পাহারাদারদের কথামতো এখন হাজি সাহেব যদি শাস্তি পান, তার কী হবে। সে নিজেও তো বউ বাপের বাড়ি থেকে আসতে চায়নি বলে গলা টিপে ধরেছিল-নরম তুলতুলে জানটা জিব ঠেলে তার করতলে ছটফটিয়ে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত। জেরা করার সময় উকিল সাহেব আদালতকে জোড়হাতে বলেছিলেন, হুজুর, আমার মক্কেল নির্দোষ, সে জানত না যে, সামান্য রঙ্গ-তামাশায়, তার বিবাহিত স্ত্রী, প্রাণের পুতুলি বেঘোরে প্রাণ হারাবে। আমার মক্কেল হুজুর স্ত্রী-অন্তপ্রাণ। রাতের পর রাত ঘুমাতে না পেরে, আমার মক্কেলের হুজুর, মাথায় বায়ু চড়ে যায়। এটা ঠান্ডা মাথার খুন নয়, এর। পেছনে ভালোবাসার বাড়াবাড়ি ছাড়া অন্য কোনো মোটিভ ছিল না–আদালতের কাছে তা প্রমাণ হয়। তাই মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে, মহামান্য আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। অথচ এর দুই বছর মেয়াদ থাকতে সে পালিয়ে এল জেলখানা থেকে। যুদ্ধের মাপে রমিজ শেখ জানে, এটা কোনো অপরাধই নয় এখন। এমনকি ঠান্ডা মাথায় বউ খুন করাটাও। এসবের জন্য এখন আদালত বসে না। উকিল-মোক্তারকে পয়সা খাওয়াতে হয় না। তাদের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে আগের মতো ভিটেবাড়ি বন্ধক দিতে হয় না। এখন বেঘোরে মানুষ মরছে, কে কাকে মারছে হিসাব নাই। অথচ এই বোকা লোকগুলো বলছে, হাজি সাহেবকে মুক্তিবাহিনী হাতের কাছে পেলে জ্যান্ত কবর দেবে, মেয়ে আর মুরগি আর্মির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। ফের হাসি পায় রমিজ শেখের। কিন্তু সে হাসে না।
নতুনগাওয়ের লোকগুলো, যারা আর্মির হামলা থেকে গ্রাম রক্ষার জন্য টেটা-বল্লম হাতে পাহারায় নেমেছে, তারা রমিজ শেখের ওপর বিরক্ত হয়। আজকের দিনে কে মোনাফেক-বেইমান আর কে দেশপ্রেমিক, তা-ও যদি ভেঙে বলা লাগে! কী রকমের বেকুব সে? হাজি লোকটা তো এখন শহরে বসে রাজাকারি করছে, মুক্তিরা হাতের কাছে পেলে তাকে যে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে–এমন সোজা কথাটাও যে উজবুক বোঝে না, তাকে বোঝাবে কে? ছয়জন পাহারাদার অন্ধকারে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এর মধ্যে একজন হঠাৎ খেপে উঠে বলে, ‘তোমার হাজি সাহেব হলো গিয়া মিরজাফর–বেইমান, নিমকহারাম। দেশটা যে বেচি দেছিলো ইংরেজের কাছে–সে খেয়াল আছে?’ সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন হায় হায় করে ওঠে, ‘সত্যি সত্যি বেচে তো দিল, যুদ্ধ তো সে করল না। পলাশীর আম্রকাননে কাঠের পুতুলের মতো খাড়ায় থাকল, ব্যাটা সিপাহসালার!’ তারা হাজি সাহেবকে মিরজাফরের জায়গায় ঠেলে দিয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হয়। মনে মনে নিজেদের বুদ্ধিরও তারিফ করে। বাকি থাকেন দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলা।
ফি-বছর শীতকালে নতুনগাঁওয়ের স্কুলমাঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পালা মঞ্চস্থ হয়। ভাটি অঞ্চল থেকে আসে নবরত্ন অপেরা। তারা মাটি খুঁড়ে তাঁবুর খুঁটি পেতে, প্যান্ডেল খাটায়। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে হ্যাঁজাক জ্বেলে যাত্রা শুরু হয়। চলে সকাল পর্যন্ত। কিন্তু পুরোটা কখনো শেষ হয় না। প্যান্ডেলের ফাঁক দিয়ে সূর্যকিরণ হামা দিয়ে মঞ্চে উঠলে দর্শকরা যাত্রাপার্টির গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে বাড়ি ফেরে। পরদিন অসমাপ্ত পালা দেখার জন্য ফের স্কুলমাঠে জড়ো হয়। ঘামে ভেজা শ্রমের টাকায় টিকিট কেনে। অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করে নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারে আগমনের, গায়ের লোম কাঁটা দেওয়া সেই দৃশ্যটির, যেখানে নকিব চোঙা ফুঁকে ঘোষণা দেবে, ‘নবাব মনসুর-উল-মুলক সিরাজ-উ-দ্দৌলা শাহ্কুলি খাঁ মির্জা মুহাম্মদ হায়বতজঙ্গ বা-হা-দু-র।’ তখন তাদের বুকের ছাতি ঢোলের মতো ফুলে ওঠে নবাবের গর্বে। নামটা আরো লম্বা হলে গর্ব আরো বেশি হতো। বুকটা ফুলে হতো দ্বিগুণ। নিজেদের ছোট ছোট অকিঞ্চিৎকর নামগুলো বাষ্পের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। একবার তো ‘চেয়ে দেখুন বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা’ ডায়লগটা দেওয়ার সময় নবাবের গোঁফের একপাশ খুলে ঝুলে পড়েছিল। দর্শকরা হেসে ওঠেনি, শিস দেয়নি। তারা যেন মুর্শিদাবাদ রাজপ্রাসাদের ষড়যন্ত্রের আলো-আঁধারে বন্দি। সিরাজউদ্দৌলার মতোই সংকট তাদের বাঁচা-মরার, জয়-পরাজয়ের। বা তার চেয়েও বেশি–কারণ সিরাজ তো জানতেন না, আর তারা জানে যে, তিনি যুদ্ধে পরাজিত হবেন, রাজ্য হারাবেন, নির্মমভাবে মৃত্যু হবে বাংলার শেষ নবাব, কমবয়সি, দুঃখী সিরাজউদ্দৌলার। তারা এ-ও জানে যে, রাতের পর রাত যাবে, পালা শেষ হবে না, নবাবের অবধারিত মৃত্যুদৃশ্য বুকে পাষাণ বেঁধে তাদের সইতে হবে না। যাত্রার এই পর্বে তখনো তিনি জীবিত। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দোলায়মান। দরবারে উপস্থিত–মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াট্স। মঞ্চের নিচের একপাশ থেকে গুমগুম ড্রামের আওয়াজ ছুটে এসে দর্শকের বুকে বাড়ি মারছে। বেলের আঠা খুলে ঝুলে পড়া গোঁফ টেনে বসাতে বসাতে নবাব আগের সেই কম্পিত গলায় বলছেন, ‘বাংলার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা। জাতির সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী। শুধু সুপ্ত সন্তান শিয়রে রুদ্ধমানা জননী–নিশাবসানের অপেক্ষায় প্রহর গণনায় রত। কে তাকে আশা দেবে? কে তাকে ভরসা দেবে? কে তাকে শোনাবে জাগরণের সেই অভয়বাণী? ওঠো, মা ওঠো। মোছো তোমার অশ্রুজল। সাত কোটি বঙ্গসন্তান হিন্দু-মুসলমান। আজ জীবন দিয়ে রুখব আমরণের এই অভিযান।’