রাতে কি খাবেন বাকের ভাই? যা! খেতে চান বলুন–রাঁধব।
পাগল হয়ে গেলে নাকি? বিকেলের ট্রেন ধরব, মেলা কাজ ঢাকায়।
আপনার কি কাজ আমার জানা আছে। যখন যেতে দেব তখন যাবেন। তার আগে না।
বকুল বড় একটা মাছের পেটি পাতে তুলে দিল। বাকেরের চোখ আবার ভিজে উঠছে। মমতা পেয়ে তার অভ্যাস নেই অল্পতেই সে কাতর হয়ে পড়ে। মন হু-হু করে।
বাকের বাড়িঘর দেখে মুগ্ধ। জহিরের ব্যবহারে মুগ্ধ। বকুলের ভালবাসায় মুগ্ধ। বাড়ির পেছনের বাধানো পুকুরের সাইজ দেখে মুগ্ধ। দুপুরে তার ঘুমিয়ে অভ্যেস নেই। ছিপ ফেলে সারা দুপুর পুকুর ঘাটে বসে রইল। সঙ্গে বাবু।
কেমন ঘাই দিচ্ছে দেখেছিস? মাছে পুকুর ভরতি। চার বানিয়ে ফেলতে হবে।
চার কি করে বানায় জানেন?
হুঁ। মেথি-ফেতি কি সব দিতে হয়। দেখি আগামীকাল জোগাড়-যন্ত্র করে ছিপ ফেলব। মাছ মারা সহজ ব্যাপার না বুঝলি–খুবই শক্ত। খুবই হার্ড কাজ। ভেরি হার্ড।
আজ বুধবার। মাছ ধরা পড়ার কথা নয়। কিন্তু কি আশ্চর্য সন্ধ্যার আগে আগে দেড় সের ওজনের একটা মৃগেল মাছ ধরা পড়ল।
বাকের আবেগজড়িত গলায় বলল, নেত্রকোনা জায়গাটা খুবই ভাল বুঝলি বারু। অসাধারণ একটা জায়গা। বাংলাদেশের মধ্যে এক নম্বর। এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। নো ডাউট। খুব ভাল জায়গায় বকুলের বিয়ে হয়েছে। খুবই ভাল জায়গা। গুড প্লেইস।
বাকেরের প্রতি বকুলের উৎসাহেব বাড়াবাড়ি জহিরের ভাল লাগছে না। সে যা হৈচৈ করছে তাতে যে কেউ বিরক্ত হবে। রাতে পোলাওয়ের ব্যবস্থা হয়েছে, মুরগী জবাই করা হয়েছে। অথচ দুপুরের মাছের প্রায় সবটাই আছে। এ সমস্ত হচ্ছে অসুস্থতার লক্ষণ। অথচ অসুস্থতার কোন ভিত্তি নেই। এবং অসুখটা এমন যে কারো সঙ্গে আলোপও করা যায় না।
গত দুরাত ধরে বকুল আলাদা শুচ্ছে। আলাদা মানে আলাদা ঘর। সন্ধ্যা হতেই সে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ঘুমায় না জেগে থাকে। যতবার জহির নিজের ঘর থেকে বের হয় ততবারই বকুল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে–কে কে?
আমি ভয় নেই।
ও আচ্ছা।
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড় বকুল।
আচ্ছা।
বাতি নিভে যায়। কিন্তু বকুল ঘুমায় না। জেগে বসে থাকে। এ যন্ত্রণার কোন মানে হয়? যতই সময় যাচ্ছে অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। কিছুদিন পরে হয়ত কাউকে চিনতে পারবে না। মুনা আপার সঙ্গে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়াই উচিত ছিল। জহির নিজে যেতে পারছে না। মামলামোকদ্দমায় অস্থির হয়ে যাওয়ার জোগাড়। জহির কি করবে ভেবে পেল না।
বাকের পাঁচদিন কাটিয়ে দিল। এই পাঁচ দিন সে যে সমস্ত কাজকর্ম করল তার মধ্যে আছে–পুকুরের কচুরিপানা পরিষ্কার। বাড়ির পেছনে জঙ্গল পরিষ্কার। দু’টি সাপ মারা (এই সাপ দু’টি জঙ্গল পরিষ্কারের সময় বের হয়ে এসেছিল)।
সন্ধ্যাগুলিও বাকেরের খুব ভাল কাটছিল; বাড়ির কাছেই যুব নাট্যদলের অফিস। সেখানে পথের সন্তান নাটকের রিহার্সেল হয়। বাকের গত চার রাত ধরে রিহার্সেলে উপস্থিত। যুব নাট্য দলের লোকজন ঢাকার এই মানুষটির গভীর আগ্রহে খুবই খুশি। নাট্যকারের বয়স অল্প। সে নিজেও বাকেরকে খুব খাতির করে। যাওয়া মাত্র চেঁচিয়ে বলে বাকের ভাইকে চা দাও-বিনা দুধে। নাটকে হাস্যরসাত্মক অংশগুলি বাকেরের খুবই পছন্দ। যতবারই হাসির অংশগুলি হয়, বাকের ঘর ফাটিয়ে হাসে। নাট্যকার এবং নাটকের লোকজন তাতে বড়ই উৎসাহিত হয়। বাকেরের ধারণা এটা একটা অসাধারণ নাটক। এবং ঢাকার কোন নাটকের দল এদের ধারে কাছেও যেতে পারবে না। বাকেরের ইচ্ছা হচ্ছে এক মাস পর যখন নাটক হবে তখন সে উপস্থিত থাকে। সে তার ইচ্ছা! ব্যক্তি ও করেছে। নাট্যকার অত্যন্ত অবাক হয়ে বলেছে কি বলেন বাকের ভাই, আপনাকে ছাড়া নাটক হবে নাকি? আপনাকে ঢাকা থেকে ধরে নিয়ে আসব না? ভেবেছেন কি আমাদের? তাদের আন্তরিকতায় বাকেরের মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। বড় উদাস লাগে।
বাকেরের আরো কিছু দিন থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু থাকতে পারল না, ঢাকায় চলে আসতে হল। কারণ বকুলের অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া দরকার। জহির যেতে পারছে। না। তার মামলার তারিখ পড়েছে।
বকুলের যে বিরাট একটা অসুখ বুঝতেই পারেনি। তার ধারণা ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া না করায় এই হাল হয়েছে। ট্রেনে উঠার পর বকুল যখন ফিসফিস করে বলল, আপনি আসায় আমার জীবনটা রক্ষা হয়েছে।
বাকের অবাক হয়ে বলল, কি বলছিস তুই?
সত্যি বলছি আমাকে মেরে ফেলত।
কে মেরে ফেলত?
জহির।
তুই পাগল হয়ে গেলি নাকি?
পাগল হব কেন? সত্যি কথা বলছি … ও আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চায়।
চুপ করে থাক। নয়ত চড় দিয়ে চাপার দাঁত ফেলে দেব।
বকুল চুপ করে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জানালায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। বাকেরের দুশ্চিন্তার সীমা রইল না ভালয় ভালয় ঢাকা পৌঁছতে পারলে হয়। ঢাকায় পৌঁছে দেরি করা যাবে না … ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি শুরু করতে হবে। মুনা একা কদিক সামলাবে? ভাগ্যিস সে সময়মত ছাড়া পেয়েছিল। এখনো হাজতে থাকলে তো বিরাট প্রবলেম হয়ে যেত।
বাকেরের জন্যে ট্রেনে কেউ কোন সাড়া শব্দ করতে পারল না। কেউ সামান্য কথা বললেও বাকের চেঁচিয়ে ওঠে–মরণাপন্ন রুগী নিয়ে যাচ্ছি–দেখতে পাচ্ছেন না? মা-বোন তো আপনাদের আছে? রোগ-শোক তো আপনাদেরও হয়, নাকি হয় না?
এই প্রচণ্ড ভিড়েও সে বেঞ্চ খালি করে বকুলকে শুইয়ে দিল এবং সারা পথ একটা খবরের কাগজ দিয়ে বকুলকে হাওয়া করল। একজন বুড়োমত যাত্রী একবার জিজ্ঞেস করল, উনার কি হয়েছে? বাকের বিরক্ত মুখে বলল, তা দিয়ে আপনার কোন দরকার আছে?