রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে কাঁধের ক্ষত এবং ক্রমবর্ধমান শীত বাককে দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল। একটা তাঁবুর ভিতর জ্বলন্ত মোমবাতির আভাস পেয়ে এগিয়ে গেল বাক। তাঁবুর পর্দা ঠেলে ভিতরে গিয়ে সে দেখল সেখানে বসে আছে পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া। কিন্তু তাবুর আরামদায়ক উত্তাপ ভোগ করতে পারল না বাক- পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়া হই হই শব্দে তাকে তাড়া করল, রান্নার যাবতীয় সামগ্রী অর্থাৎ হাঁড়িকড়াই-হাতা প্রভৃতি তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারতে লাগল তার দিকে। এমন সাংঘাতিক অভ্যর্থনা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য আবার বাক পালিয়ে এল তুষারাবৃত শীতার্ত প্রান্তরের বুকে। একটু উষ্ণ আশ্রয়ের সন্ধানে বাক যখন ইতস্তত পদচালনা করছে, সেইসময় তাকে আক্রমণ করতে এল একদল হিংস্র কুকুর। বাক দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিতেই তারা চটপট সরে পড়ল। ততক্ষণে তুষারপাত শুরু হয়েছে প্রবলবেগে, কাঁধের ক্ষতস্থানে আবার যন্ত্রণাবোধ করছিল ক্লান্ত ও অবসন্ন বাক…
হঠাৎ বাক-এর মস্তিষ্কে একটা নতুন চিন্তা চমকে উঠল বিদ্যুৎ চমকের মতো তার সঙ্গীদের বিশ্রামের জায়গা খুঁজে বার করতে পারলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। নতুন উদ্যমে শুরু হল অনসন্ধান পর্ব, কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি আর অনেক ঘোরাঘুরি করেও বাক তার সঙ্গীদের সন্ধান পেল না তারা যেন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে তুষার-ঢাকা প্রান্তরের উপর থেকে!.. হতাশভাবে চলতে চলতে বাক যখন আবার মালিকদের তাবুর কাছে এসে পড়েছে, সেইসময়ে আচম্বিতে তার সামনের পা ঢুকে গেল বরফের মধ্যে এবং তার পায়ের তলা থেকে পিছলে সরে গেল কোনো একটি বস্তু! সভয়ে ছিটকে সরে এল বাক, তার গলা থেকে বেরিয়ে এল অস্ফুট ক্রুদ্ধ গর্জন কিন্তু একটা বন্ধুত্বসূচক শব্দে আশ্বস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বাক দেখল বরফের মধ্যে একটা গর্ত খুঁড়ে শুয়ে আছে বিলি নামে নিরীহ কুকুরটি।
এবার আর কর্তব্য নির্ধারণে ভুল করল না বাকবরফের মধ্যে চটপট একটা গর্ত খুঁড়ে সে শুয়ে পড়ল তার শরীরের তাপে গর্তটা ক্রমশ গরম হয়ে উঠল আর সেই উষ্ণ আশ্রয়ের মধ্যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল বাক ধীরে ধীরে…
.
০৭. পথে বিপথে
সারা রাত ধরে তুষারপাত চলল। পরের দিন সকালে মানুষ ও কুকুরের মিলিত শব্দে বাক-এর যখন ঘুম ভাঙল, তখন তুষারের স্তূপ তার শরীর ঢেকে ফেলেছে। গত রাত্রির কথা প্রথমে তার মনে পড়েনি, ঘুম ভাঙার পর যখন সে বুঝল জমাট তুষারস্তূপের তলায় সে শুয়ে আছে, তখনই তার মনে হল একটা বিপজ্জনক ফঁদের মধ্যে পড়ে গেছে সে। বাক গৃহপালিত কুকুর, খাঁচার সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও ফাঁদ নামক বস্তুটি তার অজানা কিন্তু বনবাসী পূর্বপুরুষের বন্য সংস্কার তাকে ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন করে দিল- দারুণ আতঙ্কে এক লাফ মেরে স্তূপাকার তুষারের আবরণ ভেদ করে সূর্যের উজ্জ্বল আলোকধারার মধ্যে সে আত্মপ্রকাশ করল।
বাক-এর অভাবিত আবির্ভাবে উল্লসিত পেরল্ট ফ্রাঁসোয়াকে উদ্দেশ করে বলল, কুকুরটা খুব বুদ্ধিমান। দেখ, এক রাতের মধ্যেই সে সব কিছু শিখে ফেলেছে!
ইতিমধ্যে আরও তিনটি হাস্কি কুকুর কিনে ফেলেছে পেরল্ট। কুকুরের সংখ্যা এখন নয়। ওই নয়টি কুকুরকে স্লেজগাড়িতে জুতে নিয়ে একদিন অজানা পথে যাত্রা করল পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া। বাক সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সোল-লেকস আর ডেভ নামে কুকুর দুটি চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে যে-দুটি কুকুর নিঃসঙ্গ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল, তারা এখন সমবেতভাবে কর্তব্য করতে উৎসুক উৎসাহে, আবেগে তার যেন ছটফট করছে! যাত্রা শুরু হওয়ার পরে দেখা গেল ওই কুকুর দুটির স্লেজবাহক হিসাবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। বরফ-ঢাকা বিপজ্জনক পথে কেমন করে চলতে হয় তারা জানে। দলের অন্যান্য কুকুর ভুল করলে তারা ভীষণ বিরক্ত হত।
বাক প্রথম-প্রথম ভুল করত। সকলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে ছুটতে পারত না। অনেক সময়ে লাগামে পা জড়িয়ে সে বিভ্রাটের সৃষ্টি করত। গাড়িতে জুতে দেওয়ার সময় হলে সে চটপট হাজির হতে পারত না। ওই ধরনের বিপত্তি ঘটলেই সোল-লেকস অথবা ডেভ বাককে আক্রমণ করত, ধারাল দাঁতের কামড় বসত বাক-এর শরীরে। কিন্তু অকারণে তারা কখনো বাক-এর উপর হামলা করত না। বাক বুঝল কুকুর দুটি তার শত্রু নয়, শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা নিষ্ঠুর ব্যবহার করে। বাক বুদ্ধিমান জীব, খুব অল্পদিনের মধ্যেই সে পথ চলার কৌশল আয়ত্ত করে ফেলল। অন্য কুকুরদের মতোই মহা-উৎসাহে সে স্লেজ টানতে শুরু করল। সাধারণত ধাবমান স্লেজের সামনের পথের দিশারি হয়ে বরফ ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যেত পেরল্ট তার বিশেষভাবে তৈরি জুতো দিয়ে অনুসরণকারী স্লেজবাহক কুকুরদের সে সাহায্য করত যথাসাধ্য। বরফ-ঢাকা পথের অভিজ্ঞ পথিক পেরল্ট একবার তাকিয়েই বুঝতে পারত তুষারের আবরণ কতটা পুরু এবং ওই আবরণ বা আস্তরণের উপর স্লেজগাড়ির নিরাপত্তা বা নিরাপত্তার অভাবও সে অনুমান করতে পারত নির্ভুলভাবে..
পেরল্ট নামে দ্বিপদ মালিক আর ডেভ ও সোল-লেকস নামে চতুষ্পদ সহকর্মী দুটির নেতৃত্বে খুব অল্পদিনের মধ্যেই বাক একজন অভিজ্ঞ ব্লেজবাহক হয়ে উঠল.. জমাট এবং গভীর বরফপ, বরফ ঢাকা মসৃণ পিচ্ছিল পথ বেয়ে দিনের পর দিন ছুটতে লাগল স্লেজবাহক কুকুরের দল… অবশেষে দেখা গেল একদিনে চল্লিশ মাইল পথ পার হয়ে এসেছে তারা! পেরল্ট ঘোষণা করল, এতদিন ধরে সে যতগুলো দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্যে বর্তমান কুকুর বাহিনী হচ্ছে সবচেয়ে দক্ষ, সকলের সেরা। বাক এখন খুব খুশি, সোল-লেকস আর ডেভ তার বন্ধু, মালিক পের তার আচরণে সন্তুষ্ট– শৃঙ্খলা মেনে দলের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে শিখেছে বাক। পেরন্টের প্রশংসা আর একদিনে চল্লিশ মাইল পথ পেরিয়ে আসার কথা ভাবতে ভাবতে সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ল বাক।