেন মাঝে মাঝে।
লালটুর হঠাৎ নজরে পড়ল, বাইরের আবছায়ায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে একটা অল্পবয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। খুব উদাস ভঙ্গি। লালটুর ছেলেটাকে চেনা-চেনা লাগছিল। সে দু পা এগোল।
আরে! তুমি রেমির ভাই না?
ছেলেটা একটা জ্বলন্ত সিগারেট টুক করে ফেলে চটিতে মাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, আপনি তো লালটুদা!
কতক্ষণ এসেছ তুমি?
অনেকক্ষণ। সেই সন্ধে থেকেই। আমি একা নই। বাবা, মা, দাদা সবাই আছে।
কোথায়! দেখলাম না তো!
ওরা ওপরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাসপাতালের গন্ধ ভাল লাগে না বলে নীচে এসে দাঁড়িয়ে আছি।
ছেলেটার গায়ে এই শীতেও মাত্র শার্ট দেখে লালটু বলল, গরম জামাও তো পরে আসোনি দেখছি।
সময় পাইনি। দিদির খবর পেয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি।
আরে, এত চিন্তার কী? আমরা তো আছি। আফটার অল রেমি আমাদের বাড়ির বউ। তুমি মা বাবাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। টেক রেস্ট।
ছেলেটা একটু অভিমান ভরে বলল, যদি কোনও দরকার হয় সেইজন্যই আছি। শুনেছিলাম দিদির রক্ত লাগবে। কিন্তু তালুইমশাই কিছুতেই আমাদের রক্ত অ্যাকসেপ্ট করতে রাজি নন। কেন বলুন তো!
লালটু হোট হোর করে হাসল। বলল, আরে! তার জন্য রাগছ কেন? কাকার একটু বাতিক আছে।
এটা কী ধরনের বাতিক? আমরা তো দিদিব পর নই। আমাদের রক্ত কি অশুচি? তালুইমশাই অত্যন্ত ক্লাস কনশাস।
লালটু ছেলেটাকে একটু ভাল করে দেখল। রোগা ফরসা চেহারা। গালে কৈশোরের নরম কিছু দাড়ি এবং গোঁফ। আজকাল দাড়ি গোঁফটা বেশ চালু ফ্যাশন। ছোকরার মাথার চুলও মেলা। ঘাড় পর্যন্ত বাবরি। লালটু বুঝতে পারছিল না ছোকরা কমিউনিস্ট কি না। আগে পায়জামা এবং পাঞ্জাবি ছিল দেশি কমিউনিস্টদের মার্কামারা পোশাক। দেখেই চেনা যেত। আজকাল অবশ্য বাইরেটা দেখে চেনা মুশকিল। ছেলেটার নাম কিছুতেই মনে পড়ছিল না লালটুর। তবে সে বিগ ব্রাদারের মতো ছোকরার কাঁধে হাত রেখে বলল, আরে না, ক্লাস কনশাস কথাটা বড্ড ভারী। ওসব নয়। কাকার ধারণাটা কী জানো? শুনলে তুমি হাসবে, বাট ইট ইজ এ ফ্যাক্ট। কাকার বিশ্বাস, যারা ইস্টবেঙ্গলের লোক তারা এককালে ভাল খেয়েছে-দেয়েছে, ফ্রেশ এয়ার পেয়েছে, কাজেই তাদের রক্তটা একটু বেশি পিউরিফায়েড অ্যান্ড হেলদি।
বলে লালটু আর-এক চোট হোঃ হোঃ করে হাসল।
কিন্তু রেমির ভাই হাসল না। বলল, এই বিজ্ঞানের যুগে ওসব বিশ্বাস অচল। রক্ত কার কত পিউরিফায়েড সেটা স্পেশালিস্টরা বলবে। আমরা পশ্চিমবঙ্গের লোক বলে আমাদের রক্ত পিউরিফায়েড নয় এটা তো অশিক্ষিত লোকের ধারণা। তাই যদি হবে তবে পশ্চিমবঙ্গের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে যাওয়াই বা কেন?
প্রশ্নটা হকের। জবাবটা লালটু খানিক জানে। তবে সে কথা এই দুধের বাচ্চাকে বলবার মতো নয়। সে একটু উদার গলায় বলল, আফটার অল কাকা বুড়ো হয়েছেন, কিছুটা সেনিলিটিও এসে যায় এই বয়সে। এক সময়ে জমিদারি করেছেন, মেজাজটাও তেমন। ওঁর ওপর আমরা কোনও কথা বলি না। তবে জানি, ওঁর অনেক ধারণাই লজিক্যাল নয়।
রেমির ভাই গম্ভীর মুখে বলল, এই বিয়েতে আমরাও খুব খুশি •ই! জামাইবাবুর বিহেবিয়ার খুব খারাপ। দিদি সাইকোলজিক্যালি ভীষণ আপসেট। অনেকদিন ধরেই আমরা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে আসছি লালটুদা। কিন্তু এখন রক্তের পিউরিটির ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব হাস্যকর লাগছে। জামাইবাবুর রক্ত কি আপনার কাছে খুব পিয়োর বলে মনে হয়?
কোথাও কিছু না, এই সামান্য কথাটায় হঠাৎ লালটুর মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠল। সেই আগুন ঝলসে উঠল তার চোখেও। ঠিক কথা, ধ্রুব অল্প বয়স থেকে মদ খায়, অন্যান্য দোষও আছে। কিন্তু তা বলে তার সম্পর্কে এরকম কথা অন্তত কুটুমের মুখে মানায় না। লালটু একটু দম ধরে থেকে রাগটা সামলাল। চণ্ড রাগটাকে সে নিজেই আজকাল ভয় পায়। তারপর চাপা রাগের গনগনে গলায় বলল, ধ্রুবকে আমি বাচ্চাবেলা থেকে জানি, হি ইজ মাই ব্রাদার। মদ আমিও খাই। কিন্তু কোন শুয়োরের বাচ্চা আমার রক্তকে ইমপিয়োর বলবে হে?
রেমির ভাই যে এই ধমকে ভয় খেল এমন নয়। বরং খুবই উদাস একরকম বেপরোয়া মুখে স্তিমিত গলায় বলল, একটু আগে আমার বাবাকে তালুইমশাই ইনডিরেক্টলি অপমান করেছেন। দিদির এই প্রথম বাচ্চা। একটা প্রিমিটিভ নিয়ম আছে প্রথম বাচ্চা হওয়ার দায়দায়িত্ব মেয়ের বাপের বাড়ির। আমার বাবা নার্সিংহোমের খরচটা নিজে দিতে চেয়েছিলেন। তাতে তালুইমশাই এমন সব কথা বললেন যাতে মনে হয় এখনও এদেশে সামন্ততন্ত্র চালু আছে এবং গোটা দেশটাই ওঁর জমিদারি। নার্সিংহোমের খরচ দিতে চেয়ে আমার বাবা যেন ওঁকে অপমান করেছেন।
লালটু খুবই অবাক হয়ে গেল। তার ছোটকাকা নেতা মানুষ। পাবলিক তার সম্পর্কে ভাল কথাও বলে, খারাপ কথাও বলে। কিন্তু তা বলে কুটুমরা বলবে কেন? লালটুর গা-হাত-পা নিশপিশ করছিল।
ঠিক এই সময়ে একটা প্রাইভেট গাড়ি এসে থামল নার্সিংহোমের ফটকে। দরজা খুলে প্রথমে নামল জগা। তারপর ধ্রুব। সঙ্গে আর-একটা বাচ্চা চাকর।
লালটুর রাগটা গিয়ে পড়ল ধ্রুবর ওপর। সে গিয়ে শরীরটা চিতিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। গলায় ফেটে পড়ল রাগ, এতক্ষণ কোথায় ছিলি রে হারামজাদা? তোর জন্য কি আমাদের মুখে চুনকালি পড়বে? শালার তিন পয়সার সব কুটুমও আজকাল লম্বা চওড়া লেকচার ঝেড়ে যায়। ফর ইউ। ওনলি ফর ইউ।
বলে আচমকা ধ্রুবর পুলওভারের বুকের কাছটা খামচে ধরে দুটো মগজ-নাড়ানো ঝাঁকুনি দিল লালটু।
এই একটা লোককে ধ্রুব বরাবর ভয় পায়। নেশা এখন আর নেই। মাথাটা এমনিতেই কেমন ভোম্বল হয়ে আছে। ঝাঁকুনিতে সে আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বলে, কেন, কী হয়েছে? ইজ শি ডেড?
মরলে তোরই মরা উচিত। গো হোম অ্যান্ড শুট ইয়োরসেলফ।
ধ্রুব কিছু বুঝতে পারছে না। অসহায়ভাবে বলল, কী হয়েছে লালটুদা? এনিথিং রং?
এভরিথিং রং। যেসব লোক আমাদের জুতোবরদার হওয়ার যোগ্যতা রাখে না তাদের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়াই বোকামি হয়েছে। যা ভিতরে যা। কাকা বসে আছেন।
ধ্রুব অবশ্য ভিতরে গেল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। জগা দৃশ্যটা দাঁড়িয়ে দেখে আস্তে আস্তে ভিতরে চলে গেল। লালটু এগিয়ে গেল পেট্রল পাম্পটার কাছাকাছি। পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল।
রক্তের শুদ্ধতা সম্পর্কে তার শুচিবায়ু নেই। ওটা কাকার বাতিক ঠিকই। কিন্তু লালটু জানে তাদের পরিবারে আজ অবধি বেচাল কিছু হয়নি। নিজেদের বংশ সম্পর্কে তাদের গৌরব এখন হয়তো বৃথা, কিন্তু এটাও ঠিক গৌরব করার মতো বংশ খুব বেশি লোক পায় না। তারা ভাগ্যক্রমে পেয়েছে। ব্যতিক্রম অবশ্য ধ্রুব। একমাত্র ধ্রুব।
আড়চোখে চেয়ে লালটু দেখে, রেমির ভাই আর-একটু দূরে সরে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে আবার সিগারেট ধরিয়েছে। একটা ট্যাকসি বাঁক নিল। তার হেডলাইটের আলোয় রেমির ভাইয়ের সাদা এবং দাড়িওলা মুখটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্পষ্ট দেখা গেল।
চোখ বাঁচাতে মুখ নামিয়ে নিল ছেলেটা।
ট্যাকসি থেমেছে। তাদেরই লোক। লালটু এগোল। তার অনুমান ঠিক। ট্যাকসি থেকে একে একে নেমে আসছে শচীন, অলক, মৃদুল, জয়িতা, শান্তনু আর পৃথা। ছোটকাকার গোষ্ঠী বা ক্ল্যান। আরও আসবে। আত্মীয়রাই তো শুধু নয়, ছোটকাকার বিশাল পরিচিতির জগৎ। রাজনৈতিক দলের লোকেরা আছে। প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধব আছে। চামচা আছে। একটু বাদেই নার্সিংহোম হয়তোবা জনসমুদ্রে পরিণত হবে।
পায়ে পায়ে আবার লাউঞ্জে ফিরে আসছিল লালটু। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল, ধ্রুব তার দুর্বিনীত শালাটির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে। দুজনে নিচু স্বরে কথা বলছে।
দৃশ্যটা ভাল লাগল না লালটুর। ধ্রুবর উচিত শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কোনও সম্পর্কই না রাখা। ব্যাপারটা একদিন ধ্রুবকে বুঝিয়ে দেবে সে।
পায়ে পায়ে লাউঞ্জে ফিরে আসে লালটু। ছোটকাকা ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন সেই একই জায়গায়। অন্যরা নীরবে দাঁড়িয়ে।
কী হয়েছে?—লালটু জিজ্ঞেস করে।
কৃষ্ণকান্ত তার দিকে একবার চেয়ে মাথা নাড়লেন। গলাটা সাফ করে নিয়ে বললেন, হেমারেজটা বন্ধ হচ্ছে না। কন্ডিশন গ্রেভ। লালটু, নিতাইটাকে দেখ তো। বোধহয় গাড়িতে ঘুমোচ্ছে। ওর কাছে আমার প্রেশারের বড়ি আছে। নিয়ে আয়।
আপনি বাড়ি চলে যান না! একটা কামপোজ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমরা আছি।
না, ঠিক আছে। ওই গর্ভস্রাবটা কোথায়?
ধ্রুব বাইরে আছে। ডাকব?
ডাকতে হবে না। শুধু বল গিয়ে, বউমার অবস্থা ভাল না।
বলে কী হবে? আপনি উত্তেজিত হবেন না। অপারেশন তো হবে। দেখা যাক।
যে রুগি বাঁচতে চায় না তাকে বাঁচাবে কে?
বাঁচতে চায় না?
তাই তো শুনছি। সার্জেন দাশগুপ্ত বলল, পেশেন্ট বলছে, আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই। আমি বাঁচতে চাই না। এমনকী বাচ্চাটার জন্যও না।
লালটু বুঝে নিল, বউমার জন্য দুশ্চিন্তা, ছেলের ওপর রাগ সব মিলিয়ে ছোটকাকা আজ একটু বেহেড। সে গিয়ে ছোটকাকার পাশের খালি জায়গাটায় বসে বলল, ভেঙে পড়বেন না। এভরিথিং উইল বি অলরাইট। আমি বলি, আপনার বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল।
কেন, বাড়ি যেতে বলছিস কেন? বাড়ি গিয়ে কী করব? সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা হবে। তার চেয়ে এই-ই ভাল। যা হওয়ার চোখের সামনে হোক। বাচ্চা মেয়েটা… এই সেদিন বিয়ে দিয়ে আনলাম। স্টিল এ চাইল্ড। ওই গর্ভস্রাবটার দোষে…
কাকা!—লালটু সাবধান করে দেয়। দেয়ালেরও কান আছে। কুটুমরা ঘুরছে আশেপাশেই। কোন কথার কোন অর্থ ধরবে তা তো বলা যায় না। গলা খাকারি দিয়ে সে বলল, ধ্রুবরও তো বয়স বেশি না। পঁচিশ কি ছাব্বিশ। এই বয়সে কত আর কাণ্ডজ্ঞান হয় মানুষের।
এই বয়সে যার না হয় তার কোনওকালেই হয় না। ও জন্মেছে আমাকে শেষ করার জন্য।
অপারেশন থিয়েটারে রেমি তখন আলোর নীচে শুয়ে। এত আলো তবু যেন সব আলোও অন্ধকারকে তাড়াতে পারছে না। অন্ধকার চোখে নয়। ভিতরে।
রক্তে সে আজ স্নান করছে কখন থেকে। ভেসে যাচ্ছে নিজের রক্তের স্রোতে।
বাচ্চাটা জন্মাল দুপুরের একটু পর। অনেক যন্ত্রণা দিয়ে নাড়ি ছিঁড়ে, শরীর অবশ করে নেমে গেল। দুর্বহ যন্ত্রণার অবসান। কচি গলার কান্নার শব্দ পৃথিবী জুড়ে মাদল বাজাতে লাগল।
ছেলে? না মেয়ে?
ছেলে! ছেলে! ছেলে হয়েছে গো! সোনার গয়না দিতে হবে কিন্তু।–ধুইয়ে মুছিয়ে ছেলেটাকে দেখিয়ে এই কথা বলে নিয়ে গেল একটা আয়া।
কিন্তু তারপর থেকে রেমির শরীরের ভিতরে রক্তের কলধ্বনি আর থামতে চায় না।
হেমারেজটা ধরতে অনেক সময় নিয়েছে ডাক্তার। কিন্তু শুধু ডাক্তারেরই কি দোষ? লেবার রুম থেকে বেডে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব টের পেয়েও কি চুপ করে থাকেনি রেমি?
শুধু সে টের পেয়েছিল। কিন্তু কিছু বলেনি কাউকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল অয়েলক্লথের ওপর পাতা চাদর। ঢাকা কম্বলের নীচে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিল। রিমঝিম করছিল মাথা। কানে সব শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছিল।
কে?
আমি। আমি ধ্রুব।
খুব লাজুক মুখেই ধ্রুব এসে দেখা করেছিল।
চোখের দুর্বল পাতা অতি কষ্টে তুলে রেমি জিজ্ঞেস করল, ওকে দেখেছ?
কাকে?
বাচ্চাটাকে।
ন্ না। দেখব। তাড়া কী?
দেখো। ভাল করে দেখো।
তোমার কি খুব কষ্ট হয়েছে?
না। কষ্ট কীসের? মেয়ে হয়ে জন্মেছি, এ কষ্ট তো কপালের লেখন।
তা বটে। বাপদের গর্ভযন্ত্রণা নেই। কিন্তু অন্য যন্ত্রণা আছে।
আছে নাকি? আছে আছে।
রেমির চোখে সেই সময় একটা মস্ত পাথর চাপা দিল কে। আবার একটু বাদে চোখ মেলতে পারল সে। গলাটা বড় শুকনো। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমাকে একটু জল দিতে বলে। বড় তেষ্টা।
ধ্রুব নিজেই জল খাইয়ে দিল তাকে। খুব সাবধানে, আস্তে আস্তে। তবু ধ্রুবর হাত কাঁপছিল। অল্প অল্প চলকাচ্ছিল জল ছোট্ট পোসিলিনের মগটা থেকে।
আঃ, গায়ে জল পড়ছে। ঠান্ডা না!
আমার হাতটা আজকাল কঁপে কেন বলো তো! মাল খাই বলে নাকি?
তুমি যাও, আয়াকে বলো। না হয় নার্সকে ডাকো।
আমিই না হয় দিলাম। দাঁড়াও, গলায় তোয়ালে দিয়ে নিই।
আর লাগবে না। হয়েছে।
ধ্রুব মগটা রেখে দিল। বলল, এবার কেটে পড়তে হবে। বাবা আসবে।
তাই পড়ো না। কে থাকতে বলেছে?
তোমার চেহারাটা ভাল দেখাচ্ছে না রেমি! ইউ আর সিক!
না, মোটেই না। আমি ভাল আছি।খুব জোর দিয়ে রেমি বলেছিল। কিন্তু সে ঠিকই টের পেয়েছিল, সে ভাল নেই। তলপেটে একটা ব্যথা মেরে মেরে নিচ্ছিল। রক্তের কলধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল সে। কিন্তু সে বলেনি সেই কথা। কাউকে বলেনি।
কত বয়স হবে তার এখন? কুড়ি? না, একুশ। হ্যাঁ একুশ। এখনও সে কলেজের ছাত্রী। এই এত অল্প বয়সে সে বউ হয়েছে, মা-ও হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি দরকার ছিল না এসব হওয়া। অপেক্ষা করা উচিত ছিল।
সে আচমকা বলল, শোনো, একটা কথা বলি।
কী?
বাচ্চাটাকে দেখো।
তার মানে?
বাচ্চাটাকে একবার দুটো চোখে দেখে এসো।
বলছি তো দেখব। তাড়া কীসের?
শোনো, এই বাচ্চাটা—এটা তোমার।
তার মানে?
আমাকে সন্দেহ কোরো না।
ধ্রুব একটু লজ্জা পেল কি? হ্যাঁ, পেল। ফরসা রং একটু লাল হল। বেশ দেখতে লোকটা। লম্বা ছিপছিপে চাবুকের মতো চেহারা। স্পষ্টই বোঝা যায় গায়ে অভিজাত বংশের রক্ত আছে। তবু গোলমালটা কোথায়? কেন গোলমাল? কেন লোকটা স্বাভাবিক নয়?
বিয়ের পরই তাদের জোড়ে দার্জিলিং পাঠিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই। সেটা এক ধরনের হানিমুনই হবে। আর সেখানে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।
০০৭. ভাই হেমকান্ত
“ভাই হেমকান্ত, তোমার পত্রখানি ঠিক তিন দিন আগে পাইয়াছি। তাহার পর হইতে কেবলই ভাবিতেছি, তোমাকে কী লিখিব। ভাবিয়া দেখিলাম, দুইটি পন্থা আছে। তোমার মানসিক বৈকল্যে প্রলেপ দিতে দু-একটা সান্ত্বনার কথা, স্তোকবাক্য অথবা এই বৈকল্যকে তোমার দার্শনিক চেতনা বলিয়া বর্ণনা করিয়া লেখা যায়। তাহাতে তোমার মানসিক বৈকল্যের কতদূর কী প্রশমন ঘটিবে জানি না, কিন্তু তোমার দুর্বলতাকে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেওয়া হইবে। দ্বিতীয় পন্থা মোহমুগর। অর্থাৎ তোমার মতো কূপমণ্ডুককে দেশকাল ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সচেতন করিয়া তুলিয়া তুমি যে কত বড় অপদার্থ তাহাই তোমার চক্ষুর সম্মুখে তুলিয়া ধরা। আমি দ্বিতীয় পন্থাটিই গ্রহণ করিলাম।
“তোমার পত্র হইতে যতদূর উদ্ধার করিতে পারিলাম তাহার মোদ্দা কথা হইল, তোমার নবনীনিন্দিত কোমল কর হইতে কুয়ার বালতি খলিত হইয়া জলে পড়িয়াছে। ঘটনা তো তবে সাংঘাতিক। সারা বিশ্বে তো সাম্প্রতিককালে এরূপ বিশাল বিপর্যয় আর ঘটে নাই। ফলে তোমার মনে হইল, তুমি বুড়া হইতেছ, জীবনদীপের শিখা নিস্তেজ হইতেছে ইত্যাদি। ভাল কথা। কিন্তু এই অবিমিশ্র জলীয় মানসিকতার উৎসটি কোথায় তাহা কোনওদিন স্থিরচিত্তে ভাবিয়া দেখিবার অবকাশ পাইয়াছ কি? তোমার হস্তাক্ষর মুক্তার ন্যায় সুন্দর, ভাষাও প্রাঞ্জল। তথাপি বলি, তোমাকে বাল্যকালাবধি গভীরভাবে জানি বলিয়া পত্রটির অন্তর্নিহিত অর্থটি খানিকটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারিয়াছি। সাধারণ মানুষ এই পত্র পড়িয়া মাথামুন্ডু কিছুই বুঝিবে না। বড় জোর ভাবিবে, ইহা বোধ করি কুপিত বায়ুর প্রভাব।
“তোমার মনে আছে কি না জানি না, বাল্যকালে আমরা উভয়ে পাঠশালায় যাইতাম। একদা ব্রহ্মপুত্রের তীরে এক বুড়া পাগল আমাদের তাড়া করিয়াছিল। দোষটা আমারই। সে নিরিবিলিতে বসিয়া বিষ্ঠা ত্যাগ করিতেছিল। আমি তাহাকে একটি ঢিল মারি। খানুপাগলা তাহাতে ক্ষেপিয়া গিয়া অঙ্গের একটিমাত্র আবরণ ছেড়া গামছাখানি পরিত্যাগ করিয়া ভীম হুহুংকারে আমাদের ধাওয়া করিল। প্রকৃতপক্ষে কে ঢিল মারিয়াছিল তাহা সে জানিত না। প্রভাতসমীরে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসিয়া নিবিষ্টমনে সে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সারিতেছিল। ঢিল খাইয়া সে চমকিত হইয়া আমাদের দেখিল এবং তৎক্ষণাৎ তাড়া করিল। কে অপরাধী তাহা সে জানিত না, তবে তোমার রাঙামুলার মতো চেহারাটিই তাহার পছন্দ হইয়া থাকিবে। সুতরাং আমাকে ছাড়িয়া সে তোমার পিছু লইল। সেই বয়েসের পক্ষে যথেষ্ট নাদুসনুদুস শরীর লইয়া তুমি প্রাণভয়ে বইখাতা ফেলিয়া দৌড়াইতেছ আর দিগম্বর খানুপাগলা তোমাকে তাড়া করিয়া লইয়া যাইতেছে, দৃশ্যটা যথেষ্ট হাস্যোদ্রেককারী। কিন্তু মুশকিল হইল সেই সময়ে তুমি দৌড়ঝাপ ভাল জানিতে না। এমনকী আমাদের মতো টিয়া পাঠশালায় যাওয়ার অভ্যাসও তোমার ছিল না। তোমার দৌড় দেখিয়া মনে হইতেছিল যেন স্বয়ং জরদগব দৌড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। কালীবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাইতেই তোমার দম বাহির হইবার জোগাড়, আতঙ্কে চোখ ডিম্বাকৃতি ধারণ করিয়াছে, কেমন যেন দিগবিদিগজ্ঞানশূন্য দিশাহারা অবস্থা। জমিদার নন্দনের সেই দুরবস্থা দেখিয়া পথচারীর অবশ্য হস্তক্ষেপ করিল এবং খানুপাগলাও নিরস্ত হইল। কিন্তু বহুক্ষণ তোমার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসে নাই। তোমার বাক্য সরিতে ছিল না, আর বারবার শিহরিয়া উঠিতেছিলে, চোখে এক অস্বাভাবিক দৃষ্টি। তোমার অবস্থা দেখিয়া আমি ভয় পাইয়া গিয়াছিলাম, পাগলের তাড়া, কুকুরের কামড় বা অন্যতর নানাবিধ উৎপাত বাল্যকালের নিত্যসঙ্গী। ইহাতে অতটা আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে তাহা আমার শিশু মস্তিষ্কে ঢোকে নাই। তবে বুঝিয়াছিলাম, তোমার মন তেমন শক্তপোক্ত নহে। অথচ তোমারই অগ্রজ বরদাকান্ত অসম সাহসী বালক ছিল। তোমার সহোদর নলিনীর সাহসিকতার খ্যাতি তো ব্যাপক।
“তুমি যুবা বয়সে ফুটবল খেলিয়াছ এবং তেমন মন্দ খেলো নাই, তোমার জীবনে একমাত্র ওইটিই যা পুরুষোচিত। সেও খেলিয়াছ আমারই তাড়নায়। নহিলে বাল্যকালে বিদ্যালয়ে তুমি ছিলে বালকদের উপহাস ও লঘুক্রিয়ার উপকরণ। কিন্তু তোমার মধ্যে যে সৎ ও মহৎ একটি মানুষের বাস তাহা অনুভব করিয়া আমি তোমাকে প্রচণ্ড ভালবাসিতাম। তাই তোমাকে লইয়া বিদ্যালয়ে যে লঘু হাস্য-পরিহাস চলিত তাহা আমি পছন্দ করিতাম না। তাই সর্বদা তোমাকে রক্ষা করিয়া চলিতাম। একদিন মনে হইল, তুমি যদি নিজেই নিজেকে রক্ষা করিতে শিক্ষা না করো তবে আমার সাধ্য নাই বহির্বিশ্বের নানাবিধ আক্রমণ হইতে তোমাকে সর্বদা রক্ষা করিতে পারি। ফুটবল একটি উপলক্ষ মাত্র। তবে তাহার বিশেষ উপযোগ শরীর ও মনকে একযোগে গড়িয়া তোলে। বলিতে কী, ফুটবল তোমাকে জীবনের অনেক বাহুল্য বর্জন করিয়া একমুখীন হইতে শিখাইয়াছিল। বিপক্ষের গোলপোস্ট যখন আমাদের লক্ষ্যস্থল তখন ক্রীড়াটিও অর্থপূর্ণ ও লক্ষ্যাভিমুখী সংবেগ লাভ করে। ওই গোলপোস্টটি যদি না থাকে তবে ক্রীড়া অর্থহীন হইয়া যায়। ক্লান্তি আসে ও সমগ্র পরিশ্রমটাই পণ্ডশ্রম হইয়া পড়ে। ভাই হেম, জীবনটাও কি তাহাই নহে?
“তোমার জীবনটা এইরূপ লক্ষ্যহীন হইয়া ওঠার অবশ্য কারণ আছে। বরদাকান্ত সন্ন্যাসী ও নলিনী স্বদেশী হইয়া যাওয়ায় তোমার পিতামাতা তোমার সম্পর্কে বিশেষ সাবধানি হইয়া পড়েন। অত আদর সতর্কতা তোমাকে ঘিরিয়া থাকায় তুমি ছায়াবৃত বৃক্ষের মতো তেমন বাড়িয়া ওঠো নাই। মা-বাবার মুখ চাহিয়া তোমাকে অনেক অনভিপ্রেত গ্রহণ বর্জন করিতে হইয়াছে। ফলে তোমার চরিত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে নাই। উপরন্তু জমিদারনন্দন হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছ বলিয়া তোমাকে খাওয়া-পরার ভাবনাও ভাবিতে হয় নাই। কল্পনাবিলাসী হওয়া তোমার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু ভাই হেম, কল্পনাবিলাসী হওয়া কি আমাদের সাজে?
“দেশ তথা বিশ্বের পরিস্থিতি যদি কিছুটা অনুধাবন করার চেষ্টা করো তাহা হইলে দেখিবে আমরা কীরকম সংকটের ভিতর দিয়া চলিয়াছি। একটা বিশ্বযুদ্ধ শেষ হইয়াছে তো আফগানিস্তান লইয়া আর এক বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। আমানুল্লাকে সিংহাসন ছাড়িতে হইয়াছে। রুশিরা ফৌজ পাঠাইয়াছে। এদিকে সাইমন কমিশনরূপ এক দুষ্টচক্র এদেশে ব্রিটিশ শাসন কায়েম করিবার ফন্দি আঁটিতেছে। সংবাদপত্রটিও কি পড়িবার মতো আগ্রহ বোধ করো না? এদেশে প্রতি বৎসর ইংরাজ ১১১ কোটি টাকার পণ্য বিক্রয় করে। ভারতবাসীকে লইয়া যে ছেলেখেলা ও দুষ্ট ব্যবসা চলিতেছে সে সম্পর্কে সচেতন হও। কল্পনার ভূমি হইতে দেশ কাল পরিস্থিতির মধ্যে অবতীর্ণ হও। মৃত্যুচিন্তা কপূরের মতো উড়িয়া যাইবে।
“তুমি বুড়া হইয়াছ ভাবিলেও হাসি পায়। কই, আমি তো তোমার বয়স্য হইয়াও বুড়া হই নাই! তবে তোমার বার্ধক্যের বোধ কোথা হইতে আসিতেছে? বলিলে হয়তো রাগ করিবে, তবু বলি, তোমার আসল খাকতি অন্য জায়গায়। তোমার সেই স্পর্শকাতর ও সযত্নগোপন স্থানটির সন্ধান আমি কতকটা জানি। বলি কী, লোজ্জা পরিত্যাগ করিয়া বরং রঙ্গময়িকে বিবাহ করো। আর কতকাল একতরফা, প্রকাশবিমুখ, গোপন ও মূক প্রণয়ের জ্বালায় পুড়িয়া খাক হইবে? রঙ্গময়ি বাস্তববোধসম্পন্না, বুদ্ধিমতী ও সাহসী। সে সম্পূর্ণভাবে তোমার ভার লইলে এখনও জীবনে অনেক কিছু করার পথ খুলিয়া যাইবে। তোমার দেহ বৃদ্ধ হয় নাই, হইয়াছে তোমার মন। সুনয়নী আজ বাঁচিয়া থাকিলে আমি একথা উচ্চারণ করিবার সাহস পাইতাম না। যদিও জানি সুনয়নীর প্রতি তোমার প্রেম তেমন গভীর ছিল না। কেন ছিল না সে প্রশ্ন করিব না। হৃদয়ের আচরণ চিরকালই বিচিত্র। সুনয়নীর তো সৌন্দর্যের কোনও অভাব ছিল না। তবু সে তোমার মন পায় নাই! তোমার যখন বিবাহ হয় তখন রঙ্গময়ি নিতান্তই শিশু। তবু তাহার সঙ্গে তোমার বিবাহের একটা প্রস্তাব আসিয়াছিল। দরিদ্র পুরোহিত-কন্যাকে শেষ অবধি অবশ্য তোমরা গ্রহণ করো নাই। কিন্তু বর্জনই কি করিতে পারিলে!
“রঙ্গময়ি তোমাদের বিশাল বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরিয়া এবং তোমাদেরই ভুক্তাবশেষ খাইয়া বড় হইয়াছে। তাহাকে লইয়া রটনাও বড় কম হয় নাই। কিন্তু যখন কৈশোর উত্তীর্ণ হইয়া সে যৌবনে পা দিয়াছে তখনই তাহাকে দেখিয়া বুঝিতাম, তাহার আলাদা একটা সত্তা ও ব্যক্তিত্ব দেখা দিতেছে। সে সুনয়নীর মতো সুন্দরী নহে বটে তবে আমাদের বাড়ির মেয়েদের মতো জলভাতও সে নহে। তুমিও রঙ্গময়ির প্রসঙ্গ উঠিলে লজ্জা পাইতে শুরু করিলে। রোগটা আমি তখনই ধরিয়াছিলাম। কিন্তু তখনও সুনয়নী তোমার ঘর আলো করিয়া বিরাজ করিতেছে। কাজেই বিষয়টি বেশি তলাইয়া দেখি নাই। আমার বিশ্বাস, পুরুষমানুষ একটিমাত্র নারীর দ্বারা সম্পূর্ণ পোষণ পাইতে পারে না। বহু নারীর প্রতি তাহার আকর্ষণ স্বাভাবিক ও প্রকৃতি-অনুমোদিত। কিন্তু বহুবিহারের হ্যাপাও বড় কম নহে। তাই রঙ্গময়ির প্রতি তোমার দুর্বলতা আন্দাজ করিয়াও চুপ করিয়া ছিলাম। উপরন্তু এই যুগে ও পরিবেশে স্বাভাবিক বিবেকসম্পন্ন কোনও পুরুষের নারীপ্রেম লইয়া মাথা ঘামানোটা পাপ বলিয়াই মনে করি। প্রেম যদি কোথাও নিবেদন করিতে হয় তবে তাহা দেশমাতৃকার পায়ে। কিন্তু সেই বীরত্ব তোমার নাই। তবে তোমার সংযম আছে, কুণ্ঠা ও সৌজন্যবোধ আছে। প্রেম থাকিলেও তাহা তোমাকে প্রগলভ করিয়া তুলিবে না ইহাও জানিতাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ওই প্রেমই তোমাকে খাইবে।
“ভাই হেম, আজ তোমার যেসব মৃত্যুচিন্তা ও অনিত্যের ভাবনা দেখা দিয়াছে, আজ যে তুমি নিবিষ্টমনে জগতে কে আত্মজন ও কে পর তাহা বিচার করিতে শুরু করিয়াছ তাহা কিন্তু বাস্তবিক কোনও দার্শনিকতা নহে, বোধিও নহে। প্রবৃত্তির ক্ষুধা একটি ক্ষেত্রে নিবৃত্ত না হইলে অন্যদিক দিয়া ফুটিয়া বাহির হয়। জানিও, দুনিয়ার অধিকাংশ সন্ন্যাসী বৈরাগীই নানা অচরিতার্থ প্রবৃত্তির শিকার। তোমার ক্ষেত্রেও মনে হয়, প্রকৃতি প্রতিশোধ লইতেছে মাত্র। ওই বৈরাগ্যের মূলে আছে সেই নারীপ্রেম যাহা চরিতার্থ হয় নাই। গ্রাসটি সম্মুখে লইয়া ক্ষুধার্ত বাঘটি বসিয়া আছে। সংকোচবশে ভোজন করিতেছে না। প্রবৃত্তি চাহিতেছে, কিন্তু সৌজন্য ও সংকোচ বাধা দিতেছে। বিশেষ করিয়া, তোমার কনিষ্ঠ সহোদরকে জড়াইয়া এই রঙ্গময়ির নামে কলঙ্ক রটিয়াছিল। তদুপরি সে পুরোহিত-কন্যা। এর উপর আবার তোমার পুত্র-কন্যারা সাবালক হইয়াছে, তোমার নাতি-নাতনিও জন্মগ্রহণ করিয়াছে। সংকোচ স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষুধা ছাড়িবে কেন? সে তাই অন্য পন্থা লইয়াছে। তোমার মনের বৈপ্লব ঘটাইয়া এখন সে তোমাকে লইয়া ছিনিমিনি খেলিবেই।
“কুয়ার বালতি লইয়া আর গভীর চিন্তা করিয়ো না। বাইরের ঘটনাগুলি ঘটনাই নয়। আসলে যাহা ঘটে তাহার গভীরে আছে আমাদের মন। সেই মনের সম্মুখীন হও। অকপটে নিজের কাছে নিজেকে প্রকাশ করো। ভাবের ঘরে আর চুরি করিয়ো না।
“প্রিয় হেমকান্ত, তোমাকে এইসব কথা লিখিয়া কিছু ক্লেশও বোধ করিতেছি। হয়তো এতটা কঠোর সমালোচনা না করিলেও পারিতাম। কিন্তু শল্য চিকিৎসারই যদি প্রয়োজন দেখা দেয় তবে সংকটাপন্ন রোগীকে বাঁচাইতে অস্ত্র ধরিতে হয়।
“শীঘ্র দেশে যাওয়া হইবে না। কলিকাতায় কংগ্রেসের সভায় যোগ দিতে আসিয়াছি। যে বিপুল সমারোহ, উৎসব ও উদ্দীপনা এই সম্মেলনকে উপলক্ষ করিয়া দেখা দিয়াছে তাহা অভাবনীয়। মানুষ যদি এইভাবে জাগিয়া ও জাগরণটুকু ধরিয়া রাখিতে পারে তবে স্বরাজ আসিতে কতদিন লাগিবে?…”
হেমকান্ত সচ্চিদানন্দের দীর্ঘ চিঠিটা বার দুই পড়লেন। তাঁর গা একটু জ্বালা করছিল। রাগ, ক্ষোভ তাঁর সহজে হয় না। তবু সচ্চিদানন্দের চিঠি পড়ে হল।
বিশাল ডেকচেয়ারে আধশোয়া হেমকান্ত কাশ্মীরি কারুকাজওলা ছোট্ট ত্রিপয়ের ওপর চিঠিটা রেখে জানালা দিয়ে চেয়ে রইলেন। দক্ষিণের এই জানালা দিয়ে বাড়ির ভিতর দিককার বাগান চোখে পড়ে। দুপুরের কবোষ্ণ রোদ এসে পড়ে গায়ে।
অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ভিতরের অঙ্গন। পুকুর আছে, গাছপালা আছে, লন আছে। নীল উজ্জ্বল আকাশের গায়ে স্পর্ধিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে পাম গাছের সারি। সেদিকে চেয়ে রইলেন হেমকান্ত।
সচ্চিদানন্দ দেশ কাল পরিস্থিতির মধ্যে নেমে আসার পরামর্শ দিয়েছে। চিরকালই সে এইরকম। তার মাথায় ছেলেবেলা থেকেই দেশ কাল পরিস্থিতির চিন্তা। তা বলে সব ছেড়েছুড়ে স্বদেশি করতে সে নেমে পড়েনি। আইন পাশ করে প্রবল প্রতাপে ওকালতি করছে। কংগ্রেসের সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর। বার দুই সে ধরা পড়েছে, আবার ছাড়াও পেয়েছে। সচ্চিদানন্দের সবই ভাল, কিন্তু বড় বেশি বস্তুবাদী এবং ঠোঁটকাটা। সেই কারণেই হেমকান্তর তাকে ভাল লাগে, আবার খারাপও লাগে।
সচ্চিদানন্দের নগ্ন আক্রমণাত্মক চিঠিটার ঝাঝ হেমকান্তকে প্রায় ছেয়ে ফেলেছে। বুকে একটা যন্ত্রণার সূত্রপাত হয়েছিল কয়েকদিন আগে। এখন আবার সেরকম যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাসকষ্টের মতোও লাগছে যেন একটু। মনটা অস্থির।
হেমকান্ত উঠে ভিতর দিককার দরদালানে এসে পায়চারি করতে লাগলেন। দোতলার এই দরদালানটি বিশেষ রকমের নির্জন। হেমকান্ত পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলেন। কুয়ার দড়ি, রঙ্গময়ি, শৈশবকাল, সচ্চিদানন্দ। ভাবনার কি শেষ আছে! ভাবতে বড় ভাল লাগে তার। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, সচ্চিদানন্দের এই বিশ্লেষণ কতদূর সত্য এবং কতটাই বা ভ্রান্ত। কিন্তু তার একটু লজ্জাবোধ হচ্ছে। আপনমনে হাসছেনও। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন।
ইদানীং এই রোগটা দেখা দিয়েছে তার। একা হলেই আপনমনে ভাবতে ভাবতে কখনও হাসেন, মাথা নাড়েন, একটু-আধটু বিড়বিড় করেন। সচ্চিদানন্দটা পাগল। রঙ্গময়িকে বিয়ে করতে উপদেশ দিয়েছে। হেমকান্ত রাগ করতে গিয়ে হেসেই ফেললেন হঠাৎ। কেমন দেখাবে? মাথায় টোপর পরে ছাদনাতলায় যেতে? সিথিমৌরে রঙ্গময়ির রূপই বা কেমন খুলবে? পাগল! সচ্চিদানন্দ একটা পাগল।
মা গো! বলে কে চেঁচাল না পুকুরের ধারে?
হেমকান্ত দরদালানের জানালায় গিয়ে নীচের দিকে চেয়ে দেখলেন, পুকুরের ঘাটে বিশাখা আর চুনী। দুজনেই পিছনের দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে। চোখে রোদ পড়ছিল বলে হেমকান্ত প্রথমটায় ভাল দেখতে পেলেন না। তারপর লক্ষ করলেন, পাঁচিলের ওপর একটা কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল। ওঠা খুব সহজ নয়। কে ওটা? বাইরের লোক? না, বাড়িরই কেউ?
বিরক্ত হেমকান্ত অনুচ্চ স্বরে ডাকলেন, হরি।
তার খাস চাকর দৌড়ে এল।
হেমকান্ত ভ্রু কুঁচকে বললেন, দেখ তো কে একটা লোক পিছনের দেয়ালে উঠেছে। ধরে নিয়ে আয়। পালাতে যেন না পারে দেখিস।
হরি চলে গেল।
হেমকান্ত আবার জানালায় এসে দাঁড়ানোর আগে ঘরে গিয়ে কাঠের আলমারি থেকে দূরবীনটা নিয়ে এলেন। বিদেশে তৈরি শক্তিশালী দূরবীন। চোখে তুলে তিনি দেয়ালের ওপরে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখলেন।
লোক নয়, নিতান্তই অল্পবয়সি ছেলে একটা। সতেরো-আঠারোর বেশি বয়স হবে না। পরনে মালকোঁচা মারা ধুতি, গায়ে হাফ শার্ট। রং বেশ ফরসা। সদ্য দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে। ছেলেটা পিছনের মস্ত আমরাগানের দিক থেকেই দেয়ালে উঠেছে বলে আন্দাজ করলেন হেমকান্ত। তবে ছেলেটার হাবভাব একটু কেমনতরো। মুখ শুকনো। চুল এলোমেলো। চোখের চাউনিটা যেন লক্ষ্যহীন। চারদিকে টালুমালু করে চেয়ে দেখছে।
হেমকান্ত দূরবীনটা নামিয়ে রাখলেন। বরকন্দাজরা দেয়ালের নীচে পৌঁছে গেছে। ছেলেটার পালানোর পথ নেই।
হেমকান্ত সিঁড়ি বেয়ে আস্তে ধীরে নেমে এলেন নীচে। সামনের বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পিছমোড়ায় করে বরকন্দাজরা নিয়ে এল ছেলেটিকে। হেমকান্ত লক্ষ করলেন, ছেলেটা ল্যাংচাচ্ছে।
হেমকান্ত নিষ্ঠুরতা পছন্দ করেন না। কিন্তু এই ছেলেটার বেয়াদবিও সহ্য করার মতো নয়। অন্দরমহলের দেয়ালে উঠবে বাইরের লোক, এ কেমন কথা? ওখানে মেয়েরা স্নান করে, বেড়ায়।
হেমকান্ত গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?
ছেলেটি খুবই ঘাবড়ে গেছে। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে চেটে বলল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। ওটা যে ভিতরের মহল তা বুঝতে পারিনি।
কথাটা সত্যি হতেও পারে। হেমকান্ত বললেন, তোমার নাম কী? কোথা থেকে আসছ?
আমার নাম শশিভূষণ গঙ্গোপাধ্যায়। বাড়ি বরিশাল জেলা।
এখানে কী করতে এসেছ?
চাকরি খুঁজতে?
দেয়ালে উঠে কী করছিলে?
ছেলেটা ঠোঁট কামড়ে একটু যেন ভেবে নিয়ে বলল, আমি গত দুদিন ওই আমরাগানটায় আছি। হেমকান্ত অবাক হয়ে বলেন, আমরাগানে আছ মানে?
কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিলাম না, তাই আমরাগানে ছিলাম।
এই শীতে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। খুব কষ্ট হচ্ছিল।
তা হলে সরাসরি এসে কাছারিবাড়িতে বলেনি কেন? এ বাড়িতে বা যে-কোনও বাড়িতে গেলে একটা আশ্রয় জুটে যেত।
আমার উপায় ছিল না। কেন?
শশিভূষণ ঘাবড়ে গেছে বটে, কিন্তু ভেঙে পড়েনি। হেমকান্তর চোখের দিকে চেয়ে বলল, সেটা খুব নিরাপদ হত না। আপনার লোকেরা একটু তফাত হলে সব কথা বলতে পারি।
হেমকান্ত বিরক্ত হলেন। তবু চোখের ইশারায় সবাইকে সরে যেতে বললে সবাই সরে গেল।
এবার বলো।
আমি দুদিন ধরে কিছু খাইনি। পুলিশের তাড়া খেয়ে এখানে এসে পড়েছি।
কেন, পুলিশ তোমাকে তাড়া করেছে কেন?
তাদের সন্দেহ আমি স্বদেশি করি।
কুঞ্চিত ভ্রু সটান হল হেমকান্তর। একটু হাসলেন। আগেই তার অনুমান করা উচিত ছিল ব্যাপারটা।
হেমকান্ত বললেন, তাই বলো।
শশিভূষণ ক্ষীণ একটু হেসে বলল, আমরাগানে বড্ড মশা। আমি ওখানে আর থাকতে পারছি না।
হেমকান্তর হঠাৎ সচ্চিদানন্দের চিঠিটার কথা মনে হল। দেশ কাল পরিস্থিতি নিয়ে ভাবিত হতে তাঁকে বলেছে সচ্চিদানন্দ। তা দেশকালের তো এই অবস্থা। এইটুকু ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে, বাড়িঘর ফেলে স্বদেশি করে বেড়াচ্ছে। হয় গুলিটুলি খেয়ে মরবে, নয় তো জেলে পচবে।
হেমকান্ত বললেন, দেয়ালে উঠে কী দেখছিলে?
দেখছিলাম এদিকে কোনও পোড়ো ঘর-টর আছে কি না।
অন্য কোনও মতলব ছিল না তো?
শশিভূষণ মাথা নেড়ে বলল, না। অন্য মতলব কী থাকবে? চুরি?
ধরো তাই।
খাবার পেলে চুরি করতাম। তা ছাড়া আর কিছু চুরির মতলব ছিল না।
তোমার বাবা কী করেন?
মাস্টারি। সামান্য মাইনে।
সে জানি। মাস্টারির মাইনে আর আমাকে শেখাতে হবে না। তুমি কতদূর লেখাপড়া করেছ?
বি এ পড়ছিলাম। এখন পড়ছ না?
না। কলেজ ছেড়ে দিয়েছি।
মা-বাপের প্রতি কর্তব্য নেই?
আছে।
সেটা আগে না করেই দেশসেবায় বেরিয়ে পড়েছ?
দেশসেবা তো নয়। পুলিশের সন্দেহ যে, আমি স্বদেশি। বরিশালে একজন পাদ্রি খুন নিয়ে আমাদের বাড়িতে সার্চ হয়। বাবাই আমাকে পালিয়ে যেতে বলেন।
পাদ্রিকে কারা খুন করেছে?
জানি না। তবে লোকটা পাদ্রি নয়। পুলিশের স্পাই।
সে যাই হোক, তোমাকে আশ্রয় দেওয়া বিপজ্জনক।
তা আমি জানি। আমি দুদিন কিছুই খাইনি।
দুদিন?–বলে হেমকান্ত অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।
খাওয়ার পয়সাও নেই। বেরোতেও ভয় করছিল। আমাকে যদি কিছু খাবার দেন তা হলে আবার রওনা হয়ে যেতে পারি।
কোথায় যাবে?
ঢাকা। সেখানে আমার পিসির বাড়ি।
গাড়িভাড়া আছে?
না। তবে এতটা আসতে পেরেছি, বাকিটাও চলে যেতে পারব।
আর যদি ধরা পড়ো?
পড়ব না।
সচ্চিদানন্দের দেশ কাল পরিস্থিতিই কি শশিভূষণের রূপ ধরে এসে হাজির হল?
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হরিকে ডেকে বললেন, একে কিছু খেতে দে। তারপর বারবাড়ির নলিনীর ঘরটায় নিয়ে যা।
শশিভূষণ হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে বলে, আমি ঘরে-টরে যাব না।
হেমকান্ত মৃদুস্বরে বললেন, ভয় নেই, ধরিয়ে দেব না। একটু বিশ্রাম নাও। তারপর চলে যেয়ো।
০০৮. হানিমুন
ফার্স্ট ক্লাস কূপে কামরায় হানিমুনটা শুরু থেকেই জমে যাওয়ার কথা। একদিকে তরতাজা একটা ছেলে, অন্যদিকে টগবগে একটা মেয়ে। কিন্তু জমল না। গাড়ি শেয়ালদা ছাড়তে না ছাড়তেই ধ্রুব তার সুটকেসে জামাকাপড়ের তলায় সযত্নে শোয়ানো বোতলটি বের করে বসে গেল এবং খুব নিবিষ্টমনে প্রায় একনাগাড়ে মদ খেয়ে যেতে লাগল। ফলে খাওয়ার জলের বোতলটা বর্ধমান যেতে
যেতেই শেষ।
রেমি ধ্রুবর দিকে তাকাচ্ছিল না। জানালার ধারে আড়ষ্টভাবে বসে বাইরের চলন্ত প্রকৃতি দেখার চেষ্টা করছিল। এ কার সঙ্গে বিয়ে হল তার? একজন নেতা এবং বড়লোকের ছেলে, এই পরিচয় দেখেই কি বাবা ধ্রুবর সঙ্গে বিয়ে দিল তার? আর কোনও খোঁজখবর করল না? ধ্রুব সুপুরুষ সন্দেহ নেই। রেমি এও জানে, খাওয়া-পরা বা বিলাস ব্যসনের কোনও অভাব তার হবে না। কিন্তু সেইটেই তো সব নয়। এ লোকটা বিয়ের দিন থেকেই গণ্ডগোেল করে যাচ্ছে যে! বিয়ের দিন যখন সাজগোজ করানো হচ্ছে রেমিকে, সেই সময় একবার খবর এল ধ্রুবকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না। দুটো মিনিবাস ভর্তি রুক্ষ ও উগ্র চেহারার বরযাত্রীরা এসে বাড়ি গরম করে ফেলেছে তখন। তাদের অনেকেই ভারী ভারী সোনার গয়না দিয়ে আশীর্বাদও করে গেল তাকে। অন্তত বিশ-ত্রিশ ভরি সোনা রোজগার করে ফেলল রেমি। কিন্তু বরের গাড়ি আসেনি, বর আনতে গিয়েছিল দাদা। সে-ই টেলিফোন করে জানাল, ধ্রুব বাড়িতে নেই। কৃষ্ণকান্তবাবু খুব রাগারাগি করছেন। এমনকী পুলিশকে পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়েছে।
রেমির কানে খবরটা হয়তো এসে পৌঁছত না। কিন্তু সন্ধের লগ্ন পেরিয়ে যাওয়ায় ফিসফাস গুজগুজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাঙালরা একটু উচ্চস্বর হয়েই থাকে, বড় একটা ঢাকঢাক গুড় গুড় নেই। তাদের মধ্যে একজন রেশ চেঁচিয়েই বলছিল, দেখ কোথায় গিয়ে মাল খেয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ওর কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান আছে! কৃষ্ণদা যে কেন এটার বিয়ে দিচ্ছেন তাই বোঝা যাচ্ছে না।
বাঙাল বাড়িতে বিয়ে নিয়ে রেমির আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দ্বিধা এবং ভয় ছিলই। বাঙালদের রীতিনীতি আলাদা, আচার-ব্যবহার আলাদা, রেমিদের বাড়িতে আর কেউ বাঙাল বিয়ে করেনি। তাই বাঙাল ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে অনেকে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু বাবার উপায় ছিল না। কৃষ্ণকান্তবাবুর কাছে অনেক ব্যাপারেই তার টিকি বাঁধা। তিনি নিজের ছেলের জন্য রেমিকে পছন্দ করায় বাবা আর আপত্তি করতে পারেনি। কিন্তু বর বেপাত্তা হওয়ায় সকলেই ঘাবড়ে গেছে। বরযাত্রীদের মন্তব্য বর সম্পর্কে তাদের আরও ভীত করে তুলল।
তবে কৃষ্ণকান্ত অতি ক্ষমতাবান লোক। সারা কলকাতা এবং গোটা রাজ্য জুড়ে তার অজস্র কর্ষিকা। বাড়িতে বসে শুধু টেলিফোন করে কৃষ্ণকান্ত তার কর্ষিকাগুলিকে সক্রিয় করে তুললেন। দলীয় কর্মী, পুলিশ, চামচা, ভক্ত, আত্মীয়স্বজন, আড়কাঠি, বন্ধুবান্ধব সকলেই সজাগ হয়ে উঠল।
পরের লগ্ন রাত এগারোটার কাছাকাছি। তার অন্তত আড়াই ঘণ্টা আগে নৈহাটি স্টেশনের কাছে রুটি এবং মাংস ভক্ষণরত ধ্রুবকে প্রায় এঁটো হাতেই তুলে আনা হল। শোনা যায় সেই শুভদিনে ছেলেকে ধরে আনার পর কৃষ্ণকান্ত নিজের হাতে তাকে চটিপেটা করেন। তবে তার প্রধান অভিযোগ ছিল, উপোস ভেঙে সে বিয়ের দিন রুটি মাংস খেয়েছিল কেন।
ধ্রুব যখন বিয়ের পিড়িতে এসে বসল তখন তার মুখ গম্ভীর এবং থমথমে। একটা মন্ত্রও সে উচ্চারণ করেনি বিয়ের সময়। শুভদৃষ্টির সময় কনের মুখের দিকে তাকায়নি। শুধু পাথরের মতো চুপচাপ বসেছিল। রেমি তখনই জানত, বাবা তাকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছে। এটা বিয়েই নয়। এই লোকটা হয় পাগল, নয় বদমাশ। সারাজীবন একে স্বামী হিসেবে কল্পনা করাও তার পক্ষে কষ্টকর হবে।
ফুলশয্যার রাত্রে ঘরে এসেই একটা আলমারি খুলে মদের সরঞ্জাম বের করে বসে গেল দ্রুব। তাকে বলল, খাওয়ার ঘরের ফ্রিজ থেকে বরফের ট্রে-টা নিয়ে এসো তো।
অবাক রেমি বলল, তুমি আজ মদ খাবে?
খেলে কী? রোজ তো খাই, আজ নয় কেন?
আজকের দিনেও খায় কেউ?
মুখটায় রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে ধ্রুব বলল, প্যান প্যান কোরো না। নিজে না পারো তো একটা চাকরবাকর কাউকে বলো। এনে দেবে।
আমি পারব না।
ধ্রুব একটু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রেমির দিকে। তবে বাড়াবাড়ি করল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, তুমি বেশ সুন্দরী। তবে তোমাকে কিন্তু আমি নিজে পছন্দ করে আনিনি। সুতরাং আমার বেশি দায়দায়িত্বও নেই।
রেমি একটু দাপটের সঙ্গেই বলল, তোমার দায়দায়িত্বের বোধ কেমন তা আমি জানি। আমাকে আর বোঝাতে হবে না।
ধ্রুব এই কথায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। বেল আর জুই ফুলে সাজানো ঘর মাতাল হয়ে উঠছিল গন্ধে। দামি সেন্ট ছড়ানো বিছানা অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। চালু ছিল শব্দহীন এয়ারকুলাব। সেই অদ্ভুত মাদকতাময় ঘরে একা খাটের ওপর পা তুলে শিকারি বেড়ালের মতো তীব্র চোখে রেমি লক্ষ করছিল ধ্রুবকে। এই লোকটা কোনওদিন তাকে ছোঁবে বা আদর সোহাগ করবে ভাবতেও গা ঘিনঘিন করছিল তার।
অনেকক্ষণ চুপ করে অনড় হয়ে বসে রইল ধ্রুব। তারপর একসময়ে চেয়ারটা রেমির দিকে ঘুরিয়ে বসল।
রেমি দেখল ধ্রুবর মুখে রাগ নেই, বিদ্বেষ বা ঘৃণাও নই। এক ধরনের তীব্র ও গভীর বিষণ্ণতা আছে।
ধ্রুব ধীর স্বরে বলল, তোমার নাম তো রেমি!
রেমি সামান্য বিদ্রুপ করে বলল, না, আমার নাম বঙ্গবাসিনী।
ধ্রুব তার দিকে চেয়ে একটু হাসল। বলল, নামটা আমার জানা উচিত, তাই না?
তুমি কি উচিত-অনুচিত মানো?
ধ্রুব রাগল না। ধীর স্বরে বলল, ঠিক আমার মতো অবস্থায় না পড়লে তুমি কখনওই আমার সমস্যার কথা বুঝতে পারবে না রেমি। আমাকে ঘেন্না করা খুব সোজা। এই বাড়ির সকলেই আমাকে ঘেন্না করে। কারণ তাদের সেটা শেখানো হয়েছে।
কথাটা রেমি ভাল বুঝল না। তবে চুপ করে রইল।
ধ্রুব নিজেই খানিকক্ষণ বিরতি দিয়ে বলে, আমার মা নেই, জানো?
রেমি বলল, তোমার মা নেই তাতে কী হল? অনেকেরই থাকে না।
ঠিক কথা। কিন্তু আমার মায়ের এখনও বেঁচে থাকার কথা ছিল। মা গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা যায়। আমি তখন ছোট, বছর দশেক বয়স হবে হয়তো। পদ্মপুকুরের বাড়িতে থাকতাম তখন। বাথরুমে ঢুকে মা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। গোটাটা পুড়ে গেল, অথচ মা একটাও শব্দ করেনি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট বার্নিং, হাসপাতালে তিন দিন বেঁচে থেকে মারা যায়। সেই মৃত্যুটা যতদিন মনে থাকবে ততদিন তোমার শ্বশুরের সঙ্গে আমার লড়াই শেষ হবে না।
রেমি বুঝতে পারছিল না। বলল, কীসের লড়াই?
লড়াইটা বহুমুখী, কারণ বহু কিছুর জন্যই ওই লোকটা দায়ি। লোকটা বর্বর, নির্বোধ, ক্ষমতালোভী, নিষ্ঠুর, অহংকারী। জানো এসব?
না।—মাথা নাড়ল রেমি।
ধীরে ধীরে জানবে। তবে লোকটার গুণও অনেক। সমস্তরকমের বিরুদ্ধতাকেই জয় করতে পারে, সমস্ত প্রতিকূলতাকেই নিজের অনুকূলে ঘুরিয়ে নিতে পারে। ব্রিটিশ আমলে এ লোকটা বিস্তর সাফার করেছে, লাঠি গুলি ফাঁসির দড়িকে ভয় খায়নি। তাই লোকটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা কী জানো? সবচেয়ে বিস্ময়কর কথা? এই লোকটা নিজের দেশ এবং দেশের মানুষকে বাস্তবিকই ভালবাসে।
রেমি এই শ্বশুরপ্রসঙ্গ খুব উপভোগ করছিল না। ছেলের মুখে বাপের নিলে এমনিতেও সুস্বাদু নয়। সে বলল, আমার মাথা ধরেছে। আমি একটু শুচ্ছি।
ধ্রুব উদাস স্বরে বলল, এ বাড়িতে যে ঘেন্নার বীজাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমাকেও তা অ্যাটাক করেছে, বুঝলে? সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। এনি ওয়ে, তুমি শুয়ে পড়ো। আমার বোধহয় আজ রাতে আর ঘুম আসবে না।
রেমি শুয়ে পড়ল এবং একসময়ে ঘুমও এল। খুব সকালবেলা তুমুল চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল তার। বাইরের প্যাসেজে ধ্রুব চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলছিল, কোনও শালার রাইট নেই আমাকে আটকে রাখার। ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো! নইলে আমি গুলি করে উড়িয়ে দেব সবাইকে, সুইসাইড করব…।
রেমি বুকে ধড়ফড়ানি নিয়ে দৌড়ে দরজায় গিয়ে দেখল, চার-পাঁচজন ষণ্ডামার্কা লোক চেপে ধরে আছে ধ্রুবকে। ধ্রুব রক্তচক্ষুতে চেয়ে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু নড়তে পারছে না।
কৃষ্ণকান্ত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। টকটকে গৌরবর্ণ সুপুরুষ। দীর্ঘকায় এবং মজবুত গড়ন। এসে ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। মুখে কথা নেই।
কিন্তু জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল। সপ্তম স্বর চিঁচিঁ করতে লাগল ধ্ৰুবর। সে বলল, দেখুন, আপনার লোকেরা আমাকে ধরে রেখেছে।
কৃষ্ণকান্ত গমগমে গলায় বললেন, ওদের ওপর সেরকমই হুকুম আছে।
কেন, আমি কী করেছি?
কৃষ্ণকান্ত বললেন, ওদের ওপর হুকুম আছে, তুমি বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করলে তোমাকে যেন ধরে আনা হয়।
আমি পালানোব চেষ্টা করিনি।
তবে কী করেছিলে?
মাথা ধরেছে বলে একটু বাইরে যাচ্ছিলাম। হাওয়ায়।
কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, আজকের দিনটা শুধু বেরিয়ো না। চেষ্টা করলেও বেবোতে পারবে না। তবে কাল যেখানে খুশি যেয়ো। কেউ বাধা দেবে না!
এই বলে কৃষ্ণকান্ত আবার ওপরে চলে গেলেন।
রেমির বুকের ধড়ফড় অনেকক্ষণ ছিল। লোকগুলো ধ্রুবকে আবার ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল।
রেমি জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিলে?
ধ্রুবর মুখ-চোখ রাগে লাল। ঘনঘন শ্বাস ফেলছিল। চাপা গর্জন করে বলল, যেখানে খুশি যাচ্ছিলাম, তাতে তোমার বাবার কী?
রেমি দাঁতে দাঁত পিষে বলল, আমার বাবার কিছু নয়, তবে তোমার বাবার তো দেখলাম বেশ মাথাব্যথা।
ধ্রুব চেয়ারে বসে বোতল তুলে নিল। রেমি অবাক হয়ে দেখল, বোতলটা সারা রাত খোলেনি ধ্রুব। অর্থাৎ ফুলশয্যার রাতটা ধ্রুব বাস্তবিকই মদ খায়নি। তবে ভোরবেলা সেই অপমানের পর খেল।
পরদিনই পাহারা তুলে নিলেন কৃষ্ণকান্ত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ধ্রুব আর পালানোর চেষ্টা করল। খুব শান্ত হয়ে রইল কদিন। বেশি বেরোতও না বাড়ি থেকে।
রেমির সঙ্গে অবশ্য ধ্রুবর দেখা হত খুবই কম। পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ি দিনের বেলা স্বামীর সঙ্গে দেখা করার উপায় ছিল না। দেখা হত রাত্রিবেলা। সেই কয়েকদিন ধ্রুব খুব শান্ত রইল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে কেমন একরকম উদাসীন দূরত্ব বজায় রাখত। কথা বলত না একদম। দাড়ি কামাত নাবলে গালে কোমল দাড়ি গজিয়ে ভারী সুন্দর দেখা ওকে। আলাদা একটা ছোট খাটে শুয়ে থাকত।
খুবই কচি এবং কাঁচা বয়স ছিল তাদের। সেই সময়ে তো দুজনের ভিতরেই তীব্র চৌম্বক আকর্ষণ থাকার কথা। ধ্রুবর প্রতি বিদ্বেষ ও ক্ষোভ রেমিকে প্রথম কদিন উদভ্রান্ত রাখলেও একদিন অন্যরকম ঘটল।
সেদিন একটু রাত করেই ঘরে এসেছিল রেমি। ধ্রুব একটু কাত হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত। লম্বা চুলওলা মাথাটা একটু গড়িয়ে গেছে বালিশ থেকে। লাল টুকটুক করছে ঠোঁট। বিশাল চোখের নীচে ক্লান্তির কালো ছোপ। গায়ে একটা ফরসা পাঞ্জাবি, সোনার বোতামগুলো ঝকঝক করছে। ফরসা বুকে কিছু রোম দেখা যাচ্ছিল। একটা তাবিজ ঝুলে আছে গলা থেকে।
বড় মায়া হল রেমির। মাথাটা তুলে দিল বালিশে। এ লোকটাকে তার ভালবাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লোকটা যেন কেমনধারা। কিছুতেই কারও ভালবাসা নিতে হাত বাড়ায় না। বিদ্রোহী? কিন্তু সেই বিদ্রোহের রকমটা এরকম বিদঘুটে কন?
কয়েক মুহূর্তের বিভ্রম। রেমি ধ্রুবর মাথার চুলে একটা হাত বুলিয়ে দিল। তারপর তার পাশেই একটু জায়গা করে নিয়ে শুয়ে পড়ল। ডাকল, এই, ঘুমোলে? শোনো, আমার একা শুতে বুঝি ভয় করে না?
ধ্রুব বাস্তবিকই ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ খুলে তাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হল। তবে রাগ করল, বিরক্তও হল না। বরং ঠাট্টা করে বলল, তুমি কোন শিবিরের লোক তা জানো তো?
জানি।
তোমাকে আমি তাই বিশ্বাস করি না।
নাই বা করলে।
আমাকে শোধরানোর জন্যই বাবা তোমাকে বউ করে এনেছে। কিন্তু আমি এত সহজে শোধরাব রেমি।
তুমি কি খুব খারাপ?
আমি খুব খারাপ হতে চাই।
এখন একটু খারাপ হও না ব্রহ্মচারী, দেখি।
খুব কাছ থেকে ধ্রুবর মুখখানা দেখে সম্মোহিত হয়ে গেল রেমি, কী সুন্দর! তার মেয়েলি অহংকার ভেসে গেল, উবে গেল অভিমান রাগ আর ঘৃণা। শরীর ও হৃদয় জুড়ে বেজে যাচ্ছিল এক দামামা। এই সেই রণবাদ্য যা অবশ্যম্ভাবী করে তোলে দুই বিপরীত শরীরের সংঘর্ষ ও সংঘাত।
একটি-দুটি রাত্রি কাটল শরীরের উন্মত্ততায়।
কিন্তু এই বাড়ির ভিতরে ভিতরে যে বিভেদ, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস জমেছে বহুদিন ধরে, তা ছাড়বে কেন তাদের?
বিয়ের একমাস পরেই ইলেকশন। কৃষ্ণকান্ত বিধানসভার নমিনেশন পেয়েছেন, বাড়িতে প্রচুর লোকের আনাগোনা এবং ভীষণ ব্যস্ততা দেখা দিল। রান্নাঘরে বিশাল উনুন জ্বলে সারাদিন। দলের কর্মীরা অনেকেই এসে খায়। তা হচ্ছে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। বাড়িটা প্রায় বারোয়ারি বাড়ি হয়ে উঠল।
একদিন সন্ধেবেলা ধ্রুব একটা লোককে কলার ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে এল। চেঁচিয়ে কৃষ্ণকান্তের উদ্দেশে বলতে লাগল, দেখুন, আপনার লোকজনকে একটু দেখে যান।
কৃষ্ণকান্ত দলের লোকজনকে নিয়ে ওপরতলায় জরুরি মিটিং করছিলেন। মিটিং অবশ সারাদিন লেগেই থাকত। বিরক্ত মুখে কৃষ্ণকান্ত গাড়িবারান্দার ছাদে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?
ধ্রুব বলল, এই লোকটাকে চেনেন তো! এ হচ্ছে আপনার একজন ক্যামপেনার। রঘুবীর দাশশর্মা।
চিনব না কেন? ও কী করেছে?
একটু আগে হাজরা পার্কের উলটোদিকের গলিতে এ দুটো ছেলেকে মেরেছে। তারা দেয়ালে লিখছিল। সেই দেয়াল নাকি আপনার। শুধু এই কারণে দলবল নিয়ে এ গিয়ে ওদের তাড়া করে। গলিতে নিয়ে গিয়ে পেটে ছোরা মেরেছে। তারপর এসে ফুটপাথে বেঞ্চ পেতে বসে বিড়ি ফুকছে।
কৃষ্ণকান্ত গমগমে গলায় বললেন, চেঁচিয়ো না, ছেড়ে দাও ওকে, আমি দেখছি।
কী দেখবেন?
সে আমি বুঝব।
আপনি বুঝবেন কেন? এ লোকটাকে পুলিশের হাতে দেওয়া উচিত।
কৃষ্ণকান্ত ধমক দিয়ে বললেন, ধ্রুব! ওকে ছেড়ে দাও। পুলিশে দেওয়ার দরকার হলে আমিই দেব। তুমি তোমার কাজে যাও।
সেটা তো আইন নয়।
আইন তোমার চেয়ে আমি ভাল জানি।
জানেন, কিন্তু মানেন না।
কৃষ্ণকান্ত একটু বিপদে পড়লেন। কারণ দলের লোকজন সব উঠে গাড়িবারান্দার ওপরে ভিড় করে পিতা পুত্রের নাটক দেখছে। নীচে এবং ফটকের বাইরেও লোক জমা হচ্ছে।
কৃষ্ণকান্ত মরিয়া হয়েই বললেন, ও যে মেরেছে তার কোনও সাক্ষী আছে?
আমিই সাক্ষী।
তুমি একা?
তা ছাড়া আর কে সাক্ষী দেবে?
তুমি ঠিক দেখেছ?
নিশ্চয়ই। আপনি থানায় টেলিফোন করুন। আমি সাক্ষী দেব।
রঘুবীর দাশশর্মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। একটু হাসছিলও মাঝে মাঝে। সে জানে ধ্রুব একটু পাগলা গোছের। সে এও জানে কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী যে-কোনও বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করবেনই।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, আমি থানায় ফোন করছি। রঘুবীরকে ওপরে আসতে বলো।
ব্যাপারটা এইখানেই মিটে গেল অবশ্য। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পুলিশ এসে রঘুবীরকে ধরে নিয়ে যায় এবং তার পরদিনই রঘুবীর ছাড়া পেয়ে অন্য এলাকায় কৃষ্ণকান্তর হয়ে খাটতে থাকে।
কৃষ্ণকান্ত তখন একদিন রেমিকে ডেকে বললেন, বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নিয়ে দামড়াটাকে সঙ্গে করে কদিন দার্জিলিং বেরিয়ে এসো তো মা। রিজার্ভেশন হয়ে গেছে।
সেই তারা হানিমুনে চলল। রক্ষণশীল পরিবারের পক্ষে দারুণ আধুনিক ব্যাপার।
মধুচন্দ্রিমা না নিমচন্দ্রিমা তা কে বলবে? ধ্রুব সেই আগের মতোই অস্বাভাবিক। কিছুতেই রেমিকে চিনতে চায় না। তাকায় না, কথা বলে না। দিনরাত একনাগাড়ে মদ খেয়ে যাচ্ছে।
ইলেকশনের সময় তাকে কেন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা কি বোঝেনি ধ্রুব? ঠিকই বুঝেছিল। আর রেমি বুঝতে পারছিল মাত্র কয়েকদিনের শারীরিক প্রেম ধ্রুবর ফুরিয়ে গেছে। শরীর আর কতদিন শরীরের বাঁধনে বাঁধা থাকতে পারে। যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে যৌনতাই প্রধান সেখানে সম্পর্ক বাতাসের ভর সয় না।
বর্ধমানে ধ্রুব রেমিকে বলল, যাও না, প্ল্যাটফর্মের কল থেকে জলের বোতলটা ভরে আনো।
আমি?—রেমি অবাক হয়ে বলল, আমাকে জল আনতে বলছ?
কেন, তুমি আনলে কী হয়?
মেয়েরা কখনও এসব করে? যদি গাড়ি ছেড়ে দেয় আমি তো দৌড়ে এসে চলন্ত ট্রেনে উঠতেও পারব না।
চেষ্টা করলে সব পারা যায়। পারবে।
তুমি পারো গিয়ে। আমি তোমার মদ খাওয়ার জন্য জল আনতে পারব না।
তা হলে আমি বাথরুমের জলই মিশিয়ে খাব।
তা খেতে পারো।
খাব? তুমি আমাকে খেতে দেবে? জানো, গাড়ির জলে এক লক্ষ রকমের জীবাণু আছে?
তা আমি কী করব? তোমাকে তো আমি মদ খেতে বলিনি।
মাইরি, যাও না।
বলেছি তো পারব না।
ঠিক আছে, তা হলে আমিই নামছি। যদি গাড়িতে উঠতে না পারি তা হলে তুমি একাই দার্জিলিং যেয়ো।
এই বলে ধ্রুব নিজেই উঠল এবং জলের বোতল নিয়ে নেমে গেল। সেটা গ্রীষ্মকাল। প্ল্যাটফর্মের কলে দারুণ ভিড়। রেমি দেখল, ধ্রুব সেই ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে ঢুকে পড়ল। কিন্তু তারপর আর তাকে দেখা যাচ্ছিল না।
জল নিয়ে যাত্রীরা হুড়হুড়ি করে ফিরে আসছে। কল প্রায় কাঁকা হয়ে গেল। কিন্তু ধ্রুবকে আর দেখতে পেল না রেমি। গার্ডের হুইশিল বাজল। একসময়ে গাড়ি নড়ে উঠল।
কিন্তু ধ্রুব?
আতঙ্কে জানালা দিয়ে রেমি তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, এই তুমি কোথায়? ওগো, তুমি এসো শিগগির! গাড়ি ছেড়ে দিল যে!
কিন্তু কোথায় ধ্রুব? বর্ধমান প্ল্যাটফর্ম ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পিছন দিকে।
মরিয়া রেমি গাড়ির অ্যালার্ম চেন ধরে ঝুলে পড়ল। গাড়ি থামতেই সে নেমে পড়ল আগুন-গরম প্ল্যাটফর্মে। তারপর ছুটতে লাগল পিছন দিকে।
ধ্রুবকে অবশ্য পাওয়া গেল সহজেই।
খুব নিবিষ্টমনে হুইলারের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। রেমি গিয়ে তার হাত ধরতেই সে একটুও লজ্জিত না হয়ে একটা হাই তুলে বলল, প্রেমের চেয়ে তা হলে সিকিউরিটিই বড়! কী বলে?
০০৯. সন্ধের কুয়াশামাখা অন্ধকার
তখন সন্ধের কুয়াশামাখা অন্ধকার ধীরে ধীরে গড়িয়ে আসছে চারদিক থেকে। জল-স্থল-অন্তরীক্ষের সব বাস্তবতা হারিয়ে যাচ্ছে এক রহস্যময় কুহেলিকায়। ব্রহ্মপুত্রের বুক থেকে আঁশটে গন্ধ বয়ে নিয়ে হু-হু করে উত্তুরে হাওয়া এল। কাছেপিঠে ডেকে উঠল একশো শেয়াল।
বিকেল থেকেই শশিভূষণ টের পাচ্ছিল, জ্বর আসবে। কিন্তু পরের বাড়িতে অচেনা লোকজনের কাছে সে কথাটা বলতে পারেনি। একটা ঘর আর একটা বিছানা পেয়ে সে বর্তে গিয়েছিল। শেষ বেলায় এক পেট খেয়ে অঘোরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। ঘুম ভাঙল মাথার ব্যথা আর শরীরের কম্পে। কাউকে ডাকবে কি না বুঝতে পারছিল না সে। এরা রাজা জমিদার মানুষ। এসব লোক কেমন হয় তা তার ভাল জানা নেই। আশ্রয়টুকু দিয়েছে সেই ঢের। এরপর আবার অসুখ-বিসুখের কথা শুনলে হয়তো বিরক্ত হবে। শশিভূষণের অবশ্য জ্বরের সঙ্গে চেনাজানা বহুদিনের। এ হল ম্যালেরিয়া। খুব বেশিক্ষণ থাকে না। কিন্তু যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ঘরে কেউ আলো জ্বেলে দিয়ে যায়নি। অবশ্য আলোর ব্যবস্থা আছে। জ্বেলে নিলেই হয়। কিন্তু শশিভূষণ ভয়ে আলো জ্বালল না। ঘরে যে লোক আছে সেটা পাঁচজনকে জানান দেওয়ার কী দরকার?
লেপমুড়ি দিয়ে শশিভূষণ ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যেতে লাগল চেতনা। চোখের তারা উলটে গেল। কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে সে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা আর শেকসপিয়রের নাটক থেকে মুখস্থ বলতে লাগল। মাঝে মাঝে ভূত! ভূত! বলে চেঁচিয়ে উঠতে লাগল।
ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল সে। উঠে সেটা আর খুলে দিতে পারেনি। জানালার একটা পাল্লা ভাঙা। তা দিয়ে ভয়ংকর ঠান্ডা হাওয়া আসছিল ঘরে। অন্ধকারে একটা কি দুটো জোনাকি পোকা ঘুরে ঘুরে ওড়ে। গাছের ডালে রহস্যময় সব শব্দ হয়। শেয়াল ডাকে। জ্বরের। ঘোরে এইসব আবহ এক বিচিত্র পরপারের ছবি রচনা করে শশিভূষণের চারপাশে।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নামার পরও কৃষ্ণকান্ত বারবাড়ির মাঠে একটা টাটু ঘোড়া চালাচ্ছিল। ঘোড়া চালাতে সে সদ্যই শিখেছে। রোমাঞ্চকর এই অভিজ্ঞতার প্রথম স্বাদ সে যতক্ষণ পারে উপভোগ করে নেয়। সারা বিকেল ঘোড়া চালিয়েও সে ক্লান্ত হয়নি। আরও অনেকক্ষণ চালাতে পারে। কিন্তু উপায় নেই। একটু বাদেই প্রতুল মাস্টারমশাই আসবেন। হরি এসে তাকে ডেকে নিয়ে যাবে।
তার এই ঘোড়া দাবড়ানোর দৃশ্যটা দেখছিল মাত্র একজন। সে হল হর কম্পাউন্ডার। এই বিশ্বসংসারে তার আপনজন আর কেউ অবশিষ্ট নেই। বছর দুই আগে কৃমি বিকারে তার মেয়েটা মরার পরই সব মায়ানমোহের বাঁধন একদম কেটে গেল তার। কিন্তু সেই সঙ্গেই দেখা দিল মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ। পাঁচ টাকা বেতনে সে জ্ঞানদা দাঁতব্য চিকিৎসালয়ে চাকরি করত। কৃষ্ণকান্ত তখন প্রায়ই গিয়ে ডাক্তারখানার পেছন দিককার ওষুধের ঘরে বসে থাকত। অবাক হয়ে দেখল হর কম্পাউন্ডার কেমন ওষুধের সঙ্গে ওষুধ মেশায়, শিশির গায়ে নকশাকাটা কাগজের দাগ সাঁটে আঠা দিয়ে। মাঝে মাঝে মেজার গ্লাসে কৃষ্ণকান্তকে মিষ্টি ও সুগন্ধী সিরাপ খাওয়াত সে। বিস্তর ভূত-প্রেতের গল্প শোনাত।
মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দেওয়ায় হর কম্পাউন্ডারের চাকরিটি গেছে। কিন্তু হেমকান্ত তাকে তাড়িয়ে দেননি। হর কম্পাউন্ডারকে চাকরি দিয়েছিলেন তার বাবা শ্যামকান্ত। বাপের আমলের পুরনো ও বিশ্বাসী লোকটিকে তাই এখনও নিজের আশ্রয়ে রেখেছেন।
মায়ামোহ মানুষের জন্মগত অভিশাপ। সহজে কাটে না। আপন না পেলে পরকে আঁকড়ে ধরে। এমনকী বেড়ালটা, কুকুরটা, গাছটা পর্যন্ত মায়াবশে মানুষের আপন হয়। হর কম্পাউন্ডারেরও হয়েছে তাই। এ বাড়ির চৌহদ্দিতে তার একটা অদৃশ্য খোঁটা পোঁতা আছে। সেই খোঁটায় বাঁধা মায়ার দড়ি। কে যেন টানে। হর কম্পাউন্ডার তাই আর কোথাও যেতে পারেনি শেষ পর্যন্ত।
এই যে কৃষ্ণকান্ত, দশ-এগারো বছরের তেজি সুন্দর ছেলেটা এ হল মনিবের ছেলে। আত্মীয়তা নেই, অবস্থা বয়স ইত্যাদির ফারাকও যথেষ্ট। তবু এ ছেলেটাকে দেখলেই বুকটার মধ্যে কেমন উথলে-ওঠা ভাব হয় তার। ছেলেটার যা দেখে তাই তার ভাল লাগে। এই যে আবছায়া মতো আলোয় সাদা টাটু ঘোড়ায় চেপে চারদিকে ঢেউ তুলে দাবড়ে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণকান্ত, এই দৃশ্যটাকে তার পার্থিব কিছু বলে মনে হয় না। এ যেন এক স্বপ্ন-দৃশ্য। বিলিতি ছবির বইতে এরকম সব ছবি আছে। তা থেকেই যেন বেরিয়ে এসেছে ছেলেটা, আবার ছবির মধ্যে ফিরে যাবে।
কাছারির মাঠের চারধারে ঋজু পাম গাছের মিছিল। তারই ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণকান্ত। ঘোড়ার খুরের শব্দ ধরিত্রীর হৃদস্পন্দনের মতো ধুকপুক ধুকপুক করে বেজে যাচ্ছে অবিরল।
মস্ত একটা চক্কর দিয়ে কৃষ্ণকান্ত ঘোড়া ছুটিয়ে কাছে আসে। আবার দূরে চলে যায়। হর কম্পাউন্ডার কাছারির সিঁড়ির শেষ ধাপটায় বসে একটা নস্যি রঙের আলোয়ানে সারা গা ঢেকে চুপচাপ দেখতে থাকে। তার মুখে একটু হাসি লেগে আছে সেই কখন থেকে।
পৃথিবী জায়গাটা ভাল না খারাপ তা আজকাল আর বুঝতে পারে না হরনাথ। তবে সে বোঝে যে, এখানে তার আর কোনও কাজ নেই। কাজ শুধু চেয়ে থাকা, শুধু বসে থাকা, শুধু বেঁচে থাকা। আর কিছু নয়।
কৃষ্ণকান্ত গল্প শুনতে বড় ভালবাসে। আগে তাকে অনেক গল্প শোনাত হরনাথ। আজকাল আর গল্প মনে পড়ে না। একটা গল্প শুরু করে অন্য গল্পে চলে যায়। মাথাটা ঠিক নেই কিনা। আজ তার বদরুদ্দিনের গল্পটা মনে পড়েছে। সবটা নয়, তবে কিছুটা। কৃষ্ণকান্ত ঘোড়া চালানো শেষ করে তার পাশটিতে এসে বসবে। তখন গল্পটা শোনাবে হরনাথ। তাই প্রাণপণে সে গল্পটা মাথার মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আজকাল বেশিক্ষণ কিছুই সে মাথায় রাখতে পারে না।
বদরুদ্দিনের ঘোড়াটার বয়স হয়েছিল। তার ওপর চোখে ছানি পড়তে লাগল। বদরুদ্দিনও বুড়ো মানুষ। চোখের নজর তারও তখন কমে এসেছে। তবু সওয়ারির জন্য কানা ঘোড়ায় ছাকরা গাড়ি জুতে বদরুদ্দিন রোজ বেরোত। তবে গণ্ডগোলও হত খুব। প্রথম-প্রথম আন্দাজে রাস্তা ঠাহর করত। পরে ভুল রাস্তায় নিয়ে গিয়ে সওয়ারির ধমক খেত। বদরুদ্দিন রেগে গিয়ে চাবুক চালাত শপাশপ। কিন্তু ঘোড়াটাই বা কী করে! মার খেয়ে বেচারা চিহিহি করে কেঁদে উঠত শুধু। তারপর একদিন গাঙ্গিনার পাড়ে রাস্তা ছেড়ে ঘোড়াটা গিয়ে পড়ল একটা মাদার গাছের ওপর। গলায় ফাঁস লেগে ঘোড়াটা আর ঘাড় ভেঙে বদরুদ্দিন নিজেও সেইখানেই মরে গেল। তা বলে গল্পটা শেষ হল না কিন্তু। শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বদরুদ্দিন। গা ছাড়া দিয়ে উঠল তার ঘোড়াও। দুজনেই তখন চোখে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ভাঙা গাড়িটায় আবার ঘোড়া জুতে নিল বদরুদ্দিন। তারপর পঙ্খিরাজের মতো উড়ে বেড়াতে লাগল শহরময়। মাঝরাতে না জেনে কেউ কেউ এখনও বদরুদ্দিনের ছ্যাকরা গাড়ির সওয়ার হয়। আর রাস্তা ভুল হয় না।
বুড়ো সহিস লণ্ঠন হাতে এসে দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মধ্যিখানে। ঘোড়র পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে।
ও ছোটকর্তা, এবার নামো। ঘোড়ার মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। আর না।
কৃষ্ণকান্ত ঘোড়া থামায়। হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বসে হরনাথের পাশে। বলে, ওফ, দারুণ চালিয়েছি আজ। না, হরদা?
খুব।
দুজনেই চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। কুয়াশা এবং অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে। মন্দির থেকে শঙ্খধ্বনি আসে।
কৃষ্ণকান্তর সত্যিকারের কোনও অভিভাবক নেই। হেমকান্ত তার প্রতি নজর দেন না। কেউই দেয় না। মাঝে মাঝে রঙ্গময়ি একটু-আধটু ডাক খোঁজ করে মাত্র। কৃষ্ণকান্ত বেড়ে উঠছে নিজের মতো করেই। সময় মতো লেখাপড়া করা আর ইস্কুলে যাওয়া ছাড়া বাদবাকি সময়টা সে কী করে বেড়ায় তার খোঁজ কেউ নেয় না। সুতরাং নানা সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড করে সে। তিনতলার চোর-কুঠুরিতে পুরনো আমলের কিছু অস্ত্রশস্ত্র আছে। সেই ঘর থেকে একদিন একটা তরোয়াল বের কবে এনেছিল কৃষ্ণকান্ত। সারাদিন খোলা তরোয়াল হাতে করে ঘুরে বেড়াল। কয়েকজন অবশ্য বারণ করেছিল, সে শোনেনি। বস্তুত হেমকান্ত ছাড়া আর কারও কথা শোনে না সে। ফয়জলের গোটা দুই ছাগল আর ছানাপোনারা রোজই ঘাস খেতে আসে বারবাড়ির পশ্চিম দিককার গোচর-ভূমিটায়। কখন যে কৃষ্ণকান্ত সেখানে হাজির হয়েছে তা কেউ জানে না। হঠাৎ তার আর্তনাদ শুনে লোকজন ছুটে গিয়ে দেখল ধাড়ি ছাগলটার মুন্ডু খসে পড়ে আছে মাটিতে, ধড়টা ছটফট করছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা। কৃষ্ণকান্ত রক্তমাখা তবোয়াল হাতে দৃশ্যটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থরথর করে কাঁপছে।
কৃষ্ণকান্ত চমৎকার সাঁতার কাটতে পারে। বিশেষ করে ড়ুবসাঁতার। একদিন তার ইচ্ছে হল, অন্দরমহলের দিকে যে অথৈ পুকুরটা আছে তার তলা থেকে মাটি খামচে আনবে। যেই কথা, সেই কাজ। একদিন ড়ুব দিল তো দিলই। আর ওঠে না। হরি বিপদ বুঝে লোকজন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। যখন কৃষ্ণকান্তকে তোলা হল তখন মৃত্যুর ঘণ্টা প্রায় বেজে গেছে।
হেমকান্তর অন্যান্য ছেলেরা যেমন শান্ত ও সুশীল কৃষ্ণকান্ত তেমন নয়। ঘরের চেয়ে বাইরের আকর্ষণ তার ঢের বেশি। বাড়ির পিছন দিকে পগারের ওপারে হেমকান্তর কিছু প্রজা বাস করে। তারা গরিব ও অসংস্কৃত। কৃষ্ণকান্ত নিয়মিত সেই পাড়ায় যায়। সেখানে তার একদঙ্গল অনুচরও জুটে গেছে। কৃষ্ণকান্ত তাদের সঙ্গী করে মাঝে মাঝে মারপিট লাগায় অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে। এর ওর তার বাড়ি থেকে ফুল ফল চুরি করে। তাদের সঙ্গে ফুটবলও খেলে।
ব্ৰহ্মপুত্রের ধারে যেসব ডিঙিনৌকো থাকে সুযোগ পেলেই কৃষ্ণকান্ত দড়ি খুলে সেগুলো স্রোতের মুখে ঠেলে দিয়ে আসে। বুড়ো রামভজুয়া দারোয়ানের কানে সে একবার গোকুলপিঠের গরম রস ঢেলে দিয়েছিল। রামভজুয়ার সেই কান একদম গেছে।
হেমকান্তর কাছে অবশ্য এসব খবর বড় একটা পৌঁছয় না। প্রথম কথা, কৃষ্ণকান্ত যে হেমকান্তর আদরের ছেলে এটা সবাই জানে। দ্বিতীয় কথা, মা-মরা ছেলে বলে সকলেরই একটু মায়া আছে। তাই কেউ নালিশ করতে যায় না। হেমকান্তর বড় ছেলে কনককান্তি কলকাতায় তাদের কালীঘাটের বাড়িতে থাকে। শ্বশুরের সঙ্গে সে একটা ব্যাবসায় নেমেছে। ব্যাবসা কীসের তা খোঁজ করেননি হেমকান্ত। তবে আয় বোধহয় ভালই হচ্ছে। কনকান্তি টাকার জন্য বাপকে চিঠি লেখে না। সম্প্রতি সে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে কৃষ্ণকান্তকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করতে চায়। হেমকান্ত না বা হ্যাঁ কোনওটাই জানাননি। কৃষ্ণকান্তকে ছেড়ে থাকতে তার কষ্ট হবে। তবু তাকে যে কলকাতায় পাঠানোই উচিত তাও তার মনে হয়। এখানে কৃষ্ণকে দেখার কেউ তেমন নেই। কনককান্তিও আগ্রহের সঙ্গেই চাইছে।
কিন্তু কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তাবে কৃষ্ণকান্ত কেঁদে ভাসিয়েছে। বাবা তাকে এখনও কিছু বলেনি ঠিকই, কিন্তু যদি বলে? বাবার কথার ওপর তো আর কথা চলে না। মনু পিসি বা রঙ্গময়িই হচ্ছে তার একমাত্র ভরসা। বড়দা তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চায় শুনে সে গিয়ে মনু পিসির ওপর হামলে পড়ল, আমি কিন্তু কিছুতেই যাব না, বলে দিচ্ছি। তুমি বাবাকে রাজি করাও।
কৃষ্ণ কোথাও চলে যাবে এটা রঙ্গময়িও ভাবতে পারে না। সুনয়নী চলে যাওয়ার পর এই দুধের বাচ্চাটিকে সে বুকে আগলে এত বড়টি করেছে। তবু সে বলল, যাবি না তো কী করবি? এখানে কে তোকে অত চোখে চোখে রাখবে? কখন পুকুরে ড়ুবে মরিস, কার সঙ্গে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে আসিস তার তো ঠিক নেই। কলকাতায় ধরাবাঁধা জীবন, সেখানেই গিয়ে থাকা ভাল।
এরপর কৃষ্ণকান্ত রেগে রঙ্গময়িকে আঁচড়ে কামড়ে চুল ছিঁড়ে একাকার কাণ্ড করল। রঙ্গময়ি ভরসা দিল, আচ্ছা যা, তোর বাবাকে রাজি করানোর চেষ্টা করব।
কৃষ্ণকান্ত ভরসা পেল বটে, কিন্তু ভয়টা আজও কাটেনি। কনককান্তি সামনের মাসে আসছে। সেই সময় আবার তাকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার কথা উঠবে। সেখানে এমন অবারিত মাঠঘাট নেই, ঘোড়া নেই, বন্ধু নেই, ধারেকাছে নেই নদী বা পুকুর। বড়দা লোকটা ভারী গোমড়ামুখো। বউদিও ভীষণ রাগী।
কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, হরদা, কখনও কলকাতায় গেছ?
গেছি। অনেকদিন আগে।
তোমার ভাল লাগে?
না।
তোমার এ জায়গাটাই বেশি ভাল লাগে, না হরদা?
হ্যাঁ।
আমারও। তবু বড়দা আমাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইছে।
হরনাথ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, সে কী? তুমি যেয়ো না।
কিন্তু জোর করে নিয়ে গেলে কী করব?
তুমি জোর করেই এখানে থেকে যাবে।
কৃষ্ণকান্ত একথায় হেসে উঠে বলল, হরদা, তুমি সত্যিই পাগলা। বাবা যদি বলে, ওরে কৃষ্ণ, কনকের সঙ্গে কলকাতায় যা, তা হলে কী হবে?
তুমি লুকিয়ে থেকো। আমি তোমাকে একটা জায়গা দেখিয়ে দেব। কেউ খুঁজে পাবে না তোমাকে।
কৃষ্ণকান্ত সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলী হয়ে বলে, আছে সেরকম জায়গা?
অনেক আছে। কেউ খুঁজে পাবে না। জায়গাটা দেখাবে আমাকে?
হরনাথ মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখছিল কৃষ্ণকান্তকে। এ ছেলে ভবিষ্যতে খুব বড় কেউ একজন হবে। চোখের দৃষ্টি এই বয়সেই কী গভীর! কেমন ধারালো চেহারা। সে বলল, দেখাতে পারি। তবে একটু ভয়ের জায়গা।
ভয়! কীসের ভয়?
ওখানে আরও একজন থাকে কিনা।
সে কে?
তোমার কাকা। নলিনীকান্ত।
কী যে বলো! কাকা তো বেঁচে নেই।
তা না থাক, মরে তো আছে।
তার মানে?
হরনাথ নির্বিকার গলায় বলে, নলিনীবাবুর ঘরে এখনও নলিনীবাবু থাকেন।
কৃষ্ণকান্তর গায়ে একটু কাটা দিল। হরনাথের কাছ ঘেঁষে বসে সে বলল, সত্যি বলছ?
তিন সত্যি। মাঝরাতে সাইকেল চালিয়ে আসেন। ঘরে ঢোকেন। সব টের পাই।
কখনও দেখেছ?
দু-একবার। আমি তার সাড়া পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। রোজ দেখতে পাই না অবশ্য। তবে দুবার দেখেছি। একবার আমাকে ইশারায় কাছেও ডাকেন।
তুমি কাছে গেলে?
গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর আর কিছু দেখতে পেলাম না।
ও বাবা! ও ঘরে আমাকে লুকিয়ে থাকতে বলছ?
ভয় পেয়ো না। উনি তোমার কাকা হতেন। তোমার কোনও ক্ষতি করবেন না। বরং ভালই করবেন। ওদের ভয় পেতে নেই। আমাদের যেমন একটা জগৎ আছে, ওদেরও তেমনি একটা আলাদা জগৎ আছে।
তুমি ভূত দেখতে পাও?
খুব দেখতে পাই। তোমার মাকেও মাঝে মাঝে দেখি, ভিতরের দরদালানের জানালায় দাঁড়িয়ে দুপুরবেলা চুল শুকোচ্ছেন। কাল যখন বিকেলে তুমি ঘোড়া চালাচ্ছিলে তখন উনি এসে সামনের। গাড়িবারান্দার ছাদে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে দেখছিলেন তোমাকে।
কৃষ্ণকান্ত খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল হরনাথের সঙ্গে। বলল, মা আমাকে কেন দেখছিল?
দেখবে না? ছেলে বলে কথা! তোমাকে একটুখানি দেখে চলে গেছেন, এখন তুমি কত বড়টি হয়েছ। ঘোড়া চালাও, ইস্কুলে যাও, ফুটবল খেলল। মা তাই দেখতে আসেন।
ভয়-ভয় করলেও কৃষ্ণকান্তর ঘটনাটা খারাপ লাগল না। মার কথা তার মনেই নেই। তবু মা যে চোখের আড়ালে এখনও আছে সেটা ভাবতে ভালই লাগে।
হরনাথ অস্ফুট গলায় বলে, দুলিকেও দেখি। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে শাক তোলে। আঁচলে মাছ ধরে। কখনও ঘরেও আসে। আমার মাথার কাছটিতে চুপ করে বসে থেকে আবার চলে যায়।
তবে যে প্রতুল মাস্টারমশাই বলে, ভূত বলে কিছু নেই।
কী জানি। আমি তো সব স্পষ্ট দেখি। এই যেমন তোমাকে দেখছি। তবে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় না।
আমার মাকে দেখাবে? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
দেখা কি আর না যায়? চেষ্টা থাকলে, ইচ্ছে থাকলে দেখা যায়ই। দুলি মরার পর আমি কেবল দিনরাত তাকে ভাবতাম আর কাঁদতাম। ভাবতে ভাবতে আর কাঁদতে কাঁদতে মাথাটা কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেল। তারপর থেকে সব দেখতে পাই। কোকাবাবু যেদিন মারা গেলেন-..
সেদিন কী?
সেদিন তাঁকেও দেখেছি। সন্ধেবেলা ব্রহ্মপুত্রের জলে নেমে স্নান করলেন। সুন্দর একটা পিনিস এল। তাইতে উঠে কোথায় চলে গেলেন।
কৃষ্ণকান্ত একটু কাঠ কাঠ হয়ে গেল ভয়ে।
চারদিক অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। শেয়াল ডেকে উঠল। উত্তরের হাওয়া এল অদ্ভুত এক হাহাকারের শব্দ নিয়ে।
হরনাথ উঠে বলল, চলো, লুকিয়ে থাকার জায়গাটা তোমাকে দেখিয়ে দিই।
কৃষ্ণকান্ত ভয় পায় বটে, কিন্তু ভয়ে কুঁকড়ে যায় না, ভেঙেও পড়ে না। তার ভিতরে এক অফুরন্ত কৌতূহলই তাকে ভয়ের মুখেও এক ধরনের সাহস দেয়। সে উঠে বলল, কোথায় যাবে? কাকার ঘরে?
কাকার ঘরেই। তবে তার মধ্যেও একটু ব্যাপার আছে। চলো দেখাচ্ছি।
দুজনে আবছা অন্ধকারে টানা বারান্দা ধরে কাছারিঘর ছাড়িয়ে ভিতর দিকে হাঁটতে থাকে।
সারি সারি ঘর। এত ঘর কোনও কাজে লাগে না। এক সময়ে এই কাছারিবাড়িতে বিস্তর লোক কাজ করত। আজকাল জমিদারির আয় কমেছে। লোকজনও কমে গেছে। গোটা চারেক বড় বড় মোকদ্দমায় হেরে গেছেন হেমকান্ত, কেবল তদবিরের অভাবে। এখন শোনা যাচ্ছে, বড় ভাই বরদাকান্তর স্ত্রীও সম্পত্তির অংশ চেয়ে মামলা করবে। হেমকান্ত এসব বৈষয়িক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না। তার কর্মচারীরাও তার কানে সব কথা তোলে না। কিন্তু এই মস্ত জমিদারিতে যে অলক্ষ্মীর সঞ্চার ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। এই শূন্য ঘরগুলো তারই আগাম ইঙ্গিত বহন করছে।
নলিনীর বন্ধ দরজার সামনে এসে হরনাথ দাঁড়ায়। দরজায় কান পেতে কী একটু শোনে। তারপর ফিসফিস করে বলে, ওই শোনো। নলিনীবাবুর গলা!
আচমকা কৃষ্ণকান্তও শুনতে পেল, ঘরের মধ্যে একটা গলা বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ভূত! ভূত!
কুয়াশামাখা অন্ধকারে ভুতুড়ে ছায়া ধীরে ধীরে গড়িয়ে আসছে চারদিক থেকে। বাস্তব হারিয়ে যাচ্ছে এক রহস্যময় কুহেলিকায়। ব্রহ্মপুত্রের বুক থেকে আঁশটে গন্ধ বয়ে নিয়ে হু হু করে উত্তরে হাওয়া এল। কাছে পিঠে ডেকে উঠল একশো শেয়াল।
ভয় পাওয়ারই কথা। শশিভূষণকে যখন ধরে আনা হয় তখন কৃষ্ণকান্ত ইস্কুলে। তাই ঘটনাটার কথা সে জানে না। কৃষ্ণকান্ত একবার ভাবল, দৌড় দেবে। কিন্তু জানার কৌতূহলও তার অসীম। সে দরজায় দমাদম ঘা দিয়ে বলল, কে? কে ভিতরে?
তোমার কাকা।—ফিসফিস করে হরনাথ বলে।
কিন্তু কৃষ্ণকান্ত লক্ষ করেছে, দরজাটায় তালা দেওয়া নেই। এ ঘরটায় সর্বদাই তালা দেওয়া থাকে। ভিতরের কণ্ঠস্বর যদি নলিনীকান্তর প্রেতাত্মারই হয় তবে দরজার তালাটা খোলবার দরকারই হত না। নিশ্চয়ই কেউ আছে।
আবার সে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল।
সেই শব্দে লোক জড়ো হতে দেরি হল না। গগন মুহুরি বলল, ও ঘরে একজন অতিথি আজ দুপুর থেকে আছে। কর্তাবাবু তার ওপর নজর রাখতে বলেছেন।
কৃষ্ণকান্ত একটু রাগের গলায় বলল, নোকটা দরজা খুলছে না কেন? কে লোকটা?
গগন মাথা চুলকে বলল, আমরা চিনি না। তবে পাগলের মতো চেহারা।
কৃষ্ণকান্ত আরও কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, লোকটার বোধহয় অসুখ করেছে। দরজাটা ভাঙতে হবে।
খবর পেয়ে হেমকান্তও দরজা ভাঙার হুকুম দিলেন। ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, শশিভূষণের জ্ঞান নেই। গায়ে প্রবল জ্বর।
রঙ্গময়িকে কিছু বলতে হয় না। সে চট করে পুকুর থেকে এক বালতি জল নিয়ে এসে সযত্নে মাথা ধুইয়ে দিয়ে জলপটি দিতে লাগল কপালে। কুমুদ ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে বলে গেল, খারাপ ধরনের ম্যালেরিয়া। মাথায় রক্তের চাপ প্রবল।
কৃষ্ণকান্ত জনে জনে জিজ্ঞেস করেও লোকটার নাম ছাড়া আর কিছুই জানতে পারল না। শশিভূষণের বয়স প্রতুল মাস্টারমশাইয়ের সমান। কিন্তু চেহারাটা একদম মড়ার মতো শুটকো সাদা। গালে দাড়ি। লম্বা লম্বা চুল।
মনু পিসি, লোকটা কি পাগল?—সে রঙ্গময়িকে জিজ্ঞেস করল।
রে, দুদিন আমরাগানে লুকিয়েছিল। খায়-দায়নি। তাই ওরকম দেখাচ্ছে।
লুকিয়ে ছিল কেন?
শুনছি তো, পুলিশে নাকি তাড়া করেছিল।
কেন তাড়া করেছিল?
স্বদেশি করত যে!
এটা আর বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না কৃষ্ণকান্তকে। স্বদেশিদের সে খানিকটা চেনে। তবে ভাল চোখে দেখে না। সে বলল, তা হলে পুলিশে খবর দিচ্ছ না কেন?
ওরে চুপ, চুপ! পুলিশ এলে তোর বাপেরও রেহাই নেই। ওসব বলিস না। তোকে বলাই ভুল হয়েছে দেখছি।
কৃষ্ণকান্ত জিজ্ঞেস করল, কোন আমরাগানে? বাড়ির পিছনেরটা?
তাই তো শুনছি।
ওখানে ছিল লোটা? দুদিন?
হ্যাঁ।
মশা কামড়ায়নি?
তা আর কামড়ায়নি! সারা গায়ে তো দেখছি দানা দানা হয়ে আছে।
কিছু খায়ওনি?
কী খাবে? শীতকালে কি আর আমরাগানে আম পাওয়া যায়?
লোকটার দিকে আর-একবার ভাল করে চেয়ে দেখল কৃষ্ণকান্ত। চেহারাটা তার পছন্দ হল না ঠিকই। তবে যে-লোক দুদিন না খেয়ে আমরাগানে লুকিয়ে থাকতে পারে তাকে একটু শ্ৰদ্ধা না করে উপায় কী?
০১০. রেমি
দিশাহারা রেমি অবিশ্বাসের চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তার সন্দেহ, ধ্রুব স্বাভাবিক মানুষ নয়। হয় পাগল, না হয় পয়লা নম্বরের বদমাশ। তবু মাঝরাস্তায় এই লোকটির সঙ্গে গোলমাল বাঁধিয়ে লাভ নেই। রেমির চোখে তখন জল এসে গেছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলল, চলো শিগগির। তোমার পায়ে পড়ি। ট্রেন ছেড়ে দেবে।
ধ্রুব ম্যাগাজিনটা বগলদাবা করে ধীরে সুস্থে দাম মেটাল। তারপর বলল, চলো। কিন্তু একটা কথা বলে দিচ্ছি। অবাধ্যতা কোরো না। আমার কিন্তু কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই।
তারা কামরায় ফেরার পর গার্ড সাহেব একবার হানা দিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণকান্তর ছেলে বলে পরিচয় পাওয়ায় জল আর বেশিদূর গড়ায়নি। এমনকী জরিমানা পর্যন্ত দিতে হয়নি তাদের।
শিলিগুড়ি পর্যন্ত বাকি রাস্তাটা ধ্রুব আর গোলমাল করেনি। কারণ প্রচুর মদ খেয়ে সে একদম অচেতন অবস্থায় গাড়ির মেঝেয় পড়ে থেকেছে। একবার টেনে হিচড়ে তাকে সিটে তুলে শুইয়েছিল রেমি। দশ মিনিটের মাথায় আবার সে দড়াম করে মেঝেয় পড়ে যায় এবং পড়েই থাকে। রেমি আর তাকে তোলার সাহস পায়নি। পড়ে গিয়ে যদি ঘাড় বা হাত-পা ভাঙে?
কৃষ্ণকান্তর বন্ধু সুদর্শন রায় শিলিগুড়ির মস্ত ধনী লোক। তার চা বাগান, কাঠের ব্যাবসা, নিউ মার্কেটে বাহারি দোকান, কী নেই? দার্জিলিং-এ তার একটা ভাল হোটেলও আছে। সেই সুদর্শনবাবু গাড়ি নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিলেন। সোজা তাদের নিয়ে তুললেন হাকিমপাড়ায় নিজের
প্রকাণ্ড বাড়িতে। বললেন, দার্জিলিং তো যাবেই। একদিন এখানে রেস্ট নিয়ে যাও।
ধ্রুব একটু গাঁইগুঁই করেছিল বটে, কিন্তু থেকেও গেল।
ওই একটি দিন রেমির বড় চমৎকার কেটেছিল। সুদর্শনবাবুর দুটি যুবতী মেয়ের সঙ্গে তার ভীষণ ভাব হয়ে গেল। বড়লোকের মেয়ে বলে কোনও দেমাক-টেমাক নেই, কিংবা তা রেমিকে দেখায়নি। সেই সঙ্গে জুটে গেল সুদর্শনবাবুর ভাইপো সমীর। যেমন ঝকঝকে চেহারা তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত তার চালচলন আর কথাবার্তা। তারা চারজনে মিলে চমৎকার একটা টিম হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি যে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে তা রেমির অভিজ্ঞতায় ছিল না। সম্ভবত দায়িত্ব ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ধ্রুবর কাছ থেকে ধাক্কা খেয়েই রেমির মধ্যে একটা ভয় ও নিঃসঙ্গতার বোধ জন্ম নেয়। তাই এই তিনটি স্বাভাবিক, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা যুবক-যুবতীকে পেয়ে সে আঁকড়ে ধরল। সেই টিমে ধ্রুব ছিল না। কারণ আগের দিনের অঢেল মদ তখন তার ওপর শোধ নিচ্ছে, দারুণ মাথা ধরা, বমির ভাব ও দুর্বলতায় আচ্ছন্ন হ্যাংওভার কাটাতে সে সারাদিনটাই প্রায় বিছান! আলিঙ্গন করে রইল।
নন্দা, ছন্দা আর সমীরের সঙ্গে রেমি বেরোল শহর দেখতে। কী সুন্দর শহরটি। খানিকটা কলকাতার সঙ্গে খানিকটা গ্রাম মেশালে যেমন হয় আর কী। শহর ঘেঁষে একটি পাহাড়ি নদী বয়ে যাচ্ছে। মহানন্দা। উত্তরে মহান হিমালয়।
সমীর বলল, শিলিগুড়ি এখন ওয়েস্ট বেঙ্গলের সেকেন্ড সিটি। কলকাতার পরই শিলিগুড়ি।
কলকাতা-গরবিনী রেমি বলল, আহা রে, কলকাতার সঙ্গে টক্কর দেওয়া অত সস্তা নয় মশাই। শিলিগুড়িকে সাত জন্ম তপস্যা করতে হবে।
সমীর ছ্যাবলা নয়। একথার জবাবে মৃদু একটু হাসল মাত্র। হুড খোলা জিপগাড়িটা চালাচ্ছিল সে-ই। চোখে গগলস। কিছুক্ষণ বাদে সেই গগলসের ভিতর দিয়ে রেমির দিকে চেয়ে বলল, কলকাতা শুধু আপনারই নয় কিন্তু, আমাদেরও।
তাই নাকি?
যে-কোনও বাঙালিকেই জিজ্ঞেস করুন। নোংরা হোক, ঘিঞ্জি হোক, কলকাতার নিন্দে করলে যে-কোনও বাঙালি চটে যায়। আমি আরও বেশি চটি। কারণ কলকাতাকে আমার মতো করে কেউ আবিষ্কার করেনি। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কলকাতা।
রেমি বলল, তবু ভাল। আমি ভাবলাম আপনি বুঝি শিলিগুড়িকে তোল্লাই দিতে গিয়ে কলকাতাকে ছোট করছেন।
মোটেই নয়।
নন্দা বলল, সমীরদা অসম্ভব কলকাত্তাই। ছুটি পেলেই পালাবে। আমাদের তো বাবা সল্টলেকে অত বড় বাড়ি পড়ে আছে। কিন্তু আমার গিয়ে বেশিদিন থাকতে ইচ্ছে করে না।
ছন্দার অবশ্য অন্য মত। সে বলে, না বাবা, আমার কলকাতাই ভাল লাগে।
সেদিন তারা রেস্টুরেন্টে খেল, চোরাই হংকং মার্কেটে ঘুরে ঘুরে বিদেশি শাড়ি আর কসমেটিকস কিনল, সেভক রোড ধরে চলে গেল কালিঝোড়া পর্যন্ত। আর তারই ফাঁকে চারজনের টিমটা আরও আঠালো হয়ে উঠল।
পরদিন সেই চারজন এবং ধ্রুব একটা জোঙ্গা জিপগাড়িতে গেল দার্জিলিং। সমীর পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিল বলে বেশি কথা বলছিল না। তার পাশে বসা ধ্রুবও চুপচাপ। কলকল করছিল শুধু তিন যুবতী পিছনের দিকে বসে। একান্ন মাইল রাস্তা টেরই পাওয়া গেল না।
কিন্তু মুশকিল হল বিকেলবেলা, যখন রেমি আর ধ্রুবকে দার্জিলিং-এ রেখে ওরা ফিরে আসবে। কারণ ধ্রুব হোটেলে ঢুকেই বার-এ সেঁটে বসে গিয়েছিল। বিকেল নাগাদ সে চুরচুর মাতাল। সুতরাং নন্দা, ছন্দা আর সমীর যদি শিলিগুড়ি ফিরে আসে তাহলে রেমি একা পড়ে যায়। এই অনাত্মীয়
শহরে একা একটি যুবতী মেয়ের কেমন কাটবে?
ধ্রুবকে সুদর্শনবাবুর হোটেলে রেখে তারা চারজন একটু বেড়াতে বেরিয়েছিল। ধ্রুব যেতে চায়নি বলেই তাকে নেওয়া হয়নি। বেড়িয়ে ফেরার পর ধ্রুবর অবস্থা দেখে সমীর মুখে আফসোসের চুকচুক শব্দ করে বলল, ম্যাডাম তো খুব অসুবিধেয় পড়বেন দেখছি। ধ্রুববাবু তো আউট।
ভয়ে বুক ঢিবঢিব করছিল রেমির। শুষ্ক গলায় সে বলল, আপনারা প্লিজ যাবেন না। ওর যদি কিছু হয় তাহলে কে দেখবে?
সমীর তার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে, ওর কিছু হবে না। বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেই রাত কেটে যাবে। ভয় আপনাকে নিয়ে। আপনার রক্ষক তো কেউ থাকছে না।
নন্দা আর ছন্দাও অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তারা বুঝতে পারছিল রেমিকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়াটা ঠিক নয়। কিন্তু তাদেরও ফেরা দরকার। ছন্দার কলেজ আছে। নন্দারও কী সব এনগেজমেন্ট। খানিকক্ষণ শলা-পরামর্শের পর ঠিক হল, সমীর থেকে যাবে। দুই বোন ফিরে যাবে শিলিগুড়ি। তাদের ফিরতে কোনও অসুবিধে নেই। সুদর্শনবাবুর হোটেলেরই নিজস্ব গাড়ি তাদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।
কিন্তু রেমি আজ জানে, সমীরেরও থেকে যাওয়ার কোনও দরকার ছিল না। সেই সুন্দর ছিমছাম হোটেলটির মালিক স্বয়ং সুদর্শনবাবু। হোটেলের বশংবদ কর্মচারীরা তাদের ভালই দেখাশোনা করতে পারত। সুতরাং সমীরের ওই কথাটা আপনার রক্ষক তত কেউ থাকছে না ঠিক নয়।
কিন্তু বলতে নেই, সমীর থাকায় রেমির বুকের মধ্যে এক আনন্দের খামচাখামচি শুরু হয়েছিল। সেই অবোধ রহস্যময় অনুভূতির কোনও মানে হয় না। এত বেহায়া বেহেড রেমি বিয়ের আগেও ছিল না কোনওদিন। কিন্তু মাতাল ধ্রুবই কি তাকে ঠেলে দিয়েছিল ওই অসামাজিক এক সম্পর্ক শুরু করার রাস্তায়?
নন্দা আর ছন্দা চলে যাওয়ার পর ধ্রুবকে বিছানায় পৌঁছে দেওয়া হল। একজন বেয়ারা মজুত থাকল ঘরে। নিঃসাড়ে ঘুমোতে লাগল ধ্ৰুব।
সমীর বলল, চলুন সেকেন্ড রাউন্ড বেড়িয়ে আসি। ভাল করে ঢাকাটুকি দিয়ে নিন। দারুণ। শীত।
জোঙ্গা গাড়িটায় আবার দুজনে বেরোল। তখন সন্ধের পর রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা, ম্যাল প্রায় জনশূন্য, মেঘ করে হঠাৎ একটু বৃষ্টি পড়ছে। রেমির তবু খারাপ লাগছিল না। বুকটা একটু কেমন করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল এবার একটা কিছু হবে, কিছু ঘটবে, জীবনে একটা মোড় ফিরবে।
আস্তে আস্তে গাড়িটা বিভিন্ন চড়াই-উতরাই ভেঙে চালাচ্ছিল সমীর। কোথাও যাচ্ছিল না। উদ্দেশ্যহীন চলা।
জিজ্ঞেস করল, ধ্রুববাবু সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানি না। কিন্তু শুনেছি এক সময়ে উনি খুব ব্রাইট বয় ছিলেন। এরকম কবে থেকে হল? ইজ হি ফ্রাষ্ট্রেটেড?
রেমি তার কী জানে? সে মৃদুস্বরে বলল, আমি তো বিয়ের পর থেকেই এরকম দেখছি। আগে কীরকম ছিল জানি না।
আপনি নিশ্চয়ই খুব লোনলি ফিল করেন!
সেটা কি আর বলতে হবে!
উনি খুবই ইয়ং। বয়সে বোধহয় আমার চেয়েও ছোট। এই বয়সে এত ডিপ ফ্রাষ্ট্রেশন আমি দেখিনি কারও। এঁর সঙ্গে আপনি ঘর করবেন কী করে?
সেটাই তো ভাবছি।
ভাবছেন? যাক বাঁচালেন। প্রশ্নটা করেই আমি মনে মনে জিব কাটছিলাম, অনধিকার চর্চা হয় গেল ভেবে।
রেমি ম্লান একটু হেসে বলল, অত ফরমাল হওয়ার দরকার নেই। আমি ভীষণ প্রবলেমের মধ্যে আছি। এই সময়ে আমার একজন বন্ধু দরকার যে গাইডেনস দিতে পারবে। আমি আপনার পরামর্শ চাই। ওকে নিয়ে কী করব বলুন তো?
সমীর একটু ভেবে বলল, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে কাল সকালে আমি ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখতে পারি। তবে উনি খুব গম্ভীর। কাল থেকে বহুবার কথা বলার চেষ্টা করেছি। উনি তেমন ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছেন না।
তবু আপনি একটু কথা বলে দেখবেন। তবে দয়া করে আমার রেফারেন্স দেবেন না। তাহলে চটে যাবে।
আরে না না, আমি অত বোকা নই। আপনাকে আড়াল করাই তো আমার উদ্দেশ্য।
রেমি মৃদুস্বরে বলল, আমার খুব ভয় করছে দার্জিলিং বেড়াতে এসে।
কীসের ভয়?
আমার মনে হচ্ছে কর্তাটি অ্যাবনরম্যাল। যে-কোনও সময়ে আমার কথা ভুলে গিয়ে হয়তো আমাকে ছেড়েই কোথাও চলে যাবে।
ধ্রুববাবু কি এতই ইরেসপনসিবল?
হ্যাঁ। আপনি ধারণা করতে পারবেন না। আসার সময় বর্ধমান স্টেশনে এমন একটা কাণ্ড করেছিল যে আমার ভিতরে একটা ভয় ঢুকে গেছে। আমি ওকে বিশ্বাস করি না।
সমীর খুব হালকা গলায় বলল, আপনার মতো মেয়েকে ভুলে গিয়ে বা ফেলে রেখে কি যাওয়া যায়?
সমীরের এই ভুতিটুকু তার ভালই লাগল। সে বলল, আমি এমন কিছু না।
সে আপনি জানেন না। আমরা জানি। কিন্তু ধ্রুববাবু অ্যাবনরম্যাল, এটা কি ঠিক জানেন?
জানি। ওর সবচেয়ে বেশি রাগ ওর বাবার ওপর।
কেন বলুন তো! কৃষ্ণকান্তবাবুকে আমি চিনি। দারুণ লোক।
শ্বশুরমশাইয়ের তুলনা হয় না। তবু ও ওর বাবাকে দেখতে পারে না। সেটাই অস্বাভাবিক।
জেলাসি নয় তো!
কে জানে কী। এ প্রসঙ্গটা বাদ দিন।
সরি। দার্জিলিং আপনার কেমন লাগছে?
ভাল।
ধ্রুববাবু নরম্যাল থাকলে আরও ভাল লাগত।
সেটা ঠিক। তবে যতটা খারাপ লাগার কথা ছিল এখন ততটা খারাপ লাগছে না।
এ হচ্ছে কথার পিঠে কথার খেলা। কিন্তু রেমি বাস্তবিক কথার খেলা জানে না। সে যা বলেছিল তা অকপট মন থেকে উঠে আসা কথা। সত্যিই তো তার খারাপ লাগছিল না।
তারা যখন হোটেলে ফিরল তখন দার্জিলিং-এর নিয়ম অনুযায়ি অনেক রাত। রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ জনশূন্য। হোটেলেও দু-চারজন মদ্যপায়ি ছাড়া বাকি সবাই ঘরে দোর দিয়েছে।
ফাঁকা ডাইনিং হল-এ বসে রেমি আর সমীর বাতের খাবার খেলা খেতে খেতে রাত গড়িয়ে দিল অনেকটা। কথা আর শেষ হতে চায় না। ধ্রুবর সঙ্গে সাতদিনে যত কথা না হয় তার চেয়ে ঢের বেশি সেই কয়েক ঘণ্টায় হল সমীরের সঙ্গে রেমির। খাওয়ার পর লাউজে ইলেকট্রিক হিটারের সামনে নরম সোফায় কম্বলমুড়ি দিয়ে বসেও অনেকক্ষণ সময় কাটাল তারা।
তারপর একসময়ে রেমির মনে হল, এবার ঘরে যাওয়া দরকার। হোটেলে কেউ আর জেগে নেই। ধ্রুবকেও অনেকক্ষণ একা রাখা হয়েছে।
সে অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, এবার যাই।
আরে বসুন বসুন, সবে তো সন্ধে।
এইভাবে যাই-যাই করে কাটল আরও কিছু সময়। যখন বাস্তবিকই ঘরে এল রেমি তখন রাত পৌনে একটা।
ধ্রুব তখনও অচেতন। রেমির অনেকক্ষণ ঘুম এল না। কেমন একটা উদভ্রান্ত উত্তেজনায় বুক কাঁপছে। বারবার শিহরিত হচ্ছে সর্বাঙ্গ। এরকম তার আগে কখনও হয়নি। এমনকী ফুলশয্যার রাতেও নয়। নিজেকে বহুবার ধিক্কার দিল সে। তারপর ঠাকুর-দেবতার পায়ে মাথা কুটতে লাগল মনে মনে, আমাকে রক্ষা করো। এ আমার কী হল? কেন হল? ছিঃ ছিঃ।
পরদিন ধ্রুবর ঘুম ভাঙল বেলায়। গভীর হ্যাংওভার। ভাল করে তাকাতে পারছে না। মাথা ধরা, বমি-বমি ভাব।
রেমি তীব্র বিরাগের সঙ্গে বলল, এটা কী ধরনের হানিমুন হচ্ছে আমাদের?
ধ্রুব মাথা চেপে ধরে আধশোয়া অবস্থায় তার দিকে চেয়ে বলল, কে বলেছে হানিমুন? এটা হল একসাইল। কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীর পলিটিক্যাল ফিলড থেকে ধ্রুব চৌধুরীকে সরিয়ে দেওয়া। শুধু দেখাশোনা করার জন্য সঙ্গে তুমি।
তাই নাকি?
একজ্যাক্টলি তাই। যাও একটা হেভি ব্রেকহার্স্ট অর্ডার দিয়ে এসো। আর আমাকে ধরে একটু বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে যাও।
স্নান এবং ছোট হাজরির পর কিন্তু ছিপছিপে তেজি চেহারার ধ্রুবকে আবার বেশ তরতাজা দেখাচ্ছিল। নিজেই পোশাক-টোশাক পরল। বলল, চলো, একটু ঘুরে আসি।
হঠাৎ ভূতের মুখে যে বড় রাম নাম!
ধ্রুব একটু হেসে বলে, চলল, দেখা যাক একসাইলটাকে হানিমুন করে তোলা যায় কি না।
সত্যি নাকি?
একটা দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিল রেমি। ভিতরকার উত্তেজনায় সারা রাত সে এপাশ ওপাশ করেছে। পাপবোধ তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে। ধ্রুবর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার শারীরিক বা মানসিক শক্তিতে তখন টান ধরেছে।
সে বলল, আমি হাঁটতে পারব না।
হাঁটতে হবে না। হোটেল থেকে একটা গাড়ি ম্যানেজ করা যাবে।
রেমি একটু তটস্থ হয়ে বলে, হোটেলের গাড়ি দরকার নেই। কালকের সেই জিপগাড়িটাই তো আছে।
কোন জিপগাড়িটা?
যেটায় আমরা এলাম। সমীরবাবুও আছেন।
কে সমীরবাবু? সুদর্শনকাকার ভাইপো?
অকারণে লাল হয়ে এবং মুখ নামিয়ে রেমি বলল, হ্যাঁ। তোমার ওই অবস্থা দেখে উনি আর কাল ফিরে যাননি।
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বোধহয় সেকেন্ড দুই রেমির দিকে চেয়ে রইল। আর রেমির তখন মনে হল, ধ্রুব তার ভিতরকার সব দৃশ্য দেখে ফেলছে। কী যে অস্বস্তি! সে তাড়াতাড়ি উঠে সাজপোশাকে একটু সংশোধন শুরু করে দিল।
ধ্রুব বলল, সুদর্শনকাকার মেজো মেয়েটার নাম যেন কী!
ছন্দা। কেন বলো তো?
ওই ছন্দার সঙ্গে বোধহয় সমীরের একটা আনহেলদি রিলেশন আছে।
রেমি ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে বলে, যাঃ, কী যে বলো না!
ধ্রুব একটু অপ্রতিভ হয়ে বলে, অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল।
ওরা আপন খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইবোন, সে কথাটা ভুলে যেয়ো না।
তা বটে। তাহলে লেট আস গো। সমীরকে রেডি হতে বলো।
বলাই আছে! উনি তৈরি। আমরা নামলেই হয়।
যখন দুজনে নীচে নেমে এল তখন ধ্রুবর ফিটফাট চেহারা দেখে সমীর কিছুটা অবাক। বলল, আপনি হানড্রেড পারসেনট ফিট দেখছি।
ধ্রুব খুব লাজুক মুখে হেসে বলল, কাল একটু বেসামাল হয়েছিলাম। কিছু মনে করবেন না। শুনলাম, আমার জনাই আপনি আটকে গেলেন।
ও কিছু নয়।
ধ্রুব খুব ভদ্র গলায় বলল, কাল আপনি প্রায় সারাদিন গাড়ি চালিয়েছেন। আজ পাশে বসে রেস্ট নিন। আমি চালাব।
পারবেন? পাহাড়ি রাস্তা কিন্তু।
পারব।
আশ্চর্য এই, ধ্রুব চমৎকার পারল। গাড়ি টাল খেল না, ঝাঁকুনি লাগল না, এতটুকু বেসামাল হল না কোথাও। অত্যন্ত দক্ষ পাহাড়ি ড্রাইভারের মতোই সে ঘুম মনাস্টারি, সিনচাল লেক হয়ে কারশিয়ং পর্যন্ত নেমে এল। তারপর নিরাপদে আবার গাড়ি ফিরিয়ে আনল হোটেলে। পিছনে বসে মুগ্ধ বিস্ময়ে দৃশ্যটা দেখছিল রেমি। বুকের মধ্যে যেন দুটো হৃৎপিণ্ড ধুক ধুক করছিল তার। ধ্রুব! ধ্রুব যদি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে তবে রেমি ধ্রুব ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দেবে কি?
দুপুরে ভাত খাওয়া অবধি তিনজনে চমৎকার সময় কাটিয়ে দিল।
সমীর বলল, আজ আমার ফিরে যাওয়ার কথা। যদি অনুমতি দেন তাহলে যাই।
ধ্রুব মৃদু হেসে বলল, আমাকে বিশ্বাস করবেন না। দার্জিলিং-এর ওয়েদারের মতোই আমার মেজাজ। এই ভাল আছি, চার ঘণ্টা পরে হয়তো দেখবেন মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছি। তার চেয়ে বরং সুদর্শনকাকাকে একটা ফোন করে দিই, আপনি কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গেই থাকুন। রেমিরও একটা কমপ্যানি হবে।
সমীর হঠাৎ সেই সময়ে বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ধ্রুববাবু। আজ আপনার মেজাজটা ভাল আছে বলেই বলতে চাইছি।
আরে বলুন না!কী কথা! রেমি বরং ঘরে গিয়ে রেস্ট নিক। আমরা দুটো বিয়ার নিয়ে লাউঞ্জে বসি। সেই ভাল।
রেমি কাঁপা-কাঁপা বুক নিয়ে ঘরে এল। সমীর কী বলবে সে জানে না। কিন্তু হে ঠাকুর, এমন কিছু যেন না হয় যাতে ও চটে যায় কিংবা রেমিকে সন্দেহ করে।
অস্থির রেমি বিছানায় শুয়ে বই পড়ার চেষ্টা করল অনেকক্ষণ। মন দিতে পারল না। ঘণ্টাতিনেক কেটে যাওয়ার পর সে ক্লান্ত হয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধে হয়ে গেছে। ঘর ফাঁকা।
তাড়াতাড়ি উঠে নীচে নেমে এসে দেখল সমীর গম্ভীরভাবে লন-এ পায়চারি করছে একা।
সে কী? আপনি একা! ও কোথায়?
সমীর একবার কপালে হাত দিয়ে হতাশার ভঙ্গি করে বলল, হি ইজ বিয়ন্ড এভরিথিং।
তার মানে?
কিছু করা গেল না রেমি। আমি ভাল করে কথা বলা শুরু করার আগেই উনি আসছি বলে কেটে পড়লেন। কোথায় গেলেন কে জানে। ঘণ্টা দুই বাদে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে শুরু করলাম। খবর পেলাম, বাজারের কাছে একটা বার-এ মদ খেয়ে প্রচণ্ড হাঙ্গামা বাঁধিয়েছেন।
সে কী!–রেমির চোখ কপালে উঠল।
ব্যাপারটা স্যাড। কয়েকটা নেপালি ছোকরার সঙ্গে মারপিট হয়েছে। খুব বেশিদূর গড়ায়নি অবশ্য। তাহলে পেটে কুকরি ঢুকে যেত। তবে একটু চোট হয়েছে।
রেমি আর্তনাদ করে উঠল, ও কোথায় বলুন।
ডাক্তারখানায়। এখুনি আসবেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
নিশ্চয়ই আছে। ও কি উন্ডেড?
না, সেরকম কিছু নয়। বরং দুটো ছোকরা ওর হাতেই বেশি ঠ্যাঙানি খেয়েছে। উনি ঠিক আছেন। কপালটা একটু কেটেছে। আপনি অস্থির হবেন না। আমাদের হোটেলের ম্যানেজার নিজে গেছেন স্পটে।
রেমি অবশ হয়ে লনের একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। অত্যন্ত সেকেলে ভঙ্গিতে বলল, কী হবে?
হয়তো কিছু হবে না। কিন্তু লোক্যাল ছেলেদের সঙ্গে গণ্ডগোল করায় এখানে আপনাদের থাকাটা আর সেফ নয়। আপনি বরং ঘরে গিয়ে এসেনশিয়াল কিছু গুছিয়ে নিন। সুটকেসটুটকেসগুলো থাক, পরে পাঠিয়ে দেবে। ধ্রুববাবু এলেই আমি আপনাদের নিয়ে শিলিগুড়ি নেমে যাব।
রেমি ভয় পেয়ে বলল, কেন? লোকাল ছেলেরা কি গণ্ডগোল করবে?
করতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক।
রেমির হাত পা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কোনওরকমে ঘরে এসে সে পাগলের মতো ভুলভাল জিনিস ভরে একটা কিট ব্যাগ গোছাচ্ছিল। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা ধ্রুব ঘরে ঢুকে বিরক্ত গলায় বলল, কী করছ? আমরা শিলিগুড়ি যাচ্ছি না।
রেমি দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধ্রুবর বুকে, কী করেছ তুমি? কী সর্বনেশে কাণ্ড করেছ? জানো না, এখানে মারপিট করতে যাওয়া কী ভীষণ রিসকি? কেন মারপিট করেছ?
ধ্রুব তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আরে, অত তাড়াতাড়ি সব কথার জবাব কী করে দেব? মারপিট করিনি, নিজেকে বাঁচাতে মেরেছি। তা বলে পালাব কেন?
কিন্তু সমীর যে বলল—
হ্যাং সমীর। আমার গায়ে হাত পড়লে জল অনেক দূর গড়াবে রেমি। তুমি শ্বশুরের কথা ভুলে যাচ্ছ!
তখন স্থির হল রেমি। সত্যিই তো। ঘটনার আকস্মিকতায় সে বিস্মৃত হয়েছিল যে তার শ্বশুর কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী। শুধু দার্জিলিং কেন, সারা দেশের সর্বত্রই তার প্রভাব ছড়ানো। তবু সে বলল, কিছু হবে না তো?
কী হবে?–বলে ব্যঙ্গের হাসি হেসে ধ্রুব বলে, বাবার কাছে অলরেডি ট্রাংক কল-এ খবর চলে গেছে। পুলিশ হেভি অ্যাকশন নিচ্ছে। কিছু ভেবো না রেমি, লিডারের ছেলে হতে কপাল লাগে।
সকালটা সুন্দর কেটেছিল রেমির। কিন্তু সেই সন্ধেবেলাই আবার ধ্রুবর মেজাজ পালটাল।
০১১. পিতার বাৎসরিক কাজ
পিতার বাৎসরিক কাজটি হেমকান্ত প্রতি বছর বেশ ঘটা করেই করেন। শখানেক ব্রাহ্মণকে ভোজন করানো হয় এবং ভালরকম দক্ষিণা ও অন্যান্য দানসামগ্রী দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণ ছাড়াও আমন্ত্রিত সংখ্যা বড় কম হয় না।
এ বছর হেমকান্ত একটু দ্বিধায় পড়লেন। আয় ভাল নয়। হিসেব করে যা দেখছেন তাতে এসটেট চালানোই যথেষ্ট কষ্টকর। এর ওপর বাড়তি কোনও খরচের বোঝা বইতে গেলে উপরি আয় চাই। প্রচলিত ও প্রথাসিদ্ধ অনুষ্ঠান কাটছাট করার ইচ্ছে হেমকান্তর নেই। বিশেষ করে বাবাব বাৎসরিকের প্রশ্ন যেখানে। অগত্যা তিনি রঙ্গময়িকে ডেকে পাঠালেন।
শোনো মনু, সুনয়নীর বেশ কিছু গয়নাগাটি আছে। সেগুলো কোথায় আছে আমি সঠিক জানি। মেয়েদের মহলে গিয়ে খোঁজ-খবরও করা যাবে না। খবরটা আমাকে এনে দিতে পারবে? গোপনে?
কেন, সুনয়নীর গয়নার খোঁজ করছ কেন?
দরকারেই করছি।
দরকারটা শুনি।
আহা, অত দারোগাগিরির কী আছে? গয়নাগুলোয় তো আমারও খানিকটা অধিকার আছে, না কী?
ওমা, তোমার নেই তো আছে কার? কিন্তু সুনয়নী একাল মরেছে, এ খোঁজটা এতদিন পরে করছ কেন?
বললাম তো দরকার আছে।
গয়না কোথায় আছে জানি। কিন্তু কী অবশিষ্ট আছে তা বলতে পারব না।
তার মানে? অবশিষ্ট কথাটা বললে কেন? চুরি-টুরি গেছে নাকি?
চুরি নয়। সুনয়নীই কিছু গয়না মেয়েদের আর বউদের ভাগ করে দিয়ে গিয়েছিল। আর যা ছিল তাও সব নেই। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে আসে, এটা ওটা নিয়ে যায়। বউরাও নিয়েছে।
হেমকান্ত বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বলেন, গয়নার একটা হিসেব থাকা উচিত ছিল।
সুনয়নী অত হিসেবি মেয়ে ছিল না।
তোমার তো নিশ্চয়ই মনে আছে।
রঙ্গময়ি হেসে ফেলে বলে, গয়না তোমার বউয়ের আর তার হিসেব রাখতে হবে আমাকে?
হিসেব কি সত্যিই নেই?
রঙ্গময়ি মাথা নেড়ে বলে, না। তবে সুনয়নী আমাকে একজোড়া বালা আর একটা হার দিয়েছিল।
তোমাকে দেওয়া গয়নার কথা আসছে কেন?
আসছে, তার কারণ আছে। সুনয়নী কাউকে সাক্ষী রেখে গয়না দুটো আমাকে দেয়নি। আমি পরিও না। পরলে চোর-দায়ে ধরা পড়তে পারি। সেগুলো পড়ে আছে বাক্সে। তোমার গয়নার দরকার থাকলে নিতে পারো।
দূর, কী যে বলো।
রঙ্গময়ি একটু হাসল। প্রশান্ত গলাতেই বলল, তোমার মতো মানুষ বউয়ের গয়নার খোঁজ করছে এটা ভাবাই যায় না। ইদানিং কি খুব হিসেবি হয়েছ?
হলে দোষ কী?
দোষ তো নয়ই। বরং তুমি হিসেবি হলে আমি বাঁচি। কী দরকার বলো তো? বেচবে নাকি?
হেমকান্ত অস্বস্তি বোধ করে। প্রসঙ্গটা খুবই লজ্জাজনক। হেমকান্ত ঘরের সোনা বেচতে চান এটা পাঁচকান হলে গোটা পরিবারটারই মর্যাদার হানি। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, আরে না। হঠাৎ মনে হল, গয়নাগুলো গেল কোথায়?
সুনয়নীর ঘরে দেয়ালেব সিন্দুকে সব পাবে। তার চাবি আছে তোমার পড়ার ডেসকের ড্রয়ারে। ঠিক আছে।
একথাতে রঙ্গময়ি চলে গেল না। চুপ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গলাটা সামান্য নামিয়ে বলল, গয়না দিয়ে তুমি কী করবে জানি না। তবে আমি বলি, ও গয়না থেকে একটাও এদিক-ওদিক না করাই ভাল। তোমার হিসেব না থাক, তোমার মেয়ে আর বউদের আছে। কিছু সরালেই তারা টের পাবে।
হেমকান্ত বিস্মিত হয়ে বলেন, তারা টের পাবে? তা পাক না।
রঙ্গময়ি একটু বিব্রত হয়। একটু অপ্রতিভ হাসে। মৃদুস্বরে বলে, তুমি ভাবছ, তোমার বউয়ের গয়না, সুতরাং ওর ওপর তোমারই অধিকার।
তাই তো হওয়া উচিত, মনু।
উচিত তো অনেক কিছুই। কিন্তু ও গয়নায় হাত পড়লেই কুরুক্ষেত্র লেগে যাবে। তোমার মেয়ে আর বউরা বনবেড়ালের মতো থাবা পেতে বসে আছে। পুজোর সময় কী কাণ্ড হয়েছিল তা তো জানো না।
কী কাণ্ড?
সে তোমার শুনে কাজ নেই। অন্দরমহলে অনেক কিছু হয়, সবটাই পুরুষের কানে না যাওয়া ভাল।
নিশ্চয়ই ঝগড়া?
হ্যাঁ, ভীষণ ঝগড়া। আর সেটা সুনয়নীর গয়না নিয়েই। তাই বলছিলাম হট করে গয়নায় হাত দিয়ো না।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুখখানায় বিমর্ষতার ছায়াপাত ঘটল। হেমকান্ত বসেছিলেন নিজের শোওয়ার ঘরখানায় পূর্বাস্য হয়ে। মেঝের ওপর পুরু উলের গালিচা, তার ওপর একটা ছোট্ট ডেসকে প্যাড ও লেখার সরঞ্জাম সাজানো। সকালের বোদ এসে পড়েছে গালিচার ওপর। সেই আলোয় গালিচার অপরূপ রং ও নকশা ক্ষুরধার হয়ে উঠেছে।
হেমকান্ত গালিচার নকশার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, কত ভরি গয়না আছে জানো?
না। তবে শুধু সুনয়নীরই বোধহয় হাজার ভরির মতো সোনা ছিল। এখন বোধহয় অত নেই।
ওরা কতটা নিয়েছে তা বোধহয় জানো না?
না। ওরা যখন সিন্দুক খোলে তখন আমি কাছে থাকি না।
তবে জানলে কী করে যে, নিয়েছে?
মেয়েমানুষ হচ্ছে হীন জীব।
হেমকান্ত হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, একথাটার মানে বুঝলাম না।
রঙ্গময়ি হেসে বলে, মানে কি ছাই আমিই জানি! মেয়েমানুষের লেখাপড়া নেই, চিন্তাভাবনা নেই, তাদের মন আর চোখ সবসময়েই সংসারের আস্তাকুঁড় খুঁটছে। তাই তারা খবর রাখে।
তুমি কি সেইরকম মেয়েমানুষ?
তবে আর কীরকম?
হেমকান্তর একবার ইচ্ছে হল সচ্চিদানন্দর চিঠিটা রঙ্গময়িকে দেখান। কিন্তু সেই চিঠিতে তো শুধু রঙ্গময়ির প্রশংসাই নেই, তাঁকে এবং রঙ্গময়িকে জড়িয়ে এমন সব ইঙ্গিত আছে যা পড়লে রঙ্গময়ি হয়তো-বা গলায় দড়ি দেবে। হেমকান্ত রঙ্গময়ির দিকে এই সকালের আলোয় চেয়ে দেখলেন ভাল করে।
সচ্চিদানন্দ মিছে বলেনি। ধারালো এক ব্যক্তিত্ব রঙ্গময়িকে এই ভরা যৌবনে ভারী বিশিষ্ট করে তুলেছে। ব্যক্তিত্বটা কী ধরনের তা অবশ্য জানেন না হেমকান্ত। কারণ রঙ্গময়ি তার প্রতিদিনকাব দেখা ও জানা একটি মানুষ। এত কাছের মানুষের মধ্যে ধরা-ছোঁয়ার বাইরের কোনও গুণ আছে কি না তা টের পাওয়া কঠিন। তবু সচ্চিদানন্দর চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে রঙ্গময়িকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করছেন হেমকান্ত। কিন্তু পুরনো চোখ সব গণ্ডগোল করে দিচ্ছে। হেমকান্ত বললেন, নিজের সম্পর্কে তুমি যা ই বলো, লোকে কিন্তু অন্য কথা বলে।
লোকে কী বলে?
বলে, তুমি নাকি অসাধারণ।
লোকের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! কে তোমাকে আবার এসব বলল?
সচ্চিদানন্দকে তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই?
থাকবে না কেন? পাজি লোকদেব আমার মনে থাকে।
পাজি লোক।–হেমকান্ত চোখ বড় বড় করে বলেন, কে পাজি? আমার বন্ধু সচ্চিদানন্দ?
তার কথাই তো হচ্ছে।
সে পাজি হবে কেন?
কেন হবে তা অত বলতে পারি না। তবে লোক চিনি।
কী কান্ড?
সবই কি তোমাকে শুনতে হবে?
হবে।
শুনে তোমার ভাল লাগবে না।
তুমি সবসময়ে আমার মন রেখে কথা বলো?
তা অবশ্য বলি না। কিন্তু শুনলে যদি তোমার বন্ধুপ্রীতি চটে যায়?
হেমকান্ত মৃদু ও ম্লান একটু হেসে বললেন, তবু শোনা যাক। একটা মানুষকে নানাভাবেই জানতে হয়।
স্নিগ্ধ ও স্মিত মুখে রঙ্গময়ি কিছুক্ষণ হেমকান্তর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, ললিতার বিয়ের সময় সচ্চিদানন্দবাবু আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, রঙ্গময়ি, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
বলো কী?–হেমকান্ত ভারী বিব্রত বোধ করতে থাকেন।
অবশ্য উনি আমার অবস্থা দেখে দুঃখিত হয়েই প্রস্তাবটা করেন। বলেছিলেন, তোমার তো গতি হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ বলতে তো একটা কথা আছে।
তুমি কী বললে?
আমি কী বলতে পারি বলে তোমার মনে হয়?
হেমকান্ত হাঁ করে চেয়ে থেকে বলেন, কী জানি।
আমি বললাম, আপনার স্ত্রী তো একজন আছেন। উনি বললেন, থাক না। পুরুষমানুষের কি একজনকে নিয়ে থাকলে হয়?
তুমি তখন কী করলে?
একটা কথা বলেছিলাম। তাইতে উনি খুব ঘাবড়ে গিয়ে প্রস্তাবটা ফিরিয়ে নিলেন।
কথাটা কী?
সেটা বলতে পারব না।
কিছুতেই না?
কিছুতেই না।
হেমকান্ত আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, থাক গে, শুনতে চাই না।
রঙ্গময়ি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, যে ছেলেটাকে কাছারিবাড়িতে থাকতে দিয়েছ তার খুব জ্বর। জানো?
শুনেছিলাম।
তার বাড়িতে একটা খবর দেওয়া দরকার।
ঠিকানাটা জেনে নিয়ে একটা চিঠি দিয়ে দাও।
রঙ্গময়ি মৃদু হেসে বলে, তোমার যা বুদ্ধি!
কেন, বুদ্ধির আবার কী দোষ হল?
ছেলেটা পুলিসের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছে তা তো জানো।
হ্যাঁ, বলছিল বটে।
তাহলে চিঠি লেখাটা কি ঠিক হবে? পুলিস হয়তো চিঠির খোঁজ করবে।
হেমকান্ত একটু বিরক্ত হয়ে বলেন, তাহলে কী করব?
বরিশালে কাউকে পাঠাও। সে গিয়ে ওর বাবাকে খবরটা গোপনে দিয়ে আসবে।
ডাক্তার কী বলছে? অবস্থা খুব খারাপ?
বেশ খারাপ। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরছে, আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। জ্বরটাও ছাড়ছে না।
হাসপাতালে দিলে কেমন হয়?
ভাল হয় না। সেখানে ওর কথা সবাই জানতে পারবে। পুলিসের খাতায় নাম থাকলে হাঙ্গামা হবে।
সে তো এখানেও হতে পারে।
পারেই তো। মুহুরি গোমস্তারা দেখছে। তারাও বাইরে বলাবলি করবে। স্বদেশি করা ছেলেদের দেখলেই চেনা যায়।
ছেলেটা কি স্বদেশি বলে তোমার মনে হয়?
হয়। আমি লোক চিনি।
তাহলে তো বিপদ হল মনু।
একটু হল। কিন্তু তুমি ও নিয়ে ভেবো না। ছেলেটা যদি নাই বাঁচে তাহলে আর কী হবে?
বাঁচবে না?
বাঁচতে পারে যদি ভাগ্যে থাকে। তেমন সেবাযত্ন তো হচ্ছে না। দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার মাথায় জল দেবে কে? আইসব্যাগ ধরে থাকবে কে?
কেন, তুমি!
ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো?
ছাইও তো কাউকে না কাউকে ফেলতে হবে, মনু।
রঙ্গময়ি একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমি যেটুকু পারি করছি। কিন্তু তবু ওর বাড়ির লোককে খবর দেওয়া দরকার। যদি শেষ পর্যন্ত না বাঁচে তাহলে তারা চোখের দেখাও দেখতে পাবেন না।
ঠিক আছে। নগেন মুহুরির বাড়ি বরিশালে। ওকে যেতে বলো।
রঙ্গময়ি চলে গেলে হেমকান্ত অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন নিজের জায়গাটিতে। সচ্চিদানন্দর চিঠিটার জবাব দেওয়া দরকার। কিন্তু লিখতে ইচ্ছে করছে না। আর দিন দশেক বাদে তার বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধ। যথেষ্ট টাকার জোগাড় নেই। তার ওপর দুটি ঘটনা তার মনটাকে আরও খারাপ করে দিল। এক হল, রঙ্গময়িকে সচ্চিদানন্দ বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। দুই, শশিভূষণ ছেলেটির অসুস্থতা।
হেমকান্ত উঠে নিজের পড়ার ঘরে এসে ডেসকের দেরাজ থেকে চাবি বের করলেন।
সুনয়নীর একটা আলাদা ঘর ছিল। সেটা এখন তালাবন্ধ থাকে। ঝাড়পোঁছও বড় একটা হয় না।
তালা খুলে হেমকান্ত ভিতরে ঢুকলেন। জানালা দরজা বন্ধ থাকায় ভিতরটায় প্রদোষের আলোআঁধারি আর ভ্যাপসা গন্ধ।
ঘরের সোনা বিক্রি করার মতো দুরবস্থা হেমকান্তর নয়। ইচ্ছে করলেই তিনি ধার পেতে পারেন। কিন্তু ধার জিনিসটাকে বড়ই অপছন্দ তার। বাজারে নগদ টাকার বেশ একটা অভাব চলছে। লোকের হাতে টাকা নেই। আদায়-উশুলও কম।
হেমকান্ত দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর গিয়ে সিন্দুকটায় চাবি ঢোকালেন।
জীবনে এই কাজ এই প্রথম করছেন হেমকান্ত। সুনয়নীর গয়নার খোঁজ তিনি কোনওকালে করেননি। কত গয়না বা সোনা আছে তা জানার আগ্রহও তার ছিল না। কাজেই বুকটা কেমন দুরদুর করছিল। মনে হচ্ছিল যেন চুরি করছেন।
এটা চুরিই কি না তা নিয়ে মনে একটু দ্বন্দ্বও এল হেমকান্তর! গয়নাগুলি বেশির ভাগই সুনয়নী পেয়েছিল উপহার হিসেবে। তার বাপের বাড়ির যৌতুক আছে, হেমকান্তর মায়ের দেওয়া গয়না আর মোহর আছে, আত্মীয়-স্বজনরাও কিছু কম দেয়নি। হেমকান্তও দিয়েছেন। সুনয়নীর সেই সব সম্পদ হয়তো আইনের বলে তাতেই অর্শায়। তবু হেমকান্ত কিছুতেই সুনয়নীর সম্পদকে নিজের বলে মনে করতে পারছেন না।
আচমকাই একটা অনুভূতি হল তার। তিনি চকিতে ফিরে তাকালেন। খাটের ওই বিছানায় জীবনের শেষ কয়েকটা বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে শুয়ে কাটিয়েছে সুনয়নী। প্রচণ্ড কষ্ট পেত। ওখানে শুয়ে আজও যেন সুনয়নী চেয়ে দেখছে। দেখছে তার আদরের সব গয়নাগাটি আর মোহর চুরি করতে ঢুকেছেন হেমকান্ত।
হেমকান্তর সৌজন্যবোধ অসীম।
তিনি সিন্দুকের চাবি ঘুরিয়ে ফেলেও পাল্লাটা খুললেন না। ধীরে ধীরে এসে ফাঁকা খাটটার কাছে দাঁড়ালেন। তার মনে হল সুনয়নী এখন না থাকলেও এক সময়ে সে এই ঘরে বাস করেছে। তার সত্তার, তার অস্তিত্বের স্পন্দন বা স্মৃতি কিংবা রেশ কিছু এখনও রয়ে গেছে এইখানে। হয়তো সুনয়নী বাস্তবিকই তাঁকে দেখছে না, কিন্তু তিনি যে এ ঘরে ঢুকেছেন তার স্পন্দন সুনয়নীর সেই অদৃশ্য উপস্থিতিতে গিয়ে পৌঁছোচ্ছে।
হেমকান্ত মৃদু স্বরে বললেন, তুমি কী রেখে গেছ তা তো জানি না। একটু দেখছি, যদি অনুমতি দাও।
বলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন হেমকান্ত। কোনও জবাব আশা করেননি। পেলেনও না। তবু হেমকান্ত একবার বিছানাটা স্পর্শ করলেন। সুনয়নী যখন অসুস্থ তখন হেমকান্ত খুব একটা তার কাছে আসতেন না। অসুস্থতা বা রোগ-ভোগ জিনিসটা তিনি সইতে পারেন না। সুনয়নীকে সেবা করার। অবশ্য অনেক লোক ছিল, ফিরিঙ্গি একটি নার্স পর্যন্ত। অক্লেশে তার গু-মুত ঘাঁটত রঙ্গময়ি। হয়তো সেই সময়েই সুনয়নী রঙ্গময়িকে গয়না দিয়েছিল।
হেমকান্ত বিছানাটায় বসলেন। এখান থেকে দেয়ালে গাঁথা সিন্দুকটা মুখোমুখি দেখা যায়। সুনয়নী কি নিজের গয়নাগাটির ওপর নজর রাখত শুয়ে শুয়ে? নইলে দক্ষিণে পা করে শুত কেন?
ভেবে আবার চিন্তান্বিত হলেন হেমকান্ত। আস্তে আস্তে বিছানার জাজিমে হাতটা ঘষতে ঘষতে বললেন, কেন পার্থিব সম্পদের এত পিপাসা ছিল তোমার? কিছুই তো সঙ্গে যায় না। সব ফেলে যেতে হয়।
সুনয়নীর স্তিমিত কণ্ঠ নিজের অন্তরে শুনতে পেলেন হেমকান্ত, সবই জানি। তবু বড় মায়া। তোমার মতো জাগ্রত বিবেক কজনের থাকে? তার ওপর আমি মেয়েমানুষ।
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, সুনয়নী, তুমি মেয়েমানুষ ছিলে, কিন্তু আজ দেহ অবসানের পর আর তাও নও। আত্মা তো পুরুষ বা মেয়ে নয়। আজ বলো সুনয়নী, এই সম্পদ এই দেহ এই আত্মাজন এসবের দাম কী?
দাম নেই? তাহলে সব সৃষ্টি হল কেন?
দাম মানুষ দেয়, সৃষ্টিকর্তা তো দেন না। সোনাকে মহার্ঘ্য বানাল কে? দেহকে এত মূল্য দিল কে? আত্মজনকে পৃথিবীর মানুষের থেকে আলাদা করে চেনাল কে? মানুষই তো? সভ্য মানুষ। নইলে সেই প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ তো সোনার দাম কত তা জানত না। দেহের বিলাস সে শেখেনি তখনও। আত্মজন বলতে কেউ ছিল না তার। মানুষ তার পিতৃপরিচয় পর্যন্ত জানত না। সেসব জঙ্গলের কথা। মানুষ কি আর তখন মানুষ ছিল? জন্তুর মতোই তো ছিল।
এখনও কি তাই সেই সুনয়নী? পৃথিবীকে তো আমার এখন আরও ভয়ংকর জঙ্গলের জায়গা বলে মনে হয়।
তুমি চিরকালই একটু কেমন কেন! না বৈরাগী, না সংসারী। এরকম কেন বলো তো? তোমার কি বেঁচে থাকতে ভাল লাগে না? একটু পরমায়ুর জন্য আমি কত ছটফট করেছি।
বেঁচেও তো থাকতে চাই সুনয়নী। জীবন্বত হয়ে থাকতে চাই না। জরা আসছে, মৃত্যু আসছে, সেই সঙ্গে আসছে নানা প্রশ্ন।
কীসের প্রশ্ন?
তুমি কি জানো সুনয়নী, তুমি আর আমি মিলে যাদের জন্ম দিয়েছি, আমাদের সেইসব ছেলেমেয়েরা কেমন?
ওরা খুব ভাল।
ভাল? তবে কেন তোমার মৃত্যুর পরই মেয়েরা এসে গয়না চুরি করে নিয়ে যায়? কেন বউরা এসে তাতে ভাগ বসায়? যেন ওরা তোমার মৃত্যুর অপেক্ষাতেই ছিল।
ওসব তো ওদেরই।
ওদেরই?–হেমকান্ত প্রেতের মতো একটু হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন, ওদের নয়, কারও নয়। পৃথিবীর ধ্বংসের দিনে পৃথিবী আবার সব ফিরিয়ে নেবে। সুনয়নী, এমনকী তোমার আমার ছেলেমেয়ে বলে যাদের জানি তারাও আমাদের নয়। আমরা নিমিত্তমাত্র। আমরা স্রষ্টা নই, জন্মের উপকরণ মাত্র। কাস্টোডিয়ান। কেন এত আমার-আমার বলে হয়রান হয় মানুষ?
তোমার মতো জাগ্রত বিবেক তো সকলের নেই।
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, জাগ্রত বিবেক নয় সুনয়নী। যা জাগ্রত তা হল যন্ত্রণা। বড় যন্ত্রণা।
তুমি মরতে ভয় পাও?
না। মরতে ভয় পাই না। কিন্তু মৃত্যুর মধ্যে যে রহস্যময়তা আছে তা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তোমার মৃত্যুর কথা আমাকে বলবে?
সুনয়নী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, আমি কি অত সুন্দর করে বলতে পারব? লেখাপড়া শিখিনি, ভাষার ব্যবহারও ভাল জানি না।
বোবাও তত ভাব প্রকাশ করে। তুমি পারবে না?
পারব কি না কে জানে। তবে মনে হয়েছিল, গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। তারপর মনে হল, অনেক দূরে চলে এলাম। এত দূরে কখনও আসিনি। খুব কষ্ট হচ্ছিল।
কী রকম কষ্ট?
দোটানার কষ্ট। দুদিকেই টান। গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নেওয়া হয় তখন ফুলের যেমন লাগে।
বোঝা গেল না, সুনয়নী।
বোঝানো যায়ও না গো। অপেক্ষা করো, একদিন তোমারও তো ওরকম হবে।
হ্যাঁ। তার বড় একটা দেরিও নেই।
কেন ও কথা বলছ? সেই বালতিটা হাত থেকে পড়ে গেল বলে? ওটা কিছু নয়।
কী করে বুঝলে কিছু নয়?
কিছু নিশ্চয়ই। তবে ওটা বয়সের জন্য নয়।
তবে কীসের জন্য?
তোমার সব কাজই একটা নিয়ম-শৃংখলায় বাঁধা। নিজেকে তুমি কতগুলি নিগড়ে বেঁধে রেখেছ। গণ্ডির বাইরে কখনও যাও না। তুমি কখনও অস্বাভাবিক কোনও আচরণ করো না। কিন্তু তোমার ভিতরে, খুব গভীরে একটা নিয়ম ভাঙার ইচ্ছে জেগেছে।
সেটা কীরকম?
তুমি আর নিয়ম-শৃংখলায় থাকতে চাইছ না। কিন্তু সেই পাগল ইচ্ছেকে জোর করে চাপা দিয়ে রেখেছ। তোমার হাত থেকে বালতি পড়ে যায়নি।
তাহলে?
তুমি ইচ্ছে করেই বালতিটাকে ছেড়ে দিয়েছিলে।
০১২. সারারাত পুলিশ হোটেল ঘিরে রইল
০৮১. প্রদোষে
সারারাত পুলিশ হোটেল ঘিরে রইল বটে, কিন্তু সন্ধের পর কিছু ছেলেছোকরা জুটে দুর থেকে ঢিল আর কিছু গালাগাল ছুড়তে লাগল। হোটেলের কয়েকটা কাচ ভাঙা ছাড়া তেমন গুরুতর ঘটনা নয় সেটা। তবু ভয়ে কাঁপুনি ধরে গেল রেমির। ভয়ে মুখে কথা আসছে না, রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখে বিছানায় কম্বল জড়িয়ে বসে রইল সে।
ধ্রুব একবার বলল, তুমি খুব ঘাবড়ে গেছ। একটু ব্রান্ডি খাবে? খেয়ে শুয়ে পড়ো। গা-ও গরম হবে, ঘুমও চলে আসবে।
রেমি মাথা নেড়ে জানাল, খাবে না।
ধ্রুব আর সাধল না। পাজামা চড়িয়ে, শাল চাপিয়ে ঘর থেকে বেরোনোর মুখে বলল, সমীর বোধহয় এখনও আছে। ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। একটু কমপ্যানি দিতে পারবে।
রেমি হঠাৎ উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করে, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
লাউঞ্জে। পুলিশ থেকে আমার একটা স্টেটমেন্ট নিতে এসেছে।
আমিও যাব।–বলে উঠতে গেল রেমি। কিন্তু পায়ে একরত্তি জোর পেল না সে। শরীরে ঠকাঠক কাঁপুনি। পা দুটো অবশ। আবার বসে পড়ল।
ধ্রুব উদাস গলায় বলল, গিয়ে কী লাভ? আমি আবার মদ খাই কি না দেখতে চাও? খেলেও তো ঠেকাতে পারবে না।
ধ্রুব বেরিয়ে যাওয়ার পর রেমি টেলিফোনে কলকাতার লাইন চাইল। লাইটনিং কল। মিনিট পনেরো সময় যেন অন্তহীনতায় প্রসারিত হতে লাগল। পনেরো মিনিটের মধ্যেই সে পি বি এক্স অপারেটরকে বার দুই তাগাদা দিল এবং কৃষ্ণকান্তর ফোন নম্বর মনে করিয়ে দিল।
অবশেষে কৃষ্ণকান্ত লাইনে এলেন, বউমা, তোমরা ভাল আছ তো?
বাবা, আমাদের ভীষণ বিপদ। চারদিক ঘিরে ফেলেছে গুন্ডারা, ঢিল মারছে। আমরা বোধহয় দার্জিলিং থেকে আর ফিরতে পারব না।
কৃষ্ণকান্ত একটু চিন্তিত গলায় বলেন, কেন, এখনও পুলিশ পিকেট দেয়নি?
দিয়েছে, কিন্তু তবু আমরা বোধহয় ফিরতে পারব না।
দরকার হলে পুলিশ গুলি চালাবে। তুমি চিন্তা কোরো না।
গুলি!–বলে আর্তনাদ করে ওঠে রেমি, গুলি চালাবে কেন?
কৃষ্ণকান্ত একটু হাসলেন, গুলি চালাতে হয়তো হবে না, কিন্তু ছেলেগুলো যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে তো একটা কিছু করতে হবে। কী বলো?
তা বলে গুলি? আমি তা হলে ভয়েই মরে যাব।
কৃষ্ণকান্ত শান্ত স্বরেই বললেন, লামা নামে একজন লোক তোমার সঙ্গে দেখা করবে। তোমার কাছে বোধহয় হাজার তিন-চারেক টাকা এখনও আছে, না?
আছে, বাবা। আপনি যা দিয়েছিলেন তার কিছুই খরচ হয়নি। পুরো পাঁচ হাজারই আছে।
ঠিক আছে। ওটা থেকে লামাকে দুহাজার টাকা দিয়ো।
দেব, কিন্তু এই বিপদ থেকে কী করে বেরোব বাবা?
ওটা নিয়ে তো আমি ভাবছি। কিন্তু কিছু খেয়েছ এখনও?
না, খিদে নেই।
খিদে নেই তো ভয়ে। ভাল করে মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খাও, তারপর শুয়ে পড়। আমি লামার সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছি, তোমাকেও ফোন করতাম ওকে টাকাটা দেওয়ার জন্য।
টাকা নিয়ে লামা কী করবে বাবা?
ওই ছেলেগুলোকে দেবে। ওরা বেকার ছেলে, কাজকর্ম নেই, হুজুগ পেলেই একটা কিছু করে বসতে চায়। টাকাটা হাতে পেলেই ফুর্তি করতে চলে যাবে। কিন্তু খবরদার, নিজে গিয়ে আবার ওদের টাকা সেধো না। যা করবার লামা করবে। ও হচ্ছে আমার পলিটিক্যাল এজেন্ট।
রেমি উদ্বেগের সঙ্গে বলল, আপনার ছেলেকে পুলিশ কী সব জিজ্ঞেস করছে। ওর সঙ্গে কথা বলবেন?
কৃষ্ণকান্ত বললেন, না। কথা বলে লাভ নেই। ও কেন ওকাজ করেছে জানো? ইলেকশনের মুখে আমাকে একটা স্ক্যান্ডালে জড়ানোর জন্য। ওকে কিছু বলা বৃথা। তবে তুমি যদি পারো ওকে ইমিউন রেখো।
কিন্তু আমি যে পারছি না বাবা!
চট করে তো পারবে না। সময় লাগবে। যদি মাথা ঠান্ডা রেখে চলো তাহলে হয়তো একদিন ওকে কনট্রোল করতে পারবে। তোমার ওপর আমার অনেক ভরসা।
এমন সময়ে একটা ঢিল এসে ঝনঝন করে উত্তর দিককার শার্শি ভাঙল। চমকে উঠল রেমি। টেলিফোনে কৃষ্ণকান্তকে শুনিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, আমি যে ভীষণ ভয় পাচ্ছি। আমার মাথা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। আমি কী করব?
এক্সচেঞ্জের তিন মিনিটের ওয়ার্নিং পার হয়েও কান্নাটা গড়াল।কৃষ্ণকান্ত বাধা দিলেন না। রেমির রুদ্ধ আবেগটা একটু কমে এলে বললেন, শোনো বউমা, ধ্রুব খুব বেশিদিন বেঁচে থাকবে বলে আমার মনে হয় না। হয় খুন হয়ে যাবে, নয় তো লিভার পচাবে, না হয় তো মাতাল অবস্থায় গাড়ি টাড়ি চাপা পড়বে। ওর আয়ু বেশিদিন নয়।
রেমি শিউরে উঠে বলল, কী বলছেন?
কথাটা শুনতে খারাপ, তবু যুক্তিসঙ্গত। কে ওকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবে বলো? সব পরিস্থিতিতে তো আর আমি বাঁচাতে পারব না। বিয়ের সময় সুপাত্রের হাতে কন্যা সম্প্রদান করা হয়। আমি কিন্তু মা, ধ্রুবকেই তোমার হাতে সম্প্রদান করেছি। এখন তুমি যা বুঝবে করবে। অপাত্রে পড়েছ বলে যদি সারাজীবন মনে মনে আমাকে গালমন্দ করো তো কোরো, তবু আমার ছেলেটাকে দেখো। ওর কেউ নেই। বাস্তবিকই কেউ নেই।
শেষ দিকে কৃষ্ণকান্তর গলাটা ভারী শোনাল কি না তা ভাল বুঝতে পারছিল না রেমি। পাথুরে কৃষ্ণকান্ত সহজে গলেন না। তবু যদি গলাটা ভারী শুনিয়ে থাকে তবে সেটা কৃষ্ণকান্তর অভিনয়ও হতে পারে। রেমিকে একটা পতিত উদ্ধারের সকাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই হয়ত্রে অভিনয়টুকুর দরকার ছিল।
টেলিফোন রেখে রেমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না চাপবার বৃথা চেষ্টা করতে করতে ফেঁপাচ্ছিল। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। বাইরে থেকে সমীর ডাকল, বউদি।
সেই সময়ে রেমির মাথাটা হঠাৎ খারাপও হয়ে গিয়ে থাকবে। বিয়ের পর থেকে কাণ্ডজ্ঞানহীন, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য একটা লোকের সঙ্গ তাকে তিলে তিলে পাগল করে তুলেছে। তার ওপর আছে দেহ ও মনের যৌবনোচিত চাহিদায় দিনের পর দিন বঞ্চনা। কৃষ্ণকান্ত সুকৌশলে যে গুরুভার তার ওপরে চাপাতে চাইছেন তাতেও তার মন বিদ্রোহী হয়ে থাকবে। ঠিক কী হয়েছিল তা বলা মুশকিল। তবে এই সময়ে আর-একটা মস্ত পাথর এসে উত্তর দিককার আর-একটা শার্শি ভাঙল।
রেমি পাগলের মতো গিয়ে দরজা খুলেই আঁকড়ে ধরল সমীরকে, আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলুন। এক্ষুনি! আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাই না। প্লিজ—
অপ্রতিভ সমীর নিচু জরুরি গলায় বলল, মিস্টার লামা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। এই যে—
রেমি সামলে গেল। ঠিক সমীরের পিছনেই লোকটা দাঁড়ানো। দৃশ্যটা কুতকুতে দুই চোখে দেখছে। গায়ে ওভারকোট, মাথায় টুপি, মুখে তীব্র মদের গন্ধ। হাসতেই চোখদুটো মুখের থলথলে চর্বির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রেমি লজ্জা পেয়ে সরে এল ঘরে। সমীরের সশ্রদ্ধ ভাব দেখে সে বুঝতে পারছিল, তার শ্বশুরের পলিটিক্যাল এজেন্ট লামা দার্জিলিং-এর কেওকেটা লোক। তার চেহারাতেও যথেষ্ট বুদ্ধি এবং আত্মবিশ্বাসের ছাপ আছে। তবে খুব হাসছিল লোকটা।
লজ্জা ঢাকতে রেমি তার সুটকেস খুলে দুহাজার টাকা বের করে দিয়ে বলল, আমার শ্বশুরমশাই টাকাটা আপনাকে দিতে বলেছেন।
লামা টাকাটা বুকপকেটে রেখে ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করল, খুব ভয় পাচ্ছেন তো।
আর-একটা ঢিল এসে শার্শি ভাঙতেই কাচের টুকরো ছিটকে পড়ল চারদিকে। তবে ঘরখানা বড় এবং উত্তরের জানালায় ভারী পরদা টানা দেওয়া থাকায় তাদের গায়ে এসে পড়ল না।
রেমিকে কিছু বলতে হল না, পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে লামা নিজেই মাথা নাড়ল। মৃদুস্বরে বলল, সিচুয়েশন ইজ গ্রেভ অ্যান্ড স্যাড। লোকে এটার মধ্যে পলিটিক্যাল মোটিভেশন পেয়ে যাবে অ্যান্ড দেয়ার উইল বি স্ক্যান্ডাল। এনিওয়ে, আমি দেখছি। আপনারা আজ একটু বেশি রাতে কিংবা কাল খুব ভোরে দার্জিলিং কুইট করলে ভাল হয়।
লামা চলে গেল এবং ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই ভোজবাজিতে থেমে গেল বাইরের হাঙ্গামা।
শুকনো মুখে সমীর বলল, ম্যাডাম কী করবেন?
আমি চলে যাব।
কিন্তু ধ্রুববাবু যেতে চাইছেন না। আমি একটু আগেই লাউঞ্জে ওঁর সঙ্গে কথা বলেছি।
ও না গেলে যাবে না, আমার কিছু করার নেই। আমি যাব।
একা?
আপনি আমাকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত নিয়ে চলুন। কাল আমি প্লেন ধরে কলকাতা ফিরে যাব।
কাজটা কি ঠিক হবে?
অত চিন্তা করতে পারব না। আমি যাব। আপনি গাড়ি রেডি রাখবেন।
গাড়ি রেডিই আছে। তবে শিলিগুড়ি থেকে কাকা আসছেন। তার জন্য একটু ওয়েট করা ভাল। রেমি জেদি মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বলল, আমি অপেক্ষা করতে রাজি নই।
একটু রিস্ক নিচ্ছেন বউদি।
নিলে নিচ্ছি। অবশ্য যদি আপনার কোনও অসুবিধে না থাকে–
সমীর একটু হেসে বলল, অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সারভিস। আপনি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন। আমি ধ্রুববাবুকে একটু জানিয়ে আসি। নইলে হয়তো ভাববেন তার বউকে নিয়ে পালিয়ে গেছি।
রেমি স্পষ্ট করে সমীরের দিকে চেয়ে বলল, আমি কিন্তু সত্যিই পালাচ্ছি। আপনি ওকে জানালে জানাতে পারেন, কিন্তু আমি আর ওর সঙ্গে থাকছি না।
বলেন কী?
আমি ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। কলকাতায় ফিরেই ডিভোর্সের দরখাস্ত করব।
সমীরের চোখেমুখে সত্যিকারের আতঙ্ক ফুটে উঠল। আমতা-আমতা করে বলল, এটা তো একটা মেজর ডিসিশন। এত তাড়াতাড়ি নিলেন?
ডিসিশনটা তাড়াতাড়ি নিলে জীবনটা আবার নতুন করে তাড়াতাড়ি শুরু করতে পারব। আমাদের সম্পর্কটা কেমন তা তো আপনাকে বলেছিও।
বলেছেন ঠিকই। কিন্তু আমি ভাবছিলাম ধ্রুববাবুর এসব ব্যাপার বোধহয় খুব ডিপ সেট নয়। খানিকটা অভিনয়ও থাকতে পারে।
তার মানে?— প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রেমি।
উনি হয়তো সকলকে বিপন্ন করে তুলে এক ধরনের আনন্দ পান। যাক গে, আপনি নিশ্চয়ই সেটা আমার চেয়ে ভাল বোঝেন। মার কাছে মাসির গল্প করে লাভ কী?
কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল রেমির। কিন্তু সে তো জানে, তা নয়। রেমি ম্লান হেসে মাথা নেড়ে বলল, অভিনয়-টয় নয়। আমি জানি। কখন বেরোকেন?
রাত দশটার মধ্যে দার্জিলিং ঘুমিয়ে পড়ে। দশটায় স্টার্ট দিলে আমি আপনাকে সাড়ে বারোটায় শিলিগুড়ি পৌঁছে দিতে পারব।
বাড়ির লোক আমাকে অত রাতে দেখে কিছু বলবে না?
বলতে পারে। তবে আমি একটা টেলিফোন করে আগেই জানিয়ে দেবোখন। তা হলে আর কোনও প্রশ্ন উঠবে না।
সমীর চলে গেলে রেমি নিশ্চিন্ত হয়ে একটা শ্বাস ফেলল।
প্ল্যানটা ঠিকমতোই এগোচ্ছিল। রেমি বাক্স গুছিয়ে নিয়েছে। অনিচ্ছের সঙ্গেও ঘরে খাবার আনিয়ে খানিকটা খেয়েছে। গরম পোশাক পরে অপেক্ষা করেছে সমীরের জন্য। আর তার পালানোর পথ বিপ্নহীন করতে ধ্রুব গিয়ে ঢুকেছে বার এ। রাত নটার মধ্যে তার চেতনা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। তাকে একবার বলেছিল সমীর, বউদি শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছেন ধ্রুববাবু। আপনিও যাবেন তো?
ধ্রুব মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে এই তুচ্ছ প্রসঙ্গ উড়িয়ে দিয়েছে।
রাত দশটার কয়েক মিনিট আগে বেয়ারা এসে রেমির মালপত্র নিয়ে গাড়িতে তুলল। রেমি নেমে এল নীচে। যখন গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই আকস্মিক ঘটনাটা ঘটল।
হোটেলের সামনের বাগানের গাছপালার আড়াল থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে এল লামা। গায়ে ওভারকোট, মুখে মার্কামারা হাসি। তবে হাসিটা তখন আর স্বতঃস্ফূর্ত নয়। রেমিকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন?
ভীষণ চমকে উঠেছিল রেমি। শীত বাতাসের একটা চাবুক যেন তাকে কাপিয়ে দিয়ে গেল। কষ্টে বলল, আমি চলে যাচ্ছি। ধ্রুববাবু কোথায়?
ও যাচ্ছে না।
কেন যাচ্ছে না?
রেমি নিজেকে সামলে নিয়েছে। ভ্রুকুটি করে বলল, সেটা তো ও জানবে, আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
সমীর সামনের সিটে উঠতে গিয়েও লামাকে দেখে স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে ফিরে লামা হাসিমুখে বলল, কৃষ্ণকান্তবাবুর সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। উনি চান ধ্রুববাবুকে ওঁর স্ত্রীর সঙ্গেই কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক। আপনি রেমি দেবীকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
লামাকে দেখে সমীর যে ভয় পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সে কাঁধটা উঁচু করে বলল, ধ্রুববাবুর পারমিশন নিয়েই উনি যাচ্ছেন। আমি পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।
লামা একটু ক্ষুব্ধ গলায় বলল, কাজটা ঠিক হল কি? ধ্রুববাবু এখন সেনসে নেই, এ সময়ে ওঁর স্ত্রী চলে যাচ্ছেন।
আমার কিছু করার ছিল না মিস্টার লামা।
লামা রেমির দিকে ফিরে বলল, আপনি যেতে চাইছেন, কিন্তু এভাবে যেতে পারবেন না। হাঙ্গামা থেমেছে বটে কিন্তু রাস্তা এখনও পরিষ্কার নয়। দেখবেন? আসুন আমার সঙ্গে।
লামা গেট-এর দিকে হাঁটতে লাগল। সমীর নিচু স্বরে রেমিকে বলল, কিছু করার নেই। চলুন দেখা যাক।
ফটকের কাছে এনে লামা তাদের দেখাল। হাটেলের সামনেই একটা ঢাল। রাস্তাটা মোড় নিয়ে পাইন গাছের একটু জড়ামড়ির মধ্যে ড়ুবে গেছে। সেখানে আবছা আলোয় কয়েকটা সিগারেটের আগুন ঠিকরে ঠিকরে উঠছে। অন্তত দশ-পনেরোটা ছেলে অপেক্ষা করছে রাস্তা জুড়ে।
রেমি আতঙ্কিত হয়ে বলল, ওরা কী চায়?
লামা মৃদু হেসে বলে, নাথিং। শুধু আপনাদের বেরোনোর রাস্তাটা আটকে আছে। এখন যাওয়াটা সেফ নয় মিসেস চৌধুরী।
তা হলে কখন?
কাল সকালে।
তখন সেফ হবে?
হবে। ধ্রুববাবু আপনাকে অ্যাকমপ্যানি করবেন। কোনও ট্রাবল হবে না। এখন ঘরে ফিরে যান। হতাশ রেমি ফিরে এল ঘরে। ধ্রুবকে ধরাধরি করে এনে বিছানায় দিয়ে গেল কয়েকজন বেয়ারা।
পরদিন প্রকাশ্য দিনের আলোয় তারা দার্জিলিং ছাড়ল। রেমি, ধ্রুব আর সমীর। কার্শিয়াং-এ চা খেতে নেমে এক ফাঁকে সমীর চুপি চুপি রেমিকে বলল, বউদি, একটা বিপদ বাঁধিয়ে রেখে গেলেন কিন্তু।
কী বিপদ?
আপনি কাল একবার আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, মনে আছে?
রেমি লজ্জা পেয়ে বলে, সে তো ভয়ে।
সমীর বিকৃত মুখ করে বলে, ভালবাসায় নয় তা জানি। কিন্তু মিস্টার লামা সেটাকে ওভাবেই ইন্টারপ্রেট করেছে। লোকটার ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড। একবার যা ভেবে নেবে তা থেকে আর সরানো যাবে না। খুব সম্ভব আপনার শ্বশুরকেও ব্যাপারটা জানিয়েছে।
সে কী?
সেটাই বিপদের। কৃষ্ণকান্তবাবু যদি কাকাকে জানান তা হলে আমি খুব মুশকিলে পড়ে যাব।
কীসের মুশকিল? বুঝিয়ে বললেই হবে। আমার শ্বশুব অবুঝ লোক নন।
সমীর তবু নিশ্চিন্ত হল না। কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে রইল।
আচমকাই রেমি জিজ্ঞেস করল, আসল ভয়টা কাকে বলুন তো? ছন্দাকে? ওকে আমি চিঠি লিখে জানিয়ে দেব যে, আপনি সত্যিই আমার প্রেমে পড়েননি।
একথায় কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল সমীর। অবিশ্বাসভরা চোখে রেমির দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কিন্তু প্রতিবাদ করল না। খুব বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, মেয়েদের চোখ বোধহয় সবই দেখতে পায়। কিন্তু ব্যাপারটা ভীষণ গোপন, বউদি। ভীষণ গোপন।
ঘেন্নায় রেমির ঠোঁট বেঁকে গেল। ধ্রুব, মাতাল ও মতিচ্ছন্ন বর চোখ তা হলে ভুল করেনি।
আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে তার ধ্রুবকে আবার ভালবাসতে ইচ্ছে করল। আর অস্থির ব্যাকুল হৃদয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল ধ্ৰুবকে একা পাওয়ার জন্য।
পেল ট্রেনে। আবার সেই কুপে কামরা। সে আর ধ্রুব।
রেমি ঝাঁপিয়ে পড়ল ধ্রুবর ওপর, বলল তোমার পাগলামি আর মাতলামি সব অভিনয়! সব ভাঁড়ামি। বলো তুমি অস্বাভাবিক নও! এত বুদ্ধি এত চোখ কখনও কোনও মাতালের থাকে? বলো! বলছ না কেন?
সেই আক্রমণে ধ্রুব যেমন অবাক, তেমনি বিপন্ন। বলল, আরে কী করছ? ডাকাত পড়েছে ভেবে লোকজন ছুটে আসবে যে!
আসুক। তবু তুমি বলো এসব তোমার অভিনয়, এগুলো কিছুই সত্যি নয়!
ধ্রুব একটু বিচ্ছুর হাসি হেসে বলল, তা হলে খুশি হবে?
হব। তা হলে এমন খুশি হব যে আনন্দে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ব নীচে। খুব জোরে হো-হো করে হাসব। কেঁদেও ফেলতে পারি।
ধ্রুব কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইল চুপচাপ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলল, রেমি, তোমার সমস্যা একটাই। আমি মদ এবং পাগলামি ছাড়লেই তোমার সেই সমস্যাটা বোধকরি মিটে যায়। কিন্তু আমার সমস্যাটা অত সরল নয়।
তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি। পায়ে পড়ছি।
ধ্রুব একটু হেসে বলে, দার্জিলিং-এ আমাকে ফেলে চলে আসতে চেয়েছিলে, তবু কথাটা বিশ্বাস করছি। আমি নিজেও লক্ষ করেছি তুমি আমাকে ভালবাসার চেষ্টা করছ।
চেষ্টা নয়। আমি তোমাকে ভালবাসি গো।
সেটাও মানলাম। বাট আই হ্যাভ টু সেটল মাই অ্যাকাউন্টস উইথ আদার পিপল। রেমি, আপাতত আমার কাছে কিছু প্রত্যাশা কোরো না।
০১৩. ভাই সচ্চিদানন্দ
“ভাই সচ্চিদানন্দ, তোমার সহিত আর পারিলাম না। বহু দূরে অবস্থান করিয়াও তুমি আমার রোগ নির্ণয় করিয়া নিদান পাঠাইয়াছ। তোমার নাড়িজ্ঞান প্রখর বলিতেই হইবে। তোমার নিদানটি গ্রহণ করিলে রোগীর ধাত ছাড়িয়া যাইবে কি না তাহা অবশ্য ভাবিয়া দেখো নাই। উপরন্তু আমার নানা অক্ষমতা, অপদার্থতার নজির তুলিয়া আমি কোন শ্রেণির মানুষ তাহাই প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছ।
“বয়স্য সচ্চিদানন্দ, সুখের কথা হইল আমি কোন শ্রেণির মানুষ তাহা আমার অজ্ঞাত নহে। শৈশবের কিছুই আমি ভুলি নাই। ঈশ্বরকৃপায় আমার স্মৃতিশক্তি ভালই। আপনমনে থাকি এবং স্মৃতি লইয়াই সময় কাটে বলিয়া সহজে কিছু ভুলিয়াও যাই না।
“দুইটি ভাইয়ের মাঝখানে আমি নিতান্তই খাপছাড়া। ভগ্নীদের কথা বাদ দিতেছি। কারণ নারীদের বিচারের মাপকাঠি আলাদা। কিন্তু আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই যে সব দিক দিয়া অযোগ্য ও অপদার্থ ছিলাম তাহা আমার পিতাঠাকুর হইতে শিক্ষকরা সকলেই আমাকে বারংবার বুঝাইয়াছেন এবং আমিও বুঝিয়াছি।
“আমার জ্যেষ্ঠ বরদাকান্ত বাল্যকালে অত্যধিক দুষ্ট ছিলেন। তাঁহার অনেক অভিযানে আমিও সঙ্গে গিয়াছি। একবার রহিম সাহেবের পাটবোঝাই নৌকায় তিনি রাত্রিবেলা অগ্নিসংযোগ করেন। নিতান্তই দুষ্টামি, অন্য উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু সেই আগুনে একজন ঘুমন্ত মাল্লা অর্ধদগ্ধ হইয়া মরিতে বসিয়াছিল। ভোরবেলা নৌকা ছাড়িবে বলিয়া মাল্লারা পাটের গাঁটের খাঁজে ঢুকিয়া ঘুমাইয়া লইতেছিল। সেই হতভাগ্য মাল্লাটি সময়মতো জলে লাফাইয়া পড়িতে পারে নাই। আজ বরদাকান্ত সাধু হইয়াছেন। যদি এখন কেহ গিয়া তাহাকে সেই শৈশবের দুষ্কর্যটির কথা স্মরণ করাইয়া তিনি যে কত বড় অসাধু তাহা প্রমাণ করিবার চেষ্টা করেন তাহা হইলে কেমন হয়?
“এই যে আজ তুমি কংগ্রেসে নাম লিখাইয়া দেশভক্ত হইয়াছ ইহা তো গৌরবেরই কথা। কালক্রমে একদিন কংগ্রেসের নেতা হইয়া ওঠা তোমার পক্ষে বিচিত্র নহে। কিন্তু সেইদিন যদি কেহ গিয়া তোমাকে বলে যে মহাশয় চামেলী নাম্নী মহিলাটির সঙ্গে একদা আপনার সম্পর্কটি কতদূর ঘনিষ্ঠ ছিল তাহা আমরা জানি। তখন কেমন হইবে?
“তোমাকে আঘাত করিবার জন্য প্রসঙ্গটি উত্থাপন করি নাই। আমি জানি মানুষকে বিচার করিতে হইলে তাহার অতীতেরও খানিকটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন এবং তুমি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বলিয়াই সেই কাজ করিবার চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু আমার বর্তমান সমস্যাটি অতি সরল ও লঘু নহে। আমি মানি, সুনয়নীর সহিত আমার সম্পর্ক কিছুটা শীতল ছিল। দোষ তাহার নহে, আমার। আমি নিজেই বরাবর কিছু শীতল স্বভাবের লোক। আমি সৌন্দর্য ভালবাসি, তাহা লইয়া ঘটাছানা করিতে ইচ্ছা হয় না। সুনয়নীর সৌন্দর্য আমি দূর হইতে উপভোগ করিতে ভালবাসিতাম, যেমন লোকে ফুল বা চাঁদকে উপভোগ করে। তাহার সহিত আমার দূরত্ব ছিল তাহাও স্বীকার করি এবং বলি, জীবনটাকে উপভোগ্য করিয়া তুলিবার জন্য একটু দূরত্বেরও প্রয়োজন আছে। মুখের নিকটে আয়না ধরিলে কি মুখখানা ভাল দেখা যায়? একটু দূরে ধরিতে হয়। সুনয়নীর সহিত আমার সেই দূরত্বটুকু ছিল। কিন্তু তাহা যে তোমাদের কাছে প্রেমহীনতা বা ভালবাসার অভাব বলিয়া প্রতিভাত হইবে তাহা ভাবিয়া দেখি নাই। এখন অবশ্য ভাবিয়াও কিছু করা যাইবে না। যাহা ঘটিয়া গিয়াছে তাহার সবকিছুই আর সংশোধন করা তো সম্ভব নহে।
“তুমি বৌদ্ধ দর্শন অবশ্যই পড়িয়াছ। যে প্রদীপশিখাটি নিষ্কম্প ও স্থির হইয়া জ্বলিতেছে তাহাকে একটিই প্রদীপশিখা বলিয়া মনে হয় বটে, কিন্তু আসলে প্রতিটি নিমেষেই শিখাটি মরিয়া নূতন একটি শিখা জন্ম লইতেছে। কিন্তু তাহা এত দ্রুত ঘটিতেছে যে আমাদের চক্ষু তাহা ধরিতে পারিতেছে না। ভাই সচ্চিদানন্দ, আমার তো মনে হয় মানুষও তাহাই। ক্ষয় ও পূরণ প্রকৃতিরই নিয়ম। সেই নিয়ম অনুসারেই আমাদেরও নিত্য ক্ষয় ও পূরণ ঘটিতেছে। আর তাহারই ভিতর দিয়া চলিতেছে বলিয়া একটি মানুষও আসলে অনেকগুলি মানুষের সমষ্টিমাত্র। আমি যদি আজ বলি, খানু পাগলার তাড়া খাইয়া যে হেমকান্ত পলাইয়াছিল সে আমি নহি তাহা হইলে কি তত্ত্বগতভাবে ভুল হইবে?
“তোমাকে দর্শন বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার জন্য প্রসঙ্গটির অবতারণা করি নাই। বলিতেছিলাম, মানুষের পরিবর্তন ঘটে। আজিকার মানুষটি যাহা করিতেছে তাহা দিয়া পঁচিশ বছর পরের লোকটিকে বিচার করা সর্বাংশে যথাযথ না হইতেও পারে। পাটের নৌকায় আগুন লাগাইয়াছিল বলিয়া বরদাকান্তের বৈরাগ্য বাতিল হইয়া যায় না। চামেলীভক্ত সচ্চিদানন্দেরও দেশভক্তিতে ভেজাল ঢোকে না।
“কিন্তু বিতর্ক থাকুক। ইহাতে আমাদের কাহারও লাভ নাই। উপরন্তু নানাবিধ ঝামেলায় আমারও মনটা বড় স্থির নাই। কিছুদিন আগে শশিভূষণ গঙ্গোপাধ্যায় নামে একটি ছোকরাকে আমার বাসায় আশ্রয় দিয়াছিলাম। তাহাকে নাকি পুলিশ স্বদেশি মনে করিয়া তাড়া করিয়াছে। বেচারা দিন দুই আমাদের আমরাগানে অনাহারে লুকাইয়া ছিল। কিন্তু আশ্রয় দেওয়ার পরই ছেলেটি সাংঘাতিক অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে। ডাক্তার তেমন ভরসা দিতেছে না। সে বলিয়াছিল তাহার বাড়ি বরিশালে, পিতা শিক্ষকতা করেন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে তাহার বাড়িতেও খবর দিতে পারিতেছি না। সে বাঁচিবে কি মরিবে জানি না, কিন্তু আপাতত তাহার দায় যে আমার উপর বর্তাইয়াছে তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই।
“কথা হইল আমি এই অজ্ঞাতকুলশীল শশিভূষণের দায় স্কন্ধে নিলাম কেন। দুমুঠা খাইতে দিয়া তন্দণ্ডেই তাহাকে বিদায় দিতে পারিতাম। বিশেষ করিয়া ইংরাজ রাজত্বে পুলিশের খাতায় নামলেখানো লোককে আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবু দিলাম। কেন দিলাম তাহা জানিলে তুমি হাসিবে। দিলাম তোমার কথা মনে করিয়া।
“ভাই সচ্চিদানন্দ, দেশ কাল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি তোমার মতো সচেতন নই একথা ঠিক। দেশের কোথায় কী ঘটিতেছে, ইংরাজরা কত টাকার জিনিস বৎসরে এই দেশে রফতানি করিতেছে, স্বদেশিরা কয়টি ইংরাজ মারিল এত খবর বিস্তারিতভাবে আমি রাখি না। তবে মানুষ তাহার বিশেষ সমাজ ও পারিপার্শ্বিকের মধ্যেই বাঁচিয়া থাকে, তাই দেশ কাল পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ এড়াইতেও পারে। আমার পরিবেশ সীমাবদ্ধ বটে, তবে এখানেও বহির্বিশ্বের তরঙ্গ আসিয়া লাগে। আজকাল আরও বিশেষ করিয়া লাগে, কারণ আদায় উশুল হ্রাস পাইয়াছে, জমিদারির আয়ে বুঝি আর মর্যাদা রক্ষা হয় না। আয় কেন কমিল তাহা অনুসন্ধান করিতে গিয়া দেশ কাল পরিস্থিতির আঁচ পাইলাম। আমাদের মতো ঘরকুনো ও আত্মসুখী মানুষরাও তাই সর্বৈব পরিবেশকে এড়াইয়া চলিতে পারে না। তবে দেশ যতই সংঘাতসংকুল ও সমস্যা কণ্টকিত হউক না কেন কিছু লোক নিস্পৃহ ও উদাসীন থাকিবেই। আমি এই দলের। ইহারা আন্দোলন করিতে পথে নামিবে না, বিদেশি দ্রব্যের বৎসবে যোগদান করিবে না, ইংরাজ মারিবে না, পতিতোদ্ধার করিবে না, ইহারা কেবল বসিয়া ভাবিবে।
“তোমার এই অপদার্থ বয়স্যটিকে ক্ষমা করিয়ো। তবু শশিভূষণ যখন সামনে আসিয়া দাঁড়াইল তখন মনে হইল, এই তত সচ্চিদানন্দের দেশ কাল পরিস্থিতি আমার সম্মুখে আসিয়া হাজির হইয়াছে। ইহাকে একটু বাজাইয়া দেখিলেই তো স্বদেশিয়ানার প্রবণতাটা বুঝা যাইবে। সম্ভবত স্বদেশের প্রতি যে কর্তব্য আজও না করিয়া পাপ সঞ্চয় করিতেছি, এই ছোকরাকে আশ্রয় দিলে সেই পর্বতপ্রমাণ অপরাধের তিলপ্রমাণ ক্ষয়ও হইতে পারে। এখন সেই কর্মের ফলভোগ করিতেছি। শশিভূষণ বুঝি বাঁচে না।
“আর এক সমস্যা আমার কনিষ্ঠ পুত্রটিকে লইয়া। সে তাহার মাকে দেখে নাই বলিলেই হয়। স্বভাবতই সে আমার কিছু প্রশ্রয় পাইয়াছে। এই সপ্তানটির প্রতি আমার দুর্বলতার কথাও সকলেই জানে। এখন তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাহাকে কলিকাতায় লইয়া গিয়া লেখাপড়া শিখাইতে আগ্রহী। আমি মতামত দিই নাই। যে কোনও বিষয়েই মনস্থির করিতে আমার সময় লাগে। মনে হইতেছে, কৃষ্ণকান্ত চলিয়া গেলে আমার কিছু কষ্ট হইবে।
“পুত্রকন্যারা আমার প্রতি স্নেহাসক্ত কি না জানি না। তাহাদের সহিতও আমার সেই দূরত্ব। সুতরাং কৃষ্ণকান্তের আমাকে ছাড়িয়া যাইতে কষ্ট হইবে কি না জানি না, যদি জানিতে পারি যে হইবে না, তবে বোধহয় খুব খুশি হইব না। কিন্তু কথাটা হইল এই, এই পৃথিবীতে আমরা পরস্পরের কতটা আপনজন?
“সচ্চিদানন্দ ভায়া, তোমাকে কোকাবাবুর গৃহে সংঘটিত একটি ঘটনার কথা লিখিয়াছিলাম। দাদু মরিতেছে আর নাতি পাখি শিকার করিয়া ফিরিয়াছে বলিয়া অন্যদিকে খুশির হিল্লোল বহিয়া যাইতেছে। সন্দেহ হইয়াছিল, আমাদের অধিকাংশ লোকই হয়তো কৃত্রিম। বৃদ্ধ পিতার জন্য তাহার পুত্রের তেমন কোনও স্নেহ থাকে না।
“সেই কথা যতবার মনে হয় ততবার শীঘ্র মরিতে ইচ্ছা করে…”
হঠাৎ রঙ্গময়ির কণ্ঠস্বর পিছন থেকে বলে উঠল, তোমার মরতে ইচ্ছে করে?
হেমকান্ত চমকে উঠলেন। কিন্তু চিঠি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন না। বললেন, কখন এলে?
অনেকক্ষণ। পিছনে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়ছিলাম। আমার শ্বাসের শব্দও পাওনি?
না। হয়তো শ্বাস বন্ধ করে পড়ছিলে।
মরতে ইচ্ছে করে লিখেছ কেন? সত্যিই করে?
হেমকান্ত মৃদু একটু হাসলেন। বললেন, বোধহয় করে।
ছেলেমেয়েরা ভালবাসে না তোমাকে একথা কে বলল?
কেউ বলেনি। আমি লিখেছি ভালবাসে কি না জানি না।
জানো না কেন? খোঁজ নিলেই তো হয়।
খোঁজ নিলে কী জানা যাবে বলো তো মনু? বাসে?
আমি বলতে যাব কোন দুঃখে?
তুমি ছাড়া আর তো কেউ বলতে পারবে না।
কৃষ্ণকে ছেড়ে থাকতে যদি কষ্টই হয় তবে সে কথা কনককে জানিয়ে দিলেই তো পারো। চ্চিদানন্দবাবুকে জানানোর কী?
হেমকান্ত মৃদু মৃদু হাসছিলেন। বিব্রতও বোধ করছিলেন। বললেন, সেটা জানানো ভাল হবে না।
পাছে ছেলের সম্পর্কে তোমার দুর্বলতা ধরা পড়ে যায়? আচ্ছা লোক। বাবা ছেলেকে ভালবাসে এর মধ্যে কি লজ্জার কিছু আছে?
হেমকান্ত একটু বিষণ্ণ হয়ে বললেন, মনু, লজ্জার কিছু আছে কি না তা তুমি ঠিক বুঝবে না। যদি সত্যি কথা জানতে চাও, তা হলে বলি, আছে।
এ রকম উদ্ভট কথা কখনও শুনিনি।
আমি চাই না কৃষ্ণ কথাটা জানতে পারে।
সে জানলে দোষটা কী?
দোষের কিছু নয় তা জানি। তবে হয়তো ভাববে, বাবা এমনিতে ডাক-খোঁজও করে না কিন্তু কলকাতায় যাওয়ার বেলায় বাগড়া দিচ্ছে।
শুধু এইটুকু?
না।–হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, আরও একটু কথা আছে।
সেটা কী?
আমি মায়া কাটাতে চাই।
তাই বা কেন?
তুমি বুঝবে না।
খুব বুঝব, একটু বোঝানোর চেষ্টা করে দেখো।
তা হলে বোসো।
রঙ্গময়ি শীতের রোদে পিঠ দিয়ে কারপেটের আর-এক অংশে বসল। তার মুখচোখে ক্লান্তির ছাপ, রাত্রিজাগরণের চিহ্ন।
হেমকান্ত বললেন, আমি হঠাৎ বুঝতে পেরেছি পৃথিবীতে আত্মীয়তার বন্ধনগুলো ভারী পলকা।
একথা কেন বলছ?
যা সত্যি বলে মনে হয়েছে তাই বলছি।
তুমি তো কখনও সংসারের ভিতরেই ভাল করে ঢুকলে না। ছেলেমেয়েদের কদিন কোলে পিঠে নিয়েছ তাও আঙুলে গোনা যায়। কাউকে তো কখনও আত্মীয় করে তোলার চেষ্টাই করলে না। তাই তোমার ওসব মনে হয়।
হেমকান্ত ব্যথিত হয়ে বললেন, কথাটা ঠিক নয়, মনু। সংসারকে যতই আপন করতে চাও না কেন সংসার তোমাকে ফাঁকি দেবেই।
রঙ্গময়ি তার উড়োখুড়ো চুল হাত দিয়ে চেপে মাথায় বসানোের ব্যর্থ একটা চেষ্টা করতে করতে বলল, তোমার মতো করে ভাবলে দুনিয়ার সব নিয়মই উলটে দেওয়া যায়। কিন্তু ওটা হল ভাবের কথা। এখন কাজের কথা শোনো। শশিভূষণের অবস্থা আজ সকালে আরও খারাপ হয়েছে।
হেমকান্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কতটা খারাপ?
টিম টিম করে প্রাণটা আছে এখনও। তবে বেশিক্ষণ নয়। কী করবে?
হেমকান্ত হতাশ গলায় বললেন, কী করব? আমার কী করার আছে?
তোমার তো কখনওই কিছু করার থাকে না, শুধু ভাবার থাকে। আমি সারা রাত ছেলেটার কাছে ছিলাম।
সারা রাত! ঘুমোওনি?
একটা অল্প বয়সের ছেলে চোখের সামনে মরে যাচ্ছে তা দেখেও কি ঘুম আসে?
তা বটে।
আজ সকালে মানুবাবু এসে দেখে ওষুধ দিয়ে গেছেন।
মানুবাবুটা আবার কে?
কদমতলায় যে হোমিয়োপ্যাথ ডাক্তার বসে।
সে কী বলল?
কিছু বলল না। ওষুধ দিয়ে গেল। কিন্তু সূর্যবাবু এক রকম জবাব দিয়ে গেছেন।
হেমকান্ত মৃদুস্বরে বললেন, কেন যে ছেলেটা মরতে এ বাড়িতে এল!
সে ভেবে এখন আর কী করবে?
কোনও রকমেই কি বাঁচানো যায় না, মনু?
রঙ্গময়ি মৃদু হেসে বলল, তা জানি না। তবে বেঁচেও বোধহয় লাভ নেই।
কেন, ওকথা বলছ কেন?
বরিশালে এক পাদ্রিকে খুন করার জন্য ওর ফাঁসি হবে।
কে বলল?
আমি জানি।
কী করে জানলে?
সারা রাত ছেলেটা জ্বরের ঘোরে ভুল বকেছে। সেইসব প্রলাপ থেকেই বুঝতে পেরেছি।
কী বলছিল?
অত খুলে বলার সময় নেই। এখন গিয়ে স্নান করব, চারটি খাব, তারপর ফের এসে রুগির কাছে বসতে হবে। খানিকক্ষণের জন্য পিসিকে বসিয়ে রেখে এসেছি। আর কৃষ্ণ আছে। কিন্তু রুগির অবস্থা তো ওরা ভাল বুঝবে না।
সর্বনাশ!
সর্বনাশের কী হল?
পুলিশ যদি খবর পায়?
খবর কি আর পায়নি!
পেয়েছে?
এসব খবর কি আর গোপন থাকে! পরশু থেকে পুলিশের চর ঘোরাফেরা করছে।
কে বলো তো?
মহেশবাবু। সেই যে বাবরি চুল—
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, জানি।
তাই বলছিলাম ছেলেটার বেঁচেও লাভ নেই।
হেমকান্ত গভীর দৃষ্টিতে রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তবু ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য তুমি প্রাণপণ করছ। কেন করছ রঙ্গময়ি?
কেন আবার! বাঁচানোর চেষ্টা তো করতেই হবে। কোন মায়ের কোল খালি করে চলে এসেছে। তাকে এমনি-এমনি মরতে দেওয়া যায়?
এই যে বললে রোগে না মরলেও ফাঁসিতে মরবে!
সেটা এখনও জানি না। তবে খুনটা বোধহয় ও করেছে।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা হলে রোগেই কেন ওকে যেতে দাও না?
একথায় রঙ্গময়ি হঠাৎ একটু অদ্ভুত হাসল। সেই হাসিতে রোজকার দেখা রঙ্গময়ি বদলে গেল হঠাৎ। ধীর স্বরে বলল, তা হলে ওর কথা তো কেউ জানতে পারবে না। পত্রিকায় ওর নাম উঠবে না। ইতিহাসে নামটা লেখাও থাকবে না।
নামটা চাউড় হওয়াটা কি ভাল?
কে জানে! তবে আমার মনে হয়, ওইটুকু ছেলে একটা সাহসের কাজ যখন করেছে তখন দেশের লোকের সেটা জানা উচিত। ফাঁসিতেই যদি মরে তা হলে হাজার-হাজার ওর বয়সি ছেলে খবরটা জেনে এই কাজে নামবে।
মনু!–হেমকান্ত আর্তনাদ করে ওঠেন।
কী বলছ?–স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো গলায় রঙ্গময়ি জবাব দেয়।
তুমিও কি স্বদেশি করছ নাকি?
আমার তো জমিদারি নেই, করলে দোষ কী?
সর্বনাশ।
সর্বনাশের কিছুই নেই। মেয়েরা আবার স্বদেশি করতে পারে নাকি? হাতে পায়ে বেড়ি আছে না!–বলে রঙ্গময়ি একটু হাসে।
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু ছোকরা যদি ধরা পড়ে তা হলে আমরাও কি রেহাই পাব! বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা।
তোমার যে কত রকমের ভয়!
ভয়টা কি মিথ্যে?
তা বলিনি। কিন্তু শশীর যা হবে তোমার তো আর তা হবে না। কেউ ধরে নিয়ে ফাঁসি দেবে না তোমাকে। তুমি তো আর স্বদেশি বলৈ ওকে আশ্রয় দাওনি।
তুমি পুলিশকে জানো না।
না জানলেই বা। অত ভয় পেয়ো না।
মহেশ কবে এসেছিল?
পরশু থেকেই ঘুরঘুর করছে।
কিছু বলেছে?
আমাকে না। তবে কাছারি বাড়িতে অনেককে নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তোমার কাছেও আজ আসার কথা।
কে বলল?
মহেশবাবু নিজেই বলে গেছেন।
হেমকান্ত কিছুক্ষণ উদ্বিগ্ন মুখে ভাবলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী বলব বলল তো মনু!
কী আবার বলবে। আমি হলে তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।
ওটা কাজের কথা হল না।
তা হলে যা বলবার নিজেই বুদ্ধি করে বোলো। রাত জেগে আমার মাথাটা ঠিক নেই এখন।
একটু বোসো, মনু। তোমার সঙ্গে আমার আর-একটু কথা আছে।
আবার কী কথা?
আছে।
কাজের কথা, না ভাবের কথা?
হেমকান্ত হেসে বললেন, দুরকমই। যে ভাবে যে নেয়।
রঙ্গময়ি বলল, ভাবের কথা হলে না হয় পরে শুনব।
ভাবের কথাকে এত ভয় কেন, মনু?
আমি বাপু, ভাবের কথাকে বড় ভয় পাই। তা ছাড়া এখন ভাবের কথা শোনার মতো মন নেই।
তুমি কাজের লোক জানি। তবু আজ একটা কথা জিজ্ঞেস করি। জবাব দেবে?
আগে তো শুনি।
তোমার কি কোনও বিশেষ দুঃখ আছে, মনু?
এই কথা বলে রঙ্গময়ি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল হেমকান্তর দিকে। বেশ দেখাল তাকে।
হেমকান্ত এই চোখের সামনে বরাবর কুঁকড়ে যান। কিন্তু আজ একটু সাহস করে চোখে চোখ রাখলেন। বললেন, কথাটাকে তুচ্ছ ভেবো না। কারণ আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি।
রঙ্গময়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কারণ ছাড়া তুমি কিছু করবে না জানি। কিন্তু কারণটা কী?
আগে বলো।
বলার কী আছে তাও তো ছাই বুঝছি না। আমি গরিব পুরুতের মেয়ে, আমার তো দুঃখ থাকারই কথা।
সে দুঃখ তোমার নেই। থাকলেও আমি তার কথা বলছি না। আমি জিজ্ঞেস করছি বিশেষ কোনও দুঃখের কথা।
রঙ্গময়ি শ্রান্তমুখেও হাসতে লাগল। বলল, আর-একটু বুঝিয়ে না বললে বোকা মেয়েমানুষের মাথায় কি সেঁধোয়?
হেমকান্ত চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, ধরো যদি জিজ্ঞেস করি কোনও পুরুষের প্রতি তুমি আসক্ত কি না যাকে মুখ ফুটে কখনও কথাটা বলতে পারোনি?
রঙ্গময়ির কোনও ভাবান্তর বোঝা গেল না। তবে সে চোখ দুটো বুজে স্থির হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর চোখ খুলে হেমকান্তর দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ ও গভীর এক দৃষ্টি। আস্তে করে বলল, না তো।
ঠিক বলছ, মনু?
রঙ্গময়ি হাসল। বলল, তুমি কি অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিলে?
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, না। তবে কিছু লোক অন্য কথা বলে।
তাদের চেয়ে আমাকে তোমার ভাল জানবার কথা।
আমি তো তাই মনে করি। তবু কেন যে লোকের অদ্ভুত সব সন্দেহ!
কী সন্দেহ?
সচ্চিদানন্দ একটা চিঠি লিখেছিল। তাতে কিছু অদ্ভুত কথা ছিল তোমাকে নিয়ে।
রঙ্গময়ি মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, কী কথা?
সেটা তোমাকে বলা যায় না।
কেন বলা যায় না? আমাকে নিয়েই যখন কথা তখন আমার জানা উচিত।
সচ্চিদানন্দটা পাগল।
রঙ্গময়ি হেসে বলল, সচ্চিদানন্দবাবুর মতো ঘড়েল লোক যদি পাগল হয় তবে দুনিয়ায় সবাই পাগল। কী লিখেছে বলো না। কারও প্রতি আমার দুর্বলতা আছে বুঝি?
সেরকমই।
লোকটা কে?
হেমকান্ত বিব্রত হয়ে বলেন, সেটাও উদ্ভট। লোকটা নাকি আমিই।
বটে।–রঙ্গময়ি চোখ পাকাল। তারপর হঠাৎ হেসে ফেলে বলল, চিঠিটা চুরি করে আমিও পড়েছি।
পড়েছ! ওঃ। তা হলে—
রঙ্গময়ি ক্লান্ত, তবু শান্ত স্বরেই বলল, কথাটা উদ্ভট কেন হবে? তোমার বিয়ের পর আমি কি তোমাকে কম জ্বালিয়েছি?
হেমকান্ত হঠাৎ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলেন। বললেন, সে তো ছেলেমানুষি। কাফ লাভ।
রঙ্গময়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই হবে হয়তো। এই কথাটা বলতে তোমাকে এত ভনিতা করতে হল কেন বলো তো!
০১৪. ভোটে জিতে কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রী হয়েছেন
র আলো
ভোটে জিতে কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রী হয়েছেন। বাড়ির আবহাওয়াটা খুবই ভাল। ফুরফুরে একটা আনন্দের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে সবসময়ে। সেই আনন্দটা রেমিকেও ছোঁয়। এমন এক বাড়ির সে বউ, যে বাড়িটা সর্বসাধারণের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এ বাড়ির লোককে সম্ভ্রম এবং খাতির করে। কৃষ্ণকান্ত এলেবেলে মন্ত্রী নন। বহুদিন ধরেই এক নাগাড়ে তিনি বেশ কয়েকটা ভারী দফতর চালিয়েছেন। তার সুনাম এবং প্রতিষ্ঠা নিখাদ। অতীতটাও স্বর্ণগর্ভ। স্বদেশি আমলে মার খেয়েছেন, জেল খেটেছেন, কৃচ্ছসাধনও কিছু কম করেননি। এখনও অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করেন। মোেটা খদ্দরের ধুতি, সাধারণ পাঞ্জাবি পরেন, সামান্য অনাড়ম্বর খাবার খান, কম ঘুমোন। মোটামুটি একটা গাঁধীবাদী গন্ধ আছে তাকে ঘিরে। শুধু মেজাজটা কিছু চড়া, প্রতাপ সাংঘাতিক।
একদিন রেমিকে ডেকে বললেন, রামছাগলটা আবার চাকরি ছেড়েছে জানো?
রেমি জানত না। মাথা নিচু করে রইল।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, আটশো টাকা মাইনের চাকরি। এ বাজারে কিছু কম নয়। কেন ছাড়ল তা তোমাকে বলেছে?
উনি আমাকে কিছু বলেন না।
বলার পাত্র নয়। তোমাকে মানুষ বলে জ্ঞান করে না। আমাকেই করে না তো তুমি! ছাগলটাকে জিজ্ঞেস কোরো তো কেন ছাড়ল।
করব।
কৃষ্ণকান্ত একটু ভেবে বললেন, তোমাকে হয়তো বলবে না। তবে আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। চাকরিটা ছিল একটা প্রাইভেট ফার্মে। আমার চেনা ফার্ম। বোধহয় আমার সঙ্গে খাতির রাখতেই ওরা ছাগলটাকে ডেকে নিয়ে চাকরি দিয়েছিল। সেটাতে বোধহয় বাবুর অপমান হয়ে থাকবে। বাপের খাতিরে ওর মতো লাটসাহেব চাকরি করবে কেন! কিন্তু বউমা, আমি বুঝি না ছাগলটার কোয়ালিফিকেশনটাই বা কী যে খাতির ছাড়া আটশো টাকা মাইনের চাকরি জোগাড় করবে। ওকে একথাটাও জিজ্ঞেস কোরো।
রেমি মাথা নত করেই ছিল। জবাব দিল না। সে জানে, ধ্রুবর চাকরি ছাড়াটা এমন কিছু দারুণ ঘটনা নয়। এর আগেও কয়েকবার ছেড়েছে। আবার চাকরি পেয়েও গেছে। না পেলেও তো ক্ষতি নেই। ধ্রুবর রোজগারের পয়সা এ বাড়ির কেউ হেঁয়ওনি, এমনকী রেমি পর্যন্ত না। মাইনের টাকায় সে কী করে তা কেউ জানেও না, খবরও নেয় না।
কৃষ্ণকান্ত কিন্তু উত্তেজিত গলায় বললেন, চিরটা কাল এরকম যাবে না, বুঝলে বউমা? আমরা যৌবনে কেবিয়ার তৈরির কথা ভাবতাম না ঠিকই। কিন্তু তখন আমাদের সামনে একটা পজিটিভ লক্ষ্যবস্তু ছিল। দেশকে স্বাধীন করতে হবে। কিন্তু এখনকার ইয়ংগার জেনারেশনের সামনে ওরকম কিছু তো নেই। ওই গর্ভস্রাবটার তো আরও নেই। সামনে একটা পলিটিক্যাল ক্রাইসিস আসছে। চিরকাল তো আমি ক্ষমতায় থাকব না। মরতেও একদিন হবে। তখন ওর গতিটা হবে কী?
রেমি একথার জবাব দিল না। ইদানীং ধ্রুবর সঙ্গে তার সম্পর্কটা ভালই যাচ্ছিল। ধ্রুব অবশ্য বউ নিয়ে সিনেমায় যাওয়া বা রেস্টুরেন্টে খাওয়া ইত্যাদি হালকা পলকা ব্যাপারে নেই। প্রেমে গদ গদ ভাবেরও তার অভাব। উপরন্তু সে কমপ্লিমেন্ট দিতে জানে না। কোনওদিন রেমিকে সে বলেনি, বাঃ, তুমি তো খুব সুন্দর! কিন্তু রেমি অতটা আশাও করে না ধ্রুবর কাছ থেকে। ধ্রুব যে রোজ বাড়ি ফেরে, তার সঙ্গে স্বাভাবিক দু-চারটে কথাবার্তা কয় এবং এক বিছানায় শোয় সেইটেই যথেষ্ট বলে ধরে নিয়েছে রেমি। এর চেয়ে বেশি ভালবাসা প্রকাশের ক্ষমতাই ধ্রুবর নেই। রেমি মনে মনে ভগবানকে বলে, এটুকু বজায় থাকলেই যথেষ্ট। আমি আর বেশি চাই না। সুতরাং ধ্রুবর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনায় সে স্বামীর ওপর একটুও চটল না। সে জানে, কারও অধীনে কাজ করা বর পক্ষে শক্ত। অন্যে হুকুম করবে আর ধ্রুব তা তামিল করে যাবে এমনটা তার সম্পর্কে যেন কল্পনাই করা যায় না।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, শোনো মা, ওর সঙ্গে তোমারও ভবিষ্যৎ জড়ানো। ওর কেরিয়ারটা তৈরির ভার তুমিও একটু নাও। ওকে বোঝাও, শাসন করো।
রেমি বলল, আপনি ভাবছেন কেন? একটা কিছু ঠিক করবে।
সেটা আর কবে হবে? চাকরি করতে যদি না চায়, ব্যাবসা করুক। কিন্তু সেটাও কি করবে? টাকা হাতে পেলেই ফুঁকে দিয়ে বসে থাকবে। বাপের হোটেলে থাকে বলে টের পায় না কত ধানে কত চাল। কিন্তু দেশ কালের অবস্থা তত সুবিধের নয়। ওকে একটু বুঝিয়ে বোলো।
একথাটা একটু বিঁধল রেমিকে। ধ্রুব বাপের হোটেলে খায় বটে, কিন্তু সে আরও অনেকেই খায়। কথাটা শ্বশুরমশাই রেমির সামনে না বললেও পারতেন।
ধ্রুব কয়েকদিন যাবৎ মদ খাচ্ছে না। সেদিনও ধ্রুবকে রাত্রি স্বাভাবিক অবস্থায় পেয়ে গেল রেমি। বিছানায় শুয়ে একটা অর্থনীতির বই পড়ছিল। কয়েকদিন যাবৎ-ই অখণ্ড মনোযোগে বইটা পড়ছে। থার্ড ওয়ার্ল্ড ইকনমি।
রেমি বইটা কেড়ে নিয়ে পাশে বসে বলল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
ধ্রুব বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করল না। বলল, মেয়েদের অত কী বলার থাকে বলে তো!
আজকের কথাটা ইমপর্ট্যান্ট।
কোন কথাটা ইমপর্ট্যান্ট নয় তোমার?
বাবা আজ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
ডেকে পাঠানোর কী? তুমি তো সবসময়েই শ্বশুরের আশেপাশে পোষা বেড়ালের মতো ঘুরঘুর করছ বাবা।
তা করছি। তবু আজ ডেকে কয়েকটা কথা বললেন তোমার সম্পর্কে।
ওঃ হ্যাঁ, কথা একটা বলার আছে বটে। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।
কিন্তু সেটা আমাকে জানাওনি। অথচ আমি তোমার স্ত্রী।
চাকরি ছাড়লে স্ত্রীকে বলার একটা সাংবিধানিক নিয়ম আছে বোধহয়!
আছে। আমি জানতাম না।
তুমি অনেক কিছুই জানো না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আমাকে যখন বিয়ে করেছ, তখন আমারও ইচ্ছে করে স্বামীর রোজগারে খেতে পরতে। ইচ্ছেটা কি অন্যায়?
অন্যায় তো বটেই। তোমাকে আমি আজও বিয়ে করিনি। তোমার শ্বশুর আমার সঙ্গে তোমাকে জুটিয়ে দিয়েছেন। খাওয়া পরার ব্যাপারটা ওঁর সঙ্গেই ফয়সালা করে নাও গো
তোমার মুড পালটে যাচ্ছে।
ধ্রুব হেসে বলল, না। আমি ভাল মুডে আছি। চাকরি না থাকলে আমি সব সময়েই ভাল মুডে থাকি।
চাকরি ছাড়লে কেন?
আমার ভাল লাগে না। আমাদের বংশে কেউ কখনও চাকরি করেনি। ওটা আমার ধাতে নেই।
তুমি যে বাপের হোটেলে খাও তা নিয়ে শ্বশুরমশাই আজ একটু খোটা দিলেন। সেটা আমার ভাল লাগেনি।
সত্যকে সহ্য করাই তো ভাল।
কেন করব উপায় থাকতে?
উপায়টা কী?
তোমাকে রোজগার করতে হবে।
খামোকা রোজগার করে কী লাভ? বাবার মেলা টাকা। আমরা কভাই ছাড়া খাবে কে?
তবু সেটা বাবার টাকা, তোমার তো নয়।
বাবারও পুরোটা নয়। বলা ভাল, পূর্বপুরুষদের টাকা। তাতে বাবারও যা অধিকার আমাদেরও তাই।
সেটা উনি যখন থাকবেন না তখন দেখা যাবে। আমার স্বামী যে অক্ষম নয় আমি সেটা প্রমাণ করতে চাই।
শ্বশুরের অপমানের শোধ নেবে নাকি?
যদি বলি তাই?
লোকটা ঝানু পলিটিসিয়ান। অপমান গায়ে মাখে না। তুমি যে শোধ নিয়েছ তা হয়তো বুঝতেই পারবে না।
বোঝাতে চাইও না। আমি ওঁকে আর অপমান করার সুযোগ দিতে চাই না।
আমি চাকরি বা রোজগার করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?
খানিকটা যাবে।
কী ভাবে?
আমরা আলাদা বাসা করে সংসার পাতব।
ধ্রুব কথাটা শুনে হঠাৎ উঠে বসল। রেমিকে দুহাতে ধরে স্থির দৃষ্টিতে মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে মৃদু একটু হেসে বলল, আমি একথাটাই তোমার মুখে শুনব বলে আশা করছিলাম। কিন্তু একথা আর কখনও উচ্চারণ কোরো না।
ধ্রুবর এই কথায় একটু ঘাবড়ে গেল রেমি। বলল, কেন?
আমাদের পরিবারে বাপ এবং ছেলের ভিন্ন হওয়ার প্রথা এখনও চালু হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে একদিন হবে। কিন্তু তুমি সেটা শুরু কোরো না।
তা হলে কী করে প্রমাণ হবে যে, তুমি ওঁর ওপর নির্ভরশীল নও?
কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী প্রমাণ চাইছে না। তুমি ভুল করছ। বাপের হোটেলে খাওয়া নিয়ে খোঁটা দেওয়াটা একটা মৃদু প্রোভোকেশন মাত্র। আমি আত্মনির্ভরশীল হলেই কৃষ্ণকান্তবাবু খুশি হবেন তা নয়। বরং উনি চান যে, আমি ওঁরই হাত থেকে রোজ ল্যাজ নেড়ে নেড়ে ভুক্তাবশেষ গ্রহণ করি।
ছিঃ, ও কী বলছ?
ঠিকই বলছি। তুমি লোকটাকে চেনো না।
রেমি একটু চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে, তা হলে তুমি রোজগার করে ওঁর হাতে প্রতি মাসে টাকা দাও।
কত টাকা দেব?
যতই হোক। পাঁচশো-সাতশো।
তোমার শ্বশুর সেটা হাত পেতে নেবে?
নেবেন না কেন?
সেটা জিজ্ঞাসা করে এসো।
জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? বাপ কি ছেলের টাকা নেয় না?
কৃষ্ণকান্ত কি তেমন বাপ?
নেবেন না বলছ?
হয়তো নেবে, তবে নিজে হাত পেতে নেবে না। হয়তো কোনও চাকরকে ডেকে বলবে, ওরে টাকাটা তোর কাছে রেখে দে তো।
যাঃ, শ্বশুরমশাই মোটেই ওরকম নন।
হবে হয়তো। আমি ভদ্রলোক সম্পর্কে খুব ভাল জানি না।
ইয়ারকি হচ্ছে?
বাস্তবিকই জানি না, আমার লোকটা সম্পর্কে একটু ধাঁধা আছে।
কীরকম ধাঁধা?
ধরো, লোকটা একসময়ে স্বদেশি করত। তাই না?
তা তো বটেই।
বেশ আদর্শবাদী লোক ছিল। তাই না?
এখনও আছেন।
আহা, এখনকার কথা ছাড়ো।
ঠিক আছে, বলো।
লোকটার জ্যাঠা সন্ন্যাসী হয়ে যায়। কাকা স্বদেশি করতে করতে খুন হয় বা দুর্ঘটনায় মারা যায়। ঠিক তো?
তাই তো শুনেছি।
সুতরাং লোকটার ভিতরে সন্ন্যাস এবং স্বদেশিয়ানার একটা অ্যাডমিকশ্চারও ঘটেছে। স্বীকার করো?
না হয় করলাম।
কিন্তু লোকটা এখন এক নম্বরের ধাপ্পাবাজ, মিথ্যেবাদী এবং কেরিয়ারিস্ট।
আবার?
ধ্রুব রেমির হাত নিয়ে খেলা করতে করতে বলল, তোমার বয়স কত?
কেন, তুমি জানো না?
মেয়েদের বয়স তারা নিজেরাই মনে রাখতে চায় না। সে যাক গে। তুমি খুব কম বয়সি বোকা একটি মেয়ে।
না হয় হলাম।
এ বয়সে একজন দেশবিখ্যাত নেতার মুখোমুখি হলে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। চোখ ধাধিয়ে যায়।
আমার কি তাই হয়েছে?
হয়েছে। একটু বেশি মাত্রায় হয়েছে। যতক্ষণ ওই ধাঁধানো ভাবটা থাকবে ততক্ষণ লোকটার আসল চেহারা তোমার নজরে পড়বে না।
রেমি অভিমানভরে বলল, তুমি ঠিক বলছ না গো। শ্বশুরমশাই কত সহজ সরলভাবে থাকেন, একটুও বাবুগিরি নেই, আরাম আয়েস নেই—
ঠিক কথা। লোকটার সপক্ষে পজিটিভ পয়েন্টও অনেক আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে লোকটা সম্ভবত চরিত্রবানই ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই লোকটা চরিত্র হারাচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে অবশ্য।
পলিটিকস করতে গেলে ওরকম একটু-আধটু হয়।
ধ্রুব নীরবে মাথা নাড়ল। তারপর অন্যমনস্ক চোখে ঘরের আলোটার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, তুমি কথাটা ভেবে বলোনি, কিন্তু খুব ঠিক কথা বলেছ।
কোন কথাটা?
এই যে বললে পলিটিকস্ করতে গেলে অমন একটু-আধটু করতে হয়।
হয়ই তো।
আমি তো সেটা মেনেই নিয়েছি। কথাটা খুবই সত্যি। এদেশে পলিটিকস মানেই ওইসব। মিথ্যে কথা, ফেরেববাজি, ধাপ্পা এবং কেরিয়ার। চলো, কাল তোমাকে বিধানসভায় নিয়ে যাব। একটু দেখে আসবে, শ্রদ্ধেয় এম এল এ আর মন্ত্রীরা সেখানে বসে কেমন খেয়োখেয়ি করেন।
আমার দেখে দরকার নেই।
দরকার আছে। তোমার শ্বশুর কীরকম দেখোদ্ধার করছেন তার একটা আঁচ পাওয়া তোমার দরকার।
আমার চোখে শ্বশুরমশাইকে ছোট করে দিয়ে তোমার কী লাভ?
ধ্রুব গভীর এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে স্নেহভরে বলল, তুমি কি বিশ্বাস করো কৃষ্ণকান্তকে কালিমালেপন করায় আমার খুব সুখ?
রেমি ধ্রুবর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, তবে সব সময় ওঁর সম্পর্কে ওরকম বলো কেন?
লাভ-হেট রিলেশন কাকে বলে জানো?
কথাটা শুনেছি। মানে জানি না।
মানে আমিও ভাল জানতাম না। কিন্তু কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখন বোধহয় ওই লাভ-হেট।
তার মানে?
আমি যখন কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীকে বাবা বলে ভাববার চেষ্টা করি তখন কিছুতেই মন্ত্রী কৃষ্ণকান্তর ছবি চোখের সামনে আসে না।
তবে কী ছবি আসে?
চল্লিশ দশকের গোড়ায় জেলখানায় বসে এক কৃষ্ণকান্ত খুব মলিন বিকেলের আলোয় লাল কাগজে পেনসিল দিয়ে তার বিরহিনী বউকে চিঠি লিখছে, এরকম একটা লোককে মনে পড়ে। কিংবা মনে পড়ে একটা লোক–যাক গে, ওসব বলে লাভ নেই।
রেমির চোখ ছলছল করছিল। বলল, উনি খুব কষ্ট পেয়েছেন এককালে। না গো?
ধ্রুব হেসে মাথা নেড়ে বলল, কষ্ট কীসের? স্কোপ পেলে আমিও ওরকম রোমান্টিক কষ্ট করতে রাজি। কিন্তু আমরা তো স্কোপই পেলাম না রেমি।
পেলে কী করতে?
ওঃ, সে অনেক কিছু করতাম। বোমা মের ফাঁসির দড়িতে হাসতে হাসতে মরতাম। তার আগে গীতা পাঠ করতাম। গান গাইতাম, হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী। কিংবা দ্বীপান্তরে চলে যেতাম গোল কয়েক ইংরেজকে নিকেশ করে।
খুব বকুনি! সাহস জানা আছে।
কেন, আমি কি খুব ভেড়ুয়া?
তা বলছি না।
তবে কী বলতে চাইছ?
তুমি কোনও ব্যাপারেই সিরিয়াস নও।
আমি ভীষণ সিরিয়াস রেমি। আমি যদি স্বদেশি আমলে জন্ম নিতাম তা হলে কৃষ্ণকান্তর মতো স্বদেশি করতাম না।
কী করতে?
অন্যরকম কিছু। ভারতবর্ষে স্বদেশি আমলটাই ছিল আবেগসর্বস্ব। আবেগ জিনিসটা ক্ষণস্থায়ি। চট করে কেটে যায়। কৃষ্ণকান্তর অবস্থা দেখছ না? স্বদেশি জ্বর যেই ছেড়ে গেল, দেশ যেই স্বাধীন হল, অমনি কোমরে কাপড়ে বেঁধে স্বদেশি সার্টিফিকেটখানা বুকে লটকে কেরিয়ার তৈরি করতে নেমে পড়েছে। সেই কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে যদি এই কৃষ্ণকান্তর আজ দেখা হয়ে যায় তা হলে দুজনের মধ্যে তুমুল মারপিট লেগে যাবে।
রেমি হেসে গড়িয়ে পড়ল, কী যে বলো না!
সেইজন্যই বলছিলাম, মা যা ছিলেন এবং মা যা হইয়াছেন তা দেখতে চলো অ্যাসেমব্লিতে যাই। গ্যালারি থেকে দেখবে নীচের এরেনায় দুদল লোক দুদিকে বসে কেমন গলা ছেড়ে ঝগড়া করছে। কলেজের ডিবেটিংও এর চেয়ে অনেক ভাল। ওই কুয়োর মধ্যে যে তোতি, রেষারেষি, ঠেলাঠেলি চলছে তাই থেকে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে এমন কথা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
তার জন্য তো শ্বশুরমশাই দায়ি নন।
না। তবে তিনি যদি সৎ হতেন তবে ওই কুম্ভীপাকে গিয়ে ঢুকতেন না। স্বাধীন ভারতের পলিটিকস সভয়ে পরিহার করে ভদ্রলোকের মতো জীবনযাপন করতে পারতেন।
যারা পলিটিকস করে তারা ভদ্রলোক নয়?
কে বলল নয়? তা বলিনি। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে অনেকেই ভদ্রলোক। ভাল এবং সৎ লোকেরও অভাব নেই। কিন্তু সেটুকু তাদের নন-পলিটিক্যাল একজিসটেন্স।
আমি আর এসব শুনতে চাই না। এখন আমাকে আদর করো।
আমার মেজাজটা চটকে দিয়ে এখন আদর চাইছ?
মেজাজ কখন চটকালাম?–রেমি চোখ কপালে তুলল।
এই যে এতক্ষণ বকালে!
তুমিই বকলে।
না, তুমিই বকালে। কৃষ্ণকান্তর প্রসঙ্গ পারতপক্ষে আমার কাছে তুলো না।
আচ্ছা, ঘাট মানছি।
শোনো।
বলো।
তোমার শ্বশুরকে বলে দিয়ে, আমি কেরিয়ারিস্ট নই। নিজের জীবন কীভাবে যাপন করব সেটাও ঠিক করব আমিই। উনি যেন সেটা নিয়ে চিন্তা না করেন।
ও বাবা, ওসব আমি বলতে পারব না।
তা হলে আমিই বলব।
দোহাই, পায়ে পড়ি। বোলো না। উনি রাগী মানুষ।
আমিও রাগী।
বেশ, রাগটা আমার ওপর দেখাও। ওঁর ওপর নয়।
তোমার ভয়টা কীসের?
তোমাদের যদি ঝগড়া হয়?
হোক না।
না গো। পায়ে পড়ি।
তুমি খুব পায়ে পড়তে শিখেছ তো! কার কাছ থেকে শিখলে?
ঠেকে শিখেছি।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, এটাও পলিটিকস নয় তো? এই পায়ে পড়াটা?
তুমি এক নম্বরের—
কী?
বলব না। আমাকে এবার একটু আদর করে। একটুখানি।
ধ্রুব সে কথায় কর্ণপাত করল না। উঠে পায়চারি করতে করতে বলল, আজ আমার ঘুম আসবে। একদম ঘুম আসবে না।
পরদিন থেকেই ধ্রুব আবার বেহেড। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি পাত্তা নেই। কোনওদিন নিজেই ফেরে, কোনওদিন পুলিশ পৌঁছে দিয়ে যায়। প্রায় দিনই বেহুশ অবস্থায় ফেরে।
কেঁদে ভাসাতে লাগল রেমি।
সেই দুঃসহ দুর্দিনে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হল সমীর।
০১৫. ঝিমঝিম করে ভরা দুপুর
বাইরে ঝিমঝিম করে ভরা দুপুর। ভারী নির্জন, নিরিবিলি, অথচ রোদে ঝলমলে। কুয়াশা কেটে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। উত্তরে অতিকায় মহিষের মতো গারো পাহাড় পর্যন্ত। ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে গলন্ত রুপো এসে মেশে। ঝিরঝির করে অবিরল কথা বলে মহানিম। মস্ত মস্ত ঘরের ঘুলঘুলি, বারান্দার ওপরের কড়িবরগায় নানান জাতের হাজারও পায়রা নড়াচড়া করে আর ডেকে ওঠে। ভরন্ত দুপুরে পায়রার গদগদ স্বরের ডাক এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করে।
শব্দের কি কোনও আকার আছে? প্রশ্নটা মাথায় আসে, কিন্তু জবাবটা ভেবে পান না হেমকান্ত। শব্দ সম্ভবত নিরাকার। তবু হেমকান্তর মন বলে, ওই পায়রার বুকুম বুকুম শব্দ, ওর আকার গোল। তুলোর বলের মতো। স্টিমারের বাঁশির শব্দকে কি কখনও তার সরু ও দীর্ঘ আকারবিশিষ্ট বলে মনে হয়নি? সেতারের ঝনৎকার যেন ফুলঝুরির বহুবর্ণ কেন্দ্রাতিগ অগ্নিবিন্দু। মাঝে মাঝে এই দুপুরবেলা তার এসরাজ নিয়ে বসতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বসেন না। লজ্জা করে। এসরাজের শব্দ শুনলে ছেলে মেয়ে অবাক হবে। হয়তো দৌড়ে আসবে মনু। লোকটার হল কী? কিন্তু এসরাজের ছড় টানলেই তার চোখে ভেসে ওঠে তন্তুজালের মতো একটা আকৃতি। অদৃশ্য এক মাকড়সা অদ্ভুত দ্রুততায় বুনে চলেছে। জ্যোৎস্নারাত্রে বিরহী হরিপদ মাঝে মাঝে পুকুরের ঘাটলায় বসে আড়বাঁশি বাজায়। তখন দিঘল চিত্রময় এক সাপের আকার খেলা করে হেমকান্তর চোখের সামনে। এসবই ভ্রম হয়তো। শব্দের বাস্তবিক কোনও আকার নেই। কিন্তু হেমকান্তর ভিতরে তারা আকার পায়।
পায়রা গদগদ স্বরে কী বলে? ভালবাসার কথা? কিন্তু পশুপাখির আত্মজন নেই, সংসার নেই। নিতান্ত সংস্কারবশে তারা কখনও কখনও দলবদ্ধভাবে বাস করে বটে, কিন্তু সমাজ গড়তে জানে না। ভালবাসা তারা কোথায় পায়? তুলোর বলের মতো অবিরল তাদের বুকুম বুকুম ডাক এই নির্জন দুপুরে হেমকান্তর চারদিকে নেমে আসে। উড়ে উড়ে বেড়ায়। ভালবাসার কথা বলে।
দক্ষিণের সূর্য একফালি সাদা কার্পেট বিছিয়ে দেয় বারান্দায়। তাতে রেলিং-এর নকশাদার পুষ্পিত ছায়া। ভারী ভাল লাগে হেমকান্তর। ঘুলঘুলির রঙিন কাচ দিয়ে রঙের বিচ্ছুরণ ঘটে যায় দেয়ালে। পায়রার ময়ূরকণ্ঠী গায়ে খেলা করে রোদের বর্ণালি। চিকের ভিতর দিয়ে চেয়ে দেখেন, শতভাগে ভাগ হয়ে গেছে বাইরের দৃশ্যাবলী। কী চমৎকার!
এইসব শব্দ ও দৃশ্য, তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব ঘটনা হেমকান্তকে বার বার অবাক করে দেয়। বেঁচে থাকতে আজকাল তার দ্বিগুণ ভাল লাগে কেন? এই আলো ও ছায়া, এইসব অর্থহীন শব্দ, এসব মৃত্যুর পর কি পৌঁছাবে তার কাছে কোনওদিন? কে জানে কেমন সেই চির প্রদোষের জগৎ! কিংবা কে জানে মৃত্যুর পর হয়তো কোনও অস্তিত্বই থাকে না কারও। সে এক স্বপ্নহীন অনস্তিত্বের অন্তহীন ঘুম।
কখন নিজের অজান্তে চলে আসেন দোতলার বারান্দা ঘুরে ছেলেমেয়েদের মহলে। এমনিতে আসেন না। স্নেহশীলা দাসী ও বিশ্বাসী যত্নশীল চাকরদের পরিচর্যায় ছেলেমেয়েরা ভালই আছে, তিনি জানেন। নিজের উপস্থিতির গুরুভার কখনও ওদের ওপর চাপিয়ে দিতে তার ইচ্ছে হয় না।
একটু চমকে উঠে শোনেন, কৃষ্ণকান্ত বিশাখাকে বলছে, দেখ দিদি, আজ যদি দুপুরে ঘুমোই তো গোরু খাই।
গোরুই তো খাস। কালও ঘুমিয়েছিস। টাস্ক করেছিলি মাস্টারমশাইয়ের?
কাল? ওঃ, রাত জাগতে হয়েছিল না?
তোকে কে রাত জাগতে বলেছে?
কে আবার বলবে?
তবে জাগিস কেন?
মনুপিসি যে বলে শশীদা বাঁচবে না!
তাতে তোর কী?
আমি সেইজন্যই তো বসে থাকি।
কেন বসে থাকিস?
কম্পাউন্ডার কাকা বলে, মরার সময় আত্মাটা শরীরের কোন ফুটো দিয়ে বেরোবে তার ঠিক নেই। কারও নাক দিয়ে, কারও কান দিয়ে, কারও মুখ দিয়ে, কারও নাভি দিয়ে, আবার গুহ্যদ্বার দিয়েও বেরোয়।
কী অসভ্য রে! ছিঃ ছিঃ ভাই! দাঁড়া, মনুপিসিকে বলব।
বাঃ, কম্পাউন্ডার কাকা বলে যে আত্মাটা ধোঁয়ার মতো জিনিস। এক বিঘত লম্বা। সুট করে বেরিয়ে আসে। আমি সেইটে দেখার জন্য বসে থাকি। শশীদার আত্মা কোথা দিয়ে বেরোবে জানিস?
আমি জানব কী করে?
ব্ৰহ্মরন্ধ্র দিয়ে। মহাপুরুষের আত্মা ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে বেরোয়।
তোর শশীদা কি মহাপুরুষ নাকি?
শশীদা স্বদেশি না।
তাতে কী?
স্বদেশিরা তো আর যা তা লোক নয়। ইংরেজ মাবে। শশীদা এক পাদ্রিকে মেরেছে জানিস? বোমা দিয়ে।
খুব বীরত্বের কাজ করেছে, না? বাবা শুনলে দেবেখন তোমাকে। স্বদেশিদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে নেই।
কৃষ্ণকান্ত একটু যেন অবাক হয়ে বলে, বাবা স্বদেশিদের পছন্দ করে না?
একদম না। আমরা ইংরেজদের পক্ষে।
তবে বাবা শশীদাকে বাড়িতে থাকতে দিল কেন?
মোটেই থাকতে দেয়নি। আটক রেখেছিল। পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে।
তবে এখনও দেয়নি কেন?
লোকটার অসুখ করল বলে।
যদি শশীদা সেরে যায় তা হলে দেবে?
নিশ্চয়ই দেবে। দেওয়াই উচিত।
কৃষ্ণকান্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, তা হলে শশীদার মরাই ভাল।
হেমকান্ত খুবই অবাক হলেন। তাঁকে ইংরেজের সমর্থক ও স্বদেশিদের বিরোধী বলে কবে চিহ্নিত করা হল এবং কেন, তা তিনি জানেন না। একটু কৌতুক বোধ করলেন তিনি। শশিভূষণকে ধরিয়ে দেবেন বলে আটক রাখা হয়েছে একথাই বা কে রটাল? বিশাখাই বা এসব কথা জানল কোথা থেকে? তিনি তো মেয়েকে এসব প্রসঙ্গে কখনও কিছু বলেননি। স্বদেশিদের প্রতি বিশাখার এই জাতক্রোধের কারণটাও তাঁর অজানা। বরং উলটোটাই হওয়া উচিত ছিল। রঙ্গময়ির শাসনে এবং ছায়ায় ওরা মানুষ। রঙ্গময়ির নিজের একটু স্বদেশিপ্রীতি আছে। কাজেই বিশাখার এরকম উলটো মত হওয়ার কারণ নেই। তবে?
অনুচ্চ স্বরে তিনি ডাকলেন, কৃষ্ণ। বিশাখা।
ভাইবোনের ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ।
হেমকান্ত ঘরে ঢুকলেন।
কৃষ্ণ ও বিশাখা উঠে দাঁড়ায়। তটস্থ, সন্ত্রস্থ। মুখচোখে বিহ্বল ভাব। হেমকান্তর সামনে ওদের কেন যে এরকম একটা রূপান্তর হয়! তিনি তো শাসন তর্জন করেন না কখনও।
দুদিকে দুটি প্রকাণ্ড খাট। জানালা ঘেঁষে মস্ত ডেস্ক। তার ওপর সাজানো বইখাতা, দোয়াতদান ও কলম। একটি বিলিতি মহার্ঘ টেবিল ল্যাম্প। দুই খাটের পাশেই শ্বেতপাথরের তেপায়া। দেয়াল আলমারি, আয়না বসানো বার্মা সেগুনের আলমারি, কাচের বাক্সে সাজানো বিদেশি পুতুল আর খেলনা। দেয়ালে এয়ারগান।
চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন হেমকান্ত। এ ঘরে তিনি কদাচিৎ আসেন।
মেয়ের দিকে একটু সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি। লোকচরিত্র অনুধাবনের অভ্যাস তাঁর নেই। মুখশ্রী দেখে চরিত্রের ঠিকানা পাওয়া তার পক্ষে কঠিন। কিন্তু তার মেয়েটি যে ভারী শ্রীময়ি তাতে সন্দেহ নেই। তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়, বুক ঠান্ডা হয়।
কিন্তু মানুষের মুখশ্রীকে কি বিশ্বাস আছে? তার অন্য মেয়েরাও সুন্দরী। অপাপবিদ্ধ মুখশ্রী। কিন্তু তবু গোপনে মায়ের গয়না সরাতে তো তাদের বাধেনি। বিশাখা যে অন্যরকম হবে তা মনে করার কোনও কারণ নেই।
হেমকান্ত মেয়ের দিকে চেয়ে সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন, তুমি স্বদেশিদের পছন্দ করো না?
বিশাখা খুবই ঘাবড়ে গেছে। কী বলবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ মাথা নত করে নখ দেখতে লাগল। ব্রীড়ার সেই ভঙ্গিটুকুও ভারী অপরূপ।
মেয়েকে আর অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে ইচ্ছে হল না তার। মেয়েমাত্রই কিছুটা নির্বোধ, কুচুটে, পরশ্রীকাতর, ঈর্ষাপরায়ণ। তাদের দোষও নেই। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব গঠনে কোনও চেষ্টাও যে সমাজে নেই। দেশে সম্প্রতি একটা নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেটা ভাল কি মন্দ এবং কাজ কতদূর এগিয়েছে তা হেমকান্ত জানেন না। তবে তার বিশ্বাস স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষা দিয়ে কোনও লাভ নেই। তাদের মনের জানালাকপাট খুলে বাইরের উদার মুক্ত আলো-হাওয়ার পথটুকু অবারিত করে দিলেই যথেষ্ট। সি এ টি ক্যাট শেখার চেয়ে থানকুনিপাতার আরোগ্য গুণ জানাটা অনেক বেশি কার্যকরী শিক্ষা। লোকে বলে, এদেশের মেয়েরা ভারী সহনশীলা। কথাটা সত্যি বলে মনে হয় না হেমকান্তর। সহনশীলতা এক অনবদ্য গুণ, তা শিক্ষা করতে হয়। এদেশের মেয়েরা সয়। বটে, কিন্তু সে দায়ে পড়ে। ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহের আগুন ফুঁসতে থাকে, আর সে আগুন বেরোবার পথ পায় না বলেই অন্যবিধ রন্ধ্র খোঁজে। হেমকান্ত আজ একটু একটু টের পান, সুনয়নীর মধ্যেও সেই বিদ্রোহ ছিল। তাই আজ মেয়ের ওপর রাগ হল না হেমকান্তর। করুণা হল। ওকে তিনি কোনও শিক্ষাই দিতে পারেননি। শুধু জন্মসূত্রে পাওয়া সুন্দর মুখশ্রী ও ফরসা রংটুকুই ওর সম্বল।
বোধহয়! হ্যাঁ, বোধহয় কথাটা যোগ করে রাখা ভাল। কারণ বিশাখা তাঁর উরসজাত হলেও ওকে তো তিনি ভাল করে চেনেন না। সম্ভবত বিশাখা রঙ্গময়িকে অপছন্দ করে। আর তাই রঙ্গময়ির ঝোক যেদিকে, বিশাখার ঝোঁক ঠিক তার উলটোদিকে। নইলে স্বদেশির প্রতি অত আক্রোশ থাকার কথা ওর না। কিন্তু রঙ্গময়ির প্রতি ওর বিরাগের কারণটা কী? কারণ কি তিনি নিজেই?
ছেলের দিকে চেয়ে হেমকান্ত একটু স্বস্তি পেলেন। কৃষ্ণ তাঁকে দেখে তটস্থ বটে, কিন্তু ভীত নয়।
হেমকান্ত গাঢ়স্বরে প্রশ্ন করলেন, স্বদেশিদের তুমি পছন্দ করো?
কৃষ্ণ একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
হেমকান্ত বললেন, তুমি তোমার দিদির কাছে যা শুনেছ তা ঠিক নয়। আমি শশিভূষণকে ধরিয়ে দেব না। স্বদেশিদের প্রতিও আমার আক্রোশ নেই। ভয় পেয়ো না। বলো।
কৃষ্ণকান্ত হেসে মাথা নোয়াল। বলল, হ্যাঁ বাবা। ওরা খুব সাহসী।
হেমকান্ত কেমন যেন একটু নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। তাঁর আর কোনও ছেলেই স্বদেশিদের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। দেশে যেসব আন্দোলন হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা নির্বিকার। তিনি নিজেও তাই। তার এই ছেলেটি যদি স্বদেশ নিয়ে ভাবে তো ভাবুক।
হেমকান্ত বললেন, তোমার কাকা স্বদেশি করতেন। অবশ্য শশিভূষণের মতো ইংরেজ মারেনি। জানো বোধহয়?
জানি। কাকাকে ইংরেজরা মেরেছিল।
বিস্মিত হেমকান্ত বললেন, একথা কে বলল?
মনুপিসি।
কথাটা সম্ভবত সত্য নয়। তবু প্রতিবাদ করলেন না হেমকান্ত। শুধু বললেন, হতে পারে। তবে কে মেরেছিল বা আদৌ মেরেছিল কি না তা এখনও আমরা সঠিক জানি না। একটা নৌকাড়ুবি ঘটেছিল, এটাই জানা আছে।
মনুপিসি বলে, কাকাকে মারার পর প্রমাণ লোপ করতে নৌকোটা ড়ুবিয়ে দেওয়া হয়।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ ছেলের মনের মধ্যে কিছু জিনিস শিকড় গেড়ে বসেছে। তা সহজে ওপড়ানো যাবে না। বোধহয় বীজটা ছড়াচ্ছে মনুই। তবু অসন্তুষ্ট হলেন না হেমকান্ত। আকস্মিক এক দুর্বলতাবশে ছেলের মাথায় একবার হাত রাখলেন। স্নেহের স্বরে বললেন, পড়াশোনা হচ্ছে তো ঠিকমতো?
আমি ফার্স্ট হই বাবা।
হও?–হেমকান্ত বিস্মিত। বলেন, কই, আমাকে কেউ বলেনি তো! এবার বাৎসরিক পরীক্ষায় হয়েছি। বলোনি কেন? দিদি জানে।
হেমকান্ত হাসলেন। ছেলের পরীক্ষার ফলটুকু পর্যন্ত তার কানে কেউ পৌঁছে দেয় না। নির্বাসা কি একেই বলে না? এই নির্বাসন দণ্ডের দাতা তিনিই, গ্রহীতাও তিনিই।
কিন্তু আর নয়। বাইরে রোদ ম্লান হয়ে এল। একটু বাদেই কুঞ্জবনে এক অদ্ভুত ছায়া নামবে। ফার্ন জাতীয় গাছগুলির ছায়া আলপনার মতো পড়ে থাকবে ঘাসে। ভাঙা গাড়িটার পাদানিতে বসে চারদিকে এক নিবিড় রূপের রাজ্যে ড়ুবে যাবেন তিনি। সময় নেই।
হেমকান্ত ঘরে এসে পোশাক পরতে লাগলেন।
কিন্তু বাধা এল। একজন কর্মচারী এসে খবর দিয়ে গেল, স্বয়ং দাবোগা কাছারিঘরে অপেক্ষা করছেন। হেমকান্তর দর্শনপ্রার্থী।
হেমকান্ত বিরক্ত হলেন। একটু উদ্বেগও বোধ করতে লাগলেন। দারোগার আগমন কেন তা অনুমান করতে কষ্ট নেই। শশিভূষণ।
দারোগা রামকান্ত রায়ের সঙ্গে হেমকান্তর পরিচয় সামান্য। শুনেছেন লোকটা দুদে এবং প্রভুভক্ত।
হেমকান্ত কাছারিঘরে ঢুকতেই রামকান্ত তাঁর হ্যাটটা বগলে করে উঠে দাঁড়ালেন। বিশাল ভুঁড়িদার চেহারা। কাছারির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা তার ঘোড়াটিও বিশালদেহী এবং তেজি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ঠুকে নালের বিকট শব্দ করছে।
রামকান্ত বললেন, একটু বিরক্ত করতে এলাম, হেমবাবু। সরকারি কাজ।
বসুন।
রামকান্ত বললেন, বসা-টসা পরে। অনেকক্ষণ বসে আছি। একবার সেই ছেলেটিকে দেখতে চাই।
হেমকান্ত ন্যাকা নন। বুঝলেন। তবু একটু বিস্ময়ের ভান করে বললেন, কোন ছেলেটি?
শশিভূষণ। যে ছেলেটিকে বরিশালের পুলিশ খুঁজছে। খুনের মামলা।
হেমকান্তর উপস্থিত বুদ্ধি ভাল খেলে না। তিনি কী করবেন বুঝতে পারলেন না। শেষে হতাশার গলায় বললেন, তাকে আর দেখার কিছু নেই। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে।
তা জানি। তবু সরকারি কর্তব্য তো করতেই হবে। জানা দরকার এই ছেলেটিই সে কি না।
হলে কী করবেন?
রিমুভ করার মতো অবস্থা দেখলে পুলিশ গার্ডে হাসপাতালে ট্রান্সফার করতে হবে।
হেমকান্ত মৃদু স্বরে বললেন, বোধহয় তা সম্ভব নয়।
দেখা যাক। একটু অধৈর্যের ভাব প্রকাশ করলেন রামকান্ত। বললেন, আপনার বাড়ি সার্চ করার ওয়ারেন্ট আমার সঙ্গেই আছে। তবু আমি তা করিনি। আপনি মান্যগণ্য লোক, যা করার, আপনার অনুমতি নিয়েই করতে চাই।
হেমকান্ত বললেন, চলুন।
দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে রামকান্তকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে আজ নিজের ওপর একটু ঘৃণা হচ্ছিল হেমকান্তর। চিরকাল সুখের জীবনই কাটিয়েছেন তিনি। নির্বিকার, আত্মসুখী। নিজস্ব জগতেই তার বাস। বাইরে একটা অচেনা পৃথিবী আছে। সেখানে আছে অচেনা, অদ্ভুত চরিত্রের কিছু লোকজন। তাদের ভাল চেনেন না তিনি। এই শশিভূষণ সেই বাইরের দুনিয়ার লোক। কীই বা বয়স, তবু স্নেহের বন্ধন কেটে উধাও, বেরিয়ে পড়েছে। খুনও করেছে হয়তো। কাজটা ভাল না মন্দ তার বিচার ইতিহাস করবে। কিন্তু নিজের অস্তিত্বের একটা জানান তো দিতে পেরেছে। হেমকান্ত তা পেরে ওঠেননি।
বিছানায় শশিভূষণ শয়ান। অচৈতন্য। গালে এ কয়দিনে দাড়ি আরও কিছু বেড়েছে। শরীরটা বড়ই বিবর্ণ, শীর্ণ। মাথায় জলপটি দিচ্ছিল রঙ্গময়ি। তাঁদের দেখে উঠে দাঁড়াল।
রামকান্ত শশিভূষণের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে বললেন, আপনি রুগির কেউ হন?
না। দেখাশোনা করছি।
অবস্থা কেমন?
ভাল নয়।
একটু বাদে হাসপাতালের ডাক্তার এসে ওকে দেখবে। দুজন পুলিশ গার্ড থাকবে বাইরে।
রঙ্গময়ি একটু ক্লান্ত ও কটু গলায় বলল, রুগি কি পালাবে?
তা হয়তো নয়। তবু সাবধান হওয়া ভাল।
ডাক্তার বলে গেছে, রুগি বেশিক্ষণ নয়।
কোন ডাক্তার দেখছে?
তিনজন দেখছে।
তাদের স্টেটমেন্টও আমরা নেব। রুগির অবস্থা যদি সত্যিই খারাপ হয়ে থাকে তবে তার জন্য আপনারা কষ্ট পাবেন কেন? সরকারই ওর ভার নেবে।
সরকার ভার নেবে কেন?
শশিভূষণ সাসপেক্ট।
ক্লান্ত রঙ্গময়ি চুপ করে রইল।
হেমকান্ত মৃদুস্বরে জিজ্ঞাস করলেন, এই কি সেই?
রামকান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, হ্যাঁ।
হেমকান্ত একটা শ্বাস গোপন করলেন।
রামকান্ত বারান্দায় বেরিয়ে এসে বললেন, কীভাবে ছেলেটি আপনার বাড়িতে আশ্রয় পেল সে সম্পর্কে আপনি একটা স্টেটমেন্ট লিখে রাখবেন। দরকার হবে।
আমার স্টেটমেন্ট? কেন?
যাতে আপনাকে ঝামেলায় পড়তে না হয়।
দারোগা রামকান্ত বারবাড়িতে এসে দুজন সিপাইকে ইশারা করতেই তারা শশিভূষণের ঘরে থানা গাড়তে রওনা হয়ে গেল। রামকান্ত ঘোড়ায় ওঠার আগে হেমকান্তর দিকে চেয়ে বললেন, শশিভূষণের অবস্থা আমার কাছে খুব খারাপ বলে মনে হল না।
বলেন কী?–হেমকান্ত হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ডাক্তারও যে জবাব দিয়ে গেছে!
সে তো শুনলাম। কিন্তু মুমূর্ষ রুগি আমি কিন্তু কম দেখিনি।
আমরা কি মিথ্যে বলছি?–হেমকান্ত একটু রুষ্ট হয়ে বললেন।
তা বলিনি। এমনও হতে পারে ডাক্তাররা ঠিক বলছে না। সে যাই হোক, হাসপাতালের ডাক্তার এসে দেখলেই সব বোঝা যাবে। আমাদের এই কাজই করতে হয় হেমবাবু, মনটাও তাই কেমন সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেছে। কিন্তু মনে করবেন না। আচ্ছা ওই মহিলাটি কে? আপনার আত্মীয়া?
হ্যাঁ। ছেলেবেলা থেকেই এ বাড়িতে আছে।
ওঁকে আমার কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে, আপনি অনুমতি দিলে। তবে সে পরে হলেও হবে।
হেমকান্তর কেমন বিভ্রান্ত লাগছিল। তার সুরুচি ও সূক্ষ্ম অনুভূতির জীবনে এ যেন এক দৈত্যের হাত এসে মসিলেপন করতে লেগেছে। এ সব ওই বাইরের জগৎটা থেকে এসে হানা দেয়।
রামকান্ত রেকাবে পা রেখে ঘোড়ায় উঠলেন। তার দেহের ভারে ঘোড়াটা কেতরে গিয়ে আবার সোজা হল। রামকান্ত বললেন, স্টেটমেন্টটার কথা কিন্তু ভুলবেন না। দরকার মনে করলে আপনার
উকিলকে ডাকিয়ে তার পরামর্শ মতো লিখবেন। ফাঁকফোকর রাখবেন না।
রামকান্ত ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। সেই অশ্বক্ষুরধ্বনি একটা বিপদ-সংকেতের মতো বাজতে লাগল। ওঁর কথাগুলির মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল তাও টের পাচ্ছিলেন হেমকান্ত। কিন্তু কী করবেন? বরাবরই তিনি খানিকটা অসহায়। আজ আরও বেশি অসহায় লাগছিল। না, নিজের বিপদের কথা ভেবে নয়। আজ তিনি শশিভূষণের বিপদের কথা ভাবছিলেন? বোকা রঙ্গময়ি ওর
অসুখটাকে ফাঁপিয়ে ফুপিয়ে রটনা করেছিল বটে, কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
হেমকান্ত কাছারির খাটেই স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাথার ওপর মশার পাল উড়ছে উমমম একটা একটানা শব্দ করে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ব্রহ্মপুত্রের জলে মিশে যাচ্ছে গারো পাহাড়ের মহিষপ্রতিম ছায়া।
একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। সরকারি ডাক্তার তাড়াতাড়ি নেমে এলেন। কাছারির বারান্দায় চিত্ৰাপিতের মতো-কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছে। হেমকান্ত তাদের দিকে একটু ইশারা করে মুখ ফিরিয়ে কুঞ্জবনের দিকে এগোতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ ভূতের মতো বসে রইলেন ভাঙা গাড়ির পাদানিতে। অন্ধকার তাকে ঘেঁকে ধরল। হেঁকে ধরল মশা। শিশিরে ভিজতে লাগল পোশাক। জোনাকি পোকারা উড়তে লাগল চারদিকে পরির চোখের মতো। কিছুই তেমন ভাবতে পারছেন না হেমকান্ত। মাথাটা অস্থির, এলোমেলো।
তীব্র একটা টর্চের আলো সেই একাকিত্ব আর প্রস্তরীভূত অন্ধকারকে ছুরির ফলার মতো কেটে পায়ের কাছে এসে পড়ল।
আর্তনাদের মতো গলায় রঙ্গময়ি বলল, ওকে নিয়ে গেল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমকান্ত বললেন, তুমি বড় বোকা, মনু। অথচ তোমাকে আমি বরাবর বুদ্ধিমতী ভাবতাম।
টর্চটা নিবিয়ে রঙ্গময়ি কাছে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ আবার শান্ত শোনাল তার গলা, ঘরে যাও। ঠান্ডা লাগবে।
লাগুক। সেটা বড় কথা নয়। শশীর ফাঁসি হবে, তার কথা ভাবো।
আমাকে সকলের কথাই ভাবতে হয়। ওঠো। ঘরে চলো।
ঘর ভাল লাগছে না।
রঙ্গময়ি একটু চুপ করে থেকে বলল, শশী তো মরতেই চায়। বেঁচে থেকে আর কী করবে বলো? ওকে মরতে দাও।
আর আমি মরলে?
তুমি? মরলে এখনও যে একজনকে বিধবা হতে হয়। তার বড় জ্বালা।
০১৬. অচেনা গলা
রেমি এক সকালে টেলিফোন পেল। অচেনা গলা।
বউদি, বলুন তো আমি কে?
রেমি ভ্রু কুঁচকে বলল, কী করে বলব?
গলাটা চেনা লাগছে না?
টেলিফোনে গলা বোঝা যায় না।
এবার ওপাশ থেকে অচেনা কণ্ঠ বলল, কিন্তু ভয় হচ্ছে, পরিচয় দিলেও কি চিনতে পারবেন।
চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আমার স্মৃতিশক্তি খারাপ নয়।
আমি সমীর। মনে পড়ছে?
রেমি আবার ভ্রু কোঁচকায়। মনে তার পড়েছে ঠিকই, কিন্তু খুশি হয়নি। এমনিতে সমীরকে তার খাবাপ লাগেনি। বরং বেশিই ভাল লেগে গিয়েছিল। কিন্তু ছন্দার সঙ্গে সম্পর্কটার কথা টের পাওয়ার পর থেকেই মনটা কিছু বিরূপ হয়েছে।
রেমি বলল, কী খবর! কবে এলেন?
আমি প্রায়ই আসি। গত মাসেও এসে গেছি।
কই, যোগাযোগ করেননি তো!
সময় পাইনি। কলকাতায় আসি হাজারটা কাজ নিয়ে।
তাই বুঝি!
আপনি এখনও ছন্দা আর নন্দা কেমন আছে সেটুকুও জানতে চাননি।
রেমি ঠোঁট কামড়ায়। কথাটা মিথ্যেও নয়। শিলিগুড়িতে গিয়ে ওদের কত সহজে আপন করে নিয়েছিল, অথচ আজকাল মনেই পড়ে না। সে লজ্জা পেয়ে বলল, ওদের চিঠি দেব-দেব করছিলাম। আমারও হাজারটা ঝামেলায় সময় হচ্ছে না।
সময়ের অভাব হতেই পারে। মন্ত্রীর পুত্রবধূ।
যাঃ, শ্বশুর মন্ত্রী তো আমার কী?
মন্ত্রীর বাড়ির বেড়ালটাও পায়াভারী হয়।
পায়ারী তো আপনিই, কলকাতায় এসেও খবর নেন না।
নিই না ভয়ে। ভি আই পি লোক, পাত্তা দেন কি না দেন তার তত ঠিক নেই। টেলিফোনে গলা শুনেই তো বুঝতে পারছি খুব খুশি হননি।
বাড়িতে এসে দেখুন পাত্তা দিই কি না!
সমীর ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বলল, বাড়িতে যাব না, তবে আপনার সঙ্গে আমার একটা দরকার আছে বউদি।
রেমি ঠোঁট কামড়ে বলল, আচ্ছা, আপনি আমাকে তখন থেকে বউদি-বউদি করে যাচ্ছেন কেন বলুন তো! দার্জিলিং-এ তো দিব্যি নাম ধরে ডাকছিলেন!
ডেকেছিলাম নাকি?
কেন, মনে নেই?
সমীর হেসে বলে, আছে। কিন্তু তখন হয়তো নানা ঘটনায় লঘু-গুরু জ্ঞান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
জ্ঞানের নাড়ি তো বেশ টনটনে দেখছি। কী দরকার বলুন তো!
আছে। আজ বা কাল আপনার একটু সময় হবে?
কখন?
বিকেলের দিকে!
হতে পারে।
আমি নিউ কেনিলওয়ার্থ হোটেলে উঠেছি। জায়গাটা চেনেন?
চিনি। কেন?
আসতে পারবেন একা?
একা!
হ্যাঁ বউদি, কাউকে না জানিয়ে আসবেন।
রেমি একটু ইতস্তত করে বলল, এ বাড়ির মেয়ে-বউরা হুটহাট বেরোতে পারে না। শ্বশুরমশাই পছন্দ করেন না ওসব।
আমার দরকারটা খুব জরুরি।
আপনি তো এ বাড়িতেই আসতে পারেন।
না। পারি না।
কেন বলুন তো!
সমীর একটু চুপ থেকে বলল, আপনি আপনার শ্বশুরকে কতটা চেনেন জানি না। উনি কিন্তু ভীষণ ডেঞ্জারাস টাইপের লোক।
তাই নাকি? উনি কি আপনার ওপর চটে আছেন?
ঘটনাটা আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন!
কোন ঘটনা?
দার্জিলিং-এ আপনি একবার উত্তেজনার বশে আমাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। মনে আছে?
রেমি লজ্জা পেয়ে বলে, ধরেছিলাম নাকি?
ধরেছিলেন। এবং সেটা দেখতে পেয়েছিল লামা। তাকে ভোলেননি নিশ্চয়!
না, ভুলিনি।
আমি তখনই বলেছিলাম লামা ব্যাপারটা আপনার শ্বশুরকে রিপোর্ট করতে পারে।
হ্যাঁ, বলেছিলেন। লামা কি রিপোর্ট করেছে?
করেছে। কাকা একদিন আমাকে ডেকে কয়েকটা অপ্রিয় প্রশ্নও করেন। কৃষ্ণকান্তবাবু ব্যাপারটা ওঁকে জানিয়েছেন।
তাই আপনি এ বাড়িতে আসতে ভয় পাচ্ছেন?
ঠিক ভয় নয়। সংকোচ। কৃষ্ণকান্তবাবু হয়তো আমাকে খুব সুনজরে দেখবেন না।
রেমি একটু রাগের গলায় বলল, ওটা তো কাপুরুষতা। আপনি না এলেই বরং সন্দেহটা বাড়বে।
তা নয়। আমি তো কৃষ্ণকান্তবাবুর বাড়িতে বড় একটা যাই না। কাজেই এখন না গেলেও সন্দেহের কারণ নেই। গেলে বরং সন্দেহটাকে আরও খামোক খুঁচিয়ে তোলা হবে।
আপনি খুব হিসেবি লোক।
কমপ্লিমেন্টটা ভাল নয়। কিন্তু আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টটার কী হবে বলুন।
কেনিলওয়ার্থ হোটেল আমি চিনি। কখন যেতে হবে বলুন।
কাল বিকেল পাঁচটায়। আমি রিসেপশনে থাকব। আপনি কি নিজেদের গাড়িতে আসবেন?
আমাদের গাড়ি তো মোটে একটা। সেটা শ্বশুরমশাই ব্যবহার করেন। আমি যাব ট্যাকসিতে। কেন বলুন তো!
যাক বাঁচা গেল! আমি গাড়িটা অ্যাভয়েড করতে চাইছিলাম।
রেমি সন্দেহের গলায় বলে, এত গোপনীয়তা কীসের বলুন তো!
আপনি কি ভয় পাচ্ছেন বউদি? তেমন কিছু নয়।
ভয় তো আপনিই পাচ্ছেন মনে হচ্ছে।
আমার ভয়ের একটু কারণ আছে। প্লিজ, আমার সঙ্গে ফোনে আপনার কথা হল সেটা কাউকে বলবেন না।
না বললাম।
তা হলে কাল বিকেলে?
আচ্ছা।
পরদিন বিকেলে একটা ট্যাকসি করে যেতে যেতে রেমির মনে হল, আমি কেন যাচ্ছি? এই গোপনীয়তা, এই রহস্য সত্ত্বেও একটা হোটেলে একজন পরপুরুষের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা ঠিক নয়। তবু কেন যাচ্ছি? তার একটু ভয়-ভয় করছিল। আবার আগ্রহও বোধ করছিল সে। তার ঘটনাহীন একঘেয়ে জীবনে একটা কিছু অন্যরকম ঘটুক না একদিন।
হোটেলের রিসেপশনে সমীর অপেক্ষা করছিল। একটু কালো আর রোগা হয়ে গেছে। মুখে উদ্বেগের সুস্পষ্ট চিহ্ন।
বউদি।— বলে এগিয়ে এল সে।
রেমি খুব সেজে এসেছে। বিশুদ্ধ মুগার ওপর রেশমি বুটির দারুণ একখানা শাড়ি পরেছে সে। গায়ে রুপোর গয়নার একটা সেট। খুবই ভাল দেখাচ্ছে তাকে, সে জানে। কিন্তু সমীর তেমন মুগ্ধ হয়ে গেল না তো!
রেমি বলল, কী ব্যাপার বলুন তো!
ঘরে চলুন বলছি।
দোতলায় একটা বেশ কেতাদুরস্ত ঘরে তাকে নিয়ে গেল সমীর। কিন্তু ঘরে ঢুকেই থমকে গেল রেমি।
লন্ডভন্ড একটা মস্ত বিছানায় এলোচুলে, অবিন্যস্ত বদনে পড়ে আছে যে তাকে কষ্ট করে চিনতে হয়। সে ছন্দা। মুখ ফুলে আছে। চোখের কোলে জলের সুপষ্ট দাগ। কাজল আর লিপস্টিক লেপটে আছে মুখময়। এপাশ-ওপাশ করতে করতে এক নাগাড়ে উঃ বাবা উঃ বাবা করে যাচ্ছে ভাঙা রেকর্ডের মতো।
এ কী?–রেমি চেঁচিয়ে ওঠে।
ছন্দা কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে তাকে দেখল। তারপর হঠাৎ উঠে বসে কেঁদে ফেলল। আঁচল তুলে মুখে চাপা দিয়ে বলল, আমি পারব না। আমি পারব না।
কী পারবে না? বলে রেমি গিয়ে তাড়াতাড়ি ছন্দার পাশে বসে। তার কাঁধে হাত রেখে বলে, কী হয়েছে ছন্দা? তুমি এখানে কেন?
ছন্দা কাঁদছে। জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা নয়।
সমীর একটু অপ্রতিভ মুখে বলল, আমরা একটা কাণ্ড করে ফেলেছি বউদি।
রেমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারছিল। হোটেলের ঘরে এভাবে ছন্দা আর সমীর, এর একটাই মানে হয়। তার আজন্ম সংস্কার আর রুচিবোধে এমন অদ্ভুত আর ঘিনঘিনে লাগছিল ব্যাপারটা যে তা বলার নয়।
রেমি বলল, কী কাণ্ড সমীরবাবু? আপনি কি ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন?
না। ঠিক তা নয়। ছন্দার কলকাতায় আসার কথা ছিল। আমার সঙ্গেই।
তা হলে?
হোটেলে ওঠার কথা ছিল না।
উঠলেন কেন তবে? ছিঃ ছিঃ।
প্লিজ বউদি, ওরকম করবেন না।
তাতে ও আরও বিগড়ে যাবে।
বিগড়োবারই তো কথা।
দোষটা তো সবটাই আমার নয়। ওরও। ওকেই জিজ্ঞেস করুন। আমি আধ ঘণ্টার জন্য বাইরে যাচ্ছি।
সমীর বাইরে গিয়ে দরজা টেনে দিল।
স্তব্ধ ঘরে ছন্দার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠল রেমির কাছে। যান্ত্রিকভাবে সে ছন্দার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, কেঁদো না, ছন্দা। আমরা তো আছি। ভয় নেই।
ছন্দা মিনিট দশেক বাদে একটু শান্ত হল। মাথা নিচু করে বসে রইল চুপচাপ।
রেমি বলল, কী হয়েছে বলবে তো!
ওর দোষ নেই।
কী হয়েছে খুলে বলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছন্দা বলল, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সেই বিয়ের বাজার করতেই কলকাতায় আসা। সমীরদা ঠিক রাজি ছিল না। আমিই বললাম, চলো এই সুযোগ আর পাব না। দুজনে হোটেলে এসে উঠলাম।
তারপর?
তারপর থেকেই হঠাৎ কেমন ওলট-পালট লাগছে। মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক করিনি।
ঠোঁটকাটা রেমি বলেই ফেলল, কাজটা খুব খারাপ করেছ।
আমারও তাই মনে হচ্ছে। বাবা মা আত্মীয়রা কেউ আর আমার মুখদর্শন করবে না। আমি সেটা সহ্য করতে পারব না।
রেমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তোমরা কতদুর এগিয়েছিলে? এক ঘরে রাত কাটানো, এক বিছানায়…
আঃ, চুপ করে রেমি। আমার গা জ্বালা করছে। বোলো না। সবকিছুই হয়েছে। তবু আমি এসব থেকে আবার ফিরে যেতে চাই।
অত অস্থির হচ্ছ কেন? লোক জানাজানি তো হয়নি।
হয়েছে কি না জানি না। তবে আমাদের সল্ট লেকের বাড়িতে ওঠার কথা। সেখানে আমার এক বিধবা পিসি থাকে। বাবা নিশ্চয়ই টেলিফোনে খবর নিয়েছে।
রেমি কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তারপর বলল, দাঁড়াও। আমি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু সমীরবাবুকে বোঝনোর দায়িত্ব তোমার।
আমি কাউকে বোঝনোর দায়িত্ব নিতে পারব না। মাথা পাগল-পাগল লাগছে।
এত প্রেম হঠাৎ নিবে গেল কেন তা বুঝতে পারছিল না রেমি। তবে তার মনে হচ্ছিল, ছন্দার এসব অনুভূতি সত্য ও সঠিক।
সে দরজা খুলে বাইরে বেরোল। সমীর দাঁড়িয়ে আছে করিডরে। মুখচোখ অপ্রসন্ন।
রেমি তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কী করতে চান?
সমীরের চোখ জ্বলে উঠল হঠাৎ। বলল, ও এখন ন্যাকা সাজছে।
তার মানে?
তার মানে ও কি আপনাকে কিছু বলেনি?
একটু বলেছে।
আমার সমস্ত কেরিয়ার নষ্ট হয়ে গেল। কাকা এই ঘটনার পর অবশ্যই আমাকে আর প্রশ্রয় দেবে না। কিন্তু সে প্রবলেম ছন্দার নেই।
প্রবলেম আপনাদের দুজনেরই।
না। কাকা ছন্দাকে ফিরিয়ে নেবে। কদিন বাদে ওর বিয়ে হয়ে যাবে। মুশকিলে পড়ব আমি। অথচ আমি দুম করে রিস্কটা নিতে চাইনি।
এখন কী করা যায় সেটা তো বলবেন।
এখন রাস্তা একটাই। আমি ওকে বিয়ে করব।
ও রাজি হবে না।–রেমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলো।
আপনি ওকে রাজি করান বউদি।–একটু ভাঙা গলায় সমীর বলে।
আপনি কেন এরকম একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটাতে চাইছেন?
মরিয়া হয়ে। আমাকে শেষ করে ও দিব্যি আরামে থাকবে, তা হয় না।
এটা কি প্রতিশোধ নেওয়ার সময়?
আমি জানি না। কিন্তু এখন পিছোনোর পথ নেই।
রেমি গলায় সামান্য দৃঢ়তা এনে বলল, তা হলে আমাকে ডেকেছেন কেন? আপনার কি ধারণা এই অসামাজিক কাজ সমর্থন করব?
না। তবে আপনাকে আমার লেভেল হেডেড পারসন বলে মনে হয়েছিল। আপনি হয়তো সিচুয়েশনটা বুঝে ওকে বোঝাতে পারবেন বলে ভেবেছিলাম।
আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা চমৎকার।
রাগ করবেন না। আমি আপনার হেলপ চাইছি।
আমি হেলপ করতে পারব না সমীর। ছন্দাকে আমি নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাই।
আচমকাই সমীর একটু উঁচু গলায় বলল, শাট আপ। আমি ওকে খুন করব তবু ছাড়ব না। আপনি যদি আমাকে হেলপ করতে না পারেন তবে চলে যান।
রেমি একটুও ভয় পেল না। কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীর অগাধ ক্ষমতার ছায়ায় থাকতে থাকতে সে ভয় পাওয়া ভুলে গেছে। সে জানে, কৃষ্ণকান্ত সব হয়কে নয় করে দিতে পারেন।
সে বলল, ঠিক আছে, যাচ্ছি। ছন্দাকে একটা কথা বলে আসি।
ঘরে ফিরে সে ছন্দাকে বলল, ভেবো না। সমীর এখন একদম পাগল। ওকে ট্যাকল করতে হলে অন্য লোকের সাহায্য দরকার।
রেমি ঘর থেকে বাড়িতে টেলিফোন করল। বাড়িতে কৃষ্ণকান্ত নেই, তবে ধ্রুব আছে। সে ধ্রুবর সঙ্গেই কথা বলতে চাইল।
টেলিফোনে ধ্রুব এলে রেমি বলল, একবার এক্ষুনি কেনিলওয়ার্থ হোটেলে আসবে?
কেন?
দরকার আছে।
তুমি ওখানে কী করছ?
এলেই দেখতে পাবে। এসো।
আমরা বউয়ের হুকুমে চলি না, কী হয়েছে বলো।
উঃ, বলছি আমার ভীষণ বিপদ।
কীরকম বিপদ?
এসো না। পায়ে পড়ি। সব কি টেলিফোনে বলা যায়?
আমি কিন্তু মাল খেয়েছি।
তবু এসো। কাউকে বোলো না।
আচ্ছা।
ধ্রুব পনেরো মিনিটের বেশি সময় নিল না আসতে। রিসেপশনে টেলিফোন করে বলে রেখেছিল রেমি। ধ্রুব আসা মাত্রই ওপরে নিয়ে এল বেয়ারা।
কী হয়েছে?
ছন্দা। চিনতে পারছ?–রেমি ছন্দাকে দেখিয়ে বলে।
পারছি। এরকম অবস্থা কেন?
রেমি সংক্ষেপে বলো। জিজ্ঞেস করল, কী করা যায় বলো তো!
সমীর কোথায়?
বাইরে কোথাও আছে।
ধ্রুব গম্ভীর হয়ে চারদিকটা তাকিয়ে দেখল একটু। তারপর এক অদ্ভুত কর্তৃত্বের গলায় ছন্দাকে আদেশ করল, তোমার জিনিস গুছিয়ে নাও। ট্যাকসি দাঁড়িয়ে আছে।
ছন্দা সেই গলার স্বরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে পড়ল। বলল, গোছানোই আছে। ওই স্যুটকেসটা।
ধ্রুব সেটা তুলে নিয়ে বলল, এসো। সমীর বোধহয় পালিয়েছে।
তারা তিনজন নিরাপদে নেমে এল নীচে। ট্যাকসিতে উঠল। চলে এল কালীঘাটের বাড়িতে। ছন্দা তেমন গোলমালে পড়েনি। ধ্রুব মাঝখানে পড়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সমীরের কোনও পাত্তা পাওয়া যাচ্ছিল না।
০১৭. তরল মন্তব্য
রঙ্গময়ির আকস্মিক ওই তরল মন্তব্যে এত লজ্জা পেলেন হেমকান্ত যে, রাতে তার ভাল ঘুম হল না। শশিভূষণ এখন হাসপাতালে পুলিশের হেফাজতে, সেই চিন্তাও তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
জীবনটাকে তিনি যতদূর সম্ভব নির্ঝঞ্ঝাট এবং সরল রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। তার জন্যই সংসারের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করেননি, পুত্রকন্যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হননি, বিষয়ের প্রতি আসক্ত হননি। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটা জীবন যাতে জটিলতা নেই, আবর্ত নেই, অতিশয় শোক বা অত্যধিক আনন্দ নেই। কিন্তু তা পেলেন কই! জীবনের অনেকগুলি কপাট তিনি সভয়ে বন্ধ রেখেছিলেন। সেইসব কপাটের আড়ালে কী আছে তা জানার ইচ্ছাকে পর্যন্ত তিনি সভয়ে এড়িয়ে চলেছেন।
সেইরকম এক বন্ধ কপাট ছিল রঙ্গময়ি। আজ ওপাশ থেকে রঙ্গময়ি সেই কপাটে মৃদুমন্দ করাঘাত করতে শুরু করেছে। যদি অবারিত করে দেন দ্বার তবে হয়তো ভেসে যাবেন।
কাতর এক যন্ত্রণার শব্দ করে হেমকান্ত নিশুত রাতে পাশ ফিরলেন। এই শীতেও লেপের তলাকার উষ্ণতা তাঁর কাছে অসহ্য লাগছিল। উঠে আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালেন উত্তরের জানালার ধারে। জানালা খুলে দিলেন।
আজ কুয়াশা নেই। সামান্য জ্যোৎস্না আছে। গারো পাহাড়ের হিম বাতাস ব্রহ্মপুত্রের জল ছুঁয়ে আরও খরশান হয়ে আসছে। বালাপোশ ভেদ করে হাজারটা তিরের মতো বিদ্ধ করে যাচ্ছে শরীর। কিন্তু হৃদয় যখন উত্তপ্ত তখন বাইরের শীতলতা তেমন অনুভব করা যায় না।
ব্রহ্মপুত্রে সাদা বালির চর জেগে আছে। ওপারে জলা জমিতে মাঝে মাঝে ভূতের লণ্ঠনের মতো জ্বলে উঠছে নীলচে সবুজ শিখা। শুন্যে দোল খেয়ে হঠাৎ নিবে যাচ্ছে আবার। আলেয়া। রাত্রির কোন প্রহর ঘোষণা করছে শেয়ালের পাল? চাঁদের মুখে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে বাদুড়।
এই নিসর্গকে হেমকান্ত বুঝতে পারেন। তার শরীরের সীমায় আবদ্ধ অস্তিত্ব এই রহস্যময় গভীর রাত্রির আলো-আঁধারিতে নিজের দুকুল ছাপিয়ে যেন চারদিকে প্রবাহিত। নিজের মানুষি পরিচয়, নাম, গোত্র সব বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। যদি সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র এসব না থাকত তা হলে এই পৃথিবীতে হেমকান্তর মতো মানুষ বড় সুন্দর জীবন যাপন করতে পারত।
ঘড়িতে রাত তিনটে বাজবার সংকেত শুনে সামান্য নড়লেন হেমকান্ত। আজ আর ঘুম আসবে। জীবনের বন্ধ দুয়ারগুলিতে আজ বারবার কে কড়া নাড়ছে! কড়া নাড়ছে রঙ্গময়ি, শশিভূষণ, সচ্চিদানন্দ।
খুলে দেবেন দরজা?
হেমকান্ত নিঃশব্দে নীচে নেমে এলেন। ভোর চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে রোজ তার ঘুম ভাঙে। প্রাতঃকৃত্য শুরু করেন। আজ একটু আগেই শুরু হল তার দিন।
কুয়োয় বালতি ফেললেন। হাত বেয়ে খড়খড়ে শুকনো দড়ি নেমে যাচ্ছিল নীচে। জল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বহু নীচে গোল চক্রাকার জলের স্থির আয়না। জ্যোৎস্নায় আলোকিত আকাশের একটুখানি প্রতিবিম্ব তার বুকে। স্কুল বালতির স্পর্শে শতখান হয়ে ভেঙে গেল জলের বৃত্তাকার কাচ।
বালতিটা টেনে তুলতে ইচ্ছে হল না হেমকান্তর। দড়িটা ধরে রইলেন আলগা হাতে। তার মনে হচ্ছিল, ঠিক পিছনেই অপরূপ এক সাতরঙা ময়ূর পেখম মেলে চালচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিছন ফিরলেই মুখোমুখি দেখা হয়ে যাবে। হয়তো সেই মৃত্যুর দূত।
মুঠিটা হঠাৎ আলগা করে দিলেন হেমকান্ত। দড়িটা ছপাৎ করে গভীর কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল। পার্থিব যা কিছু আকর্ষণ ছেড়ে হেমকান্ত তাঁর মৃত্যুর মুখোমুখি হলেন।
কী চাও?
তোমাকে। শুধু তোমাকেই।–ময়ুর বলো।
আমি প্রস্তুত নই।
মৃত্যু তো কারও প্রস্তুতির ধার ধারে না। খেলার মাঝখানে খেলার ঘাঁটি তুলে নিয়ে যায়। প্রস্তুত নও সে তোমার দোষ।
মৃত্যুর কি কোনও রচনা নেই? সে কি চোর?
না। তা কেন? সে তো আসবেই, জানা কথা। বেঁচে থাকা মানেই তো প্রতিটি মুহূর্ত তার পদধ্বনির জন্য অপেক্ষা করা।
আমি অন্যরকম জানতাম।
সে কীরকম?
আমার মনে হয়, জীবনেরই পরিণতি মৃত্যু। আগে পরিপূর্ণ জীবন। উৎস থেকে শুরু করে নানা ঘাত প্রতিঘাত ভেদ করে বয়ে যাওয়া। কত বাঁক, কত খাদ, কত উঁচুনিচু, গ্রাম ও শহর ছুঁয়ে নদী যেমন যায়। তারপর মোহনায় যখন গতি শ্লথ, বিস্তার অগাধ তখন মহাসমুদ্রের সঙ্গে দেখা।
মৃত্যু উপমা মানে না, নিয়ম মানে না।
কোনও নিয়মই নয়?
তার নিয়ম আলাদা। তোমাদের সঙ্গে মিলবে না।
কেন এরকম? মৃত্যু কি স্বেচ্ছাচারী শাসক?
তার স্বরূপ জীবন থেকে জানা অসম্ভব।
সে কি এক স্থির ও ব্যাপ্ত অন্ধকার?
না। তাও নয়।
সে কি ভিন্নতর এক অস্তিত্ব?
তুমি আছো, এটা যদি সত্যি হয় তবে তুমি যে ছিলে এবং তুমি যে থাকবে তাও সত্য। কেউই তো অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব গ্রহণ করতে পারে না।
সে কেমন অস্তিত্ব?
সে এক গভীর আকাঙ্ক্ষা, আকুল পিপাসার ঘনবদ্ধ একটি বিন্দু।
কীসের আকাঙ্ক্ষা? পিপাসাই বা কীসের?
তুমি কি জানো না?
আমার আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা নেই। আমার জীবন স্তিমিত, আমার আকাঙ্ক্ষাও স্তিমিত।
তা হলে কীসের জন্য বেঁচে থাকতে চাও?
তা তো জানি না। স্বল্প পরিসরে আবদ্ধ আমার জীবন। কিন্তু তবু আমার বেঁচে থাকতে ভাল লাগে।
অন্ধকারে মিশে স্থির দাঁড়িয়ে আছেন হেমকান্ত। মুখ, পা শরীরের অনাবৃত অংশগুলিতে হেঁকে ধরেছে মশা। তবু হেমকান্তের শরীরে চেতনা নেই। তার নিজস্ব চেতনা যেন চরাচরের অদ্ভুত এই জ্যোৎস্নামাখা ব্যাপ্তির মধ্যে হারিয়ে গেল।
ভোরের কিছু আগে লোকজনের সাড়া পাওয়া গেল। হেমকান্ত সম্বিতে এলেন।
শ্যামকান্ত শরীরচর্চা করতেন। তার কিছু কাঠ ও লোহার মুগুর নীচের একটা ঘরে আজও জড়ো। করা আছে। প্রাতঃকৃত্য সেরে হেমকান্ত আজ গিয়ে সেই ঘরে ঢুকলেন। ফুটবল ছেড়েছেন অনেকদিন। তারপর আর শরীর নিয়ে মাথা ঘামাননি। আজ মনে হল, মানসিক এই বিহুল ও বিবশভাবটা শরীরের আলস্যের দরুনও হতে পারে। সম্ভবত শরীরটাকে চাঙ্গা করা গেলে মনও চাঙ্গা হবে।
ঘরের দবজা সাবধানে এঁটে তিনি মাঝারি একটা মুগুর তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরালেন। কিন্তু অল্পেই হাঁপিয়ে উঠতে হল। একটু বিশ্রাম, আবার কিছুক্ষণ ঘোরালেন। মন্দ লাগছিল না। বুড়ো বয়সের একটা খেলা।
যখন বেরিয়ে এলেন তখন মুখ লাল, গা ঘামে ভেজা। তবে মনটা একটু চনমনে লাগছিল। যেন বয়সটা এক দুই দশক পিছু হেঁটেছে। নির্দিষ্ট রুটিনের বাইরে তিনি বড় একটা চলেন না। অনিয়মের কপাটগুলো বন্ধ রাখেন। আজ নিয়ম ভাঙার একরকম আনন্দ পাচ্ছিলেন।
কৃষ্ণকান্ত তার ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে রোদে পিঠ দিয়ে পড়তে বসেছে। হেমকান্ত তার কাছে গিয়ে হাজির হলেন। মুখে একটু উদ্বেগ। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একটু-আধটু শরীরচর্চা করো তো?
কৃষ্ণকান্তর মুখখানা আজ ভার এবং বিষণ্ণ। মুখ তুলে বাবাকে একটু বিস্ময়ভরে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি ফুটবল খেলি।
ও আচ্ছা, খুব ভাল।
আমি ভাল ঘোড়ায় চড়তে পারি।
বেশ। আর কী? সাঁতার কাটতে শিখেছ?
হ্যাঁ।
নীচের ঘরে কয়েকটা মুগুর আছে। ভাঁজতে পারো। মুগুর ভাঁজা ভাল।
মুগুর কি ঘোরাতে হয়?
হ্যাঁ। ওপর নীচ ডাইনে বাঁয়ে। দরকার হলে বোলো, আমি দেখিয়ে দেবখন।
বলে হেমকান্ত চলে আসছিলেন।
পিছন থেকে কৃষ্ণকান্ত ডাকল, বাবা।
হেমকান্ত ফিরে চেয়ে বললেন, কী বলছ?
শশীদা কি ফিরে আসবে?
শশী!–হেমকান্ত একটু বিপন্ন হয়ে বললেন, আসবে না কেন?
সবাই বলছে শশীদার ফাঁসি হবে।
হেমকান্ত নিস্তেজ গলায় বলেন, বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে, হতে পারে।
যদি হয়?
আগে তো হোক।
শশীদার তো অসুখ। অসুখ না সারলেও কি ফাঁসি দেবে?
ফাঁসির কথা উঠছে কেন এখন? সে কোনও অন্যায় করেছে বলে তো আমরা জানি না।
শশীদা এক সাহেবকে মেরেছে। বরিশালে।
তুমি জানলে কী করে?
মনুপিসির মুখ থেকে শুনেছি।
মনু জানে না।
শশীদা জ্বরের ঘোরে নিজেও বলছিল।
তাই নাকি? জ্বরের ঘোরে মানুষ ভুলই বকে।
যদি শশীদা দোষী হয়েই থাকে তা হলে?
তা হলে ফাঁসি হতেও পারে।
যদি গায়ে জ্বর থাকে তবে?
জ্বর সারিয়ে নেবে।
কম্পাউন্ডারকাকাও মাকে তাই বলছিল। গায়ে জ্বর থাকলে ফাঁসি দেবে না। জ্বর সারিয়ে নেবে।
হেমকান্ত একটু হাসলেন।
কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ বলল, কেন এরকম নিয়ম বাবা? ফাঁসিই যখন দেবে তখন জ্বর সারানোর কী দরকার?
কথাটা হেমকান্ত একটু ভেবে দেখলেন। বড় মানুষরা এমন অনেক হাস্যকর ও অযৌক্তিক আচরণ করে যা ছোটদের চোখেও অসঙ্গত ঠেকে। সত্যিই তো, ফাঁসিই যদি দিবি তো জ্বর সারানোর কী দরকার?
হেমকান্ত প্রশ্ন করলেন, তোমার কি শশীর জন্য মন কেমন করছে?
এই প্রশ্নে কৃষ্ণকান্তর চোখ ছলছলে হয়ে এল। বলল, হ্যাঁ বাবা, খুব মন কেমন করছে। শশীদার তো দোষ নেই।
খুন করা নিশ্চয়ই অপরাধ।
শশীদা তো ইংরেজ মেরেছে। তাতে তো দোষ হয় না।
ইংরেজ মারলে দোষ হয় না একথা তোমাকে কে বলল?
সবাই বলে ওটা বীরত্বের কাজ।
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বিষণ্ণ গলায় বললেন, সবাই বলে না। সবাই কি অযৌক্তিক কথা বলতে পারে? ইংরেজরাও মানুষ, মানুষ মারা বীরত্বের কাজ হতে যাবে কেন?
ওরা যে আমাদের পরাধীন করে রেখেছে!
সেটা শুধু ওদের দোষ তো নয়। দোষ আমাদেরও আছে। ওরা আমাদের সেই দোষটুকুর সুযোগ নিয়েছে মাত্র। ইংরেজ যদি আমাদের পরাধীন না করত তা হলেও আমাদের রেহাই ছিল না। ফরাসি বা পর্তুগিজরা এসে আমাদের দেশ দখল করত। তুমি এসব কথা জানো না?
একটু-একটু জানি।
পরের মুখে কখনও ঝাল খেয়ো না। নিজের বিচারবুদ্ধি কাজে লাগানোর চেষ্টা কোরো। যে অবস্থায় ভারতবর্ষকে ইংরেজরা দখল করেছিল সেই অবস্থায় ইংরেজের অধীনতাই ছিল আমাদের মন্দের ভাল।
কৃষ্ণকান্ত তদগতভাবে তার বাবার দিকে চেয়ে থাকে। কোনও কথা বলে না।
হেমকান্ত জানতেন না, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রটি তাকে কত উচ্চাসনে বসিয়ে রেখেছে। বাবা যা বলেন তাই কৃষ্ণকান্তর কাছে দেববাক্য। বাবা বলেন অবশ্য খুব কম। আর কম বলেন বলেই বোধহয় সেগুলির ওজন অনেক বেশি মনে হয় কৃষ্ণকান্তর।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, একজন-দুজন ইংরেজকে মেরে লাভ কী? ওরা সাত সমুদ্র পেরিয়ে অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়েই এদেশে এসেছিল। সারা পৃথিবীটা জয় করতেও তো কম সাহস লাগে না। তুমি কি ভাবো ওরা দু-চারটে বোমা-বককে ভয় পায়, না দুচারজন মরলেই ঘাবড়ে যায়! ওরা অত ভীরু জাত নয়।
তা হলে কি শশীদার ফাঁসি হওয়াই উচিত?
তা বলিনি। শশী কী অপরাধ করেছে তা আমরা এখনও জানি না। ওসব কথা থাক। তোমার মনটা বোধহয় আজ ভাল নেই।
না। আমার মনটা আজ বড্ড কেমন করছে।
তা হলে চলো, ব্রহ্মপুত্রে একটু নৌকো করে বেড়িয়ে আসি।
একথায় কৃষ্ণকান্তর মুখ উজ্জ্বল হল, অবিশ্বাসের গলায় বলল, আপনার সঙ্গে বাবা?
হেমকান্ত বুঝতে পারছিলেন না, ছেলের কাছে তার কোনও দুর্বলতা ধরা পড়ে গেল কি না। পুত্রস্নেহের কোনও প্রকাশ ঘটুক এটা তিনি চান না। বড়ই অস্বস্তিকর ব্যাপার হবে সেটা। তাই একটু লজ্জার সঙ্গে বললেন, আমারও মনটা ভাল নেই। শশিভূষণের জন্য আমি তো কিছু করতে পারলাম না। কিন্তু অতিথিকে রক্ষা করা গৃহস্থের কর্তব্য। চলো, একটা ঘুরেই আসি।
নদীর ঘাটে কয়েকটা নৌকো সর্বদাই থাকে। হেমকান্তের নিজস্ব একটা ছোট বজরাও আছে। কিন্তু হেমকান্ত আজ নিজস্ব নৌকো নিলেন না। ছোট একটা ডিঙি ভাড়া করলেন। মাঝির কাছ থেকে বইঠা নিজের হাতে নিলেন। ছেলেকে বললেন, হালটা তুমিই ধরো।
কৃষ্ণকান্তর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে গেল আনন্দে। শীতের কবোষ্ণ বোদ, ব্রহ্মপুত্রের গৈরিক বিস্তার, রুপোলি জলের ওপর বাতাসের হিলিবিলি এবং প্রিয় পুত্রটির নিস্পাপ মুখে উত্তেজিত আনন্দের প্রভা হেমকান্তের বড় ভাল লাগল। রাত্রির অনিদ্রার কথা ভুলে গেলেন। শরীরটা যেন যৌবনের গান গাইছে। তিনি সবল হাতে বইঠা বাইতে লাগলেন। অনভিজ্ঞ কৃষ্ণকান্তর হাল ধরার দোষে মাঝে মাঝে নৌকো দিগভ্রষ্ট হচ্ছিল। একবার একপাক ঘুরেও গেল! মাঝি হালের জন্য হাত বাড়াতেই হেমকান্ত ধমক দিলেন, তুই বসে থাক। ও ঠিক পারবে।
হেমকান্তর এরকম প্রগলভ আচরণ বহুকাল কেউ দেখেনি।
তিনি নৌকোটা ভেড়ালেন নদীর মাঝখানকার চরে। সে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের জঠর যেনবা। মাথার ওপর ঘন নীল চাঁদোয়া। দুদিকেই ব্রহ্মপুত্রের গম্ভীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে। নদীর পরপারে বসতিহীন অবাধ প্রকৃতি। চরে কলুই শাকের বীজ ছড়িয়েছিল কে। হাঁটু সমান দুব্বোঘাসের মতো অতি সবুজ ও নরম খেত কী সুন্দর!
হেমকান্ত সামান্য জল ভেঙে কৃষ্ণকান্তকে নিয়ে চরে উঠে এলেন। কিছুক্ষণ বোবা হয়ে চেয়ে দেখলেন চারদিকে। তারপর ছেলের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ভাল লাগছে না?
খুব ভাল লাগছে।
তিনি সস্নেহে কৃষ্ণকান্তের মাথার চুলে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর খেতের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চরের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে গেলেন। জল ও মাটির প্রগাঢ় গন্ধ রোদে আরও ঝাঝালো হয়ে উঠেছে এখন। এই গাছপালা, ওই আকাশ, আর চারদিকের এই যে অগাধ প্রসার এর মধ্যে কোথায় হারিয়ে যায় সমাজ ও সংসার, রাজনীতি বা রাষ্ট্র।
কৃষ্ণ।
বলুন বাবা।
এসো একটু বসি।
দুজনে পাশাপাশি মাটির ওপর বসার পর হেমকান্ত প্রশ্ন করলেন, বড়দার কাছে কলকাতায় যেতে তোমার ইচ্ছে করে না?
না।
একটুও না?
একটুও না।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তবু তোমার বড়দা তোমাকে নিয়ে যেতে চায়। যাবে?
আপনি যা বলবেন।
হেমকান্ত একটু চুপ করে থেকে বলেন, হয়তো ভালর জন্যই বলছে। তুমি একটু ভেবে দেখো।
আমার কলকাতায় যেতে ইচ্ছে করে না।
কেন?
আমার এ জায়গাই ভাল।
কারও জন্য কষ্ট হবে?
আপনাকে আর ছোড়দিকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। খুব কষ্ট হবে।
হেমকান্তের বুকটা চলকে উঠল এক অনভিপ্রেত আনন্দে। যেন মায়ার একটি কলস ভরে গেল, উপচে গেল। তাকে ছেড়ে যেতে কৃষ্ণকান্তর তা হলে কষ্ট হবে? তা হলে তিনি যদি মরে যান তবে কৃষ্ণকান্ত বুঝি খুব কাঁদবে, হাহাকার করবে!
হেমকান্ত মৃদুস্বরে বললেন, আমি তো তোমার জন্য কিছুই করিনি। তুমি মা-হারা ছেলে, তোমার জন্য বোধহয় আমার আরও কিছু করা উচিত ছিল। নজরই দিতে পারলাম না তোমার দিকে।
কৃষ্ণকান্ত চুপ করে রইল।
হেমকান্তর খুব ইচ্ছে করছিল ছেলের চোখ দুটির দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকতে। কিন্তু সংকোচবশে পারলেন না। নিজের দুর্বলতা কখনও ছেলেপুলেদের কাছে প্রকাশ করতে নেই।
০১৮. ছন্দাকে নিয়ে আসা হল
ছন্দাকে নিয়ে আসা হল বটে, কিন্তু সে যেন সাপের মুখ থেকে ব্যাংকে ছাড়িয়ে আনা। শেষ অবধি সর্পদষ্ট ব্যাং বাঁচে না। যে দু-তিন দিন ছন্দা রেমির কাছে ছিল সেই কয়দিন সে কথাই বলত না। চোখে সর্বদা এক ঘোর-ঘোর চাউনি। ফঁক পেলেই কাঁদতে বসত। রেমির সে এক জ্বালা। একদিন ছন্দা হঠাৎ বলল, সমীরদা কোথায় গেল খোঁজ নেবে না, রেমি?
রেমি বিরক্ত হয়ে বলল, আবার তার খোঁজ কেন?
কোথায় আছে, কী করছে জানি না তো, তাই ভয় হচ্ছে। যদি সুইসাইড করে!
সমীর কি খোকা? আজকালকার ছেলেরা অত হট করে মরে না।
তবু একটু খোঁজ নাও। ধ্রুবদাকে বলল, ঠিক খোঁজ এনে দেবে।
তোমার কি সমীরের জন্য মন কেমন করছে?
করছে। ওর তো দোষ নেই। আমারই কেমন পাগলামি এল। নিজেও ড়ুবলাম, ওকেও ডোবালাম।
রেমি বিরক্ত হল। বলল, দু নৌকায় পা দিয়ো না ছন্দা। একটা পথ বেছে নাও। এখনও যদি সমীরের প্রতি তোমার উইকনেস থেকে থাকে তা হলে কিন্তু খুব বিপদে পড়বে।
ছন্দা অসহায়ভাবে বলল, আমি যে ওকে ভীষণ অপমান করলাম। এটা তো ওর পাওনা ছিল। প্লিজ, ওর একটু খবর এনে দাও আমাকে, তোমাদের পায়ে পড়ি।
কিন্তু সমীরের খোঁজ করা তো রেমির পক্ষে সম্ভব নয়। ছন্দা আসায় ধ্রুব একটু সংযত থাকে বটে, কিন্তু যেন একটা আনমনা উড়ুউড়ু ভাব। মুখ সর্বদা গম্ভীর। বেশির ভাগ সময়ে বাইরেই থাকে। তা ছাড়া ধ্রুবকে সমীরের খবর আনার কথা বলতে একটু লজ্জা পায় রেমি। কেন পায় তা স্পষ্ট করে ভাবতে চায় না। তবে তার ধারণা, দার্জিলিং-এর সেই ঘটনার কথা ধ্রুব জানে। শ্বশুরমশাইকে বললে অবশ্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শুধু খবর নয়, সমীরকে সুদ্ধ এনে হাজির করবে পুলিশ। কিন্তু শ্বশুরমশাইকে এসব তো বলা যাবে না। কৃষ্ণকান্ত ভিতরকার ঘটনা কিছুই জানেন না। বন্ধুর মেয়ে বেড়াতে এসেছে বলেই ধরে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু সমীরকে খোঁজার কথা বললেই জেরা শুরু করবেন, আর সে জেরার মুখে রেমির ভিতর থেকে সব কথা টেনে বের করে নেবেন।
অগত্যা রেমি ধ্রুবকেই ধরল, ওগো, ছন্দা সমীরবাবুর জন্য খুব চিন্তা করছে। একটু খবর আনতে পারো না?
ধ্রুব অবাক হয়ে বলল, খবর কীসের?
লোকটা আত্মহত্যা-টত্যা করল নাকি, খুব ভাবছে ছন্দা।
ধ্রুব একটু হেসে বলল, সে মাল সমীর নয়। ছন্দাকে ভাবতে হবে না।
বলব, কিন্তু তাতে কাজ হবে না।
ধ্রুব একটু দোনোমোনো করে বলল, সমীর টাওয়ার হোটেলে আছে। বেশ মেজাজেই আছে। রোজই আমাদের দেখা হয়।
রেমি আকাশ থেকে পড়ল, দেখা হয়। তোমাদের দেখা হয়?
হবে না কেন? একই জায়গায় বসে আমরা মাল খাই। সমীর বেশ ভাল টানে।
রেমি কী বলবে ভেবে পেল না অনেকক্ষণ। তারপর বলল, একথাটা আমাকে বলোনি!
বলার কী! —বলে ধ্রুব নির্বিকার মুখ করে বেরিয়ে গেল।
রাগে দাঁত কিড়মিড় করল রেমি। তার রাগের কারণ, সমীরের সঙ্গে ধ্রুব সম্পর্ক রাখবে কেন? ফুঁসতে ফুঁসতে সে গিয়ে ছন্দাকে বলল, তোমাকে ভাবতে হবে না! সমীরের সঙ্গে তোমার ধ্রুবদার রোজ দেখা হয়। দুজনে একসঙ্গে বসে মদ খায়।
ছন্দা যে খুব খুশি আর নিশ্চিন্ত হল তা নয়। স্তিমিত চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। যেন সমীর ভাল আছে এটা প্রত্যাশিত খবর নয়। খুব নিরুৎসুক গলায় বলল, ও, আচ্ছা।
এতে রেমির রাগ বাড়ল বই কমল না।
ছন্দার ফিরে যাওয়ার জন্য প্লেনের টিকিট কাটা হল। ধ্রুব সংসারের কোনও কাজেই নিজেকে জড়ায় না। কিন্তু ছন্দার প্লেনের টিকিট সে নিজেই কেটে আনল। একটা নয়, দুটো, টিকিট দুটো রেমির হাতে দিয়ে বলল, তুমিও ছন্দার সঙ্গে যাও। দিন দুই থেকে ফিরে এসো।
রেমি অবাক, আমি! আমি কেন যাব?
যদি কোনও কথা ওঠে তবে তুমি সামাল দিতে পারবে।
অসম্ভব! আমি যেতে পারব না। ছন্দাও তো আমাকে যেতে বলেনি ওর সঙ্গে।
ওর মাথার ঠিক নেই। আমি বলছি, তোমার যাওয়া দরকার। সুদর্শন কাকা কিছুই জানেন না, কিন্তু ছন্দার হাবভাব দেখে ওঁর সন্দেহ হতে পারে। আর ছন্দার এখন ব্যালানস নেই। এ অবস্থায় ঠান্ডা মাথার একজন কারও ওর সঙ্গে থাকা উচিত।
রেমি প্রস্তাবটায় খুশি হয়নি, তবে যৌক্তিকতাটা বুঝল। সে বলল, গেলে আমি একা কেন? তুমিও চলো।
যেতাম। কিন্তু আমার আবার একটা চাকরি হয়েছে। কালই জয়েন করতে হবে।
রেমিকে যেতে হল। কিন্তু বাগডোগরায় নেমেই সে অবাক। সমীর এবং একজন নেপালি ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির। সমীরের মুখ গম্ভীর।
মেজাজি একজন ডাকাবুকো শ্বশুরের সঙ্গ করে আজকাল রেমিরও কিছু মেজাজ হয়েছে। কর্তৃত্বের ভাবও এসেছে খানিকটা। সে রাগের গলায় বলল, আপনি?
সমীর খুব মৃদু স্বরে বলল, প্ল্যানটা আমার নয়। ধ্রুবর। সে আমাকে যেমন বলেছে, করেছি।
উনি তো আমাকে কিছু বলেননি।
সেটা আমি জানি না। যা সত্যি তাই বললাম। বিশ্বাস করা না-করা আপনার মর্জি।
বেশ চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। রেমির মেজাজ আরও চড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এয়ারপোর্টে একটা সিন তৈরি করা উচিত হবে না বলে চেপে গেল। ছন্দা সমীরকে দেখেই সেই যে এক ধরনের অপরাধী ভাব করে নতমস্তক হল, আর ঘাড় তুললই না।
সুদর্শনবাবুর বাড়িতে পৌঁছে কিছুক্ষণের মধ্যেই রেমি বুঝতে পারল ছন্দার কোনও ভয় নেই। কেউ কিছু টের পায়নি। এদের যা বোঝানো হয়েছে তা হল, ছন্দা কলকাতায় গিয়ে রেমির কাছে কয়েকদিন থেকে যায়। তার দেরি হবে বলে সমীর আগেই ফিরে এসেছে। সহজ সরল বিশ্বাসযোগ্য গল্প। সুতরাং রেমির কাজ ফুরিয়ে গেল।
সে সুদর্শনবাবুকে বলল, কাকু, আমি কালই ফিরে যাব।
সুদর্শনবাবু অবাক হয়ে বললেন, সে কী? আমাকে যে ধ্রুব ট্রাংক কল করে জানিয়েছে যে, তুমি ছন্দার বিয়ে পার করে যাবে!
রেমির এক গাল মাছি। সর্বনাশ! অতদিন থাকতে হবে! এটা কি ধ্রুবর ষড়যন্ত্র?
রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার রাগের হলকা বেরোচ্ছিল। তবে সুদর্শনবাবুকে কিছু বলে লাভ নেই। ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ সে তার উত্তপ্ত মাথাটিকে ঠান্ডা করল। তারপর স্থির মাথায় ভাবতে বসল।
অনেক ভেবে তার মনে হল, ধ্রুব হয়তো খুব ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। অবশ্য সিদ্ধান্তটার কথা তার রেমিকে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু জানালে হয়তো রেমি আসত না। তবে ছন্দার বিয়ে পর্যন্ত এ বাড়িতে থাকাটা হয়তো দরকার। ছন্দা আর সমীরের মধ্যে সে একটা ব্যারিকেডের কাজ করতে পারবে। ওদের দুজনের কারওই মনের ভারসাম্য নেই। কখন কী করে বসে! আবার হয়তো পালাবে বা আরও খারাপ কিছু করে বসবে।
রেমি থেকে গেল।
তবে থাকাটা আগের বারের মতো সুখকর হল না। ছন্দা হাসে না, কথা বলে না, দূরে দূরে থাকে।
নন্দার একটা পরীক্ষা সামনে। সমীর লজ্জায় কাছে আসে না। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। তবু রেমি দাঁত মুখ টিপে রইল। ধ্রুবকে একটা চিঠি দিল না বা টেলিফোনে কথা বলল না। শুধু শ্বশুরমশাইকে টেলিফোন করে ব্যাপারটা জানাল। কৃষ্ণকান্ত বললেন, ভালই হয়েছে। ধ্রুবও বলছিল আমাকে। সুদর্শনের মেয়ের বিয়েতে আমি তো যেতে পারছি না, আমাকে দিন সাতেকের জন্য ওয়েস্ট জার্মানি যেতে হচ্ছে। তুমিই আমাদের রিপ্রেজেনটেটিভ হয়ে থাকো।
কিন্তু সারাটা দিন চুপচাপ কঁহাতক থাকা যায়? একা-একা বেড়াতে তার ভাল লাগে না। মেয়েদের একা বাইরে বেরোনো শ্বশুরমশাই পছন্দ করেন না বলে রেমি পারতপক্ষে একা কোথাও যায় না।
সময়টা খুবই খারাপ কাটবার কথা ছিল রেমির। কিন্তু সে শিলিগুড়িতে আসার দিন দুয়েকের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল। বিকেলে ছাদে একা বসে ছিল রেমি। ছন্দা নিজের ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি। নন্দা কলেজ থেকে ফেরেনি। হঠাৎ সমীর রাঙা মুখে ছাদে এসে হাজির।
রেমি, আপনাকে একটা খবর দিতে এলাম।
খবর! রেমির বুক ধড়ফড় করতে লাগল। খারাপ খবর নয় তো!
সমীর বলল, খবরটা খুব উপাদেয় নয়। কৃষ্ণকান্তবাবুর হুকুম হয়েছে আমাকে কালকের ফ্লাইটেই কলকাতা যেতে হবে। কী যেন জরুরি দরকার।
রেমি ব্যাপারটা বুঝল না। বলল, তাই নাকি?
সমীর একটু হাসল। খুব শ্লেষের হাসি। বলল, আপনি হয়তো ব্যাপারটা তলিয়ে বোঝেননি।
রেমি সরলভাবে বলল, না।
কৃষ্ণকান্তবাবুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ। আমাকে তার কোনও কারণেই খুব জরুরি কাজে ডেকে পাঠানোর মানেই হয় না। আগে কোনওদিন তেমন প্রয়োজন দেখাও দেয়নি।
রেমি বোকার মতো বলল, ডেকেছেন যখন নিশ্চয়ই কোনও কাজ আছে। আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?
রেগে যাওয়ার কারণ আছে বলেই। উনি আমাকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে চাইছেন, আপনি এখানে আছেন বলে।
তার মানে?
আপনার শ্বশুরমশাই চান না আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার কোনও চান্স আমি পাই।
যাঃ, কী যে সব আবোল তাবোল বলছেন!
একটু ভেবে দেখলে আপনিও বুঝবেন। কাকা এখন আমাকে ছাড়তে রাজি নন। সামনে ছন্দার বিয়ে। আমাকে তার এ সময়ে দরকার। তবু কৃষ্ণকান্তবাবু ইনসিস্ট করছেন, যেন অবশ্যই আমাকে কলকাতা পাঠানো হয়। কোনও যুক্তিই তিনি মানতে রাজি নন।
রেমি শ্বশুরের পক্ষ নিয়ে বেশ রাগের গলায় বলল, তাতে কী প্রমাণ হয়?
সমীরকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। প্রায় রুদ্ধস্বরে সে বলল, তাতে একটাই জিনিস প্রমাণ হয় রেমি। ক্ষমতাবান লোকেরা যা খুশি করতে পারে। তারা ড়ুগড়ুগি বাজালেই আমাদের নাচতে হবে।
রেমি রেগে যেতে গিয়েও পারল না। সমীরের কথার ভিতরকার সত্যটুকু তাকে স্পর্শ করে থাকবে। শশুরকে সে ভীষণ ভালবাসে, ভক্তি-শ্রদ্ধাও করে। কিন্তু এও ঠিক, লোকটি অসম্ভব প্রভুত্ব করতে ভালবাসে, ভীষণ জেদি, অতিশয় কঠোর মনোভাব-সম্পন্ন।
রেমি কোমল স্বরে বলল, ঠিক আছে। আপনি না হয় যাবেন না।
সে ক্ষেত্রে রিস্কটা কে নেবে? আপনি?
কীসের রিস্ক? —রেমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলে।
রিস্ক অনেক। আমার কাকা সেটা হাড়ে হাড়ে জানে। কৃষ্ণকান্তকে চটালে কাকাকে এই উত্তরবঙ্গেও ব্যাবসা করে খেতে হবে না।
আপনি ব্যাপারটাকে ভীষণ জটিল করে তুলছেন।
সমীর সে কথায় কান না দিয়ে বলল, ইন ফ্যাকট কাকাও ভয় পাচ্ছেন। তার যদিও মত ছিল না, তবু বলছেন, কৃষ্ণকান্তর কথা ফেলা ঠিক হবে না, তুই গিয়ে ঘুরে আয়।
তাই আপনি আমার কাছে এসেছেন?
আমি যে জানি, এর পিছনের কারণটা হলেন আপনি।
এবার রেমি লজ্জায় এবং রাগে লাল হয়ে উঠল। শ্বশুরমশাই কাজটা ঠিক করেননি। রেমিকে তার বিশ্বাস করা উচিত ছিল। তা ছাড়া ধ্রুব তো এসব গ্রাহ্য করে না, শ্বশুর হয়ে ওঁর তা হলে এত মাথাব্যথা কেন?
রেমি হঠাৎ অত্যন্ত দৃঢ় স্বরে বলল, রিস্ক আমারই। আপনাকে যেতে হবে না।
সমীর বোধহয় একটু অবাক হল। বলল, সত্যিই রিস্ক নেবেন?
নেব। আপনার সন্দেহটা দূর করা দরকার। আমার শ্বশুরমশাই অতটা মীন নন।
মীন কথাটা আমি কিন্তু উচ্চারণ করিনি।
আপনি সেটাই বোঝাতে চাইছেন।
না।–সমীর মাথা নেড়ে একটু শ্লেষের গলায় বলল, বরং আমি বলতে চাইছিলাম কৃষ্ণকান্তবাবু বড় বেশি পিউরিটান। বঙ্কিমের একটা লাইন আছে জানেন! ইহারা কুকুর মারে, কিন্তু হাঁড়ি ফেলে না।
তার মানে!
কৃষ্ণকান্ত তাঁর পুত্রবধূকে কিছুই বলবেন না, কিন্তু দরকার হলে আমাকে কান ধরে কলকাতা পর্যন্ত দৌড় করাবেন। ওঁর পিউরিটানিজমও একপেশে।
রেমি তর্ক করল না। কারণ ভিতরে ভিতরে তারও কিছু ভূমিক্ষয় হয়ে থাকবে। শ্বশুরের ওপর অনেক কারণে অনেকবারই ক্ষুব্ধ হয়েছে সে, তবে কোনওবারই শ্বশুরের ব্যবহার তাকে মারাত্মক আঘাত করেনি, এটা করল।
সারারাত ঘুমোল না রেমি। মাথা গরম। কখনও চোখে জল আসে, কখনও শরীর দিয়ে রাগের হলকা বেরোয়।
সকালে উঠেই স্নান করে পোশক পর সে। সমীরকে ডেকে বলল, চলুন কোথাও একটু বেড়াতে যাই।
সমীর বিস্মিত হয়ে বলে, তা হলে কলকাতা যাব না বলছেন!
না, কিছুতেই না।
দেখবেন গরিবকে ধনেপ্রাণে মারবেন না।
রেমি বলল, মরলে আমিই মরব। আপনার ভয় নেই।
সেদিন একটা আমরাসাড়ার গাড়িতে তারা গেল জলঢাকা অবধি। সাইটে সমীরের একটু কাজও
ছিল।
পথে প্রথম দিকটায় দুজনের কেউই কথা বলেনি। অনেকক্ষণ বাদে সমীর বলল, ছন্দার ব্যাপারে আপনি এবং ধ্রুব আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
রেমি অবাক হয়ে বলল, সে কী! আমি তো উলটো ভেবেছিলাম।
সমীর মাথা নেড়ে বলল, না। আমি প্রায় ছেলেবেলা থেকে ওকে ভালবাসি ঠিকই, কিন্তু বরাবর আমার একটা দ্বিধাও ছিল। ছন্দা পাগলামি না করলে আমি ওই কাণ্ড করতাম না।
রেমি বলল, জানি। ছেলেরা রিস্ক নিতে ভয় পায়।
হ্যাঁ। কারণ ছেলেরা অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা করে। মেয়েরা করে না। আমি ছন্দাকে বিয়ে করলে কাকা আমার মুখদর্শন করতেন না। ছন্দা আর এ বাড়িতে ঢুকতে পেত না। আমরা অসামাজিক হয়ে যেতাম।
আপনি কি আর ছন্দাকে ভালবাসেন না?
সে কথা বলা কঠিন। হয়তো বাসি। আর বাসি বলেই চাই, ওর ভাল হোক।
ভালই কি হচ্ছে?
মনে তো হয়। অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে ও প্রথমটায় খুব অসুখী থাকবে ঠিকই, কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেটা কেটে যাবে।
আপনার মনের অবস্থা কী?
কাকাকে খুব বড় একটা আঘাত দিতে হচ্ছে না এটা ভেবে আমি স্বস্তি পাচ্ছি। আপনি জানেন, আমি আমার কাকাকে ভীষণ ভালবাসি। নিজের বাবার চেয়েও বেশি। আমি কাকার কাছেই মানুষ বলতে গেলে।
রেমি বহুদিন পর একটা তৃপ্তি বোধ করতে লাগল।
সমীরের সঙ্গে সেই যে ভাব হয়ে গেল তা আরও প্রগাঢ় হল কয়েক দিনে।
কতটা প্রগাঢ়? তা রেমি জানে না। তবে সে একটা কথা নিজের বুক ছুঁয়ে বলতে পারে, সেটা প্রেম নয়। যৌন আবেগ নয়। তখন তাদের কারও মনের অবস্থাই তেমন স্তরে নেই।
ছন্দার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যখন রেমি ফিরে এল তখনও কৃষ্ণকান্ত জার্মানি থেকে ফেরেননি। ধ্রুব তার নতুন চাকরির কাজে পুনা গেছে।
নিজের গর্ভ সঞ্চারের ব্যাপারটি এখনই সহসা টের পেল রেমি।
ধ্রুব ফিরে আসতেই বলল, কী কাণ্ড জানো?
না, কী কাণ্ড?
বলব না।
বোলো না।
শুনতে চাও না?
চাই তো। কিন্তু বলতে না চাইলে কী করব?
কোনও ব্যাপারেই তোমার আগ্রহ নেই কেন বলো তো?
ওঃ রেমি!
বিরক্ত হলে?
বিরক্ত করছ যে!
তুমি যে বাবা হতে চলেছ।
আমি? আমি কেন বাবা হতে যাব?
তবে কে হবে? ভূতে?
কী ব্যাপার বলো তো!
এখনও বোঝোনি?
ওঃ! তুমি কি প্রেগন্যান্ট?
মনে তো হচ্ছে।
হঠাৎ ধ্রুবর মুখটা কেমন সাদা দেখাতে লাগল।
» ০১৯. নতুন এক আনন্দ
নতুন এক আনন্দকে আবিষ্কার করলেন হেমকান্ত। শান্ত নদী, চব, নীল ও গভীর আকাশ, দিগন্তে গারো পাহাড়, এই অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে কোমল সূর্যের আলোয় নৌকো করে খানিকটা ঘুরে বেড়ানো। কতকাল জলে বইঠা মারেননি তিনি।
রোজ সকালে কৃষ্ণকান্তর পড়াশুনো শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন তিনি। ছেলের যে ইস্কুল আছে তা তাঁর খেয়াল থাকে না। পরীক্ষার পর সবে ইস্কুল খুলেছে, তাই কৃষ্ণকান্তরও বড় একটা গরজ নেই ক্লাস করার। বরং বাবার সঙ্গে এই দুর্লভ জলযাত্রা তার কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
পড়া শেষ করে কৃষ্ণকান্ত ছুটে আসে বাবার ঘরে।
হেমকান্ত প্রসন্ন মুখে উঠে পড়েন। বলেন, চলো।
সোৎসাহে কৃষ্ণকান্ত বলে, আজ সেই জায়গাটায় যাবেন বাবা?
কোন জায়গাটায়?
যেখানে কাকা ড়ুবে গিয়েছিল।
হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, সেই জায়গাটা দেখে কী করবে?
এমনি। দেখব।
কাকার কথা তুমি খুব ভাবো নাকি?
খুব ভাবি।
হেমকান্ত খুশিই হন। বলেন, মহৎ মানুষদের কথা চিন্তা করাও ভাল। তাতে নিজের ভিতরেও মহত্ত্ব জেগে ওঠে।
কয়েকদিন অভ্যাসে হেমকান্ত নৌকো বাওয়ার বিস্মৃত কলাকৌশল আবার আয়ত্ত করলেন। মাঝি বসে থাকে, তিনি এবং কৃষ্ণকান্ত নৌকো চালান। বয়সের তুলনায় কৃষ্ণকান্ত বেশ দীর্ঘকায় এবং সবল। এটা অবশ্য এই বংশেরই ধারা। হেমকান্ত নিজেও বেশ দীর্ঘকায়। তবে শরীরের চর্চা করেন না বলে এখন আর ততটা সবলদেহী নন। কিন্তু তার শরীরে এখনও তেমন মেদ সঞ্চার হয়নি। সংযম এবং মিতাচারের ফলে অল্প শ্রমে ক্লান্তও হন না। স্বাস্থ্য তার ভালই। নৌকো বাইতে বাইতে তার শরীরের জরার ভাবটাও ঝরে গেছে। এখন আর বার্ধক্যের পদধ্বনি নিজের শরীরে তেমন টের পান না। যখন দিঘল চেহারার কৃষ্ণকান্ত দুটি কচি হাতে বইঠা টানে তখন তার অপরূপ দেহভঙ্গিমার ভিতর যেন নিজেকেই খুঁজে পান হেমকান্ত।
শীতের সকালে ছোট খেয়া নৌকোটি মৃদুমন্দ চালে ভেসে চলেছে। বইঠা তুলে নিয়েছেন হেমকান্ত। তার ইশারায় কৃষ্ণকান্তও তাই করেছে। মৃদু স্রোতে নৌকো বয়ে চলেছে ভাটিতে। নদীর মাঝ বরাবর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা আছে। মুগ্ধ বিভোর হেমকান্ত সেই নিস্তব্ধতাকে অনুভব করছেন। মাঝে মধ্যে গাংচিল বা কোনও পাখির ডাক ভেসে আসে। আর আছে জলের মৃদুমন্দ শব্দ। যেন তা এই নিস্তব্ধতাকেই গভীরতর করে তোলে। কৃষ্ণকান্ত তার বাবার এই তদগত ভাব লক্ষ করে সতর্কভাবে চুপ করে থাকে। নৌকো যাতে দিকভ্রষ্ট না হয় তার জন্য হেমকান্ত অভ্যস্ত হাতে একটি বইঠা জলে ড়ুবিয়ে রাখেন কিছুক্ষণ। আবার তুলে ফেলেন। এ ছাড়া অনেকক্ষণ আর তার বাহ্যিক কোনও নড়াচড়া থাকে না।
অনেকটা ভাঁটিয়ে গিয়ে যেখানে নদী একটা বাঁক নিয়েছে সেইখানে নৌকোকে ধীরে ধীরে তীরের দিকে চালনা করেন হেমকান্ত। ভারী নির্জন জায়গা। ধারে কাছে গাঁ গঞ্জ নেই। নদীর ধারে বেঁটে কাটাঝোপ আর বেতবন। তটস্থ মাঝি জিজ্ঞেস করে, নৌকো বাঁধব কর্তা?
বাঁধ।–হেমকান্ত উদাস স্বরে বলেন।
বুড়ো মাঝি একটা লগি পুঁতে নৌকোটা বাঁধে। হেমকান্ত হাটুজলে নেমে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকান্তর দিকে চেয়ে বলেন, নামো।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কৃষ্ণকান্ত জলে নেমে দাঁড়ায়। শীতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা জল তার কোমর অবধি ওঠে। হেমকান্ত সেদিকে খেয়াল করেন না। ধীরে ধীরে তীরভূমির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন, এই সেই জায়গা। এই সেই জায়গা।
বেতবন উত্তরে বাতাসের শব্দ হুহু করে শোকাবহ শব্দ তুলে বয়ে যাচ্ছে। ঝিমঝিম করছে রোদ। আস্তে আস্তে হেমকান্ত ডাঙায় উঠে দাঁড়ালেন, সঙ্গে কৃষ্ণকান্ত।
হেমকান্ত নদীর ধারে দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্রের বহমানতার দিকে চেয়ে থেকে বলেন, নৌকোটা ড়ুবেছিল আরও উজানের দিকে। অনেকটা দূরে, শহরের কাছাকাছি। নলিনী এত দূরে ভেসে এসেছিল। কেন কে জানে!
কৃষ্ণকান্ত বোবা বিস্ময়ে শান্ত সুন্দর জায়গাটির চারদিকে চেয়ে সেই ঘটনার বিষণ্ণ রেশটুকু খুঁজতে থাকল। তারপর বয়সোচিত ছেলেমানুষি একটা প্রশ্ন করল, কাকা কি সাঁতার জানত?
হেমকান্ত তার দিকে ফিরে একটু হেসে বললেন, জানত। খুব ভাল সাঁতার দিতে পারত নলিনী। ভরা বর্ষাতেও ব্ৰহ্মপুত্ৰ এপার ওপার করত।
তা হলে ড়ুবে গেল কেন?
কে জানে। ভবিতব্য।
মনুপিসি বলে, সাঁতার জানলে নাকি কেউ জলে ড়ুবে যেতে পারে না।
হেমকান্ত একথার জবাব দিলেন না। আঘাটায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলেন স্রোতের দিকে। নদীর স্রোত জিনিসটাই ভারী অদ্ভুত। এ যেন সময় ও জল একসঙ্গে মিশে চলেছে মোহনার দিকে।
কৃষ্ণকান্ত বলল, মনুপিসি বলে, কাকাকে কেউ মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল।
বলে নাকি?–হেমকান্ত একটু হাসলেন।
কৃষ্ণকান্ত উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকার গায়ে কি খুব জোর ছিল বাবা?
তা মন্দ ছিল না। ব্রহ্মচারী মানুষ সে। সংযম ছিল, সর্বদা পরিশ্রম করত। জোর থাকারই কথা।
ব্যায়াম করত না?
বোধহয় করত।
কাকা লাঠি চালাতে জানত?
শিখেছিল খানিকটা।
তা হলে কাকাকে মারল কী করে?
হেমকান্ত একটু হেসে বললেন, সেটা তুমি তোমার মনুপিসিকেই জিজ্ঞেস কোরো।
কৃষ্ণকান্ত তার সরল চোখে অগাধ বিস্ময় নিয়ে বাবার দিকে চেয়ে বলে, মনুপিসি বলে,কাকার গায়ে নাকি ভীষণ জোর ছিল। একবার কাকা লাঠি নিয়ে একদল ডাকাতকে মেরেছিল।
হেমকান্ত হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠেন। কৃষ্ণকান্তর মনের মধ্যে একটা বীরত্বের বীজ বপন করতে চাইছে রঙ্গময়ি। রঙ্গময়ি নয়, পুরোদস্তুর মিথ্যাময়ি। হাসলেও হেমকান্ত এ ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিতে চাইলেন না। ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, মনু একটু বাড়িয়ে বলেছে। অতটা নয়। নলিনী ডাকাত মারলে আমি ঠিকই জানতে পারতাম।
একথায় কৃষ্ণকান্ত একটু হতাশ হল। কাকার বীরত্বের কথা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় বটে, কিন্তু সে জানে, তার বাবা সর্বদাই ঠিক কথা বলেন। সরলভাবেই কৃষ্ণকান্ত বলে, তা হলে মনুপিসি কি মিথ্যে কথা বলেছে?
রঙ্গময়িকে মিথ্যাবাদী বলতে বাধে হেমকান্তর। তিনি বললেন, রূপকথা বা ভূতের গল্পও তো বানানো জিনিস, তা বলে যারা সেগুলো লিখেছেন তারা কি মিথ্যেবাদী?
যুক্তিটা ঠিক বুঝল না কৃষ্ণকান্ত। হাঁ করে কিছুক্ষণ বাবার দিকে চেয়ে থেকে বলল, ভূতের গল্প কি সত্যি নয় বাবা?
না। ভূত বলে কিছু নেই।
কিন্তু কম্পাউন্ডার কাকা যে মাকে মাঝে মাঝে দেখতে পায়!
ওটা তো পাগল। ও কী দেখে আর কী না দেখে তার কোনও মাথামুন্ডু আছে নাকি?
পক্ষীরাজ ঘোড়া! তাও কি নেই?
না। ওসব মানুষের কল্পনা।
কৃষ্ণকান্ত একটু ব্যথিত হল বোধহয়। কিন্তু চুপ করে ভাবতে লাগল।
হেমকান্ত একবার ভাবলেন শিশুমনের কল্পনাশক্তিকে আঘাত করে হয়তো কাজটা ভাল করলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল, তিনি যেমন অতিশয় কল্পনাপ্রবণ ও বাস্তববুদ্ধি বর্জিত হয়েছেন তেমনটা না হওয়াই কৃষ্ণকান্তর পক্ষে ভাল। অন্তত এই একজন কঠোর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন যুক্তিবাদী ও কর্মঠ হয়ে উঠুক।
হেমকান্ত ছেলের দিকে স্নেহভরে চাইলেন, বললেন, এসো, এখানে দাঁড়িয়ে কাকাকে একটা নমস্কার জানাও। শ্রদ্ধাবোধ বড় ভাল জিনিস।
কৃষ্ণকান্ত সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করে চোখ বুজল।
হেমকান্তও কিছুক্ষণ চোখ বুজে নলিনীকান্তকে স্মরণ করলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কত কথা মনে পড়ে গেল। তাদের তিন ভাইতে খুব সদ্ভাব ছিল, কিন্তু বাক্য বিনিময় বিশেষ হত না। তিন জনের প্রকৃতিই কিছু গম্ভীর। তা ছাড়া নলিনী নিজেকে সংসারের বাইরে নির্বাসিত করেছিল বলে তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আরও কম। বেঁচে থাকলে আজ নলিনীর বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হত। একটি সাইকেল ছিল তার অচ্ছেদ্য বাহন। কোথায় কোথায় চলে যেত সাইকেলে চেপে। বেলা অবেলা মানত না, নিয়মিত স্নান-খাওয়া ছিল না। তেলের অভাবে মাথার চুল পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করেছিল। গালে অযত্নের দাড়ি বেড়ে উঠত। সাধারণ টুইলের শার্ট আর ধুতিই ছিল তার পরিধান। পায়ে তালতলার চটি আর কাঁধে উড়নি। পাবনার এক আশ্রমের সঙ্গে ছিল তার গভীর যোগাযোগ। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে সে আশ্রমে গিয়ে বেশ কিছুদিন করে থেকে আসত। পাকাঁপাকি আশ্রমবাসী হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। কিন্তু মা বেঁচে থাকতে সেটা আর পেরে ওঠেনি। বড় ছেলে সন্ন্যাস নিয়েছে, ছোটটিও আশ্রমবাসী হলে মা শোকে মারা পড়তেন। কিন্তু আজ হেমকান্ত ভাবেন, নলিনী আশ্রমবাসী হলেই বোধহয় ভাল হত। বেঁচে তো থাকত।
বুড়ো মাঝি হারান এতক্ষণ সশ্রদ্ধভাবে চুপ করে ছিল। এখন হঠাৎ হাত জোড় করে বলে উঠল, কর্তা, কয়েকখানি কচি বেত কেটে নেব? বেতাইক খেতে বড় ভাল।
হেমকান্ত ঘাড় নেড়ে বললেন, আন।
কৃষ্ণকান্ত বলে, আমিও যাব বাবা?
হেমকান্ত বলেন, ভীষণ কাটা। সাবধানে যেয়ো।
হেমকান্ত শুষ্ক বালুকাময় তীরে বসলেন। হারান নৌকোর খোল থেকে একটা চকচকে দা বের করে বেতবনে চলল। সঙ্গে কৃষ্ণকান্ত। হেমকান্ত আনমনা চোখে দেখতে লাগলেন। হু হু করে হাওয়া কত জায়গা, কত গাঁ গঞ্জ ছুঁয়ে এসে তার কানে কত কী বলে যাচ্ছে ফিসফিস করে। বেলা দুপুরের খাড়া ও চড়া রোদে বড় তেতে আছে বালি। হেমকান্ত রোদকে অগ্রাহ্য করে বাতাসের কথা শুনতে লাগলেন।
বাতাস বলে, বহুদুরে এসে গেছ তুমি, বহু দূর। আর কি ফিরে যাওয়ার দরকার আছে? তোমার ছেলেকে নিয়ে মাঝি ফিরে যাক। তুমি বেরিয়ে পড়ো মহাপৃথিবীর দিকে।
হ্যাঁ, বাতাসের কথা তো এ নয়। এ হয়তো তারই গভীর অভ্যন্তরের কথা। বাতাসে সেই কথাই ছড়িয়ে যাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন তিনি। বেরিয়ে পড়া তাঁর কাছে সহজ নয় ঠিকই, আবার অসম্ভব কিছুও নয়। কিন্তু তিনটি ভাইয়ের মধ্যে বংশের সলতে জ্বলছে মাত্র একটি। তিনি চলে গেলে কৃষ্ণকান্তকে স্থানান্তরিত করা হবে। বিশাখার বিয়ে দিতে দেরি হবে না। ছেলেরা জমিদারিতে উৎসাহী নয়। আয় কমে যাচ্ছে, ঋণ বাড়ছে। তারা হয়তো গোটা সম্পত্তিই বিক্রি করে দেবে। বাড়ি অন্ধকার হয়ে যাবে।
না, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই হবে তাকে।
বাতাস ফিসফিস করে বলল, আর কোনও কারণ নেই? রঙ্গময়ি! রঙ্গময়ির কথা ভুলে গেলে! তোমার সবচেয়ে শক্ত বন্ধন!
বুকের বাঁ ধারে আবার সেই ব্যথা। অবোধ যন্ত্রণা। হেমকান্ত ফিসফিস করে বললেন, মনু সুখী হোক।
সুখ কি সোজা! জানো না, প্রিয় মানুষ ছাড়া মানুষের কোনও সুখই নয়! তুমি ছাড়া রঙ্গময়ির এই বিশ্ব দুনিয়ায় সুখের আর কে ভাগীদার আছে?
শুধু আমি! তা কেন? রঙ্গময়ির আছে সেবা, আছে দেশোদ্ধার, আছে স্বদেশপ্রীতি। আমি তো অপদার্থ।
সেসব যুক্তি কি বোঝে হৃদয়? বাল্যাবধি রঙ্গময়ি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে সে কি জানো না?
যদি এতদিনে রঙ্গময়ির বিয়ে হয়ে যেত তা হলে? তখন কোথায় থাকত সেই বাল্যপ্রেম, কোথায় থাকতাম আমি?
তুমি ঠিকই থাকতে। তার হৃদয়ের সংগোপনে এক কোণে। রঙ্গময়ির বিদ্রোহ ছিল অন্যরকম। বিয়ে ভাঙার জন্য নিজের নামে কলঙ্ক রটনাকে সে কি প্রশ্রয় দিত না! না দিলে সে অন্তত একবার তার নিন্দুকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত। তা না করে সে এসে ঝগড়া করত তোমার সঙ্গে।
তা ঠিক। কিন্তু আমি কী করব? আমার কী করার আছে?
রঙ্গময়ি তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধন। মহাপৃথিবীর দিকে যে অবারিত পথ তাতে সবচেয়ে বড় বাধা রঙ্গময়ি।
না।–নিঃশব্দে এক আর্তনাদ বুক থেকে উঠে এল হেমকান্তর।
শোনো, তুমিও রঙ্গময়ির জীবনে এক অভিশাপ। তোমাদের ওই বাড়ি, ওই সংসারে আজও সে দাসীর মতো পড়ে আছে এক অদ্ভুত মোহের জন্য। তা কি জানো? নইলে রঙ্গময়ির জন্যও ছিল অন্য এক পৃথিবী। সে তোমাকে ত্যাগ করতে পারে না।
হেমকান্ত মাথা নত করে বসে রইলেন।
বাবা, বাড়ি যাবেন না?–কৃষ্ণকান্তের আচমকা ডাকে চমকে ওঠেন তিনি।
চলো যাই।–বলে উঠলেন তিনি।
কৃষ্ণকান্ত এক গোছ বেত বয়ে এনেছে। কাঁটায় হাত রক্তাক্ত কিন্তু তার মুখে তৃপ্তির হাসি।
নৌকোয় ওঠার পর হেমকান্ত বললেন, হাত দুটো নদীর জলে ধুয়ে নাও।
কৃষ্ণকান্ত নৌকোর বাইরে ঝুঁকতেই হেমকান্ত বললেন, সাবধান। নদীতে কুমির আর কামট আছে। দেখে নাও।
কৃষ্ণকান্ত মাথা নাড়ল। শীতের জল স্বচ্ছ। দুপুরের রোদ বহুদূর জলের মধ্যে প্রবেশ করেছে। দেখে শুনে জলে হাত দিল কৃষ্ণকান্ত। কাটায় হাত ছড়ে যাওয়াতেও যে বাবা তাকে বকেননি এর জন্য সে কৃতজ্ঞ বোধ করে।
উজানে নৌকো বাইতে বেশ কষ্ট। এক জোড়া বইঠা হারানের হাতে। দ্বিতীয় জোড়া হেমকান্তর হাতে। তিনি গলদঘর্ম হচ্ছেন।
কৃষ্ণকান্ত হাত বাড়িয়ে বলল, আমি কিছুক্ষণ বাই, বাবা?
পারবে? হাত তো কেটে ফেলেছ!
ওটা কিছু নয়। পারব।
নাও।–ছেলের হাতে বইঠা দিয়ে হেমকান্ত ধুতির খোঁটায় মুখের ঘাম মুছলেন।
বাড়ি ফিরে আসার পর রঙ্গময়ি একটু রাগারাগি করল। এত বেলা পর্যন্ত একটা দুধের বাচ্চাকে নিয়ে টো-টো করে ঘুরে বেড়াও, তোমার হল কী বল তো! বেত কাটতে গিয়ে ছেলেটার হাত দুটো কী পরিমাণ কেটেকুটে গেছে! আচ্ছা বাপ যা হোক।
হেমকান্ত রঙ্গময়ির দিকে ভাল করে তাকাতে পারেন না। কেমন এক পাপবোধ তাকে ঘেঁকে ধরেছে ভুতের মতো। শুধু বললেন, কষ্ট করতে শিখুক, আঘাত সহ্য করতে অভ্যাস করুক। না হলে তোমার স্বদেশি দলে ভিড়বে কী করে?
স্বদেশি দলে ও কেন ভিড়বে? ও হচ্ছে জমিদারের ছেলে, ইংরেজ কর্তাদের পেয়ারের লোক।
ও তো জমিদারি চায় না। ও চায় স্বদেশি হতে।
তাই নাকি? তোমাকে বলেছে?
সরাসরি বলেনি। হাবে ভাবে বলছে।
তা হলে এখন থেকে সাবধান হও।
কী করে সাবধান হব? ও হচ্ছে একটা হাওয়া। যার গায়ে লাগে সেই বিগড়ে যায়। ওঝা-বদ্যির কাজ নয় যে সারিয়ে দেবে।
অতই যদি ভয় তবে কনক কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইছে, পাঠিয়ে দাও না কেন?
পাঠালেই বা কী হবে? ওর মনুপিসি যে ওর বারোটা বাজিয়ে রেখেছে।
রঙ্গময়ি একথায় হেসে ফেলল। বলল, তা হলে আমাকেই না হয় তাড়াও। ছেলের চেয়ে তো আমি বড় নই।
তাড়াব! ওরে বাবা।
কেন, আমাকে তাড়ানো কি খুব কঠিন?
তোমাকে তাড়াতে গেলে নিজেকেই না ভিটে থেকে উচ্ছেদ হতে হয়!
ওসব কথার কোনও মানে হয় না। আমি ভেবে দেখেছি, আমি গেলেই তোমাদের মঙ্গল।
কীসের মঙ্গল?
সব দিক দিয়েই মঙ্গল।
এটা রাগের কথা।–হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, মনু, বিশাখা কেমন মেয়ে?
রঙ্গময়ি অবাক হয়ে বলল, তার মানে? বাপ হয়ে নিজের মেয়ের কথা আমার কাছে জানতে চাইছ কেন?
বাপ হলেই যে নিজের মেয়েকে ভাল চেনা যাবে একথা তোমাকে কে বলল? বরং তুমি নিজে মেয়ে বলেই বিশাখাকে ভাল বুঝতে পারবে।
রঙ্গময়ি একটু বিরক্ত হল যেন। বলল, মেয়ে তো ভালই। কিন্তু কথাটা উঠল কেন হঠাৎ?
এমনি।
এমনি নয়। তোমার প্রশ্নের পিছনে কারণ আছে। বলো।
সেদিন হঠাৎ বিশাখার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মনে হল, ও স্বদেশিদের তেমন পছন্দ করে না।
রঙ্গময়ি হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ও আবার কোনদেশি কথা! বিশাখা স্বদেশিদের পছন্দ করতে যাবেই বা কেন?
হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, কথা সেটা নয়।
তবে আবার কী কথা?
কথা হল, তুমি বিশাখাকে প্রভাবিত করতে পারোনি। কেন পারোনি, মনু? অথচ কৃষ্ণকে পেরেছ।
রঙ্গময়ি একথায় হঠাৎ একটু দিশাহারা বোধ করে চুপ করে থাকে। তারপর ধীর স্বরে বলে, তোমাকে যতটা ন্যালাখ্যাপা আর উদাসীন দেখায় তুমি ততটা নও তা হলে?
আমি অপদার্থ মনু, সে তো জানোই।
না, আমি তা জানি না। কিন্তু তুমি এত লক্ষ করতে শিখলে কবে?
তা হলে ধরেছি ঠিক!
রঙ্গময়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বিশাখা আমাকে ভালবাসে, কিন্তু তবু ও একটু অন্যরকম। একটু নিজের মতো।
ও কি স্বার্থপর?
তা তো বলিনি।
তবে কী?
সাবধানি বলা যায়। মেয়েদের পক্ষে সাবধানি হওয়া ভাল।
ওর ধারণা আমি শশীকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম। কোথা থেকে যে ধারণাটা হল!
রঙ্গময়ি বলে, শশীর ব্যাপারটা ওর ভাল লাগেনি। কে জানে, সেইজন্যই হয়তো—
কথাটা শেষ করল না রঙ্গময়ি।
হেমকান্ত চোখ তুলে প্রশ্ন করেন, সেইজন্যেই কী?
আমি ভাল জানি না।
কী জানো না?
সে তুমি অন্যের কাছ থেকেই শুনতে পাবে। আমি যাই।
রঙ্গময়ি চলে গেলে হেমকান্ত ভুকুটি করে বসে থাকেন। কথাটা হয়তো ভাল নয়। তবু জানা দরকার।
০২০. রেমি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না
রেমি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারটা কী। তাদের বাচ্চা হবে, তাতে দুশ্চিন্তা বা ভয়ের কী? সে অবাক হয়ে ধ্রুবকে বললে, ওরকম করছ কেন?
ধ্রুব একটু হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, খবরটা এখন চেপে যাও।
তার মানে?
কাউকে কিছু বোলো না।
কেন বলব না?
কারণ আছে, তাই।
রেমি রেগে গিয়ে বলল, কী কারণ তা আমার জানা দরকার।
ধ্রুব বিব্রত মুখে বলে, কারণটা এখনই বলতে পারছি না।
জীবনে প্রথম মা হতে চলেছে রেমি, এই সংবাদ তার ভিতরে যে রোমহর্ষ, যে রহস্যময় আনন্দের এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল তা এক ফুৎকারে উড়ে গেল। তীব্র অপমানে ঝা ঝা করতে লাগল মুখচোখ। সে ধ্রুবর জামা খিমচে ধরে বলল, তোমাকে বলতেই হবে! তোমাকে বলতেই হবে! কী দোষ করেছি আমি?
ধ্রুব নিজেকে ছাড়িয়ে নিল না। শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল, আসলে কী জানো? আমাদের পরিবারের প্রথম সন্তান বাঁচত না। লোকে বলে, কে বা কারা যেন বিষ নজর দিয়ে এই অপকর্মটি করে। আমি অবশ্য এই সব কুসংস্কার বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই পরিবারের বউ পোয়াতি হলে খবরটা গোপন রাখাই নিয়ম। না হলে নাকি নজর লাগে।
একথায় রেমির রাগটা একটু ধাক্কা খেল। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সামলে সে বলল, কিন্তু এ খবর কি গোপন রাখা যায়?
যায়।–ধ্রুব মৃদু গলায় বলল, লোকের সামনে না বেরোলেই হয়।
সেটাও কি এই পরিবারের নিয়ম?
তাই তো জানি।
তোমরা শহরে বাস না করে আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে থাকলে ভাল হত। সেখানে মানাত তোমাদের।
ধ্রুব কাতর গলায় বলল, মানছি। কিন্তু তবু যে পরিবারে এসেছ সেই পরিবারের প্রচলিত নিয়মগুলো খামোকা ভাঙতে যেয়ো না।
তা বলে দশ মাস ঘরবন্দি থাকতে হবে?
তা নয়। বেরোবে মাঝে মাঝে। কিন্তু নিজের মুখে এখনই খবরটা কাউকে দিতে যেয়ো না।
রেমি ফুঁসতে লাগল, কিন্তু আর ঝগড়া করল না ধ্রুবর সঙ্গে। তবে তার মনে একটা সন্দেহ ওত পেতে রইল। ধ্রুব বোধহয় কথাটা বানিয়ে বলেছে। নজর লাগার ব্যাপারটা একদম বাজে। সম্ভবত এই অযৌক্তিক অনুরোধের পিছনে অন্য কোনও গৃঢ় কারণ আছে।
পরদিনই ধ্রুব তাকে নিয়ে গেল একজন গায়নোকোলজিস্টের কাছে। ডাক্তারটি গোমড়ামুখো এবং কম কথার লোক। তবে ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটি ভারী হাসিখুশি এবং ছলবলে। রেমিকে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা সে-ই করল। তারপর বলল, আপনি প্রেগন্যান্ট, একথা কী করে জানলেন?
রেমি অবাক হয়ে বলল, কেন বলুন তো! নই নাকি?
মনে তো হচ্ছে না।
কিন্তু আমি সব লক্ষণই টের পাচ্ছি।
মেয়েটি হেসে বলল, ওরকম কত ফিলিং হয় মেয়েদের!
তবে আমার কী হয়েছে?
মনে হচ্ছে ভিতরে একটা ব্লাড ক্লট প্যাসেজে আটকে আছে। ওটাকে রিমুভ করা দরকার।
কেন?
ওটা থাকলে নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বেশিদিন থাকলে ক্যানসার অবধি হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।
আপনি সেন্ট পারসেন্ট শিয়োর?
তা অবশ্য নই। তবে কাল আপনাকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি হতে হবে। আরও পরীক্ষা আছে। তারপর হয়তো একটা মাইনর অপারেশন করতে হবে।
রেমির মনটা আবার ঝাৎ করে ওঠে। কেমন একটা সন্দেহ ঘুলিয়ে ওঠে মনে। কিন্তু ডাক্তারের যা চকচকে চেম্বার, নানারকম গ্যাজেট, অ্যাসিস্ট্যান্টের হাবভাবের মধ্যে উঁচুদরের পেশাদারি দক্ষতা এসব দেখে সে উচ্চবাচ্য করল না। সে ডাক্তার নয়, বিশেষজ্ঞ নয়, সে কী করে সব কিছু জানবে?
কিন্তু সন্দেহ ছিল। বারবার উসখুস করে উঠছে একটা অস্বস্তি, অজানা ভয়। ফেরার পথে গাড়িতে সে ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?
কারা মানে?
উনি কি খুব ভাল ডাক্তার?
খুব ভাল। যে-কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারো।
জিজ্ঞেস করতে হবে না, রেমি জানে। খুব উঁচুদরের ডাক্তার ছাড়া কৃষ্ণকান্তর পুত্রবধূর চিকিৎসা আর কেউ করবে না।
রেমি মৃদুস্বরে বলল, ব্লাড ক্লট না কী যেন বলছিল মেয়েটা। ওরকম কি হয়?
না হলে বলছে কেন?
মা-মাসিদের কারও এরকম হয়েছে বলে শুনিনি।
শোনোনি বলেই কি হতে নেই?
আমার কেমন ভয় করছে। অন্য কোনও ডাক্তারকে দেখালে হয় না?
কাকে দেখাতে চাও?
আমার বাপের বাড়ির ডাক্তার হলেন অমিত গুপ্ত। ভাল গাইনি।
ধ্রুব একটু অবাক হয়ে রেমির দিকে চেয়ে বলল, বাপের বাড়ি?
রেমি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তার খেয়াল ছিল না, ধ্রুবদের পরিবারে যারা বউ হয়ে আসে তাদের অতীত মুছে ফেলেই আসতে হয়। কোনও সূত্রেই বাপের বাড়ির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিশেষ থাকে না। কথায়-কথায় বাপের বাড়ির রেফারেন্স দেওয়া বারণ, বাপের বাড়ির কোনওরকম সাহায্য নেওয়া বারণ, এমনকী ছোটখাটো নিমন্ত্রণেও সেখানে যাওয়া নিষেধ। রেমির অবশ্য এই নিয়ম মেনে নিতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। কৃষ্ণকান্ত তাকে অগাধ স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন, দেওরননদদের কাছ থেকেও সে যথেষ্ট আদর আর সহানুভূতি পায়। একমাত্র স্বামীটিই যা অন্যরকম। তবু এই সুদর্শন ও অদ্ভুত মানুষটির প্রতি এক রহস্যময় আকর্ষণ এবং একে আবিষ্কার করার এক নাছোড় নেশা রেমিয় শূন্যস্থানটি ভরিয়ে রেখেছে। বাপের বাড়িকে সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, কিন্তু ধ্রুবর ওই বাপের বাড়ি? প্রশ্নটি উচ্চারণে যে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ টের পেল সে, তাতে মন ফুসে উঠল হঠাৎ।
রেমি শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ। আমার বাপের বাড়ির রুগি দেখেন বলে তো আর অমিত গুপ্ত পচে যাননি।
রেমির কথার ঝঝে ওর মনের অবস্থাটা টের পেয়েই বোধহয় ধ্রুব কথাটা ঘুরিয়ে নিল। বলল, ভয় পেয়ো না রেমি, তোমাকে যিনি দেখছেন তিনি দেশের সবচেয়ে ভাল ডাক্তারদের একজন।
জানি। তবু বড় ডাক্তারদেরও ভুল হয়। আমি আর-একজন ডাক্তারকে দেখাতে চাই।
বেশ। দেখাবে।
কথা রেখেছিল ধ্রুব। পরদিন আরও একজন বড় ডাক্তার রেমিকে দেখল এবং অনেক রকম প্রশ্ন করল। কিন্তু রেমির প্রশ্নের জবাব দিল না। একটু স্নেহসিক্ত হাসিমুখে এড়িয়ে গেল বারবার।
রেমি কিছুতেই বুঝতে পারল না, তার গোলমালটা কী।
ফেরার সময় গাড়িতে ধ্রুব একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, আরও ডাক্তার দেখাবে? আরও আছে। কিন্তু!
রেমি স্থির চোখে সামনের দিকে চেয়ে উউনডস্ক্রিনের আয়ত চতুষ্কোণে দ্রুত গুটিয়ে আসা রাস্তা দেখছিল শূন্য চোখে। একটা চক্রান্ত! একটা গণ্ডগোল! একটা অদ্ভুত ও অর্থহীন ষড়যন্ত্র! নইলে তার বাচ্চা হবে শুনে প্রথম দিনই ধ্রুব অমন সাদা হয়ে গেল কেন?
রেমি ধ্রুবর কথার জবাব দিল না। বাড়ি ফিরে এসে শুধু বালিশে মুখ ঠেসে ধরে গোপনে কাঁদল কিছুক্ষণ।
পরদিন একটা চমৎকার ক্লিনিকে ভর্তি হল সে। প্রথমূবারের গোমড়ামুখো ডাক্তারটি এত নিপুণভাবে সেই রহস্যময় জমাট রক্তটি বের করে নিল যে রেমি কোনও শারীরিক যন্ত্রণা প্রায় টেরই পেল না। কিংবা পেলেও তা প্রকাশ করল না একটুও। দুটো দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁট বজ্রের মতো এঁটে থেকে ভিতরকার সব যন্ত্রণার শব্দকে আটকে রাখল। পরদিন একটু সাদা, একটু ক্লান্ত এবং একটু বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে সে ফিরে এল বাড়িতে। ধ্রুবর সঙ্গেই।
ধ্রুব সেদিন কোনও কথা বলল না। ঠাট্টা নয়, সান্ত্বনা নয়, কিছু না। সেই রাতেই সে অফিসের কাজে চলে গেল বোম্বাই। সাত দিন আর তার কোনও খবর নেই।
সেই সাত দিনের মধ্যেই অবশ্য কৃষ্ণকান্ত বিদেশ থেকে ফিরলেন। প্রচুর জিনিসপত্র এনেছেন। সেগুলো আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে হই হই করে বিলোলেন। রেমির জন্য এনেছিলেন ফরাসি ও জারমান কয়েক রকম সুগন্ধ, বিখ্যাত সব শিল্পের দামি প্রিন্ট, সোনার বালার সেট করা ঘড়ি, কাট গ্লাসের কিছু জিনিস।
এত দামি সব উপহার পেয়েও যে রেমির মুখে সত্যিকারের খুশি উপচে পড়ল না এটা লক্ষ করেছিলেন কৃষ্ণকান্ত। বুদ্ধিমান মানুষ তাই প্রথমেই জেরা করেননি। পরদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে উচ্চকিত হয়ে উঠলেন, সেই দামড়াটা কই? সেটা আবার কোথায় গেল?
দামড়াটা যে কোনওকালেই কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে বসে খায় না এটা সবাই জানে। তবু অভিনয়টা দেখালেন ভালই। রেমির দিকে চেয়ে বললেন, এই তল্লাটে আছে, না হিল্লিদিল্লি কোথাও গেছে?
নতমুখে রেমি বলল, বোম্বাই। অফিসের কাজে।
অফিস!–কৃষ্ণকান্ত চোখ বড় বড় করে বলল, আবার চাকরিতে ঢুকেছে নাকি? কোন কোম্পানির সর্বনাশ করছে এবার?
খাওয়ার পর রেমিকে স্টাডিতে ডেকে নিয়ে সুদর্শনের মেয়ের বিয়ে সম্পর্কে সব খুঁটিয়ে শুনলেন। সুদর্শনের সঙ্গে তার কতকালের ও কেমন বন্ধুত্ব তারও অনেক মজার ঘটনা বললেন। তারপর খুব নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে কেন এত রোগা দেখছি মা? দামড়াটার সঙ্গে কিছু আবার হয়নি তো!
না।–মৃদুস্বরে রেমি বলে।
কৃষ্ণকান্ত খুব উদার গলায় বলেন, আমি তো তোমাকে বলেই দিয়েছি, লোকে কন্যা সম্প্রদান করে, আমি করেছি পুত্র সম্প্রদান। কী করলে ওর ভাল হয় তুমি বুঝে দেখো। লাঠৌষধিতেও আমার আপত্তি নেই।
রেমি জবাব দিল না।
কৃষ্ণকান্ত একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আসলে রক্তটা তো খারাপ নয়। কুসঙ্গে পড়েছে। বলে ওরকম। আদর্শ নেই, লক্ষ নেই, আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। এই যুগের ছেলেরা যেমন হয় আর কী। সবচেয়ে বড় কথা, দেশাচার লোকাঁচার বা ট্র্যাডিশনের প্রতিও শ্রদ্ধা নেই। আমি একটু প্রাচীনপন্থী ঠিকই। কিন্তু এটাও ঠিক যে, একটা দেশের প্রথা, লোকাঁচার, অভ্যাসের মধ্যেই একটা জাতির ব্যক্তিত্ব। মাঝেমধ্যে সেইসব প্রথা প্রকরণের সংশোধন পরিমার্জন করতে হয়, কিন্তু বিনাশ করা ভাল নয়। কিন্তু এই দামড়াটা যে যুগে জন্মেছে এটা হল ব্যক্তিত্বহীনতার যুগ। কী মানে, কী মানে না, সেটাও বোঝে না ভাল করে। ওকে কেউ যদি স্বক্ষেত্রে ফেরাতে পারে তো সে তুমি। বলেছি তো, রক্তটা খারাপ নয়, একটু শুধু গোড করা দরকার।
রেমি অনেকক্ষণ শুনল। তারপর খুব মৃদু স্বরে বলল, আপনি চিন্তা করছেন কেন? আমার সঙ্গে কোনও গণ্ডগোল হয়নি। অফিসের কাজেই বোম্বাই গেছে।
কৃষ্ণকান্ত একটু অবাক হয়ে বললেন, তা হলে তোমার এ চেহারা কেন? শরীর ভাল তো?
রেমি একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, একটু খারাপ হয়েছিল। এখন সেরে গেছে।
কৃষ্ণকান্ত একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলে বললেন, তা হলেই ভাল। তোমার জন্য আমি খুব ভাবি। একটু বেশিই ভাবি।
রেমি সেটা জানে। তার কথা কৃষ্ণকান্ত ভাবেন। দুনিয়ার আর-কেউ যদি না-ও ভাবে, তবু কৃষ্ণকান্ত ভাবেন। রেমির সামান্য গাম্ভীর্য বা ক্ষণিক বিষণ্ণতাও তার নজর এড়ায় না। একজন ব্যস্ত মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদের পক্ষে সেটা এক মস্ত স্নেহের প্রকাশ। আর এই জন্যই এই লোকটির প্রতি রেমিরও আছে এক অন্ধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। অন্ধই। কারণ রেমি জানে, লোকটি স্বেচ্ছাচারী, আত্মম্ভরী, পরিবার-সচেতন এবং ক্ষমতাপ্রিয়।
কৃষ্ণকান্ত সেদিন ভারী নরম হয়ে পড়লেন। আস্তে আস্তে নিজের জীবনের কিছু কথা বললেন রেমিকে। বললেন, মাতৃস্নেহ কাকে বলে আমি জানি না। তোমার শাশুড়ির সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিল সামান্য। আমি হয় জেল খাটতাম, না হয় আন্দোলন করে দেখোদ্ধারে মেতে থাকতাম। ছেলেবেলায় একমাত্র ছিল আমার ছোড়দিদি আর বাবার সঙ্গ। সেও বড় একটা পাওয়া যেত না। বাবা ছিলেন গম্ভীর ও অন্যমনস্ক মানুষ। ছেলের দিকে নজর দেওয়ার রীতিও ছিল না তখন। তবু ছিটেফোঁটা যা ভালবাসা পেয়েছিলাম তা তার কাছ থেকেই। সেটুকুই সম্পদ।
কৃষ্ণকান্ত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু ও অদ্ভুত করুণ গলায় বললেন, মা গো, নিজের জনেরা কেউ আমাকে মানুষ বলেই ভাবল না। তারা ভাবে, আমি বুঝি নরদেহে এক পাথরের মূর্তি। আমার বুঝি-বা হৃৎপিণ্ড নেই, মগজ নেই, বোধশক্তি নেই, সুখদুঃখ নেই। বাইরের লোকেরা আমাকে যে চোখে দেখে, ঘরের লোকেরাও সেই চোখে দেখে। একজন নেতা। আর কিছু নয়।
তা কেন বাবা?
কৃষ্ণকান্ত খুব মলিন একটু হেসে বললেন, তোমার কথা বলিনি। একমাত্র তুমিই বোধহয় একটু আলাদা। একটু অন্যরকম। কিন্তু বেশির ভাগ সংসারই মানুষের সদগুণগুলি নষ্ট করে দেয়। ছাড়ানকাটান নেই। ভাবি ওই দামড়াটার সঙ্গ করে করে তুমিও বুঝি একদিন আমাকে ঘেন্না করতে শিখে যাবে।
রেমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। ধরা গলায় বলল, না বাবা, কক্ষনও নয়।
কিন্তু প্রতিজ্ঞাটা টেকেনি রেমির। টিকল না ধ্রুবর জন্যই।
বোম্বাই থেকে ধ্রুব ফিরলই মাতাল অবস্থায়। কিংবা এও হতে পারে, এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি আসার পথে কোথাও নেমে গলা অবধি খেয়ে এসেছিল। এসেই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল, ভাঙো, ভাঙো, ভেঙে ফেললা বাড়ি ঘর। রোলার চালিয়ে দাও। বদমাশ, খুনিয়া, শয়তান, ভণ্ড এইসব মানুষের মুখোশ খোলো। শালারা পলিটিকস করে! আঁ! পলিটিকস! খোয়াড়ে ছাগলগুলো পর্যন্ত এদের চেয়ে অনেক বেশি ওয়েল-বিহেভ৬।
লোকজন গিয়ে ধরে আনল ধ্রুবকে। ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল।
কিন্তু তারপর দিন থেকেই ধ্রুব ফিরে গেল তার পুরনো চরিত্রে। সারাদিন মদ খায় হল্লা করে। কখনও বাড়ি ফেরে, কখনও ফেরে না। বোম্বাই থেকে ফেরার পর প্রায় মাসখানেক ধ্রুবকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখল না রেমি।
কৃষ্ণকান্ত দোতলায় আলাদা একটা ঘর ঠিক করে দিয়ে বললেন, ওঘরে তোমার অসুবিধে হলে এখানে এসে থেকো। দামড়াটা কখন কী কাণ্ড করে বসে তার তত ঠিক নেই।
রেমি সেইটেই সঙ্গত প্রস্তাব বলে মেনে নিয়েছিল। ধ্রুবর ঘরে রাত্রিবাস সে প্রায় ছেড়েই দিল। তা বলে যে ধ্রুব তাকে কোনওদিন প্রশ্ন করেছে তাও নয়। প্রশ্ন করলে বা জোর করে রেমিকে ধরে নিয়ে গেলেই বোধহয় রেমি খুশি হত। কিন্তু ধ্রুব সেই ধাতুতে গড়া নয়।
রেমি একদিন টের পেল, ধ্রুব সন্ধেবেলায় তার ঘরে আছে এবং খুব একটা হল্লা করছে না। চেঁচিয়ে কার কাছে যেন জল চাইল এবং ঘরের টেবিল-ল্যাম্পের বালবটা ফিউজ হয়ে গেছে বলে কিছুক্ষণ রাগারাগি করল। তারপর চুপচাপ।
রেমিকে ভূতে পেল সেদিন। ধ্রুবকে ধরতেই হবে আজ। ওর মুখ থেকে শুনতে হবে, কেন ও এরকম।
পা টিপে টিপে রেমি নেমে গেল নীচে। ভেজানো দরজা ফাঁক করে দেখল, ধ্রুব বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। এই একটা কাজ ধ্রুব করে। খুব বই পড়ে। প্রায়ই সেগুলো অর্থনীতি বা সমাজদর্শন বা অনুরূপ কঠিন বিষয়ের বই।
রেমি ঘরে ঢুকে বইটা বিনা ভূমিকায় কেড়ে নিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার অত কথা কীসের?
থাকলে কী করব?
আমার বেশি কথা ভাল লাগে না।
আমি কি বেশি কথা বলি?
তা একটু বলো। মেয়েরা বড্ড বাজে বকে।
আমি জানতে চাই, তুমি এরকম করছ কেন?
কী রকম করছি।
আবার মদ খাচ্ছ!
আমি তো বরাবর খাই। যোলো-সতেরো বছর বয়স থেকে।
মাঝখানে খেতে না তো!
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল, খাই তো নিজের পয়সায় খাই। তোমার বাপের পয়সায় খাই না, তোমার শ্বশুরের পয়সাতেও খাই না।
পয়সার কথা উঠছে না। খাও কেন? কী হয়েছে?
কিছু একটা হয়েছে।
আজ খেয়েছ?
খেয়েছি।
কতটা?
বেশি নয়। তিন পেগ। নেশা হয়নি। এখন আবার খাব। তুমি সেফলি কেটে পড়ে ওপরের ঘরে গিয়ে দরজা দাও। পারলে শ্বশুরকে দরজায় পাহাবা বসিয়ে রেখো। লাঠি হাতে গোঁফে তা দিতে দিতে বউমাকে পাহারা দেবে, যেন ছেলে গিয়ে তার সতীত্ব নষ্ট না করে।
তুমি গেলে কি আমার সতীত্ব নষ্ট হয়? যাও না কেন? গেলেই তো পারো। গিয়ে দেখো, কেউ তোমাকে আটকায় কি না।
ইজ ইট অ্যান ইনভিটেশন?
ধরো তাই।
আমি দোতলায় উঠি না। ওটা একজন নখদন্তহীন অথর্ব ও কুম্মাণ্ড মন্ত্রীর এলাকা।
উনি তোমার বাবা।
যা, দুর্ভাগ্যক্রমে।
ঠিক আছে, ওপরে যেতে না চাও, না যাবে। আমি কি আসব?
না। তোমাকে আমার দরকার তো নেই।
তোমাকে আমার আছে।
না, আমাকেও তোমার দরকার নেই।
আমার ওপর রাগ করেছ?
না। আলমারি থেকে হুইস্কির বোতলটা বের করে আনো। খেতে খেতে একটু কথা কই।
রেমি দাঁতে দাঁত পিষে তাই করল। ধ্রুবর মুখ থেকে তার কথা বের করাটা দরকার। অনেকটা হুইস্কি খাওয়ার পর ধ্রুব বলল, কী বলতে এসেছ?
তুমি আবার মদ খাচ্ছো কেন?
আমার খুব দুঃখ হয়েছিল, তাই।
কীসের দুঃখ?
বাচ্চাটার জন্য।
কোন বাচ্চা?
আমার বাচ্চা।
রেমি কেঁপে উঠল। বলল, কী বলছ?
ধ্রুব মাথা নাড়ল, ওটা ব্লাড ক্লট নয়। বাচ্চা।
০২১. রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীন
রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীন ল পাস করে ওকালতি শুরু করেছে সবে। শোনা যাচ্ছে কাছারিতে সে আরগুমেন্ট ভালই করে। হেমকান্তর পুরনো উকিল গগন তালুকদার বড়ই বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কোর্ট-কাছারি বড় একটা যান না। নতুন একজন উকিল নিয়োগের কথা বহুদিন ধরেই ভাবছেন হেমকান্ত। কিন্তু অলস লোকের যা স্বভাব। ভাবেন তো কাজে আর হয়ে ওঠে না। কাকে রাখবেন সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
শচীনের কথা তাকে বলল রঙ্গময়ি। এসব খবর রঙ্গময়ির খুব ভাল রাখার কথা নয়। কিন্তু একদিন সে সকালে এসে সোজা বলল, গগনবাবুর তো নখদন্ত বলে আর কিছু নেই। কথা বলতে গেলে নালে-ঝোলে একাকার হয়। এই বুড়োকে দিয়ে তোমার মামলা-টামলা চলবে?
হেমকান্ত অবাক হয়ে বলেন, মামলা কীসের?
মামলা লাগতে কতক্ষণ? রামকান্ত দারোগা যে তোমাকে কী একটা লিখে দিতে বলেছিল, লিখেছ?
না, হয়ে ওঠেনি।
তোমার তো আজকাল কিছুই হয়ে উঠছে না। শুধু ছেলে নিয়ে নৌকো চালালেই হবে? ওটাও তো গোল্লায় যাচ্ছে। বইপত্র ছোঁয় না।
হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার দরকার কী? উকিলের কথাটা হঠাৎ তুললে কেন?
রামকান্ত দারোগা রোজ লোক পাঠাচ্ছে তোমাকে কী সব লিখে দেওয়ার জন্য।
কেন?
বাঃ, পুলিশ এখন শশিভূষণের নামে মামলা আনবে না? তুমি তাদের সাক্ষী যে!
ও, এই কথা! কিন্তু স্টেটমেন্ট লেখাও ঝকমারি, কাকে উকিল রাখা যায় বলো তো!
আমি তো শচীনের কথা বলি, অল্প বয়স, বুদ্ধিসুদ্ধি খুব।
শচীনকে ভালই চেনেন হেমকান্ত, রাজেনবাবুর বাড়ির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাও অনেক দিনের। রাজেনবাবু ঢাকার লোক। ময়মনসিংহে আসেন ফৌজদারি মামলার ছড়াছড়ি দেখে। খুবই সামান্য আয়ে আইনের ব্যাবসা শুরু করেন। মুক্তাগাছার এক জমিদার নলিনীরঞ্জন। তার ছেলেকে পড়াতেন। সেই সূত্রে শহরে একটু বসতের জমি পান। আস্তে আস্তে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছেন এখন। দুর্গাবাড়িতে একখানা বাড়ি করেছেন। সেখানে দুর্গোৎসব পর্যন্ত হয়। শচীন তার ছোট ছেলে। বেশ সুপুরুষ, লম্বা ছিপছিপে চেহারা, গান-টানও গায়।
শচীনের নিয়োগে আপত্তির কিছু নেই। হেমকান্ত বললেন, তা হলে ওকে একটু ডেকে পাঠাও।
রঙ্গময়ি একটু কুটিল চোখে হেমকান্তর দিকে চেয়ে ছিল। এরপর বলল, একটু বুঝেসুঝে কথাবার্তা বোলো, আর ছেলেটিকে ভাল করে লক্ষও কোরো।
হেমকান্ত অবাক হয়ে বলেন, শচীনকে আর লক্ষ করার কী আছে? ছোট থেকে দেখছি।
তোমার মতো ক্যাবলা দুটি নেই। শচীন শুধু উকিলই নয়, একজন সৎ পাত্রও বটে। তোমাদেব পালটি ঘর।
হেমকান্ত থতমত খেয়ে বলেন, ও বাবা, তুমি অনেকদূর ভেবে ফেলেছ দেখছি।
ভাবতেই হয়। মেয়ে বড় হচ্ছে, কিন্তু বাপের কোনও দুশ্চিন্তা নেই, কাজেই পাড়া পড়শিকেই ভাবতে হয়।
হেমকান্ত খুব হাসলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা দেখা যাবে।
আর-একটা কথা।
বলো।
শশীর হয়ে মামলা লড়ার কেউ নেই।
বরিশালে ওর বাবা আছে।
তা আছে। কিন্তু ভদ্রলোক খুব গা করছেন না বলে শুনেছি।
কেন, গা করছে না কেন?
বাপ হচ্ছে সেই সৎ মায়ের পোষা ভেড়ার মতো। শশীকে নাকি ত্যাজ্যপুত্রও করেছে। আমার মনে হয় না, শশীর বাপ উকিল-টুকিল লাগাবে।
হেমকান্ত গম্ভীর হয়ে বলেন, লোকটাকে তো চাবকাতে হয়।
সে যখন হাতের কাছে পাবে তখন চাবকিয়ে। কিন্তু এখন তো অবস্থাটা সামাল দেওয়া দরকার।
আমার কী করার আছে?
শচীনকে একটু বোলো।
শচীন!
ছেলেটা ভাল। বুদ্ধি রাখে। পয়সার পিশাচও নয়। তুমি বললে হয়তো শশীর পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে। তোমাকে কোনও বিপদের ঝুঁকি নিতে হবে না। ভয় পেয়ো না।
হেমকান্ত রঙ্গময়ির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখের হাসি ধীর ধীরে মুছে গিয়ে একটা কঠোরতা ফুটল। ধীর স্বরে বললেন, মনু, তোমরা আমাকে সবাই একটু ভুল বুঝলে।
রঙ্গময়ি বুঝি একটু লজ্জা পেল। বলল, আমাদের মেয়েমানুষে বুদ্ধি, ওগো রাগ কোরো না। তুমি গম্ভীর হলে আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়।
হেমকান্ত খুব ম্লান একটু হেসে বললেন, থাক, আর মন-রাখা কথা বলতে হবে না, মনু। শচীনকে খবর পাঠাও। যা বলবার আমিই বলব।
বিকেলে কাছারির কাজ শেষ করে শচীন এল। রুচিবান ছেলে। বাড়ি গিয়ে উকিলের পোশাক ছেড়ে ধুতি পাঞ্জাবি শাল চাপিয়ে এসেছে। ভারী সুন্দর চেহারাটি। কমনীয় মুখশ্রীতে বুদ্ধির দীপ্তি ঝলমল করছে। হৈমকান্তকে প্রণাম করে সামনে বসল।
রঙ্গময়ির পরামর্শমতো ছেলেটিকে ভাল করেই লক্ষ করলেন হেমকান্ত। চমৎকার ছেলে, সন্দেহ নেই। এই ছেলে এ বাজারে এখনও পড়ে আছে সেটাই বিস্ময়ের।
হেমকান্ত বললেন, ঘটনাটা কি শুনেছ? শশিভূষণ নামে একটি ছেলে যে আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল!
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সেটা নিয়েই গোলমাল। দারোগা রামকান্তবাবু আমার একটা বিবৃতি চাইছেন। সেটা কি দেওয়া উচিত বলে মনে করো?
শচীন বলল, স্টেটমেন্ট এখনই দেওয়ার দরকার নেই। মামলা উঠুক, তখন দিলেও চলবে।
দারোগা আমার কাছে কীরকম স্টেটমেন্ট চাইছে তা আন্দাজ করতে পারো?
শচীন মৃদু একটু হেসে বলল, তা বোধহয় পারি। উনি সম্ভবত আপনার কাছ থেকে একটা মুচলেকা আদায় করতে চাইছেন।
উদ্দেশ্যটা কী?
উদ্দেশ্য, শশিভূষণকে ফাসানো, তার বিনিময়ে আপনি আপনার নিরাপত্তা কিনে নিতে পারবেন।
হেমকান্ত গম্ভীর হয়ে বলেন, আর যদি সেরকম মুচলেকা না দিই?
তা হলে পুলিশ আপনাকেও ফাঁসানোর চেষ্টা করবে।
মামলাটা তুমি নেবে?
শচীন বিনীতভাবে ঘাড় হেঁট করে বলে, নিতে পারি।
আমাদের পুরনো উকিল গগনবাবু বুড়ো হয়েছেন। আমি সেই জায়গাতেও তোমাকে অ্যাপয়েন্ট করতে চাই।
যে আজ্ঞে।
তা হলে কাল থেকেই গগনবাবুর সঙ্গে বসে সব কাগজপত্র বুঝে নাও।
যে আজ্ঞে।
আমার এস্টেটের অবস্থা বিশেষ ভাল নয়। খাজনা আসে খুব সামান্য। আদায়-উসুল করার লোক নেই। প্রজাদের হাতে নাকি নগদ টাকারও খুব অভাব।
শচীন মৃদু স্ববে বলে, একটা ডিপ্রেশন চলছে ঠিকই।
ছেলেরা চায় জমিদারি বেচে দিই, তুমিও কি তাই বলো?
শচীন একটু ভেবে নিয়ে বলল, দেখাশোনার লোক না থাকলে অবশ্য জমিদারিটা একটা লায়াবিলিটি হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু এখনই বেচার কথা ভাবছেন কেন? আমি আগে কাগজপত্র দেখি।
তুমি তো দেখবে আইনের দিকটা, হিসেবপত্র দেখবে কে? আমি নতুন করে গোটা এস্টেটের একটা অ্যাসেসমেন্ট করতে চাই।
শচীন বলে, সেটাও খুব শক্ত হবে না। দলিল-টলিলগুলো আমাকে দেবেন। দেখে দেব। আপনার ম্যানেজার মশাইয়ের সঙ্গেও একটু বসা দরকার।
বেশ, সে ব্যবস্থাও হবে। তা হলে আমি নিশ্চিন্ত?
আগে সব দেখি।
শশিভূষণের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা সাজিয়েছে বলে কিছু জানো?
শচীন মাথা নেড়ে বলে, এখনও দেয়নি। তবে হাসপাতাল থেকে আজই তাকে হাজতে নেওয়া হয়েছে।
হেমকান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা হলে ছেলেটা ফাঁসিতে মরার জন্যই বেঁচে উঠল!
ফাঁসি যে হবেই তা বলা যায় না।
শশীকে তুমি বাঁচাতে পারবে?
শচীন চিন্তিত মুখে বলে, পুলিশের কাছে সে কী বলেছে তা তো জানি না। পুলিশই বা কী পয়েন্ট দিয়েছে তাও দেখা দরকার। আপনি বললে আমি শশীর সঙ্গে দেখা করতে পারি।
করো।
কিন্তু একটা কথা আছে।
কী কথা?
আমি একা গেলে সে হয়তো আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারবে না।
আমি যদি তোমার সঙ্গে যাই?
শচীন একটু দ্বিধা করল। কী যেন বলি বলি করেও সামলে নিয়ে বলল, তার হয়তো দরকার হবে না। শশীকে আমি কনভিনস করতে পারব।
আমি যাব না বলছ?
দরকার হলে বলবখন। তখন যাবেন।
হেমকান্ত উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, ছেলেটাকে আমার একটু দেখতেও ইচ্ছে করছে। আমার বাড়িতে কয়েকদিন ছিল, কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় ভাল করে কথাও হয়নি। না, চলো, কাল আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
শচীনের মুখে আবার সেই দ্বিধার ভাবটা দেখা গেল। মৃদুস্বরে বলল, আপনার এখন না যাওয়াই বোধহয় ভাল।
কেন বলো তো?
শচীন মৃদু একটু হেসে বলল, শহরে একটা গুজব রটেছে। লোকের ধারণা এ বাড়ি থেকে শশীকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হেমকান্ত চমকে উঠে বলেন, সে কী? কে রটাল?
গুজব রটানোই তো কিছু লোকের কাজ। আমার মনে হয় শশীরও সেরকমই ধারণা।
কেন, শশীর এরকম ধারণা হওয়ার কারণ কী?
কোনও কারণ নেই। তবে শহরের গুজবটা তার কানে পৌঁছানোই সম্ভব।
হেমকান্তকে ভারী ক্লান্ত দেখাল। বললেন, লোকে একথা বিশ্বাস করে?
হয়তো সবাই করে না।
তুমি করো?
না। আপনাকে আমি শিশুবয়স থেকে দেখে আসছি। এই পরিবারের কোনও লোক কখনও ছোট কাজ করেনি।
হেমকান্ত একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, না, আমরা ছোট কাজ সহজে করি না। শশীকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
আমি জানি। বরিশাল মার্ডার কেস নিয়ে খুব তোলপাড় হচ্ছে। শশীর পক্ষে দলছুট হয়ে লুকিয়ে থাকা এমনিতেই সম্ভব ছিল না।
তুমি অনেক জানো দেখছি।
কিছু খবর রাখি। ওকে যারা প্রোটেকশন দিতে পারত তাদের সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারেনি। তা ছাড়া আর-একটা নির্দেশ ছিল ওর ওপর। সেটাও ও মানেনি।
কী সেটা?
কথা ছিল, মার্ডারের পর সুইসাইড করবে।
হেমকান্ত শিউরে ওঠেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তুমি কী করে জানলে?
মনুদিদির কাছে ও নিজেই বলেছে।
কই, মনু তো আমাকে বলেনি!
আপনাকে আমোক বিরক্ত করতে চাননি।
তোমাকে কবে বলল?
পরশু মনুদিদি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখনই বলেন।
শশী সুইসাইড করল না কেন?
সেটা বোঝা মুশকিল। হয়তো শেষ সময়ে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। পিস্তলের গুলিও ফুরিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। বাচ্চা ছেলে তো!
হেমকান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু আমার সম্পর্কে ওর ভুল ধারণাটা যে ভাঙা দরকার। কী করব বলতে পারো?
এখন কিছু করার দরকার নেই। আগে আমি ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি।
মনু কি ছেলেটার সঙ্গে দেখা করেছে?
না, উনি চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশ দেখা করতে দেয়নি।
ঠিক আছে। আগে তুমিই দেখা করো।
যে আজ্ঞে।
মামলা কবে নাগাদ উঠবে?
তা বলতে পারি না। তা ছাড়া মামলা তো এখানে হবে না। শশীকে বরিশালে চালান দেওয়া হবে। মামলা উঠবে সেখানে।
এখানে হয় না?
সেটা নরমাল প্রসিডিওর নয়।
তুমি কি বরিশালে গিয়ে মামলা লড়তে পারবে?
তা পারা যাবে না কেন? ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।
আচ্ছা, তোমার ওপর অনেক দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিলাম।
তাতে কী?
পারবে তো সব সামলাতে? চেষ্টা করব।
শচীন চলে যাওয়ার পর হেমকান্ত অনেকক্ষণ শচীনের কথাই ভাবলেন। ছেলেটি অতি চমৎকার। এই ছেলেটিকে যদি জামাই করেন তবে সব দিক দিয়েই তার ভাল হয়। বিষয় আশয় এবং মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে ভাববার মতো একজন লোক পেলে জীবনটা তিনি নিশ্চিন্তে কাটাতে পারেন।
হেমকান্তর ঘরের বাইরেই ওত পেতে ছিল কৃষ্ণকান্ত। শচীন বেরিয়ে আসতেই ধরল, শচীনদা, কী কথা হল?
শচীন একটু হেসে বলে, তা দিয়ে তোর কী দরকার?
আমার দরকার আছে। তুমি শশীদাকে বাঁচাবে?
আমি বাঁচাতে যাব কোন দুঃখে?
বাবা তোমাকে শশীদার উকিল ঠিক করেনি?
করলেই বা। উকিল কি ভগবান?
সি আর দাশ কীরকম আরগুমেন্ট করেছিল জানো?
খুব পেকেছিস দেখছি।
শচীন নীচে এসে বার-বাড়িতে রাখা তার সাইকেলটা টেনে নিয়ে বলে, শশীকে নিয়ে তোকে অত ভাবতে হবে না। লেখাপড়া কর।
করছি। আমি উকিল হব।
তাই নাকি?
উকিল হয়ে শুধু স্বদেশিদের হয়ে মামলা লড়ব।
বলিস কী? শুধু স্বদেশিদের মামলা লড়লে যে পেট চলবে না।
আমি তোমার সাইকেলের রডে একটু উঠি শচীনদা?
ওঠ। কিন্তু তোর মতলবখানা কী?
চলোই না, বলছি।
শচীন সাইকেলের রডে কৃষ্ণকান্তকে নিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এল। রাস্তা মোটেই ভাল নয়। ইটের রাস্তায় গর্ত, উঁচু-নিচু।
সাইকেল চালাতে চালাতে শচীন বলল, এবার বল।
ছোড়দিকে তোমার পছন্দ হয়?
শচীন একটু থতমত খেয়ে হেসে ওঠে। বলে, আমার পছন্দ হলে তোর কী লাভ?
তোমার সঙ্গে ছোড়দির বিয়ের কথা চলছে, জানো?
শচীন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, না তো! তোকে কে বলল?
মনুপিসি। বলেনি ঠিক। বাবাকে বলছিল, আমি শুনেছি।
তাই নাকি?
তুমি ছোড়দিকে বিয়ে করবে?
দূর ফাজিল!
ছোড়দি সুন্দর না?
কে জানে!
লোকে বলে, ছোড়দি নাকি খুব সুন্দর।
তা হবে।
কিন্তু ছোড়দির একটা দোষের কথা তোমাকে বলে দিই। রেগে গেলে কিন্তু ছোড়দির নাকের ডগা নড়ে।
শচীন এত জোরে হেসে ফেলল যে, সাইকেল বেসামাল হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ফের সামলে নিয়ে সে বলল, আর কী দোষ আছে রে তোর ছোড়দির?
ভীষণ হিংসুটে। খুব মিথ্যে কথা বলে।
তাই নাকি? তা হলে ওকে তো বিয়ে করা উচিত নয়।
না, না। করো। ছোড়দি এমনিতে ভালই। তোমাব সঙ্গে বিয়ে হলে ছোড়দি তো কাছাকাছিই থাকবে, তাই না?
ও, সেইজন্যই আমাকে বিয়ে করতে বলছিস?
শচীন আবার হাসতে থাকে।
রঙ্গময়ি বিশাখার চুল বেঁধে দিল সেদিন বিকেলে। তারপর বলল, বাপ তো বোম ভোলানাথ, মেয়ের বয়সের দিকে লক্ষই নেই। কিন্তু এই বয়সে কি ঘরে রাখা যায়!
কথাটা শুনল বিশাখা। কোনও মন্তব্য করল না।
রঙ্গময়ি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীনকে তো দেখেছিস!
বিশাখা একটু বিস্ময়ভরে চেয়ে বলে, দেখব না কেন? সুফলার দাদা তো!
তার কথাই বলছি।
তার কথা কেন?
তোর বাবার খুব ইচ্ছে, ওর সঙ্গে তোর সম্বন্ধ করে।
ওর সঙ্গে?–বলে বিশাখা যেন আকাশ থেকে পড়ে।
কেন, ছেলেটা খারাপ নাকি? কী চমৎকার রাজপুত্রের মতো চেহারা!
বিশাখা একটা ঝামটা মেরে বলে, হলেই বা! মোক্তারের ছেলেকে বিয়ে করতে যাব কেন? আর পাত্র জুটল না।
রঙ্গময়ি বলে, মোক্তারের ছেলে তো কী! ও নিজে তো উকিল। ওরকম উকিল গন্ডায়-গন্ডায় আছে। তোর পছন্দ নয়?
দুর! —বলে প্রস্তাবটা একদম উড়িয়ে দিল বিশাখা।
রঙ্গময়ি স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এমন পাত্র তোর পছন্দ নয়! সত্যিই পছন্দ নয়?
বিশাখা বিরক্ত হয়ে বলে, আমি কি তোমাদের পথের কাঁটা পিসি যে, ধরে বেঁধে জলে ফেলে দিতে চাও?
জলে ফেলে দেওয়া কি একে বলে?
তা ছাড়া আর কী? আমার কোনও দিদির কি এরকম ঘরে বিয়ে হয়েছে?
রাজেন মোক্তারও তো গরিব নয়।
একসময়ে তো ছিল। ওদের বাড়ি থেকে মার কাছে প্রায়ই লোক আসত চাল, টাকা, পুরনো কাপড় চাইতে।
সে তো কবেকার কথা!
তা হোক। ওদের সংসারে বউ হয়ে আমি যেতে পারব না। বরং তোমাদের অসুবিধে হলে বোলো, পুকুরে ড়ুবে মরব।
আমাদের অসুবিধে আবার কী? বারবার ওকথা বলছিস কেন?
হচ্ছে বলেই বলছি।
কীসের অসুবিধে? কার অসুবিধে?
অত জানি না। মনে হল, তোমাদের দুজনের একটু অসুবিধে হচ্ছে আমি থাকতে।
রঙ্গময়ি নিঃশব্দে পালিয়ে গেল।
০২২. কূট সন্দেহ
কূট সন্দেহ যখন সত্য হয়ে দেখা দিল অবশেষে, তখন রেমির সত্যিকারের ঘেন্না এল ধ্রুবর ওপর। আর রাগ। পারলে সে লোকটাকে খুন করে।
দুহাতে জামা খামচে ধরে ধ্রুবকে এত জোরে নাড়া দিতে লাগল সে যে মাতাল ধ্রুবর মাথাটা লটপট করতে লাগল ঘাড়ের ওপর। বুঝি-বা ঝাঁকুনিতে খসে পড়ে। চিৎকার করে রেমি জিজ্ঞেস করতে লাগল, কী বললে? ঠিক করে বলো! স্পষ্ট করে বলো! বলো! নইলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলব!
ঝাঁকুনির চোটে ধ্রুব কেমন ভ্যাবলা হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে পারছিল না। হাঁফাতে হাফাতে শুধু একবার অতি কষ্টে বলল, মাইরি! তোমার গায়ে তো সাংঘাতিক জোর!
রেমির রাগ তাতে আরও চড়ল। উত্তুঙ্গ সেই পিশাচ রাগ লুপ্ত করে দিল তার কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান। দুহাতে সে ধ্রুবর গলা টিপে ধরে বলল, বলো! স্পষ্ট করে বলো! কী করেছ তুমি? আমার পেটে সত্যিকারের বাচ্চা এসেছিল! তুমি আমাকে মিথ্যে করে বুঝিয়ে সেটা নষ্ট করেছ! বলল, ঠিক কি না!
ধ্রুব সভয়ে রেমির দিকে চেয়ে বলে, ঠিক।
ঠিক? —আর্তনাদ করে উঠে রেমি চেপে ধরল ধ্রুবর গলা। প্রাণপণে তার শ্বাসনালি অবরোধ করে বলল, তা হলে তুমিই-বা কেন বেঁচে থাকবে? খুনি! ছোটলোক! চণ্ডাল! তুমিই-বা কেন বেঁচে থাকবে? মরো! মরো! মরো!
আশ্চর্য এই, ধ্রুব নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটা হাতও তুলল না। একটুও বাধা দিল না রেমিকে। রেমির প্রচণ্ড মুঠোর চাপে দম আটকে আসছিল তার। চোখ দুটো বড় বড়। কপালে রক্তোচ্ছাস। মুখটা হাঁ করা।
রেমি সম্ভবত মেরেই ফেলত ধ্রুবকে। যদি সে ধ্রুবর মুখের দিকে না তাকাত। যদি চোখ বুজে থাকত রেমি, তা হলে হয়তো পারত। কারণ সেই মুহূর্তে খুন করার মতোই একটা রাগ ভর করেছিল তার শরীরে। কিন্তু ধ্রুবর অসামান্য মুখশ্রীতে যে কষ্টের ছাপ ও মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়াবহতা ফুটে উঠেছিল তার দিকে চেয়ে শিথিল হয়ে গেল রেমি। নিজের কাছে এক রহস্যময় অদ্ভুত প্রশ্ন রয়ে গেল তার। কেন কেন আমি এই খুনি এই পিশাচকে ভালবাসি? কেন ভালবাসি?
রেমির হাত থেকে মুক্ত ধ্রুব গড়িয়ে পড়ে গেল বিছানায়। একটা বীভৎস হেঁচকিব শব্দ উঠতে লাগল তার গলা দিয়ে। ঠোঁটের কোনা বেয়ে কষ ও ফেনা গড়াতে থাকে।
রেমি প্রথমটায় অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। তারপর তার বুক জুড়ে দেখা দেয় ভয়। ও কি মরে যাবে? ও কি মরে যাচ্ছে? হায় হায় হায়। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব কী করে?
পাগলের মতো রেমি তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ধ্রুবর ওপর, ওগো! তোমার কী হল? বলো না! পায়ে পড়ি, ওরকম কোরো না। কী হয়েছে তোমার? ওগো!
ধ্রুবর খাস চলছিল, জ্ঞান কিছুটা লুপ্ত হয়ে গিয়ে থাকবে। তবে তার শরীর অত্যন্ত মজবুত। ভাল ভিতের ওপর তৈরি বাড়ি ভাঙতে সময় লাগে। অস্পষ্ট আধো চেতনার মধ্যেও সে বুঝল আতঙ্কিত রেমি যদি চেঁচায়, তা হলে লোক জানাজানি হবে। বিশ্রী এক পরিস্থিতির মুখে পড়ে যাবে রেমি। ধ্রুব অতি কষ্টে একখানা হাত একটু তুলে রেমির একখানা হাত ছুঁল। একটু মাথা নাড়ল। বোধহয় বোঝাতে চাইল, তার তেমন কিছু হয়নি।
হতবুদ্ধি রেমি এইটুকু দেখেই বুঝতে পারল, ধ্রুব হয়তো মরে যাচ্ছে না। সে দৌড়ে গেল বাথরুমে। জল এনে ছিটে দিতে লাগল ধুবর মুখে-চোখে। ফ্যান খুলে দিল মাথার ওপর। খুলে দিল। বুকের বোতাম।
অনেকক্ষণ ধরে কাশল ধ্রুব। গভীর শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। গলার ফরসা চামড়ায় তখনও লাল দগদগে হয়ে বসে আছে রেমির আঙুলের ছাপ।
ওঠার মতো অবস্থা তখনও তার নয়। বালিশে ক্লান্ত মাথা এলানো। ম্লান একটু হেসে বলল, পারলে না?
রেমি অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে ছিল ওর মুখের দিকে। বলল, কী পারলাম না?
আর একটুক্ষণ চেপে রাখলেই তো হত। পারলে না কেন?
রেমি উপুড় হয়ে পড়ল ধ্রুবর বুকে। দুহাত আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল, বোলো না! বোলো না! আমি রাক্ষুসি।
ধ্রুব সেই কান্নায় বাধা দিল না। চুপচাপ শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ। তারপর ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল, একটু ব্র্যান্ডি দাও।
একটুও প্রতিবাদ করল না রেমি। উঠে কাঁদতে কাঁদতে, ফোঁপাতে ফোপাতেই আলমারি থেকে ব্র্যান্ডির বোতল বের করে গেলাসে ঢেলে জল মিশিয়ে ধ্রুবর হাঁ করা মুখে একটু একটু করে ঢেলে দিতে লাগল যত্ন করে। জীবনে এই প্রথম স্বামীকে মদ খাওয়াচ্ছে সে। তবে মদ হিসেবে নয়।
ধ্রুব গিলতে পারছিল না। গিলতে গিয়ে একবার বিষম খেল। পরের বার কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল অনেকটা। ফিসফিস করে বলল, পারছি না।
রেমি ওর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সস্নেহে। জিজ্ঞেস করল, কষ্ট হচ্ছে?
ধ্রুব মাথা নেড়ে সেইরকম ফিসফিসে গলায় বলে, না। তেমন কিছু নয়।
আমি ডাক্তারকে খবর দেব।
না রেমি। ওসব কোরো না। কেউ যেন জানতে না পারে। একটা মাফলার বের করে আনো।
রেমি আনল।
ধ্রুব বলল, গলাটা ঢেকে দাও।
কেন গো?
দাও না।
তোমার কেমন লাগছে সত্যি করে বলো।
ভাল। গলাটায় একটু অস্বস্তি। ওটা কেটে যাবে।
ঠিক করে বলো। ঠিকই বলছি, রেমি। শোনো, কাউকে কিছু বোলো না। ডাক্তার ডেকো না।
রেমি বুঝল, ধ্রুব তাকেই বাঁচাতে চাইছে। আর কিছু নয়।
সেই রাতটা ধ্রুব খুব কাশল। গলাটা একটু ফুলে উঠেছিল লাল হয়ে। আর তেমন কিছু হল না। পরদিন ধ্রুবকে খুবই স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। সারারাত রেমি এক সেকেন্ডও ঘুমোয়নি। চিত্ৰাপিতের মতো বসে ধ্রুবর মুখখানার দিকে চেয়ে থেকেছে অপলকে। সারা রাত ধরে সে নিজেকে প্রশ্ন করেছে, কেন এই লোকটিকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারি না? কেন এই মানুষটিকে আমি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না! এই মাতাল, খুনি, নিষ্ঠুর, উদাসীন ও অপ্রকৃতিস্থ লোকটা কোন জাদুবলে আমাকে দখল করে আছে?
এ এক রহস্য। এক অদ্ভুত জটিল রহস্য। ধ্রুবর ওপর যেরকম প্রচণ্ড রাগ ও ঘৃণা ক্ষণিকের জন্য। পাগল করে তুলেছিল তাকে, তেমনি ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর বুক ভাসিয়ে এল করুণা মায়া গভীর এক ভালবাসা। সেই দুকূল ছাপানো ভালবাসায় বয়ঃসন্ধির প্রথম প্রেমের মতো উন্মন চঞ্চল হল রেমি। কিন্তু হায়! যাকে নিয়ে তার এই ভালবাসা সেই অপ্রকৃতিস্থ পুরুষ আবার এঁটে দিল তার অভ্যন্তরের কপাট। রেমিকে যেন চেনেই না।
পরদিন গলায় মাফলার জড়িয়েই অফিসে বেরোল ধ্রুব। গভীর রাতে ফিরল মাতাল হয়ে।
দুদিন পর চলে গেল ব্যাঙ্গালোর অফিসের কাজে। রওনা হওয়ার আগে রেমি বলল, আমাকে নিয়ে যাও। কলকাতা বড় একঘেয়ে লাগছে।
আরে দূর! আমি যাচ্ছি হারিকেন ট্যুরে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকব। তোমার কি আর হোটেলে একা-একা বসে থাকতে ভাল লাগবে?
তবু তো চেঞ্জ!
আচ্ছা, পরের বার হবে।
আমাকে অ্যাভয়েড করছে?
ধ্রুব একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ঠিক তা নয়। তবে অনেক ঝামেলা আছে। আমরা ইচ্ছেমতো বউ নিয়ে বেড়াতে যেতে পারি না। শ্বশুরের পারমিশন নিতে হবে তোমাকে।
নিতে হলে নেব।
উনি দেবেন না।
কেন দেবেন না?
উনি আমাকে বিশ্বাস করেন না। দার্জিলিং-এ আমি কী কাণ্ড করেছিলাম মনে নেই?
মদ খাবে, এই তো? সে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
আর যদি ফের মারপিট লাগে?
তা হলেও তো আমার সঙ্গে থাকা দরকার। তোমাকে দেখবে কে?
প্লিজ রেমি, চাপাচাপি কোরো না।
আমার সঙ্গ তোমার ভাল লাগে না?
ধ্রুব একটু হেসে বলল, কথাটা মিথ্যেও নয়। তোমার সঙ্গ বলে কথা নেই, আসলে আমি মেয়েদের বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না।
কেন পারো না?
রেগে যেয়ো না। গার্লস আর এ অফুল লট। তাদের এতরকম প্রবলেম থাকে।
আমি তোমাকে কখনও কোনও প্রবলেমের কথা বলি?
না। তবে তুমি নিজেই একটি জ্যান্ত প্রবলেম।
কীরকম?
ধ্রুব হাতঘড়ি দেখে বলল, অত সময় নেই রেমি। এ নিয়ে পরে কথা হবে।
রেমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, তুমি অনেক কথাই শুরু করে, কিন্তু শেষ করো না। মেয়েদের যদি তুমি অতই অপছন্দ করে তা হলে বিয়ে করেছিলে কেন?
একথার একটা পেটেন্ট জবাব আছে ধ্রুবর। সে বলে, বিয়ে আমি করিনি, বিয়ে আমাকে করানো হয়েছে। আমি মন্ত্র উচ্চারণ করিনি বিয়ের সময়। কিন্তু আজ ধ্রুব সে জবাব দিল না। বরং মুখে একটা অবাক ভাব ফুটিয়ে বলল, আমি বিয়ে না করলে তোমার বিয়ে হত কার সঙ্গে?
রেমি বলল, অনেক ভাল ছেলে ছিল। অনেক ব্রাইট, লাভিং, ব্রড-হার্টেড পাত্র জুটতে পারত।
তাই নাকি? তা হলে ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন কথাটা সত্যি নয় বলছ?
মোটেই নয়।
আমার তো মনে হয় বিয়েটা বাস্তবিকই ভবিতব্য। আমি ছাড়া তোমার গতি ছিল না।
না, মোটেই না। আমি এ বিয়ে মানছি না।
ধ্রুব বড় বড় চোখে রেমির বিদ্রোহী চেহারাটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, সাব্বাস! এই তো চাই।
তার মানে? ইয়ার্কি করছ নাকি?
ধ্রুব দুহাত রেমির কাঁধে রেখে বলে, না রেমি, একটুও ইয়ার্কি নয়। শোনো, আমি বাস্তবিকই তোমাকে বিয়ে করিনি। অন্তত স্বেচ্ছায় নয়। তুমি কি আমাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছ?
রেমির চোখ ফেটে জল আসছিল। ফুসে উঠে বলল, তোমাকে চিনলে কখনও স্বেচ্ছায় বিয়ে করতাম না।
তোমার কোনও লাভার ছিল না?
না। কিন্তু তাতে কী?
ছিল। বলবে না। ঠিক আছে, শুনতে চাই না। তবে আমার মনে হয়, তোমার মতো সুন্দরী মেয়েদের লাভার না থাকাটাই অস্বাভাবিক।
রেমি ছিটকে সরে গিয়ে বলল, ঘোটলোক! ছুঁয়ো না আমাকে। তুমি ছুঁলে আমার ঘেন্না করে।
ধ্রুব হাসল। উদার গলায় বলল, আরে সিস্টার খুব রেগে যাচ্ছ। সেন্টুতে সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য কথাটা বলিনি মাইরি। আমি বলতে চাই, সত্যিই যদি কোনও লাভার থেকে থাকে তবে তার কাছেই তোমার ফিরে যাওয়া উচিত।
মুখে এল কথাটা তোমার? বলতে জিব সরল? ছিঃ!
আঃ, মাইরি! ফের তুমি সেন্টু হয়ে যাচ্ছ। কিন্তু আদত কথাটা যদি বুঝতে! তুমি কি জানোনা বা এতদিনেও টের পাওনি যে, কৃষ্ণকান্তর বখে যাওয়া এক ছেলেকে আবার লাইনে আনার জন্য তোমার মতো একটি সুন্দরী মেয়েকে ভারচুয়ালি উৎসর্গ করা হয়েছে। ঠিক যেভাবে পাঁঠা বলি দেয়! পারছ বুঝতে?
রেমির নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছিল রাগে। বলল, হ্যাঁ। এখন আমার তা-ই মনে হয়। তোমার মতো একজন লম্পট মাতালের সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার পিছনে হয়তো ওইটাই কারণ।
তা হলে? —বলে ধ্রুব খুব বিজ্ঞের মতো হাসল, এই বিয়ের বিরুদ্ধে কি তোমার বিদ্রোহ করা উচিত নয় রেমি? উচিত নয় কি আদালতে গিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়া! বলো!
উচিত। নিশ্চয়ই উচিত।
তা হলে তাই করো রেমি। ভাঙো, ভাঙো এই পরিবারের ভিত। কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীনপন্থী, প্রগতিবিরোধী, সংকীর্ণমনা, মতলববাজ ও কায়েমি স্বার্থের এই বাস্তুঘুঘুর প্রতিষ্ঠানটিকে উড়িয়ে দাও। পাবলিকলি অপমান করো কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীকে। লম্পট ধ্রুব চৌধুরীর মুখোশ খুলে দাও। কেন চুপ করে মেনে নিচ্ছো সব কিছু? এই পারিবারিক প্রতিষ্ঠানটির ভিত ভেঙে স্বাধীন ও মুক্ত হয়ে চলে যাও নিজের সত্যিকারের প্রেমিকের কাছে। জয়ি হও, মুক্ত হও, ঘৃণা করো আমাদের।
অভিনয়! পুরোটাই অভিনয়! কিন্তু তবু কী চমৎকার অভিনয়! ধ্রুব রওনা হয়ে যাওয়ার একঘণ্টা। বাদে রেমি বিছানায় বসে আনমনে আঙুল দিয়ে বিছানায় আঁকিবুকি করতে করতে আপনমনে হাসছিল, পাগল! একটা পাগল!
ফুল ফুটলে পতঙ্গ আসেই। সেই অর্থে রেমিরও কি প্রেমিক ছিল না দু-একজন? ছিল। দাদার বন্ধু মানিকদা। দারুণ চেহারা, ইঞ্জিনিয়ার। সন্তু নামে পাড়ার একটি বেকার ছেলে। দায়ে-দফায় এসে সব সময় হাজির হত। একজন অধ্যাপক ছিলেন চিন্ময় সান্যাল নামে। চমৎকার মানুষ। একটু নরম। হয়ে পড়েছিলেন তার প্রতি। রাস্তায় ঘাটে কতবার সপ্রশংস বা লোভী চোখ তাকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু প্রেম করার অবকাশ ঠিক পায়নি সে। বড্ড অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেল। তবে আজ তার মনে হয়, পৃথিবীর আর কোনও পুরুষ নয়, আর কেউ নয়, একজনকেই তার চাই। পুরোপুরি চাই। যে লোকটা তাকে এত অপমান করে নাকের ডগা দিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল। তার প্রতি যার এত উপেক্ষা। এত উদাসীনতা। ওই পাগলকে সে একদিন বলবে, এসো, বিয়ে ভেঙে দিই। আমি কুমারী হয়ে যাই, তুমিও কৌমার্যে ফিরে যাও। তারপর আমার স্বয়ংবর হোক। কাকে মালা দেব জানো? আহাম্মক কোথাকার? বোঝো না?
বউমার উড়ুউড় ভাবটা ব্যস্ততার মধ্যেও একদিন লক্ষ করেন কৃষ্ণকান্ত। ডেকে বলেন, দামড়াটা ব্যাঙ্গালোর না কোথায় গেছে যেন!
হ্যাঁ।
তোমাকে চিঠিপত্র দিয়েছে?
না।
ফোন-টোনও করে না?
না।
চমৎকার। হিরের টুকরো আর কাকে বলে! কোন হোটেলে আছে তাও বোধহয় জানো না?
রেমি মাথা নেড়ে বলে, না। বলে যায়নি।
দিন সাতেক হল বোধহয়।
তা হয়েছে।
কৃষ্ণকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, এবার থেকে যখন বাইরে যাবে তখন ওর হোটলের নামটা অন্তত জেনে নিয়ো। তোমার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে, দামড়াটার জন্য দুশ্চিন্তা করছ। কিন্তু তাতে লাভ নেই। কাল বোধহয় লতু দক্ষিণেশ্বর যাবে। সঙ্গে জগা থাকবে। গাড়ি যাচ্ছে। ওই সঙ্গে তুমিও ঘুরে এসো গে যাও। লতুটা তোমার সঙ্গে মেশে-টেশে, না কি নিজের বন্ধু-টন্ধু নিয়েই মত্ত থাকে?
প্রশ্নটা খুবই প্রাসঙ্গিক। রেমির ননদ লতু বউদিকে প্রচণ্ড ভালবাসে বটে, কিন্তু তার কলেজ এবং বাইরের জগৎটা বড্ড বেশি বড়। তা ছাড়া এই বয়সেই সে নানারকম সোশ্যাল ওয়ার্ক করে বেড়ায়। ফলে বউদির জন্য তার দেওয়ার মতো সময় থাকে না। একজন ভাসুর ও একটি দেওর আছে রেমির। তারা প্রায় না থাকার মধ্যেই। ভাসুর দেরাদুন মিলিটারি স্কুল থেকে পাশ করে এখন সামরিক বাহিনীর উঁচু পোস্টে বসে আছে পুনায়। বিয়ের পর তাকে এক-আধবার দেখেছে রেমি। অবাঙালির মতো চেহারা। লম্বা চওড়া। একজন ডিভোর্সি মারাঠি ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করার পর থেকেই এ বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক একরকম চুকে গেছে। তার নামও কেউ উচ্চারণ করে না। দেওর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে রুরকিতে। বড় একটা আসে না। এলেও বউদির সঙ্গে খুব একটা কথাটথা বলে না। লজ্জা পায় বোধহয়। সুতরাং এ বাড়িতে রেমি একরকম একা।
একা যেমন, তেমনি আবার একচ্ছত্র আধিপত্যও তার। কৃষ্ণকান্ত ইদানীং তার হাতেই সংসার খরচের টাকা পয়সা দিচ্ছেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করছেন তাকে। স্বামীর কাছ থেকে যা সে পায় না। তার সেই শূন্যতাকে পূরণ করার এ এক অক্ষম চেষ্টা।
রেমি পরদিন দক্ষিণেশ্বর গেল না। কেন যাবে? তার তত বেড়াতে ইচ্ছে করে না একা একা। একা ছাড়া কী? লতু, জগাদা এরা থাকলেও তার একাকিত্ব ঘোচে না কিছুতেই।
পেটের বাচ্চাটা যদি থাকত তা হলে হয়তো এত একা লাগত না। শরীরের মধ্যে আর একটা শরীর। তার প্রাণস্পন্দন টের পেত রেমি। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত। ধ্রুবর অভাব তাতেই পূরণ হয়ে যেত অনেকটা।
কেন মারল ধ্রুব? কেন? ধ্রুবর কাছ থেকে সত্যিকারের জবাবটা আজও পায়নি রেমি। কেন বাচ্চা হবে শুনে সাদা হয়ে গিয়েছিল ওর মুখ? কোথায় বাধা ছিল?
দশদিন বাদে ধ্রুব ফিরল। হা-ক্লান্ত চিমসে চেহারা হয়ে গেছে। ট্যাকসি থেকে নেমেই রেমিকে বলল, শিগগির ভাত খাওয়াও। দশদিন প্রায় আধপেটা খেয়ে ছিলাম।
তখন অবেলা। বিকেলের ফ্লাইটে ধ্রুব ফিরেছে। তবু প্রশ্ন না করে আগে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল রেমি। পুরুষমানুষ বড় একটা খিদে সহ্য করতে পারে না।
খাওয়ার টেবিলে মুখোমুখি বসে রেমি জিজ্ঞেস করল, রোগা হয়ে গেছ কেন?
ধ্রুব ফিচেল হেসে বলল, বিরহে।
বিরহ কেমন তা তুমি জানো?
আহা তোমার বিরহে নয়।
তবে কার বিরহে?
বিরহ ফর ফুড। দক্ষিণ ভারতের খাবার সহ্য হচ্ছিল না।
রেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই বলো।
ধ্রুব চোখের কোনা দিয়ে তাকে একবার দেখে নিয়ে বলল, তোমার শরীরটা তো তেমন কৃশ দেখছি না।
দেখবে কেন? কৃশ তো হইনি।
অথচ হওয়ার কথা।
কেন? হওয়ার কথা কেন?
রওনা হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল তুমি খুব বিরহ ফিল করছ।
মোটেই নয়।
একদম করোনি?
না। বিরহটা একতরফা তো হয় না।
দূর মাইরি! তুমি একদম উলটপুরাণ। বিরহ চিরকালই একতরফা।
তাই নাকি?
কেষ্টর জন্য রাধা যত কেঁদেছিল, তার টুয়েন্টিফাইভ পারসেন্টও কেষ্ট কাঁদেনি।
তোমার সেই টুয়েন্টিফাইভ পারসেন্টও বোধহয় নেই।
না। তবে তোমার জন্য আমি ফিল করি।
সেটা কীরকম?
একটা বাজে লোকের জন্য তোমাকে অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে।
তা হচ্ছে।
আমি সেটা ফিল করি।
শুধু ফিল করলেই হবে? তোমার কিছু করার নেই?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, আমার নেই। কিন্তু তোমার আছে।
কী করব?
ওই যে বলেছিলাম, এ বাড়ির ভিত নাড়িয়ে দাও। ভাঙো, আগুন জ্বালো।
এ বাড়ির ওপর তোমার এত রাগ কেন?
রাগ তোমারও হওয়ার কথা ম্যাডাম।
কেন তা আগে বলো।
এরা ভণ্ড, অহংকারী, রক্তের বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী।
তাই নাকি?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, কেন, তুমি কি জানো না?
কী জানব?
বুদ্ধি থাকলে বুঝতে পারতে।
আমার বুদ্ধি নেই। বুঝিয়ে দাও।
নির্বোধদের মাথায় কোনও ফ্যানটাস্টিক আইডিয়া ঢোকাতে নেই, রেমি। তাতে সে খেপে উঠে যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে বসতে পারে।
আমি কি ততটাই নির্বোধ?
তা কে জানে! তুমি নিজেই তো নিজেকে নির্বোধ বললে।
তুমি আমাকে একটা কিছু বলতে চাইছ। কিন্তু পারছ না। কেন বলো তো?
আমার কিছু বলার নেই।
আছে। আমি জানি।
ওসব এখন বাদ দাও। আমি টায়ার্ড অ্যান্ড হাংরি।
ঠিক আছে। পরে বোলো। আমি অপেক্ষা করব।
ধ্রুব অবাক হয়ে বলল, মনে হচ্ছে, তোমারও কিছু বলার আছে।
আছে। আমি তোমাদের রক্তের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
ধ্রুব একটু ম্লান হেসে বলল, ব্লাড ইজ এ স্ট্রেঞ্জ থিং।
০২৩. গভীর রাত্রি পর্যন্ত হেমকান্তর ঘুম হল না
গভীর রাত্রি পর্যন্ত হেমকান্তর ঘুম হল না। মাথায় ধিকিধিকি অঙ্গার জ্বলছে। আত্মধিক্কার ও চারিদিককার কলুষিত পরিবেশের ওপর ঘৃণা তাকে আজ পাগলের মতো করে তুলেছে।
কোন রন্ধ্র দিয়ে নিয়তি আসে তা মানুষের অনুমান করা অসাধ্য। তার ক্ষেত্রে সেই নিয়তি এল শশিভূষণের রূপ ধরে অনুকম্পার রন্ধ্র দিয়ে। তিনি শশিভূষণকে ধরিয়ে দিতে পারতেন বটে, কি ও কথাটাই তাঁর মনে কখনও উদয় হয়নি। নিজের গাঁটের কড়ি দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়েছিলেন। এখন তার ফল ভোগ করতে হবে। লোকে কারও সম্পর্কে ভাল কথা শুনলে গা করে না, কিন্তু মন্দ কথা শুনলে তৎক্ষণাৎ তা বিশ্বাস করে। লোকচরিত্র সম্পর্কে হেমকান্তর জ্ঞান সীমাবদ্ধ বটে, কিন্তু তিনি যেটুকু জানেন সেটুকুই বিষাক্ত।
শীতের প্রকোপ অনেকটাই কমে গেছে। আজকাল কোকিল ডাকে। শিমুলের গাছে ফুল এল।
উত্তরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান হেমকান্ত। প্রকৃতি শান্ত ও সীমাহীন। নির্মেঘ আকাশ থেকে দেবতাদের লক্ষ লক্ষ চোখ নক্ষত্রের আলোয় তাকে নিরীক্ষণ করে। তোদম হেমকান্ত ঊর্ধ্বমুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন আকাশের দিকে। তার বুক থেকে ঊর্ধ্বে ধাবিত হয় পুঞ্জীভূত অভিমান, আমি কী করেছি? কেন এই কলঙ্ক? ভগবান!
অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। মাথার চুলে এলোমেলো হাওয়া এসে লাগে। চোখ জ্বালা করে এবং জল আসে।
ঘর থেকে একটা ভারী চেয়ার টেনে আনেন তিনি। বসেন এবং বসেই থাকেন। মানুষের সমাজকে তিনি কোনওদিন ভাল চোখে দেখেননি। কিন্তু এতদিন সেই সমাজ তাঁকে নিয়ে তেমন কথাও বলেনি। তিনি একাচোরা মানুষ, ঘটনাবিহীন। রঙ্গময়ির সঙ্গে তাকে জড়িয়ে একটা রটনা আছে বটে, কিন্তু সেটা তাকে ততটা স্পর্শ করেনি। ইচ্ছে করলে রঙ্গময়িকে বিয়ে করে আজও তিনি সেই রটনা বন্ধ করতে পারেন। কাজটা এমনিতে শক্ত হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু শশিভূষণকে নিয়ে যে রটনা তা অন্যরকম। তা দেশদ্রোহিতা, বিশ্বাসঘাতকতা। মিরজাফরের কত দয়িতা বা শয্যাসঙ্গিনী ছিল তা নিয়ে ইতিহাস মাথা ঘামায় না, কিন্তু দেশদ্রোহিতার কথা আগুনের অক্ষরে লেখা থাকে।
হেমকান্ত চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজলেন।
সকালে তাকে জাগাল সূর্যের আলো আর পাখির ডাক। হু হু শব্দে কোকিল ডাকছে আজ। হেমকান্ত টের পেলেন, খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানোর ফলে তার গলা খুশখুশ করছে। মাথায় কিছু যন্ত্রণাও টের পান তিনি। একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
নিস্তেজ শরীরে উঠে তিনি প্রাতঃকৃত্য সারলেন। তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে কোচোয়ানকে গাড়ি ঠিক করতে হুকুম পাঠালেন। পোশাক পরে গাড়িতে উঠে বললেন, সোজা থানায় চল।
রামকান্ত রায় থানার হাতার মধ্যেই থাকেন। খবর পেয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, আরে আসুন! আসুন!
হেমকান্তকে প্রায় হাত ধরেই নিয়ে গিয়ে বসালেন বাইরের ঘরে।
হেমকান্ত বিনা ভূমিকায় বললেন, আমি একটু শশিভূষণের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
রামকান্ত রায় ভ্রু কুঁচকে বললেন, কেন বলুন তো?
তাকে আমার একটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে।
কী কথা?
সেটা তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বলা যাবে না।
আপনি খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে।
তা ঠিক। আমার মনটা ভারী অস্থির।
রামকান্ত রায় একটা শ্বাস ফেলে বলেন, হওয়ারই কথা। শশিভূষণ ধরা পড়ুক, এটা তো আপনি চাননি!
হেমকান্ত সরল ভাবেই বলেন, না, চাইনি।
কেন? হঠাৎ ধমকের মতো শোনায় রামকান্তর গলা।
হেমকান্ত তটস্থ হয়ে বলেন, কেনই বা চাইব?
আপনি কি স্বদেশিদের প্রতি সিমপ্যাথি পোষণ করেন?
না তো! তা কেন?
আপনার অস্থিরতা দেখে তো তাই মনে হয় হেমকান্তবাবু।
হেমকান্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানতাম না।
রামকান্তর মুখের কুটিলতা তবু সরল হল না। ধমকের স্বরটা বজায় রেখেই বললেন, ঘটনাটা আপনি যেভাবে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন সেটা ছেলেমানুষি। আমাদের চোখ কান মগজ তো আর কারও কাছে বাঁধা দিইনি। একজন মারাত্মক অপরাধীকে আপনি যেভাবে আড়াল করে রেখেছিলেন তা মোটেই ভাল ব্যাপার নয়। তবু আমি আপনাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আপনি আজও সেই স্টেটমেন্টটা দেননি।
হেমকান্তকে আজ যেন জুজুবুড়ির ভয় পেয়ে বসেছে। একজন তিন পয়সার দারোগা তাঁকে চোখ রাঙাচ্ছে তবু তিনি কেমন যেন আঁকুপাকু করছেন ভিতরে-ভিতরে। তেতে উঠছেন না, ফেটে পড়ছেন না। মিন মিন করেই বললেন, স্টেটমেন্ট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানতাম না।
আপনি না জানলেও কেউ তো জানত! কারও মাথা থেকে তো প্ল্যানটা বেরিয়েছিল!
হতভম্বের মতো চেয়ে থাকেন হেমকান্ত।
রামকান্ত নিজের হাতের প্রকাণ্ড চেটোটার দিকে চেয়ে ভ্রুকুটি করে বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, গর্তের সব সাপ আমি টেনে বার করবই। ওই মেয়েটা, রঙ্গময়ি, ও কেমন মেয়ে?
ভাল! খুব ভাল।
আপনার কাছে ভাল হলেই তো হবে না। সে যে ভাল এমন কোনও প্রমাণ নেই। শশিভূষণকে সে যে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
রঙ্গময়ি জানত না।
রামকান্তর গলায় বাজ ডাকল, আলবাত জানত। তাকে অ্যারেস্ট করে থানায় আনলেই সব কথা কবুল করবে।
হেমকান্ত নিজের শরীরে একটা শীতলতা টের পান। একটা কাঁপুনি ধরেছে তাঁকে। দাঁতে দাঁতে ঠকঠক শব্দ হল একটু। জ্বর আসছে? হবে? শরীরটা আজ বশে নেই। বললেন, ওকে ধরে আনবেন?
আনাই তো উচিত।
রঙ্গময়িকে?— যেন বুঝতে পারছেন না এমন ভাবলার মতো বলেন হেমকান্ত।
রামকান্তর গলা কিছু নরম হল। বললেন, অন্য কোনও উপায় নেই। তবে আপনি যাতে নিজেকে বাঁচাতে পারেন আমি সেই পথ খোলা রেখেছি। এখনও রেখেছি। আপনি যদি সুযোগটা না নেন তবে বাধ্য হয়ে আমাকে আইনমতো ব্যবস্থা নিতে হবে।
হেমকান্ত নিশ্চুপ বসে রইলেন। লোকে জানে, তিনি শশিভূষণকে ধরিয়ে দিয়েছেন। পুলিশের বিশ্বাস, তিনি শশিভূষণকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। বড় অদ্ভুত অবস্থা।
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। লোকের সঙ্গে তিনি কখনও ঝগড়া বা তর্ক করেনি। কী করে যুক্তি প্রয়োগ করতে হয় তাও তার অজানা। তার ওপর এক আতঙ্কে তার মন ও মাথা ছেয়ে আছে।
রামকান্ত বললেন, শশিভূষণের সঙ্গে দেখা করতে চান কেন?
একটু দরকার ছিল। কোনও অসুবিধে আছে?
হাসপাতাল থেকে এনে তাকে এখনও থানার হাজতেই রাখা হয়েছে। অসুবিধে আছে বই কী। তবে আপনার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
খুব ভাল হয় তা হলে।
আসুন।–বলে রামকান্ত উঠলেন। থানার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, রঙ্গময়ি আপনার কে হয়? কোনও আত্মীয়া নয় তো?
ঠিক তা নয়।
মেয়েটির প্রতি লক্ষ রাখবেন। ওর অ্যাকটিভিটি যথেষ্ট সন্দেহজনক।
রঙ্গময়ি কী করেছে?
সে আপনিও নিশ্চয়ই জানেন।
হেমকান্ত ভয় খেয়ে চুপ করে গেলেন। বোস কোনও কথা যদি বেরিয়ে যায়!
প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল যে, শশিভূষণ বড় একটা যত্নে নেই। খুব রোগা হয়ে গেছে। সুকুমার মুখশ্রীতে একটা হাড় উঁচু লাবণ্যহীনতা। গালের কোমল দাড়ি রুক্ষ। চুল পিঙ্গল। মোটা কম্বলে গা ঢেকে বিছানায় বসে ছিল।
হেমকান্তকে দেখে হঠাৎ চিনতে পারল না। না চেনারই কথা। মাত্র একবারই পরস্পর দেখা হয়েছিল। তারপর জল ঘোলা হয়েছে কিছু কম নয়।
হেমকান্ত আত্মপরিচয় দিতেই কিন্তু শশিভূষণের মুখ ভীষণ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে এল বিছানা থেকে। আশ্চর্যের কথা, নিচু হয়ে গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে সে হেমকান্তর পায়ের ধুলো নেওয়ারও চেষ্টা করল।
হেমকান্ত পিছিয়ে গিয়ে বললেন, থাক থাক।
তার মনে হল, এরকম তেজি ও প্রাণভয়হীন যুবকের প্রণাম নেওয়াটা তার পক্ষে পাপ হবে।
সাগ্রহে শশিভূষণ জিজ্ঞেস করল, বাড়ির সবাই কেমন আছেন?
ভাল।
রঙ্গমাসি ভাল?
হ্যাঁ। তোমার জন্য খুব দুশ্চিন্তা করছে।
ওঁকে বলবেন, আমি ভাল আছি।
বলব। কিন্তু তুমি সত্যিই কেমন আছ?
শশিভূষণ হাসল। বলল, এখনও খারাপ কিছু লাগছে না।
এখানকার খাওয়া-দাওয়া?
জঘন্য। তবে আমার ওসব অভ্যাস আছে।
মারধোর করে না তো!
না না। এখনও ওগুলো শুরু হয়নি। শুনছি বরিশালে চালান দেবে। তখন কী হয় বলতে পারি না।
তোমার বাড়িতে একটা খবর দেব?
শশিভূষণ আবার শুকনো ঠোঁটে হাসে। ঠোঁট দুটো চড়চড়ে শুকনো। মামড়ি এবং রক্ত শুকিয়ে আছে। কষ্টেই হাসতে হয়। বলল, ওসব পুলিশ নিজের গরজেই করবে। আপনি ভাববেন না।
শোনো শশী, আমি তোমার জন্য উকিল লাগিয়েছি। তুমি তাকে যথাসাধ্য সাহায্য কোরো।
শশিভূষণ অবাক হয়ে বলে, আপনি উকিল লাগালেন কেন?
এমনি। তুমি আমার অতিথি ছিলে। পুলিশ তোমাকে সেই অবস্থায় ধরে এনেছে। আমার মনে হল তোমার জন্য কিছু করা আমার আতিথেয়তা হিসেবেই কর্তব্য।
শশী ম্লান হেসে বলল, যথেষ্টই করেছেন। রঙ্গমাসি দিনরাত আমার সেবা করেছেন। কয়েকদিন আরামের আশ্রয় জুটেছিল। আর কী চাই?
ওটুকু কিছুই নয়। তুমি তার চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট করেছ। দেশের লোকের জন্যই করেছ। তোমার জন্য কিছু করতে পারলে আমার নিজেরই ভাল লাগবে।
শশী বলল, উকিল আমার বাবাও নিশ্চয়ই দেবেন।
তা তো জানি। তবে অধিকন্তু ন দোষায়। ভাল কথা, তুমি তোমার বাড়ির যে ঠিকানাটা দিয়েছিলে সেটা কি যথার্থ?
শশিভূষণ লজ্জার হাসি হেসে বলে, না। সত্যি ঠিকানা দেওয়ার নিয়ম নেই।
তোমার বাবা কী করেন?
ব্যাবসা।
তোমরা কি ধনী?
ধনী না হলেও বাবার অবস্থা খারাপ নয়।
তা হলে তুমি আদরেই মানুষ হয়েছ।
তা হয়েছি।
এখন যে এত কষ্ট তা সইছ কী করে?
মনটাকে শক্ত করে ফেললে আর কষ্ট থাকে না।
মনকে শক্ত করা কি সহজ কাজ, শশী?
তা নয়। খুব শক্ত কাজ। তবে অভ্যাস করে নিতে হয়েছিল।
তোমার এত কম বয়স, এত অভ্যাস করার সময় পেলে কবে?
শশিভূষণ একটু হাসল মাত্র।
হেমকান্ত গলা খাঁকারি দিলেন। শরীরটা ভাল নেই। মাথা ঝিমঝিম করছে। গায়ে জ্বরের সঞ্চার টের পাচ্ছেন। প্রবল শীত করছে। গরাদটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, একটা কথা।
বলুন।–সসম্ভ্রমে শশী বলে।
লোকে বলছে আমিই নাকি তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি।
আপনি!–শশী আকাশ থেকে পড়ে।
লোকে তাই ভাবছে। একটা প্রচারও হচ্ছে।
কে একথা রটাল?
তা বলা শক্ত। তবে রটেছে। কথাটা কি তুমি বিশ্বাস করো?
শশী হতভম্বের মতো চেয়ে থেকে বলে, আপনি আমাকে ধরিয়ে দেবেন একথা কি বিশ্বাসযোগ্য?
তুমি বিশ্বাস করো না তো!
ওরকম কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। রঙ্গমাসির কাছে আপনার কথা কত শুনেছি!
আমার কথা! মনু মানে রঙ্গময়ি তোমাকে আমার কথা বলত নাকি?
বলত মানে! রঙ্গমাসি শুধু আপনার কথাই তো বলতেন।
আমার সম্পর্কে এত কী বলার থাকতে পারে তার?
ও বাবা, সে অনেক আছে। ওঁর কাছে বোধহয় আপনিই ভগবান।
হেমকান্ত ভীষণ অবাক হয়ে যান। রঙ্গময়ি তাঁর সম্পর্কে ভাল কথা বলে বেড়ায় তাহলে কিন্তু কী কথা?
একবার ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু লজ্জা করতে লাগল। নিজের প্রশংসা অন্যের মুখ থেকে টেনে বের করার প্রবণতা ভাল না।
হেমকান্ত একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস ছেড়ে বলেন, তাহলে তুমি বিশ্বাস করো না। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।
কারা এসব বলছে বলুন তো? তাদের চাবকানো দরকার।
লোকে নিন্দা করতে এবং শুনতে ভালবাসে। প্রায় সকলেই। কজনকে চাবকাবে? লাভ নেই।
শশী বলে, বরং পুলিশের ধারণা তো উলটোই। তারা বলে যে, আপনি আমাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
বলে নাকি?
বলে। রঙ্গমাসির ওপরে দারোগাবাবুর খুব রাগ।
জানি।–হেমকান্ত বিষণ্ণ গলায় বলেন, ওকেও ধরে আনতে চাইছে।
কথাটা শুনে শশী অবাক হল না। খানিকটা উদাস গলায় বলল, ধরতেই পারে। একদিন রঙ্গমাসি ধরা পড়বেনই। উনি ভীষণ বেপরোয়া।
তাই নাকি? দেখো শশী, ওকে ছেলেবেলা থেকে চিনি বটে, কিন্তু কী যে ওর চরিত্র তা আজও ভাল বুঝলাম না। অদ্ভুত মেয়ে।
শশী মাথা নাড়ল। তারপর বলল, কৃষ্ণ কেমন আছে?
ভালই। তোমার খুব ভক্ত হয়ে উঠেছিল কয়দিনে! তাই না?
হ্যাঁ। খুব স্পিরিটেড ছেলে আপনার।
হেমকান্ত আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। ছেলেকে তিনি ইদানীং একটু কাছে ভিড়তে দিয়েছেন বটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণকান্ত কেমন ছেলে তা তিনি খুব ভাল জানেন না।
শশী বলল, আপনার বাড়িতে আমার খুব ভাল কেটেছিল। জ্বরটা না হলে আরও ভাল কাটত।
সব ভাল যার শেষ ভাল। শেষ অবধি আর ভাল কাটল কই তোমার! ধরা পড়ে গেলে।
শশী মাথা নেড়ে বলে, ধরা পড়তেই হত। উপায় ছিল না। আমার ওপর কমান্ডারের অর্ডার ছিল সুইসাইড করার। তা আমি করিনি।
হেমকান্ত শিউরে উঠলেন।
শশী আপনমনেই বলল, মার মুখ মনে পড়ায় ভেবেছিলাম, একবার মাকে দেখে নিয়ে তারপর দূরে কোনও নির্জন জায়গায় গিয়ে সুইসাইড করব। যাতে আমার লাশ কেউ খুঁজে না পায়। মা যাতে ধরে নেয়, আমি নিরুদ্দেশ। কিন্তু হল না।
যেতে পারলে না মার কাছে?
না। অসুবিধে ছিল। কিন্তু সুইসাইডও করা হল না। প্রথম চোটে না করতে পারলে পরে নানারকম দুর্বলতা দেখা দেয়।
ওসব কথা ভেবো না, শশী। আমি ভাল উকিল দিয়েছি। সে তোমাকে খালাস করে আনবে।
পারবে?–শশী ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করে।
কেন পারবে না? তাকে সব বোলো।
শশী ঘাড় নাড়ল। কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাকে। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সে বলল, আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিছু মনে করবেন না।
হেমকান্ত ধীর স্বরে বলেন, তোমার বয়সি এবং তোমার চেয়ে বড় ছেলে আমার আছে। কেউ স্বদেশি করেনি কখনও। কিন্তু এক-আধজন যদি করত তবে খুশি হতাম।
শশী বলল, আপনাদের বংশে তো স্বদেশির রক্ত আছেই।
হ্যাঁ। আমার ভাই ছিল।
শুনেছি। রঙ্গমাসি সব বলেছে।
হেমকান্ত জ্বরের ঘোরে কাঁপছিলেন। উঠলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, আসি।
ফেরার পথে সারা রাস্তায় হেমকান্ত আচ্ছন্নের মতো এলিয়ে রইলেন। বাড়িতে ফিরে নামতে যাবেন, একটা হাত তাঁকে ধরল।
মনু! আমার বড় জ্বর আসছে মনু!
জানি। খারাপ শরীর নিয়ে কোন রাজকার্যে গিয়েছিলে?
শশীর কাছে।
কেন? চলো, ওপরে চলো, এখন আর কথা নয়।
হেমকান্ত ওপরে উঠতে উঠতে হাঁফিয়ে গেলেন। বড় বড় শ্বাস পড়তে লাগল। বিছানায় শুয়ে এক আচ্ছন্নতার সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করতে করতে বললেন, ও বিশ্বাস করে না।
কী বিশ্বাস করে না?
ও গুজবটায় বিশ্বাস করে না।
কোন গুজব?
আমি যে ওকে ধরিয়ে দিয়েছি তা ও বিশ্বাস করে না।
ঠিক আছে। এখন চুপ করে শুয়ে থাকো।
তুমি ওকে আমার কথা কী বলেছে, মনু?
তোমার কথা! তোমার কথা বলতে যাব কেন? বলেছ।
রঙ্গময়ি লেপ দিয়ে হেমকান্তকে ঠেসে চেপে ঢাকা দিয়ে বলে, বেশ করেছি বলেছি। বলেছি আমার মাথা আর মুন্ডু।
কই, আমাকে তো আমার কথা বলো না!
বলার কিছু নেই বলে।
আমাকে তো কেবল বকো, ধমকাও।
বেশ করি।
মনু, আমি মরে যাব এবার? কত জ্বর বলো তো!
যত জ্বরই হোক, মরণ তোমার কাছে ঘেঁষুক তো একবার! চুপ করে থাকে। তোমার মনুর শরীরে এখনও প্রাণ আছে।
০২৪. রেমি মাথা ঠান্ডা রেখে
রেমি মাথা ঠান্ডা রেখে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, বাচ্চাটা যে তোমার নয় এরকম একটা কথা তুমি কি মনে করো?
ধ্রুব মাথা নাড়ল, কী জানি। হতে পারে।
আমি জানতে চাই এরকম ধারণা তোমার কেন হল!
ধারণা আমার নয়। আমি আজকাল তলিয়ে কিছু ভাবতেই পারি না।
তাহলে ধারণাটা কার?
ধ্রুব খাওয়া থামিয়ে পিছনে হেলান দিয়ে খুব অপ্রতিভ মুখে একটু হেসে বলল, এসব নিয়ে আকচা-আকচি কি এখনই করতে হবে? আমি ড্যাম টায়ার্ড।
টায়ার্ড আমিও। তোমাকে নিয়ে।
আমাকে ছেড়ে দাও না কেন? তোমার কি কোনও প্রেমিক নেই, আমাকে ছেড়ে দিয়ে যার কাছে ফিরে যেতে পারো?
না। আমরা সেরকম মানুষ নই।
তোমরা কীরকম মানুষ তাহলে? সর্বংসহা সতী সাধ্বী? মাইবি, এই সব টাইপ নিয়েই পুরুষদের যত ঝামেলা।
আমি এখনও তেমন ঝামেলা করিনি, কিন্তু করব! কথাটার জবাব দেবে?
ধ্রুব উঠে বেসিনে আঁচিয়ে এসে বলল, ঘরে চলো।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল ধ্রুব। তারপর সিগারেট ধরিয়ে বলল, কথাটা বেস বেবিয়ে গিয়েছিল সেদিন। যেতে দাও। আর হবে না।
ওটা কোনও এক্সপ্লানেশন নয়। কথাটা বোস বেরোয়ওনি। যদি কথাটাই বড় হত তাহলে তুমি আমাকে মিথ্যে বুঝিয়ে পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করতে না। আরও কিছু আছে।
ধরো, ঠিক এই সময়ে আমি বাচ্চা চাইছিলাম না।
সেটা আমাকে বলতে পারতে। ডিসিশনটা আমরা দুজনে মিলেই নিতাম।
তুমি নিতে পারতে না রেমি। তুমি একটু সেকেলে টাইপের।
দেখো, আমার সঙ্গে এখন চালাকি কোরো না। আমার মন ভাল নেই। আমাকে নিয়ে খেলা পুতুলের মতো যা খুশি অনেক করেছ। ব্যাপারটা শেষ হওয়া দরকার।
ধ্রুব কি একটু ভয় পেল? হবেও-বা। তার মুখ-চোখে কিন্তু জলে-পড়া ভাব ফুটে উঠছিল।
ধ্রুব খানিকক্ষণ নীরবে সিগারেট টেনে গেল। তারপর হঠাৎ বলল, ওরকম ধারণার কথা কেউ মুখ ফুটে বলেনি। কিন্তু তবু এ বাড়ির বাতাস শুকলে কখনও কখনও তুমি মানুষের মনোভাব টের পাবে। অবশ্য খুব সেনসিটিভ নার্ভ থাকা দরকার।
তাই নাকি? কিন্তু আমি ওসব বুজরুকি শুনতে চাই না। আসল কথাটা বলো।
সেটাই বলার চেষ্টা করছি। ধারণাটা আমার নয়। অন্য কারও। কিন্তু ধারণাটা আমাদের ভিতরে ঠিকই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তুমি শিলিগুড়ি গেছ। সমীরও সেখানেই আছে। সমীর এবং তুমি তোমাদের দুজনের মধ্যে কী রিলেশন তা আমি জানি না। ইন্টারেস্টেডও নই। কিন্তু দেয়ার ইজ এ হামিং অ্যাবাউট ইট।
ছিঃ ছিঃ!
ব্যাপারটা হয়তো নিতান্তই ছিঃ ছিঃ। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। শুনেছি তোমার শ্বশুর সমীরকে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়েছিল। জরুরি কাজে। সে আসেনি।
তোমরা এত হীন?
তুমি আর কতটাই বা জানো? আমরা তার চেয়েও হীন। সেইজন্যই তোমাকে বলি, এ বাড়ির বনিয়াদ ভাঙতে থাকো। সব মুখোশ খুলে দাও।
আমার বাচ্চাটা যে তোমার নয় একথাটা কে প্রথম তোমাকে বলে?
ধ্রুব অবাক হয়। বলে, কেউ তো বলেনি!
তাহলে?
বললাম তো, কেউ মুখ ফুটে বলে না। কিন্তু সন্দেহের বীজ বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। আর বাতাসেই সব বার্তা সবাই জানতে পেরে যায়।
আমি ওসব বিশ্বাস করি না। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশে একটা বাচ্চাকে খুন করা কি মানুষের কাজ, পিশাচের?
পিশাচের। এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত।
যাতে কিছুতেই, কোনও রক্তৃপথেই এ পরিবারের রক্তে কোনও কলুষিত রক্ত ঢুকতে না পারে, সেই জন্য?
অবিকল তাই।
রেমির চোখ-মুখ অস্বাভাবিক তীক্ষ আর গনগনে হয়ে উঠছিল। তবে সে ধ্রুবকে আক্রমণ করল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কিন্তু এ ঘানা আমি ঘটাব।
কী ঘটাবে?
তোমাদের রক্তের বিশুদ্ধতার শুচিবাই আমাকে ভাঙতেই হবে।
ধ্রুব উদাস গলায় বলে, ভাঙাই উচিত। ভাঙো।
আমি তোমার পারমিশান চাইনি।
চাওনি, তবু আমি দিলাম। এমনকী এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে কো-অপারেটও করতে পারি।
তার মানে?
আমি বলছি, তোমার এই ভেনচারে আমার সায় আছে। আমি হেলপও করতে পারি।
রেমি এই অদ্ভুত ও কিম্ভুত লোকটার দিকে হতবুদ্ধির মতো চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বিশ্বাস করো যে, সমীরের সঙ্গে আমার সত্যিই কিছু হতে পারে? এটা কি সম্ভব?
ধ্রুব মৃদুস্বরে বলে, আমার মতামত চাইছ কেন?
তুমি আমার স্বামী, তোমার মতই আমার কাছে সবচেয়ে ইমপরট্যান্ট।
আমি নামকোবাস্তে স্বামী।
সে তো ঠিকই। তবু আমার জানা দরকার, কথাটা তুমি বিশ্বাস করো কি না।
ধ্রুব একটু সময় নিল। নিজের নখগুলোর দিকে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলল, অনেকক্ষণ ভ্যাজরং-ভ্যাজরং করছি। আর ভাল লাগছে না।
বলবে না? কথাটা আমার যে জানা ভীষণ দরকার।
কেন, আত্মহত্যাফত্যা করবে নাকি?
সেটা জানার পর ঠিক করব।
আজকাল এসব আকছার হয়। আত্মহত্যা-ফত্যা করে বোসো না। তাহলে তোমার শ্বশুরের পলিটিক্যাল কেরিয়ার ফিনিশ হয়ে যাবে।
রেমি ঠান্ডা মাথাতেই বলে, বলো।
ধ্রুব মাথা নাড়ল, না করি না।
সত্যি বলছ?
বলছি।
তাহলে? তাহলে বাচ্চাটা নষ্ট করলে কেন?
বহুত জেরা করছ ভাই।
একথাটার জবাব দাও।
শুধু একথার জবাব দিলেই হবে?
হবে।
আমার ধারণা তোমার প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে কারও সন্দেহ হয়েছিল। সে চায় এই বংশের ধাবায় কোনও বরক্ত এসে যেন না মেশে। এবং তার সেই সন্দেহের সম্মান রাখতেই ঝামেলাটা করতে হয়েছিল।
তিনি কি শ্বশুরমশাই?
হতে পারে। তবে আমাকে কৃষ্ণকান্তবাবু এম এল এ এবং মাননীয় মন্ত্রী নিজের মুখে কিছু বলেননি। তবে সন্দেহটা এ বাড়ির বাতাসে জীবাণুর মতো সংক্রামিত হয়েছিল।
তোমাকে তো কেউ নিশ্চয়ই বলেছিল!
না। আমি টের পেয়েছিলাম।
এটা কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?
বলি। আমি প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলি। অপ্রয়োজনে নয়।
আমি আজই তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।
উইশ ইউ গুড লাক। তৈরি হয়ে নাও।
রেমি উঠল এবং বাস্তবিকই একটা ছোট ব্যাগ গোছাতে লাগল।
ধ্রুব অলস চোখে ব্যাপারটা দেখতে দেখতে কয়েকবার হাই তুলল।
তারপর উঠে পোশাক পরে বেরিয়ে গেল।
কাউকেই কিছু বলল না রেমি। কারও অনুমতি নিল না। তার মাথা আর বুক জুড়ে একটা ঘৃণা রাগ আর ধিক্কারের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে কিছু সঠিক ভাবে চিন্তা করতে পারছে না। উচিত-অনুচিতে বোধ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বাপের বাড়িতে এসে দুদিন প্রায় নির্বাক রইল রেমি। কারও প্রশ্নের জবাব দেয় না। কারও দিকে তাকায় না। শুধু গভীর রাতে বালিশে মুখ ঠেসে ধরে কেঁপে কেঁপে কাঁদে।
আশ্চর্য এই, তিন দিনেব মধ্যেও তার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ খোঁজ করতে এল না। ব্যাপাবটা অস্বাভাবিক। রেমির বাপের বাড়ির সকলেই খানিকটা চিন্তিত উদ্বিগ্ন। কিন্তু রেমির মুখে কিছু না শুনে তারাও কৃষ্ণকান্ত বা ধ্রুবকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ভরসা পায় না। রেমির বাপের বাড়িতে ফোন নেই, থাকলেও ও বাড়ির থেকে কেউ খোঁজ করত কি না কে জানে।
চতুর্থ দিন অফিস থেকে ফিরে রেমির বাবা নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, আজ কৃষ্ণকান্তবাবুর সেক্রেটারি আমার অফিসে ফোন করেছিলেন।
উদ্বিগ্ন রেমির মা বললেন, কী কথা হল?
এমনি। রেমি কেমন আছে জানতে চাইল।
আর কিছু বলল না?
না।
আমি তো মেয়ের ভাবগতিক ভাল বুঝছি না। ওরা বাঙাল মানুষ, মেয়ে বোধহয় মানিয়ে নিতে পারছে না।
শুধু বাঙাল নয়, জামাই বাবাজিও সুবিধের লোক নয়। এখন বুঝতে পারছি না বিয়েটা দিয়ে ঠিক কাজ করেছি কি না।
ছোট বাড়ি। পরিসর কম। সব কথাই রেমির কানে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে বিস্ফোরণ ঘটে। সে আর সব সহ্য করতে পারে, শুধু ধ্রুবর প্রসঙ্গটা বাদে। ওই একটা বিষয় নিয়ে কেউ কিছু বলুক তা সে সইতে পারে না।
রেমি কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করল না। এমনকী জিনিসপত্র পর্যন্ত গোছাল না। হাতব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে ট্যাকসি ধরল। সোজা শ্বশুরবাড়ি কালীঘাট।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল সে।
ধ্রুব খুব রাত করল না। এমনকী মদ খেয়েও আসেনি। বেশ ক্লান্ত চেহারা। বোধহয় অফিসে খাটতে হয়েছে।
ঘরে ঢুকে থমকে গিয়ে বলল, আরে! আমি ভাবছি ওদিকে তুমি এ বাড়ির তলায় ডিনামাইট ফিট কবার জন্য গর্ত খুঁড়তে লেগেছ! আর তুমি নিজেই রিটার্ন পোস্টে ব্যাক করলে?
করলাম। তোমার কি একটু অসুবিধে হল?
আরে না। তুমি থাকলে একটু ঘেঁষাঘেঁষি হয় বটে, স্পেস কমে যায়, কিন্তু তাতে কী?
আমি থাকলে তোমার স্পেস কমে যায়?
তা একটু কমবারই তো কথা। এক ঘরে দুজন থাকলে।
শ্বশুরমশাই দোতলায় আমার ঘর ঠিক করে রেখেছেন, তা তো জানোই।
জানব না কেন! আমি বেশি মাতলামি করলে তুমি গিয়ে সেই ঘরে কত দিন থেকেও ছিলে।
এখন যদি পাকাপাকিভাবে ওপরেই থাকি?
থাকো। এ গুড ডিসিশন। ওয়াইজ।
তোমার সুবিধে হবে? সত্যিই হবে?
আঃ মাইরি! তুমি বহুত বকাবাজ আছে।
আজ তো মদ খাওনি, তবু ওরকম রকবাজের মতো কথা বলছ কেন?
একটু দিল্লাগি করছি।
তোমার ইয়ার্কি আমার ভাল লাগছে না। তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না কেন?
পারি না কে বলল? খুব পারি।
না পারো না।
বাপের বাড়িতে কী হল? ওখানেও খিচ লেগেছিল নাকি?
না। আমি নিজেই থাকতে পারিনি।
বিরহ নাকি!
হতে পারে।
তুমি খুব অদ্ভুত আছ। সেলফ-রেসপেক্ট নেই।
নেই। তুমি আমার খোঁজ নাওনি কেন?
নেওয়ার কথা ছিল বুঝি?
কথা ছিল না। তবু নিতে পারতে!
আমি ভাবলাম তুমি ওখানে গিয়ে বেশ আছে। খামোকা ঝামেলা মাচিয়ে লাভ কী?
না, তা ভাবোনি।
তবে কী ভেবেছি বলো তো অন্তর্যামী?
তুমি আমার কথা মোটেই ভাবোনি।
ধ্রুব খুব চিন্তিতভাবে নিজের মাথায় দুটো টোকা মেরে বলল, ভাবিনি। সত্যিই ভাবিনি নাকি? ঠিক জানো! না, এক-আধবার নিশ্চয়ই ভেবেছি।
ইয়ার্কি কোরো না। তুমি জানো, বাপের বাড়িতে মেয়েদের স্বামীর জন্য কতটা অপমান সইতে হয়?
কে অপমান করেছে তোমাকে?
তা শুনে আর কী হবে?
তবু বলো। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।
কেউ আমাকে অপমান করেনি। করেছো তুমি।
আমি? আমি কী করলাম?
খোঁজ নাওনি। একবার যাওনি। শুধু তুমিই নও। এ বাড়ির কেউ খোঁজ করেনি।
তুমি কদিন হল গেছ?
তাও মনে নেই? চার দিন।
ওঃ চার দিন! আমি ভাবছিলাম, কাল-পরশুই একবার যাব।
উঃ মুখে আসেও সব মিথ্যে কথা!
না, সত্যিই একবার ভেবেছিলাম কিন্তু।
রেমি একটু হাসল। ম্লান হলেও হাসিটা তার বুক থেকেই উঠে এল। সাজানো নয়। মাথা নেড়ে সে বলল, জানি, সব জানি।
ধ্রুব তার মুখোমুখি বসে বলল, তবু আমার ওপর সত্যিকারের রাগ করতে পারছ না?
রেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, পারছি। আমার সব রাগ এখন তো তোমারই ওপর। কিন্তু সে রাগেব তো কোনও দাম নেই।
কে বলল তো?
যে রাগের দাম দেয় তার ওপরেই রাগ করা যায়।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, মেয়েমানুষকে আমি ভাল চিনি না, বুঝলে! মাকে যদি পেতাম, বুঝতাম।
ওটা কোনও কথা হল না।
ওটাই কথা। তুমি বুঝবে না। ওটাই কথা।
ওটা তো অতীত। বহু দিন পার হয়ে গেছে।
ধ্রুব মাথা নাড়ে, অতীত হলে বেঁচে যেতাম। মা এখনও রোজ আমার মনে এসে হানা দেয়। না, কথাটা ঠিক হল না। মার সবটুকু নয়। শুধু একটা দৃশ্য। সারা গায়ে আগুন, তার মধ্যে মা–আমার ভীষণ ফরসা মা কালো থেকে আরও কালো হয়ে যাচ্ছে। বীভৎস!
রেমি সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকে। কতদিন নিজেকে নিয়েও একরকম দৃশ্য কল্পনা করেছে সে। কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন দেবে, নয়তো গলায় ফাঁস আটকে ঝুলবে, বিষ খাবে।
ধ্রুবর মায়ের কথা খানিকটা শুনেছে রেমি। বেশি শুনতে চায়নি সে। তার মনে হয়েছে মায়ের ঘটনাটাকে ধ্রুব সুকৌশলে বাপের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে কাজে লাগাচ্ছে। শোক এত দীর্ঘস্থায়ি হয় না কখনও।
রেমি বলল, ওরকম একটা দৃশ্য এখন দেখতে তোমার কেমন লাগবে?
তার মানে?–ধ্রুব একটা কল্পনার স্তর থেকে নেমে এল।
যারা গেছে তারা তো গেছেই, যারা আছে তাদের ধরে রাখতে হবে তো!
ধ্রুব গম্ভীর হল। বলল, হুঁ।
আমি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছিলাম না।
ধ্রুব জামাকাপড় পালটাতে লাগল। তারপর বলল, শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেছ?
না।
উনি কদিন খুব দুশ্চিন্তা করছেন তোমার জন্য।
তাই বুঝি খোঁজ নেননি।
খোঁজ নিতে ওঁর সম্মানে লাগে হয়তো। বিশেষ করে পুত্রবধূর বাপের বাড়িতে। কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতে পারো। এ কয়দিন উনি ভাল করে খাননি, ভাল ঘুমোননি। শুনেছি আমার উদ্দেশে অজস্র কটুকাটব্যও করেছেন।
রেমি খুশি হয়ে বলল, তোমার দোষ কী?
ওঁর ধারণা আমার জন্যই তুমি রাগ করে বাপের বাড়ি গেছ। অথচ প্রকৃত ব্যাপারটা জানার কোনও উপায় নেই। অক্ষম আক্রোশে এই চারদিন উনি কনটিনিউয়াস ফ্রঁসেছেন।
রেমি উঠে পড়ল। বলল, যাই গিয়ে বলে আসি যে, আমি এসেছি।
ধ্রুব গম্ভীর হয়ে বলল, যাও। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো। উনিই সেই ভিলেন যিনি রক্তের বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী। উনিই সেই খলচরিত্র যিনি তোমাব চরিত্রের ইন্টিগ্রিটিতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরে সমীরকে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন। উনিই সেই—
রেমি হাতজোড় করে বলল, দয়া করে চুপ করবে?
কেন বলো তো!
আমি সব জানি।
তবু মনে করিয়ে দিলাম। লোকটাকে যতটা শ্রদ্ধা করা উচিত নয় ততটা কোরো না।
আমি অত হিসেব জানি না। শুধু এটুকু জানি, সব সত্ত্বেও উনি আমাকে স্নেহ করেন।
স্নেহ নয় ভাই, গাড্ডা। গভীর গাড্ডা।
হোক গে। আমি তো গাড্ডাই চাই। তুমি তো তাও দিতে পারোনি।
আমি আর উনি! মন্ত্রীর ভালবাসার দাম কত বেশি!
রেমি রাগ করে চলে গেল।
কিন্তু কৃষ্ণকান্ত তখনও ফেরেননি। কোথায় একটা সেতু উদ্বোধন করতে গেছেন। ফিরতে রাত হবে। নাও ফিবতে পারেন।
তবে কিছুক্ষণ রাইটার্সে ফোনে চেষ্টা করে জেলা শহরের সার্কিট হাউসের নম্বর জোগাড় করল রেমি।
কৃষ্ণকান্ত তার গলা শুনেই সোল্লাসে টেলিফোনে চেঁচিয়ে উঠলেন, ফিরেছ মা, ফিরেছ! বাঁচালে!
আপনি ফিরবেন না বাবা?
ঠিক ছিল, আজ আর ফিরব না। কিন্তু তুমি যখন ফিরেছ তখন আর কথা কী! এক্ষুনি রওনা হচ্ছি।
দুঘণ্টার মধ্যেই কৃষ্ণকান্ত ফিরলেন। দু-তিন ঘণ্টার মোটরদৌড়ের পরও তার মুখে হাসি উপচে পড়েছে। চোখ চিকমিক করছে আনন্দে।
রেমি বুঝল, এই আত্মম্ভরী কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিষ্ঠুর ও আত্মকেন্দ্রিক লোটার কাছ থেকেও তার মুক্তি নেই। স্নেহের মতো শক্ত বাঁধন আর কী আছে? খুনি ডাকাত বাপকেও তার মেয়েটা সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসে। রাত্রে রেমি যখন ফিরল তখন ধ্রুব বই পড়ছে। অদ্ভুত সব বই পড়ে সে। শক্ত বিষয়। খটোমটো।
বইটা এক টানে নিয়ে রেখে দেয় রেমি। বলে, এবার তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া।
ধ্রুব একটু হাসল। কী অদ্ভুত মাদক হাসি। রেমির পায়ের তলায় ভূমিকম্প হতে লাগল। বুক উথাল-পাথাল।
» ০২৫. মুখখানা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন
তোমার মুখখানা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
কোথায় শুকনো?–বলে নিজের অজান্তে গালে একটু আঙুল বোলায় বিশাখা।
দেখাচ্ছে শুকনো-শুকনো৷ বলে একটু ইঙ্গিতময় হাসি হাসে চুনী, তোমার কিছু হল নাকি?
বিশাখা একটু লাল হয়। বলে, যাঃ।
আজ চলে, গাঙে গিয়ে খুব ড়ুবিয়ে স্নান করে আসি। কী সুন্দর টলটলে জল!
যেতে দেবে না। মনুপিসিকে তো চিনিস না!
কত মেয়ে তো করছে।
সকলের মতো কি আমরা? বললেই বলবে, ধিঙ্গি মেয়ে ড্যাং ড্যাং কবে সকলের নাকের ওপর দিয়ে নাইতে যায় নাকি? এ বাড়ির মান-সম্মান নেই?
তাহলে ঝিয়েরা কাপড় আড়াল করে নিয়ে যাক।
দূর! সে আমার লজ্জা করে। দুধারে চারজন কাপড় টান করে আড়াল করবে আর মাঝখান দিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে যাওয়া, ও আমার ভাল লাগে না।
চুনী একটু মন-খারাপ গলায় বলে, তোমাদের অনেক ঝঞ্ঝাট। এটা বারণ, সেটা বারণ।
বিশাখা রাগ করে বলে, বারণ তত বেশ। আমরা কি আর-সকলের মতো সস্তা নাকি?
কুলতলার নিবিড় ছায়ায় ঘাসের ওপর দুজন বসা। কিছু কড়ি চিত উপুড় হয়ে পড়ে আছে ঘাসে। চুনী সেগুলো গুছিয়ে তুলছে একটা পুঁতির কাজ করা থলিতে। কত খেলনা আর কত সুন্দর সুন্দর জিনিস এদের। মাঝে মাঝে চুনীর ইচ্ছে করে এক-আধটা জিনিস কাপড়ের আড়ালে নিয়ে চলে যায়। এরা টেরও পাবে না। কিন্তু টের পায় আর-একজন। সে হরি। হরিখুডোর যেন একশো জোড়া চোখ। চতুর্দিকে ঘুরছে আর হিসেব নিচ্ছে। একটা পানের বোঁটা পর্যন্ত ভাঙার উপায় নেই। চুনীর রাগ হয়। হরি এ বাড়ির চাকর ছাড়া আর কিছু তো নয়। তফাত শুধু এই যে, সে কর্তাবাবুর চাকর। তার জোরেই সে এ বাড়ির আর সব ঝি-চাকরকে দাবড়ায়। এমনকী জুতো মারে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করেও দেয়। তার ওপর কথা বলার লোক নেই। নতুন ঝি-চাকর রাখেও সেই। তার পছন্দ না হলে। এ বাড়িতে কাজ পাওয়ার উপায় নেই।
চুনী কড়িগুলো তুলে থলির মুখে লাল টুকটুকে দড়ির ফাঁস টেনে বন্ধ করে বলে, তোমার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে জানো?
বিশাখা দুখানা বড় বড় চোখ চুনীর মুখে স্থিরভাবে স্থাপন করে বলে, তোকে কে বলল?
চুনী একটু ভয় খেয়ে বলে, শুনেছি। কেন, তুমি জানো না? রাজেনবাবুর ছেলে শচীনবাবু–সেই যে ভারী সুন্দর চেহারা!
সুন্দর না হাতি!
তোমার পছন্দ নয়?
ওকে পছন্দ হবে কেন?
তবে তোমার কাকে পর্যন্ত?
তা জেনে তোর কী হবে? তোর কাকে পছন্দ?
আমার! আমার আবার পছন্দের কী?
তবে আমার কথা তোকে বলব কেন?
চুনী হিহি করে হাসে। তারপর উঠে বলে, চলো, চান করি গে। আজ তোমার পায়ে ঝামা ঘষতে হবে। মনু ঠাকরুন বলে দিয়েছে।
বিশাখা নড়ল না। অলস আনমনে বসে চারদিককার ঝুরো ছায়ার দিকে চেয়ে কীরকম বিভোর হয়ে থাকে।
চুনী জানে সে বিশাখার সখী নয়, বন্ধুও নয়। সঙ্গী বটে, কিন্তু আসলে সে বিশাখার ঝি। কাজেই বেশি ঘটাতে সাহস পায় না সে। বিশাখা এমনিতে ঠান্ডা সুস্থির হলে কী হয়, রেগে গেলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়ে। রাগ পুষে রাখে। তবুচুনী নিজের মতো করে বিশাখাকে ভালবাসে। অত রূপ, ভাল না বেসে পারা যায়?
এই যে ঘন দুপুর, শেষ শীতের কবোষ্ণ রোদে এক ঝিমঝিম নেশারু মাদকতা ছড়িয়ে রেখেছে। চারধারে তা বিশাখাকে টেনে নেয় বুকের মধ্যে। কুলতলার ঝুরো ছায়া আর চারদিককার গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ফরসা চাদরের মতো টানটান বোদ তাকে এক অদ্ভুত পুরুষের স্বপ্ন দেখায়। সে পুরুষ সাধারণ নয়। অপাপবিদ্ধ, দুর্মর সাহসী, বিশ্বজয়ি সেই মানুষ বোধ হয় স্বপ্নেই বাস করে। তবু তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বিশাখার উপায় কী?
অনেকক্ষণ আনমনে বসে থাকে বিশাখা। চুনী উসখুস করে। তার মাথায় উকুন কুটকুট করছে। পেটের মধ্যে নাচছে খিদের বাঁদর। বিশাখার মুখের থমথমে ভাব লক্ষ করে সে কিছু বলতে সাহস পায় না।
কিছুক্ষণ বাদে অবশ্য বিশাখা নড়ল। উঠল। একটা হাই তুলে বলল, চল যাই।
পুকুরঘাটে দাসী সব সাজিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তেলের বাটি, ঝামা, গামছা, কাপড়, সাবান। বিশাখা পৈঠায় বসে। চুনী সযত্নে তার পায়ে ঝামা ঘষতে থাকে। ঘষতে ঘষতে তারও রূপমুগ্ধতার বিভ্রম ঘটে। এত সুন্দর নিটোল পা, ঝামা ঘষার কোনও দরকার নেই। একটুও ফাটা নয়, ময়লা নয়। শুধু পুরনো আলতার দাগ। সেটা উঠে যাওয়ার পরও টুকটুকে লাল। দুখানি পা-কে যেন মা দুর্গার পা বলে মনে হয়। কী সুন্দর! ইচ্ছে করে পা দুখানায় ঠোঁট ঘষে, কপালে চেপে রাখে কিছুক্ষণ।
চুনী!
বলো।
সুফলা তোকে কিছু বলেছে?
হুঁ।
কী বলেছে?
এর মধ্যে কবে যেন নায়েবমশাই গিয়েছিলেন ওদের বাড়ি।
কথা পেড়ে এসেছে, না?
তাই তো বলো। কর্তাবাবু রাজেন মোক্তারকে ডেকে পাঠিয়েছে।
কবে আসবে বুড়োটা?
তা অত জানি না।
এ বিয়ে হবে না।
ইস!
ইস আবার কীসের?
আমার যদি ওরকম বর জুটত তাহলে আনন্দে নাচতাম।
আমি আর তুই কি সমান?
তা বলিনি। কিন্তু শচীনবাবু কী ভাল দেখতে বলো!
তেমন কিছু নয়।
এ শহরে ওর মতো সুন্দর আর কেউ নেই।
আছে। তুই গগনবাবুর ছেলেকে দেখেছিস?
কোকাবাবুর নাতি? দেখব না কেন? সেও অবশ্য সুন্দর।
শচীনের চেয়ে ঢের সুন্দর।
চুনী একটু দ্বিধার গলায় বলে, কেমন যেন একটু গোঁয়ার মতো আছে!
তার মানে?
একটু বেশি লম্বা-চওড়া।
পুরুষ মানুষ তো ওরকমই ভাল।
চুনী ফের একটু দ্বিধায় পড়ে। খুব ভয়ে-ভয়ে বলে, শরৎ কিন্তু তোক ভাল নয়।
শরৎ কী রে! শবৎবাবু বল।
ওই হল। শরৎবাবু নাকি-হি হি–
হাসছিস কেন?
মদ-টদ খায়, জানো?
তোকে কে বলল?
সবাই জানে।
আর কী করে?
বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে।
সেটা কি খারাপ?
তা নয়। মেয়েমানুষের দোষ আছে।
বাজে কথা।
তোমার কি শরৎকে পছন্দ?
তাতে তোর কী?
না, কিছু না। আমার কাছে শচীনবাবুকে বেশি ভাল লাগে। বেশ নরম-সরম মানুষ।
খেটে খায়। খেটে খাওয়াটা কি খুব বড় কথা নাকি? ভীষণ গরিব ছিল ওরা।
জানি।
মনুপিসিই সব নষ্টের গোড়া। আপদ বিদেয় করার জন্য যা তা একটা ছেলেকে ধরে গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে!
চুনী বিশাখার ভিতরকার গনগনে রাগের আঁচ টের পেয়ে ভয়ে চুপ করে গেল। এখন মতামত করতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। পা ঘষা শেষ করে ঝাঝালো সরষের তেল হাতের তেলোয় নিয়ে বিশাখার কোমল সুন্দর হাত আর পায়ে মাখাতে লাগল সে। মহেন্দ্রর ঘানিতে রাই সরষে পিষে তৈরি করা তেল। কী মিষ্টি গন্ধ। যে তেলটি চুলে দেয় বিশাখা, যে সাবানটি মাখে তাদের গন্ধ চুনীকে পাগল করে দেয়। এই বাজকন্যার মতো সুন্দরী মেয়েটিকে সে বোজ ছোয়, এর দামি সাবান আর তেল তার হাতে লেগে থাকে, এসবই নিজের সৌভাগ্য বলে মনে করে চুনী। ভারী গৌরব বোধ করে। কিন্তু বিশাখার পছন্দ কি ভাল? শরৎকে সে চেনে। চেহারাটা খারাপ নয়, কিন্তু ভীষণ রাগী, বুনোলোক। আর শচীনবাবুর চেহারাটা কী মিষ্টি! কত লেখাপড়া জানে!
বিয়ের কথা ওঠার ফলেই বোধ হয় ইদানীং সুফলা খুব একটা আসে না।
বিশাখা জলে নামতে নামতে বলল, সুফলাকে একটা খবর দিস তো। ওর সঙ্গে কথা আছে।
চুনী বলল, দেব।
আজই কিন্তু। বলিস জরুরি দরকার।
বিকেলে সুফলা এল। জমিদারবাড়ির মেয়ের সঙ্গে দাদার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে, এটা তাদের কাছেও খবরের মতো খবর। তার ওপর পাত্রী তার প্রাণের বন্ধু। সুফলার মুখে-চোখে একটা চাপা আনন্দ ডগমগ করছিল। চোখের দৃষ্টিতে একটু লজ্জা-লজ্জা ভাবও। এসেই বিশাখাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কেমন আছিস? কদিনে রোগা হয়ে গেছিস কেন?
বিশাখার মুখটা খুব খুশি দেখাল না। গম্ভীর মুখে বলল, ছাদে চল, কথা আছে।
তাদের ছাদটি বিশাল। মাঠের মতো বড় সেই ছাদে অনেক রকম বসার জায়গা আছে। শ্বেতপাথরের আরামকেদারা, পাথরের বেদি। বড় বড় ফুলের টব আছে অনেকগুলো। আছে বড়ি আর আমসত্ত্ব রোদে দেওয়ার জন্য জালের ঘর, যাতে পাখি এসে না ঠোকরাতে পারে।
সাদা বেদিটার ওপর দুজন পা তুলে বসে।
মানুষের মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বলতে বিশাখা কখনওই সংকোচ বোধ করে না। এমনকী দাদা-দিদিদের মুখের ওপরেও সে অনেক কথা বলে দেয়। শুধু বাবার প্রতি তার এক ধরনের সমীহ আছে।
বিশাখা সুফলার দিকে তাকিয়ে বলল, তোদর এখন অবস্থা বেশ ভাল হয়েছে, তাই না?
সুফলা একটু থতমত খেয়ে বলে, কীসের অবস্থা?
সংসারের অবস্থার কথা বলছি। ন্যাকা, বুঝিস না কিছু?
সুফলা একটু গম্ভীর হয়ে বলে, সংসারের খবর অত জানি না।
খুব জানিস। কদিন আগেও তো খেতে পেতিস না ভাল করে। চেয়ে-চিন্তে চলত।
সুফলা চঞ্চল হয়ে ওঠে। মুখে থমথমিয়ে ওঠে কান্না। বলে, এসব কথা কেন বলছিস?
বিশাখার খুব ভাল লাগতে থাকে। নিষ্ঠুরতার মধ্যে সে এক রকম তীব্র আনন্দ বোধ করে। বলে, আমার মার কাছ থেকেও কতদিন চাল পয়সা নিয়ে তবে তাদের চলত, মনে নেই?
সুফলা ফোস করে ওঠে, সেসব মা শোধ দিয়েছে।
তা দিতে পারে। তোরা এখন বেশ পয়সার মুখ দেখেছিস, না?
তা জেনে তোর কী হবে?
আমার জানা দরকার বলেই জিজ্ঞেস করছি। তোর বাবা আর দাদা কত টাকা রোজগার করে রে?
সুফলার চোখে জল চিকচিক করতে থাকে। আকস্মিক এই অপ্রিয় প্রসঙ্গে সে কথার খেই হারিয়ে ফেলে। জবাব দিতে পারে না। শুধু অস্থিরভাবে এদিক ওদিক চাইতে থাকে।
বিশাখা বলে, উকিল-মোক্তারদের খুব কাঁচা পয়সা হয় বলে শুনেছি। আমাদের জমিদারিটা কিনে নিতে পারিস তোরা? সে ক্ষমতা আছে?
সুফলার চোখে জল, ফোঁপানিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে বুক। তবু খুব তেজের সঙ্গে বলল, অত দেমাক করিস না। তোদের জমিদারির অবস্থাও জানি।
কী জানিস?
অনেক জানি। আমার দাদা সব কাগজপত্র দেখেছে।
তাই নাকি? কী দেখেছে?
আমাদের জমিদারি নেই বলে তো আর না খেয়ে থাকি না। তোদের কদিন পরেই হাঁড়ির হাল হবে।
বিশাখার সুন্দর মুখটায় আক্রোশের হিংস্রতা দেখা দেয়। জমিদারির অবস্থা যে ভাল নয় এটা সেও শুনেছে। সে বলল, তোর দাদাকে মাইনে দিয়ে রাখছি তো আমরা, সেই ক্ষমতা তো এখনও আছে।
আমার দাদা কি তাদের চাকর?
তাছাড়া আর কী?
দাদাকে তো তোর বাবা হাতে-পায়ে ধরে সেধে জমিদারি দেখার কাজ দিয়েছে। অতই যদি দেমাক তবে দাদার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করার দরকার কী ছিল?
বিশাখা একটু হাসল, বাবার মতিচ্ছন্ন হয়েছে বলে করেছে।
তাহলে আমাকে বলতে আসিস কেন? আমরা অত ল্যালা না। তোরাই ল্যালা। আজই আমি বাড়ি গিয়ে সব বলছি।
বলিস। আমি তাই চাই। কুঁজোর আবার চিত হয়ে শোবার সাধ! ইঃ!
ভারী তো তিন পয়সার জমিদারি, তাও খাজনা আদায় হয় না, ঠাটবাটই সার।
একথাও কি তোর দাদা বলেছে?
বলেছেই তো। জমিদারি রাখতে হলে তোর বাবাকেও ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে ধার করতে বেরোতে হবে।
বিশাখা বিভীষণ মুখে চুপ করে বসে রইল।
সুফলা কাঁদতে কাঁদতে এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নীচে।
আপনমনে বিশাখা একটু হাসে। বিয়েটা শেষ অবধি হবে না হয়তো। সুফলা গিয়ে বলবে। কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে।
ছাদ থেকে নেমে সে মুখে ভালমানুষি মাখিয়ে মনুপিসির কাছে চুল বাঁধতে বসল।
রঙ্গময়ি জিজ্ঞেস করে, সুফলা এসেছিল নাকি?
হুঁ।
রঙ্গময়ি চুপ করে থাকে। বোধ হয় ভয়ে।
বিশাখার বিষদাঁত একটু সুলসুল করে। বিষ ঢালার একটা জা.গা চাই তো! চুলের জট ছাড়ানোর বাঁকুনিতে মাথাটা পিছন দিকে হেলে যাচ্ছিল। মুখটা সামান্য বিব্রত। বলল, মোক্তারের মেয়ের খুব তেজ।
রঙ্গময়ি মন্তব্য করে না।
বিশাখা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, বলে কী জানো! বাবাকে নাকি খাজনার দায় মেটাতে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে বেরোতে হবে।
একথা বলল কেন?
কাঁচা পয়সা পাচ্ছে তো। ধরাকে সরা দেখছে।
কী থেকে কথাটা উঠল?
কী আবার? কথার পিঠে কথা।
মেয়েটার মুখ তত ভাল নয়।
সেই কথাই তো আমি তোমাকে বলি।
কী বলিস?
ওরা ভাল নয়।
রঙ্গময়ি মৃদু একটু হাসল। বলল, কী করে বুঝলি? শুধু সুফলার সঙ্গে ঝগড়া করলেই কি সব বোঝা যায়?
ঝগড়া আবার কীসের? ঝগড়া হয় সমানে-সমানে।
মানুষকে ছোট মনে করিস কেন? এই যে আমাকে পিসি বলে ডাকি, আমিও তো তোদের সমান নই। গরিব পুরুতের মেয়ে, পিসি না বলে নাম ধরে ডাকলেই তো পারিস তাহলে।
তোমার কথা আলাদা।
কিছুই আলাদা নয় রে। মানুষকে অত পর ভাবতে নেই।
তুমি একটু অদ্ভুত আছো পিসি। ওরা আমাদের সমান নয় সে কথাই বলেছি। নইলে সুফলা তো আমার বন্ধুই।
তুই সুফলার সঙ্গে কেন ঝগড়া করেছিস তা আমি জানি।
বিশাখা ঝামড়ে উঠে বলে, আমি মোটেই ঝগড়া করিনি। কেন করতে যাব? ওদের আমি মানুষ বলেই মনে করি না। ঝগড়া ও করেছে।
বিয়ের ব্যাপারে তোর মত নেই, সে কথা তোর বাবাকে না হয় আমি জানিয়ে দেব। তুই আর কিছু করতে যাস না।
বিশাখা চুপ করে রইল। কিন্তু তার মুখ-চোখ ফেটে পড়ছে অভ্যন্তরীণ রাগ ও উত্তেজনায়।
চমৎকার একটা খোঁপা করে চিরুনি গুঁজে দিল তাতে রঙ্গময়ি। আঙুলের নিপুণ চাপে খোঁপাটা ঠিকঠাক করে বসিয়ে দিল। তারপর বলল, এই তোর শেষ কথা তো!
কোনটা আবার শেষ কথা?
শচীনকে বিয়ে করবি না, এই তো?
ওকে করব কেন?
সেটাই ভাল করে জেনে গেলাম। তোর বাবাকে আজই বলব।
বিশাখার মুখ একটু বিবর্ণ হয়ে গেল। বলল, আমার কথা বলে বলবে নাকি পিসি?
তাহলে কার কথা বলব?
বাবা যে আমার ওপর রাগ করবে।
রাগ করবে কেন? তবে প্রস্তাবটা এক রকম হয়ে গেছে, সেটা ফিরিয়ে নিতে সম্মানে লাগবে। তবু আমি বলি মেয়েদের অমতে বিয়ে দেওয়া ভাল নয়।
বিশাখার সুর অনেক নরম হয়ে গেল। বলল, বাবাকে আমার কথা বোলো না।
তবে কী বলব?
বোলো তোমার পছন্দ নয়। তোমার কথা তো বাবা খুব শোনে।
রঙ্গময়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমাকে কেন নিমিত্তের ভাগী করতে চাস? এসবের মধ্যে আমি থাকতে চাই না। শচীনকে পছন্দ করেছিলাম আমিই।
শচীনকে তোমার কীসে পছন্দ বলো তো?
কী জানি, আমার হয়তো চোখ নেই।
নেই-ই তো পিসি। ও এমন একটা কী পাত্র?
ওকে তোর এত অপছন্দের কারণ কী বল দেখি! বলবি?
ওদের বাড়ি ভাল নয়। কেমন সব গরিব-গরিব স্বভাব।
রঙ্গময়ি হেসে ফেলল। আবার গম্ভীর হয়ে গেল।
বিশাখা হঠাৎ রঙ্গময়ির গলা জড়িয়ে ধরে বয়সোচিত আদুরে গলায় বলল, তুমি আমার ওপর রাগ করেছ পিসি?
রঙ্গময়ি মা-মরা এই বাচ্চাদের নিজের ছায়া দিয়ে তাপ দিয়ে বড় করেছে এতটা। তাই এই আদরে তার বুকের মধ্যে অভিমানের একটা তুফান উঠতে চাইছিল। কিন্তু রঙ্গময়ি জোর করে চাপা দিল সেটা।
বিশাখার থুতনিটা একটু নেড়ে দিয়ে বলল, না, আমার রাগ করতে নেই। আমি রাগ করলে যে ভূমিকম্প হয়ে যাবে। যা, খেলা কর গে।
বিশাখা আস্তে আস্তে উঠে বারবাড়ির দিকে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। জড়োসড়ো ভাব। শীত এখন যাই-যাই। বেলা চট করে পড়ে না। এখনও রোদ আছে।
ব্রহ্মপুত্রের দিকে অনেকগুলো কদম গাছ। মলিন চেহারা। তার ওপর পিঙ্গল আকাশ। চেয়ে ছিল বিশাখা।
একটা সাইকেল বড় রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে বাড়িতে ঢুকল।
বিশাখা ত্বরিৎপদে একটা থামের আড়ালে সরে যায়।
শচীন এল। রোজ এ সময়ে আসে। কাছারিবাড়িতে বসে কাগজপত্র দেখে। পরনে উকিলের পোশাক।
থামের আড়াল থেকে বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল বিশাখা।
» ০২৬. আচমকা একদিন দুপুরে
আচমকা একদিন দুপুরে জয়ন্ত এসে হাজির।
রেমি একটু অবাক হল। জয়ন্ত তার ছোট ভাই। কিন্তু তার বিয়ের পর থেকে এ বাড়িতে বাপের বাড়ির কেউ বড় একটা আসে না। কৃষ্ণকান্ত ঠারেঠোরে এটা জানিয়ে দিয়েছেন; বিয়ের পর মেয়েদের বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক যতটা ক্ষীণ হয় ততই ভাল। পালে-পার্বণে বা পারিবারিক বিয়ে উৎসবে একটু-আধটু দেখা হোক। ব্যস, তার বেশি নয়। মেয়েদের যতক্ষণ বাপের বাড়ির পিছুটান থাকে ততদিন শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক গাঢ় হয় না। আর সেই থেকেই আসে সংসারের অশান্তি। এ ব্যাপারটা রেমি মেনে নিয়েছে। তার বয়স অল্প হলেও বুদ্ধি বিবেচনা অপরিণত নয়। বাপের বাড়ির সঙ্গে এই আলগা সম্পর্কের যৌক্তিকতা সে বোঝে। আপাতনিষ্ঠুর হলেও আখেরে এতে ভালই হয়।
কৃষ্ণকান্তর এইসব অনুশাসনকে তার বাপের বাড়ির লোক ভাল চোখে দেখেনি। অপমান হিসেবেও গায়ে মেখেছে। তাই এমনিতেই কেউ বড় একটা আসে না। তারা গরিব না হলেও টাকা পয়সা বা ক্ষমতায় কৃষ্ণকান্তর ধারেকাছেও নয়। সেই সংকোচ এবং ভয়ও কিছু দূরত্ব রচনা করে থাকবে। রাগ করে যে কয়েকদিন রেমি গিয়ে বাপের বাড়িতে ছিল তাইতেই বাবা মা বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিল।
জয়ন্তকে দেখে রেমির বুক কেঁপে উঠল একটু। কোনও দুঃসংবাদ নয়তো!
কী রে? তুই!
জয়ন্ত ঠিক কিশোর ছেলেটি নেই। অল্প কয়দিনেই ধাঁ করে একটু লম্বা হয়ে গেছে। গালে সামান্য দাড়ি। গলার স্বর ভেঙে মোটা হয়ে গেছে। চোখে এসেছে তীক্ষ্ণ ও স্থির দৃষ্টি। পোশাকে আশাকে মেন মনোেযোগী নয়। একরাশ তেলহীন রুক্ষ চুল ঘাড় অবধি নেমেছে।
জয়ন্ত দিদির দিকে চেয়ে বলল, তোর সঙ্গে কথা ছিল।
আয়। বোস এসে। কী খাবি?
তোর বাড়িতে খাব! ও বাবা, তোর শ্বশুর টের পেলে—
যাঃ। আমার শ্বশুর কি হিরণ্যকশিপু নাকি? লোকেরা বড় বাড়িয়ে বলে ওঁর সম্পর্কে।
তুই একেবারে গেছিস।
তার মানে?
ওই বুড়ো তোকে হিপনোটাইজ করে ফেলেছে। পারসোন্যালিটি বলে তোর আর কিছু নেই।
রেমি লজ্জা পেয়ে বলে, মোটেই নয়। বাইরে থেকে লোকটাকে ওরকম মনে হয়। আদর্শবাদীরা একটু তো কঠোর হবেই। কিন্তু মনটা ভীষণ ভাল।
কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী কেমন লোক তা পাবলিক জানে। তোকে অত ওকালতি করতে হবে না।
পাবলিক ছাই জানে।
জয়ন্ত একটু হেসে বলে, তোর শ্বশুর আদর্শবাদী ছিল আজ থেকে তিন যুগ আগে। এখন ওঁকে আদর্শবাদী বললে কথাটাকেই অপমান করা হয়।
রেমি একটু উষ্মর সঙ্গে বলে, আচ্ছা না হয় তাই হল। এবার কী খবর বল!
কোনও খবর-টবর নেই। আমি বাড়ির রিপ্রেজেনটিভ হয়ে আসিনি।
কোনও খারাপ খবর নেই তো!
আরে না। আমাদের নিয়ে তোকে অত দুশ্চিন্তা করতে হবে না। বরং তুই নিজেকে নিয়ে একটু ভাবলে আমাদের দুশ্চিন্তা যায়।
নিজেকে নিয়ে কী আবার ভাবব?
জয়ন্ত একটু চুপচাপ তার দিদির দিকে চেয়ে থেকে বলে, আমি বুঝতে পারছি না তুই তোর নিজের সিচুয়েশনটা সম্পর্কে কনশাস কি না।
কনশাস না হওয়ার কী?
আর ইউ হ্যাপি ইন দিস সেট আপ?
চলে তো যাচ্ছে।
আর ইউ হ্যাপি উইথ ধ্রুব চৌধুরী?
রেমি এবার রেগে গিয়ে বলে, তোর এত পাকা পাকা কথার দরকার কী বল তো! আমি হ্যাপি কি না সে আমি বুঝব।
দ্যাখ ছোড়দি, তোর যখন বিয়ে হয় তখন আমি মাইনর ছিলাম। মতামতের দাম ছিল না। তাছাড়া আমরা তত খোঁজ খবরও নিইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোর জন্য আমাদের একটু চিন্তা করা দরকার।
কেন, এতদিন বাদে চিন্তা করার মতো কী হল?
তুই আমাদের কাছে কিছুই বলিস না। কিন্তু আমাদের কানে অনেক কথা আসে।
কী এমন কথা! তোর জামাইবাবু মদ খায়, এই তো!
সেটাও একটা পয়েন্ট।
মদ খাওয়া এই পরিবারের ট্র্যাডিশন নয়। তোর জামাইবাবু খায় বটে, তবে আমার মনে হয় সেটা শুধু নেশা করার জন্য নয়।
তবে কীসের জন্য?
অন্য কারণ আছে। অত কথা তোর মতো পুঁচকের সঙ্গে বলতে পারি না।
আমি এখন আর তত পুঁচকে নই।
আমার কাছে পুঁচকেই। না হয় একটু দাড়ি গোঁফই উঠেছে, তাই বলে কি জ্যাঠামশাই হয়ে গেছিস নাকি?
উই আর অ্যাংশাস অ্যাবাউট য়ুওর ওয়েলফেয়ার।
কেন? হঠাৎ কী হয়েছে?
জামাইবাবুর বন্ধুবান্ধবদের তুই চিনিস?
রেমি একটু ভেবে নিয়ে বলল, না। দু-একজনের সঙ্গে এক-আধবার পরিচয় হয়েছিল। এ বাড়িতে বাইরের পুরুষরা চট করে ভিতরবাড়িতে আসতে পারে না। মেয়েদের স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ কবার নিয়মও নেই।
তার মানে জামাইবাবুর বন্ধুরা এ বাড়িতে আসে না!
না। কেন বল তো!
জয়ন্ত একটু হেসে বলে, জামাইবাবু তার বন্ধুদের এ বাড়িতে আনে না কেন তা জানিস? বন্ধুদের অধিকাংশই ভদ্রলোক নয়।
রেমি একটু থতিয়ে গেল। ধ্রুবর বন্ধুদের সে চেনে না। কাজেই জোর গলায় বলার মতো কিছু নেই। মিনমিন করে বলল, ভদ্রলোক নয় কী করে বুঝলি? তুই চিনিস তাদের?
চিনি। পান্ডা নামে জামাইবাবুর এক বন্ধু আছে। অধীর পান্ডা। নাম শুনেছিস?
বললাম তো, আমি ওর বন্ধুদের চিনি না।
অধীর পান্ডার এক বোন আছে। দুর্গা। খুব খারাপ মেয়ে। স্কুলে থাকতেই দুবার পালিয়ে গিয়েছিল।
রেমির বুক কাঁপতে থাকে। তার একবার ইচ্ছে করে জয়কে থামিয়ে দেয়। সে আর শুনতে চায় না। কিন্তু কৌতূহল এক অদ্ভুত জিনিস। নিজের সর্বনাশের ভয়কেও মানে না। রেমি অস্ফুট গলায় বলল, তার সঙ্গে কী?
সেই দুর্গার সঙ্গে জামাইবাবু ইদানীং ইনভলভড।
যাঃ হতেই পারে না।
সত্যি মিথ্যে জানি না। আমি নিজের চোখে কিছু দেখিনি। কিন্তু খুব রিলায়েবল সোর্চ থেকে খবরটা পেয়েছি।
কে বলেছে তার নাম বল।
নাম বললে তুই গিয়ে তোর শ্বশুরকে লাগাবি। তোর শ্বশুর কুরুক্ষেত্র করে ছাড়বে। পারিবারিক অশান্তি হবে।
আমি ওঁকে বলব না কথা দিচ্ছি।
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলে, তোর কথার দাম নেই ছোড়দি। কৃষ্ণকান্তর হিপনোটিজম তোকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। উনি কথাটা যেই শুনবেন সেই কথাটার সোর্স বের করার জন্য উঠে পড়ে লাগবেন।
আমি তোর নাম বলব না।
জয়ন্ত মৃদু হেসে বলে, আমার নাম বলতে পারিস। আমি ওকে ভয় পাই না। কিন্তু ইনফরমেশনটার সোর্স তো আমি নই। অন্য লোক। আর কে, তোদের আত্মীয়।
আমাদের আত্মীয়? কে রে?
বলেছি তো, নাম বলব না।
আমাকে কী করতে বলিস? চোখ কান খোলা রাখ। অত মজে থাকিস না।
ধ্রুব চৌধুরী খুব চরিত্রবান লোক নয়।
রেমি এই দুঃসময়েও রেগে গেল। বলল, সে আমি বুঝবা কে কী বলেছে তা দিয়ে তো আর বিচার হবে না। মিথ্যে করেও তো রটাতে পারে।
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলে, তুই ইনকিওরেবল। কিছুতেই তোকে তোর মোহ থেকে বের করে আনা যাবে না। আমি এটা জানতাম। তবু তোর কাছে এসেছি কেন তা জানিস! জামাইবাবুর নামে কিছু রটলে সেটা আমাদেরও গায়ে লাগে। সেটা জামাইবাবুর জন্য নয়, তোর জন্য।
আমার কথা তোদের ভাবতে হবে না।
তুই আমাদের কথা ভাবিস না বলে কি আমরাও তোকে ভুলে যাব?
ভুলতে বলিনি। আমার মাথাটা এখন ঝা ঝা করছে। কী পান্ডা নামটা বললি?
অধীর পান্ডার বোন দুর্গা পান্ডা। অধীর ইজ এ পলিটিক্যাল লিডার। লেফটিস্ট।
তার সঙ্গে তোর জামাইবাবুর সম্পর্ক কী?
জামাইবাবুর কোনও পলিটিক্যাল কালার আছে বলে আমি জানি না। থাকলে লোকটা হয়তো মানুষ হত। অধীরের সঙ্গে জামাইবাবুর বন্ধুত্ব কলেজ থেকে। তবে এখন বন্ধুত্ব নেই। পাবলে অধীর ধ্রুব চৌধুরীর গলা নামিয়ে দেয়। দুর্গাকে নিয়ে জামাইবাবু ব্যাঙ্গালোরে গিয়েছিল, জানিস?
রেমির পায়ে জোর ছিল না। থরথর করে কেঁপে বসে পড়ল বিছানায়। মুখ কেমন সাদা। চোখে বোবা শূন্যতা।
কী বলছিস?
ঠিকই বলছি। খবরটা শুনে তুই আপসেট হয়ে যাবি জানতাম। তবু তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। বলতে বাধ্য হলাম।
ওর আর যে দোষই থাক, মেয়েমানুষের দোষ তো ছিল না।
ছিল না আবার কী! জমিদারদের রক্তেই ওসব বিষ থাকে। ফিউডালিজম যাবে কোথায়!
চুপ কর। তুই সব জেনে বসে আছিস, না?
আমরা কিছু জানার চেষ্টা করিনি। খবরটা আমাদের কানে অন্য লোকই পৌঁছে দিচ্ছে।
রেমি আনমনে অন্য দিকে চেয়ে বলল, তাই নাকি?
তুই সব ঘটনার একদম মাঝখানে থেকেও কোনও খোঁজ রাখিস না। বড্ড বোকা তুই। নিজের। স্বার্থ সম্পর্কে তোর আর একটু কনশাস হওয়া দরকার।
রেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখে অবশ্যম্ভাবী জলটুকু মুছে নিল আঁচলে। জয়ন্তর কথা তার যে খুব বিশ্বাস হচ্ছিল তা নয়। ধ্রুব মেয়েদের তেমন পাত্তা দেয় না কোনওদিনই। তবু যদি এই গুণ তার দেখা দিয়ে থাকে তবে আজ রেমির পায়ের নীচে সত্যিই জায়গা নেই।
জয়ন্ত বলল, সেকেলে মেয়েমানুষের মতো কাঁদছিস কেন? রুখে দাঁড়াতে পারিস না!
রুখে দাঁড়াব! কীভাবে?
লোকটার মুখের ওপর বলে দে, তোমার নামে এই সব রটেছে। সত্যি কি না বলো।
রেমি জবাব দিল না।
জয়ন্ত বলল, ব্যাপারটা শুধু লাম্পট্যেই শেষ হবে না। তোর শ্বশুর পলিটিকস করে, অধীরও পলিটিকস করে। অধীর স্মল ফ্রাই, কিন্তু একটা এলাকায় তার অনেক ফলোয়ার আছে। দু-চারটে মার্ডার ওদের কাছে কিছুই না। তোর শ্বশুর মন্ত্রী এবং পুলিশ তার হাতের মুঠোয় বলে এখনও জামাইবাবুর গায়ে হাত পড়েনি। কিন্তু এবার পড়বে।
ওকে ওরা মারবে?
মারাই তো স্বাভাবিক। দুর্গার মতো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা মানেই তো বিপদ ডেকে আনা।
দুর্গা যদি বাজে মেয়েই হয়ে থাকে তবে তার জামাইবাবুকেই শুধু দায়ি করবে কেন?
দুর্গা বাজে মেয়ে বটে, কিন্তু ওর রিসেন্টলি বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঠিক এ সময়ে ওকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ায় সব ব্যাপারটাই গুবলেট হয়ে গেছে।
তোকে এত কথা কে বলল?
বললাম তো, নাম বলব না।
কেন বলবি না?
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলে, তোকে জানি ছোড়দি। তুই আর আমাদের লোক নোস, তুই এ বাড়িতে মাথা বিকিয়ে দিয়ে বসে আছিস। তোকে বলা যাবে না। তোর ভিতরে ফিউডাল সিস্টেম ঢুকিয়ে দিয়েছে এরা। এ বাড়ির ইজ্জত বাঁচাতে তুই সবাইকে ফাঁসিয়ে দিতে পারিস।
রেমি অবাক হয়ে বলে, কী সব যা তা বলছিস তখন থেকে?
বলছি তোর দুর্দশা দেখে। শো-কেসের পুতুল হয়ে রইলি। যা বোঝাচ্ছে তাই বুঝছিস। তোর ব্যক্তিত্ব নেই।
রেমি হঠাৎ জ্বলে উঠে বলল, ভাবিস না। যদি ঘটনাটা সত্যি হয় তবে তোর জামাইবাবুকে আমি ছেড়ে দেব না। আর যদি সত্যি না হয় তবে তোকেও ছেড়ে দেব না।
জয়ন্ত ম্লান একটু হাসল, জানি। পারলে আমাকে বোধহয় এখুনি কোতল করতিস। তবে বলছি শোন, কথাটা উড়ো কথা হলে তোকে বলতাম না।
জয়ন্ত চলে যাওয়ার পর অস্থির রেমি কতবার যে ঘর-বার করল তার সংখ্যা নেই। বাথরুমে ঢুকে স্নান করল। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। ছাদে গিয়ে পায়চারি করল। তারপর
অনেক ভেবেচিন্তে টেলিফোন করল ধ্রুবর অফিসে।
আমি রেমি বলছি।
বলো। কী খবর?
তুমি একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিবে আজ? জরুরি দরকার।
আজ যে পার্টি আছে সিস্টার।
দরকারটা ভীষণ জরুরি।
তা বুঝতে পারছি। একটু ঝেড়ে কাশো না! কী হয়েছে?
ফোনে বলা যায় না।
যায় না? সে কী? আমাকে তো কেউই কিছু বলতে বাকি রাখে না। প্রকাশ্যেই বলে। টেলিফোনে বলতে পারবে না কেন?
বলছি তো, বলা যাবে না। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।
জয়ন্ত তোমাকে কিছু বলে গেছে নাকি? খুব সিরিয়াস কিছু? এবং আমাকে নিয়ে?
রেমি স্তম্ভিত হয়ে গেল। জয়ন্ত দুপুরে এসেছিল, খবরটা ওর জানার কথাই নয়। বিস্ময়টাকে নিজের ভিতরে ছিপি এঁটে রেখে রেমি বলল, সব খবরই বাখো তা হলে!
আরে ভাই, আমি রাখি না। তবে সিস্টেমটা চালু আছে। শালাবাবু কী বলে গেছে বলো তো?
অনেক কিছু। কথাগুলো সত্যি কি না জানতে চাই।
না শুনলে কী করে বলব সত্যি কি না।
অধীর পান্ডা নামে তোমার এক বন্ধু আছে?
আছে। আগে বন্ধু ছিল, এখন ঘোর শত্রু। আর কী জানতে চাও?
সে তোমার শত্রু হল কেন?
তা কি শালাবাবু বলে যায়নি?
বলেছে। তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
জ্বালালে সিস্টার। শুনে তোমার লাভ কী বলল তো!
তুমি কার সঙ্গে ব্যাঙ্গালোরে গিয়েছিলে?
কারও সঙ্গে নয়। হিজ হিজ হুজ হুজ।
তার মানে?
তার মানে দুর্গার প্লেনের টিকিট সে নিজেই কেটেছিল। আমারটা কেটেছিল অফিস।
তোমরা একসঙ্গে গিয়েছিলে তো!
হ্যাঁ, তবে এয়ারপোর্ট অবধি।
তার মানে কী?
তার মানে দুর্গাকে এক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। দিয়েছি। শালাবাবু অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়েছে তো!
দিয়েছে। কিন্তু সেটা কি মিথ্যে?
না, না। আমি বরং বলি, ওটার বেসিসে তুমি একটা ডিভভার্সের মামলা আনো। আমি লড়ব না।
রেমি রেগে যেতে পারছিল না। তার উদ্বিগ্ন বুকে ধ্রুবর এইসব ইয়ার্কি এক ধরনের প্রলেপ দিচ্ছিল। সে বলল, ঠিক করে বলো।
আমি তো ঠিক করেই বলছি।
তোমরা একসঙ্গে ছিলে না?
দুর্গাকে তো তুমি চোখেও দেখোনি সিস্টার।
তাতে কী?
দেখলে বুঝতে ওর সঙ্গে থাকার চেয়ে একটা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে থাকাও ভাল।
তুমি ওকে কার কাছে পৌঁছে দিয়েছ?
ভেল-এর একজন ইঞ্জিনিয়ারের ডেরায়। ভাল ছেলে। ব্রাহ্মণ।
সে ওর কে হয়?
আমি তোমার কে হই?
স্বামী। আবার কে?
স্বামী কথাটা বড্ড ভারী। ফিউডালিজমের গন্ধ আছে। বর বরং বেটার।
ঠিক আছে। বর।
ওই ছেলেটাও দুর্গার তাই।
কী করে হল?
হয়ে গেল। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।
ইয়ার্কি কোরো না।
তুমি যে আমার গুরুজন তা মাঝে মধ্যে ভুলে যাই।
গুরুজন নই, তবে এখন ব্যাপারটা সিরিয়াস। এ সময়ে ইয়ার্কি ভাল লাগে না।
গোটা জীবনটাই ইয়ার্কি সিস্টার। এ গ্রেট ইয়ার্কি অফ দি ক্রিয়েটার।
আমি ফিলজফি শুনতে চাই না। দুর্গার ব্যাপারটা বলো।
বললাম তো।
ওর বর ব্যাঙ্গালোরে কী করছিল?
বললাম তো চাকরি।
আহা তা জানতে চাইছি না। ওখানে ওর তো বিয়ে ঠিক ছিল না!
বিয়ে ঠিক না থাক, হৃদয়টা ছিল।
কী করে?
তুমি মাইরি একদম মগজ খেলাও না আজকাল। মরচে পড়ে যাচ্ছে। ছেলেটার সঙ্গে দুর্গার আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। এখানে বিয়ে ঠিক করেছিল অধীর। জোর করে। ছোঁড়াটাও ভাল নয়। তাই আমাকে ধরেছিল দুর্গা। আমি বেড়াল পার করে দিয়েছি।
দুর্গা তোমার সঙ্গে ফেরেনি তা হলে?
কোন দুঃখে? দিব্যি জমিয়ে বসে গেছে ব্যাঙ্গালোর।
সিঁদুর পরছে?
পরবে না কেন?
ঠিক আছে। ছাড়ছি। পরে কথা হবে।
শোনো সিস্টার।
বলো।
আমার কথা ফেস ভ্যালুতে বিশ্বাস করে নিয়ো না। ভাল করে তদন্ত করো।
করার দরকার আছে কি?
ডিভোর্সের চান্সটা ফসকাবে কেন ভাই?
আমি কি খুব ডিভোর্স চাই নাকি?
তুমি না চাও তোমার ভাই চাইতে পারে।
মোটেই নয়।
বোকা মেয়ে। ভাইটিকে তো চেনো না!
কেন? সে আবার কী করেছে?
কিছু করেনি এখনও। তবে করতে চাইছে।
কী করতে চাইছে?
লঙ্কাপুরী থেকে বন্দিনী সীতাকে উদ্ধার করতে চাইছে বোধহয়।
সীতা কি আমি?
আলবত। কৃষ্ণকান্তবাবু রাবণ।
আর তুমি?
আমি বোধহয় বিভীষণ। রামকে হেলপ করতে চাইছি।
আর দরকার নেই। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধ্রুব বলে, ভুল করছ সিস্টার।
করলে বেশ করছি। তুমি বার বার সিস্টার বলবে না।
কেন, সম্পর্কটা তো প্রায় তাই।
মোটেই নয়। এসো আগে, তার পর দেখাব সম্পর্কটা কী!
০২৭. শচীন অনেকক্ষণ কাজ করল
শচীন অনেকক্ষণ কাজ করল। কাছারিঘরে মস্ত আলো জ্বেলে দিয়ে গেছে চাকর। কর্মচারীরা তটস্থ হয়ে অপেক্ষা করছে। একটা কারুকাজ করা তেপায়ায় ভারী রুপোর থালায় ঢাকা দেওয়া খাবার আর রুপোর গেলাসে জল অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ।
শচীন বুঝতে পারছে, জমিদারির অবস্থা খুব খারাপ নয়। কিন্তু ঠিকমতো তদারকি হয়নি বলে আদায়পত্র ভীষণ কম হচ্ছে কয়েকবছর। একটু চেষ্টা করলে এবং সতর্ক থাকলে সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু কাজটা করবে কে? শচীন জানে, হেমকান্ত আপনভোলা লোক। বিষয়-আশয়ে মন নেই। তার ছেলেরা জমিদারিতে আগ্রহী নয়। জমিদারি হল ভাগের মা। হেমকান্তর সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যে হিস্যা তারা পাবে তা লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই তারা অন্যান্য কাজ কারবারে নেমে পড়েছে।
শচীন আর-একটা ব্যাপারও বুঝতে পারছে। হেমকান্ত তাকে জামাই করতে চান সম্ভবত এই জমিদারি দেখাশোনা করার জন্যই। এ বাড়ির জামাই হয়ে বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করতে শচীনের আপত্তি নেই। বিশাখাকে সে বাল্যকাল থেকে দেখে আসছে। ভারী সুন্দর ফুলের মতো মেয়ে। মুখখানা মনে পড়লেই বুক তোলপাড় করে। শচীন অবশ্য খুব ভাবালু নয়। বরং বাস্তববাদী। কিন্তু পুরুষ তো! সুন্দরী মেয়ে দেখে কোন পুরুষের না বুক তোলপাড় হয়?
শচীন তাই খুব আগ্রহ আর নিষ্ঠার সঙ্গে হেমকান্তর জমিদারি জরিপ করছে। টাকার জন্য নয়, বিশাখার মুখ চেয়েই। এ বাড়ির মান-সম্মান রাখা তাবও কর্তব্য।
বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা দুনিয়াতেই একটা মন্দা চলছে। এ দেশের লোকের হাতে বিশেষ টাকা নই। নগদ টাকার টানাটানি থেকেই বোধহয় খাজনা আদায়েও মন্দা চলছে। উপরন্তু হেমকান্ত পাওনা আদায়ে পটু নন। গত বছর দুয়েকের মধ্যে কম করেও তিনটে মহাল হেমকান্ত প্রায় জলের পরে ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন কোনও বন্দোবস্তও হয়নি। কয়েকটা মোকদ্দমা হেরে গেছেন তদবিরের অভাবে।
শচীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মুহুরি রাখাল বলল, শচীনবাবু, এখনও কিছু মুখে দিলেন না।
দিচ্ছি।–শচীন হাসিমুখেই বলে। তারপর আবার কাগজপত্রে ড়ুব দেয়। হেমকান্তর নায়েবমশাই বুড়ো মানুষ। রাতে চোখে ভাল দেখেন না বলে এ সময়টায় আসেনও না। একটা ছুটির দিনে এসে তার সঙ্গে সকালের দিকে বসা দরকার।
শচীন কাজ রেখে খাবারের ঢাকনা খুলল। বিশাল আকারের গোটা আষ্টেক মিষ্টি, কমলালেবু, ক্ষীর, নাড়ু, এক বাটি পায়েস। এত খেতে পারে নাকি কেউ! রোজই সে অর্ধেকের ওপর পাতে ফেলে রেখে যায়। কমিয়ে আনতে বললে কেউ গা করে না। অপচয় এদের গায়ে লাগে না বোধহয়। কিন্তু সে গরিব ঘরের ছেলে, তার লাগে।
বড় কষ্টে মানুষ হয়েছে তারা। শচীনের বাবার আ