নাদিয়া দোতলা থেকে নামল। দিঘির ঘাটের দিকে রওনা হলো। হাবীব মেয়েকে দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, প্রণবকে তো নিষেধ করেছিলাম তোকে খবর দিতে।
নাদিয়া বলল, কেউ আমাকে খবর দেয় নাই বাবা। আমি নিজ থেকে এসেছি। এখানে বসে আছ কেন?
হাবীব জবাব দিলেন না। হুক্কার কয়লা নিভে গেছে। তারপরেও তিনি অভ্যাসবশে টেনে যাচ্ছেন।
বাবা, কোনো সমস্যা?
সমস্যা হলে কী করবি? সমাধান করবি?
চেষ্টা করতে পারি।
নাদিয়া বাবার পাশে বসল। হাবীব অন্যমনস্কভাবে বললেন, একটা বেনামি চিঠি পেয়েছি।
নাদিয়া বলল, চিঠিতে কী লেখা? তোমাকে খুন করবে এই ধরনের কিছু?
না।
কী লেখা বলো।
হাবীব চুপ করে রইলেন। নাদিয়া বলল, আমাকে নিয়ে নোংরা কোনো কথা?
হুঁ।
এটাই তোমার সমস্যা?
হ্যাঁ।
বাবা শোনো, তোমাদের আদালত কি বেনামি চিঠি গ্রহণ করে?
না।
কাজেই বেনামি চিঠি গুরুত্বহীন। আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আছে, নাম বকুল। মেয়েটার মাথায় মনে হয় কোনো গণ্ডগোল আছে। সে তার ক্লাসমেটদের ঠিকানা জোগাড় করে এবং তাদের বাবা-মা’র কাছে কুৎসিত সব কথা বেনামিতে লিখে পাঠায়। আমি নিশ্চিত আমাকে নিয়ে চিঠিটা সে-ই পাঠিয়েছে। আমি তার হাতের লেখা চিনি। চিঠিটা দাও পড়লেই বুঝব।
হাবীব দিঘির দিকে তাকালেন। কাগজের বল ডুবে গেছে। তিনি হুক্কার নল পাশে রাখতে রাখতে বললেন, চিঠি নষ্ট করে ফেলেছি।
নাদিয়া বলল, সামান্য একটা চিঠির কারণে মুখ ভোঁতা করে বসে থাকার কোনো অর্থ হয়? তুমি আমাকে চেনো। আমাকে দিয়ে ভয়ঙ্কর কোনো অন্যায় হবে না। আমি ভালো মেয়ে।
হাবীব বললেন, বড় বড় অন্যায় ভালো মানুষরা করে।
নাদিয়া বলল, তাহলে মনে হয় আমি ভালোমানুষ না। বড় অন্যায় দূরের কথা ছোট অন্যায়ও আমি করতে পারব না।
পাংখাপুলার রশিদ এসেছে। সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে। হাবীব বিরক্ত গলায় বললেন, কী চাও?
রশিদ ভীত গলায় বলল, বড় মা আপনেরে ডাকে।
হাবীব বললেন, উনি সারা দিনে এক হাজারবার আমাকে ডাকেন। তাই বলে এক হাজারবার আমাকে খবর দিতে হবে? সামনে থেকে যাও।
রশিদ প্রায় দৌড়ে সরে গেল। হাবীব তাকালেন মেয়ের দিকে। কী সহজ সুন্দর মুখ মেয়েটার! তার মা’র চেহারাও সুন্দর, তবে সে সৌন্দর্যে কাঠিন্য আছে। নাদিয়ার মধ্যে তা নেই।
নাদিয়া বলল, কী দেখে বাবা?
হাবীব কিছু বললেন না। দৃষ্টি ঘাটের দিকে ফিরিয়ে নিলেন। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, নাদিয়া তার বান্ধবী বকুল সম্পর্কে যা বলেছে তা মিথ্যা। নাদিয়া জানে তাকে নিয়ে এধরনের বেনামি চিঠি আসতে পারে। কাজেই সে বেনামি চিঠির কারণ নিয়ে গল্প বানিয়ে রেখেছে। নাদিয়াকে ঠিকমতো জেরা করলেই সব বের হয়ে যাবে। তার জেরার মুখে কঠিন আসামিও মাখনের মতো গলে যায়। আর এই মেয়ে তো শুরুতেই মাখন। তিনি হুক্কার নল মুখে নিয়ে কয়েকবার টানলেন।
নাদিয়া বলল, আগুন নিভে গেছে বাবা। কাউকে বলি কল্কে সাজিয়ে দিক।
না। তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, জবাব দিবি। নাদিয়া হাসিমুখে বলল, জবাব দেওয়ার আগে কি আদালতের মতো প্রতিজ্ঞা করব—যাহা বলিব সত্য বলিব।
প্রতিজ্ঞা লাগবে না। তোদের ক্লাসের মেয়েটার নাম বকুল?
হ্যাঁ।
কীভাবে নিশ্চিত হলি বেনামি চিঠি সে-ই পাঠায়?
তার রুমমেট বলেছে। সে হাতেনাতে ধরেছে।
রুমমেটের নাম কী?
শেফালি।
শেফালির নামেও চিঠি পাঠিয়েছিল?
হ্যাঁ। শেফালিকে নিয়ে আর হলের দারোয়ানকে নিয়ে জঘন্য এক চিঠি।
বকুলের ভালো নাম কী?
বকুল বালা।
হিন্দু মেয়ে?
হ্যাঁ।
শেফালির ভালো নাম কী?
শেফালি হক।
তার সাবজেক্ট কী?
পলিটিক্যাল সায়েন্স।
রুম নাম্বার কত?
তিনশ এগারো।
হাবীব বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। নাদিয়া বলল, জেরা শেষ?
হাবীব বললেন, জেরা আবার কী? ঘটনা জানতে ইচ্ছা করল বলে প্রশ্ন করলাম।
আমি সত্যি জবাব দিয়েছি না মিথ্যা দিয়েছি তা ধরতে পেরেছ?
মিথ্যা জবাব কেন দিবি?
দিতেও তো পারি। কেউ মিথ্যা বলছে কি না তা ধরার টেকনিক আছে। টেকনিকটা কি তোমাকে বলব?
বল।
টেকনিকটা আমরা শিখেছি বিদ্যুত স্যারের কাছে। স্যার বলেছেন যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন তার ব্রেইনে বাড়তি চাপ পড়ে। এই কারণে ব্রেইনের অক্সিজেন লাগে বেশি। কাজেই মিথ্যাবাধী বড় করে শ্বাস নেয়। ব্রেইনের বাড়তি চাপের জন্যে চোখের মণির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। চোখের মণি হয় ডাইলেটেড। তোমাকে তো প্রায়ই আসামি জেরা করতে হয়। আসামির চোখের মণির দিকে তাকালেই তুমি কিন্তু ধরে ফেলতে পারবে সে সত্যি বলছে না মিথ্যা বলছে।
হাবীব দিঘির ঘাট ছেড়ে চেম্বারে যাচ্ছেন। আগামী পরশু হাসান রাজা চৌধুরীর মামলার আবার তারিখ পড়েছে। ফরিদকে জেরা করা হবে। কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখা দরকার। মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলেই নাদিয়ার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি দরকার। তবে মামলা ঠিকমতো যাচ্ছে। সাজানো মামলা রেললাইনের ওপরের রেলগাড়ি। কখনো লাইন ছেড়ে যাবে না।
চেম্বারে ঢোকার মুখে প্রণবের সঙ্গে দেখা। হাবীব বললেন, হাসান রাজী চৌধুরীর মামলার কাগজপত্রগুলা বের করো।
এখন দেখবেন?
হুঁ।
আপনার শরীরটা খারাপ, আজ বাদ দেন।
তোমাকে যা করতে বললাম করো। আরেকটা খবর এনে দাও। রোকেয়া হলের তিনশ এগারো নম্বর রুমে যে মেয়ে দু’টা থাকে তাদের নাম। তারা কোন সাবজেক্টে পড়ে এই তথ্যও লাগবে।
ব্যবস্থা করব। তিনশ এগারোর মেয়ে দুটার নাম। সাবজেক্ট।