কিছুক্ষণের মধ্যেই নদী আর বৃক্ষ-সমাকীর্ণ বনভূমি পেরিয়ে বাক-এর অধিকৃত উপত্যকায় প্রবেশ করল নেকড়ের দল। চন্দ্রালোকে আলোকিত নিরেট রূপার ধাবমান স্রোতের মতো একটা ফাঁকা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নেকড়ে বাহিনী
পূর্বোক্ত ফাঁকা জায়গার ঠিক মাঝখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বাক- মৌন, গম্ভীর, নিশ্চল!
সেই মৌন গাম্ভীর্যে স্থির চতুষ্পদ প্রাণীটির অস্তিত্ব নেকড়ের দলে আতঙ্কের সঞ্চার করল। একটি মুহূর্ত, শুধু একটি মুহূর্তই স্থায়ী ছিল আতঙ্কের ছায়া, পরক্ষণেই দলের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী নেকড়েটা লাফিয়ে পড়ল দণ্ডায়মান জন্তুটার উপর। বিদ্যুঝলকের মতে আঘাত হানল বাক, ঘাড় ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দুঃসাহসী নেকড়ে, তার মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ। বাক তখনও নীরব, নিশ্চল– কিন্তু প্রতীক্ষায় ভয়ংকর। আরও তিনটি নেকড়ে পরপর আক্রমণ করল তাকে, তিনজনই গলায় অথবা ঘাড়ে রক্তাক্ত ক্ষত নিয়ে পিছিয়ে এল। এবার আর একে একে নয়– সমস্ত দলটা মিলিত আক্রমণে ঝাঁপিয়ে এল বাক-এর দিকে।
কিন্তু কার সাধ্য তার সামনে এগোয়? সামনে, পিছনে, ডাইনে, বায়ে বিদ্যুচ্চমকের মতো ঘুরতে ঘুরতে দলবদ্ধ আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল বাক- তার দুই চোয়ালের দুর্ভেদ্য প্রহরা এড়িয়ে কোনো নেকড়ে বাক-এর দেহ স্পর্শ করতে পারল না। খনি-মজুরদের খননকার্যের ফলে শুকনো নদীর খাঁড়িতে যেখানে খাড়া পাঁচিল তৈরি হয়েছিল, সেই পাঁচিলের তলায় পিঠ দিয়ে রুখে দাঁড়াল বাক- নেকড়ের দলের কোনো জন্তুকে সে তার পিছনে যেতে দিল না।
শুকনো খাড়ির খাড়া পার আর পাঁচিলের দেয়াল বাক-এর বাম, দক্ষিণ ও পশ্চাৎভাগ আড়াল করে রেখেছিল, শুধুমাত্র সামনের দিক ছাড়া অন্য কোনো দিক থেকে তাকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। প্রায় আধ ঘণ্টা কাটল। বাক তখনও দাঁড়িয়ে আছে বিজয়ী বীরের মতো। নেকড়ের দল তাকে অর্ধবৃত্তের আকারে ঘিরে রক্তাক্ত ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করছে, কেউ আর ওই ভয়ংকর জীবটির সামনে এগিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
হঠাৎ একটি কৃশকায় দীর্ঘদেহী ধূসর বর্ণের নেকড়ে ধীরে ধীরে সতর্ক পদে এগিয়ে গেল বাক-এর দিকে, তার আচরণ বন্ধুর মতো। বাক-এর দুই চোখে পরিচয়ের আলো জ্বলে উঠল সে চিনতে পেরেছে ওই নেকড়েটাকে এরই সঙ্গে কিছুদিন আগে সে মিলিত হয়েছিল অরণ্যের গর্ভে, এরই সঙ্গে সে পাশাপাশি ছুটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নেকড়ে এগিয়ে এল, তার গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল মৃদু কোমল স্বরের লহরী- একই রকম ভাবে কণ্ঠস্বরে বন্ধুত্ব প্রকাশ করল বাক- তারপর পরস্পরের নাকে নাক লাগিয়ে দাঁড়াল তারা।
এবার এগিয়ে এল একটা বয়স্ক নেকড়ে। তার ক্ষতবিক্ষত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বহন করছে বহু যুদ্ধের চিহ্ন। বাক তার নাকে নাক ঠেকাল। বয়স্ক নেকড়ে তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল। তার সঙ্গে যোগ দিল দলের অন্যান্য নেকড়ে। সাগ্রহে তাদের ঐকতানে যোগ দিল বাক।
বন্ধুত্ব স্থাপিত হতে দেরি হল না নেকড়ে-বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছুটতে শুরু করল সে…
.
২৫. ভুতুড়ে কুকুর
জন থর্নটন ও তার সঙ্গীদের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যেই ঈহাট জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ানরা লক্ষ করল বনবাসী নেকড়ের দলে একটা পরিবর্তন এসেছে। কয়েকটি নেকড়ের মাথায় ও মুখে বাদামি রং-এর ছাপ দেখা যাচ্ছে, আবার কোনো কোনো জন্তুর বুকের মাঝখানে শ্বেতবর্ণের প্রলেপ।
নেকড়ের দলে এই অস্বাভাবিক বর্ণবৈচিত্র্য ঈহাটদের বিস্মিত করেছিল বটে, কিন্তু তাদের বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল আর একটা ঘটনা নেকড়ের দলকে পরিচার্লিত করে সর্বাগ্রে ধাবমান একটি প্রকাণ্ড কুকুর~ মাঝে মাঝেই আত্মপ্রকাশ করে অরণ্য-প্রান্তরে। ঈহাটরা ওই কুকুরটাকে আখ্যা দিয়েছে প্রেতগ্রস্ত বা ভুতুড়ে কুকুর। উক্ত ভুতুড়ে কুকুর এখন ঈহাটদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। বহু চেষ্টাতেও তারা ওই কুকুরটার হামলা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না। তাদের ফাঁদে-আটকানো জন্তুগুলোকে ওই কুকুরটা মেরে খায়- নিজে ফাঁদে পড়ে না, কিন্তু ফাঁদগুলোকে ভেঙে শেষ করে দেয়। তাঁবু থেকে খাবার চুরি করে কুকুরটা, ঈহাটদের পোষা কুকুরগুলোকে নির্বিচারে হত্যা করে। ঈহাটদের মধ্যে যারা শিকার করতে যায়, তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিকারি আর ঘরে ফেরে না– জঙ্গলের মধ্যে অনুসন্ধান চার্লিয়ে দেখা যায় মাটিতে পড়ে আছে শিকারির মৃতদেহ, তার কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন এবং মাটিতে বরফের উপর যে শ্বাপদের পদচিহ্নগুলো দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে নেকড়ের পদচিহ্নের সাদৃশ্য থাকলেও কোনো নেকড়ের পায়ের ছাপই অত বড়ো হয় না।
ঈহাটরা একটি উপত্যকায় কখনো প্রবেশ করে না। জনশ্রুতি আছে, উক্ত উপত্যকায় বাস করে একটি দুষ্ট আত্মা! ওই উপত্যকায় শিকার করতে গেলে শিকারি যে জীবিত অবস্থায় ফিরবে না এ বিষয়ে ঈহাটরা নিঃসন্দেহ।
যাই হোক, দ্বিপদ মনুষ্য পূর্বোক্ত উপত্যকায় পদক্ষেপ না করলেও একটি চতুম্পদ জীব প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে সেখানে উপস্থিত হয়। জন্তুটি নেকড়ের মতো দেখতে হলেও নেকড়ে নয়। একটি ছোটো নদীর ধারে সে কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকে, তারপর একবার মুখ তুলে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে- সেই তীব্র করুণ আর্তনাদের রেশ দীর্ঘসময় ধরে বাজতে থাকে বনভূমির বুকে… তারপর জন্তুটা স্থানত্যাগ করে চলে যায় অন্যত্র…