মুক্তি নাম ব্যতিরেকে যুদ্ধের আর কিছু ধারণ করে না, জানেও না বিশেষ। জানার দরকারও হয়নি বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের চাকরিটা পাওয়ার জন্য। বরং আগেভাগে কিছু জানার চেয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে শোনাটাই যে বেশি জরুরি এবং শুনতে শুনতে একদিন যুদ্ধের আগাপাশতলা জানা হয়ে যাবে, কর্তৃপক্ষ প্রথম দিনই তাকে পইপই করে বলে দিয়েছেন। গত দু’দিন ধরে মুক্তি তা-ই করেছে। মরিয়ম বলে গেছে আর তার কাজ ছিল বিনা বাক্যে শুনে যাওয়া। কিন্তু এখন তো স্বয়ং সাক্ষাৎকারদাতাই অত্যধিক ঘুমের বড়ি খেয়ে বেহুশ। আর সময়টা হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, মুক্তির জন্মের আগমুহূর্তের এক বিভীষিকাময় মধ্যরাত। কালনাগের দংশনের রাত। প্রতারণা আর সামঞ্জস্যহীন রাত। গাছের গুঁড়ি, খালি পানির ট্যাংকের ব্যারিকেডের বিরুদ্ধে কামান আর মেশিনগানের রাত। স্লোগানের বিপরীতে অজস্র গুলিবর্ষণের রাত। অসহযোগের বিরুদ্ধে সহিংসতার রাত। তখন মুক্তির মা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন, সামর্থ্যেরও বাইরে শক্তি প্রয়োগ করে চাপ দিচ্ছেন, কিন্তু ডাক্তারের অভাবে প্রসব করতে পারছেন না। এদিকে মরিয়ম বাবাহীন সন্তানের জন্ম দিতে দিতে নিজেও তখন ভ্রণের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে।
রাত বাড়ছে…
আটাশ বছর, অর্থাৎ–দুই বছর কম তিন দশক। পাহাড়সমান না হলেও, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যুদ্ধের নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, বই, গ্রন্থাগারের বাসি গন্ধময় খবরের কাগজের মুক্তিরা উত্তরাধিকার। তবে পড়ে দেখেনি। মাথা অক্ষরহীন কাগজের মতো সাদা। মরিয়মই তাতে প্রথম দাগ কাটে। হাতেখড়িটা হয় তাকে দিয়েই। সূচনার এই পর্বে চোখ ফোটেনি যখন, কোনটা খাদ্য কোনটা অখাদ্য জানে না, প্রাণিজগতের এমন এক অবোধ-অন্ধ নবজাতকের মতো মুক্তি বইপত্রের স্তূপ থেকে ২৫ মার্চ রাতটাকে খুঁটে খুঁটে বাইরে আনে।
এ রাতের অভিনবত্ব–যারা কুশীলব তারাই দর্শক। তারা বাঙালির ঔদ্ধত্যে বিরক্ত হয়ে উত্তর দিক থেকে যখন ঢাকা আক্রমণ করে, দক্ষিণ দিক থেকে তখন বসন্তের বাতাস বইছিল। এ ছিল ফুলের গন্ধভরা বাঁশি বাজানোর ভালোবাসাবাসির এক অপূর্ব রাত। শহর থেকে নিরাপদ দূরত্বে–প্রদেশের রাজধানী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে বসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল যে জায়গাটায়, যার নাম তখন ছিল সেকেন্ড ক্যাপিটাল, সেখান থেকে নির্দেশদানকারীরা বায়স্কোপ দেখার মতো তাদের নৃশংসতা উপভোগ করেছিল। তাদের বাধা দেওয়ার মতো আশপাশে কেউ ছিল না। যুদ্ধের আটাশ বছর পর, মুক্তি ২৫ মার্চ রাত পুনর্নির্মাণে দূরবর্তী সেই নিরাপদ জায়গাটিই বেছে নেয়। আর অনুসরণ করে পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার বইটিকে। অমানবিক সর্তকতা সত্ত্বেও খুনি পায়ের ছাপ রেখে যায়–রক্তের দাগ মুছে দিতে দিতে এগিয়ে গেলেও, অগণিত লাশ বুলডোজার দিয়ে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলার পরও, মেজরের ‘অপারেশন সার্চলাইট—এক’ পরিচ্ছেদে এই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হয়।
মুক্তি খুনির পায়ের ছাপ অনুসরণ করে…
২৫ মার্চ রাতে সেকেন্ড ক্যাপিটালের ঘাস-ছাঁটা আঙিনায় ‘আউটডোর অপারেশন কক্ষ’ লেখা ব্যানার টাঙানো হয়েছে। ঘাসের ওপর সারি সারি সোফা আর আরামকেদারায় দর্শকরা একে একে আসন গ্রহণ করে। তারা যাতে রণসংগীতের মূর্ঘনায় ঘুমিয়ে না যায়, তাই পাশের টেবিলে ফ্লাস্কভর্তি চা-কফি মজুত রাখা হয়েছে। একটা জিপের পিঠে বসানো হয়েছে বেতারযন্ত্র। যন্ত্রটা যুদ্ধের ধারাবিবরণী পেশ করবে। দর্শকদের মুখ দক্ষিণ দিকে–শহরের পানে। সেখানে দিগন্তব্যাপী ন্যাচরাল স্ক্রিন। যা এখন শূন্য, শান্ত, অন্ধকার। যারা শহরের রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল তারা পরিশ্রান্ত। ঘুমিয়ে পড়েছে কেউ কেউ। ৩২ নম্বর বাড়ির ব্রিফিং-পর্ব শেষ। নেতারা অন্ধকারে গা ঢাকা দিচ্ছেন। তাদের নিঃশব্দ সঞ্চরণ পর্দায় দেখা যায় না। দেখা। যায় না, শেখ মুজিবুর রহমানের আনমনে পাইপ টানার দৃশ্যটিও। কারণ পর্দাটা অন্ধকার, বাতি নেভানো ঘুমন্ত শহর বুকে ধারণ করে নিঃসাড় হয়ে আছে তখনো।
সেকেন্ড ক্যাপিটালের দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটি বীভৎস হত্যাকাণ্ডের। এদিকে আক্রমণকারীরাও সশস্ত্র, উদ্যত, অস্থির। বেতারযন্ত্র মারফত মিনিটে মিনিটে আবদার আসছে–ইমামের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, আর কতক্ষণ অস্ত্র হাতে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু পিআইএর স্পেশাল ফ্লাইটটার যত দ্রুত করাচির আকাশসীমায় পৌঁছে যাওয়ার কথা, তত দ্রুত পৌঁছাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাতে সওয়ার। রাতের অন্ধকারে ঢাকা ত্যাগ করে তিনি এখনো কলম্বো করাচির মাঝপথে, ৩০ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ছেন। এভাবে কালক্ষেপণ মস্ত বড় হেঁয়ালি। কুশীলবরা মেকআপ নিয়ে বসে আছে অথচ পর্দাটা তোলা হচ্ছে না। জেনারেলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আর অতর্কিত আক্রমণ দুটোই প্রয়োজন। একদিকে সময়কে হাতে রাখা, অন্যদিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া। শেষমেশ আক্রমণের এইচ-আওয়ার কাগজে-কলমে রাত একটায় গিয়ে ঠেকে। যদিও কার্যত যা শুরু হয় দেড় ঘণ্টা আগে।
বসন্তের মিষ্টি হাওয়ায় সেকেন্ড ক্যাপিটালের দর্শকদের চোখে ঘুম নামে। আয় ঘুম, যায় ঘুম, এর মধ্যে তাদের সিন বাই সিন যুদ্ধ দেখতে হবে। এটি যুদ্ধ করার সমান পুণ্যের।