সতরঞ্জ আমাকে পতঙ্গবাজির চেয়েও বেশী টানত। কেন জানেন? সতরঞ্জ আসলে একটা লড়াইয়ের ময়দান। এক একটা চালে যখন বংশীধরের খুঁটি খেতুম, রক্তের গন্ধ পেতুম আমি। এইভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল আমার। একদিন চৌসর খেলাও ধরলুম। চৌসরের জুয়া। ম্যায়খানা, মফিল, শরাব। তবায়েফদের কোঠিতেও যেতুম। কী করব বলুন? কালে মহলে থাকতে আমার ভাল লাগত না; আম্মাজানকে কতটুকুই বা কাছে পেতুম; তিনি ছাড়া তো আমার কাছের মানুষ কেউ ছিলেন না। তাঁর জায়গা তো ছিল জেনানামহলে। মীর আজম আলির মাদ্রাসায় পড়তে যেতুম; শেখ মুয়াজ্জামও পড়াতেন আমাকে, কিন্তু সেই সব পড়াশোনা আমার ভালো লাগত না মান্টোভাই। কত আশ্চর্য সব শব্দ আমার দিল-এর দরজায় এসে কড়া নাড়ত; রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে আমি শব্দগুলোকে সাজাতুম, কারা যেন আমার ভিতরে কথা বলে উঠত, আমি চমকে উঠতুম, আরে বা- ইয়ে তো শের হয়, হ্যাঁ মান্টোভাই। আমি, মির্জা গালিব গর্ব করে বলতে পারি ন’বছর বয়স থেকে আমি গজল লিখেছি। তারপর জনাব আবদুস সামাদ এলেন, দু’বছর কালে মহলে ছিলেন, ফারসির সৌন্দর্য ও রহস্য আমি তাঁর কাছেই শিখেছি। মান্টোভাই, উর্দুতে আমি গজল লিখেছি ঠিকই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, গজলের ভাষা একমাত্র ফারসি। আর তসবির মানে তো পারস্যের মুসাব্বিরদের আঁকা তসবির। আম্মাজান একদিন বললেন, মাদ্রাসায় যাস রোজ?’
-জি।
-লেখাপড়া কর আসাদ। এই মহলে তো সারা জীবন থাকতে পারবি ন।
-জি।
-তুই মহল বানাবি। আমি, ইউসুফ, ছোটি খানম তোর কাছে গিয়ে থাকব। মান্টোভাই, আপনি তো জানেন, আমার নিজের মহল কোনওদিন হয়নি। একদিন আম্মাজানকেও আগ্রায় ফেলে আমি শাহজাহানাবাদে চলে এলুম। তার মাঝে আমার নিকাহ্ হল উমরাও বেগমের সঙ্গে। আবার বন্দি হলুম, মান্টোভাই। কবরে শুয়ে বসে আমার কত বন্দিত্বের গন্ধই যে শুনতে হবে আপনাদের।
০৬. কিস্সাটা একটু ঘুড়িয়ে দেওয়া যাক
চাহতে হৈঁ খুবরুয়োঁ-কো অসদ;
আপ-কী সূরৎ তো দেখা চাহীয়ে।।
(সুন্দর মুখ ভালবাসেন, আসাদ;
নিজের মুখখানিও তো একবার দেখা চাই।।)
কিস্সাটা একটু ঘুড়িয়ে দেওয়া যাক ভাইসব। কবরে শুয়ে বসে আমাদের দুজনের বকবক শুনতে শুনতে বিরক্ত লাগারই কথা। খামোখা লাগাতার আমাদের কথা শুনবেনই বা কেন। আপনারা? আপনাদের জীবনেও তো কিস্সা কিছু কম নেই, যদি কখনও বলতে চান, আমরা দুজন মন দিয়ে শুনব, খোদার কসম বলছি। তবে এখন, মির্জাসাব ও আমাকে বাদ দিয়ে অন্য একটা কিস্সাই শোনাই আপনাদের। ভারী পাথরের মত মির্জাসাবের জীবনের বাইরে এই হাল্কা-ফুল্কা কিস্যাটা আপনাদের ভালই লাগবে, কিস্যার মধ্যে মাঝে মাঝে হাওয়া খেলাতে হয়; যারা তা পারে না, তাদের আমি কিস্সা লেখকই বলি না। এদের লেখা পড়তে পড়তে দম বন্ধ হয়ে আসে, যেন একটা কয়েদখানায় ঢুকিয়ে ওরা হুকুমত চালাতে থাকে। আরে বাবা, শব্দ তো এক-একটা ফুল, তার রং-গন্ধই যদি না পাওয়া যায়, তবে সে তো মরা এক একটা হরফ। হাফিজসাব বলেছিলেন না,
রৌনকে অহাদ শবাবস্ত
দিগর বোস্তারাঁ
মী রসদ মুদ্দা-এ-গুল
বুলবুলে খুশ ইলহাঁরা।
(বাগানে বাগানে বনে উপবনে
নওজোয়ানের কাল এসে গেছে;
পেল সুকণ্ঠ বুলবুল আজ
সেই সুখবর গোলাপের কাছে)
বুলবুলের গানই যদি গোলাপের কাছে না পৌঁছয়, তা হলে পাতার পর পাতা শব্দ লেখা কেন? ভাষার ভিতরে খুবই অভিমান আছে, ভাইসব।
সেই দরবেশের কথা মনে আছে তো? যমুনা নদী থেকে উঠে তিনি আসাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যেমন শামসউদ্দিন তাবরিজি একদিন জালালুদ্দিন রুমির জীবনে এসেছিলেন, আর তারপর তো রুমি এক অন্য জীবনের ভিতরে ঢুকে গেলেন। এই শামস এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন, ভাইসব। এক দিব্যোন্মাদ পুরুষ। তাঁর একটা কিস্সা জিভের ডগায় এসে গেছে, তাই বলেই ফেলি। ভাববেন না, মির্জাসাবের জীবনের সঙ্গে এই কিস্সার কোনও সম্পর্ক নেই। মির্জাসাবের জীবনটা যে কত কিস্সায় জড়িয়ে আছে, আমি ভেবে কুলকিনারা পাই না। শামসের কিস্সাটা শুনলে বুঝতে পারবেন, মির্জাসাব এর মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছেন।
ওয়াউদ্দিন কিরমানি ছিলেন এক সুফি শেখ। তিনি মনে করতেন, এই যে দুনিয়া-এই সৃষ্টির সব খুবসুরতির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় আল্লাকে। একদিন এক হ্রদের জলে চাঁদের ছায়ার দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন তিনি। শামস তাঁকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জলের দিকে কেন তাকিয়ে আছেন শেখ?
-চাঁদের ছায়া দেখছি।
-কেন, আপনার ঘাড়ে কি ব্যাথা হয়েছে?
-না।
-তা হলে আশমানে তাকালেই তো চাঁদকে দেখা যায়। নাকি, আপনার চোখ অন্ধ হয়ে গেছে? সোজা জিনিসকে তো সোজা ভাবেই দেখতে হয়।
শামসের কথা শুনে শেখ তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন।
-হুজুর, আপনি আমার পীর, আপনার পায়ে আমাকে ঠাঁই দিন।
শামস বললেন, আমার মুনাসিব হওয়ার তাক আপনার নেই।
-আছে হুজুর। আপনার পথে আমাকে নিয়ে চলুন।
শামস হা হা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, তা হলে দারু নিয়ে আসুন। বাগদাদের বাজারে বসে আমরা একসঙ্গে বসে দারু খাব।
ইসলামে তো দারু হারাম। শেখ বাজারে বসে দারু খেলে লোকে কী বলবে? তাঁর মান-ইজ্জত ধুলোয় লুটোবে। শেখ মিন মিন করে বললেন, তা কি করে হয় পীরজাদা?