জাহাজ থেকে নামিয়ে বাক এবং তার চতুষ্পদ সঙ্গীদের নিয়ে যাওয়া হল খনি শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট একটি তাঁবুতে। ওইখানে বাক ও তার সঙ্গীরা এসে পড়ল এক ভয়ংকর পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে। তাবুর বাসিন্দা ছিল শতাধিক মানুষ। তাদের মধ্যে খুব কম লোকই ছিল পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার মতো ভদ্র ও সহৃদয় অধিকাংশই ছিল বদমেজাজি নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ এবং তাদের হাতে সর্বদাই থাকত চাবুক আর মুগুর। ওই লোকগুলোর সঙ্গে যে কুকুরগুলো ছিল, তাদের স্বভাব-চরিত্র ছিল মনিবদের চেয়েও খারাপ। বাক সবসময়ই প্রস্তুত থাকত অতর্কিত আক্রমণের মোকাবিলার জন্য। হাস্কি নামে অভিহিত ওই ভয়ংকর কুকুররা প্রতিপক্ষকে আত্মরক্ষার সুযোগ দিত না, নিঃশব্দে দ্রুত আঘাত হানত প্রতিপক্ষের উপর। বাক কোনোদিনই খুব নিরীহ জীব ছিল না, কিন্তু ওই হিংস্র বদমেজাজি জন্তুগুলোর সঙ্গে কলহে লিপ্ত হতে সে চাইত না। অতএব, যথাসম্ভব তাদের এড়িয়ে চলত সে।
মাত্র একদিনের জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল বাক। পরের দিনই ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার স্বাদ পেল সে। সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে…
একদিন ফ্রাঁসোয়া অনেকগুলো চামড়ার ফিতে, বগলস প্রভৃতি সাজসজ্জা নিয়ে এল এবং ওই বস্তুগুলিকে বাক-এর শরীরে জড়িয়ে দিল। পূর্বোক্ত সাজ-সরঞ্জামের সঙ্গে বাক পরিচিত ছিল। তার পূর্বতন মনিব বিচারক মিলারের আস্তাবলে সে দেখেছিল যাত্রা করার আগে ঘোড়াদের ওইসব চামড়ার জিনিস দিয়ে সাজানো হত।
ঘোড়াকে যেভাবে গাড়িতে জুতে দেওয়া হয়, ঠিক সেইভাবেই একটা স্লেজগাড়ির সঙ্গে লাগাম, বন্ধনী প্রভৃতি জিনিসের সাহায্যে বাককে জুতে দেওয়া হল।
এইখানেই গল্প থামিয়ে স্লেজ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। কারণ, বাংলাভাষী বালক বালিকাদের মধ্যে অনেকেই পূর্বোক্ত গাড়ি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না। স্লেজগাড়ি তুষারবৃত উত্তরাঞ্চলের একমাত্র যান– গাড়িটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্যান্য গাড়ির মতো স্লেজের তলায় চাকা লাগানো থাকে না, চাকার বদলে থাকে দুটি সমান্তরাল ডাণ্ডা। রানার নামে অভিহিত ওই ডাণ্ডায় ভর দিয়ে কুকুর-টানা স্লেজ দ্রুতবেগে ছুটে যায় মাইলের পর মাইল অক্লেশে। ঘোড়ায় টানা গাড়ির চাকা এবং ঘোড়ার পা হালকা তুষারের উপর বসে যায় বলেই চক্রবিহীন স্লেজগাড়ি কুকুরের সাহায্যে চালানো হয়। কুকুরের দেহের ওজন ঘোড়ার চাইতে অনেক কম– সুতরাং তুষারমাখা কাদায় তাদের পা বসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এবং স্লেজের কাঠ অথবা ইস্পাত নির্মিত রানার তুষারের উপর দিয়ে পিছলে সবেগে ছুটতে পারে বলেই মানুষ ঘোড়ার বদলে কুকরবাহিত স্লেজ ব্যবহার করে উত্তর আমেরিকার তুষারবৃত অঞ্চলে। যে কুকুরগুলো স্লেজগাড়ি টানে, তাদের বিশেষভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষিত কুকুর সহজেই চালকের ইঙ্গিত বুঝে বাঁদিকে বা ডানদিকে ঘুরে যায়, থামে, টানতে শুরু করে, সবচেয়ে বড়ো কথা, জমি যেখানে বিপজ্জনক, অর্থাৎ হালকা তুষারের তলায় যেখানে লুকিয়ে আছে। মৃত্যুফঁদের মতো অতল গহ্বর বা গভীর জলাশয় সেই মরণফাঁদের অস্তিত্ব চালকের চোখে ধরা পড়লেও শিক্ষিত কুকুর সেটা বুঝতে পারে এবং চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দেয় চালকের ইঙ্গিত ছাড়াই!
বাক-এর শিক্ষা শুরু হল ফ্রাঁসোয়ার হাতে। বুদ্ধিমান বাক খুব অল্পদিনের মধ্যেই স্লেজবাহী কুকুরের যাবতীয় নিয়মকানুন আয়ত্ত করে ফেলল। চতুষ্পদ স্লেজবাহকের শুধু গাড়ি টানার কৌশল শিখলে চলে না, যে ভয়ংকর পরিবেশের মধ্যে তাকে দিনযাপন করতে হয়, সেই অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন না থাকলে জীবনসংশয় অবশ্যম্ভাবী।
বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতোই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার নিষ্ঠুর পরিণাম বাককে তার পারিপার্শ্বিক ভয়াল অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলল। সেই কথাই বলছি..
বাক-এর সঙ্গিনী কার্লি নামে মেয়ে কুকুরটির কথা আগেই বলেছি। কার্লির শরীরটা প্রকাণ্ড হলেও স্বভাব ছিল খুব ভালো, অপরিচিত কুকুরদের সঙ্গে ঝগড়া করার চাইতে বন্ধুত্ব করার পক্ষপাতী ছিল সে। একদিন রাত্রে খাওয়ার পর কালি একটি স্লেজবাহী হাস্কি কুকুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে গেল। হাস্কির দেহ ছিল কার্লির প্রায় অর্ধেক কিন্তু ওই ছোটোখাটো জন্তুটার স্বভাব যে কতটা হিংস্র ও ভয়ংকর হতে পারে, মুহূর্তের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। কার্লিকে সতর্ক হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই হাস্কি লাফ দিল– দস্তাঘাতের একটা ধাতব শব্দ, বিদ্যুচ্চমকের মতো পরক্ষণেই আর এক লাফে হাস্কির প্রত্যাবর্তন- কার্লির চোখ থেকে চোয়াল পর্যন্ত বিদীর্ণ হয়ে জেগে উঠল এক সুগভীর রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন!
বুনো নেকড়ে ওইভাবে লড়াই করে, কামড় বসিয়ে সরে যায়, শত্রুর দেহে কামড় বসিয়ে ধরে রাখে না- শত্রুকে বারংবার দংশনে রক্তাক্ত করে দেয় এবং পরিশেষে রক্তপাতে অবসন্ন শত্রুর শরীরে প্রাণঘাতী চরম আঘাত হানে। হাস্কি কুকুরেরা বুনো নেকড়ের মতোই ভয়ংকর, তাদের লড়াই-এর কৌশলও নেকড়ের মতো গৃহপালিত কুকুরের সঙ্গে স্বভাব-চরিত্রে তাদের কোনো মিল নেই।
নিতান্ত অকারণে সঙ্গিনীর উপর হাস্কি কুকুরের নির্দয় আক্রমণ বাককে আতঙ্কে বিহ্বল করে দিল, কিন্তু সশব্দে হেসে উঠল স্পিটজ।