- বইয়ের নামঃ আমি রবি ঠাকুরের বউ
- লেখকের নামঃ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০০. মুখপাত
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনীর একটিই পরিচয়-তিনি রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী। এবং সহমর্মিণীও।
তাঁর যেন আর কোনও পরিচয় নেই।
এই নারী বেঁচে ছিলেন মাত্র আঠাশ বছর।
উনিশ বছর কাটিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বউ হয়ে।
মৃণালিনীর প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি বই এবং প্রবন্ধ।
কেমন ছিল মৃণালিনীর জীবনের অন্তরমহল?
রবি ঠাকুরের বউ-হওয়া ‘ব্যাপারটা’ আসলে ঠিক কেমন?
মৃণালিনী প্রসঙ্গে কোনও গ্রন্থে, কোনও নিবন্ধে নেই এই অন্তরএষণা।
এই নারীর দাম্পত্যজীবনের গহনে আজও পৌঁছোয়নি কোনও ডুবসাঁতারু অনুসন্ধান।
রবীন্দ্রনাথের চিঠির উত্তরে মৃণালিনীও নিশ্চয় লিখেছিলেন অনেক চিঠি।
সেই সব চিঠিতে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বেদনাদীর্ণ উচ্চারণও ছিল নিশ্চয়।
একটি চিঠিও পাওয়া যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের অব্যর্থ পৌরহিত্যে লুপ্ত হয়েছে সেই আর্তিময়, অসহায় পত্রগুচ্ছ।
মৃণালিনী যদি লিখতেন তাঁর আত্মকথা?
সেই লুকোনো আত্মকথারও বিলোপন ঘটত নিঃসন্দেহে।
এমনই যে ঘটেনি, এ-কথাই বা বলি কী করে?
কী লিখতেন মৃণালিনী তাঁর লুকোনো আত্মকথায়?
এই উপন্যাসে সেটাই ভাবার চেষ্টা করেছি।
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৩
০১. ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৬
১৮৮৬ থেকে ১৮৯৬।
এই দশ বছরের মধ্যে আমাকে পাঁচটি ছেলেমেয়ে দিলেন আপনাদের রবি ঠাকুর।
আঁতুড়ঘর থেকে আমি তো প্রায় বেরোতেই পারিনি।
আমার সঙ্গে রবি ঠাকুরের বিয়ে হল ১২৯০-এর ২৪শে অঘ্রাণ। ওঁর কাছে পরে জেনেছি, ইংরেজি তারিখটা ছিল ১৮৮৩-র ৯ই ডিসেম্বর।
আমার বয়েস তখন ন’বছর ন’মাস।
আর আপনাদের রবীন্দ্রনাথ কী সুন্দর দেখতে। তরতাজা তেইশ।
আমার প্রথমটি মেয়ে। বেলা। ও পেটে এল আমার এগারো বছর ক’মাস বয়েসে।
প্রথম মা হয়ে মেয়ের মুখ দেখলাম বারো বছর বয়েসে। সেই শুরু।
আমার বড় ছেলে রথী পেটে এল পরের বছর। জন্মাল ১৮৮৮-র ডিসেম্বরে।
এর পর জন্মাল আমার সেজো মেয়ে, আমার তৃতীয় সন্তান রেণুকা।
তারিখগুলো সব গন্ডগোল হয়ে যায়। যতদূর মনে পড়ছে রেণুকা বা রানির জন্মদিন ১৮৯১ এর ২৩শে জানুয়ারি।
অই যাঃ। আপনাদের রবি ঠাকুরের মতো আমি লেখক নই। গুছিয়ে লিখতে পারিনে।
বেলা, যার ভালো নাম মাধুরীলতা, তার জন্মদিন আর রথীর জন্মদিনের কথা তো বলাই হল না।
যতদূর মনে পড়ছে, বেলা জন্মেছে ১৮৮৬-র ২৫শে অক্টোবর, মনে আছে, পুজোর মাস। আর রথীর জন্মদিন ২৭শে ডিসেম্বর।
শীতকাল, খুব শীত পড়েছিল সেবার, আঁতুড়ঘরে খুব কষ্ট পেয়েছিলুম। শীতকালে যাদের
ছেলেপুলে হয়েছে সেই মায়েরা বুঝবে আমার কষ্টের কথা।
রেণুকা জন্মাল আবার শীতকালেই।
শীতকাল মানেই যেন আঁতুড়ঘর।
শীতকাল এলেই আমার ভয় করত।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি কী সুন্দর বাড়ি বলুন তো! কিন্তু সে-বাড়ির ওই আঁতুড়ঘরটা যদি দেখতেন, বুঝতেন কেন বলছি এ-কথা।
শীতকালে ওই ঘরটা ছিল বাড়ির সবচেয়ে ঠান্ডা আর অন্ধকার ঘর। এতটুকু রোদ্দুর ঢুকত না।
আমার ছোট মেয়ে মীরা, যার একটা পোশাকি নামও আছে–অতসীলতা—সেও আমাকে রেহাই দিল না।
জন্মাল সেই শীতকালেই।
মাপ করবেন যদি তারিখের গন্ডগোল করে ফেলি। এতগুলো জন্মদিন তো। মীরা জন্মাল ১৮৯৪-এর ১২ই জানুয়ারি।
উনি হেসে বললেন, ‘আমার কনিষ্ঠ শাবক।’
‘আমাদের’ বললেন না কেন?
চোখে জল এল আমার।
১৮৯৬ সালে এল আমার ছোট ছেলে। আমার পাঁচ নম্বর। শমী। শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠিক ওঁর মতো দেখতে।
ও নিশ্চয় শীতকালে জন্মায়নি?
আপনারা ভাবছেন তো!
শমীও শীতে।
১২ই ডিসেম্বর।
আমার পাঁচ ছেলেমেয়ের চারটিই শীতকালে।
আর বেলা মানে মাধুরীলতা, ও শরৎকালে।
কী আশ্চর্য, ওর বরের নামও শরৎ! ওঁকে একদিন মজা করে বললুম, দ্যাখো তো, বেলির সঙ্গে শরতের সম্পর্ক সেই জন্ম থেকেই।
উনি এতটুকু হাসলেন না।
উনি যে কতবার বলেছেন, আমার কোনও রসবোধ নেই। যে-মেয়েদের সঙ্গ উনি পছন্দ করেন, যাদের কথা শুনতে, যাদের সঙ্গে কথা বলতে, যাদের চিঠি লিখতে ওঁর ভালো লাগে, তাদের মধ্যে আমি পড়ি না। একটিই কারণ, আমার তেমন শিক্ষাদীক্ষা নেই। সুতরাং বোধবুদ্ধিরও খোলতাই হয়নি।
ইন্দিরা, আমার মেজোভাশুর সত্যেন ঠাকুরের মেয়ে, আমার চেয়ে মাস কয়েকের ছোট, ওর সঙ্গে আপনাদের রবি ঠাকুরের খুব ভাব। উনি যে কত চিঠি ওকে লিখেছেন।
আর সে সব কী লম্বা-লম্বা চিঠি। চিঠি নয় তো, সব মনের কথা, কত ভাবনা, আমাকে কোনওদিন বলেন না সেসব।
ইন্দিরা যে ওঁর ভাইঝি, সে কথা উনি ভুলে যান।
মনে হয় ইন্দিরা ওঁর বন্ধু। মনের মানুষ।
পরের চিঠি পড়তে নেই। তবু আমি ইন্দিরাকে লেখা কিছু-কিছু চিঠি না পড়ে পারিনি। সব যে বুঝতে পেরেছি তা নয়।
তবে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি।
ইন্দিরার সঙ্গে উনি হৃদয়ের কথা বলতে পারেন।
কোনও রাখঢাক নেই। সব কথা।
কারণ, উনি জানেন, ইন্দিরা বুঝতে পারে।
আমার সঙ্গে মনের কথা বলেন না।
আমি যে বুঝতে পারব না, উনি খুব ভালো করেই জানেন।
আমার মনে আছে বিবিকে, মানে ইন্দিরাকে, ওর ডাক নাম তো বিবি, ও তো খুব মেমসায়েব মেমসায়েব, কতদিন বিলেতে ছিল, তাই ওর ডাক নাম বোধহয় বিবি, ইংরিজিতে কথা বলতে পারে, আবার ফরাসিতেও কথা বলতে পারে, ওকে একটা চিঠিতে উনি লিখেছেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে—
তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যেরকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনও লেখায় হয়নি…তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনও মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোনও কথা বুঝবি নে, কিংবা ভুল বুঝবি, কিংবা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি।
এসব হুবহু ওঁর কথা।
আর কারই বা হবে?
এরকম আর কে লিখতে পারে?
এত ভালো লেগে ছিল, অনেকবার পড়েছিলুম।
তাই ভুলিনি।
একদিন বললুম, বিবির সঙ্গে যেমন মনের কথা বলো, আমার সঙ্গে বলো না কেন?
বলেই মনে হল, ইস! কেন বললুম? নিজেকে খুব ছোট মনে হল। আর খুব লজ্জা করল। আর একটু ভয়ও করল।
উনি রেগে যাবেন না তো?
রাগ তো উনি প্রকাশ করেন না। শুধু গম্ভীর হয়ে যান। উনি কিন্তু সামান্য হাসলেন।
আমি দেখলুম ঠোঁটে হাসিটুকু মিলিয়ে যেতেই ওঁর বড়-বড় চোখ দুটির মধ্যে কেমন যেন ব্যথার ভাব জেগে উঠল।
উনি মৃদুভাবে বললেন, তোমার সঙ্গে মনের কথা কতবার তো বলেছি। আমি কথা বললে তো মনের কথাই বলি।
–কই বলো? শুধু তো সংসারের আর দরকারের কথা বলো।
আবার ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। উনি কী সুন্দর ছড়া করে বললেন—
তুমি মোরে পার না বুঝিতে?
কিছু আমি করিনি গোপন।
যাহা আছে সব আছে তোমার আঁখির কাছে
প্রসারিত অবারিত মন।
আমি বললুম, তুমি আমার এত কাছের মানুষ, তোমার সঙ্গে এত বছর ঘর করছি, তবু তোমার মন কী জানি কেন আমি বুঝতে পারিনে। অন্যদের তো পারি। তোমাকে পারিনে।
এবারও উনি হাসলেন বটে। কিন্তু এইটুকু বুঝলাম, সেই হাসির মধ্যে কোথাও ব্যথা আছে ঠিক ব্যথা নয়, অভিমান। আবার উনি কবিতা করে জবাব দিলেন—এই রকম কিছু একটা–
এ যে সখী, সমস্ত হৃদয়।
এ রাজ্যের আদিঅন্ত নাহি জান রানি।
এ তবু তোমার রাজধানী।
আরও যেন কীসব বলেছিলেন, কোথা জল কোথা কূল, দিক হয়ে যায় ভুল, এইরকম কিছু।
আমি বললুম, কবিতাই বলো আর যাই বলো, তোমার সঙ্গে এত বছর থাকলুম, তোমার ছেলেমেয়ের মা হলুম, তোমার সংসার টানলুম, কিন্তু তোমার মনের কতটুকু পেলুম? অন্যেরা অনেক বেশি পেয়েছে। আমি কতটুকু পেয়েছি বলো? সবসময় মনে হয় একটা আড়াল। কিছুতেই সেই আড়ালের ওপারে যেতে পারিনে।
উনি আমার কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
এ-হাসি মোটেই খুশির নয়।
আমি খুব লজ্জা পেলুম।
উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার কবিতায় বললেন—
নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে।
বুঝা যায় আধো প্রেম, আধখানা
মন—
সমস্ত কে বুঝেছে কখন?
আমি মনে-মনে বললুম, কেন, তোমার নতুন বউঠান বোঝেননি? তোমার আদরের ভাইঝি বিবি বোঝে না?
কিন্তু এসব কথা সত্যি-সত্যি বলা যায় নাকি?
বুকের মধ্যে কান্না হয়ে জমে থাকে। বুকটা আমার হিমঘর।
ওখানে অনেক কান্না আর সন্দেহ জমে বরফ হয়ে আছে।
উনি তখন শিলাইদহে। আপন মনে রয়েছেন সেখানে মাসের-পর-মাস।
আমি কলকাতায় সংসার টানছি।
ওঁর চিঠি প্রায় রোজই আসে।
আমাকে লেখেন না।
লেখেন বিবিকে।
আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে ওঁকে। মন কেমন করে।
কিছুদিনের জন্যে বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ওঁর কাছে।
আমাদের সেই ‘আসা’ নিয়ে উনি বিবিকে চিঠি লিখেছিলেন।
তখন জানতুম না।
পরে একদিন ইন্দিরাই হাসতে-হাসতে দেখিয়েছিল সেই মজার চিঠি।
মজার চিঠিই বটে!
আমাদের রবি ঠাকুর জানাচ্ছেন ইন্দিরাকে, শিলাইদহের আকাশ, পদ্মার বাতাস আর নির্জনতা তাঁকে বেষ্টন করে আছে হৃদয়পুঞ্জের মতো। পরশু থেকে সেই আকাশ-বাতাস-নির্জনতা
আর থাকবে না। কারণ, পরশু তাঁর ওখানে ‘জনসমাগম’ হবে।
জনসমাগম? মানে, আমি, আমাদের ছেলেমেয়েরা ওঁর কাছে অবাঞ্ছিত ভিড়? আমরা এলে নাকি ওঁর পরিচয় পর্যন্ত পালটে যাবে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলুম না—উনি কিন্তু ইন্দিরাকে সত্যিই লিখেছেন—
ওরা এলে আমি তখন তমুকের বাপ, অমুকের স্বামী শ্রীযুক্ত অমুক। সত্যিই তো, এইরকম অবাঞ্ছিত ভিড়ের মধ্যে কি প্রাণের মেয়ে ইন্দিরাকে চিঠি লেখা যায়?
উনি কী করে ভুলে গেলেন, যাকে উনি মনের কথা জানিয়ে প্রায় রোজ লিখছেন, পাতার-পর পাতা, সেই মেয়ের উনি কাকা? শুধু আমরাই পারিবারিক ভিড়?
আর ওঁর আদরের বিবি?
ঠিক কথা, আপনাদের রবি ঠাকুর যা বলেছেন, আমি মেনে নিচ্ছি, আমার কোনও রসবোধ নেই।
কিন্তু রসবোধ যাদের না থাকে, তারা হিসেবে খুব পাকাপোক্ত হয়।
আমি একটা হিসেব করেছি।
১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫। এই আট বছরে অন্তত দুশো বাহান্নখানা চিঠি লিখেছেন আপনাদের রবি ঠাকুর তাঁর ভাইঝি ইন্দিরাকে। আর আমাকে দিয়েছেন পনেরোখানি চিঠি, পাঁচটি সন্তান। বেশ করেছেন। আমি নালিশ করছিনা।
আমাকে যদি দুশো বাহান্নটা চিঠি লিখতেন, খুব বিপদে পড়তুম আমি।
আদ্দেক চিঠি তো আমি বুঝতেই পারতুম না।
পারি না পারি, উত্তর তো দিতে হত।
আড়াইশো চিঠি পেলে তো অন্তত পঞ্চাশটা চিঠি লিখতে হত। চিঠি লেখা আমার ধাতে নেই।
উনি আমাকে যে-ক’টি চিঠি লিখেছেন তার ক’টির উত্তর পেয়েছেন উনি?
এই অবিচারটা আমি করেছি। ইচ্ছে যে করত না চিঠি লিখতে তা নয়। কিন্তু যেই মনে হত আমার স্বামী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এক লাইনও লেখার সাহস হত না।
তবে আমাকে যে-ক’খানি চিঠি উনি লিখেছেন, পড়লে মনে হয় না সেই সব চিঠির লেখক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে কী কর্কশ তিনি!
কোথায় গেল তাঁর ভাষার গুণ, নরম-নরম ভাব?
ইন্দিরাকে কখনও তিনি এরকম ভাষায় চিঠি লিখেছেন?
আমার কী ভাগ্য! আমি রবি ঠাকুরের বউ!
আমি চিনেছি, জেনেছি এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে।
যে-রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পৃথিবীর আর কোনও মেয়ে পায়নি।
একবার ওঁকে চিঠি লিখলুম, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কিছু ভালো গব্যঘৃত পাঠাবার জন্যে।
উত্তরে উনি লিখলেন সাজাদপুর থেকে–আমি কোনওদিন ভুলব না সেই চিঠি–
আচ্ছা, আমি যে তোমাকে এই সাজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে উৎকৃষ্ট মাখনমারা ঘেৰ্ত্ত সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম তৎসম্বন্ধে কোনও রকম উল্লেখমাত্র যে করলে না তার কারণ কি বলো দেখি? আমি দেখছি অজস্র উপহার পেয়ে পেয়ে তোমার কৃতজ্ঞতা বৃত্তিটা ক্রমেই অসাড় হয়ে আসছে। প্রতি মাসে নিয়মিত পনেরো সের করে ঘি পাওয়া তোমার এমনি স্বাভাবিক মনে হয়ে গেছে যেন বিয়ের পূর্বে থেকে তোমার সঙ্গে আমার এই রকম কথা নির্দিষ্ট ছিল। তোমার ভোলার মা যখন আজকাল শয্যাগত তখন এ ঘি বোধহয় অনেক লোকের উপকারে লাগচে। ভালোই তো। একটা সুবিধা, ভালো ঘি চুরি করে খেয়ে চাকরগুলোর অসুখ করবে না।
কী মনে হয়? আপনাদের চেনা রবীন্দ্রনাথ? তিনি এই ভাবে ও ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন! বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে তো? আমি মা হিসেবে কতদূর অপদার্থ সেকথাও একটি চিঠিতে জানাতে উনি কসুর করলেন না।
আমি যশোর জেলার ফুলতুলি গ্রামের মেয়ে।
বাঙাল তো বটেই। তার উপর আবার আমার বাবা বেণীমাধব জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার কর্মী।
সত্যি কথা বলব?
এমন অসম বিয়ে হওয়া উচিত নয়।
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার কোনও যোগ্যতাই আমার নেই। না বংশমর্যাদায়। না শিক্ষায়।
একটি চিঠিতে ওঁর ভেতরের কথাটা দপ করে জ্বলে উঠল—
একেই তো বাঙাল। ছিঃ, ছেলেটাকে পর্যন্ত বাঙাল করে তুললে গো।
এইভাবে, আসতে-আসতে অন্য এক রবি ঠাকুরকে আমি জানতে পেরেছি। আমি রবি ঠাকুরের বউ না হলে এই মানুষটিকে আমি চিনতেই পারতুম না।
আমার কোনও রসবোধ নেই, একথা উনি নানাভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু আগেই বলেছি রসবোধ যাদের নেই, তারা পাকা হয় হিসেবপত্তরে। আমি আরও একটি হিসেব করেছি।
সেই হিসেব এইরকম—
আমার প্রথম সন্তানের জন্মের দু-বছর দু-মাস পরে জন্মাল আমার দ্বিতীয় সন্তান। বেলার পরে রথী। ঠিক তিন বছর পেরোতে-না-পেরোতেই আমার তিন নম্বর, রেণুকা। আবার দু-বছর কয়েক মাস, আমার চার নম্বর মীরা। মীরা জন্মের প্রায় পরে পরেই পেটে এল আমার পাঁচ নম্বর, শমী। শমীই রবি ঠাকুর আর আমার শেষ সন্তান—তাই তো জানেন আপনারা? একটু ভুল জানেন।
একটা অন্য গল্প আছে।
আমার সর্বনাশের গল্প।
কিন্তু আপনারা রস পাবেন। ভালোই লাগবে। এ-গল্পটা তিনজন জানি।
আমি।
উনি।
হেমলতা ঠাকুর।
হেমলতা মানে আমার বড়ভাশুর দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বউ। আমার ভাশুরপো-বউ।
হেমলতা আমার খুব বন্ধু। এক্কেবারে আমার সমবয়সি। দুজনেই জন্মেছি ১৮৭৪-এ।
ওকে সব বলেছি। ঘটনাটা ঘটেছে সম্প্রতি।
আমি শান্তিনিকেতনে।
ঘনঘোর বর্ষা।
বোলপুরের মুন্সেফবাবুর বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলুম। এ-বছরেই অর্থাৎ ১৯০২-এর আষাঢ় মাসে। বর্ষার জলে ওদের বাইরের সিঁড়িটা বেশ পেছল হয়েছিল।
পা পিছলে পড়লুম।
পেটে চোট লাগল।
আমার তখন ‘কয়েক মাস।’
আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে আরও একবার কৃপা করেছিলেন তো। বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল।
আর আমার যা হবার তাই হল। সর্বনাশ। রক্ত আর থামে না।
আমার বয়েস আঠাশ।
আমার বিয়ের বয়েস উনিশ।
আমার আর বাঁচার ইচ্ছে নেই।
শক্তিও নেই।
সমস্ত জীবনটাই কেমন আবছা মনে হচ্ছে।
কেন জন্মেছিলুম?
কেন এত কষ্ট পেলুম?
রাতে ঘুম আসছে না আমার।
সমস্ত শরীরে জ্বালা।
ঘর অন্ধকারে।
সেই অন্ধকারে উনি আর আমি।
আমি বিছানায় মরা পাতার মতো শুয়ে আছি।
উনি বসে-বসে আমাকে হাত-পাখার বাতাস করছেন। উনি অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে বাতাস করেন। আমি শুতে বলি।
কিছুতেই কথা শোনেন না।
হঠাৎ বললেন, ছোটবউ, একটা কথা তোমার কাছে স্বীকার করতে প্রাণ চাইছে।
তুমি আমার সঙ্গে এতদিন ঘর করলে, নিশ্চয় বুঝেছ, ভিতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম।
—না গো, তুমি নির্মম নও। তুমি খুব দয়ালু, খুব ভালো। কত যত্ন করছ আমাকে।
না ছোটবউ, আমি নির্মম, আমি অনাসক্ত। কেন জানো?
—না তো।
শোনো। আমি জানি আমি অনেক দূরের যাত্রী। অনেক পথ পেরোতে হবে আমাকে।
—তাই নির্মম হতে হবে?
—এই দীর্ঘ যাত্রার জন্যেই বন্ধুবান্ধব, সংসার, তোমাকে, আমার ছেলেমেয়েদের…আমি কোনও কিছু আঁকড়ে ধরিনি।
—কোথায় পৌঁছতে চাও তুমি?
—জানি না। শুধু জানি অনেক পথ পেরোতে হবে। আটকে পড়লে চলবে না।
—তুমি এগিয়ে যাও। আমার ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা রইল।
–ছোটবউ, আমার মধ্যে একটা প্রবল শক্তি আছে। আমি জানি, সেই শক্তি বিচিত্র পথে ধীরে-ধীরে নিজেকে প্রকাশ করবে। ভিতরে ভিতরে আমি যদি নিষ্ঠুর না হই তাহলে সেই শক্তিকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। যদি জড়িয়ে পড়ি, আমার সব নষ্ট হয়ে যাবে।
অন্ধকারের মধ্যে আমার গাল বেয়ে নামল চোখের জল। উনি দেখতে পেলেন না। মনে-মনে বললাম, আমার রবি ঠাকুর, আমি অন্তত তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি দেব।
০২. বিয়ের কোনও গল্প নেই
উনি বলেছেন, ওঁর বিয়ের কোনও গল্প নেই।
ওঁর বিয়ের গল্প থাকবেই বা কী করে?
আমার মতো অতি সাধারণ অল্প শিক্ষিত একটি গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে বিয়ের গল্প তো না থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার বিয়ের মস্ত বড় গল্প।
রবি ঠাকুরের সঙ্গে বিয়ে—গল্প থাকবে না?
আমার সমস্ত জীবনটাই তো আমার বিয়ের গল্প। আমার বিয়ে হল প্রায় দশ বছর বয়সে।
রবি ঠাকুরের স্ত্রী হয়ে থাকলুম প্রায় উনিশ বছর।
আর তো কিছু নেই আমার জীবনে—তাঁর একের পর এক সন্তানের মা হওয়া এবং তাদের বড় করা এবং ক্রমশ একা আর অসুস্থ হয়ে যাওয়া ছাড়া।
না, আরও আছে। সেই কথাটাই বড় কথা।
আছে আমার পরিচয়ের গৌরব, মহিমা।
আমি ক্রমেই বুঝতে পারছি, তেমন কিছুই না করেও আমি অমরত্বে উত্তীর্ণ হতে চলেছি।
ওঁর আলোই আমার আলো।
ওঁর দীর্ঘ যাত্রা আর হয়ে ওঠার ইতিহাসে আমার আসন চিরস্থায়ী।
আমার মতো এত কাছ থেকে ওঁকে তো আর কেউ দেখেনি।
সেই সৌভাগ্য তো শুধু আমার।
আমার উপর ঈশ্বরের করুণার শেষ নেই।
সব দিক থেকে কত সাধারণ, তুচ্ছ আমি।
তবু আমিই দেখতে পেলুম চাঁদের উলটো পিঠ। এ তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ!
সেই রবি ঠাকুরকে ক’জন জেনেছেন, চিনেছেন, আমি যাঁকে চিনি, জানি।
আগেই বলেছি আমি লিখতে জানি না। উনি কী সুন্দর সাজিয়ে-গুছিয়ে মনের কথা বলেন।
আমি কিছুতেই পারিনে।
ওঁর সঙ্গে ঘর করলুম–যদি একে ঘর করা বলে—যা হোক, কাটালুম তো এতগুলি বছর একসঙ্গে কিন্তু কিছুতেই লেখার ব্যাপারটা রপ্ত করতে পারলুম না।
কিন্তু তবু, যত শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, যতই আর সংসারের ভার বহন করতে পারছিনে, যতই খুব একা লাগছে, ততই মনে হচ্ছে কিছু একটা লিখে সময় কাটাই।
দেখেছি, লিখলে বেশ সময় কেটে যায়। কিন্তু কী লিখি?
কেন, নিজের কথা।
আমি তো লেখক নই ওঁর মতে, যে বানিয়ে বানিয়ে লিখব।
নিজের কথা লিখি তো। বানাতে হয় না। একেবারে রেডি মেড গপ্পো।
নিজের কথা লিখি কীভাবে?
আমার দিক থেকে আমি আমার জীবনটাকে যেভাবে দেখেছি, সেইভাবে। সেইটেই লিখে ফেলি।
সেই দেখাটা আপনাদের রবি ঠাকুরের মতো নাও হতে পারে। তানা হওয়াই তো স্বাভাবিক।
উনি যদি লেখেন কোনওদিন আমাদের কথা, আমাদের নিয়ে ওঁর জীবনের কথা লিখবেন কি কোনওদিন? সে-লেখা তো ছাপার অক্ষরে বেরোবে, সবাই পড়বে। একেবারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, লেখার মতো লেখা। রবি ঠাকুরের লেখা বলে কথা। আমাদের চেয়ে লেখাটাই তখন বড় হয়ে উঠবে! আমি তো আর ছাপাবার জন্যে লিখছি না। লুকিয়ে রাখার জন্যে লিখছি।
যেমন ওঁকে লেখা আমার চিঠি—সেসব চিঠি আমি তো জানি, আমার সঙ্গে চিতায় উঠবে। কেউ কোনওদিন খুঁজে পাবে না তাদের। এই লেখাটার ভাগ্যে কী আছে কে জানে!
আমার বিয়ের বেশ ক’বছর পরে। উনি শিলাইদহে জমিদারির দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত।
কত কী লিখছেন। গল্প, কবিতা, গান।
ওঁর কাজ আর খ্যাতি ক্রমশই বাড়ছে। আমি তো তেমন কিছু বুঝি না। দূর থেকে শুধু ওঁর মঙ্গল চাই। উনি দূরে আছেন। মন কেমন করে। কতদিন দেখা হয় না। কিন্তু এও ভাবি, দূরে আছেন বলেই ভালো আছেন।
আপন মনে কাজ করতে পারছেন।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বিশেষ করে মেয়েমহলে কূটনীতির শেষ নেই।
শুধু সাংসারিক মারপ্যাঁচ।
যে যার নিজের স্বার্থ নিয়ে আছে।
সেই খেয়োখেয়ির মধ্যে আমি পচছি।
যতখানি পারি মানিয়ে চলার চেষ্টা করি।
মাঝেমধ্যে মনে হয় সংসারের, ছেলেমেয়েদের সব দায়িত্ব কি শুধুই আমার?
ওঁকে কি কখনও পাশে পাব না?
বলতে গেলে আমিই এখন বাড়ির গিন্নি, যদিও আমি কিন্তু এ-বাড়ির ছোটবউ।
ওঁকে সুবিধে-অসুবিধে জানাবার উপায় নেই।
উনি দিনরাত ভেসে চলেছেন পূর্ববাংলার নদীপথে।
পদ্মার চরে, কোনও অজানা প্রান্তরের পাশে উনি বোটের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন।
কখনও ইছামতীতে। কখনও দীঘাপতিয়ার জলপথে। কখনও সুদূর নোয়ালঙ্গে একা।
তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের কোনও উপায় নেই।
কখনও হয়তো তাঁর চিঠি এল কালিগ্রাম থেকে।
তারপর খবর আসে তিনি নাটোরে, তিনি পতিসরে, তিনি কুষ্টিয়ায়! আমি যখন নিজের কথা ভাবি তখন দেখি পনেরো বছর ধরে আমি আসলে জোড়াসাঁকোর বাড়ির কাজের লোক হয়ে গিয়েছি।
না হয়ে উপায় বা কী?
বাড়ির বড়বউ সর্বসুন্দরী বহুকাল হল মরে বেঁচেছেন।
বড়বউ মানে আমার বড়ভার দ্বিজেন্দ্রনাথের স্ত্রী।
আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনী, মানে সত্যেন্দ্রনাথের বউ, তিনি তো বিলেত ফেরত মেমসাহেব, প্রথম ভারতীয় আইসিএস-এর স্ত্রী বলে কথা, তিনি জোড়াসাঁকোর সংসার ছেড়ে থাকেন সায়েবপাড়া পার্কস্ট্রিটে। এলাহি ব্যাপার। বাবামশায় আজকাল কলকাতায় এলে ওখানেই থাকেন। মেজোজায়ের এক ছেলে এক মেয়ে।
সুরেন আর ইন্দিরা।
আর একটি ছেলে হয়েছিল। ভারি মিষ্টি দেখতে। নাম দেওয়া হয়েছিল কবীন্দ্র। তবে সবাই ডাকত চোবি বলে। সে বিলেতে মারা গেল দু-বছর বয়েসে। বোধহয় বিলেতের ঠান্ডা সহ্য করতে পারেনি।
এবার আসি আমার সেজোজানীপময়ীর কথায়।
আমার সেজোভাশুর হেমেন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন চল্লিশ বছর বয়সে।
এগারোটি ছেলেপুলে নিয়ে নীপময়ী বিধবা। এবং বিধবা হওয়ার পর থেকে তিনি সংসারের কুটোটি নাড়েন না। ধম্মকম্ম নিয়ে আলগোছা হয়ে থাকেন একপাশে।
আমার আরও এক জা আছে। ইনি আমার শ্বশুরমশায়ের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রফুল্লময়ী। প্রফুল্লময়ী নীপময়ীর ছোটবোন। নীপময়ীর তো বিয়ে হয়েছে। হেমেন্দ্রনাথের সঙ্গে। পরের ভাই বিয়ে করলেন নীপময়ীর ছোটবোন প্রফুল্লময়ীকে। তার কারণ, এঁদের বাবা হরদেব চাটুজ্জ্যে আমার শ্বশুরমশায়ের খুব ভক্ত ছিলেন। অতএব ভক্তের দুই কন্যাকে দুই ছেলের বউ করে নিয়ে এলেন বাবামশায়। ভাগ্যে সুখ সইল না। হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন প্রফুল্লময়ীর স্বামী বীরেন্দ্রনাথ।
আপনাদের রবি ঠাকুর একদিন আমাকে হেসে বললেন, আমার দাদা পূর্ণ উন্মাদ। আর আমি অর্ধেক।
আমি বললুম, বালাইষাট, তুমি পাগল হতে যাবে কেন?
উনি বললেন, কবি মাত্রেই অর্ধোন্মাদ।
আমার ভাশুর যখন উন্মাদরোগে আক্রান্ত সেই অবস্থায় ওঁর একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথের জন্ম হল।
এবং বলেন্দ্র মারা গেল মাত্র ঊনতিরিশ বছর বয়েসে।
বলু আমাকে সংস্কৃত, ইংরেজি এইসব শিখিয়েছিল। ও ছিল আমার খুব বন্ধু। ওর মৃত্যুর পরে আমি আরও একা হলুম।
বলুর কথায় পরে আসছি। যতটুকু বলা যায়, ততটুকুই বলব বলুর আর আমার বন্ধুত্বের কথা। তবে এখন তো জোড়াসাঁকোর বাড়ির জটিল পরিবেশের কথা বলছি যার মধ্যে আমি একা বছরের পর বছর কাটিয়েছি। এবং বলা যেতে পারে, শেষ হয়ে গেছি।
ওঁকে পাশে পাইনি বলেই বড্ড একা থাকতে হল সারাজীবন। বলু মারা যাওয়ার পর বাবামশায় বেশ একটা নিষ্ঠুর কাণ্ড করলেন। আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু উনি বাবামশায়কে সমর্থন করেছিলেন। আমার মনের কষ্টটা বোঝেননি।
বলুর মৃত্যুর পরে বাবামশায় তাঁর শেষ উইলে পাগল ছেলে বীরেন্দ্রকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলেন। কারণ দেখালেন, বলুর মৃত্যুর পরে বীরেন্দ্রর তো আর কোনও উত্তরাধিকারী নেই। তিনি নিজেও উন্মাদ। তা-ই তাঁকে সম্পত্তির ভাগ দেওয়া উচিত হবে না। তাঁর বিধবা স্ত্রী প্রফুল্লময়ীর কথা বাবামশায় একবারও ভাবলেন না। প্রফুল্লময়ীর জন্যে নির্দিষ্ট হল একশো টাকা মাসোয়ারা। প্রফুল্লময়ী অর্থচিন্তায় ভেঙে পড়লেন। জোড়াসাঁকোর পারিবারিক পরিবেশ কেমন যেন অন্ধকার আর ঘোরালো হয়ে উঠল।
উনি দূর থেকে তাঁর কতটুকু আঁচ করতে পেরেছিলেন, জানি না। আমার মনে হয়েছিল বাবামশায় প্রফুল্লময়ীর উপর অবিচার করলেন। আপনাদের রবি ঠাকুর কিন্তু বাবামশায়ের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে আমাকে একটি চিঠিতে জানালেন, ন’বউঠানের এক ছেলে, সংসারের একমাত্র বন্ধন নষ্ট হয়েছে, তবু তিনি টাকাকড়ি, কোম্পানির কাগজ কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত্তির যেরকম লেগে রয়েছেন তা দেখে সকলেই আশ্চর্য এবং বিরক্ত। চিঠি পড়ে আমার মনে হল অন্তত আমার স্বামীটি বেশ রেগেই রয়েছে। তবে আপনাদের রবি ঠাকুর এটাও জানালেন তিনি মনুষ্যচরিত্রের বৈচিত্র্য বিবেচনা করে ন’বউঠানের কাজকম্ম শান্তভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন। আমার স্বামীর চিঠি পেয়ে এই প্রথম তাঁকে চিঠি লেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। এবং সেই চিঠিতে তাঁকে একটি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলুম।
কিন্তু চিঠি লিখিনি, প্রশ্নও করিনি।
সাহসে কুলোয়নি।
আমার এই অগোছালো কিন্তু একেবারে খাঁটি আত্মজীবনীতে সেই প্রশ্নটি আপনাদের রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লিখে রেখে গেলুম—তুমি কি ভুলে গিয়েছিলে যে তোমার পাগল দাদার একমাত্র ছেলে বলু যখন মারা গেল, সে রেখে গেল তার পনেরো বছরের বিধবা বউ সাহানাকে?
তার ভরণপোষণের দায়িত্ব কি ন’বউঠানের উপর এসে পড়ল না?
বাবামশায় সেকথা ভুলে গেলেন কী করে?
আর তুমিও টু শব্দটি পর্যন্ত করলে না!
তোমার এই ব্যবহারে আমি যতটা না অবাক হয়েছিলুম, তার থেকে লজ্জা পেয়েছিলুম অনেক বেশি।
আরও একটা ঘটনা ঘটল আমার চোখের সামনে।
সাহানা অভিমান করেই চলে গেল এলাহাবাদে তার বাপের বাড়িতে। সাহানার বাপ মেজর ফকির চাটুজ্যে জাঁদরেল মানুষ ছিলেন। তিনি পনেরো বছরের বিধবা মেয়েটির আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।
সাহানা বারো বছর বয়েসে বলুর বউ হয়ে আসে।
তিন বছরে তার কোনও বাচ্চা হয়নি। এই একটা সুবিধে ছিল। যেই না বাবামশায়ের কানে পৌঁছোল সাহানার বিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে অমনি উনি যেন দপ করে জ্বলে উঠলেন।
উনি বিধবাবিবাহের একান্ত বিরোধী।
এছাড়া উনি মনে করলেন, ঠাকুরবাড়ির কোনও বিধবার অন্যত্র বিয়ে হলে তাঁর এবং বংশের মর্যাদাহানি হবে।
বাবামশায় তোমাকেই পাঠালেন এলাহাবাদে তাঁর দূত হিসেবে। তোমার একমাত্র কাজ এই বিয়ে বন্ধ করে পনেরো বছরের সাহানাকে জোড়াসাঁকোর বাড়ির জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
আমার মনে হয়, তোমার মেজোদাদাকে যদি বাবামশায় এই কাজটি করতে বলতেন, তিনি প্রতিবাদ করতেন।
একমাত্র তাঁরই মধ্যে আমি বাবামশায়ের সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলার সাহস দেখেছি। তোমার ভাইদের মধ্যে এ-ব্যাপারে তিনি একা। তার অবিশ্যি একটা বড় কারণ হল, তিনি প্রথম ভারতীয় আইসিএস, তাঁর মাসে অনেক টাকা বেতন, তিনি বাবামশায়ের তহবিল থেকে পাওয়া হাতখরচের উপর নির্ভর করেন না।
বাবামশায় যেই তোমাকে এলাহাবাদ যেতে বললেন অমনি তুমি শুড়শুড় করে এলাহাবাদ ছুটলে।
ঠিক যেমনি বাবামশায়ের কথায় আমাকে শুড়শুড় করে বিয়ে করলে। আমাকে বিয়ে করাটা তো স্রেফ পিতৃআজ্ঞা পালন। তাই না?
কেন বিয়েটা করেছিলে বলো তো?
তুমিও কষ্ট পাচ্ছ। আর আমি? সেকথা ছাড়ো। অন্তত আপাতত। পরে তো আসতেই হবে সেকথায়। এখন যে কথা বলছিলুম—তুমি চলে গেলে এলাহাবাদে। কী জন্যে এলাহাবাদে যাচ্ছ, ঠিক করে আমাকেও জানাওনি।
আমি জিগ্যেস করেছিলুম।
তুমি বললে, একবার সাহানাদের বাড়িতে যেতে হচ্ছে।
—সাহানার বাপের বাড়ি! সে তো এলাহাবাদে। তার ওখানে যাওয়ার কী দরকার পড়ল?
–বাবামশায়ের আদেশ।
–মেয়েটা এ-বাড়িতে ভালো ছিল না। খুব একলা হয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ কাঁদত।
—প্রথম প্রথম তো কাঁদবেই। এত কম বয়েসে বিধবা হল। কিন্তু কী জানো ছোটবউ, ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে যেত। এ-বাড়িতে এত লোকজন। ওর এখন মানুষজনের সঙ্গ প্রয়োজন।
—ওকে কি ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছ?
–দ্যাখা যাক।
—বাপের বাড়িতে গিয়ে যদি মেয়েটা একটু শান্তিতে থাকে, থাকুক না। এখুনি ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে?
—তুমি বুঝবে না ছোটবউ। সাহানা ঠাকুরবাড়ির বউ। এই বাড়িই ওর জায়গা। ওর অন্য কোথাও মন বসলে সেটা ওর ভবিষ্যতের পক্ষে ভালো হবে না।।
আমি অন্যের মুখে শুনলাম, সাহানাকে এত তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন কেন হয়েছিল!
বিধবাবিবাহের বিরোধিতা করেছেন বাবামশায় আজীবন। কিন্তু তোমার নিজস্ব কোনও মত ছিল না?
তুমি তো আমাকে কতবার বলেছ, তুমি বিধবাবিবাহের পক্ষে। অথচ বাবামশায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একটি কথাও বলার সাহস হল না তোমার।
আমি তোমাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি।
খুব ভালোবাসি।
তাই তুমি যখন সাহানাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্যে এলাহাবাদে গেলে আমি বড় কষ্ট পেয়েছিলুম। লজ্জাও হয়েছিল।
তবে আমি জানতুম সাহানার বাপের বাড়ি তোমার কথায় মজে যাবে। আর সাহানা তো একরত্তি মেয়ে—ওর আবার মতামত আছে নাকি। আমার মনে এতটুকু সন্দেহ ছিল না, তুমি যখন ওকে আনতে যাচ্ছ, ও ঠিকই চলে আসবে। আর ওর বাকি জীবন বিধবা হয়েই কাটবে। তোমার সঙ্গে কথায়, যুক্তিতে, বোঝনোর ক্ষমতায় কে এঁটে উঠবে?
তুমি তো ভাষার ভগবান।
তোমার কথায় কী জাদু, তার কত প্রমাণ তো পেলাম সারাজীবন।
একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। আমি অকৃতজ্ঞ নই। কথাটা বলতেই হবে। কথাটা হল, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমি যখন খুব একা, সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি, তখন আমার বড়ননদ সৌদামিনী কিছুদিন আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাল ধরেছিলেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, কাজটি বড় সুবিধের নয়। বেশিদিন পারলেনও না।
মনে হল, আড়াল থেকে আঙুল নাড়লেন বাবামশায়। মেজোবউদিদি জ্ঞানদানন্দিনীরও যে ইশারা ছিল না এমনও তো ভাবতে পারিনে।
বাবামশায় এখন কলকাতায় থাকলে মেজোভাশুরের পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতেই ওঠেন। জোড়াসাঁকোতে আর আসেন না।
আমার বড় ননদ বাবামশায়ের সেবা করার জন্যে পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতেই চলে গেলেন।
বাবামশায় নিজেও চেয়েছিলেন সেটাই—তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাটি তাঁর কাছেই থাকুক।
সুতরাং আমার ঘাড়ে জোড়াসাঁকোর সকল ভার চাপিয়ে বড় ননদ পিতৃআজ্ঞা পালন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করলেন না।
তখন তো পার্ক স্ট্রিটের বাড়ি জমজমাট। যে-ভাশুটি রূপেগুণে আমার রূপবান গুণবান। স্বামীটির চেয়ে বিন্দুমাত্র কম নন, সেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথও সেখানে।
তবে স্ত্রী কাদম্বরীর আত্মহত্যার পরে তিনি ক্রমশ কেমন যেন হয়ে গেলেন।
মেজোবউঠানের খুব কাছের মানুষ হয়ে রইলেন। কিন্তু তোমার আমার কাছ থেকে ক্রমশই যেন দূরে সরে গেলেন। এর কারণ আমি ধীরে-ধীরে জানতে পেরেছি। তুমি কিন্তু আমাকে কিছু বলোনি।
এত বছর হয়ে গেল তোমার আমার। তবু তোমার সেই আড়াল গেল না।
তুমি এত বোঝে।
এইটুকু বোঝো না?
তোমার এক এবং অদ্বিতীয় জ্যোতিদাদার কথা যখন উঠলই, তখন তো তোমার নতুন বউঠানের কথা উঠতে বাধ্য।
কিন্তু আমি বলতে চাই না সেই বিষয়ে বিশেষ কিছু। তুমি যখন আড়াল করে রেখেছ, আড়ালেই থাক।
তবে একেবারে যে আমাকে কিছুই বলেনি, তাও তো নয়।
তুমি বলেছ তোমার মতো করে হয়তো সব কথাই।
একমাত্র তুমিই পারো এভাবে সমস্ত বলতে সেই সমস্তর মধ্যে আড়াল থেকেই যায়।
তুমি আমাকে বলেছিলে, তুমি নতুন বউঠানকে খুব ভালোবাসতে। আর বলেছিলে, নতুন বউঠানও তোমাকে খুব ভালোবাসতেন। সেই নতুন বউঠান কেন তোমার আমার বিয়ের ক’মাসের মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন?
কী এমন দুঃখ হল তাঁর?
যখন তিনি আত্মহত্যা করলেন, আমার বয়স তখন দশ।
কিছুই বুঝিনি।
একটা দৃশ্য মনে আছে।
তুমি আর তোমার জ্যোতিদাদা, দুজনে নতুন বউঠানকে ধরে তাঁকে দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটাবার চেষ্টা করছ।
তিনি সামনের দিকে ঝুলে পড়ে ঘুমিয়ে পড়ছেন।
আর তোমরা দুজনে তাঁকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছ।
কিন্তু কিছুতেই জাগিয়ে রাখতে পারলে না।
আমার মনে আছে তাঁকে।
ঠাকুরবাড়ির সব বউদের চেয়ে তাঁর গায়ের রং ময়লা।
আমার থেকেও।
কিন্তু সব থেকে সুন্দর তিনিই। তাঁর সঙ্গে আমার বেশি দেখা হয়নি। তিনি তো ঘর থেকে বেরোতেনই না। আমাকেও তুমি কোনওদিন নিয়ে যেতে না ওঁর ঘরে।
তুমি যেতে মাঝেমধ্যে। অনেকক্ষণ থাকতে। যখন ফিরে আসতে আমার কাছে, তোমার মন থাকত অন্য কোথাও।
আমি যে ঘরে আছি খেয়ালই থাকত না তোমার।
দু-একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলুম, কী কথা হল গো?
তুমি কোনও উত্তর দাওনি।
জিগ্যেস করেছিলুম, আমার একা যেতে ভয় করে, তুমি একদিন নিয়ে যাবে ওঁর ঘরে?
তুমি বললে, ওঁকে একা থাকতে দাও। ওঁকে তুমি বুঝবে না। যখন নতুন বউঠান আত্মহত্যার চেষ্টা করেও দুদিন বেঁচে থাকলেন, বউঠানের খুব অসুখ, জানতে চাইলুম কী হয়েছে? তুমি বললে, ডাক্তার তো দেখছে। শক্ত ব্যামো।
তারপর এ-বাড়িতে থাকতে-থাকতে, নানা গল্প, কানাঘুষো, উড়োকথা শুনতে-শুনতে এইটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছি, নতুন বউঠান বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, ওঁর কোনও ব্যামো হয়নি।
একটা জলজ্যান্ত মানুষ, কী কম বয়েস, আত্মহত্যা করল!
কেন? সব চুপ! কেউ কিছু জানে না।
আমি বাতাসে কান পেতে জানতে পারছিলুম খুব আস্তে আস্তে আমার রবি ঠাকুর আর তাঁর নতুন বউঠানের বয়েস ছিল খুব কাছাকাছি।
নতুন বউঠান ছিলেন মাত্র দু-বছরের বড়। আর এ-বাড়িতে আমার স্বামী ছাড়া তাঁর কোনও বন্ধু ছিল না।
ওঁদের মনের মিল হয়েছিল।
ওঁদের সম্পর্কটা আমি খুব ধীরে-ধীরে অনুভব করেছিলুম—যেমন একটু-একটু করে আলো ফুটে ভোর হয়, সেইভাবে।
যেদিন তাঁর নতুন বউঠান চলে গেলেন, সেদিন অনেক রাত্তির পর্যন্ত উনি ঘরে এলেন না।
কোথায় উনি?
আমি চুপিচুপি ছাদে গিয়ে দেখি, উনি পায়চারি করছেন আর মাঝে-মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছেন, কোথায় তুমি নতুন বউঠান, তুমি ফিরে এসো। আমি তোমাকে ছেড়ে বাঁচব কী করে?
আমি আর কখনও ওঁকে এমন উদভ্রান্ত দেখিনি। আমি কাঁদতে কাঁদতে একা ঘরে ফিরে এলুম।
শুরু করেছিলুম বিয়ের কয়েক বছর পরে শিলাইদহে একটি ঘটনার কথা মনে করে।
কিন্তু সেই ঘটনা চুলোয় গেল, কথায়-কথায় কোথায় চলে এসেছি—একেবারে আমার বিয়ের মাস তিনেকের মধ্যে!
লেখক না হলে এই হয়। খালি খেই হারিয়ে যায়। তা হোক। এই লেখা তো কেউ কোনওদিন ছাপবে না।
শুধু সময় কাটানোর জন্যে লিখছি।
মনের মধ্যে কথা জমিয়ে রেখে কোনও লাভ নেই।
মনের কথা লিখে ফেললে মন অনেক হালকা হয়ে যায়। আর মনের কষ্টও কমে যায়।
সেদিন হঠাৎ বৃষ্টি এল। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। উনি লেখা বন্ধ করে জানলার কাছে গিয়ে বসলেন।
বরাবর দেখেছি, বৃষ্টির সঙ্গে ওঁর খুব গভীর একটা সম্পর্ক। বৃষ্টি আর উনি যেন পরস্পরের মনের কথা বোঝেন।
আর কারো সঙ্গে বৃষ্টির এমন বন্ধুত্ব দেখিনি।
কতবার দেখেছি; শান্তিনিকেতনে দেখেছি, শিলাইদহে দেখেছি, সাজাদপুরে দেখেছি, বৃষ্টি এসেছে, উনি তাকিয়ে আছেন মেঘের দিকে, আকাশের মধ্যে যেন হারিয়ে গিয়েছেন, সেই সময়ে উনি একেবারে অন্য মানুষ, সংসারের বাইরের মানুষ।
গান লেখার সময়েও ওইরকম। অন্য কিছু লেখার সময় হয়তো তবু কথা বলা যায়।
কিন্তু বৃষ্টি আর গানের সঙ্গে উনি একাকার হয়ে থাকেন। তখন উনি আমাদের কেউ নন।
আমার কী সৌভাগ্য—এই দুই ভাবের মধ্যেই আমি ওঁকে কতবার কত কাছ থেকে দেখেছি।
আমি ওঁর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। উনি ডুবে আছেন। টের পাননি। টেবিলের উপর ওঁর লেখার কাগজ। কলম। কী লিখছিলেন উনি? লেখা বন্ধ করে উঠে গিয়েছেন জানলার কাছে চেয়ারটিতে।
টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি মুক্তোর মতো হাতের লেখায় ইন্দিরাকে একটি চিঠি লিখছেন।
কোথাও একটি কাটাকুটি নেই। কী এক তোড়ে বেরিয়ে এসেছে তাঁর মনের কথা! আমার সব চিঠিটা মনে নেই। কিন্তু তার ভিতরের কথাটা মনে আছে।
উনি লিখেছেন, যারা খুব অল্প অনুভব করে, অল্প চিন্তা করে, অল্পই কাজ করে, তাদের সংসর্গে মনের কোনও সুখ নেই। ঠিক এই ভাষায় লেখেননি, কিন্তু মোদ্দা কথাটা তাই।
চিঠির শেষে লিখছেন, আমাদের সমস্ত জীবনের সফলতাটা যে জায়গায় সেইখানে একটা প্রেমের স্পর্শ, একটা মনুষ্য-সঙ্গের উত্তাপ সর্বদা পাওয়া আবশ্যকনইলে তার ফুলে-ফলে যথেষ্ট বর্ণ গন্ধ এবং রস সঞ্চারিত হয় না। কথাগুলি আমার এমনভাবে মনে ধরল যে মুখস্থ হয়ে গেল!
উনি তো কখনও আমাকে এই ভাষায় এমন ভাবের চিঠি লেখেননি! কেনই বা লিখবেন?
আমি কি এমন চিঠির, এমন ভাব আর ভাষার যোগ্য? আমি কি দিতে পারব জীবনের সফলতার জায়গায় প্রেমের স্পর্শ? আমার সঙ্গের উত্তাপ?
আর দিতে যদি পারিও, আমার মতো অতি সাধারণ একটি মেয়ের প্রেমের কী দাম?
একবার ইচ্ছে হল, ওঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াই, ঢুকে পড়ি ওঁর ভাবের ঘরে আর স্পষ্ট কণ্ঠে ওঁকে প্রশ্ন করি, সত্যি করে বলো, আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন?
জিগ্যেস করতে পারিনি। পারলে তো আমি অন্য মেয়ে হতুম। বলা যায় না, এমন প্রশ্ন করতে পারলে হয়তো উনি আমাকে ওঁর প্রেমের যোগ্য ভাবতেন কোনওদিন।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম নিঃশব্দে।
কেন তুমি আমাকে বিয়ে করতে গেলে?
আমার প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, কেনই বা তোমাকে আমি এ-প্রশ্ন করতে চেয়েছিলুম? এ-প্রশ্নের উত্তর, সঠিক উত্তর, তুমি কিছুতেই দিতে পারতে না।
সেই স্বীকারোক্তি তোমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
আমি কিন্তু জানি কেন তুমি বিয়ে করেছিলে আমাকে, তোমাদের বাড়ির এক গরিব কর্মচারীর অতি সাধারণ দশ বছরের কন্যাকে।
তোমার তখন বয়েস প্রায় তেইশ।
নতুন বউঠান তোমার জীবনে তখন একমাত্র ভালোবাসার মেয়ে, তোমার ধ্রুবতারা—তার বয়েস পঁচিশ, তাঁকে ছাড়তে বাধ্য হলে তুমি। আর বিয়ে করতে বাধ্য হলে ন’বছর ন’মাসের আমাকে!
কী দিতে পারতুম আমি?
কী-ই বা তোমার পাওয়ার ছিল আমার কাছে?
কেন তুমি বিয়ে করতে বাধ্য হলে, সে-গল্প আমি একটু-একটু করে বুঝতে পেরেছি।
কত মুখে কত কথা শুনতে-শুনতে বুঝেছি, তোমার জীবনে আমার জায়গাটা কোথায়।
তোমার সঙ্গে তোমার নতুন বউঠানের বন্ধুত্ব বলো, সম্পর্ক বলো, মনের দেয়ানেয়া বলল, ভালোবাসা বলল, তা যে কত গভীরে গিয়ে পৌঁছেছিল, সেকথাও আমি ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলুম।
তোমার যখন দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার কথা হল—এবার বিলেত যাবে তুমি ব্যারিস্টার হতে—সেই খবর পেয়ে নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি।
কেন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন তিনি?
কারণ, ঠাকুরবাড়িতে তিনি কারও সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেননি।
আমার মতো তিনিও ছিলেন এ-বাড়ির কাজের লোকের মেয়ে। তাঁর সঙ্গেও তাঁর স্বামীর বয়েসের অনেক তফাত।
তাঁকে তোমার নতুন দাদার যোগ্য স্ত্রী বলে কেউ মনে করতেন না। এমনকী তোমার নতুন দাদাও নন।
একমাত্র তুমি ছিলে তাঁর বন্ধু।
তাঁর একটিমাত্র মনের মানুষ।
একমাত্র তোমারই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তাঁর ভারি মধুর এক সম্পর্ক। তুমি যখন প্রথমবার বিলেত গেলে, তোমার বয়স সতেরো। তোমার নতুন বউঠান কুড়ি। তুমি তাঁকে দেড় বছরের জন্যে ফেলে রেখে গিয়েছিলে এমন এক পৃথিবীতে যেখানে প্রতি মুহূর্তে তিনি তোমার অভাব বোধ করেছেন এবং কষ্ট পেয়েছেন।
নতুন দেশে, নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে তুমি কিন্তু অতটা কষ্ট পাওনি রবি ঠাকুর।
আমি অনেক ভেবেছি। এবং ভাবতে ভাবতে কিছু সত্যের সন্ধান পেয়েছি। আস্তে-আস্তে আমার চোখের সামনে থেকে পরদাটা সরে গিয়েছে।
আমি অনেকগুলি সিঁড়ি পেরিয়ে ধাপে-ধাপে তোমার আমার সম্পর্কের আসল জায়গাটায় পৌঁছোতে পেরেছি।
সেটা হল সত্যের তলানি।
যে-কথা বলছিলুম। তুমি বিলেত যাওয়ার আগে আমেদাবাদে গেলে তোমার মেজোদাদার কাছে। তিনি চাইলেন বিলেত যাবার জন্যে তোমাকে তৈরি করতে।
কেমন ভাবে তৈরি করা?
বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেইরকম মেয়েদের সঙ্গে তোমাকে মিলিয়ে দিয়ে তৈরি করা।
তোমাকে পাঠিয়ে দিলেন বম্বেতে বন্ধু ডাঃ আত্মারাম পাণ্ডুরঙের বাড়িতে থাকার জন্যে।
সেই বাড়িতে থাকে আত্মারামের সদ্য বিলেত ফেরত সুন্দরী কন্যা। এই মারাঠি মেয়ে শেখাবে তোমাকে বিলিতি বুলি আর আদবকায়দা।
কিন্তু সে তো তোমার প্রেমে পড়ল গো রবি ঠাকুর। তোমার প্রেমে কে না পড়বে বলো?
তুমিও পড়লে তার প্রেমে—সেটাই তো খবর।
সেই মেয়ের মারাঠি নাম ছিল আন্না।
তুমি ভালোবেসে তার নাম রাখলে ‘নলিনী’।
তুমি তাকে নিয়েই লিখলে তোমার কাব্য ‘কবিকাহিনি’।
তোমার বড়দাদা আমার বিয়ের পরে আমার আইবুড়ো নাম ভবতারিণী বদলে নতুন নাম রাখলেন ‘মৃণালিনী।’
কেন মৃণালিনী অনেক পরে জেনেছিলুম।
নলিনী-ই কি মৃণালিনী নয়? আমার নাম শুনলেই যাতে তোমার জীবনের প্রথম প্রেমিকার কথা তোমার মনে আসে, তাই আমার নাম হল ‘মৃণালিনী।’ আমি অন্য এক মেয়ের ছায়া হয়ে এলুম তোমার জীবনে।
প্রথম থেকেই আমার নিজের বলতে কিছুরইল না। মুছে দিলে তোমরাই।
নলিনীকে অবিশ্যি ভুলতে তোমার বেশি সময় লাগেনি।
তোমার মুখেই আমি নলিনীর গল্প শুনেছি।
সেই মেয়ে যে চাঁদনি রাতে তোমার খাটে একা এসে বলেছিল, আমার হাত ধরে টানো তো, দেখি টাগ-অফ-ওয়া’র কে জেতে—সেই মেয়ে যে তোমাকে বলেছিল, রাখলাম আমার হাতের দস্তানা তোমার সামনে, এবার আমি ঘুমিয়ে পড়ছি, এই সুযোগে যদি দস্তানাটা চুরি করতে পারো, তাহলে তুমি পাবে আমাকে চুমু খাবার অধিকার কী সাহসী মেয়ে গো! পারব কখনও অচেনা পুরুষকে এসব কথা বলতে?
তুমি তো তার প্রেমে পড়বেই। কিন্তু বিলেতে মেমসায়েব দেখে নলিনীকে গেলে ভুলে ক’দিনের মধ্যেই। অথচ ‘কবিকাহিনী,’ ‘ভগ্নহৃদয়’ তাকে নিয়েই লেখা।
নলিনীকে ভুললে কার প্রেমে পড়ে?
লুসি স্কটের প্রেমে পড়ে।
লন্ডনে যাঁদের বাড়িতে গিয়ে উঠলে তুমি সেই ভদ্রলোকের চার মেয়ে।
লুসিই ছোট মেয়ে।
তার সঙ্গে শুরু করে দিলে গানবাজনা-প্রেম। শুধু কি লুসি? তোমার মুখেই তো শুনেছি আরও অনেক নাম—মিস লং, মিস ভিভিয়ান, মিস মুল।
তুমি তো নতুন বউঠানকে জানিয়েও ছিলে, বিলেতে অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে নাচতে তোমার মন্দ লাগে না। জানিয়েছিলে, যেদিকে পা বাড়াও সেদিকেই বিবিদের গাউন। জানিয়েছিলে, যেদিকে চোখ ফেরাও চোখ ঝলসে যায় মেয়েদের রূপে। জানিয়েছিলে, সকলের মুখে হাসি আর হাসতে হাসতেই এইসব বিলিতি মেয়েরা পুরুষের মন অধিকার করার যত প্রকার গোলাগুলি আছে, সব তারা অকাতরে নির্দয়ভাবে বর্ষণ করছে। জানিয়েছিলে, বিলেতে যে-ঘর যত পিছল সে-ঘর তত নাচার উপযুক্ত। জানিয়েছিলে, এই পিছল ঘরে পা কোনও বাধা পায় না, আপনাআপনি পিছলে আসে।
আমি কী করে জানলুম, তোমার নতুন বউঠানকে তুমি লিখেছিলে এইসব কথা?
এসব কথা তো ছাপার অক্ষরেই লেখা আছে। আর আমি তো বুঝতে পেরেছি, এসব লেখা তোমার নতুন বউঠানকেই লেখা চিঠি।
তুমিই লিখেছ নতুন বউঠানকে, এইসব মেয়েদের কেউ তোমাকে ডেকেছে ইশারায়, কেউ চাপল্যের মাধুর্যে। কারও কাছে পেয়েছ রোম্যান্টিক উষ্ণতা। কারও সঙ্গে একা বেড়াতে গেছ বনের পথে। কারও সঙ্গে নেচ্ছে। কারও সঙ্গে গেয়েছ। কেউ দিয়েছে স্পর্শসুখ। কেউ মনের তৃপ্তি।
তুমি তো নিজেই লিখেছ রবি ঠাকুর, তোমার চেহারাটা যে নেহাত মন্দ নয় একথা তুমি প্রথম টের পেলে বিলেতে।।
তুমি তো স্বীকার করেছ, তোমার বয়স হয়েছিল একটু দেরিতেই। ইঙ্গিতে বলেছ, বিলেতের মেয়েরাই তোমাকে প্রাপ্তবয়স্ক করল—তাই তো?
আমি তখন তোমার জীবন থেকে অনেক দূরে।
আমি তখন ফুলতুলি গ্রামে বছর পাঁচেকের শিশু। আরও বছর পাঁচেক পরে তোমারই সঙ্গে আমার বিয়ে হবে!
ভাবো একবার! কী এক অসম্ভব অবাস্তব ঘটনা ঘটল বলো তো?
একদিকে তোমার জীবনে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন নতুন বউঠান কাদম্বরীদেবী।
অন্যদিকে তুমি শরীরে-মনে বড় হয়ে উঠছ বিলেতে, বিলিতি মেয়েদের সঙ্গসুখ পাচ্ছ, আন্নার মতো মারাঠি মেয়েও এসেছে তোমার জীবনে, কেউ তোমাকে বলছে আমার দস্তানা চুরি করলে আমাকে চুমু খাবার অধিকার পাবে তুমি, আর কেউ তোমার উপর অকাতরে বর্ষণ করছে মন অধিকারের গোলাগুলি—সেই সব ছেড়ে, কিংবা ছাড়তে বাধ্য হয়ে তুমি বিয়ে করলে আমাকে!
কেন, রবি ঠাকুর, কেন?
সেই ‘কেন’-র উত্তর আমাকে তুমি দাওনি। দিতে পারোনি।
অন্য কেউও দেয়নি।
তবে সেই ‘কেন’-র উত্তর ছড়িয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের নানা টিপ্পনিতে, আড়চোখের চাউনিতে, বিদ্রূপে, নানা কথাবার্তার চোরাস্রোতে।
যেমন করে ডুবুরি ডুব সাঁতার দিয়ে আহরণ করে সাগরতলার মণিমুক্তো, তেমনি করে আমিও পেয়েছি আমার গভীর ব্যথার নীলকান্তমণি—আমার সেই ‘কেন’র উত্তর।
০৩. নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
আমার ভাশুরদের মধ্যে সব থেকে সুন্দর কথা বলেন, কী গুণী, গান-বাজনা-লেখা, সবদিকে ওঁর প্রতিভা,—তিনি ওঁর নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
যা সুন্দর দেখতে!
ওঁর চেয়েও সুন্দর!
তবে দেখলেই মনে হয় ভারি দুঃখী।
সব সময়ে মন খারাপ করে থাকেন। তেমন মেশেন না কারও সঙ্গে।
শুনেছি এক সময়ে খুব মিশুকে ছিলেন।
আমোদ-আহ্লাদ-গান-বাজনা-থিয়েটার, এইসব নিয়ে থাকতেন।
স্ত্রীর আত্মহত্যার পর থেকে উনি অন্য মানুষ।
আমি বরাবর এই অন্য মানুষটাকেই দেখেছি।
আগে যেরকম ছিলেন, সেই মানুষটি সম্পর্কে কত কথা শুনেছি। তাঁকে তো দেখলুম না কোনওদিন।
আমার সঙ্গে তো একেবারেই মিশলেন না কোনওদিন। হয়তো আমাকে এ-বাড়ির অপয়া বউ ভাবেন। তেমন ভাবাই তো স্বাভাবিক। আমার বিয়ের দিনেই শিলাইদহে মারা গেলেন আমার বড় ননদ সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবামশায় বিয়েতে অনুপস্থিত থাকলেন। আর আমার বিয়ের ক’মাস পরেই তো নতুন বউঠান আত্মহত্যা করলেন।
বরাবর একটা কথা আমার মনে হয়েছে।
ছোট বড় মুখে কথা হবে, তাই কথাটা কাউকে বলতে পারিনি।
কথাটা হল, ওঁর নতুনদাদার যদি একটি সন্তান হত, ওঁর জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।
কেন সন্তান হল না?
সবাই দোষ চাপাল নতুন বউঠানের ঘাড়ে।
এ-ব্যাপারে মেয়েমানুষেরই যেন যত দোষ, বরাবর দেখেছি।
আমার ভাশুরেরও তো দোষ থাকতে পারত।
কে বলবে? সে কথা ভাবাও অন্যায়।
পরিবারের সবাই নতুন বউঠানের দিকেই ঢিল ছুড়লেন।
উনিও মনে-মনে নিজেকে বাঁজা ভেবে অপরাধী করে ফেললেন।
মনের কষ্ট কাকে জানাবেন?
কষ্ট জানাবার একটিই লোক সারা পরিবারে—
আমার স্বামী।
আমার বিয়ের পরে নতুন বউঠানের নিশ্চয় মনে হয়েছিল, একমাত্র বন্ধু, তাঁর প্রাণের রবি, সেও দূরে সরে গেল।
নতুন বউঠানকে দূর থেকে দেখতুম।
কাছে গিয়ে তাঁকে চেনবার জানবার সুযোগ আর হল কই?
আমিও এলাম রবি ঠাকুরের বউ হয়ে আর উনিও চলে গেলেন চিরদিনের জন্যে।
তা ছাড়া কাছে যাওয়ার সুযোগ হলেও দশ বছর বয়েসে মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে কতটুকুই বা বুঝতে পারতুম তাঁকে?
শুধু এইটুকু মনে আছে, আমাকে উনি এতটুকু ভালোবাসতেন না।
যদিও তাঁর প্রিয় দেওরের জন্যে বউ পছন্দ করার দলের মধ্যে উনিও ছিলেন।
উনি যেতে চাননি।
নিশ্চয়ই এই কাজটি করতে ওঁর নানা কারণেই ভালো না লেগে থাকতে পারে।
তবু গিয়েছিলেন।
যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বলেই মনে হয়। পিছনে ছিল বাবামশায়ের কড়া আদেশ। অনিচ্ছাসত্বেও গিয়েছিলেন বলেই হয়তো ধকল সহ্য করতে পারেননি।
খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
আমাকে নিশ্চয় প্রিয়তম পুরুষ রবির বউ হিসেবে ওঁর পছন্দও হয়নি।
ওঁর দেওরটির বিয়ে হয়ে যাক, এটাই তো উনি চাননি।
আমি যদি সুন্দরী হতুম?
বা নিদেনপক্ষে কিশোরী?
তাহলে নিশ্চয়ই আরও খারাপ লাগত ওঁর।
নেহাত বালিকা এবং রোগা ডিগডিগে এক্কেবারে হেলাফেলার যোগ্যা গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে—এই যা রক্ষে!
কোথায় পঁচিশ বছরের সুন্দরী, বিদুষী, রবি ঠাকুরের প্রাণের মানুষ নতুন বউঠান আর কোথায় আমি ন’বছর ন’মাসের একরত্তি গ্রাম্য বালিকা—কোনও তুলনা হয় নাকি?
আগেই বলেছি, আমার রবি ঠাকুরের বয়েস তখন তেইশ।
ছ’ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এক তরতাজা তরুণ, কী বলিষ্ঠ শরীর কী বলব!
আর নতুন বউঠান ছিপছিপে তরুণী। উনি যত ফরসা, নতুন বউঠান ততই শ্যামবর্ণ। কিন্তু কী যেন একটা কিছু নতুন বউঠানের ভিতরে ছিল, বিশেষ করে ওঁর চোখে, টেনে নেওয়ার শক্তি ছিল। উনি তো বলেন, নতুন বউঠানের চোখ উনি কখনও ভুলবেন না। একদিকে এইরকম এক বউদি, যাকে হাসলে ভারি সুন্দর দেখায়, যিনি তাকালে প্রাণে টান লাগে, যাকে দেখলেই অন্যদের থেকে অন্যরকম মনে হয়, আমার ভাষা নেই যে বোঝাই ঠিক কীরকম—আর একদিকে আমি বছর দশেকের ম্যাড়মেড়ে গ্রামের মেয়ে।
তবু আমিই রবি ঠাকুরের বউ!
আর নতুন বউঠান কেমন যেন ম্লান ছায়ার মতো একটা মানুষ—একদিন উনিই আমাকে বললেন, ছোটবউ, নতুন বউঠান কিন্তু একদমই এরকম ছিলেন না। ক’মাসের মধ্যে এরকম হয়ে গেছেন।
কীরকম ছিলেন উনি? জিগ্যেস করলুম আমার রবি ঠাকুরকে।
উনি বললেন, সে তুমি বুঝবে না। নাগপাশের মতো। যখন প্রথমবার বিলেত থেকে ফিরে এলুম, নতুন বউঠানের সঙ্গে দেখা হল, তখন তো মনে হয়েছিল, আবার আমার বাংলাদেশ, সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই দক্ষিণে বাতাস আর সেই নতুন বউঠান, মনে হল নাগপাশের দ্বারা জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে বসে থাকতে চাই, আর কিছু চাইনে।
কী সুন্দর কথা বলেন বলুন তো আমার রবি ঠাকুর। এরকম কথা আর কাউকে বলতে শুনিনি কখনও।
উনি কবি মানুষ। অনেক কিছুই কল্পনা করে নেন। যা ঘটে না তাও। যা অতি সাধারণ তার মধ্যেও অসাধারণ কিছু অনুভব করে গান লিখে ফেলতে পারেন।
এই যে উনি বললেন, নতুন বউঠান নাগপাশের মতো, বিলেত থেকে ফিরে উনি সেই নাগপাশে জড়িত বেষ্টিত হয়ে বসে রইলেন,“আমার মনে হচ্ছে এই সবই ওঁর কল্পনা।
নতুন বউঠান তো কোনওদিন আমার কাছেই আসেননি।
কখনও কাছে ডাকেননি।।
ভালোবেসে আদর করা, জড়িয়ে উড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা। আমাদের পাড়াতে দুপুরবেলা ডাক দিয়ে কত খেলনাওলা যেত, কৃষ্ণনগরের পুতুল, রান্নাবাটি হাঁড়িকুড়ি কতসব—একটা খেলনাও তো কিনে দিতে পারতেন নতুন বউঠান।
কোনওদিন দেননি।
আমার জন্যে বিয়ের পরেই অনেক খেলনা পাঠিয়েছিলেন বাবামশায়।
ছেলের বিয়েতে উনি আসেননি বটে। কিন্তু আমার জন্যে খেলনা পাঠাতে ভোলেননি। আমার বিয়ের তিন মাসের মধ্যে আমি নতুন বউঠানকে যতটুকু বুঝতে পেরেছিলুম, ওই বয়েসে কী-ই বা বোধবুদ্ধি আমার—তবুও যতটুকু বুঝেছি, মনে হয়েছে তিনি একেবারেই খোলামেলা মানুষ নন। কেমন যেন নিজের মধ্যে সিঁধিয়ে-যাওয়া মানুষ।
আমার পরে মনে হয়েছে—পরে মানে যখন আমি ছেলেপিলের মা হলুম, রীতিমতো সংসারী হয়ে উঠলুম, তখন বুঝতে পারলুম নতুন বউঠানের পায়ের তলায় কোনও মাটি ছিল না।
এই সংসারে কোনওদিন উনি হালে পানি পাননি।
যদিও সংসারের পুরুষমহলে ওঁর হঠাৎ বেশ কদর হয়েছিল।
সেটাও অনেকটাই অবিশ্যি আমার স্বামীর জন্যেই।
স্বয়ং রবি ঠাকুর ওঁকে কতগুলি বই পরপর উৎসর্গ করলেন।
আর কী ভাষায় সেইসব উৎসর্গ!
স্পষ্ট করে বলছেন না কিন্তু নতুন বউঠানকে দিলুম।
’প্রকৃতির প্রতিশোধ’ উনি উৎসর্গ করেছেন শুধু এইকথা লিখে ‘তোমাকে দিলাম।’
তারপর ‘শৈশবসংগীত’ বেরোল। উনি উৎসর্গ করলেন নতুন বউঠানকেই। লিখেছেন ‘তোমাকেই দিলাম।’
এসব আমি আগে কিছুই বুঝিনি।
এসব যে একটা ভাববার ব্যাপার, তাই মনে আসেনি কখনও।
অনেক পরে সব বুঝলাম। তখন তো নতুন বউঠান নেই।
কিন্তু নেই বলি কী করে?
‘ভানুসিংহের পদাবলী’ যখন বেরোল তখন তো নতুন বউঠান চলে গেছেন।
কিন্তু সেই বইও উৎসর্গ করলেন ওঁকেই। কী বললেন? বললেন, ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে তুমিই তো অনুরোধ করেছিলে। তোমার সেই অনুরোধ তখন পালন করিনি। আজ সেই বই ছাপিয়েছি।
কিন্তু তুমি আর দেখতে পেলে না।
ছ’বছর পরে ‘মানসী’ প্রকাশিত হল।
উনি উৎসর্গপত্রে লিখেছেন—তব করে দিনু তুলি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ। কার হাতে, স্পষ্ট করে বললেন না। আমার হাতেও তো হতে পারত।
‘মানসী’ যে বছর বেরোল সে-বছর আমাদের বিয়েরও সাত বছর হল।
কিন্তু তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ তিনি যাঁর হাতে তুলে দিলেন তিনি নতুন বউঠান—সবাই বুঝল আর আমি বুঝব না?
সাত বছর আগে নতুন বউঠান চলে গেছেন, তবু তিনিই তখনও আছেন ওঁর সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে।
আমি থেকেও নেই।
ঠিক মনে নেই, আরও বোধহয় বছর ছয়েক পরে ছাপা হল ওঁর বিখ্যাত কবিতার বই ‘চৈতালি’। আমি তখন ওঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের মা।
আমি জানতুম, আর যাকেই দিন, ‘চৈতালি’ উনি আমাকে দেবেন না। আমি তো তখন শুধু অমুকের আর অমুকের আর অমুকের মা। আর বাড়ির কাজের লোক।
কিন্তু ‘চৈতালি’ যেই হাতে এল, বইটি কাকে উনি উৎসর্গ করলেন সেটিই সবথেকে আগে জানতে চাইল আমার চোখ।
বলিহারি মেয়েমানুষের মন।
এ কীরকম উৎসর্গ?
উনি লিখেছেন, তব ওষ্ঠ দশনদংশনে টুটে যাক পূৰ্ণফলগুলি! প্রথমে আমি সত্যি বলছি কিছু বুঝতে পারিনি।
ভাবলুম, ওঁকেই জিগ্যেস করি।
তারপর মনে হল, কেউ তো ওঁকে কিছু জিগ্যেস করছে না। সবাই তো একেবারে চুপ।
তার মানে, সবাই বুঝছে আর বুঝেই চুপ করে আছে।
সবাই যা বুঝছে, আমিই বা বুঝব না কেন?
’দশনদংশন’ ছাড়া আর তো কোনও শক্ত কথা নেই। দশন মানে তো দাঁত, সে তো আমি জানি। আর দংশন হল কামড়।
তার মানে যাকে উৎসর্গ করা হল তার দাঁতের কামড়, এই তো?
কী হবে সেই দাঁতের কামড়ে?
ভেঙে যাবে রসে ভরতি ফলগুলি।
সেই রসে ভরতি ফলগুলিই কি নয় ‘চৈতালি’র কবিতা?
তখনই মনে এল, একদিন উনি আমাকে বলেছিলেন, নতুন বউঠানকে হাসলে ভারি সুন্দর দেখাত।
ওঁর দাঁতগুলি ভারি সুন্দর ছিল তো!
আমি উৎসর্গের এই কথাগুলির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেম। বুঝবার আর কিছু বাকি থাকল না আমার।
একসময়ে ঠাকুরবাড়িতে যে গানবাজনা, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, এই সব হত তার মাঝখানে ছিলেন আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনী। খুব দাপট ছিল তাঁর।
সব বদলে দিলেন ওঁর নতুন দাদার বন্ধু বিহারীলাল চক্রবর্তী।
উনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধু হিসেবে। এবং যাকে বলে, উড়ে এসে জুড়ে বসলেন।
বিহারীলাল ছিলেন খুব নামকরা কবি। নতুন বউঠান নাকি ওঁর কবিতা বিশেষ পছন্দ করতেন।
আর বিহারীলালও ক্রমে এ-বাড়িতে ঘনঘন আসতে শুরু করলেন নতুন বউঠানের জন্যেই।
নতুন বউঠানের উদ্দেশে কবিতা লিখতে লাগলেন। তাঁকে সেগুলি পড়ে শোনাতেন। শুনেছি, ভালোবাসার কবিতা।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো কবি যে-মেয়ের জন্যে কবিতা লেখেন, যে মেয়েকে সেইসব কবিতা পড়ে শোনাবার জন্যে আমাদের বাড়িতে আসেন, যে-মেয়ে ক্রমেই হয়ে ওঠে তাঁর প্রাণের মানুষ সেই মেয়ে ক্রমে এ-বাড়ির গানবাজনা, সাহিত্য, এসব নিয়ে আসরের প্রধান হয়ে তো উঠবেনই। আড়ালে সরে গেলেন জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি তো চলেই গেলেন এ-বাড়ি থেকে। আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলুম, নতুন বউঠানকে তিনি ঈর্ষা করতেন।
যাইহোক, আমার তো মনে হয় বিহারীলালের ভালোবাসাই নতুন বউঠানকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নায়িকা করে তুলল। তখন কোথায় আমার বর রবি ঠাকুর? তিনি তখন নিতান্ত নাবালক। বিহারীলাল ভালোবাসতেন নতুন বউঠানকে। আর নতুন বউঠান? শুনেছি, বিহারীলালের ভালোবাসার কবিতা শুনে খুশি হয়ে নতুন বউঠান তাঁকে রান্না করে নানারকম খাওয়াতেন। মাঝেমধ্যে উপহারও দিতেন। নিজের হাতে একটি আসন বুনে তিনি নাকি বিহারীলালকে দেন। তাতে আমার বরের খুব হিংসে হয়েছিল।
আর আমার বর খুব দুঃখ পেত যখন নতুন বউঠান ওকে বলতেন, ঠাকুরপো, তুমি কোনওদিন বিহারীলালের মতো ভালো কবিতা লিখতে পারবে না। ঠিক বললুম কি? দুঃখ হত, আবার অভিমানও হত আমার বরের নতুন বউঠানের মুখে একথা শুনে।
আপনাদের রবি ঠাকুর একদিন আমাকে কিঞ্চিৎ মজা করেই বললেন, জানো ছোটবউ, তখন আমার বছর পনেরো বয়েস, নতুন বউঠানের মুখে ক্রমাগত বিহারীলালের প্রশংসা শুনতে শুনতে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমি শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকটাই অনুবাদ করে নতুন বউঠানকে শোনাতে লাগলেম। কিন্তু তাতে নতুন বউঠান এতটুকু ইমপ্রেসড হয়েছিল বলে তো মনে হয় না। বিহারীলালের কবিতাতেই তিনি মুগ্ধ হয়ে থাকলেন।
কিন্তু ছোটবউ, ম্যাকবেথ অনুবাদ করতে-করতে আমার মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটল, বললেন আপনাদের রবি ঠাকুর।
কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। হয়তো ভাবলেন আমি বুঝতে পারব না। উনি আবার বলতে লাগলেন–
ম্যাকবেথ নাটকেই আছে ‘হেকাট’ নামের এক ডাইনির প্রসঙ্গ। আসলে কিন্তু ওর নাম ‘হেকেটি’। হেকেটি বা হেকাট শুধু শেক্সপিয়রের ডাকিনি নয়। সে এক গ্রিক দেবী যে থাকে এক রহস্যময় অন্ধকারে। সে আসলে অন্ধকারের দেবী। তাকে দেখা বা বোঝা যায় না। শুধু অনুভব করা যায় তার আকর্ষণ। আমার মনে পড়ল নতুন বউঠানকে। হেকেটির মতোই নিঃসঙ্গ, হেকেটির মতোই অন্তরালবাসিনী। আমি আমার কবিতার খাতা মালতী পুঁথি-র পাতায় প্রবল আবেগে লিখতে লাগলেম, বারবার, হেকেট ঠাকরুণ, হেকেট ঠাকরুণ। কিছুদিনের মধ্যে আমি নতুন বউঠানকে হেকেটি বউঠান বলে ডাকতেও লাগলাম। তারপর শুধু ‘হে’ বলে।
আমি ‘হে’ বলে ডাকলে সে মুখে সাড়া দিত না।
শুধু আড়চোখে মৃদু হেসে তাকাত।
সেই তাকানো আমি ভুলতে পারিনি।
নতুন বউঠানের মধ্যে একটা দুষ্টুমি ছিল প্রথম থেকেই। ভারি মিষ্টি দুষ্টুমি, বললেন আমার স্বামী। আর বললেন, নতুন বউঠান চুপিচুপি একদিন বললে, ‘হে’ নামটা যেন কেউ জানতে না পারে। তোমার দেওয়া এই নামটি যেন তোমার কাছেই থাকে ঠাকুরপো।
সেদিন এর চেয়ে বেশি কিছু বলেননি আপনাদের রবি ঠাকুর।
নতুন বউঠান সম্পর্কে আমি যা জেনেছি, সবই আমার শোনা কথা।
নানা মুখের নানা কথা ক্রমে আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধে একটা ছবি ফুটিয়ে তুলেছে।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে নতুন বউঠান সম্পর্কে নানা কথা চলত।
নতুন বউঠানকে অনেকেই আড়ালে ‘মক্ষীরানি’ বলতেন।
নিজের কানে শুনেছি সেকথা।
০৪. আমি যে লেখক নই
আমি যে লেখক নই এবং এই লেখাটার উপর যে আমার বিন্দুমাত্র হাত নেই, সেটা নিশ্চয় আপনারা এতক্ষণে বুঝে গেছেন। এবং অনেক আগেই হয়তো লেখাটা পড়াই বন্ধ করে দিয়েছেন।
আবার অনেকে হয়তো আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে কিংবা রবি ঠাকুর আর আমার ব্যক্তিগত জীবনের হাঁড়ি এই যে এইভাবে হাটে ভাঙছি আমি, সেই কারণেই লেখাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি।
যাঁরা এখনও আমার সঙ্গে আছেন, তা সে যে কারণেই হোক, তাঁদের জিগ্যেস করছি, মনে আছে কি আপনাদের এই লেখাতেই বেশ কিছু আগে আমি বলেছি, রবি ঠাকুর আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি!
প্রশ্নটা খুবই সহজ—কেন রবি ঠাকুর, কেন তুমি বিয়ে করলে আমাকে?
সেই ‘কেন’র উত্তর আমার বর আমাকে দেয়নি।
দিতে পারেনি।
আমি লিখেছিলুম, সেই ‘কেন’-র উত্তর উঁকিঝুঁকি মারছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের টিপ্পনিতে, আড়চোখের চাউনিতে, নানারকম বাঁকা কথার চোরাস্রোতে।
ডুবুরি যেমন খুঁজে পায় সমুদ্রের অনেক নীচের মণিমুক্তো, তেমনি করে আমি পেয়েছি আমার সেই ‘কেন’-র উত্তর।
এই ‘কেন’-র উত্তর লুকিয়ে আছে রবি ঠাকুরের জীবনের একান্ত গোপন এক কাহিনির মধ্যে।
সেই গল্প আমি একটু একটু করে জোগাড় করেছি।
এই গল্পের মধ্যেই আমার বর রবি ঠাকুরের আর এক পরিচয়। চাঁদের উলটো পিঠ। একটা কথা, আমি কিন্তু এ-গল্প আমার স্বামীর নিন্দে করার জন্যে লিখছি না।
যা ঘটেছে তা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।
কোনও অন্যায় নেই এই কাহিনির মধ্যে।
আর আমরা তিনজনেই এই ঘটনার শিকার—আমার বর, তার নতুন বউঠান আর আমি।
১৮৭৮ সালে আমার বরকে বিলেত যেতে হল। তখন তার বয়েস সতেরো।
উনিশ বছরের নতুন বউঠান পড়ে থাকলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে—অবহেলার মধ্যে।
কেউ তাঁর বন্ধু ছিল না এ-বাড়িতে। একমাত্র বন্ধু তাঁর দু-বছরের ছোট দেওর রবি ঠাকুর।
তাঁদের সম্পর্কটা কিন্তু শুধুমাত্র বউদি-দেওরের সম্পর্ক ছিল না। সতেরো বছরের রবি ঠাকুর, উনিশ বছরের কাদম্বরী, একজন কবি আর অন্যজন অসম্ভব একলা এক মেয়ে, যাঁকে কেউ ভালোবাসে না, সবাই যাঁকে বাজার সরকারের মেয়ে বলে নীচু চোখে দেখে আর যাঁর সঙ্গে স্বামী জ্যেতিরিন্দ্রনাথের সম্পর্কে তেমন কোনও মনের আঁট তৈরি হয়নি বলে আমার ধারণা।
সব মেয়েরই বুকের মধ্যে ভালোবাসার জন্যে একটা তীব্র তেষ্টা থাকে। আমার তেষ্টা থেকেই সেকথা আমি বুঝতে পেরেছি।
নতুন বউঠানের তো কোনও বাচ্চা হয়নি। মেয়েরা মা হলে অনেক অভাব পূর্ণ হয়ে যায়।
নতুন বউঠানের মনের ভিতরটা খাঁ-খাঁ করত। খুব দুঃখী ছিলেন তিনি। রবি ঠাকুরের ভালোবাসা নতুন বউঠানের মনের কষ্ট অনেকটাই জুড়িয়ে দিয়েছিল।
হঠাৎ যখন তাঁর অনেক ভালোবাসার দেওরটি বিলেতে চলে গেল, কী ভাবে দিন কেটেছিল তাঁর?
একবারও কি কেউ ভেবে দেখেছে সেকথা?
এমনকী সতেরো বছরের রবি ঠাকুরের কি সেকথা ভাববার সময় ছিল?
না, ছিল না। কিন্তু রবি ঠাকুরের কথায় পরে আসছি।
প্রথমে নতুন বউঠানের কথা।
১৮৬৮ সালে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বউ হয়ে এ-বাড়িতে আসেন। আর ১৮৭৮-এ, অর্থাৎ দশ বছর পরে তাঁর পরম বন্ধু, প্রিয়তম মানুষটি তাঁকে ছেড়ে চলে গেল সাতসমুদ্র পেরিয়ে এক অজানা দেশে। কবে সে ফিরবে, কেমন হয়ে ফিরবে, ফিরে আর নতুন বউঠানকে মনে ধরবে কি না, কিছুই তাঁর জানা নেই।
বাড়ির লোকজন সবাই তাঁকে হেয় করে। কেউ তাঁকে ভালোবাসে না। নতুন বউঠানের বুকের ভিতরটা কতখানি হু-হু করত সারাক্ষণ তাঁর প্রিয় মানুষটির জন্যে, তা আন্দাজ করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। একা ঘরে কত নিঃসঙ্গ কান্নাই না তিনি কেঁদেছেন তখন।
এই যে দশ বছর তিনি ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে দিনরাত অবহেলা আর চাপা অপমান সহ্য করেছেন, তার মধ্যে একমাত্র তাঁর ঠাকুরপোর মমতাই যেন নতুন বউঠানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
প্রথম ক’বছর তো খেলার সাথি। তারপর প্রিয় রবি যখন মাতৃহারা হল, সেই মাতৃহারা বালকটিকে স্নেহে-মায়ায়-মমতায় যে মেয়েটি ঘিরে থাকল, মায়ের অভাব বুঝতে দিল না, সেও তো বালিকাই তখন। কিন্তু তবু যেন রাতারাতি কত বড় হয়ে উঠল সেই মেয়ে—রবি ঠাকুরের নতুন বউঠান।
রবি ঠাকুরের বয়েস তখন বছর বারো। আর নতুন বউঠান চোদ্দো বছরের। বালিকা বলব? না কিশোরী?
আমার যে তাঁকে কিশোরী বলতেই ইচ্ছে হচ্ছে। রাধিকা তো ওই বয়েসেই রাইকিশোরী হয়ে উঠেছিল। আর আমি তো সে-বয়েসে মা হয়ে গেছি।
বারো বছরের রবি ঠাকুরের পৈতে হল। তার জন্যে কে বেঁধে দিল হবিষ্যি?
কে আবার, চোদ্দো বছরের সেই রাইকিশোরী।
আমার বর সেই হবিষ্যির স্বাদ এখনও ভুলতে পারেনি। যা সে বলেছে আমাকে, তার মতো করে তো আমি বলতে পারিনে—তার কথাগুলোই যতদূর মনে পড়ছে হুবহু লিখে দিলুম—
মনে পড়ে, বউঠাকরুণ হবিষ্যান্ন বেঁধে দিত, তাতে দিত সামান্য গাওয়া ঘি। ওই তিনদিন তার স্বাদে-গন্ধে মুগ্ধ হয়েছিলুম লোভীর মতো।।
আর একদিন আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে বললেন, বুঝলে ছোটবউ, ছেলেবেলায় আমি পান্তাভাত খেতে ভালোবাসতুম।
আর সেই পান্তার স্বাদে যেদিন যুক্ত হত নতুন বউঠানের আঙুলের স্পর্শ, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না।
শুধু কিন্তু হবিষ্যি আর পান্তার মধ্যেই আমার বরের মুগ্ধতা বন্দি হয়ে থাকল না।
তার মনের মধ্যে অন্য ঢেউ উঠল। একদিন আমার বর আর আমি একলা বেড়াতে বেরিয়েছি পদ্মার চরে।
বিকেলবেলা। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। সেদিকে তাকিয়ে আপনাদের রবি ঠাকুর বললেন, নতুন বউঠানের চোখ দুটো এমনভাবে আমার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে যে জ্বলজ্বল করতে থাকে, কিছুতেই ভুলতে পারি নে। যদি আঁকতে পারতুম তো বারবার তার চোখ দুটিকে আঁকতুম।
আসলে আমার বর তার নতুন বউঠানকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল খুব কাঁচা বয়েসে।
আর নতুন বউঠান?
বলতেই হবে সেকথা?
না, আমি বলতে চাইনে। আমি যদি লেখক হতুম বলতে পারতুম। যা বলা যায় না, বলতে নেই, তাও লেখকরা কেমন সুন্দর করে বলতে পারেন।
শুধু একটা কথা না বলে পারছি না—রবি ঠাকুর যখন সতেরো বছর বয়েসে হঠাৎ বিলেত চলে গেল, উনিশ বছরের নতুন বউঠান তখন কত যে কষ্ট পেয়েছিল, তা লিখে বোঝাতে পারব না।
আপনাদের রবি ঠাকুর কিন্তু অত কষ্ট পাননি। একথা আগেও বলেছিনা?
তিনি তো নতুন দেশে কত নতুন অভিজ্ঞতা আর মজার মধ্যে গেলেন। কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে কমবেশি ভালোবাসাও তো হল। তখন কি নতুন বউঠানের কথা তাঁর মনে পড়েছিল? কী করছে, কেমন করে দিন কাটছে নতুন বউঠানের জোড়াসাঁকোর অবহেলায় অপমানে?
আমাকে নতুন বউঠান সম্পর্কে কত সময়ে কত কথাই তো বলেছেন আপনাদের রবি ঠাকুর। কিন্তু কোনও কোনও কথা আবার বলেননি। বেশ বুঝতে পারতুম বলতে চাইছেন না।
তিনি যা বলেছেন আমাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি বলেননি। কতটা বলতে হয় আর কোথায় দাঁড়ি টানতে হয় তাঁর মতো আর কে জানে?
একদিন জিগ্যেস করেছিলুম—একদিনই শুধু—তুমি নতুন বউঠানকে বিলেত থেকে নিশ্চয় অনেক চিঠি লিখেছিলে। আর তিনি তো আমার মতো মুখ ছিলেন না যে তোমাকে চিঠি লিখতে ভয় পেতেন। একদিন দেখাবে তুমি আমাকে ওঁর লেখা একটা চিঠি?
আমার এ-প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর দিলেন না উনি। শুধু ওঁর ফরসা মুখটা আরও লাল হয়ে উঠল। কী জানি, হয়তো রেগে গেলেন আমি আলটপকা এভাবে কথা বলে ফেলেছি বলে। স্ত্রীর অধিকার তিনি আমাকে নিশ্চিত দিয়েছেন। কিন্তু এতটা নয়।।
দু-তিনদিন পরে উনি আমাকে বললেন, একটু মজা করেই বললেন বলে মনে হল, আসলে ওঁর মনের কথা যে ঠিক কী তা বুঝতে পারতুম না সব সময়ে, ওঁর মনের উপর অনেক ঢাকনা যে-কথা বলছিলুম, উনি বললেন, নতুন বউঠাকরুণকে লেখা আমার অনেক চিঠি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। যাকে লিখছি সে ঠিকই বুঝত, তাকেই এসব চিঠিতে আভাসে ইঙ্গিতে অনেক কথা বলছি—আর কেউ বুঝত না।
এখানে একটু যেন কী ভাবলেন আপনাদের রবি ঠাকুর। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, নতুন বউঠানকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলুম বিলেতের মেয়েদের কথা—সবার নাম জানাতাম, মিস ভিভিয়ান, মিস লং, মিস মুল আর অবশ্যই মিস লুসি স্কট। এইসব বিলিতি বিবিরা যে আমার আকর্ষণে সাড়া দিয়েছিল সেকথা নতুন বউঠানকে গর্বভরে জানাতে দ্বিধা করিনি। তবে নতুন বউঠান নিশ্চয়ই ভাবত, আমি যেরকম লাজুক আর মুখচোরা, বিলেতের তরুণীমহলে আমি কিছুতেই ভিড়তে পারব না। সেটা অবিশ্যি বউঠাকরুণের ধারণা। বিলেতের সব মেয়েদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা একরকম নয় ছোটবউ। মেয়েরা এমন বিচিত্র বলেই তো তাদের আকর্ষণের এতরকম রং। লুসিকে ভালোলাগত তার চাপল্যের মাধুর্যের জন্যে। ভিভিয়ান ছিল অস্পষ্ট, কেমন যেন ইশারাময়। মিস লং চাইত আমার সঙ্গে অরণ্যের নির্জনতায় যেতে। আর মিস মুল ভালোবাসত নাচতে-গাইতে। একটা কথা বলতে পারি, এদের সান্নিধ্যে আমার লজ্জা ভাঙল, দ্বিধা ঘুচল। একটি চিঠিতে মনে পড়ে, এসব কথা লিখেও ছিলুম নতুন বউঠাকরুণকে।
বিলেতের তরুণীমহলে যখন আমার বরের প্রতিষ্ঠার কানাঘুষো এসে পৌঁছোচ্ছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, তখন সেই বাড়িতেই কেমন ছিলেন নতুন বউঠান? কী নিয়ে কীভাবে কাটছিল তাঁর দিনরাত?
নতুন বউঠানের বয়েস তখন কুড়ি ছুঁইছুঁই। তাঁর প্রাণের মানুষটি বিলেত চলে যাবার পর তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে একলা মানুষ। এবং এই অপবাদের অপমান তাঁকে বয়ে চলতে হচ্ছিল যে তিনি বাঁজা। তাঁর কোনওদিন বাচ্চা হবে না। ঠাকুরবাড়ির মহিলামহলে তিনি ছিলেন সবচেয়ে অপমানিত। একে বাজার সরকারের মেয়ে, তায় সন্তান ধারণে অক্ষম, তায় আবার গায়ের রং কালো কোথায় লেখাপড়া জানা মাজাঘষা ঝকঝকে জ্ঞানদানন্দিনী যিনিও তখন বিলেতে, আর কোথায় ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে—এ-মেয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী! বিয়েটাকেই তো অনেকে অচল বলে ধরে নিয়েছিলেন। মাথা নিচু করে এই অচল বিয়ের অপবাদ মেনে নেওয়া ছাড়া নতুন বউঠানের কোনও উপায় ছিল না।
তিনি একটি জিনিস মনেপ্রাণে চাইছিলেন—কেউ তাঁকেও ভালোবাসুক। সেই ভালোবাসা তিনি পেলেন ছোট্ট ঊর্মিলার কাছ থেকে।
কে এই ছোট্ট মেয়ে যাকে বুকে করে বেঁচে থাকতে চাইলেন নতুন বউঠান?
উর্মিলা হল আমার বরের ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে।
নিঃসন্তান নতুন বউঠান বুকে টেনে নিলেন এই মেয়েটিকে।
ঊর্মিলার কাছ থেকে তিনি পেলেন একটি শিশুর নিখাদ ভালোবাসা। নতুন বউঠানই এই শিশুকে দেখতেন শুনতেন খাওয়াতেন পরাতেন। নতুন বউঠানের ঘর ছিল বাইরে, তেতলার ছাদে। বাড়ির অন্দরমহলের বাইরে থাকতেই হয়তো তিনি আরাম পেয়েছিলেন।
শুনেছি ওই ছাদের ঘরে একাই থাকতেন তিনি উর্মিলাকে নিয়ে। যেন তাঁরই মেয়ে ঊর্মিলা।
বাড়ির অন্দরমহলের সঙ্গে মা-মেয়ের তেমন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এই সুখ সইল না নতুন বউঠানের ভাগ্যে।
তেতলার ছাদের ওই ঘরের পাশেই ছিল নীচে যাওয়ার লোহার সিঁড়ি।
নতুন বউঠানের চোখের আড়ালে ছোট্ট উর্মিলা একাই নামতে গেল সেই সিঁড়ি দিয়ে।
শীতের সন্ধে। জায়গাটা অন্ধকার।
উর্মিলার পা গেল ফস্কে। লোহার সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে সে পড়ে গেল নীচে।
মাথায় আঘাত লেগে অজ্ঞান হয়ে গেল।
আর জ্ঞান ফিরল না উর্মিলার।
এই ঘটনার পরে যা হওয়ার তাই হল। একে বাঁজা তায় অপয়া, অলক্ষ্মী—ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে একঘরে হয়ে গেলেন নতুন বউঠান। তার মুখ দেখলেও অকল্যাণ হয়—এমন রটনাও শোনা গেল ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে।
একদিন শান্তিনিকেতনে আপনাদের রবি ঠাকুরের মুখেই শুনেছিলুম এই ঘটনার পরে নতুন বউঠান কেমন ছিলেন, সেই কথা।
কী গভীর গম্ভীরভাবে বলেছিলেন তিনি কথাগুলি। ওঁর মুখের কথা, যতটুকু মনে আছে, এইখানে লিখে দিলুম—এই ঘটনার পর নতুন বউঠান আরও নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। কারও সঙ্গে আর তেমন মিশত না। বিলেত থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই এক নতুন ভাবে বউঠাকরুণকে আবিষ্কার করলেম।।
এই মেয়ে যেন তার সমস্ত ঘরকন্না, সমস্ত কর্তব্যের তলায় একটা সুড়ঙ্গ কেটে সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে একটি গোপন শোকের মন্দির তৈরি করে তারই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে— সেখানে তার স্বামী বা কারও কোনও অধিকার নেই।
উনি দেড় বছর পর বিলেত থেকে ফিরলেন।
যে নতুন বউঠানকে উনি ফেলে গিয়েছিলেন আর যাঁর কাছে ফিরে এলেন উনি, তাঁরা কি একই মানুষ?
তা কি হতে পারে?
দেড় বছর যে অনেক সময়।
আমার তো মনে হয় অনেক ব্যথা, অভিমান, অপমান, একাকিত্ব আর ভালোবাসা নিয়ে নতুন বউঠান পথ চেয়ে বসেছিলেন ওঁরই জন্য। নতুন বউঠান যে নিজের মধ্যে আরও ঢুকে গেছেন, তাঁর ভেতরটা যে এখন নির্জন শোকের মন্দির—একথা ঠাকুরবাড়ির আর কেউ না বুঝুক, উনি বিলেত থেকে ফিরেই বুঝতে পেরেছিলেন। কী করে নতুন বউঠানকে বের করে আনা যায় সেই শোকের মন্দির থেকে? তাঁর মনের অন্দরমহলে, যেখানে তাঁর স্বামীরও অধিকার নেই, কেমন করে প্রবেশ করা যায় সেখানে? পারবেন কি আপনাদের উনিশ বছরের রবি ঠাকুর তাঁর একুশ বছরের নতুন বউঠানের মনের গোপন অন্ধকারে অধিকারের আসনটি পাততে?
নতুন বউঠান তাঁর রবির সঙ্গে পুনর্মিলনের অপেক্ষাতেই তো দিন গুনছিলেন। বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর কাছে বসেই তো রবি লিখত, পড়ত।
বিলেতের বিবিরা তাকে বদলে দেয়নি তো?
নতুন বউঠানকে আর কি সে আগের মতো ভালোবাসবে?
এই ভয়, অনিশ্চয়তা তো নতুন বউঠানের মনে ছিলই। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন বউঠানের মনের মেঘ কেটে গেল।
বিলেত থেকে ফিরেই নতুন বউঠানের তেতলার ছাদের ঘরের সামনে বাগান করতে শুরু করলেন তাঁর প্রিয় ঠাকুরপো।
সেই বাগান তৈরির গল্প উনি একদিন আমাকে শুনিয়েছিলেন শিলাইদহে।
সে এক বর্ষার সন্ধে।
তোড়ে নামল বৃষ্টি। উনি বসেছিলেন শোবার ঘরে জানলার পাশটিতে। কুঠিবাড়ির সামনে ধু-ধু পদ্মার চর।
জানলার পাশটিতে বসে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পাশে পাথরের টেবিলে জ্বলছে একটি শামাদান।
সেই আলোয় ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে ওঁকে।
আমি সেইদিকে তাকিয়ে বসে আছি কাছেই খাটের উপর।
উনি বললেন, বিলেত থেকে ফিরে নতুন বউঠানের সঙ্গে বাগান করতে শুরু করলেন।
এই কাজটি করতে বউঠাকরুণ খুব উৎসাহ পেল। নিজের মধ্যে যে শোকের মন্দিরটি সে তৈরি করে তারই ভিতর নিঃসঙ্গ নির্বাসনে দিন কাটাচ্ছিল, সেখান থেকে আমার সঙ্গে বাগান তৈরির কাজ তাকে বের করে আনল। লতা-পাতা-ফুল-ফল-পাখির ডাক ছাড়া এই কাজটি সম্ভব হত না।
আমি ওঁর কথা শুনে হঠাৎ বলে ফেললুম ওসব ডাকের কোনও মানেই হত না তোমার ভালোবাসার ডাক না থাকলে।
উনি খুব ধীরে-ধীরে বললেন, খুব ভালোবাসতেম নতুন বউঠানকে, বউঠাকরুণও আমাকে খুব ভালোবাসত।
তারপর আরও কথা বললেন উনি—ওই একবারই—আর কখনও বলেননি।
বললেন, সেইসব দিনগুলির কথা খুব মনে পড়ছে। সেই সুন্দর দিনগুলোকে যদি সোনার খাঁচায় বন্দি করে রাখতে পারতেম! বিলেত থেকে ফিরেই নতুন বউঠানের চোখের দিকে তাকিয়ে একটি কথা আমি বুঝতে পেরেছিলেম—নতুন বউঠান কোনওদিন মুখ ফুটে বলেনি, আমি কিন্তু অনুভব করেছিলেম বউঠান এক অসহায় একাকিত্ব এবং ঠাকুরবাড়ির নানা তির্যক অপমান থেকে একটা মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। আর তার ভিতরটা ছটফট করছে।
ছোটবউ, আমি ছাড়া ঠাকুরবাড়িতে আর কেউ ছিল না যে নতুন বউঠানের মনের খোঁজ রাখত। এই কথাটা আমি বিলেত থেকে ফেরার পরেই প্রথম সঠিকভাবে উপলব্ধি করলেম।
নতুন বউঠান আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাগান তৈরি করল।
আমি বললেম, বউঠান বাগান তো ফুলে-ফলে-লতায়-পাতায় ভরে উঠেছে। এবার তুমি বাগানের একটা নাম দাও।
নতুন বউঠান একটুও না ভেবে বলল, ঠাকুরপো, তুমি থাকতে আমি দেব নাম?
আমিও একটুও না ভেবে বললাম, নন্দনকানন।
বউঠানের নামটি ভারি পছন্দ হল। আমরা তখন শরৎকালের এক বিকেলবেলায় বাগানের মাঝখানটিতে দাঁড়িয়ে।
বউঠান মুখে কিছু বলল না। শুধু একবার তাকাল আমার চোখের পানে।
সেই দৃষ্টি মনে থাকবে চিরকাল। আর…
আর কী? প্রশ্ন করে ফেললুম ওঁর কথার মাঝখানে।
উনি বললেন, কী আর? বললেম বউঠান, আমাদের এই বাগানে রূপকথার রাজকন্যার মতো তোমাকে নিজের হাতে গাছে জল দিতে হবে।
নতুন বউঠান আমার হাতে হাত রেখে বলল, ওই পশ্চিমের কোণটাতে একটা কুঁড়ে তৈরি করে দিও, হরিণের বাচ্চা থাকবে।
আমি বললেম, আর একটি প্রস্তাব আছে বউঠান।
বউঠান প্রশ্ন না করে একটু হাসল।
আমি বললেম, যেন সেই হাসির উত্তরে, আর একটি ছোটখাটো ঝিল থাকবে, তাতে দু-চারটি হাঁস চরবে।
বউঠানের সে কী উৎসাহ, বললে শুধু ঝিল আর হাঁস হলে চলবে না ঠাকুরপো। ঝিলের মধ্যে তুমি-আমি দুজনে ফুটিয়ে তুলব নীলপদ্ম। আমার অনেক দিন থেকে নীলপদ্ম দেখবার সাধ আছে।
আমি বললেম, বেশ তো বউঠান, সেই নীলপদ্মের ঝিলের উপর একটি সাঁকো বেঁধে দেওয়া যাবে আর ঘাটে থাকবে ছোট্ট একটি ডিঙি। আমার কথা শোনামাত্র বউঠান বললে, ঘাট অবশ্য সাদা মার্বেলের হবে।
গল্পটা এই পর্যন্ত বলে আপনাদের রবি ঠাকুর অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
বাইরে বৃষ্টিও তখন প্রায় ধরে এসেছে।
আমি ভাবলুম, এই একান্ত ব্যক্তিগত কাহিনি উনি আর বেশিদূর আমাকে বলতে চান না।
আমি খাট থেকে নেমে টেবিলে শেজের আলোটা একটু উস্কে দিলুম। আর উনি তখুনি বললেন, কোনও একদিন একটা গল্প লিখব যেখানে বউঠান আর আমার এই বাগান করার ব্যাপারটা থাকবে।
–কী নাম দেবে সেই গল্পের?
–নষ্টনীড়।
–নষ্টনীড়? বাগান নিয়ে গল্প, তার নাম নষ্টনীড়? আমি তো অবাক।
—সে তুমি বুঝবে না ছোটবউ। গল্পটা তো বাগান নিয়ে হবে না। বাগানটা থাকবে, কিন্তু গল্পটা হবে এক নারীর গল্প, যে-নারী চারদিক থেকে আক্রান্ত। তার জন্যে এ-পৃথিবীতে এমন স্থান নেই যেখানে সমস্ত হৃদয় উদঘাটিত করে দিয়ে সে হাহাকার করে উঠতে পারে—বাগানটা তার হৃদয়ের মধ্যেই একটু-একটু করে মরে গেল।
—সেই মেয়েটির স্বামী—তিনিও কি বোঝেন না মেয়েটির মনের কষ্ট?
—তার স্বামীর মনের কথা দিয়েই শেষ হবে আমার সেই গল্প।
–কী তার স্বামীর মনের কথা? আমি প্রশ্ন না করে পারলুম না। কেন জানি না আমার সারা বুক জুড়ে তখন ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র এক যন্ত্রণা। আর ভয় করছে। কীসের ভয়!
রবি ঠাকুর বললেন, ধরো আমার সেই গল্পের একেবারে শেষে নিঃশব্দে স্বামীটি ভাবছে— আমি কোথায় পালাব? যে স্ত্রী হৃদয়ের মধ্যে নিয়ত অন্যকে ধ্যান করে, নির্জন বন্ধুহীন প্রবাসে তাকে সঙ্গদান করব কী করে? যে-স্ত্রীর অন্তরের মধ্যে অন্য পুরুষের ভাবনা, তাকে বুকের কাছে ধরে রাখার যন্ত্রণা কতদিন সহ্য করতে পারব? যে-আশ্রয় চূর্ণ হয়ে গেছে তার ভাঙা ইটকাঠগুলো আমাকেই বাকি জীবন কাঁধে করে বয়ে বেড়াতে হবে?
রবি ঠাকুর আবার চুপ করলেন।
আমি হঠাৎ বুঝলাম, পায়ের তলায় কোনও মাটি নেই আমার। আমার বুক ঘামে ভিজে যাচ্ছে।
জানলার ধারে চুপ করে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বিলেত থেকে আমার বর ফিরে এল। নতুন বউঠান তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। এ যেন ছেলেবেলার বন্ধু, খেলার সাথীকে নতুন করে পাওয়া।
গল্পটা কিন্তু আরও অনেক দূর গড়াল।
আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে সবটা বলেননি। যা বলেছেন তার মধ্যেও অনেক আড়াল আছে।
আমি একটু একটু করে সেই আড়াল সরাবার চেষ্টা করেছি।
কেন করেছি?
হয়তো আরও ব্যথা পেতে ভালোলেগেছে, তাই।
স্বামীর জীবনে তার জায়গা ঠিক কোথায়, সেইটুকু অন্তত জানতে কোন স্ত্রীর না ইচ্ছে করে?
আড়াল সরিয়ে আমি সত্যিটা জানতে চেয়েছি সেই কারণেও।
আর একটা কারণ আছে।
রবি ঠাকুর কেন আমাকে বিয়ে করলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতেও আমার এই আড়াল সরিয়ে-সরিয়ে সন্ধান। একটা কথা বলি, যত আমি এগিয়েছি সত্যের দিকে, ততই আমি আমার স্বামীকে আমার মতো করে ভালোবেসেছি, আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁকে ভালোবেসেছি আমার জীবনে দুঃখদানের দেবতা হিসেবে। আর বেদনাও পেয়েছি ততই বেশি।
আমার ভিতরটা বরফ হয়ে গেছে। আমার বরের বয়েস তখন একুশ। নতুন বউঠান তেইশ। শোনা কথা, গুজব, উড়ো গল্প থেকে আমি বুঝতে পাচ্ছিলুম আস্তে আস্তে যে আমার বর আর তার নতুন বউঠানের সম্পর্কটা হয়ে উঠল খুব গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক।
আমি আপনাদের রবি ঠাকুরের সঙ্গে এত বছর ঘর করলুম, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের (না কি ছয় বলব?) মা হলুম,—তাঁকে আমি যতটুকু বুঝেছি, তিনি আর কোনও মেয়েকে নতুন বউঠানের মতো ভালোবাসেননি। আমার বর বিলেত থেকে ফিরে আসার পর ঠিক কী হয়েছিল?
এক কথায়, ঠাকুরবাড়িতে নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছিল।
রবি ঠাকুর কবিতায়, গানে, সাহিত্যচর্চায় ভরিয়ে দিলেন, ভাসিয়ে দিলেন।
সেই জোয়ার নতুন বউঠানকে ভাসিয়ে নিয়ে এল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির একেবারে মাঝখানে।
আর যিনি ছিলেন মাঝখানে, জ্ঞানদানন্দিনী, তিনি ভেসে চলে গেলেন দূরে।
সব আলো এসে পড়ল কাদম্বরীদেবীর মুখে।
আমার বর গান লেখে, সুর দেয়, কবিতা লেখে—সবই তারই জন্যে। আর নতুন বউঠান টিপ্পনি কেটে বলেন, যতই লেখো না কেন, বিহারীলালের মতো লেখা তোমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমার বর তখন তার নতুন বউঠানের মন পাওয়ার জন্যে বিহারীলালের অনুকরণ করেও লিখেছে।
তার কাছ থেকে জেনেছি সেই গল্প—
বউঠাকরুণের ব্যবহার ছিল উলটো। আমি যে সত্যি-সত্যি কোনওকালে কিঞ্চিৎ লিখতে টিখতে সক্ষম হব এ সে কিছুতেই যেন মানতে পারত না। কেবল খোঁটা দিত আর বলত, ঠাকুরপো, বিহারী চক্রবর্তীর মতো লেখার চেষ্টা করছ, বটে, কিন্তু সে তুমি পারবে না। একথা বলবার পরেই নতুন বউঠান আড়চোখে হাসত। ভারি দুষ্টুমিভরা সেই হাসি।
আমার বর বোধহয় ক্রমেই বুঝতে পেরেছিল, এইভাবেই তার নতুন বউঠান তাকে আরও ভালো লেখার উৎসাহ দিচ্ছেন।
নতুন বউঠানই ছিলেন তাঁর লেখার প্রধান প্রেরণা। প্রিয় ঠাকুরপোটি দুপুরবেলা নতুন বউঠানের পাশে শুয়ে তার লেখা পড়ে শোনাত। আর হাতপাখা নেড়ে বাতাস করতেন নতুন। বউঠান।
সে-গল্প যে কতবার শুনেছি আমার বরের মুখে।
এই গল্প শোনাতে তার ভালোলাগে, নতুন বউঠানকে যেন চোখের সামনে দেখতে পায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ছোটবউ, দুপুরবেলা জ্যোতিদাদা নীচের তলায় কাছারিতে চলে গেল।
বউঠাকরুণ ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে-কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিচ্ছে। নিজের হাতে তৈরি মিষ্টি—তাও সে কিছু দিয়ে দিচ্ছে সঙ্গে। কী সুন্দর করে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে নতুন বউঠান। সঙ্গে পাঠাচ্ছে ডাবের জল কিংবা বরফে ঠান্ডা করা তালশাঁস। সমস্তটার উপর রেশমের রুমাল বিছিয়ে মোরাদাবাদি খুনচেতে করে জলখাবার পাঠিয়ে দিত নতুন বউঠান রোজ দুপুরবেলা জ্যোতিদাদার জন্যে। তার মনটা ভালোবাসায় ভরা ছিল। সেই সহজ সরল ভালোবাসাকে ভালোবাসার মতো মানুষ নতুন বউঠান পায়নি। এইটে ছিল নতুন বউঠানের সবচেয়ে ব্যথার জায়গা ছোটবউ।
একটা কথা এখানে না বলে পারছিনা।
আমার তো মনে হয় ওঁর নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ক্রমে বুঝতে পারছিলেন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে প্রিয় দেওরটি প্রেমে পড়েছে। আর স্ত্রীও যে ভালোবাসার মতো একটি মানুষ পেয়েছেন এই সংসারে, সে-বিষয়েও আমার মনে হয় কোনও সন্দেহ ছিল না জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে।
এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি হয়তো ভিতরে ভিতরে কষ্ট পেয়েছেন, তবু আমার বর আর ওঁর স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কটা আরও গভীর, আরও ঘনিষ্ঠ করে দেওয়ার পিছনেও তিনি।
তিনি সব দেখছিলেন, সব বুঝছিলেন। তবু এমন নাটক লিখলেন যাতে উর্বশীর ভূমিকার অভিনয় করলেন নতুন বউঠান আর মদনের ভূমিকায় আপনাদের রবি ঠাকুর। এ তো আগুনে ঘি ঢালা।
এখানেই থেমে থাকেননি এই অদ্ভুত মানুষটি। তিনি লিখলেন আর এক নাটক ‘অলীকবাবু।’ সেই নাটকের নায়ক আমার বর, নায়িকা নতুন বউঠান। দুপুরবেলা খাটে শুয়ে-শুয়ে এই নাটকের মহড়া দিতেন নতুন বউঠান তাঁর ঠাকুরপোর সঙ্গে।
অলীকবাবু আমি পড়েছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে এই কথাগুলো তাঁর প্রিয় ঠাকুরপোকে বলিয়েছেন—আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্রসূর্যকে সাক্ষী করে মুক্তকণ্ঠে বলব, লক্ষবার বলব, তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলব, সহস্রবার বলব, লক্ষবার বলব, আমিই তোমার স্ত্রী।
আমি যতবার পড়েছি লাইনগুলো আমার বুক কেঁপে উঠেছে। ভাগ্যিস আমার বিয়ের অনেক আগে এই অভিনয় হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে।
আমার সামনে হলে আমি সহ্য করতে পারতুম না।
খুব কষ্ট হত আমার। তবে এখন আর হয় না। এখন মনে মরচে পড়ে গেছে।
আমি তো লাইনগুলো শুধু পড়েছি।
তবু মনে হয়েছে, এসব নতুন বউঠানের মনের কথা। আমার বরেরও নিশ্চয় ভালোলেগেছিল তার সবচেয়ে ভালোবাসার মেয়েটির মুখে এই কথাগুলি। হতে পারে অভিনয়। সে তো শুধু আপাতভাবে।
এ তো একেবারে ভেতরের কথা।
যে বলছে, তার কাছে।
যাকে বলছে, তার কাছেও।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সব জেনেও কী করে ঘটালেন এমন ঘটনা?
তিনি কি ভালোবাসতে পারেননি তাঁর স্ত্রীকে? এতটুকুও? তাই তিনি চাইছিলেন অন্য কেউ তাঁকে ভালোবাসুক?
এ-প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না কোনওদিন।
শুধু এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আমার স্বামীর জীবনে যদি নতুন বউঠানের মতো কেউ না আসতেন, তাহলে তিনি আজ যা হয়েছেন এবং পরে হয়তো যা হতে চলেছেন, তা তিনি হতে পারতেন না।
রবি ঠাকুরের জীবনে আমি তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলেমেয়ের মা, তাঁর সংসারে কাজের লোক।
নতুন বউঠান তো তাঁর ভালোবাসার মানুষ। তাঁর প্রেরণা। এইটুকু বুঝে মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়?
০৫. রবি ঠাকুরের মন
আমার রবি ঠাকুরের মন ঠিক শরৎকালের আকাশের মতো।
এই মেঘ। এই রোদ্দু।
এই হালকা। এই গম্ভীর।
সেদিন আমরা ছিলেম জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ও বসেছিল দক্ষিণের বারান্দায়, আরাম কেদারায়। আমি বসেছিলেম মেঝেতে, ওর পায়ের কাছে। আমি তখন ক’মাসের পোয়াতি। ও বেশ হালকা মেজাজেই। সারাদিন লেখার মধ্যে ডুবে কেটেছে।
বিকেলবেলা কী মনে হয়েছে, বারান্দায় এসে বসে বলল, ছোটবউ, ওই যে তুমি একটা গজার মতো মিষ্টি তৈরি করো, ভারি ভালোলাগে আমার, কী যেন নাম ওটার?
আমি বললেম, এলোঝেলো। কবে খেতে চাও বলো, করে দেব।
আমার বর বলল, এলোঝেলো! অমন সুন্দর মিষ্টির এমন বিশ্রী নাম?
আমি বললেম, তুমি একটা জুতসই নাম দাও, এবার থেকে এলোঝেলোকে ওই নামেই ডাকব তাহলে।
রবি ঠাকুর তৎক্ষণাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বললে, ‘পরিবন্ধ।’
কোথায় এলোঝেলো। কোথায় ‘পরিবন্ধ’। ’পরিবন্ধ’ মানে কী? উনি একটু হেসে বললেন নতুন বউঠানকে একদিন বলেছিলেম, সে যখন চুলবেঁধে এসে দাঁড়াল, তখন বলেছিলেম বেঁধেছ কবরী তুমি নানা পরিবন্ধে—পরিবন্ধ মানে বৈচিত্র্যের বাঁধুনি, যেমন তোমার এলোঝেলো—কত রকমের গজার মিশ্রণ!
মোটেই পছন্দ হয়নি আমার নামটা। কিন্তু স্বয়ং রবি ঠাকুর নাম দিয়েছে—চুপ করে মেনে নিলেম।
শুধু রান্নার নাম নয়, রান্না নিয়েও অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসে আমার বর।
যশোরের মেয়ে আমি। যশোরের বেশ নামডাক আছে নিরামিষ রান্নার জন্যে। আমি নানারকম নিরামিষ রান্না জানি।
আমার ঢাকাই রান্না শেখারও খুব শখ। কেউ আমাকে ঢাকার রান্না শেখালে আমি তাকে যশোরের রান্না শিখিয়ে দিই।
আমার বর আমার হাতের নিরামিষ রান্নার তারিফ করেছে। বলেছেন, এই একটি ব্যাপারে আমি নাকি অদ্বিতীয়।
বিশেষ করে আমার হাতে তৈরি মিষ্টি খেতে ও বড় ভালোবাসে।
এইখানে আমি জিতেছি। নতুন বউঠান নাকি খুব ভালো মিষ্টি বানাতেন।
আমার বর বলেছে, আমি তাঁর চেয়েও ভালো এই ব্যাপারে।
শান্তিনিকেতনে নিজেদের বাসের জন্য আলাদা বাড়ি তখন ছিল না।
আমরা থাকতেম আশ্রমের অতিথিশালার দোতলায়। রান্নাবাড়িটা ছিল দূরে।
রবি ঠাকুর বললে, পৃথক কোনও রান্নঘর নেই, ওই বাইরের বারান্দার এক কোণে উনুন পেতে তুমি রান্না করবে।
আমি তাই করতেম। ছুটির দিনে আমি নানারকম মিষ্টি তৈরি করতুম। তারপর সেগুলিকে একটা জালের আলমারিতে রেখে দিতুম। রথী জালের আলমারি চুপিচুপি খুলে মিষ্টি খেত। আমি আড়াল থেকে দেখে ভারি মজা পেতুম।
একদিন আপনাদের রবি ঠাকুর মজা করে বললে, ছোটবউ তোমার জালের আলমারিটি দেখছি মিষ্টান্নের অক্ষয় ভাণ্ডার—লোভনীয় জিনিসে সদাই ভরতি। দেখেছি রথী তার সহপাঠীদের নিয়ে এসে তোমার ওই মিষ্টির ভাণ্ডার প্রায়ই লুট করে।
এই মিষ্টির ভাণ্ডারের পিছনে আমার বরের নানারকম চাহিদার দানও কিছু কম নয়।
কতরকমের নতুন-নতুন মিষ্টির জন্যে তার আবদার। আমাকে সেইসব আবদার মেটাতে হয়।
একদিন রান্না করছি, হঠাৎ চৌকিটা টেনে পিছনে বসে বললে, মানকচুর জিলিপি করে খাওয়াও তো দেখি। ঠিক-ঠিক করতে পারলে ভালোই হবে। আর বাঙালিরা ঘরে ঘরে তোমার জয়গান করবে।
মানকচুর জিলিপি! কী পাগলের মতো বলছ বলো তো? তোমার এই আবদার আমি রাখতে পারব না।
আবদার নয় ছোটবউ, বলতে পারো ফরমাশ। তোমাকে করতেই হবে মানকচুর জিলিপি। দেখলাম, রবি ঠাকুরের মুখে মৃদু হাসি।
সেই হাসি আমাকে উৎসাহ দিল। সত্যিই সারা দুপুর ধরে তৈরি করলেম মানকচুর জিলিপি।
রথী, খেয়ে দ্যাখ তো কেমন হয়েছে। ওকে দেওয়ার আগে ছেলেকেই দিলুম।
রথী বলল, মা, তুমি যে সাধারণ জিলিপি করো, তার চেয়েও ভালো।
সন্ধেবেলা আপনাদের রবি ঠাকুর কী যেন লিখছেন। একেবারে মগ্ন হয়ে আছেন। আমি লেখার সময় ওকে বিরক্ত করি না। ডাকলেও অনেক সময় সাড়া পাওয়া যায় না। লেখার ঝোঁক চাপলে ও খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দেয়।
আমি প্রথম প্রথম রাগারাগি করতেম। কোনও ফল হয় না। এখন আর রাগারাগি করি না। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। ’ভারতী’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরিয়ে গেছে, পরের মাস থেকে সেই কাগজে রবি ঠাকুরের লেখা নিয়মিত বেরোবে। এদিকে আমার বরকে বলাই হয়নি এমন একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপন বেরোবার পর সে জানল। এবার কী হবে?
রবি ঠাকুর তো লিখতে বসে গেল। খাওয়াদাওয়া ভুলে দিনরাত একটানা লিখে চলেছে। আমার হল বিপদ। মানুষটাকে খাওয়াব কী করে? আমার সাহসই হচ্ছে না ওকে খাওয়ার কথা বলতে। বলেই দিয়েছে আমি লিখতে যাচ্ছি, খাওয়ার জন্যে আমাকে ডাকাডাকি কোরো না। খেতে গেলে নাকি সময় নষ্ট হয়। তা ছাড়া, খাওয়ার পরে পরিশ্রম করার ক্ষমতাও নাকি কমে যায়, বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে।
লেখকদের যতদূর সম্ভব না খেয়ে থাকাই ভালো—এইটেই মনে হয় আপনাদের রবি ঠাকুরের মত।
দিনের পর দিন না খেয়েই কাটাচ্ছে আমার বর। বেশ বুঝতে পারছি, ও অসুস্থ হয়ে পড়ল বলে। ও যখন এইভাবে একটানা লেখে, কেমন যেন পাগল-পাগল হয়ে যায়। তখন মনে হয়, ও আমাদের কেউ নয়। ও আমাদের কথা বুঝবে না।
আমি শুধু ওর লেখার টেবিলে কখনও একটু ফলের রস, কখনও শরবত দিয়ে আসছি— ব্যস। সবই নীরবে। ওর সঙ্গে আমার দিনের পর দিন কোনও কথা নেই।
এইভাবে দিনরাত একটানা লিখে ও একটা নাটক শেষ করলে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরোবে বলে।
নাটকটির নাম, ‘চিরকুমার সভা’। কী মজার লেখা! অথচ খালিপেটে লেখা।
লেখাটা শেষ করেই সেটা নিয়ে ও কলকাতায় চলে গেল। পরের দিনই আমার কাছে খবর এল, জোড়াসাঁকোর বাড়ির তেতলার ঘরে উঠতে সিঁড়িতেই ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে—দিনের পর দিন না খেয়ে একটানা লিখতে লিখতে ওর শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। এবার আত্মীয়স্বজনের চিঠি আসতে লাগল আমার কাছে–
আমি কেন ওকে ঠিকমতো দেখাশোনা করছি না!
আমিও স্পষ্ট জানিয়ে দিলুম, তোমরা তো ওকে চেনো না। খাওয়ার কথা যত বলেছি জেদ ততই বেড়েছে। কিছুতেই খাবে না। না খেয়ে দুর্বল হয়ে সিঁড়িতে মাথা ঘুরে পড়েছে। এবার হয়তো নিজেই শিখবে। কারও শেখানো কথা শোনবার মানুষ তো ও নয়।
তবে কোনও ব্যাপারেই আমার বরের উপর জোর খাটাতে পারিনি এমন অপদার্থ বউ আমি নই। মাঝেমধ্যে ও আমাকে একটু-একটু ভয়ও পেয়েছে।
আমরা তখন শান্তিনিকেতনে। খবর এল, আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দুজন মেথরের প্লেগ হয়েছে। সেই সময়ে ওর বন্ধু প্রিয়নাথ সেন ওকে কলকাতায় যাওয়ার জন্যে বললেন— কোনও বিশেষ দরকার ছিল বোধহয়।
আমি বললেম, কলকাতায় এখন প্লেগ হচ্ছে, আমাদের বাড়িতেও দু’জনের হয়েছে, তুমি কিছুতেই কলকাতায় যেতে পারবে না।
ও বললে, বিশেষ প্রয়োজন, যেতেই হবে।
আমি বললেম, যাও তো দেখি কেমন যেতে পারো।
উনি খানিকক্ষণ বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বন্ধুকে চিঠি লিখে জানালেন, তুমি তো আমাকে কলকাতায় যাওয়ার জন্যে লিখেছ—আমিও অনেকদিন থেকে যাব যাব করছি কিন্তু প্লেগের ভয়ে গৃহিণী যেতে দিচ্ছেন না। এ অবস্থায় কোনও জরুরি কাজের ওজর দেখিয়ে যে আমি ছুটি পাব এমন আশমাত্র নেই। চেষ্টা করে অবশেষে ক্ষান্ত দিয়েছি। বেলা হল। এখন বরং নাইতে খেতে যাওয়া যাক। নইলে নির্দোষী নিরপরাধী তুমি সুদ্ধ গৃহিণীর বিদ্বেষের ভাগী হবে।
কে বলে রবি ঠাকুর বউকে ভয় পায় না? কি, আসল সত্যিটা হল, তিনি নিজেই প্লেগের ভয়ে কলকাতায় গেলেন না?
একটা ব্যাপারে ওর সঙ্গে আমার নিত্য খটাখটি। ব্যাপারটা আপাতভাবে তুচ্ছ হলেও আমার কাছে তুচ্ছ নয়।
যদি কোনওদিন আমার এই আত্মজীবনী কোনও প্রকাশকের হাতে সত্যিই পড়ে এবং সত্যিই ছাপা হয়, তাহলে মেয়েরা অন্তত আমার মনের এই কষ্টটা বুঝবে। এবং রবি ঠাকুরকে অন্তত এ ব্যাপারে দোষ দেবে।
ও সংসার করে সন্ন্যাসীর মতো। অনেক ব্যাপারেই ও সন্ন্যাসী নয়। কিন্তু এ-ব্যাপারে ওর কোনও চাহিদাই নেই।
সংসার করতে গেলে তো নানারকম সরঞ্জাম-উপকরণ লাগে। আমি কোনওরকম বিলাসিতার কথা বলছি না। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কথা বলছি। সেগুলিকে ও অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল বলে ভাবে। আর আমার তো সংসার যাযাবরের সংসার। আজ শান্তিনিকেতনে তো কাল কলকাতায়। গাজিপুরে কিছুদিন নিভৃতে সংসার করেছিলুম, সেই যা। তারপর কিছুদিন ও আমাকে নিয়ে থাকল শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। তারপর শান্তিনিকেতনের অতিথি আবাসে। বাইরের বারান্দায় দিনের-পর-দিন রান্না করেছি। ও আবার পাশে মোড়া নিয়ে বসে নতুন-নতুন রান্নার ফরমাশ করে যাচ্ছে। তারপর রান্নাটা যখন আমি করে ফেললুম, তখন ও বললে, দেখলে তো তোমাদেরই কাজ তোমাদেরই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম।
আমি এই সবই হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। মানতে পারিনি একটি জিনিস।
আপনাদের রবি ঠাকুর যখন গৃহস্থালির জিনিসপত্র দেখে বিরক্ত হয়ে মেজাজ খারাপ করেন, তখন আমার খুব রাগ হয়, অভিমান হয়, ভাবি এইমানুষের সঙ্গে ঘর করা যায় না।
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংসার পাততে গেলে সংসারের সরঞ্জাম তো বয়ে বেড়াতে হবেই।
হয়তো কখনও কখনও একটু বেশি জিনিসপত্তরই নিয়ে গিয়েছি। সব মেয়েরই ঝোঁক থাকে সেই দিকে।
ও যেখানেই যায়, অতিথি সমাগম হবেই। ব্যস, অতিথি এলেই তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আমাকেই তো করতে হয়।
তখন আনো মালপো, আনো মিঠাই, ভাজো শিঙাড়া, ভাজো নিমকি-কচুরি।
আমার কবি-বরের আবার কিছু কম হলে চলবে না।
পাত্র বোঝাই প্রচুর হওয়া চাই।
কিন্তু বাসনপত্তর, সরঞ্জাম না হলে এসব তৈরি করব কী করে? রাখব কোথায়? পরিবেশনই বা করব কী করে?
কিন্তু সংসারের সরঞ্জাম দেখলেই ও এমন করতে থাকে! কে বোঝাবে ওকে?
এই খাওয়াদাওয়া, অতিথিসেবা প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। তাতে ঠাকুরবাড়ির ভিতরের ব্যাপারটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমিও হয়তো একটু বাহবা পাব।
ওর এক কাকিমা আছেন। ছোট কাকিমা। নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী।
ইনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জলগ্রহণ করতেন না। কেন তিনি আমাদের বাড়ি কিছু খান না?
কারণ, তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, এ-বাড়িতে তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে।
কেন হত্যা করা হবে তাঁকে?
বাবামশায় তাঁকে মাসে এক হাজার টাকা হাত খরচা দিতেন।
ছোটকাকিমা ভাবলেন, বাবামশায় তাঁর খাবারে বিষ দিয়ে মাসে ওই হাজার টাকা খরচের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন। যাইহোক, ছোটকাকিমা আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
একদিন আমি নিজের হাতে মিষ্টি বানিয়ে ওঁকে খাবার জন্যে অনুরোধ করলেম।
ছোটকাকিমা তো কিছুতেই খাবেন না।
আমিও ছাড়ব না।
অগত্যা শেষ পর্যন্ত উনি সেই মিষ্টি মুখে দিলেন। জলও খেলেন। এবং দিব্য বেঁচে রইলেন।
এরপর আমার উপর কাকিমার আস্থা বাড়ল। একমাত্র আমার তৈরি মিষ্টি উনি মাঝেমধ্যে খেতেন। প্রায় সারাজীবন সর্বক্ষেত্রে আমি হেরে গিয়েছি। এই একটি জায়গায় আমি জিতেছিলুম।
তবে আমার রান্না খেয়ে বিশেষ করে আমার হাতের চিঁড়ের পুলি, আমের মিঠাই, দইয়ের মালপো খেয়ে নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায় যে কী প্রশংসা করেছিলেন কী বলব! এটাও তো একরকমের জিত, তাই না?
রান্না করতে গেলে তো রান্নার সরঞ্জাম লাগবেই, উপকরণ লাগবে। সুতরাং খরচ তো আছেই।
এই খরচের ব্যাপারেই আমার বর বেশ খিটখিট করে কোনও কোনও সময়ে। একদিন বলল, নীচে বসে লিখতে লিখতে রোজ শুনি, চাই ঘি, চাই সুজি, চিনি, চিড়ে, ময়দা; মিষ্টি তৈরি করতে হবে। যত চাচ্ছ তত পাচ্ছ। মজা হয়েছে খুব।
তোমার মতো গিন্নি হলেই হয়েছে আর কী, দু-দিনে ফতুর। আমি উত্তরে বলেছিলুম, তুমি সংসার বোঝো না, তোমার এদিকে নজর দেয়া কেন?
ও খুব গম্ভীর হয়ে গেল। সারাদিন আর কথাই বলল না। আমার মনে খুব কষ্ট হল। কিন্তু সেই কষ্টের কথা কাকে বলব?
আমার মনের আরও একটা বড় কষ্ট হল, আমাকে দেখতে বেশ খারাপ। কিন্তু ভগবান আমাকে যেভাবে গড়েছেন, তার উপর তো আমার কোনও হাত নেই।
আমার রাগ আমার ভাগ্যের উপর।
আমার এত সুন্দর বর হল কেন?
ওর পাশে আমাকে আরও খারাপ দেখায়, একদম মানায় না। তখন আমি সবে নতুন বউ। ভাবলুম, বাড়িতে বেশ সেজেগুজে থাকব। তাহলে আমাকে আমার অত সুন্দর বরের পাশে খানিকটা অন্তত মানানসই মনে হবে।
একদিন একটু সেজেগুজে মুখে একটু রংটং লাগিয়ে ঘরের মধ্যেই রয়েছি।
মেয়েরা আরও দু-একজন আছেন ঘরের মধ্যে।
হঠাৎ আপনাদের রবি ঠাকুর এলেন ঘরে। সবাই তাকাল ওঁর দিকে।
গায়ে একখানা লাল শাল। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে!
আমি কানে পরেছিলাম দুটি দুলঝোলানো বীরবৌলি।
আপনাদের রবি ঠাকুর একবার শুধু দেখলেন আমার দিকে। আমি সঙ্গে-সঙ্গে হাত দিয়ে কান চাপা দিলুম।
উনি বললেন, অসভ্য দেশের মানুষরাই মুখচিত্তির করে। তুমি কি মুখে রং মেখে অসভ্য দেশের মানুষ সাজতে চাও?
সেই থেকে আর কখনও সাজিনি। নিতান্ত সাদাসিধেভাবেই জীবনের আঠাশটা বছর কাটিয়ে দিলুম।
ভালো কথা, ইচ্ছে করলে গয়না পরবই বা কী করে?
আমার তো আর কোনও গয়নাই নেই।
আমার বিখ্যাত বর শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করল।
আমি তো শুধু তার সহধর্মিণী নই।
তার সহকর্মিণীও হয়ে ওঠবার চেষ্টা করলুম।
ছাত্রদের খাওয়াদাওয়া দেখা-শোনার ভার সব আমার।
ওরা ঘর ছেড়ে, মা-বোন ছেড়ে সব আশ্রমে এসে উঠেছে। ওরা যাতে আমার কাছে মাতৃস্নেহ পায়, অসুখে সেবাযত্ন পায়, দুঃখেকষ্টে সহানুভূতি পায়, সেইদিকে নজর ছিল আমার।
জোড়াসাঁকোর পরিবার ছেড়ে, সেখানকার গোছানো সংসার ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে থাকাটা আমার খুব সুখের হয়নি।
আমার একমাত্র আনন্দ ছিল ছাত্রদের সেবাযত্ন করা। এইভাবে আমি আপনাদের রবি ঠাকুরের বিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলুম।
আর যখনই বিদ্যালয়ে অর্থাভাব হত, যখনই ও চাইত, আমি আমার গয়না একটি একটি করে খুলে বিক্রির জন্যে ওকে দিয়ে দিতুম।
গয়না তো কিছু কম ছিল না আমার। শাশুড়ির প্রাচীন আমলের ভারী-ভারী গয়না। বিয়ের যৌতুক হিসেবেও পেয়েছিলেম অনেক গয়না।
সবই একে-একে বিক্রি হয়ে গেল শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ চালাতে। থেকে গেছে শুধু গলার এই চেনটা, যেটা পরে আছি আর হাতে ক’গাছা চুড়ি।
আমাদের আত্মীয়েরা আমাকে প্রচুর তিরস্কার করেছেন গয়না বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলুম বলে।
আমার স্বামীকে তো ওঁরা কাণ্ডজ্ঞানহীন মনে করতেন। আমাদের দুজনকেই বিদ্যালয়ের বিষয়ে অনেক বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছে। একটা কথা, গয়নার জন্যে আমার কোনও কষ্ট বা অনুশোচনা নেই। আমার গয়নাগুলো যে ওর কোনও কাজে লেগেছে, তাতে আমি খুশি।
যে-বিদ্যালয় আপনাদের রবি ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করলেন সেটা তো তাঁর সাময়িক শখের জিনিস নয়।
বহুদিন ধরে তাঁর মনের মধ্যে শিক্ষার একটি আদর্শ গড়ে উঠেছিল। সেই আদর্শকেই আপনাদের রবীন্দ্রনাথ রূপ দিতে চেয়েছিলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর তৃপ্তির জন্যে আমি তাঁর স্ত্রী হিসেবে সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছি মাত্র!
আমার একটাই কষ্ট—তাঁর জন্যে আরও বেশি কিছু, বড় কিছু করতে পারলুম না। তাঁর কাজের, তাঁর জীবনের প্রেরণা হতে পারলুম না।
দেখুন তো, কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি।
এতবড় একজন লেখকের বউ আমি, নিজের কথাটুকুও গুছিয়ে লিখতে পারছি না।
খালি খেই হারিয়ে যাচ্ছে।
মনে আছে তো, আমি ওঁর আবদার মেটাতে মানকচুর জিলিপি তৈরি করেছিলুম একদিন।
প্রথমে ছেলে রথীকে বললুম, একটু চেখে দ্যাখ তো বাবা কেমন হয়েছে। ও তো বলল, মা, খুব ভালো হয়েছে, সাধারণত আমি যে জিলিপি করি, তার চেয়েও ভালো।
এবার সাহস করে মানকচুর জিলিপি নিয়ে গেলুম ওর লেখার ঘরে। আমি যে ঘরে ঢুকলুম, ও টের পেল না।
একমনে লিখেই চলেছে।
আমি ধীরে-ধীরে প্লেটটা রাখলুম ওর টেবিলে।
ও আমার দিকে একটুক্ষণ তাকাল। তারপর প্লেটটির দিকে একবার তাকিয়েই জিলিপি তুলে মুখে দিল।
মুখ দেখেই বুঝলাম, ভালোলেগেছে, বেশ ভালো। শুধু বললে, মানকচুর জিলিপি পর্যন্ত উতরে দিলে ছুটকি।
ব্যস, আর কিছুনয়। শুধু ওইটুকু।
কী যে ভালোলাগল আমার। কত আনন্দ হল বোঝাই কেমন করে?
০৬. সকাল থেকেই গম্ভীর
সেদিন ও সকাল থেকেই গম্ভীর হয়েছিল।
এক-এক দিন এইরকম—সকাল থেকে নিজের মধ্যে ডুবে থাকে।
আমি ঘরে আলমারি গোছাচ্ছিলাম।
ও খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে একটা ইংরিজি বই পড়ছিল। হঠাৎ জিগ্যেস করল, ছোটবউ, তুমি আমার ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটা পড়েছ?
আমি বললুম, না তো! তুমি তো জানো, তোমার আদ্দেক কবিতাই আমি বুঝতে পারিনে।
ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমি ভাবলুম, এ-প্রসঙ্গে আর কোনও কথা হয়তো বলবে না। সত্যি কথা বলতে ও সাহিত্য আলোচনা শুরু করলে আমি অসহায় বোধ করি, অস্বস্তিতে পড়ি।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ও বলল, ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটা অনেক বছর আগে লিখেছিলেম। আমার ‘ছবি ও গান’ বইয়ে কবিতাটা আছে।
–কী আছে তোমার ওই ‘রাহুর প্রেম’ কবিতায়? কী নিয়ে লিখেছ তুমি?
—ওই কবিতায় আমি আমার কথা বলিনি। বলেছিনতুন বউঠানের মনের কথা।
–নতুন বউঠানের মনের কথা? কী কথা?
–বলতে পারো, নতুন বউঠানই কথা বলছেন, সেই কবিতায়। ছোটবউ, আমি জানি, তোমার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে আমাকে নিয়ে—সেসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো তুমি পেতে এই কবিতায়।
–নতুন বউঠান অনেক বছর হল চলে গেছেন। সবাই তাঁকে ভুলেও গেছে। তাঁর মনের কথা জেনে আমার কী হবে?
ও যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। বলতে লাগল, ছোটবউ, আমি তখন দিনরাত পাগল হয়ে ছিলুম। একটা মাতাল অবস্থায় লিখেছিলুম ‘রাহুল প্রেম’ কবিতাটা। তখন যদি তুমি আমাকে দেখতে তো মনে করতে এই ব্যক্তি কবিত্বের খেপামি দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি জানতুম না আমি কোথায় যাচ্ছি। এক অন্ধ প্রেম আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল।
আপনাদের রবীন্দ্রনাথ এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ। আমিও আলমারি গোছানো বন্ধ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।
জানি না কেন, খুব ভয় করছে আমার।
উনি হঠাৎ বললেন আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে, ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটায় নতুন বউঠানের কণ্ঠস্বর আমি আজও শুনতে পাই ছোটবউ—তিনি আমাকে ছেড়ে যাননি, যাবেন না কোনওদিন। এরপর তিনি কবিতাটার কিছু অংশ স্মৃতি থেকে বললেন—
তিনি তখন আমার কেউ নন, তিনি তখন শুধুই রবীন্দ্রনাথ—
নতুন বউঠানের মনের কথা আমি শুনতে লাগলুম তাঁর কণ্ঠে–
চাও নাই চাও, ডাকো নাই ডাকো,
কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো,
যাব সাথে সাথে রব পায়ে পায়ে,
রব গায়ে গায়ে মিশি—
এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ
হতাশ নিশ্বাস, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্য-সম বাজিবে কেবল
সাথে সাথে দিবানিশি।
নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তোর ছায়া—
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে
দেখিতে পাইবি কখনও পাশেতে
কভু সমুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া।
গভীর নিশীথে একাকী যখন বসিয়া মলিনপ্রাণে
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখপানে।
উনি থামলেন, আপনাদের রবীন্দ্রনাথ।
এঁকে আমি চিনি না। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল উনিও আমাকে চেনেন না।
উনি আমার কেউ নন।
আমিও ওঁর কেউ নই।
অন্য এক প্রেম তাঁকে রাহুর মতো গ্রাস করে আছে সারাক্ষণ।
সেই মেয়ে আজও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। কখনও ছেড়ে যাবে না।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকার বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলুম। আমার ভীষণ ভয় করছে যে…
কিন্তু কাকে বলব আমার সেই ভয়ের কথা।
এই কথাগুলো আমি নাই লিখতে পারতুম। এই দিনের ঘটনাটা আলগোছা চলে এল।
কিন্তু না বলেও তো পারলাম না।
আমি তো সত্যিই ঘর করলুম একজনের সঙ্গে, তার ছেলেমেয়ের মা হলুম অথচ সে রইল অন্যের ঘরে—এমন একজনের যে এই পৃথিবীতে নেই, তবু সে আছে—আমার আর ওর মাঝখানটি জুড়ে সে আছে।
কোনওদিন সে যাবে না।
তার কাছ থেকে আমাদের দু’জনেরই মুক্তি নেই।
অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারলুম, সে আঁধারের মধ্যে অশরীরী আঁধার হয়ে মিশে আছে।
আর তখুনি মনে এল, অন্য একদিনের গল্প—আমার স্বামীর মুখ থেকে শোনা কথা। ওর মতো করে তো বলতে পারব না। নেহাত আটপৌরে কথাও কী সুন্দর করে বলেন।
আমি আমার মতো করে, আবার যখন মনে পড়বে হুবহু, ওর মতো করেও, মিলিয়ে মিশিয়ে বলি—একটু এলোমেলোও হবে। কিন্তু বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর কথাই—মানে নতুন বউঠানের ভয়ঙ্কর সেদিনের কথাই যে মনে আসছে।
ও যখন লেখে, বা গানে সুর বসায়, আমি ওর ধারেকাছেও যাই না। সেদিন কী মনে হল, হঠাৎ গেলাম ওর ঘরে, তখন আমরা গাজিপুরে সংসার পেতেছি, বিয়ের বছর চার পরে।
ও আমাকে কাছে পেয়ে লেখা থামিয়ে বলল, অনেকদিন ইচ্ছে করেছি এই পশ্চিম ভারতের কোথাও একটুকরো বাসা নিয়ে ভারতবর্ষের বিরাট অতীত যুগের স্পর্শ লাভ করব।
আমি তেমনভাবে বুঝতে পারিনি ওর কথা। সেকথা নিশ্চয়ই আমার চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল।
আমার বর বললে, ছেলেবেলা থেকে পশ্চিমভারত আমায় রোম্যান্টিক কল্পনার ইন্ধন জুগিয়েছে। ছুটি (মাঝেমধ্যে আমাকে ছুটি বলেও ডাকেন। ছোটবউ থেকে ছুটকি থেকে ছুটি), এত দেশ থাকতে গাজিপুর কেন? দুটো কারণ আছে। শুনেছিলেম গাজিপুর নাকি বিখ্যাত তার গোলাপের খেতের জন্যে। আমি মনে-মনে গোলাপবিলাসী সিরাজ হয়ে গাজিপুরে এসেছি। কিন্তু এসে দেখছি, এ তো ব্যবসাদারদের গোলাপের খেত। এখানে বুলবুলের আমন্ত্রণ কোথায়? আর যেখানে বুলবুল নেই, সেখানে কী করবে কবি? আর যে কারণে গাজিপুরে বাসা বাঁধলুম তা হল, ভেবেছিলেম এখানে ভারতবর্ষের মহিমান্বিত ইতিহাসের স্বাক্ষর পাব। কোথায় তার ছাপ? তেমন কিছুই তো নেই।
—তাহলে গাজিপুর তোমার তেমন ভালো লাগল না, তাই তো?
—ছোটবউ, আমি ঠিক ওইভাবে বলতে চাইনে। আমার চোখে গাজিপুরের চেহারাটা ঠেকছে সাদা কাপড়পরা বিধবার মতো সেও কোনও বড় ঘরের বিধবা নয়।
—তাহলে চলো, জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই ফিরে যাই। আমারও এখানে মন বসছে না। তবে একটা জিনিস ভালো, এখানে তোমাকে একলা পাচ্ছি।
আমার কথার উত্তরে ও বললে, একলা দেখা আর একলা পাওয়া এক জিনিস নয় ছুটি।
আমি ঠিক এরকম কথা বুঝে উত্তর দিতে পারিনে। তাই চুপ করে থাকলুম।
ও বললে, একথা ঠিক, গাজিপুরকে আগ্রা-দিল্লির সঙ্গে তুলনা করাটা ঠিক হবে না। আবার সিরাজ-সমরকন্দের সঙ্গেও তুলনা হয় না। তবু ছোটবউ, গাজিপুরের কাছে আমি ঋণী। কেন জানো?
—কেন গো?
–কারণ গাজিপুরে অক্ষুণ্ণ অবকাশের মধ্যে আমার মন নিমগ্ন হতে পারল। মুক্তি এল মনোরাজ্যে। এই অবস্থায় আমার কাব্যরচনার একটা নতুন পর্ব আপনি প্রকাশ পেল। এই যে বড় বাংলোটায় আছি, গঙ্গার ধারেও বটে, আবার ঠিক গঙ্গার ধারও নয়, প্রায় মাইল খানেক চর পড়ে গেছে, সেখানে যবের, ছোলার, সর্ষের খেত। আমি ঘরের জানলায় বসে দেখতে পাই দূর থেকে। গঙ্গার জলধারা। গুণটানা নৌকো চলেছে মন্থর গতিতে। গোলকচাঁপার ঘনপল্লব থেকে ভেসে আসে কোকিলের ডাক। আমার বিশেষ ভালোলাগে রৌদ্রতপ্ত প্রহরের ক্লান্ত হাওয়া। তুমি কি কখনও ভালো করে দেখেছ ছোটবউ, পশ্চিম কোণে প্রাচীন ওই মহানিম গাছটিকে? তার বিস্তীর্ণ ছায়াতলে বসবার জায়গাটি? আমি দেখি। শুধু তাকিয়ে থাকি। আর আমার মন চলে যায় অনেক দূরের অতীতে। এইরকমই গঙ্গার ধার, রৌদ্রতপ্ত দুপুর, ঠিক এইরকমই একটি নিমগাছ, তার বিস্তীর্ণ ছায়াতল—যেখানে নতুন বউঠানের সঙ্গে চন্দননগরে কত সময় কাটিয়েছি আমি।
ওর কথা শুনে আমার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। চার বছর আগে চলে গিয়েও তিনি গাজিপুরে এসেছেন আমাদের সঙ্গে। আর আমি ভাবছি বিয়ের চার বছর পরে এই প্রথম সংসারের কোলাহলের বাইরে আমার স্বামীকে আমি একলা পেলাম? সে আর আমি। আর কেউ নেই।
আমাদের বড় মেয়ে বেলি তখন গুটগুট করে ঘরে এসে আমার আঁচল ধরে টানছে। আমি ওকে কোলে নিয়ে আমার বরকে জিগ্যেস করলুম, তোমার নতুন কাব্যের কী নাম দিয়েছ?
—মানসী।
—কাকে উৎসর্গ করলে? না জিগ্যেস করে পারলুম না আমি। ও বললে, সেই তাকে, যে নেই, তবু আছে, আমার সবকিছু নিয়ে আছে। কী লিখেছি জানো?
আমার গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না।
আপনাদের রবীন্দ্রনাথ এখন অনেক দূরের মানুষ। তিনি বললেন,
সেই আনন্দমুহূর্তগুলি তব করে দিনু তুলি
সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ।
আমি অনেকক্ষণ নীরব। উনিও চুপ। আমার বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে রবি ঠাকুর বললে, ছোটবউ, আমি জানি, তুমি কবিতা পড়তে তেমন ভালোবাসো না, তবু ‘মানসী’র প্রথম কবিতার কয়েকটি লাইন তোমাকে শোনাতে ইচ্ছে করছে। আমার মনের এই বেদনা তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি
লাজে বাধোবাধো সোহাগের বাণী,
মনে পড়ে সেই হৃদয়-উচ্ছাস নয়নকূলে।
তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে।
এমন করিয়া কেমনে কাটিবে মাধবী রাতি?
দখিনে বাতাসে কেহ নেই পাশে সাথের সাথি!
চারিদিক হতে বাঁশি শোনা যায়
সুখে আছে যারা তারা গান গায়—
আকুল বাতাসে মদির সুবাসে, বিকচ ফুলে,
এখনও কি কেঁদে চাহিবেনা কেউ আসিলে ভুলে?
আমি কোনও কথা বলিনি। ও বুঝল, আমি তো কবিতা বুঝিনে। বেলিকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেলুম।
ও যখন চান করতে গেল, আমি ফিরে এলুম ওর লেখার ঘরে।
চারধার শুনশান।
শুধু বাথরুমে জলের শব্দ।
আর দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক।
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল, তবু করলাম একটি কাজ–
ওর কবিতার খাতাটা লুকিয়ে দেখতে লাগলেম।
একটি পাতায় শুধু এই কয়েকটি লাইন—খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা, যেখানে ও বলেছে ওর জীবনে লুকোনো প্রেমের কথা, পরে হয়তো ও কোনও বড় কবিতায় জুড়ে দেবে এই ক’টা লাইন–
লুকানো প্রাণের প্রেম
পবিত্র সে কত!
আঁধার হৃদয়তলে মানিকের
মতো জ্বলে,
আলোতে দেখায় কালো
কলঙ্কের মতো।।
ওর কবিতার খাতায় আমার চোখের জল পড়ল।
ভাগ্যিস কোনও অক্ষরের উপর পড়েনি।
আমি মুছে দিলুম।
ও বুঝতেও পারবে না।
০৭. নতুন বউঠান আর আমার বর
এই যে নতুন বউঠান আর আমার বর, দু’জনে মিলে বাড়ির ছাদে তৈরি করল ওদের নন্দনকানন, ওটার একটা ভিতরের রূপ আছে।
ওটা শুধুমাত্র একটা বাগান নয়।
ওটা ওদের দুজনের সম্পর্কের বাগান। ওই বাগানটার মধ্যে ওদের লুকোনো প্রেমকে ওরা ঘোষণা করল।
ভালোবাসা কি কখনও লুকিয়ে রাখা যায়? যায় না। এ তো আমার বরের কথা। গোপন কথা নাকি চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে।
একদিন আমাকেও বলেছিল, আমার অনেক কবিতা আর গানের মধ্যে আমি জানিয়ে দিয়েছি আমার গোপন ভালোবাসার কথা। এই গোপন কখা তো গোপন রাখা যায় না ছোটবউ। যে কথা বলছিলেম, ওই নন্দনকাননের মধ্যেই দেয়ানেয়া, ওদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হল।
সন্ধে হলেই নতুন বউঠান গা-ধুয়ে চুল বেঁধে প্রিয়তম ঠাকুরপোটির সঙ্গে ছাদে যেতেন। নন্দনকাননে পাতা হত মাদুর আর তাকিয়া।
নতুন বউঠান রুপোর রেকাবিতে ভিজে রুমালে বেলফুলের গোড়ে মালা ঢাকা দিয়ে রাখতেন।
আর নিজের ঠোঁট রাঙিয়ে তোলার জন্যে বাটিতে রাখতেন ছাঁচি পান।
আমার স্বামীর মুখেই শোনা—নতুন বউঠানের জন্যে, শুধু তাঁকে শোনাব বলেই নতুন-নতুন গান লিখতুম আমি। আমার মধ্যে যেন ভালোবাসার গানের প্লাবন এসেছিল। নন্দনকাননে হু-হু করে বইত দক্ষিণে বাতাস। নতুন বউঠাকরুণ তার আঁচল আর চুল সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আর দক্ষিণে বাতাসের কাছে পরাজয় স্বীকার করে তার সেই হাসি মনে পড়ে আমার কী যে সুন্দর দেখাত তাকে। ওর হাসি যেন আকাশের গায়ে ফুটিয়ে তুলত তারা। সে বলত, কী গো ঠাকুরপো, আজ আমায় নতুন গান শোনাবে না? আমিও দিলেম নতুন বউঠানকে আমার নতুন গানটি শুনিয়ে—ধরলেম বেহাগে—
মধুর মিলন। হাসিতে মিলেছে হাসি, নয়নে নয়ন।
মরমর মৃদু বাণী মরমর মরমে, কপোলে মিলায় হাসি সুমধুর শরমে—নয়নে স্বপন।।
তারাগুলি চেয়ে আছে, কুসুম গাছে গাছে—
বাতাস চুপি চুপি ফিরিছে কাছে কাছে। মা
লাগুলি গেঁথে নিয়ে, আড়ালে লুকাইয়ে
সখীরা নেহারিছে দোঁহার আনন—
হেসে আকুল হল বকুলকানন।
গানটা পুরোটাই গাইলেন আপনাদের রবি ঠাকুর। তারপর নিজেকেই যেন ঠাট্টা করে গেয়ে উঠলেন—আ মরি মরি।
আমি তো অবাক। কতদিন আগের লেখা গান, এখনও মনে আছে! এই গানটা তো কোনওদিন কাউকে গাইতে শুনিনি।
কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ও বললে, বুঝলে ছোটবউ, তখন গান বললেই গান আসত। সুরও আসত সঙ্গে। একুশ-বাইশ বছরের লেখা তো বেশ কাঁচা। কিন্তু গানের মধ্যে সেই নন্দনকাননের পরিবেশ আর নতুন বউঠানের হাসিটি ধরা আছে। ধরা আছে তার চোখের মায়া আর লজ্জার সুমধুর রূপটি। একেবারে ক্যামেরার মতো। ছবিটার মধ্যে আমিও আছি-ওই যে, হাসিতে মিলছে হাসি, নয়নে নয়ন। আমার বুকের মধ্যে সমস্ত তোলপাড়ের গলা টিপে আমি জিগ্যেস করলুম, এমন সুন্দর গান শুনে নতুন বউঠান কী বললেন?
বিশেষ কিছু বলল না। এক পাগলামি করে বসল। গড়ে মালাটা ভিজে রুমালের ভিতর থেকে বের করে দিলে আমার গলায় পরিয়ে। আর হেসে বললে, আজ স্বীকার করছি ঠাকুরপো, তুমি বিহারীলালের চেয়ে অনেক বড় কবি।
আমি বললুম, নতুন বউঠান যে শেষ পর্যন্ত তোমাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর থেকে তুমি বড় কবি—এ তো তোমার খুব একটা বড় জয়। তুমিও নিশ্চয় আনন্দে তাঁকে কিছু একটা দিয়েছিলে।
ও বেশ কিছুক্ষণ আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। মনে হল, ও কিছু একটা, গভীর কিছু ভাবছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। ও হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল, ওই মালাটা আমি আমার কাছে অনেকদিন পর্যন্ত রেখে দিয়েছিলেম। ফুলগুলি শুকিয়ে সব কালো হয়ে গিয়েছিল। তবু আমার কাছে ওই মালাটা বেঁচে ছিল—এতটুকু নষ্ট হয়নি। কত বসন্তে, কত বর্ষায়, কত শরতে আমি যে নতুন বউঠানের কত কাছে ছিলেম, কত প্রভাতে দুপুরে সন্ধ্যায় সে আমাকে কতভাবে দেখেছে, কত ভালোবেসেছে আমাকে সতেরো বছর ধরে, কত সুখদুঃখের মধ্যে দিয়ে আমরা দু’জনে একসঙ্গে গেছি, সতেরো বছর ধরে আমার জীবন যে তার সব ডাকে সাড়া দিত—এই সমস্ত কিছু আমাদের মেলামেশা, ভালোবাসা তার সবটুকু দিয়ে ওই গড়ে মালাটি গেঁথে নতুন বউঠান আমার গলায় সেদিন পরিয়ে দিয়েছিল। আমি তা-ই ওটিকে ফেলতে পারিনি।
আমি দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
ও কথা থামিয়ে নীরব।
ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।
জিগ্যেস করলুম, মালাটা এখনও আছে?
ও বললে, না ছোটবউ, মালা আর নেই। ওটা নতুন বউঠানের সঙ্গে চিতায় শেষ হয়েছে।
আমার তখনও রবি ঠাকুরের বউ হতে বছর দুই দেরি। আমার বয়েস তখন সাত বছর ক’মাস। আমি তখন যশোর জেলার ফুলতুলি গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে ভবতারিণী। আমাদের গ্রামের চারধারে এক ক্রোশের মধ্যেও কোনও ইস্কুল নেই। আমি কাছেই একটা পাঠশালায় প্রথম বর্গ পর্যন্ত পড়েছি। তারপর লোকনিন্দের ভয়ে পড়া বন্ধ হয়েছে।
এই সময়ে, ১৮৮১ সালে রবি ঠাকুরের বয়েস কুড়ি। আর নতুন বউঠান বাইশ।
রবি ঠাকুরের নতুন বই বেরোল। নাম ‘ভগ্নহৃদয়’। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরে এ-বই আমি প্রথম দেখি। দেখলুম, উৎসর্গের জায়গায় লেখা, শ্রীমতী হে!
কে গো শ্ৰীমতী হে?
কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলুম আমি। কৌতূহল থেকে প্রশ্নটা করে ফেলেছিলুম।
ও সম্ভবত একটু বিরক্তই হল। বললে, সব কথা সবাইকে জানতে নেই।
আমি বললুম, আমাকেও জানতে নেই?
ও বললে, জানলেও বুঝবে না। তবু, জানতে যখন চাইছই, শোনো। ’হে’ হল হেমাঙ্গিনী।
—হেমাঙ্গিনী! সে কে?
—হেকেটি আর হেমাঙ্গিনী সব একাকার হয়ে আছে।।
–বুঝতে পারছিনে, একটু খোলসা করে বলো না বাপু।
—হেকেটি এক রহস্যময়ী দেবী। আর হেমাঙ্গিনী হল নতুন দাদার লেখা অলীকবাবু নাটকের নায়িকা। দু’টি চরিত্রের মধ্যেই মিশে আছে নতুন বউঠান।
এর বেশি কিছু সেদিন আমাকেও বলেনি। বাকি গল্পটুকুও আমি একটু একটু করে জোগাড় করে গেঁথেছি। আগে বলেওছি সেকথা। কিন্তু যা বলিনি, তা এবার বলতে চলেছি।
লিখতে খুব খারাপ লাগছে। তবু লিখছি।
কেন লিখছি, জানি না। আমার জীবদ্দশায় এ-লেখার কথা কেউ জানবে না।
আমার মৃত্যুর পরে যদি কোনওদিন কেউ আবিষ্কার করে এই লেখা…তবু কোনওদিন ছাপা হবে, এ-আশা আমি করি না। ঠাকুরবাড়ির যা রীতি, সেই অনুসারে এই লেখা, এই অপ্রিয় সত্য, জ্বলে-পুড়ে শেষ হবে।
আমার স্বামী বিলেত থেকে ফেরবার পরেই নতুন বউঠানের মধ্যে যে প্রাণের জোয়ার এল, যেভাবে দু’জনের মেলামেশা ঘনিষ্ঠতা শুরু হল, সেটা ঠাকুরবাড়ির অনেকেরই চোখে পড়ল।
বিশেষ চোখ টাটাল আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনীর। তিনি কিংবা মেজোভাশুর, কেউ একজন কথাটা বাবামশায়ের কানে তুলে দেন বলে আমার ধারণা।
বাবামশায় তো কোনওরকম উত্তেজনা বা আবেগ দেখান না। উনি চাইলেন, রবিকে যেন তখুনি আবার বিলেত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওর আবার বিলেত যাওয়ার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল।
কথাটা নতুন বউঠানের কাছে পৌঁছোতে দেরি হল না।
রবি আবার তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে?
আবার সেই একা জীবনের যন্ত্রণা? আবার ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের সেই অত্যাচার?
তাঁর প্রাণের দেওরটিই তো শুধু তাঁর বেদনার কথা বোঝে এতবড় বাড়িতে।
তাঁর মনের কথা বলার আর তো কেউ নেই সেই ছেলেবেলা থেকে। দেড়বছর পরে ফিরে আসার পর রবিই হয়ে উঠেছে তাঁর একমাত্র অবলম্বন।
রবিকে ছেড়ে থাকা এখন আর তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হল।
তাঁর ব্যর্থ আত্মহত্যার গল্প নানাভাবে রটতে লাগল। এরকম একটা মুখরোচক গল্পে ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহল যে কত রকমের রং চড়াল। বাবামশায় যে সে গল্প জানতেন, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই।
আমি নিশ্চিত, নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করায় তাঁর সঙ্গে আমার স্বামীর সম্পর্ক নিয়ে আরও বেশি কানাঘুষো শুরু হল। নতুন বউঠান আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকতে পারলেন না। কোথায় যাবেন তিনি?
তাঁর তো কোনও বাপের বাড়িও নেই।
স্বাভাবিকভাবে জ্ঞানদানন্দিনীর চাপ এল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর—নতুন ঠাকুরপো, কোথাও একটু কিছুদিনের জন্যে বউকে নিয়ে ঘুরে এসো। এ বাড়িতে এখন তোমাদের বেশ কিছুদিন না থাকাই উচিত। ব্যাপারটা একটু থিতিয়ে যাক। তখন না হয় ফিরে এসো। আমার তো মনে হয় বাবামশায়ই পিছন থেকে আমার মেজোজাকে বলেছিলেন, নতুন বউঠানকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে। তিনি চাইছিলেন, নতুন বউঠানের সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্কটা আরও অনেক আঁটসাঁট হোক।
ওকে যে আবার বিলেতে ফেরত যেতে হবে, সেটা আমার বর বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল, নতুন বউঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া হবেই—আজ না হয় কাল।
ব্যারিস্টার হতেই হবে, যাও বিলেত যাও, আইন পড়ো, শুধু গান-কবিতা লিখে বাড়িতে বসে থাকলে হবে না রবি ঠাকুরকে তো প্রায় হুকুম করা হল। আদেশ করলেন তার মেজোদাদা ও মেজো বউঠাকরুণ।
ওর মনেও তো কষ্ট কম হয়নি নতুন বউঠানকে ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে ভেবে। নতুন বউঠান তাঁর রবিকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না, তা তিনি যেখানেই যান তাঁর স্বামীর সঙ্গে, একথাও প্রিয়তম দেওরটি অনুভব করেছিল।
আর সেই কথাটাই তো অকপটে না লিখে পারল না ‘ভগ্নহৃদয়’-এর উৎসর্গে—সে লিখেছে, আমি যে কতবার পড়েছি এই লাইনগুলি, কষ্ট পেতে ভালো লেগেছে, তাই পড়েছি–
আজ সাগরের তীরে দাঁড়ায়ে
তোমার কাছে;
পরপারে মেঘাচ্ছন্ন
অন্ধকার দেশ আছে।
দিবস ফুরায়ে যবে সে দেশে
যাইতে হবে,
এপারে ফেলিয়া যাব
আমার তপন শশী—
ফুরাইবে গীত গান,
অবসাদে ম্রিয়মান,
সুখ শান্তি অবসান—
কাঁদিব আঁধারে বসি।
আমি ভাবতে চেষ্টা করছি তখন ঠিক আমার বরের মনের অবস্থা কেমন?
যে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তার নতুন বউঠানকে। তার নতুন বউঠানও খুব ভালোবাসেন তাকে। তাঁদের জীবনের প্রথম প্রেম বলতে কিন্তু এই ভালোবাসাটাই।
জোর করে ঘটানো হচ্ছে তাঁদের বিচ্ছেদ। এছাড়া উপায় বা কী? এই অসামাজিক সম্পর্ক কোন সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাবে দু’জনকে? হয়তো সমগ্র পরিবারকেই? ।
নতুন বউঠানকে ছেড়ে ও যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, কেমন তার মনের অবস্থা সেই মুহূর্তে? আমার বর কিন্তু কিছু লুকোয়নি। তার মনে ভয়, তার সঙ্গে তার নতুন বউঠানের আর কোনওদিন দেখা হবে না। তাকে ছাড়া তার বউঠান বাঁচবে না—এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। এর পরে, সে-ও হয়তো আর লিখবে না। লিখলেও সেই লেখার জন্যে থাকবে না তার নতুন বউঠানের হৃদয়ের ছায়া, তার প্রেমের আশ্রয়। সে শুধু চাইছে একটুখানি কান্না—তার নতুন বউঠানের চোখের জল। এই লেখা যখন ছেপে বেরোল সবাই তো বুঝল। আমার বরের কি একটুও ভয় করেনি! আমার বর কী মরিয়া হয়ে ভালোবেসেছিল নতুন বউঠানকে!
মরিয়া না হলে সবাই দেখবে পড়বে জানবে জেনেও সে লিখল কী করে এইভাবে–
স্নেহের অরুণাললাকে
খুলিয়া হৃদয় প্রাণ।
এপারে দাঁড়াবে দেবি,
গাহিনু যে শেষ গান
তোমারি মনের ছায়
সে গান আশ্রয় চায়—
একটি নয়নজল তাহারে
করিয়ো দান।
আজিকে বিদায় তবে,
আবার কি দেখা হবে—
পাইয়া স্নেহের আলো
হৃদয় গাহিবে গান?
উপর-উপর একটা মোড়ক আছে বটে। স্নেহের মোড়ক। কিন্তু সে তো শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। সবাই যা বোঝার তাই বুঝেছিল নিশ্চয়।
ও কিন্তু বিলেত গেল না।
গেল না মানে যেতে পারল না।
নতুন বউঠানের জন্যে মনকেমন সামলাতে পারেনি।
তাছাড়া ওর মনে ভয় ছিল, নতুন বউঠান ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না, আবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করবে। তাই জাহাজ মাদ্রাজে পৌঁছতে ও জাহাজ থেকে পালিয়ে গেলই বলা যায়।
একেবারে সোজা চন্দননগরে। সেখানেই নতুন বউঠানকে নিয়ে উঠেছিলেন তাঁর স্বামী। আমার বর সেখানে হঠাৎ গিয়ে হাজির।
নতুন বউঠান আশাই করেননি তাঁর রবি জাহাজ থেকে পালিয়ে তাঁর কাছে চলে আসবে। সেই পুনর্মিলনের গল্প আমি আমার বরের মুখেই শুনেছি। যতটা মনে আছে ওর ভাষাতেই লিখছি— আমি তো ফিরে এলেম মাদ্রাজ থেকে। সেই ফিরে আসাটা বিফলে গেল না ছোটবউ। নতুন বউঠান তখন জ্যোতিদাদার সঙ্গে তেলেনিপাড়ায় বাঁড়ুজ্যেদের বাগানবাড়িতে। গিয়ে দেখি জ্যোতিদাদা রয়েছেন তাঁর নিজস্ব জগতে। আর নতুন বউঠান ভারি নিঃসঙ্গ। আমাকে ফিরে পেয়ে সে যে কী খুশি হয়েছিল! আবার গানে কবিতায় ভরিয়ে দিলেম তাকে। বুঝলে ছুটি, গঙ্গা সাঁতরে তখন এপার-ওপার হতেন। নতুন বউঠান দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠত। আর সেই মেয়ে যে আমার জন্যে এতটাই উদ্বিগ্ন তা দেখতে আমার ভালোলাগত। আমি সাঁতার কাটতে কাটতে এতই দূরে চলে যেতাম যে সে আর আমাকে দেখতে পেত না। তখন প্রায় কান্নাকাটি শুরু করে দিত আমি ডুবে গেছি ভেবে। এখন ভাবি নতুন বউঠানকে এতটা কষ্ট না দিলেই পারতাম—তার তো মনের কষ্টের অভাব ছিল না।
তারপর একদিন বাঁড়ুজ্যেদের বাগানবাড়ি থেকে চন্দননগরেই আরও একটা রোম্যান্টিক ঠিকানায় চলে এলাম আমরা। মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি—এ-বাড়িটা আরও সুন্দর। একেবারে গঙ্গার উপরেই। আর তখন ভরা বর্ষা। একদিন দুপুরবেলা খুব বৃষ্টি এল। যাকে বলে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন। সেই দুপুরবেলাটা নতুন বউঠানের সঙ্গে আমি খ্যাপার মতো কাটিয়েছিলাম। সেই খ্যাপামিটা ছিল আমাদের দু’জনের। বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটিকে মনের মতো সুর বসিয়ে গাইতে গাইতে আমরা দুজনে বৃষ্টিতে ভিজেছিলুম— কোনও বাধা ছিল না সেদিন আমাদের মধ্যে। আবার হয়তো কোনও-কোনওদিন সূর্যাস্তের সময় আমরা দুজনে নৌকো করে বেরিয়ে পড়তাম—তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তার আলো এসে পড়েছে নতুন বউঠানের চোখে, চুলে। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে তাকে! সেই মায়া কাটতে না কাটতে তাকে আবার নতুন রূপে পেতুম, যখন সূর্যাস্তের পর পূর্ববনান্ত থেকে চাঁদ উঠত। তারপর আমরা বাগানের ঘাটে ফিরে নদীতীরের ছাদটার উপরে বিছানা করে চুপচাপ। তীরের বনরেখা অন্ধকারে নিবিড় হয়ে আসত। সেই যে দু’জনে মিলে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ, সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা, মনের দেয়ানেয়া, সেই সন্ধেবেলার ছায়া, কোনও-কোনওদিন শ্রাবণের বর্ষণ আর বিদ্যাপতির গান—ছোটবউ, তারা সব চলে গেছে। কিন্তু তবু তারা যায়নি। আমার গানে, আমার কবিতায় তাদের ইতিহাস লেখা থাকল। মনে পড়ছে, একদিন নতুন বউঠানকে বলেছিলুম, আমার লেখার মধ্যে আরও একটি লেখা লুকিয়ে থাকল। এক লেখা আর সকলে পড়বে। আর সেই লুকিয়ে থাকা লেখা তুমি আমি পড়ব। কিন্তু তা-ই কি হয় রবি ঠাকুর? সবাই কি এত বোকা? তোমার লেখার মধ্যে লুকিয়ে থাকা লেখার মানে যে সবাই বুঝে গেল একদিন। তোমার লুকিয়ে থাকা লেখাই যে ডেকে আনল সর্বনাশ! আমাদের বিয়ের মাস সাতেক আগেই হবে, ‘ভারতী’ পত্রিকাতে তুমি লিখেছিলে একটা লেখা—সেই লেখার আমি খোঁজ পেয়ে পড়েছি। তুমি কেন লিখতে গেলে এই লেখাটা? আবেগ সামলাতে পারোনি? ভেবেছিলে কেউ বুঝবে না? বা বুঝেও চুপ করে থাকবে? তুমি লিখেছিলে হুবহু এই কথা—
সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে
মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়া ছিল। তাহার সেই অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটাকতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।
এই লেখা বেরোবার পরে বাবামশায় আর বসে থাকেননি। তখন তিনি মুসৌরিতে। সেখান থেকে তিনি আপনাদের রবি ঠাকুরকে চিঠি লিখে আজ্ঞা করেন, অবিলম্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে। আপনাদের রবি ঠাকুর বলেছেন বটে, তাঁর বিয়ের কোনও গল্প নেই, কিন্তু গল্প একটা আছে বইকি। সেই গল্পের শুরু ‘ভারতী’ পত্রিকায় এই লেখাটি থেকে। তারপর বাবামশায়ের চিঠি—অবিলম্বে আমার সঙ্গে দেখা করো এবং তাঁর আদেশ, যত শীঘ্র সম্ভব, বিয়ে করো। এরপরেই বউদিদিদের আগ্রহ রবির বিয়ের জন্যে বিশেষ করে মেজোজার ইচ্ছে বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোক।
এইবার সেই প্রশ্নের উত্তরের কাছাকাছি আসছি রবি ঠাকুর, তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন? কেন রবি ঠাকুর, কেন? সেই ‘কেন’-র উত্তর আমি নিজেই খুঁজেছি সারা জীবন। এবার হয়তো উত্তরটির কাছাকাছি আসছি ক্রমশ।
ঠাকুরবাড়ির বধূদের চিরাচরিত ‘আকর’ যশোর। বউঠাকুরানিরা তাঁদের প্রিয় রবির বউ খুঁজতে সেখানেই এলেন। তার মানে, কনে খুঁজতে এলেন, জ্ঞানদানন্দিনীদেবী এবং কাদম্বরীদেবী, দু’জনেই। সঙ্গে এসেছিল ইন্দিরা, মানে মেজোজার মেয়ে। আর কে এসেছিলেন জানেন—স্বয়ং রবি ঠাকুর।
যদিও উনি বলেছেন, উনি আসেননি। কিন্তু উনি না এসে পারেননি।
কারণ নতুন বউঠান যে এসেছিলেন। কে
ন এসেছিলেন নতুন বউঠান?
অনেক পরে বুঝেছি, তাঁর আত্মহত্যারও অনেক পরে, যখন একটু বয়েস হল আমার, তখন বুঝেছি তাঁর ভালোবাসার মানুষটির বউ খুঁজতে তাঁকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছিল—ইচ্ছে করে তাঁকে এই মানসিক শাস্তি দেয়া হয়েছিল। এই হল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের নিষ্ঠুরতা। পরে যখন বুঝতে পেরেছি, আমার খুব কষ্ট হয়েছে নতুন বউঠানের জন্যে। সেই মানসিক কষ্ট যাতে তাঁকে একা না পেতে হয়, জ্ঞানদানন্দিনীর চাপ তাঁকে না একা সহ্য করতে হয়, সেইজন্যেই নতুন বউঠানের সঙ্গে তাঁর প্রিয়তম মানুষটিও এসেছিল—আমাকে দেখে পছন্দ করতে নয়, নতুন বউঠানকে আগলাতে, তাঁর পাশে থাকতে।
এবার প্রশ্ন হল, যশোরে এত মেয়ে থাকতে আমাকে পছন্দ হল কেন?
যশোরে এত মেয়ে তো কী হয়েছে, সবাই তো আর পিরালি-ব্রাহ্মণ ঠাকুরবাড়িতে মেয়ে দেবে না। পিরালিরা মুসলমানের জলছোঁয়া ব্রাহ্মণ। তায় আবার ব্রাহ্ম। হিন্দুদের মতো নারায়ণ-সাক্ষী করে বিয়ে করে না। তা ছাড়া সে বছর বোধহয় যশোরে সুন্দরী মেয়েদের আকাল পড়েছিল। আমাকে পছন্দ হওয়ার কারণ বউঠাকরুণরা অনেক চেষ্টা করেও রবি ঠাকুরের জন্যে মনের মতো কনে খুঁজে পাননি।
তবে আরও একটু কারণ আছে। একটু গোপন কারণ এবং আরও জরুরি কারণ।
আমার বাপ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এক সামান্য কর্মচারী বেণী রায়। সুতরাং এ-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, আমি ঠাকুরবাড়ির একান্ত বাধ্য বউ হব, সারা জীবন মুখে রা-টি কাটব না। সেই সাহসই হবে না আমার।
নতুন বউঠানও তো তাই। বাজার সরকারের মেয়ে—তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বউ!
আমি ঠাকুরবাড়ির আর এক কাজের লোকের মেয়ে—রবি ঠাকুরের বউ!
আর জ্ঞানদানন্দিনী, আমার মেজোজা? তাঁর বাবা অভয়চরণের তো এক বিরাট গল্প। সে গল্প তাঁর মুখেই শুনেছি। তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে এক ধনী পিরালি-ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। এবং তাঁরই মেয়ে নিস্তারিণীকে তিনি বিয়ে করে ঘরজামাই হন। জ্ঞানদানন্দিনী বউ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে এলেন তাঁর দুধেদাঁত পড়ার আগে। একদিন আমাকে গপ্পো করে বললেন, দুধেদাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্ত খুঁজে সেখানে দাঁতটি দিয়ে বলতে হয়, ইঁদুর, পড়া দাঁত তুমি নাও, তোমার দাঁত আমায় দাও। বিয়ের পরে আমার যখন দুধেদাঁত পড়ল তখন কলকাতার পাকা ইটচুনের বাড়িতে কোথায় খুঁজব ইঁদুরের গর্ত? সে এক সমস্যা হয়েছিল। এই জ্ঞানদানন্দিনী লেখাপড়া শিখে একা বিলেত গিয়েছিলেন। তারপর আবার গভর্নর লরেন্সের পার্টিতেও একা গিয়েছিলেন! তাঁর কাছে আমরা তো কোন ছার! আমার তো মনে হয়, আমার মেজোজা চেয়েছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের বউ যেন আমরাই হই, যাদের সামাজিক পরিচয় অনেক নীচের। এখানে স্বীকার করছি, একটা ব্যাপার আমার খুব ভালোলাগে—এই যে ঠাকুরবাড়ির মঞ্চ আলো করে হঠাৎ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন ওর নতুন বউঠান কাদম্বরীদেবী আর জ্ঞানদানন্দিনীকে কিছুদিনের জন্যে যে ছায়ায় চলে যেতে হয়েছিল, ওঁর লাঠি ঘোরানো একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই ব্যাপারটা আমার বেশ মনে ধরেছে। নতুন বউঠানকে সারা জীবন ঠাকুরবাড়ির মহিলামহল নানাভাবে মানসিক কষ্ট দিয়েছে। আমি যখন ভাবি, আপনাদের রবি ঠাকুর অত অল্প বয়সে তাঁর নতুন বউঠানের পাশে দাঁড়িয়ে সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার হয়তো চেষ্টা করেছিলেন, তখন আমার মধ্যে কষ্টের, বেদনার যে আগুন জ্বলছে তার মধ্যে কোথাও যেন একটু অহংকারও মিশে যায়। আমার বরকে আমার ভালোবাসার মতো একজন মানুষ বলে মনে হয়। ওর কবিতা, গান, কতরকমের লেখা আমি অত বুঝিনে। কিন্তু এইটুকু বুঝি, ও নতুন বউঠানকে এত ভালোবেসেছিল, আজও বাসে, সেই মেয়ে এ-বাড়িতে এত একা একা কষ্ট পেয়েছিল বলে। তার বাপের বাড়ির জোর ছিল না বলেই তো এত কষ্ট তাঁকে পেতে হল। আমারও তো তা-ই।
আমার সঙ্গে রবি ঠাকুরের বিয়ের ঠিক হল আর যশোরেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন নতুন বউঠান।
তাঁর প্রিয়তম মানুষটির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এ-বিয়ে আটকাবার আর কোনও উপায় নেই, রবি আর তাঁর থাকবে না—এই মানসিক যন্ত্রণা তিনি সহ্য করতে পারেননি। এবং এই যে তিনি অসুস্থ হলেন, আমার বিয়ের পরে যে ক’টি মাস তিনি বেঁচে ছিলেন, তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ অসুস্থই ছিলেন। আমি যখন তাঁকে দূর থেকেই দেখতুম, কেমন যেন মানুষ বলে মনেই হত না তাঁকে। মনে হত তিনি ছায়া। খুব দুঃখী ছায়া। তবে ভারি সুন্দর দেখতে। ঠাকুরবাড়িতে সবচেয়ে সুন্দরী ওই ছায়ার মতো মেয়ে। শুনেছিলুম, ওঁর বয়স নাকি পঁচিশ। আমার মনে হত অনেক কম। কী পাতলা হালকা গড়ন। তাই হয়তো বয়স অত কম মনে হত। রং বেশ চাপা, ছিপছিপে, আর চোখের চাউনিতে কী যেন ছিল, ঠিক বলতে পারব না—অন্য কোনও মেয়ের অমন চাউনি দেখিনি–।
একদিন আপনাদের রবি ঠাকুরকে হঠাৎ জিগ্যেস করেছিলেন, তোমার মুখে মারাঠি মেয়ে আন্না তড়খড়ের গল্প শুনেছি, বিলেতের কত মেয়েদের গল্প শুনেছি, ওদের দেখে আসার পর
আমাকে পছন্দ করলে কেন?
এতটুকু না দেরি করে ও বললে, আমার বিয়ের যেমন কোনও গল্প নেই, আমার পছন্দ অপছন্দেরও তেমনই কোনও ব্যাপার নেই। বউঠানরা যখন বড় বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলেন, আমি বললুম, তোমরা যা হয় করো, আমার কোনও মতামত নেই।
আমি বললুম, তুমি তো মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে। আমাকে কী কারণে পছন্দ করলে?
ও কী বললে জানেন? বললে, দেখতে গিয়েছিলুম বুঝি?
আমার কখনও-কখনও মনে হয়, নিজের বিয়েটাকে অন্তত প্রথম প্রথম, ও নিজেই মেনে নিতে পারেনি।
ও তো ঠাট্টাই করেছিল আমার সঙ্গে ওর বিয়েটাকে।
তা না হলে কেউ নিজের বিয়ের নেমনতন্নের চিঠি ও যে ভাবে লিখেছিল, সেই ভাবে লেখে?
নেমনতন্ন চিঠিটার প্রথমেই মাইকেল মধুসূদনের লেখা এই লাইনটা ছিল—আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়! তারপর এই চিঠি—নিজের হাতে লেখা—
আগামী রবিবার ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক।
আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন। ইতি।
অনুগত শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অনেকে এই চিঠিতে রবি ঠাকুরের কৌতুকভরা মনের পরিচয় পেয়েছেন। আমি চিঠিটা অনেক পরে হঠাৎ-ই দেখেছিলুম। এবং আমার বেশ খারাপ লেগেছিল।
তবে ভয় করেছিল—সত্যিই ভয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলুমবাসরঘরে। বাসরঘর আমাদের বাড়িতে হয়নি।
হয়েছিল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
উনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি।
কত বড় জমিদার!
সেই বাড়ির ছেলে কী করে যাবে তার কর্মচারীর মেয়েকে বিয়ে করতে তারই বাড়িতে?
কী করে সেই বাড়িতে হতে পারে তার বাসরঘর?
ও পরিষ্কার বলে দিলে, বিয়ে করতে আমি কোথাও যাব না।
কনেকে নিয়ে এসো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
যা হওয়ার এখানেই হবে।
তাই হল। আমার বিয়েই হল সম্পূর্ণ এক অজানা অচেনা পরিবেশে।
এতবড় বাড়ি সেই আমি প্রথম দেখলুম।
এইরকম মানুষজনও কখনও আগে দেখিনি।
এঁদের কথাবার্তা, আদবকায়দা সব আলাদা।
বিশেষ করে মেয়েদের সাজপোশাক, কথা, পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা—এরকম তো আগে কখনও দেখিনি।
আমার যে কী লজ্জা করছিল, আর ভয় করছিল।
কোথায় গেল সব—আমার মা, আমার বাবা, আত্মীয়রা?
কোথাও তো তাদের দেখতেই পেলুম না।
তবে মনে আছে, এতটুকু ধুমধাম হয়নি আমার বিয়েতে। কোনও আনন্দ ছিল না বাড়িতে। যেন হঠাৎ আলো নিভে গেল। তার একটা কারণ অবিশ্যি আগেই বলেছি, আমার বড় ননদাই সারদাপ্রসাদ আমার বিয়ের দিনেই মারা যান।
আরও একটা কারণ, বরের নিজের মনে মনে কোনও আনন্দ ছিল না। এবং সবার মনের মধ্যে এই ভাবটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, জোর করে আমার মতো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাড়িতে সবার প্রিয় রবির প্রতি নিদারুণ অবিচার করা হল।
এই অপরাধের ক্ষমা নেই, এ কথাটা মনে-মনে ঘুরছিল।
বাসরঘরে সম্ভবত চাপা অভিমান, রাগ, হতাশা থেকে আমার বর যে কাণ্ডটা করল, আমার বুক কাঁপছিল। পাশে আমার কেউ নিজের লোক, মানে বাপের বাড়ির কেউ ছিল না, তা-ই আরও ভয় পেয়ে গেলুম।
নিজেরই বাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে বর এল আমাকে বিয়ে করতে। এসে দাঁড়াল পিঁড়ির উপর।
এরপর মনে পড়ছে বাসরঘরের কথা। ভাঁড়-কুলো খেলার সময় এল।
ভাঁড়ের চালগুলি ঢালাই-ভরাই করা হল ভাঁড়খেলা।
আমি একগলা ঘোমটার মধ্যে দিয়ে দেখছি আমার বর কেমন ভাঁড় খেলে।
ও করল কী, ভাঁড়গুলো ধরে ধরে সব উপুড় করে দিতে লাগল।
ওর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী, যাঁর গল্প ইতিমধ্যে বলেছি, উনি তো চিৎকার করে উঠলেন —ও কী করিস রবি? ওই বুঝি তোর ভাঁড়খেলা? ভাঁড়গুলো সব উলটেপালটে দিচ্ছিস কেন?
দেখলাম, ঠিক সেই সময়ে ঘরে এসে দাঁড়ালেন যিনি, পরে জেনেছিলুম তিনিই নতুন বউঠান!
খুব অসুস্থ লাগছিল তাঁকে।
সবাই তাকিয়ে তাঁর দিকে।
তাঁর চোখ দিয়ে মনে হল আগুন ঝরছে। আর ঠোঁটে হাসি।
আমার বর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরীকে বললে, জানো না কাকিমা, আজ আমার জীবনের সব কিছুই তো উলটপালট হয়ে গেল! কাজেই আমি ভাঁড়গুলোও উলটে দিচ্ছি। আমার বর তাঁর ছোটকাকিমাকে কথাগুলো বললেন বটে, উনি কিন্তু সারাক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন নতুন বউঠানের চোখের দিকে! ওর সেই কথা আজও শুনতে পাই।
আমার বরের মুখে একথা শুনেই নতুন বউঠান মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ছোট কাকিমা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, রবি, তুই একটা বরং গান কর। তোর মতো গাইয়ে থাকতে তোর বাসরে আর কে গান গাইবে?
কাকিমার মুখের কথা খসতে না খসতে কর্তাটি আমার মনে হল আমাকে বেশ ঠাট্টা করেই গান শুরু করে দিল—
আ মরি লাবণ্যময়ী
কে ও স্থিরসৌদামিনী,
পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে
মার্জিত বদনখানি!
নেহারিয়া রূপ হায়,
আঁখি না ফিরিতে চায়,
অপ্সরা কি বিদ্যাধরী
কে রূপসী নাহি জানি।
প্রথম রাত্তিরেই আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উনি আমাকে কী চোখে দেখলেন—বাকি জীবন কী চোখে দেখবেন।
উনি কিন্তু বেড়াল মারতে দেরি করেননি।
০৮. আমার জীবনের গল্প প্রায় শেষ
আমার জীবনের গল্প প্রায় শেষ হয়ে এল।
আঠাশ বছরের জীবন, তার উনিশ বছর কাটল রবি ঠাকুরের বউ হয়ে।
তার আবার দশ বছর কাটল ক্রমাগত ওঁর পাঁচটি শাবক প্রসব করতে-করতে। আমাদের সন্তান সম্পর্কে ‘শাবক’ কথাটি উনিই একবার ব্যবহার করেছিলেন।
তা-ই আমিও সেই সাহস দেখালাম।
আরও একটি পেটে ধরেছিলুম। পড়ে গেলুম বলে সেটা নষ্ট হল। আর আমার সর্বনাশ হল।
আমি জানি, আমার এ-অসুখ সারবে না। শরীর শেষ হয়ে আসছে। শরীরের আর অপরাধ কী!
যা গেল উনিশ বছর ধরে এই শরীর আর মনের উপর দিয়ে!
শরীরের যে-অবস্থা, বেশিদিন আর লিখতে পারব বলেও মনে হয় না। লুকিয়ে-লুকিয়ে লিখছি তো—কেউ দেখে ফেললেই লেখাটা লোপাট হয়ে যাবে।
আর লিখতেও পারছিনে। দৃষ্টি ক্রমে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সারা গায়ে জ্বালা। আর সারাক্ষণ গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
এত দুর্বল লাগে, বলে বোঝাতে পারব না। ডাক্তার বলছে, এত রক্তপাত হচ্ছে শরীরে আর রক্ত নেই।
শুনছি, শান্তিনিকেতনে থাকলে চিকিৎসা তেমনভাবে হবে না।
তবে প্রথম থেকেই আমার চিকিৎসা তো উনিই করছেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। কতরকমের এক্সপেরিমেন্ট করছেন ওষুধ বদলে-বদলে।
এবার আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে পড়লে কি আর লিখতে পারব?
আমার বিয়ের পরেই বাড়িতে যেন একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল।
কীসের উৎসব?
নতুন বউঠানের শোবার ঘরের খোলনলচে বদলে একেবারে নতুন করে সাজানো হচ্ছে।
কেন?
কারণ, নতুন বউঠানের মনখারাপ। তার মনের ব্যামো হয়েছে।
সেই ব্যাধি সারানোর জন্যে ঘর সাজিয়ে ওঁর মন ভালো করার চেষ্টা চলছে।
কীরকম সাজানো হচ্ছে ঘর?
জ্ঞানদানন্দিনীর যেমন পছন্দ তেমনভাবে।
কে সাজিয়ে দিচ্ছেন?
জ্ঞানদানন্দিনীর প্রিয় দেওর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
আমার বর একদিন তিতিবিরক্ত হয়ে বললে, বাড়িতে এসব কী হচ্ছে বলো তো? যার মন ভালো করার জন্যে ঘর সাজানো তার কি ওইরকম পছন্দ? আমি তো নতুন বউঠানের পছন্দ জানি। দেয়ালে ওইরকম কড়া রং ওর পছন্দই নয়। তাছাড়া, পালঙ্কটাই বা বদলে দেওয়া হল কেন? ওই পালঙ্কটাই তো ওর কত পছন্দের। এক সময়ে দুপুরবেলা আমরা দু’জনে ওই পালঙ্কে কত গল্প পড়েছি। ওখানে শুয়ে শুয়ে কত কবিতা লিখে আমি শুনিয়েছি নতুন বউঠানকে। বরাবর তো বউঠান ওই পালঙ্কেই শুয়েছে—এ-বাড়িতে বউ হয়ে আসার দিন থেকে। কী সুন্দর ফুল ফলের, পাখির, বাগানের ডিজাইন ছিল পালঙ্কটায় নতুন বউঠান একদিন বলেছিল, ঠাকুরপো, আমার এই পালঙ্কটাও একটা নন্দনকানন। সেটাও কিনা বদলে দিলেন মেজোবউঠান? নতুন দাদাও একটিবার ভেবে দেখল না, নতুন বউঠান তার ঘরে এইসব পরিবর্তন চাইছে কি না?
এই সবের মাস কয়েক পরেই ঘটল সেই ঘটনা।
আমার বিয়ে হল ১৮৮৩-র ডিসেম্বরে। ১৮৮৪-এর এপ্রিল মাসে নতুন বউঠান আত্মহত্যা করলেন।
সেই দিনটা মনে আছে আমার।
আমি ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারিনি।
শুধু এইটুকু জানি, সেদিন নতুন বউঠানের ঘর সারাদিন বন্ধ ছিল।
ভোরবেলা কাজের লোকেদের সন্দেহ হয়, নতুন বউঠান বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
ওর ঘুম ভাঙে খুব সকালে।
ও নতুন বউঠানের ঘরে খুব জোরে জোরে আঘাত করে চিৎকার করতে থাকে, নতুন বউঠান দরজা খোলো, দরজা খোলো।
আমি বারান্দায় বেরিয়ে আসি।
কেউ যখন দরজা খুলল না, দরজা ভাঙা হল।
ততক্ষণে বাবামশায় ঘরের সামনে এসে গিয়েছেন।
প্রথমে ঘরে ঢুকল ও।
কিছুক্ষণ পরে বাবামশায়।
আমাকে ভিতরে যেতে দেওয়া হয়নি।
নতুন বউঠান অজ্ঞান। একেবারে কোনও জ্ঞান নেই।
কিন্তু তখনও বেঁচে ছিলেন।
ও ঘরে ঢুকেই বেশকিছু কাগজ চাদরের মধ্যে লুকিয়ে বেরিয়ে এল।
সেই কাগজ আমি কোনওদিন দেখিনি।
বাবামশায়ও অনেক ছেঁড়া কাগজ—চিঠির মতো কিছু–নিয়ে বাইরে এলেন।
তারপর ওর উদ্দেশে বললেন, জ্যোতিকে খবর দাও। সে কোথায় ছিল রাত্তিরে?
বাবামশায়কে কখনও এরকম রাগতে দেখিনি। বললেন, বউমা এখনও বেঁচে আছেন। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। আর তাঁর আত্মহত্যার সমস্ত প্রমাণ লুপ্ত করার ব্যবস্থা করো। আর জ্যোতিকে বোলো, আমাদের এস্টেট থেকে তার সমস্ত বাড়তি পাওনা আমি বন্ধ করে দিলুম।
আমি প্রমাণ পেয়েছি, সে চরিত্রহীন!
এ-আমি ক্ষমা করতে পারব না।
বেশ বেলায় এলেন জ্যোতিদাদা।
তখন কী বিধ্বস্ত অবস্থা তাঁর!
মুখচোখ সব ফুলে আছে।
তিনি নাকি নতুন বউঠানকে বলে গিয়েছিলেন, তিনি সে-রাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন।
ফিরলেন তার পরদিন বেশ বেলায়।
আমার মনে আছে, আপনাদের রবি ঠাকুর আর তাঁর নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দু’জনে দু’ধার থেকে ধরে নতুন বউঠানকে দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটাবার চেষ্টা করছেন।
নতুন বউঠানের আঁচল খসে মাটিতে লুটোচ্ছে।
তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
তিনি হাঁটবেন কী করে?
বিষ খেয়ে তাঁর চৈতন্যই নেই।
তিনি কিন্তু আরও দু-দিন বেঁচে ছিলেন অচৈতন্য হয়ে।
বাবামশায়ের হুকুমে তাঁর এই দু-দিন বেঁচে থাকার তথ্যটাই লোপাট করা হল।
পুলিশ থেকে ডাক্তার—সবাই ভয়ে বা ঘুষ খেয়ে চুপ করে গেল। বলা হল, তিনি হঠাৎ হার্টফেল করেছেন।
দুদিন আগে যে নতুন বউঠান আফিম খেয়েছিলেন, সেই ব্যাপারটাই ঠাকুরবাড়ি চেপে গেল।
এই হল এই বড় বাড়ির একতা।
আমি শুনেছি, নতুন বউঠান শেষ দিনে অনেক বড় একটি চিঠি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয়তম রবিকে।
সে-চিঠি কোথায় গেল, কেউ জানে না।
নতুন বউঠান আর একটি ছোট চিঠি লিখেছিলেন তাঁর স্বামীকে।
শুনেছি, সেই চিঠির মধ্যে ছিল আর একটি চিঠি।
সেই ভালোবাসার চিঠিটা লিখেছিল কলকাতার এক বিখ্যাত নটী জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে।
নতুন বউঠান নাকি সেই চিঠিটা পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীর জোব্বার পকেটে।
নতুন বউঠান তাঁর স্বামীকে শেষ দিনে যে চিঠিটি লেখেন তার মধ্যে নটীর চিঠিটি—সবটা গিয়ে পড়ে বাবামশায়ের হাতে।
বাবামশায়ের পক্ষে ক্ষমা করা সম্ভব হয়নি তাঁর পুত্রকে।
০৯. একজনের কথা
একজনের কথা সব শেষে না বললেই নয়।
কারণ আমি তাকে খুব ভালোবেসে ছিলুম।
আমি এই ভালোবাসার কথা কাউকে বলতে পারিনি।
আমি তো কোনও অন্যায় করিনি।
আমি যে খুব একা। আর আমার মনের ভিতর অনেক কষ্ট।
সে সব বুঝেছিল।
তা-ই তাকে ভালোবেসে ছিলুম।
তার মতো ভালো আমার শ্বশুরবাড়িতে আমাকে আর কেউ বাসেনি।
সে আমার থেকে মাত্র চার বছরের বড়।
আমি যখন বউ হয়ে ন’বছর ন’মাস বয়সে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এলাম, বন্ধুর মতো এসে আমার হাত ধরল সে।
তখন তার বয়েস সবে তেরো পেরিয়েছে।
ঠিক যেমন রবি ঠাকুরের সঙ্গে দু-বছরের বড় নতুন বউঠানের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা তৈরি হল, আমার সঙ্গে ঠিক তেমনই বন্ধুত্ব, ভালোবাসা তৈরি হল ঠাকুরবাড়ির এই ছেলেটির।
সে ছিল জন্মরুগ্ন।
আর তার বাপ ছিল বদ্ধ পাগল।
মা-ও যে তাকে খুব দেখত, তা-ও নয়।
ঠাকুরবাড়িতে তারা ছিল একটু একঘরে মতো।
সে ভালো করে হাঁটতে পারত না।
কত সময়ে আমাকে ধরে ধরে হাঁটত।
পা ঘসে ঘসে চলত বলে সে মেলামেশায় লজ্জা পেত। আমি তার মনের কষ্ট বুঝতুম।
এভাবেই ওর প্রতি আমার ভালোবাসায় স্নেহ-মায়া-মমতা-মাতৃত্ব সব মিলে মিশে ছিল।
ওকে না দেখলে ওর জন্যে খুব মনকেমন করত।
ও-ই আমাকে যত্ন করে লেখাপড়া শিখিয়ে ছিল।
ও খুব ভালো সংস্কৃত জানত।
সংস্কৃত কাব্য-নাটক আমাকে পড়ে শোনাত। আবার ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েও দিত। ওই আমাকে কালিদাসের মেঘদূত আর কুমারসম্ভব পড়িয়েছিল। কুমারসম্ভব পড়ে খুব লজ্জা পেয়েছিলুম। শিব আর পার্বতীর কত আদরের কথা কী খোলাখুলি লিখেছেন কালিদাস!
আমি যে একটু-আধটু সংস্কৃত শিখতে পেরেছিলুম সেটা কিন্তু ওর জন্যে।
কী সুন্দর কবিতা লিখত সে!
যোলো বছর বয়েসে গান লিখেছে, সেই গান মাঘোৎসবে গাওয়া হয়েছে।
আমার বর তখন ‘বালক’ পত্রিকার সম্পাদক—সেই পত্রিকায় ওর লেখা বেরিয়েছে।
তারপর সে যখন আমাদের সঙ্গে শিলাইদহে থাকতে এল কিছুদিনের জন্যে—তখন সে তার খাতায় কত যত্নে টুকে রাখত ফকিরদের কাছে শোনা গান। গগন হরকরার গানও তার খাতায় ছিল!
এবার একটা অন্য কথা বলি–যা কেউ জানে না।
নতুন বউঠানের মতো আমিও একদিন আত্মহত্যা করতে চাইলেম।
সে সেদিন আমার সঙ্গে ছিল।
আমরা তখন একসঙ্গে শিলাইদহে। সে আর আমি। আমরা দুজনেই হয়তো একসঙ্গে মরতাম। কে জানে!
নতুন বউঠান একলা একলা বিষ খেয়ে মরতে পেরেছিলেন। আমরা হয়তো দুজনে একসঙ্গে শেষ হতে চেয়েছিলুম।
সেদিন শিলাইদহের ওপারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে।
বিরাট চর। ধু-ধু করছে। কোথাও শেষ নেই। গ্রাম নেই, লোক নেই, কিচ্ছু নেই। শুধু চর।
সে বললে, এই চরের শেষটা একবার চলো দেখে আসি। সেখানে নাকি রূপকথার দেশ।
আমি বললুম, রূপকথার দেশে গেলে ফিরতে যদি ইচ্ছে নাই করে?
সে বললে, তবে ফিরব না।
আমি বললুম, তোমার পায়ের এই অবস্থায় হাঁটতে পারবে তো?
সে বললে, তুমি তো আছ।
আমরা বেরিয়ে পড়লুম।
হাঁটছি তো হাঁটছি।
কেমন যেন একটা নেশা ধরে গেল।
হঠাৎ সূর্য ডুবে গেল। আর ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার।
আমরা দিক হারালুম।
হাঁটতে-হাঁটতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছোলুম যেখানে ছলাৎছলাৎ জলের শব্দ।
আমরা বোধহয় চরের শেষে বা ধারে চলে এসেছি। অন্ধকারে জল দেখা যাচ্ছে না।
সম্ভবত কয়েক ঘণ্টা হেঁটেছি। কোনও কথা বলিনি দুজনে। শুধু হাত ধরে হেঁটেছি।
আর একটু হাঁটলেই কালো পদ্মার বুক।
আমরা দুজনেই থেমে গেলুম। নতুন বউঠান পেরেছিলেন। আমরা পারলুম না।
ওইটুকু পথ হাঁটবার সাহস হল না আমাদের। আমি ভেবে ছিলুম ওর হাত ছাড়িয়ে একাই চলে যাই, পদ্মার কালো জলে ডুবে মরি। কিন্তু ওর হাত কিছুতেই ছাড়তে পারলুম না। ও আমার মনের ভাব বুঝে আমাকে জড়িয়ে ধরল। পদ্মার তীরে অন্ধকার রাত্তিরে আমি ওর বুকের মধ্যে নীরবে কেমন যেন জুড়িয়ে রইলাম। মরবার ইচ্ছেটা আস্তে আস্তে নিভে গেল।
হঠাৎ মনে হল, বোটে ফিরব কেমন করে?
তা-ও তো জানি না।
আমরা পথ হারিয়েছি।
পথটা অন্ধকারের মধ্যে আন্দাজ করে হাঁটতে লাগলুম।
এবার খুব ক্লান্ত।
মনে হচ্ছে এ-পথ শেষ হবে না। ভীষণ ভয় করছে।
হঠাৎ শুনতে পেলুম কিছু আর্তকণ্ঠের ডাকাডাকি। দেখতে পেলুম লণ্ঠনের আলো।
আমাদেরই খুঁজতে বেরিয়েছে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে স্বয়ং রবি ঠাকুর।
শেষ পর্যন্ত বোটে ফিরলুম।
রবি ঠাকুর বললেন দুটি কথা—এক, স্ত্রী-স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলুম। দুই, তোমাদের এইভাবে একলা বেরোনো বন্ধ। তারপর আমার সঙ্গীটির দিকে শুধু একবার তাকালেন। সেই দৃষ্টিই যথেষ্ট।
আমি ভাবলুম অন্য কথা—সত্যিই যদি মরতে পারতুম। প্রতিদিনের সংসার থেকে দূরে। এই ধু-ধু নির্জনতার মধ্যে। নিঃশব্দ অন্ধকারে। বন্ধুর সঙ্গে।
তবু ভয় করল কেন?
সে কলকাতায় ফিরে গেল।
তার রোজ-রোজ জ্বর হতে লাগল।
তার অসুখ বাড়তেই লাগল।
আমাকে আমার বর কিছুতেই কলকাতায় যেতে দিল না।
আমি শিলাইদহে।
আমি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বললুম, আমি কলকাতা যাবই।
কিন্তু যেতে পারলুম কই?
তার আগেই তো তার মৃত্যুর খবর এল আমার কাছে।
মাগো! আমার তো কোনও বন্ধু নেই।
সেই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু।
সে—আমার পাগল ভাশুর বীরেন্দ্রনাথের একমাত্র সন্তান। বলু। বলেন্দ্রনাথ।
মাত্র ঊনতিরিশ বছর বয়সে চলে গেল।
১০. বলুর আমি কাকিমা
বলুর আমি কাকিমা।
কিন্তু শুধুই কি কাকিমা?
ও আমাকে কাকিমা বলেই ডাকত।
কিন্তু ওই ডাকের সঙ্গে ওর মন, ওর ভালোবাসা মিশে থাকত।
ঠাকুর বাড়িতে এমন করে আমাকে কেউ কখনও ডাকেনি।
আমি ওর চেয়ে বয়েসে চার বছরের ছোট, তবু ওর কাকিমা!
বলু যে আমার চেয়ে বয়েসে বড়, বোধবুদ্ধি লেখাপড়া অন্য সব দিক থেকে বড়, এই ব্যাপারটা আমার আর ওর সম্পর্কের মধ্যে ও নীরবে বুনে দিয়েছিল।
আমি ওর কাকিমা হয়েও ওকে শ্রদ্ধা করতুম। সেই শ্রদ্ধার সঙ্গে ক্রমশ মিশে গেল গভীর ভালোবাসা।
যে ভালোবাসা বুকের মধ্যে শিরায় টান ধরায়, সেইরকম।
আমার খুব ভয় করছে প্রশ্নটা করতে, তবু করছি।
এরই নাম কি প্রেম?
বলু যখন আমার হাত ধরে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলত, মনে হত ওর শরীর থেকে কিছু একটা আমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে।
একদিন বলুকে বললুম সে কথা।
ও একটু হেসে কী সুন্দর করে তাকাল আমার দিকে। আমার চোখে চোখ রেখে জিগ্যেস করল, কী ঢুকে যাচ্ছে জানো?
আমি বললুম জানি, কিন্তু বলতে পারব না।
—কেন, পারবে না কেন?
–সব কথা বলা যায় না।
-কেন বলা যায় না?
—বললে পাপ হয়।
—পাপ হয়! মনের ভাব প্রকাশ করলে পাপ হয়? তুমি সেকেলে অশিক্ষিত মানুষের মতো কথা বলছ। তোমাকে এত পড়িয়ে এই লাভ হল?
—তোমার-আমার যে-সম্পর্ক, তাতে কথাটা বলা যায় না। এ-কথা ভাবাও অন্যায়। বলা তো দূরের কথা।
—তুমি এক নারী। আমি এক পুরুষ। এই আমাদের আদিম সম্পর্ক। সামাজিক সম্পর্কটা মানুষের মনগড়া। আমরা মানব-মানবী। সামাজিক পুতুল নই।
—তবু, কিছুতেই বলতে পারব না।
—তুমিই তো বললে, আমার শরীর থেকে কিছু একটা তোমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। আমি জিগ্যেস করলাম, কী ঢুকে যাচ্ছে?
—কোনও নাম নেই তার। কিছু একটা ঢুকে যাচ্ছে। ব্যস, এইটুকু, বললাম আমি।
বলু বলল, নাম আছে।
আমি বললুম, সে নাম আমি জানিনে।
বলু বলল, আমি জানি।
–কী?
-ইচ্ছে।
আমার বিশ্বাস, বলুর প্রতি ঠাকুরবাড়ির অনেকেই অবিচার করেছেন।
আমার মেজোভাশুর সত্যেন্দ্রনাথ তো বলুকে দেখতে পারতেন না বলেই মনে হয়।
তবে বলুর প্রতি রবি ঠাকুরের অবিচারই আমাকে কষ্ট দিয়েছে সবচেয়ে বেশি।
বলু তার রবিকাকাকে বড্ড ভালোবাসত যে।
বলুর প্রতি ঠাকুরবাড়ির এই অবহেলা ও অবিচারের কথা না লিখলে অন্যায় করা হবে।
বলুর আদর্শ পুরুষ ছিলেন তার ঠাকুরদা দেবেন্দ্রনাথ।
বোলপুরে ভুবনডাঙার নির্জন বিশাল প্রান্তরে দেবেন্দ্রনাথই খুঁজে পান তাঁর সাধনার স্থান।
কী নাম জায়গাটার?
নাম ভুবনভাঙার মাঠ।
কোথায় গো সেই নির্জন ধু-ধু প্রান্তর?
সবাই জানে, বোলপুরে।
বোলপুর তো অনেক বড়। তার চেয়েও বড় বুঝি ভুবনভাঙার মাঠ!
ওই জায়গাটার আলাদা কোনও নাম নেই?
না তো!
দেবেন্দ্রনাথ এই নির্জন প্রান্তরে একটি বাড়ি করলেন। নিজে থাকবেন বলে?
না, না, কেউ যদি চান নির্জনে সাধনা করতে, এখানে থেকে তাঁর সেই ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন।
দেবেন্দ্রনাথ নিজেও থাকতে লাগলেন ভুবনভাঙার মাঠের এই একলা বাড়িতে।
তিনি বাড়িটির একটি নামও রাখলেন—শান্তিনিকেতন! এই বাড়িটার নাম থেকে জায়গাটারও নাম হয়ে গেল শান্তিনিকেতন!
দেবেন্দ্রনাথ একটি ট্রাস্টডিড বা অছিপত্র বানালেন ওই শান্তিনিকেতন বাড়িটার ব্যাপারে। ওই অছিনামায় তিনি তাঁর একান্ত ইচ্ছেটি প্রকাশ করলেন। ইচ্ছেটা হল, ট্রাস্টিরা যেন শান্তিনিকেতনে একটি ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ স্থাপন করেন।
কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছে, ইচ্ছে হয়েই থেকে গেল। তিনি চলে গেলেন। তাঁর ছেলেরা তাঁর ইচ্ছের ব্রহ্মবিদ্যালয়টি তৈরি করে উঠতে পাড়লেন না। হয়তো তাঁরা তেমনভাবে চাননি। হয়তো তাঁরা অন্যান্য কাজে বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
বলু একদিন আমাকে বলল, আমি পিতামহের স্বপ্নটি পূর্ণ করতে চাই। কাজটা মহৎ কাজ। আমি করবই।
–কী কাজ গো? আমি একটু অবাক হয়েই জিগ্যেস করলুম।
সে বলল, কী কাজ মানে? তোমাকেও আমার সঙ্গে কাজ করতে হবে। মনে মনে তৈরি হও। খুব বড় দায়িত্ব কিন্তু।
–কী কাজ শুনি।
—তুমি হয়তো জানো না, পিতামহের ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করার। কাজটা তিনি করে যাবার সময় পাননি। আমিই উদ্যোগ নিয়ে কাজটা করব।
–ওরে বাবা, সে তো বিশাল ব্যাপার। আমি কী দায়িত্ব নেব! তা ছাড়া তোমার কাকার সংসার সামলাতেই তো আমি দিনরাত ব্যস্ত।
আমার কথা শুনে বলু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বোধহয় ওর মন খারাপ হয়ে গেল। ও আমাকে পাশে চেয়েছিল। ও যেমন আমার হাত ধরে হাঁটত তেমনি ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারেও আমার হাত ধরে এগোতে চেয়েছিল বলু। আমি ওকে নিরাশ করেছিলুম। আমার কোনও উপায় ছিল না। ওঁর অনুমতি না পেলে আমি বলুর পাশে দাঁড়াব কী করে?
-তোমার কাকা-জ্যাঠাদের অনুমতি নিয়েছ? জিগ্যেস করলুম। জানতুম বিশেষ করে রবিকাকার অনুমতি ছাড়া বলু একাজে হয়তো হাত দেবে না।
বলু বলল, রবিকাকা তেমন উৎসাহী বলে মনে হল না।
বলুর সঙ্গে আমার এসব কথা হচ্ছিল ও যখন আমাদের সঙ্গে শিলাইদহে, সেই সময়ে।
আপনাদের রবি ঠাকুর তখন অন্য ভাবধারায় চলছিলেন। জোড়াসাঁকোতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যে তৈরি হয়েছিল গৃহবিদ্যালয়। সেখানে ইস্কুলের নিয়মরীতি ঠিক মানা হত না। এক ধরনের আবাঁধা শিক্ষাব্যবস্থা বলা যায়।
আমাকে উনি জোড়াসাঁকো থেকে ছেলেমেয়ে সমেত উপড়ে নিয়ে গিয়ে ফেললেন শিলাইদহে। সেখানেই চালু করলেন নতুন এক গৃহবিদ্যালয়। যেখানে আমার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে লাগল। স্বভাবতই ব্রহ্মবিদ্যালয় সম্পর্কে বলুর উৎসাহে তিনি জল ঢেলে দিলেন।
বলু শিলাইদহ থেকে কলকাতা ফিরে আসার দিন দুই আগে আমার সঙ্গে একা বসেছিল বারান্দায়।
হঠাৎ আমার হাতটি ওর বুকের মধ্যে ধরে বলল, তুমি জানো, আমি একেশ্বরবাদী।
আমি কী করব, কী বলব ভেবে পেলুম না। আমার শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে এল। বুক ভিজে গেল ঘামে।
বলু বলল, কথা দাও, মনে-মনে আমার সঙ্গে থাকবে। আমি কলকাতায় ফিরে একাই কাজে নামছি। জানব, তুমি আছ সঙ্গে।
–কোন কাজ?
—একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের কাজ। ঠাকুরদার ইচ্ছে তো তাই ছিল।
বলেন্দ্রনাথের কল্পনায় যেমন ছিল, ঠিক তেমনি একটি ব্রহ্মবিদ্যালয়ভবন তৈরি হল শান্তিনিকেতনে।
কিন্তু ততদিনে বলু চলে গেছে।
কে দ্বার-উদঘাটন করলেন সেই ভবনের?
কে আবার বলুর জ্যাঠামশাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কী বললেন তিনি?
বললেন অনেক কথা—বললেন এতদিনে পূর্ণ হল তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথের সংকল্প।
শুধু একটিবারও একটি নাম উচ্চারণ করলেন না।
বলেন্দ্রনাথের নাম—যে বলু ছাড়া ব্রহ্মবিদ্যালয় কোনওদিন তৈরিই হত না তার নামটিই ভুলে গেলেন আমার মেজোভাশুর!
আমি অবিশ্যি বলুর পাশে দাঁড়াতে পারিনি। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের দ্বার-উদঘাটন অনুষ্ঠানেও আসতে পারিনি।
আমি তখন শিলাইদহের নির্বাসনে।
আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে পরিষ্কার বলে দিলেন, কলকাতার ভিড়ে আমার জীবনটা বড় নিষ্ফল হয়ে থাকে। কাজেই আমার জন্যে তোমাকে এই নির্বাসনদণ্ড গ্রহণ করতেই হবে। তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না, আমি কলকাতায় নিজের সমস্ত শক্তিকে গোর দিয়ে বসে থাকি।
সত্যিই তো! কী করে তা চাই? আমি যে রবি ঠাকুরের বউ। আমার পক্ষে কী করেই বা বলুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করা সম্ভব হত?
এই ঘটনার মাস ছয় পরে, বাইশে ডিসেম্বর।
রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করলেন ব্রহ্মবিদ্যালয়!
তিনি বললেন, এই কাজে তিনি পিতার অনুমতি নিয়েছিলেন এবং এই কাজটিকে তিনি ‘পিতার আরদ্ধ সম্পাদন’ বলে কী সুন্দর ব্যাখ্যা করলেন।
আমার শুধু বলুর কথা মনে পড়ে চোখে জল এল।
আমি বলুকে মনে মনে প্রণাম করলাম। আর তার কপালে চুমু খেলাম। আর তার মাথাটি বুকের মধ্যে ধরে খুব কাঁদতে লাগলাম। হে আমার রবীন্দ্রনাথ, তুমিও ব্রহ্মবিদ্যালয়ের উদঘাটন উৎসবে একটিবারও বলুর নামটি উচ্চারণ করলে না!
কেন এত রাগ গো তোমার ওর ওপর?
তোমাকে একটি কথা জানিয়ে যাই রবি ঠাকুর। তোমাদের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের দ্বার-উদঘাটন যখন চলছে আর যখন তুমি তোমার ভাষণ পাঠ করছ, আমি একা গৃহকোণে বসে গাইছিলুম বলুর লেখা একটি গান—ওই আমাকে শিখিয়েছিল আর বলেছিল এই গানটি আমার গলাতেই ওর সবচেয়ে শুনতে ভালোলাগে—
অসীম রহস্যমাঝে কে তুমি মহিমাময়!
জগৎ শিশুর মতো চরণে ঘুমায়ে রয়।
অভিমান অহংকার মুছে গেছে নাহি আর
ঘুচে গেছে শোকতাপ, নাহি দুঃখ নাহি ভয়।
কোটি রবি শশী তারা, তোমাতে হতেছে হারা
অযুত কিরণ ধারা তোমাতে পাইছে লয়।
১১. কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে
আমাকে ওরা কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে এসেছে।
আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই বাড়িরই সব দায়িত্ব পালন করতে-করতে আর সন্তানের জন্ম দিতে দিতে, আর তাদের বড় করতে-করতে আমি মৃত্যুর দরজায়। আমি চোখে ভালো দেখতেও পাচ্ছি না।
আমার হাত কাঁপছে। নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।
তবু দু-একটা কথা এখনও লিখতে বাকি। আমার নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে শেষ দুটি বন্ধু পেয়েছিলুম–
আমার দুই মেয়ে, মাধুরীলতা (বেলা) আর রেণুকা।
গত বছর ১৫ জুন রবি ঠাকুর মাধুরীলতাকে জোর করে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে খুব ভেবেচিন্তে! কার সঙ্গে? সেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলের সঙ্গে, যে বিহারীলাল ছিলেন নতুন বউঠানের ভক্ত বন্ধু!
বেলার বয়স মাত্র পনেরো।
আমি রেণুকাকে বুকে করে বেঁচে ছিলুম।
বেলার বিয়ের মাত্র একমাস চব্বিশ দিন পরে ও তাকেও কেড়ে নিল আমার বুক থেকে।
বিয়ে দিয়ে দিল মাত্র দশ বছর বয়সে।
কারণ বাবামশায় ১৮৯৯-এর ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শেষ উইল করেছেন। সেই উইল অনুসারে বাবামশায় বেঁচে থাকতে থাকতে মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলে বিয়ের খরচের প্রায় সবটাই পাওয়া যাবে জোড়াসাঁকোর তহবিল থেকে! কী চমৎকার হিসেব!
আমার কোলের ছেলে শমী, মাত্র ছ’বছর বয়েস, কী দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।
ওকে কতবার বললুম, যাওয়ার আগে শমীকে একটিবার দেখে যাই, ওকে নিয়ে এসো!
কোথায় শমী?
রথী, তাকেও তো আসতে দিলেন না।
এখন আর আমার কারও সঙ্গে কথা বলার শক্তি নেই।
লিখতেও আর পারছিনে।
শুধু থামবার আগে আরও দু-একটা কথা লিখতেই হবে।
খুব এলোমেলোভাবে লিখেছি। সেই জন্যে ক্ষমা চাইছি।
কী করব—শরীর যে আর পারছে না।
রবি ঠাকুরকে কখনও তুমি, কখনও আপনি বলেছি এই লেখায়।
যখন কাছের, তখন তুমি।
যখন দূরের তখন আপনি। ব্যস।
আমি লেখাটা আমার সিন্দুকের একটা গোপন কোঠরে লুকিয়ে রাখছি।
যদি কোনওদিন এমন কারও হাতে পড়ে, যিনি এটিকে ঠাকুরবাড়ির বাইরে নিয়ে যাবেন…।
আমার শেষ ইচ্ছে ছিল—চলে যাওয়ার আগে শমীকে একবার শুধু দেখা—একটি চুমু দেওয়া ওর ছোট্ট নরম ঠোঁটে।
ভালো থাকিস বাবা!
তোরা সব্বাই ভালো থাকিস।
উনিও যেন ভালো থাকেন।
ঈশ্বর তোমাদের সঙ্গে থাকুন।
১৩ই নভেম্বর, ১৯০২।
১২. উপসংহার
মৃণালিনীদেবীকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্যে দিয়ে আসা হয় ১৯০২-এর ১২ সেপ্টেম্বর। ১৩০৯-এর ২৭ ভাদ্র।
তাঁকে জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্রনাথের লালবাড়ির দোতলায় একটি ঘরে রাখা হয়। সেই বাড়িতে কোনও বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না।
দেখা যাচ্ছে এই লালবাড়ির ওই ঘরেই তিনি তাঁর আত্মজীবনীটি লেখা শেষ করেন কলকাতায় আসার পরের দিনই—১৩ সেপ্টেম্বর। মৃত্যুর দু-মাস আগে। আচ্ছন্ন অবস্থায় মৃণালিনী বারবার বলতেন, আমাকে উনি বলেন ঘুমাও, ঘুমাও। শমীকে রেখে এলেন শান্তিনিকেতনে, ওইটুকু ছেলেকে ছেড়ে আমি কি ঘুমাতে পারি? বোঝেন না সেটা?
মৃণালিনীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হল ১৭ নভেম্বর। মৃত্যুর আগের দিন বড় ছেলে রথীকে শেষ দেখা দেখলেন মৃণালিনী।
সেই কথা এইভাবে আছে রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায়—
‘মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে শুধু নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা।’
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মৃণালিনীদেবীর জীবনাবসান হল ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর। দু-মাস এগারোদিন তিনি কলকাতায় মৃত্যুশয্যার যন্ত্রণা পেয়েছেন।
রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন মায়ের মৃত্যুদিনটির কথা—
‘আমাদের ভাইবোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরোনো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারারাত জেগে কাটল। ভোরবেলার অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম, কোনও সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম, আমাদের মা আর নেই। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
মৃণালিনীর দেহ সেই রাত্রেই শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল।
ছেলেমেয়েরা কেউ জানতেই পারেনি কখন।
শমীকে শেষবারের মতো দেখে যেতে পারেননি মৃণালিনী।
পুত্র রথীন্দ্রনাথকে শ্মশানে যেতে, মুখাগ্নি করতে দেননি রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও শ্মশানে যাননি।
নিতান্ত নম নম করে সারা হয় মৃণালিনীর অন্ত্যেষ্টি। খরচ ২৮ টাকা ২ পয়সা।
সেই দিনই সকালে রথীকে ডেকে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ, মৃণালিনীর ব্যবহৃত চটি জোড়াটি তাকে দিয়ে বললেন, রেখে দিস, তোকে দিলুম।
ঠিক পরের দিন থেকে রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন স্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি লিখতে—প্রতিদিন দু-একটি করে।
সাতাশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হল ‘স্মরণ’ পরের বছর, মোহিতচন্দ্র সেনের সম্পাদনায়, রবীন্দ্র কাব্যগ্রন্থের ষষ্ঠভাগে।
স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থ রূপে ‘স্মরণ’-এর প্রকাশ ১৯১৪-র ২৫শে মে, মৃণালিনীর মৃত্যুর বারো বছর পরে।
উৎসর্গ পত্রে কোনও নাম নেই।
শুধু একটি তারিখ।
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯।
মৃণালিনীর প্রয়াণদিবস।