- বইয়ের নামঃ মাতাল হাওয়া
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, ইতিহাস
হাজেরা বিবি
মাতাল হাওয়া (২০১০)
উৎসর্গ
কোনো মৃত মানুষ মহান আন্দোলন চালিয়ে নিতে পারেন না। একজন পেরেছিলেন। আমানুল্লাহ মোহম্মদ আসাদুজ্জামান। তাঁর রক্তমাখা শার্ট ছিল ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি।
প্রাককথন
আমি মূলত একজন গল্পকার। গল্প বানাতে ভালোবাসি, গল্প করতে ভালোবাসি। দুর্বোধ্য কারণে ইতিহাস আমার পছন্দের বিষয় না। আমি বর্তমানের মানুষ। আমার কাছে অতীত হচ্ছে অতীত। লেখকদের সমস্যা হলো, তারা কাল উপেক্ষা করে লিখতে পারেন না। তারা যদি বিশেষ কোনো সময় ধরতে চান, তখন ইতিহাসের কাছে হাত পাততে হয়।
ঊনসত্তর আমার অতি পছন্দের একটি বছর। আমার লেখালেখি জীবনের শুরু ঊনসত্তরে। একটি মহান গণআন্দোলনকে কাছ থেকে দেখা হয় এই ঊনসত্তরেই। মানুষ চন্দ্র জয় করে ঊনসত্তরে। মাতাল সেই সময়কে ধরতে চেষ্টা করেছি মাতাল হাওয়ায়। তথ্যের ভুলভ্রান্তি থাকার কথা না, তারপরেও যদি কিছু থাকে জানালে পরের সংস্করণে ঠিক করে দেব।
উপন্যাসটি লেখার সময় অনেকেই বইপত্র দিয়ে, ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছেন। দু’একজনের নাম বলতেই হয়। বন্ধু মনিরুজ্জামান, শহীদ আসাদের ছোটভাই। সাংবাদিক এবং কবি সালেহ চৌধুরী।
প্রুফ দেখা, গল্পের অসঙ্গতি বের করার ক্লান্তিকর কাজ করেছে শাওন। তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। পুত্র নিষাদ আমার আট পৃষ্ঠা লেখা এমনভাবে নষ্ট করেছে যে আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাকে তিরস্কার।
হুমায়ূন আহমেদ
১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০
নুহাশ পল্লী, গাজীপুর
০১.
হাজেরা বিবি সকাল থেকেই থেমে থেমে ডাকছেন, হাবু কইরে! ও বু! হাবু!
হাবু তাঁর বড় ছেলে। বয়স ৫৭। ময়মনসিংহ জজ কোর্টের কঠিন ক্রিমিনাল লইয়ার। জনশ্রুতি আছে তিনি একবার এক গ্লাস খাঁটি গরুর দুধকে সেভেন আপ প্রমাণ করে আসামি খালাস করে নিয়ে এসেছিলেন। দুধের সঙ্গে আসামির কী সম্পর্ক- সেই বিষয়টা অস্পষ্ট।
হাজেরা বিবি যে ডাকসাইটে অ্যাডভোকেটকে হাবু ডাকছেন তাঁর ভালো নাম হাবীব। হাবীব থেকে আদরের হাবু। এই আদরটা সঙ্গত কারণেই হাবীবের পছন্দ না। তিনি শান্ত গলায় অনেকবার মাকে বলেছেন, মা, আমার বয়সের একজনকে হাবু হাবু বলে ডাকা ঠিক না। একতলায় আমার চেম্বার। মক্কেলরা বসে থাকে। তারা শুনলে কী ভাববে?
হাজেরা বিবি বললেন, মা ছেলেকে ডাকে। এর মধ্যে ভাবাভাবির কী আছে? তোর মক্কেলদের মা তাদের ডাকে না? না-কি তাদের কারোর মা নাই?
মা, আমার নাম হাবীব। তুমি আমাকে হাবীব ডাকো। হাবু ডাকো কেন? হাবু শুনলেই মনে হয় হাবা।
হাজেরা বিবি বললেন, তুই তো হাবাই। লতিফার বিয়ের দিন কী করেছিলি মনে আছে? হি হি হি। এই তো মনে হয় সেইদিনের ঘটনা। তুই নেংটা হয়ে দৌড়াচ্ছিস, তোর পিছনে একটা লাল রঙের রামছাগল। রামছাগলের মতলবটা ছিল খারাপ। হি হি হি।
হাজেরা বিবির বয়স একাশি। দিনের পুরো সময়টা তিনি কুঁজো হয়ে পালঙ্কে ঠেস দিয়ে বসে থাকেন। রাতে তার একেবারেই ঘুম হয় না। সারা রাত জেগে থাকেন। ক্রমাগত কথা বলেন। বেশির ভাগ কথাই আজরাইলের সঙ্গে। তিনি আজরাইলের শরীরের খোঁজখবর নেন। আদবের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন, আপনার শরীর ভালো? খুব পরিশ্রম যাইতাছে? আইজ কয়জনের জান কবজ করছেন? তার মাথা খানিকটা এলোমেলো অবস্থায় আছে। তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প প্রায়ই বলেন, যেসব গল্পের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। তার বেশির ভাগ গল্পেই লতিফ নামের একটা মেয়ের উল্লেখ থাকে। বাস্তবে লতিফা নামের কারোর সঙ্গে তার পরিচয় নেই। আদর করে মাঝে মাঝে লতিফাকে তিনি লতু বলেও ডাকেন।
হাবীবের চেম্বার মফস্বল শহরের তুলনায় যথেষ্ট বড়। সেগুন কাঠের মস্ত টেবিলের তিনদিকে মক্কেলদের বসার ব্যবস্থা। মেঝের একপাশে ফরাস পাতা। মাঝে মাঝে রাত বেশি হলে মক্কেলরা থেকে যান। তখন বালিশের ব্যবস্থা হয়। মক্কেলরা ফরাসে ঘুমান। চেম্বারে দুটা সিলিং ফ্যান আছে। কারেন্টের খুব সমস্যা হয় বলে টানা পাখার ব্যবস্থা আছে। রশীদ নামের একজন পাংখাপুলার পাংখার দড়ি ধরে বসে থাকে। ফ্যান বন্ধ হওয়া মাত্র সে দড়ি টানা শুরু করে।
চেম্বারে তার দূরসম্পর্কের ভাই মোনায়েম খান সাহেবের বড় একটা ছবি আছে। ছবিতে তিনি এবং মোনায়েম খান পাশাপাশি দাঁড়ানো। দু’জনার গলাতেই ফুলের মালা। মোনায়েম খান তখন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর। হাবীবের আরেকটা বড় ছবি আছে আয়ুব খানের সঙ্গে। ইউনিফর্ম পরা জেনারেল আয়ুব তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। আয়ুব খান চশমা পরা, তার মুখ হাসি হাসি। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ছবি কিন্তু মোটামুটি অর্থহীন, কারণ হাবীবের মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার মুখের খানিকটা অংশ দেখা গেলেও হতো, লোকে বুঝত যার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করা হচ্ছে তিনি দুদে অ্যাডভোকেট হাবীব খান। এই ছবির দিকে যারই চোখ যায় তিনি মনে মনে বলেন, শুয়োরের বাচ্চা ফটোগ্রাফার! নেংটা করে পাছায় বেত মারা উচিত।
আজ শুক্রবার হাবীব চেম্বারে মকেল নিয়ে বসেছেন। শুক্রবার তিনি চেম্বারে বসেন না। আজ বসতে হয়েছে কারণ মক্কেল শাসালো। খুনের মামলায় ফেঁসেছে। ৩০৫ ধারা। মকেল ভাটি অঞ্চলের বেকুব সিন্ধি গাইয়ের মতো দিনে তিনবার দুয়ানো যাবে। হাবীব মক্কেলের সঙ্গে কথা বলে আরাম পাচ্ছেন না। কারণ কিছুক্ষণ পরপর তার মা’র তীক্ষ্ণ গলায় ডাক শোনা যাচ্ছে হবু হবুরে! ও হাবু! হাবীব খানের মুহুরি প্রণব বাবু বললেন, স্যার, আপনারে আম্মা ডাকেন। আগে শুনে আসেন। আম্মাকে ঠান্ডা করে আসেন। হাবীব বিরক্ত মুখে উঠে গেলেন। মনে মনে ঠিক করলেন চেম্বারটা এখান থেকে সরিয়ে এমন কোনো ঘরে নিতে হবে যেখান থেকে মা’র গলা শোনা যাবে না। এত বইপত্র নিয়ে চেম্বার সরানো এক দিগদারি। সহজ হতো মা’র ঘর সরিয়ে দেওয়া। সেটা সম্ভব না। হাজেরা বিবি ঘর ছাড়বেন না। কারণ দক্ষিণমুখী ঘর। সামনেই নিমগাছ। সারাক্ষণ নিমগাছের হাওয়া গায়ে লাগে। বৃদ্ধ বয়সে নিমের হাওয়ার মতো ওষুধ আর নাই।