চটপট আহার শেষ করেই বাক ফিরে গেল তার আস্তানার দিকে, কিন্তু গর্তের ভিতর সে ঢুকতে পারল না কারণ সেখানে বেশ আরাম করে শুয়েছিল স্পিটজ। বাক যখন খাদ্যগ্রহণে ব্যস্ত, সেইসময়ে তার তৈরি করা গর্তটাকে স্পিটজ অধিকার করেছে। সব কিছুরই শেষ আছে, স্বভাবে শান্ত হলেও বাক-এর ধৈর্য অসীম নয়- সগর্জনে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পিটজের উপর। দুজনে জড়াজড়ি করে ছিটকে বেরিয়ে এল গর্তের বাইরে, পরক্ষণেই দন্তবিস্তার করে দুই শত্রু পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল হিংস্র আগ্রহে।
কুকুরদের চরিত্র সম্পর্কে দস্তুরমতো অভিজ্ঞ ছিল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট, বাক এবং স্পিটজের চালচনল দেখে অনেক আগেই তাদের মনিব দু-জন বুঝতে পেরেছিল একটা ভয়ংকর লড়াই আসন্ন– এই কলহের একমাত্র ও অনিবার্য সমাধান হচ্ছে মৃত্যু!
বাক, হতভাগা স্পিটজকে ভালো রকম শিক্ষা দাও, চিৎকার করে উঠল পেরল্ট, ও একটা ছিঁচকে চোর।
কিন্তু দুই শত্রুর মৃত্যুপণ লড়াই শুরু হওয়ার আগেই বাধা এল-হঠাৎ তীব্রকণ্ঠে একটা কটু শপথ করে হাতের মুগুর সবেগে চালনা করল পেরল্ট– একটা বুনো কুকুর খাবারের বাক্সটার দিকে চুপি চুপি এগিয়ে আসছিল, পেরন্টের মুগুর সজোরে ও সশব্দে নেমে এল তার অস্থিসার দেহের উপর।
পরক্ষণেই খাবারের বাক্সটাকে আক্রমণ করল এক বিরাট সারমেয়-বাহিনী। চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশটা বুনো কুকুর ছিল ওই দলে। তাদের সমবেত আক্রমণে বাক্সটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে খাবারগুলো ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্টের মুগুরের আঘাত অগ্রাহ্য করে ক্ষুধার্ত জন্তুগুলো খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ডিম, রুটি, মাংস প্রভৃতি খাদ্যসামগ্রী অন্তর্ধান করল বুভুক্ষু কুকুরদের উদরে!
স্লেজবাহক কুকুরের দল সাগ্রহে দেখছিল বাক আর স্পিটজের দ্বন্দ্বযুদ্ধ; বুনো কুকুরদের হঠাৎ আবির্ভাব তাদের চমকে দিয়েছিল। প্রথমে তারা অবাক হয়ে আগন্তুকদের গতিবিধি লক্ষ করছিল। কিন্তু বুনো কুকুরদের দলটা যখন খাবার শেষ করেই পোষা কুকুরদের উপর হিংস্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন পোষা কুকুরগুলো বুঝল নিশ্চেষ্ট দর্শকের ভূমিকায় থাকলে মৃত্যু অবধারিত– প্রথম বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই তারা রুখে দাঁড়াল সমবেতভাবে। স্লেজবাহক কুকুররা ছিল বুনোদের চাইতে অনেক বড়ো এবং ওজনে ভারি– তার উপর নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের ফলে তাদের দেহ হয়েছিল পেশীপুষ্ট, বলিষ্ঠ তাই এক-একটি স্লেজবাহক কুকুর দুদুটো অনশনক্লিষ্ট বুনো কুকুরকে অনায়াসেই মাটির উপর ঝেড়ে ফেলেছিল। কিন্তু বুনোদের সংখ্যা ছিল স্লেজবাহক কুকুরদের চাইতে অনেক বেশি, সুতরাং বুনোদের চাইতে শারীরিক ক্ষমতায় অধিকতর বলিষ্ঠ হলেও সংখ্যাগুরু শত্রুর আক্রমণে তাদের জীবন হয়ে উঠল বিপন্ন।
একসঙ্গে তিন-তিনটি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বাক দেখল আরও একটি কুকুর তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে। নবাগত শত্ৰু বাক-এর অপরিচিত নয়, সবিস্ময়ে সে দেখল বুনো কুকুরদের দলে যোগ দিয়ে স্পিটজ তার গলায় কামড় বসিয়ে দিয়েছে! দারুণ আক্রোশে সংহারমূর্তি ধারণ করল বাক- এমন ভয়ংকর, এমন তীব্র সেই আক্রমণ যে, মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল চার-চারটি শত্রু!
ইতিমধ্যে লড়াই করতে করতে পিছু হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করছিল স্লেজবাহক কুকুরের দল। বুনোরা তাদের অনুসরণ না করে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে গেল খাদ্যের সন্ধানে। পোষা কুকুররা সকলেই কম-বেশি আহত হয়েছিল। ডলি নামে মেয়ে কুকুরটির আঘাত ছিল মারাত্মক ধারাল দাঁতের কামড়ে তার গলায় ফুটে উঠেছিল বীভৎস ক্ষতচিহ্ন।
সারা রাত ধরেই পোষা কুকুরের দল তাদের রক্তাক্ত ক্ষতগুলোর পরিচর্যা করল, তারপর ভোরের আলো পৃথিবীতে উঁকি মারার সঙ্গেসঙ্গে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে এল পরিত্যক্ত অঁবুতে।
বুনো কুকুররা তখন সরে পড়েছে। পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার মনের অবস্থা ভালো নয়। খাবার-দাবার যা ছিল তার অর্ধেক গেছে বুনোদের পেটে, বাকি অর্ধেক অতিকষ্টে বাঁচিয়েছে দুই বন্ধু। অনশনক্লিষ্ট ক্ষুধার্ত বুনো কুকুরের দল যা পেয়েছে তা-ই খেয়েছে লাগাম, জুতো কিছুই তারা বাদ দেয়নি।
ছিন্নভিন্ন লাগামগুলো মেরামত করে দুই বন্ধু যখন কুকুরগুলোকে স্লেজগাড়িতে জুতে নিয়ে আবার যাত্রা করার আদেশ দিল, তখনও আহত কুকুরদের শরীরে দস্তুরমতো যন্ত্রণা ছিল। কিন্তু কেউ বিদ্রোহ করল না, স্লেজটাকে টানতে টানতে তারা চলতে শুরু করল। কুকুররা কেউ তখন অসমাপ্ত লড়াইটার কথা ভাবছিল না, এমনকী দ্বন্দ্বযুদ্ধের দুই নায়ক স্পিটজ আর বাক-এর মনেও লড়াই-এর চিন্তা উঁকি দেয়নি মুহূর্তের জন্য।
১০. পাদুকাবিলাসী বাক
বুনো কুকুরদের আক্রমণ যেখানে ঘটেছিল, সেখান থেকে স্লেজচালক দুটির নির্দিষ্ট গন্তব্য ডসন নামক স্থানটির দুরত্ব ছিল চারশো মাইল। পথের মধ্যে পড়ল একটা প্রকাণ্ড নদী। নদীর জলস্রোত ছিল অতিশয় প্রখর। নিদারুণ শীত ওই নদীর কয়েক জায়গায় নিরেট বরফের মসৃণ চাদর বিছিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু অধিকাংশ স্থানেই শীতের আক্রমণ অগ্রাহ্য করে জলস্রোত ছিল অব্যাহত। নদীর যেসব জায়গায় বরফের আবরণে নিরেট জমি তৈরি হয়েছিল, সেইসব জায়গার উপর দিয়ে প্রাণ বিপন্ন করে কুকুরবাহিত স্লেজ চার্লিয়ে নদী পার হল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট। নদীটা পার হতে তাদের সময় লেগেছিল ছয়দিন। খুব সহজে অবশ্য কার্য সম্পন্ন হয়নি। বরফের চাদর ভেঙে একবার তলদেশে প্রবাহিত জলস্রোতের মধ্যে পড়েগিয়েছিল পেরল্ট। ভেঙে-পড়া বরফের গর্তের দু-ধারে নিরেট বরফ ঢাকা জমির উপর হাতের লম্বা বাঁশটা আড়াআড়িভাবে আটকে দিয়ে পের কোনোরকমে সলিলসমাধি থেকে আত্মরক্ষা করল বটে, কিন্তু তুষারশীতল জলে তার সর্বাঙ্গ এমন অসাড় ও আড়ষ্ট করে দিল যে, গর্তের ভিতর থেকে উপরের নিরাপদ আশ্রয়ে উঠে আসার ক্ষমতা তার রইল না। ফ্রাঁসোয়া অতিকষ্টে বিপন্ন বন্ধুকে সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করল। আর-একবার গোটা স্লেজগাড়িটাই বরফ ভেঙে তলদেশে প্রবাহিত জলস্রোতের মধ্যে ছিটকে পড়ল। প্রাণপণ চেষ্টায় দুই বন্ধু যখন স্লেজসমেত কুকুর বাহিনীকে নদীগর্ভ থেকে জমাট বরফের উপর তুলে আনল– তখন দেখা গেল প্রচণ্ড ঠান্ডায় কুকুরদের জলে-ভেজা রোমশ দেহের উপর পড়ে গেছে নিরেট বরফের আবরণ!