সকালে ঘুম থেকে উঠে মনোয়ারা বেগম বাড়ির কোথায় ময়লা জমে আছে, গাছের গোড়ার আগাছা সাফ করা হয়নি কেন, টিউবওয়েলের পাটাতনে শ্যাওলা জমে আছে–এরকম হাজারটা দোষ ধরে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে ভাড়াটে স্বামী-স্ত্রীর কান ঝালাপালা করে দেন। বাচ্চারা টু শব্দ করে তার কাছে ধমক খায়। মরিয়মের আশ্রিত জীবনের কথা মনে পড়ে। গত পাঁচটা বছর মেয়ে কোন নরকে ছিল, মা জানেন না। মেয়েও তা বুঝতে পারছে কেরানি পরিবারটির লাঞ্ছনা দেখে। মায়ের এটা নতুন রূপ। কফিলউদ্দিন আহমেদকে হুবহু নকল করছেন। বাড়িতে বলেকয়ে না এলেও স্বামীর ছায়াটা যেন তার সঙ্গে সঙ্গে শহরে এসেছে। মরিয়ম মুখে কিছু বলে না। মা বিগড়ে গেলে তাকে পথে বসতে হবে। তার চেয়ে কেরানির পরিবারটি না-হয় পথে বসুক!
টানা এক মাস মনোয়ারা বেগম একটি পরিবারের ওপর নির্বিঘ্নে রাজত্ব করেন। তাদের চলে যাওয়ার দিন হঠাৎ করে মনটা তার নরম হয়ে গেল। ঝোঁকের মাথায় ভাড়াটের বড় মেয়েকে বিয়ের অগ্রিম উপহারস্বরূপ সোনার একজোড়া কানপাশা দেন। ছোট বাচ্চাদের আদর করেন কোলে বসিয়ে। একটা ঠেলাগাড়িতে পুরো পরিবারটি মালামালসহ এঁটে গেল। সব সময় উচ্ছেদকৃত মানুষের পরিত্যক্ত ভিটেয় মরিয়মের ঠাঁই হয়েছে। তাদের চলে যাওয়া সে কখনো নিজের চোখে দেখেনি। এবার একটা ঠেলাগাড়ি আটজন মানুষ পিঠে নিয়ে চলতে শুরু করলে মরিয়ম কান্নায় ভেঙে পড়ে। ‘মা, আমরা সুখী হব না, মনোয়ারা বেগম তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে এর বেশি কিছু বুঝিয়ে বলা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। সুখ!’ মেয়ের মুখে সুখী শব্দটি শুনে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। সুখ কি গাছে ধরে মরিয়ম, যে ডাল থেকে ছিড়া নিবি! তুই নিজের কপাল ভাঙছস, আমারেও শেষ করছস। এমন গুণের মাইয়্যা তুই।
মা কী বলে! মরিয়মের কান্না থেমে যায়। এরপর দুজনের মধ্যে যা হয়, তাকে বলে কাজিয়া, বচসা। একে অন্যকে দোষারোপ করে। পরবর্তী আট মাস তারা সময় অসময় তা-ই করেছে। এই পর্বের সমাপ্তি ঘটে বাহাদুর শাহ পার্কের এক গণকের হাতে। লোকটার পোষমানা টিয়া পাখি মনোয়ারা বেগমের ভাগ্যের লটারি চটের ওপরের অনেকগুলো খাম থেকে ঠোঁটে টেনে তোলে। তাতে কী লেখা ছিল, মরিয়ম আজও জানে না। পরদিন ব্যাগ গুছিয়ে মা বাড়ি চলে যান। মনোয়ারা বেগমের অমরকীর্তি, সে সময় অনুরাধার ভবিষ্যদ্বাণী চুরমার করে মরিয়মকে তিনি বেশ্যা হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন। তা ছিল মেয়ের প্রতি একজন মায়ের কঠিন দায়িত্ব, তার ওপর একটি জাতির অসমাপ্ত কাজ-বীরাঙ্গনার আধাআধি সামাজিক পুনর্বাসন।
মরিয়মের জন্য সময়টা ছিল স্বর্ণযুগ। মা-মেয়ে তখন সোনা বেচার মূল্যে জীবন ধারণ করছে। প্রথম একটি সেলাই মেশিন কেনা হয় হাতের একজোড়া অনন্ত বালা বেচে। এ থেকে উপার্জন হওয়ার আগ পর্যন্ত একটা একটা গয়না ভাঙিয়ে দুর্মূল্যের বাজারে তারা সওদাপাতি করেছে। বটুয়ায় করে সোনা নিয়ে মা-মেয়ে বাজারে যেত। সেখানে তা অর্ধেক দামে টাকায় রূপান্তর করে কেনা হতো চাল-ডাল-মাছ তরিতরকারি। মনোয়ারা বেগমের রেশনের আতপ চালের গন্ধ সহ্য হয় না। টিনের গুঁড়ো দুধও তিনি মুখে দিতে পারেন না। এদিকে চালের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে। এক মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার দ্বিগুণ যখন, তখনো মা-মেয়ে রিকশায় চালের বস্তা নিয়ে দোকান থেকে বাসায় ফিরেছেন। রোজ সকালে কামরাঙ্গীরচর থেকে এক বৃদ্ধ গোয়ালা ফেনা ওঠা টাটকা গরুর দুধ জগে করে দিয়ে যেত। সকালের নাশতায় আটার রুটির বদলে তেলে ভাজা ময়দার পরোটা। শহরে থাকতে হলে মনোয়ারা বেগমের কথা হলো, খাঁটি শহুরে হয়েই থাকতে হবে। এ ব্যাপারে নয়-ছয় করলে চলবে না। এর মধ্যে উঁচু হিলের জুতো পরে খটখটিয়ে হাটা রপ্ত করে ফেলেন। ফুলতলি গায়ের কথার টান তার বচনে আর নেই বললেই চলে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে মনোয়ারা বেগমের ইংরেজি শব্দের স্টকও হু-হুঁ করে বাড়তে থাকে। গোলাম মোস্তফা মাঝে মাঝে এসে বোনের চালচলন, কথাবার্তার তারিফ করে যান। মরিয়মকে কাছে ডেকে নিচু স্বরে দু চারটা উপদেশও দেন। তিনি বলেন, নারীজন্মের সার্থকতা যে বিবাহে আর মাতৃত্বে তা তার ভুলে গেলে চলবে না। নারীর যৌবন হচ্ছে কলাগাছ। যত দ্রুত বৃদ্ধি, তত দ্রুত লয়। তখন পথের কুকুরের চেয়েও অধম সেই নারী।
গোলাম মোস্তফার কথায় ধার থাকলেও বলার ভঙ্গিটা কেমন যেন গা-ছাড়া। যেন মুরুব্বি হিসেবে দু-চারটা দামি কথা বলতে হয় বলেই ভাগনিকে বলে রাখছেন। আগের মতোই তিনি একজন ব্যস্ত মানুষ। শত্রুসম্পত্তি আইনের খোলনলচে ঠিক রেখে স্বাধীন দেশের সরকার শুধু নামটা বদলে দিয়েছে। তবে জমি কেনাবেচায় গোলাম মোস্তফার আর মন নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন যেমন ঘোলাটে, ছেঁড়া জাল পেতে রাখলেও মাছ উঠবে। তিনি এখন ফুলটাইম রাজনীতি করেন। কফিলউদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে তার বক্তব্য সোজাসাপটা। তিনি উচ্চকণ্ঠে মনোয়ারা বেগমকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, ‘দুলাভাই এহনও নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে যাচ্ছেন। আমি কচ্ছি বুবু, হে একটা আস্ত পাগল।’ বুঝদার ভাইয়ের কথায় বোন সঙ্গে সঙ্গে সায় দেন, ‘কম কষ্টে মাইয়্যামানুষ ঘর ছাড়ে, ভাই! মানুষটা যে চোখের সামনে পাগল হইয়্যা গেল, হেই দুঃখ আমি কারে ভেঙে কই।’ কফিলউদ্দিন আহমেদ যে জমিজমা বেচে সংসারটা ছারখার করছে, এ নিয়ে ভাইবোন নির্বিঘ্নে খানিক কথা চালাচালি করেন। তাদের মতভেদ দেখা দেয় তখন, যখন গোলাম মোস্তফা অকস্মাৎ বলে বসেন, ‘যার ছেলে শহিদ, বুবু আমারে আগে কথা শেষ করতে দেন, তার আজকের দিনে কিছু করা লাগে? দুলাভাই তো আহম্মক, এমন সুযোগ কাজে লাগাতি পারলেন না।’