আমি ঠিক করলাম, বাবার কিছু কথা শুনব। কিছু শুনব না। ছাত্ররাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে, এই কথাটি অবশ্যই শুনব। ছাত্ররাজনীতির নামে গুণ্ডামি আমাকে দারুণ আহত করেছিল। একটি উদাহরণ দেই। তখন শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন ড. মুশফিকুর রহমান। তার টেলিফোনটি চলে গিয়েছিল NSF এর গুণ্ডা খোকার ঘরে। খোকার বক্তব্য—আপনার চেয়ে আমার টেলিফোন বেশি দরকার।
প্রভোস্ট তেলতেলা হাসি দিয়ে বললেন, অবশই অবশ্যই।
খোকা বলল, কোনো জরুরি কল করতে হলে আমার এখানে চলে আসবেন সার।
অবশ্যই আসব। অবশ্যই। ধন্যবাদ।
সেই মাতাল সময়ে ছাত্রদের রাজনৈতিক বিভাজন ছিল এরকম—
ক) ছাত্র ইউনিয়ন। যারা এই দলে ধরেই নেওয়া হতো তাদের মধ্যে মেয়েলিভাব আছে। তারা পড়ুয়া টাইপ। রবীন্দ্রনাথ তাদের গুরুদেব। এরা পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করে। গানবাজনা, মঞ্চনাটক জাতীয় অনুষ্ঠানগুলিতে উপস্থিত থাকে। এদের ভাষা শুদ্ধ। নদীয়া শান্তিপুর স্টাইল। যে-কোনো বিপদআপদে দ্রুত স্থানত্যাগ করতে এরা পারদর্শী। মিছিলের সময় পালানোর সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে এরা পেছনদিকে থাকে।
এই দলটির আবার দুটি ভাগ। মতিয়া গ্রুপ, মেনন গ্রুপ। এক দলের ওপর দিয়ে চীনের বাতাস বয়, আরেক দলের ওপর দিয়ে রাশিয়ার বাতাস বয়।
খ) ছাত্রলীগ। পড়াশোনায় মিডিওকার এবং বডি বিল্ডাররা এই দলে। এই সময়ে তাদের প্রধান কাজ এনএসএফ-এর গুণ্ডাদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের সামনে তারা খানিকটা হীনমন্যতায় ভোগে। মারদাঙ্গায় এবং হলের ক্যানটিনে খাবার বাকিতে খাওয়ায় এরা বিশেষ পারদর্শী।
গ) ইসলামী ছাত্রসংঘ। মওদুদীর বই বিলিয়ে ‘দীনের দাওয়াত দেওয়া এদের অনেক কাজের একটি। পূর্বপাকিস্তানকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করা, মসজিদভিত্তিক সংগঠন করা এদের কাজ। দল হিসেবে এরা বেশ সংঘটিত। কথাবার্তা মার্জিত। অনেকের বেশ ভালো পড়াশোনা আছে।
ঘ) এনএসএফ। প্রধান এবং একমাত্র কাজ সরকারি ছাতার নিচে থেকে গুণ্ডামি করা। সরকার এদের ওপর খুশি। কারণ এদের কারণে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না।
এই জাতীয় কোনো সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার প্রশ্নই আসে না। আমি পড়াশোনা নিয়ে থাকি। বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে ছয় আনা খরচ করে দু’টা গরম গরম সিঙ্গারা এবং এককাপ চা খেয়ে শরিফ মিয়ার কেন্টিনের সঙ্গে লাগোয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকে যাই। গল্প-উপন্যাস পড়ি। ঘড়ির কাটার দিকে খেয়াল রাখি। সন্ধ্যা মিলানো মাত্র হলে ফিরে এসেই গ্লাস হাতে হলের ডাইনিং রুমে ঢুকে যাই। প্রথম ব্যাচে খেয়ে ফেলা।
একরাতে খেতে বসেছি। আমার পাশে কালো কিন্তু সুদর্শন এক যুবক বসেছেন। প্লেটে ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছি—বেয়ারা মাংসের বাটি (হলের ভাষায় কাপ) এনে দুজনার সামনে রাখল। কাপে থাকবে অতি ক্ষুদ্র দুই পিস মাংস, এক পিস আলু।
আমি মাংসের বাটিতে হাত দিয়ে মাংস নিচ্ছি। আমার পাশে বসা যুবক আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার তাকিয়ে থাকার অর্থ কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হলো। আমার বাটিভর্তি মাংস! ভুল করে এই যুবকের কাপ আমি টেনে নিয়েছি। এই যুবক NSF এর পাতিগুণ্ডাদের একজন। তার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা।
আমি বললাম, ভাই ভুল করে ফেলেছি।
যুবক বললেন, অসুবিধা নাই। খান।
আমি বললাম, আপনি বেয়ারাকে বলুন। আপনার জন্যে আবার আসবে।
প্রয়োজন নাই।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনার নামটা কি জানতে পারি?
আমার নাম মনিরুজ্জামান। আমি ইতিহাসে এমএ পড়ি। আপনাকে আমি চিনি। আপনার নাম হুমায়ূন আপনি ম্যাজিক দেখান এবং ভূত নামান, হিপনোটাইজ করেন। এইগুলা কি সত্যি পারেন?
আমি বললাম, পারি।
একদিন করে দেখাবেন?
অবশ্যই।
এই মনিরুজ্জামানের আরেক ভাইয়ের নাম আসাদুজ্জামান। তিনি আমাদের এক সহপাঠিনীর প্রেমে পড়েছিলেন। প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার জন্যে প্রায়ই কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে আসতেন। রসায়ন বিভাগের শিক্ষকরা তখন সমাজশাসকের ভূমিকা পালন করতেন। একটা ছেলে একজন মেয়ের সঙ্গে রসায়ন বিভাগে কথা বলবে তা হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ছিল— প্রক্টর যদি কোনো ছেলেমেয়েকে গল্প করতে দেখেন, তাহলে ফাইন করা হবে। ফাইনের পরিমাণ পাঁচ টাকা। কোনো ছেলের যদি কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বিশেষ জরুরি হয়, তাহলে প্রক্টরকে তা জানাতে হবে। প্রক্টর একটা তারিখ দেবেন। সেই তারিখে প্রক্টরের উপস্থিতিতে দুজনকে কথা বলতে হবে।
আমি যতদূর জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আইন এখনো বদলানো হয়নি। যাই হোক, মনিরুজ্জামানের ভাই আসাদুজ্জামানকে প্রায়ই রসায়ন বিভাগের আশেপাশে শুকনা মুখে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যেত। রসায়ন বিভাগের একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে বেচারা অতি বিব্রত অবস্থায় ছিল। এই আসাদুজ্জামানের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে কবি শামসুর রাহমান তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আসাদের শার্ট’ লেখেন। আয়ুব গেটের নাম পাল্টে নাম রাখা হয় আসাদ গেট। সেই গল্প যথাসময়ে বলা হবে।
পরিস্থিতি বৈরী হলে শামুক তার নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে যায়। আমার কাছে পরিস্থিতি বৈরী মনে হলো। চলমান উত্তপ্ত ছাত্ররাজনীতির বাইরে নিজেকে নিয়ে গেলাম। বিচিত্র এক খোলস তৈরি করলাম। সেই খোলস ম্যাজিকের খোলস, চক্র করে ভূত নামানোর খোলস। তখন হাত দেখাও শুরু করলাম। হাত দেখে গড়গড় করে নানান কথা বলি। যা বলি তাই না-কি মিলে যায়।