- বইয়ের নামঃ মন্দ্রসপ্তক
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
সকালবেলাতেই মৃত্যুসংবাদ
সকালবেলাতেই মৃত্যুসংবাদ।
টুথব্রাশে পেস্ট মাখাচ্ছি। অস্বস্তি নিয়েই মাখাচ্ছি—কারণ কার ব্রাশ ঠিক ধরতে পারছি না। এ বাড়িতে তিনটা সাদা রঙের টুথব্রাশ আছে যার একটা আমার। সেই একটা মানে কোনটা, আমি কখনো ধরতে পারি না। বাকি দুটার মালিক আমার দুবোন। এদের চোখের দৃষ্টি ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ–এরা দূর থেকে বলতে পারে ব্রাশটা কার। এই কারণে দাঁত মাজার পর্বটা আমি সাধারণত অতি দ্রুত সেরে ফেলি। বোনদের চোখে পড়ার আগেই। এরা বড় যন্ত্ৰণা করে।
আজ আমার পরিকল্পনা ছিল ধীরে-সুস্থে সব কাজকর্ম করা। দাঁত মাজার পর্বে মিনিট দশেক সময় দেবার কথা ভাবছিলাম। সম্ভব হল না। মীরা এসে বলল, দাদা শুনেছিস, মেজো খালু সাহেব মারা গেছেন।
আমি অসম্ভব অবাক এবং দঃখিত হবার ভাব করলাম। যেন পৃথিবীর সবচে ভয়াবহ খবর এইমাত্ৰ শুনলাম। দুঃখের ভাবটাকে আরো জোরালো করার জন্যে কিছু একটা বলা দরকার। যেমন করুণ গলায় বলা, হোয়াট এ ট্রাজেডি কিংবা কী সর্বনাশ! এই দুটার মধ্যে কোনটা বলব ভাবছি, তখন মীরা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুই আবার আমার ব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষছিল? যেন এটাই বর্তমান সময়ের গ্রেট ট্রাজেডি। মেজো খালু সাহেবের মৃত্যুসংবাদ চাপা পড়ে গেল। আমি উদাসীন ভঙ্গিতে বললাম, এটা তোর নাকি?
ব্রাশের গায়ে M লেখা দেখছি না? গতকালও আমার ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজলি। এইসব কী?
গতকাল তোর ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজলাম, তুই বুঝলি কী করে?
সিগারেটের গন্ধ থেকে বুঝেছি। ভক ভক করে সিগারেটের গন্ধ বের হয়।
মীরার দিকে তাকিয়ে মনে হল সে কেঁদে ফেলার একটা চেষ্টা করছে। আমার দুই বোন কাঁদার ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট। অতি তুচ্ছ কারণে এবং সম্পূর্ণ অকারণে এরা কাঁদতে পারে। গত শুক্রবারে টিভি-র একটা নাটক দেখে এরা দুজনই এমন মায়াকান্না জুড়ে দিল যে, বড় চাচা ধমক দিয়ে বললেন—এসব হচ্ছে কী? এই, টিভি বন্ধ করে দে তো। এদের নিয়ে বড় যন্ত্রণা! আসলেই বড় যন্ত্ৰণা। একই চিরুনি দিয়ে সেও মাথা আঁচড়াচ্ছে, আমিও আঁচড়াচ্ছি, তাতে দোষ হচ্ছে না। ব্রাশের বেলায় একেবারে কেঁদে ফেলতে হবে।
আমি বললাম, কাঁদছিস কেন? কেঁদে ফেলার মতো কী হল?
মীরা জবাব না দিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল। মীরা বয়সে আমার তিন বছরের ছোট। ওর এখন একুশ চলছে। যদিও চেহারায় খুকি খুকি ভাবটা রয়ে গেছে। শুধু চেহারায় না, স্বভাবেও। একদিন বাসায় এসেছে কাঁদতে কাঁদতে, কারণ এক রিকশাওয়ালা নাকি তাকে গালি দিয়েছে। বলেছে—এই ছেমরি। এক জন রিকশাওয়ালা কী করে মীরার মতো অত্যন্ত রূপবতী মেয়েকে এই ছেমরি বলতে পারে সে এক রহস্য। রূপবতীদের গালি দেয়া বেশ কঠিন। তাছাড়া মীরা শুধু রূপবতীই নয়, বাইরের লোকজনদের সঙ্গে তার ব্যবহারও খুব ভালো। কাজের লোক, রিকশাওয়ালা এদের সবাইকে সে আপনি করে বলে। তাকে কেন রিকশাওয়ালা গালি দেবে? মীরা অবশ্যি কিছুই বলল না। সারা বিকাল ফুঁপাল।
নাশতার টেবিলে মা বললেন, তোর মেজো খালু মারা গেছেন, শুনেছি? আমি নিস্পৃহ গলায় বললাম, হুঁ।
দুঃখিত, ব্যথিত হবার ভঙ্গিমার সামনে করলাম না। এক বিষয় নিয়ে দুবার অভিনয় করার কোন মানে হয় না।
মা বললেন, রাত তিনটার সময় মারা গেলেন। ঘুমুচ্ছিলেন, হঠাৎ জেগে উঠে বললেন, ফরিদা, একগ্লাস পানি দাও। ফরিদা পানি এনে দিল। পানি খেয়ে বললেন, মেয়েটাকে ঘুম থেকে ডেকে তোল। ফরিদা বলল, মেয়েকে ডাকার দরকার কি? তোর মেজো খালু বললেন, শরীরটা ভালো লাগছে না। তখন তাঁর খুব ঘাম হতে লাগল। তারপর….
মা নিপুণ ভঙ্গিতে মৃত্যু-সময়কার খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো বলতে লাগলেন। এতসব খুঁটিনাটি তিনি কোত্থেকে জোগাড় করলেন কে জানে। আমি লক্ষ করেছি, মৃত্যু বিষয়ক খুঁটিনাটি মেয়েরা খুব আগ্রহ করে বলে।
তোর খালুর ঘাম দেখে ফরিদা বলল, এত ঘামছ কেন? গরম লাগছে? তোর খালু বললেন, একটা ভেজা ভোয়ালে দাও……..
আমি মাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এত খবর পেলে কোথায়?
মার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। তাঁকে কোনো প্রশ্ন করলেই তিনি মনে করেন তাঁকে বিপদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। তখন অসম্ভব রেগে যান। এই ভোরবেলাতেই মাকে রাগিয়ে দেবার কোনো মানে হয় না। আমি আগের প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়ে বললাম, বেচারা অল্পবয়সে মারা গেল। তুমি যাচ্ছ ও বাড়িতে?
মা আঁৎকে উঠে বললেন, সংসার ফেলে আমি যাব কী করে—তোর ছোট চাচীর আবার ব্যথা উঠেছে।
তাই নাকি?
সারারাতই তো ব্যথায় ছটফট করল। খবর রাখিস না নাকি? হাসপাতালে নিতে হবে মনে হয়। তোর ছোট চাচা বলছিল দুপুর নাগাদ ব্যথা না কমলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।
আমি শুকনা গলায় বললাম—ও।
ছোট চাচীর ব্যথা হচ্ছে নিত্যদিনকার একটা ব্যাপার। এই খবরে শুকনো ও ছাড়া কিছু বলা যায় না। ছোট চাচীর ব্যথা এবং ব্যথার সঙ্গে জড়িত কুঁ কাতরধ্বনির সঙ্গে আমরা এত পরিচিত যে, এখন এসব শুনলে মুখের ভাবভঙ্গির কোন পরিবর্তন হয় না। তবে ছোট চাচীর ব্যথা আমাদের নানান সময়ে নানান উপকার করে। এই যেমন আজ করছে। মা বলতে পারছেন—ছোট চাচীর ব্যথার কারণে তিনি যেতে পারছেন না। যে সমস্ত বিয়ের দাওয়াতে আমাদের যেতে ইচ্ছে করে না আমরা খবর পাঠাইছোট চাচীকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি চলছে। কী যে অবস্থা।