কিছুক্ষণ পরে একটা লোক তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে এসে ঢুকল। সে দেখল। অন্য একটা লোক চোখ বন্ধ করে মেঝেয় পড়ে থাকা কোনও কিছুর ওপর কাঁপা কাঁপা হাতে কম্বল ছুঁড়ে দিচ্ছে। লোকটা চিৎকার করে উঠল, কওন হো তুম?
কাসিম চমকে উঠে ফিরে তাকাল।
কাসিম! এখানে কী করছ?
কাসিম কাঁপতে কাঁপতে মেঝেয় পড়ে থাকা কম্বলটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ডুকরে উঠল, শরিফান
যারা হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে কত লোক এভাবেই যে পাগল হয়ে গেছে। এরা তো কেউ হত্যাকারী নয়, মির্জাসাব। তাই ঠাণ্ডা মাথায় এত বড় পাপকে সারাজীবন বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ সব তো পারে রাজনীতির মানুষরা, ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই যারা আর কখনও ভালবাসেনি, তারা প্রিয়জনের রক্তও তো হাত থেকে মুছে ফেলতে পারে। কিন্তু। কাসিমের মতো মানুষের কাছে শরিফান, বিমলা – সবাই একাকার হয়ে যায়। শুধু তো নিজের ঘর, দেশ থেকে নয়, মানুষ এভাবে সম্পর্ক থেকেও উৎখাত হয়ে যায়, সে তখন মহাকাশ থেকে ছিটকে পড়া একটা উল্কা খণ্ড। এতটাই পরিত্যক্ত যে নিজের কাছেও তার আশ্রয় নেই। মানুষ মেরেছি আমি-তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে। আমিই তো একটা বধ্যভূমি হয়ে বেঁচে
আছি। আমার স্মৃতির বধ্যভূমিতেই তো ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই মা, মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যায় সে, তারপর একদিন মরে পড়ে থাকে রাস্তায়। আমি তখন পাকিস্থানে মির্জাসাব। তখনও। মুসলমানরা ওপার থেকে এপারে আসছে; হিন্দুরা পাকিস্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু শিবিরগুলি যেন গরু-ছাগলের খোঁয়াড়। খাবার নেই, চিকিৎসা নেই। মানুষ পোকার মতো মরছে। এপারে-ওপারে যেসব নারী ও শিশু পালিয়ে গিয়েছিল, আসলে অপহরণ করা হয়েছিল, তাদের উদ্ধার করার কাজ চলছে। কত মানুষ যে স্বেচ্ছায় সে-কাজে যোগ দিয়েছিল। দেখে মনে আশা জাগত। সব তা হলে শেষ হয়ে যায়নি। খোদা নিশ্চয়ই মানুষকে একাবারে নষ্ট হয়ে যেতে দেবেন না। স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে কত ঘটনাই না শুনতাম। একজন বলেছিল, সাহারানপুরের দুটি মেয়ে নাকি আর মা-বাবার কাছে ফিরতে চায় না। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে কত যে মেয়ে লজ্জায়-ঘৃণায় আত্মহত্যা করেছিল। অত্যাচারিত হতে হতে নেশায় ডুবে গিয়েছিল অনেকে, তেষ্টা পেলে জলের বদলে মদ চাইত, না দিলে তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসত খিস্তির স্রোত।
মির্জাসাব, এইসব অপহৃত মেয়ের কথা ভাবলে আমি শুধু তাদের ফুলে-ওঠা পেট দেখতে পেতাম। পেটগুলোর ভেতরে যারা আছে, তাদের কী হবে? কে নেবে ওদের? ভারত না পাকিস্থান? আর দশ মাস ধরে বহন করার দাম কোন দেশ দেবে? নাকি এর কোনও মূল্য নেই? সবটাই আমরা প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেব?
ওপার থেকে হারিয়ে যাওয়া মুসলমান মেয়েরা এপারে আসছিল; এপারের ঠিকানাহীন হিন্দু মেয়েরা ওপারে চলে যাচ্ছিল। ওদের সরকারি ভাবে বলা হল পলাতক। কিন্তু আসলে তো কেউ পালায়নি। তাদের অপহরণ করা হয়েছিল, উপযুপরি ধর্ষণ করা হয়েছিল; কেউ পাথর হয়ে গিয়েছে, কেউ উন্মাদ, কেউ তার অতীতকেই মুছে ফেলেছে।
সে-ই মায়ের কাহিনীটা আমাকে একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেছিল।
-সীমান্তের ওপারে তো আমাদের বহুবার যেতে হয়েছে, মান্টোসাব। প্রত্যেকবার একজন। মুসলিম বৃদ্ধাকে দেখেছি। প্রথমবার জলন্ধরে। পরনে ছেঁড়া কাপড়, মাথার চুল ভর্তি ধুলো ময়লা, সবসময় কাউকে খুঁজে চলেছেন।
-কাকে?
-ওর মেয়েকে। বৃদ্ধার ঘর ছিল পাতিয়ালায়। দাঙ্গায় ওঁর একমাত্র মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটিকে খোঁজার অনেক চেষ্টা হয়েছিল, পাওয়া যায়নি। হয়তো খুনই হয়ে গিয়েছিল। বৃদ্ধাকে সে-কথা বললেও কিছুতেই মানতেন না। দ্বিতীয়বার তাঁকে দেখেছিলাম সাহারানপুরে। তখন ওঁর চেহারা আরও খারাপ, আরও নোংরা। চুলে জটা ধরে গেছে। অনেকবার কথা বলে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, মেয়েকে খোজার চেষ্টা ছেড়ে দিন। ওকে মেরে ফেলেছে। বৃদ্ধা বিড়বিড় করে বললেন, মেরে ফেলেছে?…না কিছুতেই না। ওকে কেউ মারতে পারে না। আমার মেয়েকে কেউ মারতেই পারবে না।
-তারপর?
-তৃতীয়বার যখন তাঁকে দেখলাম, তখন বৃদ্ধার শরীরে একফালি ন্যাকড়া, প্রায় নগ্ন। আমি কাপড় কিনে দিতে চাইলেও নিলেন না। আমি আবার তাঁকে বোঝালাম, আমাকে বিশ্বাস করুন। আপনার মেয়ে পাতিয়ালাতেই খুন হয়ে গেছে। বৃদ্ধা বিড়বিড় করে বললেন, কেন মিথ্যে বলছ?
-মিথ্যে নয়। মেয়ের জন্য আপনি তো অনেক চোখের জল ফেলেছেন। চলুন আপনাকে পাকিস্থানে নিয়ে যাব।
-না-না-আমার মেয়েকে কেউ মারতেই পারে না।
-কেন?
বৃদ্ধার কণ্ঠস্বরে যেন শিশির ছড়িয়ে পড়ল।-ও কী সুন্দর ছিল, জানো না! এত সুন্দর-ওকে কেউ মারবেই না। চড় মারতে গেলেও হাত উঠবে না।
-আশ্চর্য।
-আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম মান্টোসাব। এত মার খাওয়া মানুষও বিশ্বাস করতে পারে, সুন্দরকে কেউ হত্যা করবে না।
-মার খাওয়া মানুষই তো পারে, ভাই। মার খেতে খেতে তার শেষ অবলম্বন তো সামান্য একটু সৌন্দর্য। তারপর কী হল?
-সীমান্তের ওপারে যতবার গেছি, বৃদ্ধাকে দেখেছি। দিনে দিনে তাকে প্রায় কঙ্কাল হয়ে যেতে দেখেছি। একসময় চোখেও খুব কম দেখতেন, তবু সবসময় খুঁজে চলেছেন। যত দিন গেছে, ততই তাঁর আশা দৃঢ় হয়েছে, তার মেয়েকে কেউ মারতে পারে না। একদিন তিনি মেয়েকে খুঁজে পাবেনই।