- বইয়ের নামঃ দোজখনামা
- লেখকের নামঃ রবিশংকর বল
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. আমার জীবনে এমন সব ঘটনা
নিবেদন
‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর ‘রোববার’ ক্রোড়পত্রিকায় ২০০৯ সালে এক বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছিল এই উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রকাশের বিষয়ে সম্পাদক শ্রীঋতুপর্ণ ঘোষ যে-আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, সেজন্য তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। প্রকাশনার নানা পর্বে সাহায্য করেছেন ক্রোড়পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক শ্রীঅনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও তরুণ সহকর্মী শ্রীভাস্কর লেট। ‘সংবাদ প্রতিদিন’ এর সম্পাদক শ্রীসৃঞ্জয় বোস নানা বিষয়ে আমাকে উৎসাহ দিয়ে থাকেন; এই উপন্যাস প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি। বন্ধু শ্রীদেবাশিস বিশ্বাস প্রয়োজনীয় সংশোধনের কাজ করে দিয়েছেন।
এবার শুধু আপনাদের পৃষ্ঠা ওল্টানোর অপেক্ষা। পাঠিকা/পাঠক আমার নমস্কার গ্রহণ করুন।
রবিশংকর বল
শ্রাবণ ১৪১৭
০১.
আমার জীবনে এমন সব ঘটনা এসে হানা দিয়েছে, যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আমি ঘটনাগুলোকে বোঝবার চেষ্টা করেও এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করি না। মনে হয়, ওরা যে আমার জীবনে অযাচিত ভাবে এসেছে, তার চেয়ে গভীর অর্থ আর কী হতে পারে! একদিন রাস্তায় এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে আপনি যদি এমন কাউকে দেখে ফেলেন, যাকে চিত্রে বা স্বপ্নে দেখা যায়, হয়তো একটা মুহূর্তের জন্য মুখোমুখিও দেখা হয়ে যেতে পারে, তবে কী মনে হবে আপনার? মনে হবে না, এক আশ্চর্য দরজা খুলে গেছে আপনার সামনে?
সেবার লখনউতে গিয়ে এমন এক আশ্চর্য দরজাই খুলে গিয়েছিল আমার সামনে। খবরের কাগজের কলম পেষা মজুর আমি, গিয়েছিলাম লখনউয়ের তবায়েফদের নিয়ে একটা লেখার খোঁজে। লখনউতে পৌঁছে প্রথম দেখা করি পরভিন তালহার সঙ্গে; তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, লখনউয়ের ইতিহাস তাঁর চোখের পর্দায় ভাসতে দেখেছিলাম। পরভিন আমাকে বলেছিলেন, যে-তবায়েফদের কথা আপনি হালির পুরনো লখনউ বইতে, উমরাও জান উপন্যাসে পড়েছেন, তাঁদের দেখা লখনউতে আর পাবেন না। সত্যিই পাইনি। আমি তাই নানা মানুষের মুখে শোনা গল্প লিখে নিচ্ছিলাম ডায়েরিতে। এইসব গল্পই বা কম কী? বংশ পরম্পরায় যে-গল্প বয়ে চলেছে, তাকে ইতিহাসের চেয়ে ছোট করে দেখা, অন্তত, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এইরকম, এর ওর মুখ থেকে গল্প শুনতে শুনতে আমি গিয়ে পৌঁছলাম পুরনো লখনউতে, ফরিদ মিঞার কাছে। ধুলোয় ঢাকা ওয়াজিরগঞ্জ। রোদ থাকলেও এমন ছায়ায় জড়ানো যাকে একটা। লুপ্ত শহরই বলা যায়। আমি দূর থেকে দেখেছিলাম ‘আদাবিস্তান’ নামের সেই বিরাট মহল, যেখানে উর্দু লেখক নাইয়ের মাসুদ থাকেন। এই নিয়তি-তাড়িত লেখককে দেখার ইচ্ছে আমার ছিল, কিন্তু উর্দু না জেনে, কীভাবে তাঁর গল্পের প্রতি মুগ্ধতা আমি জানাব? ইংরেজি বা হিন্দি বলা যেত, কিন্তু নাইয়ের মাসুদের সঙ্গে উর্দুতে কথা না বলতে পারলে, তাঁর কথোপকথনের রহস্য। কী বোঝা সম্ভব? এসবই আমার কল্পনা। লেখক আর তাঁর লেখা তো মেলে না।
ফরিদ মিঞার বসার ভঙ্গি দু-হাঁটু মুড়ে নামাজ আদায় করার মতো। আমার সঙ্গে যতক্ষণ কথা বলছিলেন, একই ভাবে বসেছিলেন। তায়েফদের অনেক গল্প বলার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিস্সা লেখেন?’
-ওই আর কি
-আমিও একসময় লিখতাম।
-এখন আর লেখেন না?
-না।
-কেন?
-কিস্সা লিখলে বড় একা হয়ে যেতে হয়, জনাব। আল্লা যাকে কিস্সা লেখার হুকুম করেন, তাঁর জীবন জাহান্নাম হয়ে যায় জি।
-কেন?
-শুধু ছায়া ছায়া মানুষেদের সঙ্গে থাকা তো।
-তাই কিস্সা লেখা ছেড়ে দিলেন?
-জি জনাব। জীবনটা কারবালা হয়ে যাচ্ছিল। কারবালা জানেন তো?
-মহরমের কাহিনিতে
-হ্যাঁ। কারবালা কী? সে কী শুধু মহরমের কথা? কারবালা মানে রি জীবন যখন মৃত্যুর প্রান্তর হয়ে ওঠে। কিস্সা লেখার নিয়তি এইরকমই জনাব।
-কেন?
-ওই যে, ছায়া ছায়া মানুষেরা তাকে সবসময় ঘিরে থাকে, তার সঙ্গে কথা বলে, আর কী যে পাগলামির দিকে নিয়ে যায় ওরা। আপনার কখনও এমন হয়নি?
হ্যাঁ।
-আপনার বিবি জিজ্ঞেস করেননি, কেন এই কিস্সাটা লিখলে?
-হ্যাঁ।
-আমাকেও কতবার বিবি জিজ্ঞেস করেছেন। কী বলব? আমি যা বলব, তাতেই তিনি হাসবেন, আর বলবেন, আপ পাগল হো গিয়া মিঞা।
-তাই কিস্সা লেখা ছেড়ে দিলেন?
-জনাব, আমি আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পেরেছি। দাওয়াত দিতে পারব না। এই তো কিস্সা লেখক।
তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। আমি তাঁর অন্দরমহলের চবুতরা থেকে ভেসে আসা পায়রাদের বকবকম শব্দের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম। এক সময় তাঁর গলা কবুতরের ডাকের ধূসরতার ভিতর ঢুকে পড়ল, ‘আমি একটা কিস্সা নিয়ে বড় মুসকিলে আছি, জনাব।
-কোন কিস্যা?
তিনি কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, আপনি একটু বসতে পারবেন?
-জরুর।
-কিস্সাটা তাহলে আপনাকে দেখাই।
-আপনার লেখা?
-না। ফরিদ মিঞা হাসেন। – একটু অপেক্ষা করুন। এও এক আশ্চর্য কিস্সা জনাব।
তিনি হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে ভিতরে চলে গেলেন। ভিতরে যাওয়ার দরজার ওপরে একটা মৎস্যকন্যা। হঠাৎ দৌড়ে কে একজন ঘরের ভিতরে এসে ঢুকল। কালো, লোমে ভরা একটা শরীর, আমার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বলতে শুরু করল, ‘মিঞা, পাগল হয়ে গেছে আপনি জানেন না?’