- বইয়ের নামঃ আমি রবি ঠাকুরের বউ
- লেখকের নামঃ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০০. মুখপাত
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনীর একটিই পরিচয়-তিনি রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী। এবং সহমর্মিণীও।
তাঁর যেন আর কোনও পরিচয় নেই।
এই নারী বেঁচে ছিলেন মাত্র আঠাশ বছর।
উনিশ বছর কাটিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বউ হয়ে।
মৃণালিনীর প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি বই এবং প্রবন্ধ।
কেমন ছিল মৃণালিনীর জীবনের অন্তরমহল?
রবি ঠাকুরের বউ-হওয়া ‘ব্যাপারটা’ আসলে ঠিক কেমন?
মৃণালিনী প্রসঙ্গে কোনও গ্রন্থে, কোনও নিবন্ধে নেই এই অন্তরএষণা।
এই নারীর দাম্পত্যজীবনের গহনে আজও পৌঁছোয়নি কোনও ডুবসাঁতারু অনুসন্ধান।
রবীন্দ্রনাথের চিঠির উত্তরে মৃণালিনীও নিশ্চয় লিখেছিলেন অনেক চিঠি।
সেই সব চিঠিতে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বেদনাদীর্ণ উচ্চারণও ছিল নিশ্চয়।
একটি চিঠিও পাওয়া যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের অব্যর্থ পৌরহিত্যে লুপ্ত হয়েছে সেই আর্তিময়, অসহায় পত্রগুচ্ছ।
মৃণালিনী যদি লিখতেন তাঁর আত্মকথা?
সেই লুকোনো আত্মকথারও বিলোপন ঘটত নিঃসন্দেহে।
এমনই যে ঘটেনি, এ-কথাই বা বলি কী করে?
কী লিখতেন মৃণালিনী তাঁর লুকোনো আত্মকথায়?
এই উপন্যাসে সেটাই ভাবার চেষ্টা করেছি।
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৩
০১. ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৬
১৮৮৬ থেকে ১৮৯৬।
এই দশ বছরের মধ্যে আমাকে পাঁচটি ছেলেমেয়ে দিলেন আপনাদের রবি ঠাকুর।
আঁতুড়ঘর থেকে আমি তো প্রায় বেরোতেই পারিনি।
আমার সঙ্গে রবি ঠাকুরের বিয়ে হল ১২৯০-এর ২৪শে অঘ্রাণ। ওঁর কাছে পরে জেনেছি, ইংরেজি তারিখটা ছিল ১৮৮৩-র ৯ই ডিসেম্বর।
আমার বয়েস তখন ন’বছর ন’মাস।
আর আপনাদের রবীন্দ্রনাথ কী সুন্দর দেখতে। তরতাজা তেইশ।
আমার প্রথমটি মেয়ে। বেলা। ও পেটে এল আমার এগারো বছর ক’মাস বয়েসে।
প্রথম মা হয়ে মেয়ের মুখ দেখলাম বারো বছর বয়েসে। সেই শুরু।
আমার বড় ছেলে রথী পেটে এল পরের বছর। জন্মাল ১৮৮৮-র ডিসেম্বরে।
এর পর জন্মাল আমার সেজো মেয়ে, আমার তৃতীয় সন্তান রেণুকা।
তারিখগুলো সব গন্ডগোল হয়ে যায়। যতদূর মনে পড়ছে রেণুকা বা রানির জন্মদিন ১৮৯১ এর ২৩শে জানুয়ারি।
অই যাঃ। আপনাদের রবি ঠাকুরের মতো আমি লেখক নই। গুছিয়ে লিখতে পারিনে।
বেলা, যার ভালো নাম মাধুরীলতা, তার জন্মদিন আর রথীর জন্মদিনের কথা তো বলাই হল না।
যতদূর মনে পড়ছে, বেলা জন্মেছে ১৮৮৬-র ২৫শে অক্টোবর, মনে আছে, পুজোর মাস। আর রথীর জন্মদিন ২৭শে ডিসেম্বর।
শীতকাল, খুব শীত পড়েছিল সেবার, আঁতুড়ঘরে খুব কষ্ট পেয়েছিলুম। শীতকালে যাদের
ছেলেপুলে হয়েছে সেই মায়েরা বুঝবে আমার কষ্টের কথা।
রেণুকা জন্মাল আবার শীতকালেই।
শীতকাল মানেই যেন আঁতুড়ঘর।
শীতকাল এলেই আমার ভয় করত।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি কী সুন্দর বাড়ি বলুন তো! কিন্তু সে-বাড়ির ওই আঁতুড়ঘরটা যদি দেখতেন, বুঝতেন কেন বলছি এ-কথা।
শীতকালে ওই ঘরটা ছিল বাড়ির সবচেয়ে ঠান্ডা আর অন্ধকার ঘর। এতটুকু রোদ্দুর ঢুকত না।
আমার ছোট মেয়ে মীরা, যার একটা পোশাকি নামও আছে–অতসীলতা—সেও আমাকে রেহাই দিল না।
জন্মাল সেই শীতকালেই।
মাপ করবেন যদি তারিখের গন্ডগোল করে ফেলি। এতগুলো জন্মদিন তো। মীরা জন্মাল ১৮৯৪-এর ১২ই জানুয়ারি।
উনি হেসে বললেন, ‘আমার কনিষ্ঠ শাবক।’
‘আমাদের’ বললেন না কেন?
চোখে জল এল আমার।
১৮৯৬ সালে এল আমার ছোট ছেলে। আমার পাঁচ নম্বর। শমী। শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠিক ওঁর মতো দেখতে।
ও নিশ্চয় শীতকালে জন্মায়নি?
আপনারা ভাবছেন তো!
শমীও শীতে।
১২ই ডিসেম্বর।
আমার পাঁচ ছেলেমেয়ের চারটিই শীতকালে।
আর বেলা মানে মাধুরীলতা, ও শরৎকালে।
কী আশ্চর্য, ওর বরের নামও শরৎ! ওঁকে একদিন মজা করে বললুম, দ্যাখো তো, বেলির সঙ্গে শরতের সম্পর্ক সেই জন্ম থেকেই।
উনি এতটুকু হাসলেন না।
উনি যে কতবার বলেছেন, আমার কোনও রসবোধ নেই। যে-মেয়েদের সঙ্গ উনি পছন্দ করেন, যাদের কথা শুনতে, যাদের সঙ্গে কথা বলতে, যাদের চিঠি লিখতে ওঁর ভালো লাগে, তাদের মধ্যে আমি পড়ি না। একটিই কারণ, আমার তেমন শিক্ষাদীক্ষা নেই। সুতরাং বোধবুদ্ধিরও খোলতাই হয়নি।
ইন্দিরা, আমার মেজোভাশুর সত্যেন ঠাকুরের মেয়ে, আমার চেয়ে মাস কয়েকের ছোট, ওর সঙ্গে আপনাদের রবি ঠাকুরের খুব ভাব। উনি যে কত চিঠি ওকে লিখেছেন।
আর সে সব কী লম্বা-লম্বা চিঠি। চিঠি নয় তো, সব মনের কথা, কত ভাবনা, আমাকে কোনওদিন বলেন না সেসব।
ইন্দিরা যে ওঁর ভাইঝি, সে কথা উনি ভুলে যান।
মনে হয় ইন্দিরা ওঁর বন্ধু। মনের মানুষ।
পরের চিঠি পড়তে নেই। তবু আমি ইন্দিরাকে লেখা কিছু-কিছু চিঠি না পড়ে পারিনি। সব যে বুঝতে পেরেছি তা নয়।
তবে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি।
ইন্দিরার সঙ্গে উনি হৃদয়ের কথা বলতে পারেন।
কোনও রাখঢাক নেই। সব কথা।
কারণ, উনি জানেন, ইন্দিরা বুঝতে পারে।
আমার সঙ্গে মনের কথা বলেন না।
আমি যে বুঝতে পারব না, উনি খুব ভালো করেই জানেন।
আমার মনে আছে বিবিকে, মানে ইন্দিরাকে, ওর ডাক নাম তো বিবি, ও তো খুব মেমসায়েব মেমসায়েব, কতদিন বিলেতে ছিল, তাই ওর ডাক নাম বোধহয় বিবি, ইংরিজিতে কথা বলতে পারে, আবার ফরাসিতেও কথা বলতে পারে, ওকে একটা চিঠিতে উনি লিখেছেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে—