বেতারযন্ত্রটির বাকস্ফুরণ ঘটে…
: ইকবাল হল, জগন্নাথ হলের ছাত্ররা আমাদের দিকে গুলি ছুড়ছে।
: তাদের হাতে অস্ত্র কী আছে?
: থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল।
: তোমাদের?
: রকেট লঞ্চার, রোমিও রোমিও (রিকয়েললেস রাইফেল), মর্টার এবং….
: ননসেন্স! ইমাম বলছেন–সবগুলো একসঙ্গে ব্যবহার করো। দু’ঘণ্টার ভেতর ধ্বংস করো।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উল্টো দিকে ইংরেজি দৈনিক দ্য পিপল-এর অফিস। হোটেলের ১১ তলায় দাঁড়িয়ে বিদেশি সাংবাদিকেরা সামনের রাস্তা দিয়ে মেশিনগান বসানো জিপ এগিয়ে যেতে দেখে। পদাতিক বাহিনী পেছনে। তাদের কাঁধে রকেট জাতীয় অস্ত্র। সৈন্যরা একসঙ্গে গোলাবর্ষণ শুরু করে। প্রেসের যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করে। ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
: দ্য পিপল-এর খবর জানাও। ওভার।
: আমাদের দুজন সৈন্য গুরুতর আহত। সিএমএইচ-এ পাঠানো হয়েছে।
: ক্যাজুয়ালটি কত আনুমানিক?
: এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব। আগুন জ্বলছে। একেবারে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না, এখানে কতজন বাঙালি ছিল।
বেতারযন্ত্রটি পিলখানার ইপিআর ক্যাম্প পতনের খবর দেয় রাত আড়াইটার সময়। দু’দিন আগে আক্রান্তদের নিরস্ত্র করা হয়েছিল এই বলে যে, শিগগির শেখের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, দেশে এখন শান্তি বিরাজ করছে, তোমরা অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্রাম নাও। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বাঙালি ইপিআর বাহিনী প্রথম বুঝতে পারে, তারা প্রতারিত হয়েছে। অস্ত্রাগারে তখন বিশাল তালা। মাঝরাতে নিরস্ত্র ইপিআর সদস্যদের দিকে ছুটে আসে কামানের গোলা আর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি।
পর্দাটা লাল, রক্তাক্ত শহর বুকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশটাও লাল। ধোঁয়া হটে গেছে, জায়গায় জায়গায় আগুন। আগুনের রক্তিমাভা। পর্দাটা এখন আগুনের দখলে। বস্তিতে আগুন ধরানোর পর অর্ধভুক্ত, কঙ্কালসার, হালকা-পলকা মানুষগুলো যে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে শুরু করেছে, পর্দায় তা দেখা গেল না। তারপর যে গুলি খাওয়া ছোট ছোট পাখির মতো ঝুরঝুরিয়ে পড়ে গেল মাটিতে, সেই দৃশ্যটিও নয়। বেতারযন্ত্রটি চুপ। আবর্জনার মানুষ আবর্জনা হয়ে গেছে। মাঝখানে ওড়ার দৃশ্যটি শুধু ব্যতিক্রম।
: বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো গোলাগুলি চলছে?
: এতগুলো বিল্ডিং শেষ করতে সময় লাগছে। ছাত্ররা গুলি ছুড়ছে। কিন্তু আমাদের কোনো ক্যাজুয়ালটি হয়নি। ওভার।
: খুব শিগগির বিগ ব্রাদার (আর্টিলারি সাপোর্ট) পৌঁছে যাবে। ইকবাল হল, লিয়াকত হল মনে হয় চুপ মেরে গেছে! অ্যাম আই কারেক্ট?
: ইয়েস।
: দ্যাট ইজ জলি গুড! নাউ লিসন। মাইকে কারফিউর ঘোষণা দিতে বলো–নম্বর-এক। নম্বর-দুই, বাংলাদেশের পতাকা যে বাড়ির মাথায় উড়বে, এর ফল ভোগ করতে হবে বাড়ির লোকদের। শহরে যেন একটিও কালো পতাকা দৃশ্যমান না হয়–পরিণাম অত্যন্ত খারাপ হবে, অ্যানাউন্স করে দাও। রাস্তায় কাউকে ব্যারিকেড দিতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি। যে এলাকার রাস্তায় ব্যারিকেড আছে–পিপল ফ্রম দ্যাট লোকালিটি উইল বি প্রসিকিউটেট। অ্যান্ড দ্য হাউজেস…লেফট অ্যান্ড রাইট–আমি আবার বলছি, ডানে-বাঁয়ের বাড়িগুলি ডেমলিশ করে দাও-ডেমলিশড।
কয়েকটা জিপ উত্তর দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে শহিদমিনারের কাছটায়। থামে। রাস্তাজুড়ে বটের মোটা মোটা কাণ্ড। খালি পানির ট্যাংক ইটে বোঝাই। সৈন্যরা গাড়ি থেকে দুপদাপ নেমে পড়ে। রাস্তার বাঁ পাশে বাউন্ডারি ওয়াল, মাঝখানে লোহার গেট। তারা একটানে খুলে ফেলে গেটের তালা। আঙিনা দৌড়ে পার হয়। তিন-চারটা করে সিঁড়ি একলাফে ডিঙিয়ে যায়। ফ্ল্যাটের দরজায় বুটের লাথি পড়ে। পর্দাটা কেঁপে। কেঁপে জানান দেয়, ঘরের ভেতরের মানুষগুলোর হৃৎপিণ্ডের লাফঝাঁপ। যা পরক্ষণেই বুলেট বিদ্ধ হবে, মানুষগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে সিঁড়িতে, ল্যান্ডিংয়ে, ছোট আর সমান করে ছাঁটা সবুজ ঘাসের চাতালটায়। সৈন্যরা দৌড়ে দৌড়ে পর্দা থেকে বেরিয়ে যায়। পেছনে রক্তের ভেলায় ভাসতে থাকে কয়েকজন মৃত্যুপথযাত্রী। তারা শেষবারের মতো পানি খেতে চাইছে।
রাত তিনটার দিকে বেতারযন্ত্রটি ঘর্ঘর করে বলে চলে-রাজারবাগ ক্যাপচাড়…রমনা থানা ক্যাপচাড়…কমলাপুর রেলস্টেশন ক্যাপচার্ড্…টিভি/রেডিও আন্ডার কন্ট্রোল…এক্সচেঞ্জ ক্যাপচার্ড্…
: এত আগুন কীসের?
: পুলিশ লাইন জ্বলছে।
: গুড শো!
ভোর চারটায় বেতারযোগে বিশ্ববিদ্যালয় পতনের খবর আসে সেকেন্ড ক্যাপিটালে। মাঠে যেন চূড়ান্ত গোল দেওয়া হয়ে গেছে–আনন্দে উচ্ছ্বাসে লাফায় দর্শকেরা।
সৈন্যরা তখন ‘সারেন্ডার অর ইউ সেল বি কিলড’ ঘোষণা দিতে দিতে জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে ঢুকতে শুরু করেছে কেবল। হত্যাকাণ্ডের মাঝপথে তারা। কক্ষের কোনা, পাঁচিলের নিচ, কচুক্ষেত, সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে ছাত্রদের ধরে এনে তখনো গুলি করা বাকি। তারপর আছে ছড়ানো-ছিটানো লাশ টেনে এনে এক জায়গায় শুমার করা। তার জন্য অবশিষ্ট ছাত্র, সুইপার, মালি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আর দারোয়ানদের জড়ো করা হয়। এক পর্যায়ে অবাঙালি মেথর, মালি আর মিস্ত্রিরা দেনদরবার শুরু করে মিলিটারির সঙ্গে, যদি কোনো প্রকারে বাঁচা যায়–
: নেহি সাব, হাম বাঙালি নেহি হ্যায়, পশ্চিমা হ্যায়, হামলোক তো ভাঙ্গি হ্যায়।