.
০৮. আদিম সংগীত
বাক ক্ষুধার্ত। সর্বদাই সে ক্ষুধার্ত থাকে। তীব্র শীতার্ত আবহাওয়ায় মাইলের পর মাইল স্লেজ টেনে ছুটে চলার পরিশ্রম তার উদরে যে ক্ষুধার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পরিমিত মাপা খাদ্য সেই আগুন নিবিয়ে দিতে পারে না। দলের অন্য কুকুরদের চাইতে তাকে বেশি খাবার দেওয়া হত। মালিক দু-জন বুঝেছিল অন্য কুকুরদের চাইতে বাক-এর শরীর অনেক বড়, তাই তুলনামূলকভাবে তাকে বেশি খাবার না দিলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে। সকলের জন্য বরাদ্দ ছিল এক পাউন্ড শুকনো স্যালমন মাছ, বাক-এর জন্য বরাদ্দ দেড় পাউন্ড। তবু তার পেট ভরত না। অন্য কুকুরদের দেহের আকার ছোটো, তার উপর তারা কঠিন পরিশ্রমে অভ্যস্ত, তাই কম খেয়েও তাদের স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। কিন্তু কঠিন পরিশ্রমে অনভ্যস্ত বাক-এর প্রকাণ্ড শরীর প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব অনুভব করত প্রতি মুহূর্তে। এমনকী বরাদ্দ খাবারও তার ভাগ্যে অনেক সময় জুটত না, অন্য কুকুরেরা সুযোগ পেলেই তার খাবার খেয়ে ফেলত। বাক একসময়ে শৌখিন খাদ্যরসিক ছিল হাউমাউ করে সে খাবার গিলত না–রসিয়ে রসিয়ে সময় নিয়ে সে আহার্য গ্রহণ করত বনেদি বংশের সন্তানের মতো। কিন্তু এখনকার হ্যাংলা কুকুরগুলো ঝটপট নিজেদের খাদ্য গলাধঃকরণ করেই বাক-এর খাবারে ভাগ বসাত। বাক কিছুতেই তাদের বাধা দিতে পারত না। সে যখন দু-দুটো কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন তৃতীয় কুকুরটি বাক-এর বরাদ্দ মাছটি নিয়ে সরে পড়েছে নিরাপদ দূরত্বে! এমন হাভাতে হ্যাংলা অসভ্য সঙ্গীদের কবল থেকে লড়াই করে খাবার বাঁচানো যায় না এদের ঠেকানোর একটাই উপায় এবং মাথা খাঁটিয়ে সেই উপায়টাই একসময়ে বার করে ফেলল বাক। সে খুব তাড়াতাড়ি খেতে শিখল- অন্য কুকুররা তাদের খাবার শেষ করে বাক-এর উপর হানা দিতে এসে দেখত বাক তার খাদ্য অনেক আগেই শেষ করে বসে আছে।
একটা প্রবাদ আছে, প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ আবিষ্কার করে। কথাটা শুধু মানুষ সম্পর্কে নয়, কুকুর সম্পর্কেও প্রযোজ্য। বাক চুরি করতে শিখল। এমন সাবধানে সে চুরি করত যে, মনিবরা বুঝতেই পারত না কে চুরি করেছে। মাইক নামে কুকুরটি এবিষয়ে তার পথ-প্রদর্শক। একদিন পেরল্ট যখন রান্না করছে, সেইসময় তার পিছনে এসে নিঃশব্দে এক টুকরো মাংস নিয়ে সরে পড়ল মাইক। দৃশ্যটা বাক-এর চোখে পড়েছিল। বিচারক মিলারের পোষ্য বাক এতদিন চুরির কথা কল্পনাই করতে পারেনি, চুরি তো মহাপাপ! কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাইকের চৌর্যবৃত্তি তাকে উৎসাহিত করল এবং পরের দিনই পেরন্টের অজ্ঞাতসারে তার থালা থেকে একটা মস্ত বড়ো মাংসের চাই সরিয়ে ফেলল বাক। পেরল্ট মাইকের চুরি ধরতে পারেনি, কারণ অপহৃত মাংসের টুকরোটা ছিল খুব ছোটো কিন্তু বিরাট একখণ্ড মাংস উধাও হয়ে যেতেই ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল পেরল্ট। বাক-এর মতো সভ্যভব্য ভদ্র কুকুরকে চোর বলে ভাবতে পারল না সে, ডাব নামে একটি কুকুরকে সন্দেহ করে তার উপর সে চাবুক চালাল। বাক বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করল না, নিজের কৃতিত্বে দস্তুরমতো খুশি হল সে।
ক্রমশ কঠিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল বাক। লোহার মতো শক্ত হয়ে উঠল তার দেহের মাংসপেশী। সাধারণ ব্যথা-বেদনা সে আর অনুভব করত না। তৃষ্ণার্ত হলে কেমন করে কঠিন বরফের নিরেট আবরণ ভেদ করে তলদেশে অবস্থিত শীতল জলে তৃষ্ণা নিবারণ করা যায়, নখের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে থাকা বরফের টুকরো কেমন করে বার করতে হয়- সব কৌশল সে রপ্ত করে ফেলল। এখন যে-কোনো খাদ্য তা যত অখাদ্যই হোক– সে নির্বিকারভাবে উদরস্থ করতে পারে। তার সবল পরিপাকযন্ত্র নিতান্ত অখাদ্য থেকেও খাদ্যরস সংগ্রহ করে শরীরকে বলিষ্ঠ করে তুলতে সমর্থ। ওই সঙ্গে জন্মগত ঘ্রাণশক্তি হয়েছে আরও তীব্র, শ্রবণ-ইন্দ্রিয় হয়ে উঠেছে এমন তীক্ষ্ণ যে, ঘুমের মধ্যেও সাম্ভাব্য বিপদের ইঙ্গিত বুঝতে তার অসুবিধা হয় না।
শুধু অভিজ্ঞতা থেকেই সে শিক্ষালাভ করেনি, পূর্বপুরুষের আদিম সংস্কার তার রক্তে জেগে উঠছিল ধীরে ধীরে। গৃহপালিত কুকুরের শিক্ষা-দীক্ষা একসময়ে মুছে গেল তার চরিত্র থেকে, জাগ্রত হল পূর্বপুরুষের হিংস্র সত্তা, যুগযুগান্তরের বিস্মৃতির আবরণ ভেদ করে- যেমনভাবে একসময়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে বুনো নেকড়ের দল, ঠিক সেইভাবেই লড়তে শিখল বাক। নেকড়ের মতোই চাঁদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠত সে, অন্ধকার অরণ্যের বুকে বিষাদের শিহরন তুলে বাজাত সেই আদিম জান্তব সংগীত।
.
০৯. মৃত্যুর হানা
দলের নেতা স্পিটজ আর বাক-এর বিরোধ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। বাক তার নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল, অনর্থক কলহে লিপ্ত হতে চাইত না সে। কিন্তু স্পিটজ ভুল বুঝল, সে ভাবল বাক ভয় পাচ্ছে। স্পিটজ আরও একটা ভুল করল- সে ধরে নিল শুধু বিশাল দেহের অধিকারী বলেই বাককে দলের কুকুরা সমীহ করে, আসলে বাক দুর্বল ও ভীরু লড়াই করতে সে ভয় পায়। লে বার্জ নামক হ্রদের ধারে যে রাতে স্লেজচালকদের তাবু পড়ল, সেই রাতেই বাক-এর সঙ্গে কলহে লিপ্ত হল স্পিটজ।
কনকনে ঠান্ডা বাতসের ভিতর দিয়ে বরফ ভেঙে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট, বাতাস যেন ধারাল ছুরির মতো ছোবল মারছিল তাদের শরীরে বাধ্য হয়ে অন্ধকার নেমে আসার অনেক আগেই দুই স্লেজচালক সেদিন তাঁবু খাঁটিয়ে ফেলল। একটা উঁচু পাথরের তলায় বরফ খুঁড়ে রাতের আস্তানা বানাল বাক। বরফের তলায় ওই সদ্যনির্মিত বাসা এত আরামদায়ক যে, সেই আশ্রয় ছেড়ে বাইরে আসতে সে আদৌ ইচ্ছুক ছিল না। ফ্রাঁসোয়া যখন কুকুরদের ডেকে তাদের বরাদ্দ মাছ বিতরণ করতে শুরু করল, তখন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেবলমাত্র খাওয়ার জন্যই অমন চমৎকার আশ্ৰয়টা ছেড়ে খাদ্যগ্রহণের জন্য এগিয়ে গেল বাক।