মাওলানা সাহেব, কাকটা দেখতে পাচ্ছেন না? জি জনাব।
এক কাজ করি, কাকের ঠোঁটটা ঐকে ফেলি। ঠোঁট তীক্ষ্ণ। একটু বাঁকা না?
জি।
দেখুন তো হয়েছে?
জি।
ঠোঁট হয়ে গেছে, এখন ঠোঁটের মাপে শরীর। ঠোঁট বড় শরীর ছোট হলে তো হবে না। এখন মনে মনে মাপটা ঠিক করে ফেলি। মাপ ঠিক করে লেজটা আঁকি। এখান থেকে শুরু করি লেজ। হবে না?
মাওলানা বললেন, না লেজটা বড় হয়ে যাবে।
ঠিক ধরেছেন। তার মানে আমি কী বলছি বুঝতে পারছেন। লেজটা একটু ছোট করে দিলাম। এখন আঁকব পাখা। কাকের পাখার রঙ কী?
কালো!
পুরোপুরি কালো না। দাঁড়কাক হয় কুচকুচে কালো। যেন চাইনিজ ইংক। এই কাকগুলোর কালোর সঙ্গে সামান্য সাদা আছে। আমি কালো দিয়েই আঁকব, তারপর ঘাড়ের কাছে রঙটা বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে পাতলা করে দিব।
কাক আঁকা শেষ হয়েছে। জয়নুল পাতাটা ছিড়ে মাওলানার হাতে দিয়ে বললেন, নিয়ে যান।
ইদরিস বললেন, জনাব শুকরিয়া।
জয়নুল বললেন, পান খাবেন? আমি এখন জর্দা দিয়ে একটা পান খাব। পান সিগারেট খাবার বিরাট বদঅভ্যাস হয়েছে।
ইদরিস বলল, আগে পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল। একদিন মনে হলো, কী সর্বনাশ, আমাদের নবীজি তো পান খান না। তাঁর দেশে তো পান সুপারি নাই।
আপনি নবীভক্ত মানুষ?
জি।
আপনার মতো আরেকজন নবীভক্ত মানুষ ছিলেন। তিনিও কোরানে হাফেজ। বিরাট কবি ছিলেন। শিরাজ নগরে ছিল তার বাড়ি। আমার পছন্দের কবি। তাঁর কবিতার বইয়ের নাম ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’। কবি হাফিজের নাম শুনেছেন?
জি-না। আমি বিরাট মুর্থ।
আমরা সবাই মূর্খ। বলেই জয়নুল ব্যাগ থেকে পানের কৌটা বের করে পান মুখে দিলেন। আয়োজন করে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, এখন আপনার পরীক্ষা।
কী পরীক্ষা?
আপনি হচ্ছেন আমার জীবনের প্রথম ছাত্র। কাক আঁকা শিখিয়েছি। ছাত্র কাক আঁকতে পারল কি-না দেখব না? ওই কাকটা দেখে দেখে একটা কাক আঁকুন। এই নিন কাগজ। এই যে কয়লা। কয়লাটা শক্ত করে ধরবেন। কয়লাকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। কয়লা আপনাকে কামড়াবে না।
মাওলানা কোনোরকম অস্বস্তি ছাড়াই আঁকতে বসলেন।
আমি যদি পা দুটা আগে আঁকি অসুবিধা আছে?
না। পা যেহেতু কাকের মাঝখানে, পা দিয়ে শুরু করাই ভালো হবে। Proportion ঠিক করা সহজ হবে।
কী বললেন বুঝলাম না।
আপনাকে বুঝতে হবে না। আপনি ছবি আঁকুন।
মাওলানা কাক এঁকে শেষ করলেন। লজ্জিত চোখে তাকালেন তার তরুণ শিক্ষকের দিকে। জয়নুল বললেন, আপনার কি ধারণা হয়েছে?
মাওলানা ক্ষীণ গলায় বললেন, হয়েছে।
জয়নুল বললেন, আমি আপনাকে দিলাম দশে আট। আমি ভালো শিক্ষক। ছাত্রকে ভালো নাম্বার দেই। কাকটার নিচে দশে আট লিখে জয়নুলা নিজের নাম সই করলেন। করে বললেন, এই কাকটা আমি রেখে দেব। পরীক্ষার খাতা টিচারের কাছে থাকে। এই নিয়ম। *
[* ১৯৬০ কিংবা ’৬৫-র দিকে জয়নুল আবেদিনের এই কাক এক ভক্ত অনেক টাকা দিয়ে মাদ্রিদে কিনে নিল। জয়নুলের নাম সই আছে। যে বিখ্যাত কাক বেচারা কিনল তা জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছিল না। (সূত্ৰ : অসমর্থিত)]
ইদরিস বাসায় ফিরলেন আনন্দ নিয়ে। তাঁর শরীর পুরোপুরি সারে নি। রাত করে জ্বর আসছে। শরীর কাঁপিয়ে ভয়ঙ্কর জুর। জ্বরের সময় তাঁর মনে হয় পৃথিবীর অতি শীতলতম স্থানে কেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে। যে শীত দোজখের আগুনের চেয়েও ভয়াবহ। এটা কি মৃত্যুর অভিজ্ঞতা? মৃত্যুর আগে আগে মানুষ কি শীতের জগতে প্রবেশ করে? মৃত্যু কি চরম শৈত্য? জ্বরের ঘোরে তিনি লম্বা সাদা টুপি পরা কিছু মানুষজন দেখেন। তাদের মাথার টুপি যেমন লম্বা তারাও লম্বা। তাদের সবার গায়ে ভারী কম্বল। সেই কম্বলের রঙও সাদা। তিনি যেমন শীতে কষ্ট পাচ্ছেন তারাও পাচ্ছে। লোকগুলি নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে। ইদরিস তাদের কথা শুনতে পারেন না, তবে তারা যখন মুখ নাড়ে তখন তাদের মুখ দিয়ে সাদা কুয়াশার মতো বের হয়।
মাওলানা তাঁর অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলেন না। তার লজ্জা লাগে। জ্বর বিকারে মানুষ অনেক কিছু দেখে, তা নিয়ে আলাপ করার কিছু নাই। অবশ্য মাঝে মাঝে গোপালনগর স্কুলের একজন শিক্ষকের সঙ্গে এই বিষয়ে তার আলোচনা হয়। শিক্ষকের নাম বিভূতিভূষণ। ব্ৰাহ্মণ। পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়। এই শিক্ষক হঠাৎ হঠাৎ যমুনাদের বাড়িতে আসেন। তারাশংকর বাবুর সঙ্গে নানান বিষয়ে কথা বলেন। একসময় ভূতের গল্প শুরু করেন। তখন তারাশংকর বিরক্ত গলায় বলেন, আপনার মতো লেখক যদি ভূতপ্ৰেত নিয়ে থাকেন তাহলে কি হয়? সাহিত্য জীবননির্ভর। ভুতনির্ভর না।
বিভূতিভূষণ আলাভুলা ধরনের মানুষ। খাওয়াদাওয়ার গল্প করতে খুব পছন্দ করেন। একদিন ইদরিসকে বললেন, শিং মাছের ডিমের পাতুরি কখনো খেয়েছেন?
ইদরিস বললেন, জি-না জনাব।
একদিন খেয়ে দেখবেন। অসাধারণ। কীভাবে রাধবেন বলে দেই? খুব সহজ।
জি বলুন।
শিং মাছের ডিমের সঙ্গে সামান্য মসলা দেবেন। কাঁচামরিচ লাগবে। পিঁয়াজ দেবেন না। কলাপাতা দিয়ে ডিম মুড়ে ভাতের মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। মনে থাকবে?
জি জনাব থাকবে।
কচ্ছপের ডিমের একটা রন্ধন প্ৰণালি আমার কাছে আছে। আপনাকে দেব?
জি-না জনাব। আমি মুসলমান। কচ্ছপ খাই না।
আপনি মুসলমান আমি জানি। আমাদের এলাকার অনেক মুসলমান কচ্ছপ খান বলেই বলেছি। কিছু মনে করবেন না।
কিছুই মনে করি নাই।
বিভূতিভূষণ বললেন, আপনাদের যেমন এক ঈশ্বরবাদ, আমাদেরও কিন্তু এক অর্থে তাই। বেদান্ত গ্রন্থে আছে ‘একং ব্ৰহ্ম দ্বিতীয়ং নাস্তি, নেহ নানাস্তি কিজ্ঞন।’ এর অর্থ-ব্ৰহ্মা এক, তিনি ব্যতীত আর উপাস্য কেউ নেই।