লজ্জা – রবিন দে
আজকালকার দরজায় ল্যাচ্-কি লাগানো একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুবিধে আছে। কোথাও যেতে আসতে গেলে টুক করে টেনে দিলেই দরজা বন্ধ।
শনিবার বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ অনিমার বাইরে যাবার একটা গোপন ইচ্ছে ছিল। বিশেষ কেউ জানে না। বাইরে মানে বাপের বাড়ি। বাড়ির সব পুরুষরা বেরিয়ে যাবার পর, টুক করে যাবে আর আসবে।
ঝাড়ু দিচ্ছে চিন্তামণি। ঘর ঝাড়ু দেবার পরেই ছুটি। চিন্তামণি ঝাড়ু দিচ্ছে আর মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে উঁকি মারছে। এক ফাঁকে টুক করে বাইরের জানলার পাশে দরজার ল্যা-কি টা খুলে দিলে।
ঠিক তখনই খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা একটা লোক ঢুকেই চিন্তামণির দিকে আড়চোখে চেয়ে নিমেষে সোফার পেছনে গিয়ে লুকোলো। বাঁকা চোখে একবার ইশারা করেই চিন্তামণি আবার ঝাড়ু দিতে লাগলো।
শোবার ঘরে তালা ঝুলিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে প্রসাধন সেরে অনিমা প্রস্তুত।
চিন্তামণির হাতের কাজ সেরে অনিমার পেছনে পেছনে এগিয়ে চললো। তেমনি গুন গুন করতে করতে ফ্ল্যাটের বাইরে এসে ল্যা-কিটা টুক করে টেনে দিলে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
ফ্ল্যাটের তিনটি চাবি। একটি পাশের ফ্ল্যাটে, একটি তিনতলায়। তিনটি চাবি। একটি পাশের ফ্ল্যাটে, একটি তিন তলায়। আর একটি নিজের কাছে।
—মিনিট পাঁচ সাত পৰে খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা লোকটা সোফার পেছন থেকে বেরিয়ে দেখলে বাই থেকে কেউ দেখছে কিনা।
তারপর নিজের ছোট যন্ত্রপাতি নিয়ে একা ঘরের তালা ভাঙ্গতে লেগে গেল।
সবে কাজ আরম্ভ করেছে…এমন সময়ে খুট করে একটা শব্দ। দাড়িওলা, মুখ ঘুরিয়ে দেখেই চমকে উঠলো। বাইরে থেকে দরজার ল্যাচ-কি খুলে একটি কিশোরী মেয়ে চুপি চুপি এগিয়ে যাচ্ছে কোণে রাখা টেলিফোনের দিকে।
হঠাৎ চোখোচোখি হতেই ঐ বীভৎস চেহারার দাড়িওলা লোকটাকে দেখেই মেয়েটি আঁতকে উঠে আর্তনাদ করে উঠলো। দাড়িওলা তড়াক করে লাফ দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটির সামনে। হাতে যন্ত্রপাতির সঙ্গে একটা লকলকে ছোরা।–চোপরাও, বদমা কাহাকা…জানসে খতম্ কর দেগা।
ভয়ে শিউরে উঠে মেয়েটি আবার আর্তনাদ করে উঠতে যাচ্ছিলো। কিন্তু গলার কাছে চেপে ধরলো সেই ধারালো ছোরাটা…তাই গলা দিয়ে গোঙ্গানি ছাড়া কোনো শব্দ বেরলো না।
অচৈতন্য হয়ে মেয়েটি পড়েই যাচ্ছিলো। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বীভৎস লোকটা সেই অবস্থায় মারলে এক ধাক্কা। মেয়েটি ছিটকে গিয়ে পড়লো মাটিতে। উঠতেই আবার এক ধাক্কা….আর্তনাদ করে মেয়েটি আবার খানিকটা পেছিয়ে পড়লো…কাছেই বাথরুমের দরজাটা।
কদাকার লোকটা কি যেন ভাবলে। তারপর বাঁ হাতে মেয়েটির শাড়িটা ধরে মারলে এক হেঁচকা টান। ডান হাতে ছোরাটা গলায় চেপে ধরে আবার এক ধাক্কা। চাপা আর্তনাদ…মেয়েটি পড়লো বাথরুমের মধ্যে।
পরনে সায়া আর ব্লাউজ। অঝোর কান্নায় মেয়েটি উঠেই বাথরুমের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে ছিটকিনি আটকে দিলে। দাড়িওলাও বাইরে থেকে খটাস্ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলে।
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে দাড়িওলা বললে
–যত্তো সব ঝুট ঝামেলা! গা
লিগালাজ দিতে দিতে লোকটা আবার তালা ভাঙ্গতে আরম্ভ করলে।
মেয়েটি আগে প্রাণের ভয়ে কাঁদছিল। এবার তার কান্না বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে। দাঁত খিঁচিয়ে লোকটা আবার তালা ভাঙ্গতে আরম্ভ করলে। কিন্তু এবার তালাভাঙ্গা বন্ধ করে বাইরের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি দুটো পেতলের ফুলদানি আর মেয়েটার গোলাপি শাড়িটা নিয়েই ল্যা-কি খুলে বাইরে গিয়ে খুট করে দরজা বন্ধ করে উধাও হয়ে গেল।
বন্ধ বাথরুমে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এদিকে বেলা বারোটা বাজলো। তারপর বেলা দুটো বাজে।
এদিকে তিনতলায় মেয়েটির বাড়িতে চারিদিক তোলপাড় করে খোঁজাখুজি আরম্ভ হয়ে গেছে।
শনিবার। অনিমার দেওর সমীরণ অফিস থেকে ফিরে বেল বাজালে…. একবার… দুবার….তিনবার। দরজা খুললো না। অগত্যা পাশের ফ্ল্যাট থেকে চাবি এনে দরজা খুললে।
সবে জুতো, মোজা খুলছে….হঠাৎ কানে গেল একটা চাপা কান্নার শব্দ। মনে হল শব্দটা আসছে বাথরুম থেকে…।
সমীরণ চমকে উঠলো…তবে কি বৌদির কান্না? অথচ বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ….। তাড়াতাড়ি গিয়ে কান রাখলে।
বেশ বোঝা গেল। কান্নার শব্দ আসছে ভেতর থেকে। দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে বিস্ময়ে সমীরণ চেঁচিয়ে উঠলো—বৌদি! বৌদি!
বন্ধ দরজার ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না। বিস্ময়ে সমীরণ আরো চেঁচিয়ে উঠলো—বৌদি! বৌদি!
বন্ধ দরজার ভেতর থেকে কান্না ভরা স্বর, শোনা গেল–আমাকে শুধু একটা শাড়ি দিন।
সমীরণ আরো চমকে উঠলো! গলার স্বরটা বৌদির নয়…আপনিও বলে না…!
বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়…ওকি ভূত দেখছে? মধ্য দিনের নির্জন তালা দেওয়া ফ্ল্যাটের বন্ধ বাথরুমের মধ্যে এ কি রহস্য?
আর মহিলা শাড়িই বা চাইছেন কেন? সমীরণের মাথায় সব ওলোটপালোট হয়ে গেল। তবু তাড়াতাড়ি শাড়ি আনতে ছুটলো।
সব ঘরেই তালা দেওয়া। নিজের ঘরে ধুতি আছে, পাজামাও আছে, কিন্তু শাড়ি?
অনেক সন্ধান করে একটা শাড়ী দেখা গেল বটে, বৌদির ঘরে আলনায়। কিন্তু নাগালের বাইরে। ডোরা কাটা সবুজ শাড়িটা ছাতার সাহায্যে বহু কষ্টে বাইরে আনা হল।