- বইয়ের নামঃ মৃন্ময়ীর মন ভালো নেই
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, রোম্যান্টিক গল্পের বই
মৃন্ময়ীর ঘুম ভাঙানোর মহান দায়িত্ব
মৃন্ময়ীর ঘুম ভাঙানোর মহান দায়িত্ব যে-কাজের মেয়েটি পালন করে তার নাম–বিন্তি। তার বয়স মৃন্ময়ীর কাছাকাছি সতেরো। মৃন্ময়ীর উনিশ। বিন্তি এসেছে নেত্রকোনার দুর্গাপুর থেকে। এই প্রথম তার ঢাকা শহরে আসা। বড়লোকদের কাণ্ডকারখানা কিছুই তার মাথায় এখনো ঢুকছে না। ভয়ে সারাক্ষণই তার কইলজা কাঁপে এবং পেট পুড়ে দুর্গাপুরের জন্যে।
সকাল আটটা। বিন্তি চায়ের কাপ নিয়ে মৃন্ময়ীর ঘরে ঢুকেছে। তার কলিজা কাঁপা শুরু হয়েছে। সে জানে মৃন্ময়ী এক্ষুনি তাকে কঠিন ধমক দেবে। ঘুম ভাঙলে মৃন্ময়ীর মেজাজ খারাপ থাকে। তার দায়িত্ব ভোর আটটায় আপার ঘুম ভাঙানো? আপ নিজেই তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে অথচ…
যথাসম্ভব নরম গলায় বিন্তি ডাকল, আপা! আপা।
মৃন্ময়ী মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে কঠিন গলায় বলল, এমন এক থাপ্পড় খাবে। যাও বললাম। ভোর ছটার সময় বলে আপা। আপা।
আপা আটটা বাজে।
বাজুক আটটা। আমি এক থেকে তিন গুনব। এর মধ্যে তুমি যদি না যাও তা হলে থাপ্পড় খাবে। সত্যি সত্যি খাবে। এক থাপ্পড়ে দুর্গাপুর।
এই সময় বিন্তির কী করা উচিত সে ভেবে পায় না। তার কি উচিত চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা? নাকি সে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসবে? সমস্যাটা নিয়ে সে রহিমার মার সঙ্গে আলোচনা করেছে। রহিমার মা এই বাড়ির হেড বাবুর্চি। অনেক দিন ধরে এদের সঙ্গে আছে। রহিমার মা বলেছে, খামার মতো খাড়ায়া থাকবি। নড়বি না। আফা ধমক-ধামক মুখে দিব। আর যদি চড় মারে মারব। বড়লোকদের চড়ে মজা আছে।
কী মজা?
চড় দিয়া বসলে আফার মন হইব খারাপ। তোরে দিব বখশিশ। পাঁচশ টেকাও পাইতে পারস। আফার ব্যাগে ভাংতি থাকে না। আর এরর টেকার নাই হিসাব।
রহিমার মা সব কথাই বাড়িয়ে বলে তবে এদের টাকার যে হিসাব নাই এই কথাটা খুব সম্ভব সত্যি। আপার ঘর গুছাতে গিয়ে একবার সে এমন ধাক্কা খেয়েছিল চিরুনি রাখার ডালায় পাঁচশ টাকার একটা প্যাকেট। রাবার দিয়ে বাধা। সবই চকচকা নোট। যাদের টাকার হিসাব নাই তারাই এত টাকা এইভাবে ফেলে রাখতে পারে।
আজ বিন্তির ভাগ্য খুবই ভালো। একবার ডাকতেই মৃন্ময়ী উঠে পড়ল। বিন্তির হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে সহজ গলায় বলল, বিন্তি মাকে একটু আসতে বল। খুবই জরুরি।
আপা ঘর গুছাব না?
ঘর গুছাতে হবে না। ঘর আরো নোংরা কর।
বিন্তি বের হয়ে গেল। আপার মেজাজ আজ কোন দিকে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। ঘর আরো নোংরা কর কথাটার মানেই বা কী?
মৃন্ময়ীর মায়ের নাম শায়লা। তিনি হাইপার টেনশানের রোগী। কোনো কারণ ছাড়াই তার প্রেশার (সিস্টোলিক) ধুম করে একশ হয়ে যায়। তখন তার ঘাড় ব্যথা করতে থাকে কপালের শিরা দপদপ করতে থাকে। দরজা-জানালা বন্ধ করে তাকে শুয়ে থাকতে হয়। তার ঘরে শীত-গ্রীষ্ম সবসময়ই এসি চলে। ঘরের টেম্পারেচার রাখা হয় ২১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। ঘরে একটা জার্মান মেড হিউমিডি ফায়ার আছে, যার কাজ ঘরের জলীয় বাষ্প ৩৫ পারসেন্টে রাখা।
বসন্তকালটা শায়লার জন্য খুব খারাপ কাটে। এই সময় তাঁর অ্যালার্জির এটাক হয়। শ্বাসনালি ফুলে শ্বাস বন্ধের উপক্রম হয়। অ্যালার্জির নানান ধরনের অষুধপত্র খেয়েও কোনো লাভ হয় নি। এখন খাচ্ছেন চাইনিজ হার্বাল মেডিসিন। মনে হয় এই অষুধটা কাজ করছে। বসন্ত শুরু হয়েছে। আমগাছে মুকুল এসেছে। এখনও তার অ্যালার্জির অ্যাটাক শুরু হয় নি।
শায়লা মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। চিন্তিত মুখে বললেন, তোর কী নাকি জরুরি কথা?
মৃন্ময়ী বলল, মা বসো। মুখোমুখি বসো।
শায়লা বসলেন। মৃন্ময়ী বলল, আজ প্রেশারের অষুধ খেয়েছ?
নাশতার পরে খাব।
তা হলে যাও প্রেশারের অষুধ খেয়ে তারপর সামনে এসে বসো। আমার কথা শুনে হুট করে প্রেশার বেড়ে যেতে পারে। তখন আরেক যন্ত্রণা।
শায়লা বললেন, তোর কী বলার এখনই বল।
প্রেশার বেড়ে গেলে আমাকে কিন্তু দুষতে পারবে না।
কী বলতে চাচ্ছিস বলে ফ্যাল।
মা আমার তো মনে হয় তোমার প্রেশার এখনই বেড়ে গেছে। নাক ঘামছে।
কথাটা কী?
মৃন্ময়ী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, কথাটা হচ্ছে আমি পরীক্ষা দিচ্ছি না।
পরশু তোর পরীক্ষা। আজ বলছিস পরীক্ষা দিবি না!
প্রিপারেশন খুবই খারাপ। পরীক্ষা দিলেই ফেল করব। ফেল করার চেয়ে পরীক্ষা না-দেয়া ভালো না?
তোর বাবা জানে?
বাবা জানবে কীভাবে? আমি নিজেই তো জানলাম ঘুম ভাঙার পর। কাল রাতে যখন ঘুমুতে যাচ্ছি তখনও জানতাম পরীক্ষা দিচ্ছি। ঘুম ভাঙার পর মনে হলো পরীক্ষা কেন দেব? ফেল করার জন্যে পরীক্ষা দেবার কোনো অর্থ হয়?
পরীক্ষা সত্যি দিবি না?
গড প্রমিজ, দেব না।
তোর বাবাকে বল। সে কী বলে শুনি।
মৃন্ময়ী বলল, পরীক্ষা আমি দিচ্ছি, বাবা দিচ্ছে না। কাজেই এখানে বাবার বলার কিছু নেই।
শায়লা বললেন, তোর বাবার তো জানা উচিত যে পরীক্ষা দিচ্ছিস না।
তুমি জানাও। আদর্শ মায়ের দায়িত্ব হলো মিডিয়েটর হিসেবে কাজ করা।
শায়লা উঠে পড়লেন। তার ঘাড়ব্যথা শুরু হয়েছে। কপালও দপদপ করছে। গলাও খুসখুস করছে। এলার্জি এটাকের আগে তার গলা খুস খুস করে।
মৃন্ময়ী রিমোট হাতে সিডিপ্লেয়ার চালু করল। কাল রাতে জর্জিয়ান চেন্ট নামের একটা সিডি প্লেয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছিল। সকালে শুনবে এই ছিল পরিকল্পনা। যে-কোনো নতুন মিউজিক ভোরবেলায় শুনতে হয়। রাতে শুনতে হয় পরিচিত পুরানো মিউজিক।