আর একবার স্পিটজের পায়ের তলায় ভেঙে গেল বরফ– সঙ্গে সঙ্গে তার পতনজনিত দেহের ভার সমগ্র কুকুরবাহিনীকে জলের মধ্যে টেনে আনার উপক্রম করল। ৰাক আর ডেভ শক্ত বরফ-ঢাকা জমির বুকে নখ বসিয়ে নিজেদের বাঁচাতে সচেষ্ট হল। তাদের চেষ্টা হয়তো সফল হত না, কিন্তু স্লেজটাকে পিছন থেকে টেনে ধরে ফ্রাঁসোয়া কুকুরগুলোকে জলের মধ্যে পড়তে দিল না। ওই অবস্থা থেকে তাদের উদ্ধার করল পেরল্ট ডেভ আর বাক ছাড়া যে কুকুরগুলো স্পিটজের ছিটকে-পড়া দেহের টানে জলে পড়ে গিয়েছিল, একে একে পেরল্ট তাদের জল থেকে তুলে আনল।
শুধু বিপজ্জনক বরফ নয়, আরও একটা সমস্যা বাককে বিপন্ন করে তুলেছিল। দীর্ঘকাল মানুষের আশ্রয়ে থাকার ফলে বাক-এর পায়ের তলা ছিল নরম। কিন্তু তার সঙ্গী হাস্কি কুকুরদের পা ছিল দীর্ঘভ্রমণে অভ্যস্ত ও কঠিন– ফলে ওই কুকুরগুলো কঠিন বরফ মাড়িয়ে অনায়াসে ছুটত আর বাক চলত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ছুটোছুটির পালা শেষ করে বিশ্রামগ্রহণের সময় হলেই বাক মড়ার মতো শুয়ে পড়ত। অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হলেও সে আহার্যগ্রহণের জন্য উঠতে চাইত না। ফ্রাঁসোয়া খাদ্য পৌঁছে দিত তার কাছে এবং নৈশভোজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রতি রাত্রেই তার পা মালিশ করে দিত।
অবশেষে সমস্যার সমাধান করল পেরল্ট তার নিজস্ব মোকাসিন জুতোর উপরাংশ কেটে সেই চামড়া দিয়ে বাক-এর জন্য চারটি জুতো বানিয়ে দিল সে। জুতো পরে পথ চলতে কষ্ট পায়নি বাক। একসময়ে অনুভব করল তার পায়ের তলা বেশ শক্ত হয়ে গেছে, জুতো ছাড়াই সে হাঁটতে পারে সহজভাবে। তখন জীর্ণ পাদুকা চারটি পথেই বিসর্জন দেওয়া হল।
.
১১. কুকুর যখন পাগল হয়
স্পিটজ ছিল দলের নেতা। দলের কোনো কুকুর অবাধ্য হলে তার দেহের উপর পড়ত স্পিটজের দাঁতাল চোয়ালের ধারাল দংশন। কিন্তু বাক সম্পর্কে তার অস্বস্তি ছিল। দক্ষিণের অধিবাসী কোনো কুকুর ইতিপূর্বে তুষার আচ্ছন্ন এই দুর্গম পথ অতিক্রম করতে পারেনি; পথশ্রমে শ্রান্ত দক্ষিণাঞ্চলের কুকুর পথের উপরেই হয়েছে মৃত্যুশয্যায় লম্বমান। বাক ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম। প্রথম প্রথম স্বল্প খাদ্য, দুরন্ত শীত আর কঠিন পরিশ্রম তাকে কাবু করে ফেললেও শেষ পর্যন্ত সে তার সহকর্মী হাস্কি কুকুরদের মতোই কষ্টসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। তার প্রচণ্ড শারীরিক শক্তি আর পরিবর্তিত হিংস্র চরিত্র স্পিটজকে উদবিগ্ন করে তুলেছিল।
কয়েকদিন পরে একটি অভাবিত দুর্ঘটনা দুই শত্রুর তিক্ত সম্পর্ককে আরও বেশি তিক্ত করে দিল। একদিন সকালে ফ্রাঁসোয়া যখন কুকুরদের স্লেজগাড়িতে জুতে রওনা হওয়ার উপক্রম করছে, সেইসময় প্রভাতের স্তব্ধতা ভেদ করে জাগল শ্বাপদকণ্ঠের তীব্র উৎকট ধ্বনি! ডলি নামে মেয়ে কুকুরটির গলা থেকে বেরিয়ে এসেছে ওই ভয়ংকর শব্দ!
ডলির চিৎকার শুনে ভয়ে চমকে উঠল কুকুরের দল। একবার মাত্র চেঁচিয়ে উঠেছিল ডলি, পরক্ষণেই সে তেড়ে গেল বাক-এর দিকে। বাক লড়াই করার চেষ্টা করল না, ডলির জ্বলন্ত চোখে সে উন্মাদের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিল– সভয়ে পিছন ফিরে দৌড় দিল সে। বাক জানত পাগলা কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে তার মৃত্যু নিশ্চিত- ডলির চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েও সে রুখে দাঁড়াতে সাহস পেল না, চেষ্টা করল পালিয়ে বাঁচতে।
বাক ছুটছে আর ছুটছে, দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে তার গতি, তবু ডলির সঙ্গে তার দূরত্ব কমে আসছে। ডলির দেহে এখন উন্মাদের অস্বাভাবিক শক্তি, প্রাণপণে ছুটেও বাক তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারছে না- ডলি একেবারে তার কাছে এসে পড়ল…
প্রাণের আশা যখন বাক ছেড়ে দিয়েছে, সেইসময় তার কান এল ফ্ৰসোয়র কণ্ঠস্বর- তার প্রভু তাকে ডাকছে। চোখ তুলে একবার সে ফ্রাঁসোয়ার মুখের দিকে চাইল, তারপর তিরবেগে ছুটে আসতে লাগল প্রভুর দিকে। বাক দেখল উদ্যত কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রাঁসোয়া। সে বুঝল এই প্রভুই তাকে বাঁচাতে পারে। ফ্রাঁসোয়ার পাশ দিয়ে বাক ছুটে বেরিয়ে গেল, তাকে অনুসরণ করে ফ্রাঁসোয়ার পাশে এসে পড়ল ডলি আর তৎক্ষণাৎ কুঠার তুলে ভীষণ জোরে আঘাত হানল ফ্রাঁসোয়া ডলির মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বুনন কুকুরের দংশনে উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল ডলি।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে বাক-এর দম ফুরিয়ে এসেছিল, অতিকষ্টে হাঁফাতে হাঁফাতে শ্বাসগ্রহণের চেষ্টা করছিল সে। স্পিটজ বুঝল এই সুযোগ, ক্লান্ত অবসন্ন বাক-এর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল। স্পিটজের ধারাল দাঁত মাংস ভেদ করে হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেল– বাক বাধা দিল না, কারণ বাধা দেবার ক্ষমতা তার তখন ছিল না।
বিপন্ন বাককে সাহায্য করতে আবার এগিয়ে এল ফ্রাঁসোয়া। তার চাবুক পড়তে লাগল স্পিটজের সর্বাঙ্গে। ইতিপূর্বে ফ্রাঁসোয়ার হাতে এমন ভীষম মার খায়নি কোনো কুকুর। মহা-আনন্দে দৃশ্যটাকে উপভোগ করল বাক। এই ঘটনার পর বাক একটা চরম সিদ্ধান্তে উপস্থিত হল- এতদিন সে শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে, এইবার আক্রান্তের ভূমিকা ছেড়ে আক্রমণকারীর ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হবে।
.
১২. সংঘাত
বাক এবার নেতা হল। ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট পরিচার্লিত স্লেজবাহক কুকুরদের অবিসংবাদিত নেতা এখনও স্পিটজ, কিন্তু পূর্বোক্ত কুকুরদের মধ্যে যে বিদ্রোহী দলটার সৃষ্টি হয়েছে, সেই দলের অবিসংবাদিত নেতা হল বিপুল বপু বাক।