এতক্ষণে যে হাস্কি কুকুরের দল চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছিল, তারা হঠাৎ ছুটে এসে কার্লি ও ক্ষুদ্রকায় হাস্কি কুকুরটিকে ঘিরে বসল এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল সাগ্রহে।
বিনাদোষে মার খেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল কার্লি, সে সক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাস্কির উপর। কিন্তু ক্ষুদ্রাকায় হাস্কি তার বিপুল বপু প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল একলাফে সরে গিয়ে–পরক্ষণেই আর এক লাফে কার্লির উপর পড়ে তীব্র দংশনে তাকে রক্তাক্ত করে দিয়ে সরে এল নাগালের বাইরে কার্লি একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না। হাস্কি কুকুরটার পরবর্তী আক্রমণে ভারসাম্য হারিয়ে মাটির উপর ছিটকে পড়ল কার্লি, সঙ্গেসঙ্গে চতুর্দিকে অপেক্ষমাণ হাস্কি কুকুরের দল সমবেত আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধরাশায়ী কার্লির উপর। অনেকগুলো দাঁতের নিষ্ঠুর আঘাতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল কার্লি…।
বাক বুঝল একদল হিংস্র বন্যপশুর সঙ্গে সে বাস করছে– গৃহপালিত হলেও স্বভাবে তারা বনবাসী শ্বাপদের মতোই রক্তলোলুপ, ভয়ংকর স্বজাতির মাংসে তাদের রুচি নেই কিছুমাত্র। দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ কোনো কুকুর মাটিতে ছিটকে পড়লে তার রক্ষা নেই ধরাশায়ী কুকুর ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ানোর আগেই তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সারমেয়-বাহিনীর সমবেত আক্রমণে। বাক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামলেও সে কিছুতেই ভারসাম্য হারিয়ে ধরাশায়ী হবে না, কার্লির মতো অসহায়ভাবে সে মৃত্যুবরণ করবে না কখনোই। কার্লির শোচনীয় পরিণামে উল্লসিত স্পিটজের নিষ্ঠুর হাসির শব্দ তার মনের ভিতর ধ্বনিত হতে লাগল বারবার, পূর্বোক্ত ঘটনার পর থেকেই স্পিটজ সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করতে লাগল বাক।
.
০৬. শীতার্তের আশ্রয়
তুষারাবৃত উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে সরকারি চিঠিপত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব নিয়েছিল পেরল্ট। কার্লির মৃত্যুর ফলে কুকুরবাহী স্লেজগাড়ির গতি হল মন্থর, সুতরাং চিঠিপত্র যথাস্থানে যথাসময়ে পৌঁছনোর পরিবর্তে বিলম্বের সম্ভাবনা দেখা দিল। নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পেরল্ট ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেইজন্য অর্থব্যয় করতেও সে অসম্মত ছিল না- মধ্যাহ্নভোজনের পরেই দুটি নতুন কুকুর কিনে নিয়ে সে ফিরে এল তাঁবুতে।
ফ্রাঁসোয়া নবাগতদের পরীক্ষা করতে লাগল। কুকুর দুটি সহোদর ভাই হলেও তাদের স্বভাবে একটুও মিল ছিল না। বিলি ছিল মৃত কার্লির মতোই শান্ত নিরীহ, সর্বদাই সে অন্য কুকুরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী কিন্তু তার ভাই জো ছিল অত্যন্ত বদমেজাজি– তার ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে ধারাল দাঁতের সারি সবসময়ই কিছুটা বেরিয়ে থেকে প্রমাণ করত দাঁতের অধিকারী ওই অস্ত্রের ব্যবহার করতে বিলক্ষণ প্রস্তুত এবং অবরুদ্ধ ক্রোধের আগুনে তার দুই চক্ষু ছিল সর্বদাই জ্বলন্ত!
স্পিটজ তার স্বভাব অনুযায়ী নবাগতদের শিক্ষা দিতে এগিয়ে এল। বিলি বিনাযুদ্ধেই পরাজয় স্বীকার করল, তা সত্ত্বেও স্পিটজের নিষ্ঠুর দংশন বিলির দেহের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত ক্ষতের সৃষ্টি করল।
কিন্তু জো ভাই-এর মতো নিরীহ জীব নয়– হিংস্ৰদন্ত বিস্তার করে দুই চোখে ঘৃণা ও আক্রোশের আগুন জ্বালিয়ে সে এমন ভীষণভাবে রুখে দাঁড়াল যে, স্পিটজ বুঝল এই শত্রু কিছুতেই হার মানবে না– জীবন বিপন্ন করেও সে লড়াই করতে প্রস্তুত। এমন গোঁয়ার শত্রুর সঙ্গে মারামারি করতে চাইল না স্পিটজ, সে চটপট সরে পড়ল এবং মান বাঁচাতে এমন ভাব করল যেন সে জো নামে কুকুরটির সঙ্গে কখনোই লড়াই করতে চায়নি। গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিতে সে আবার হামলা চালাল নিরীহ বেচারা বিলির উপর।
সেইদিনই নৈশভোজের আগে একটি লোক আরও একটি কুকুরকে তাবুতে নিয়ে এল। কুকুরটি লম্বা ও ছিপছিপে, তার ক্ষতবিক্ষত মুখ বহু রক্তাক্ত যুদ্ধের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং তার একটি চোখ অন্ধ (সম্ভবত কোনো যুদ্ধের পরিণাম)।
লোকটি পূর্বোক্ত কুকুরটিকে পেরন্টের কাছে বিক্রি করে দিল। ওর নাম সোল-লেকস, লোকটি বলল, কথাটার অর্থ হচ্ছে ক্রুদ্ধ পশু, বুঝলে?
কুকুরদের কাছে সোল-লেকস নামটির অর্থ ব্যাখ্যা করার দরকার হল না। এমন সার্থকনামা জীব বড়ো একটা দেখা যায় না। সে নির্বিকারভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দলের মাঝখানে। স্পিটজ নবাগতকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু একনজর তাকিয়েই সে বুঝতে পারল এই জটাও খুব সুবিধার নয়, এর সঙ্গে লাগতে গেলে বিপদ ঘটতে পারে- স্পিটজ আবার বসে পড়ল।
ডেভ নামে কুকুরটির মতোই সোল-লে ছিল শান্তিপ্রিয়, তবে কারও সঙ্গে বন্ধুত্বস্থাপনে সে ইচ্ছুক ছিল না– তাকে চুপচাপ থাকতে দিলেই সে খুশি। কিন্তু একটি বিষয়ে সে ছিল অতিশয় স্পর্শকাতর– তার যে চোখটা কানা, সেইদিক থেকে কোনো কুকুর তার নিকটবর্তী হলেই সে হিংস্র প্রতিবাদে চঞ্চল হয়ে উঠত।
নবাগত কুকুরটির চরিত্রগত দুর্বলতার বিষয় প্রথমেই সচেতন হল বাক এক রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে। প্রথম রাতেই বাক আগন্তুকের খুব কাছে এসে পড়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় সোল-লেকস-এর যে-চোখটা কানা, সেইদিকেই অবস্থান করছিল বাক। বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্ত আক্রমণে বাক-এর কাঁধের মাংস হাড় পর্যন্ত কেটে নামিয়ে দিল সোল-লেকস। পেরল্ট তাড়াতাড়ি বাধা না দিলে তখনই একটা রক্তাক্ত বিপর্যয় ছিল অনিবার্য। ওই ঘটনায় দলের অন্য কুকুরগুলো সতর্ক হয়ে গেল। বেচারা বাক তার অজ্ঞতার প্রায়শ্চিত্ত করল রক্ত দিয়ে।