.
২৩. আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ
দুই দিন দুই রাত তাবু ছেড়ে বাইরে গেল না বাক। ওই সময়ের মধ্যে একবারও থর্নটনকে সে চোখের আড়াল করেনি। কিন্তু তারপর আবার অস্থির হয়ে পড়ল সে, প্রতিমুহূর্তে অনুভব করতে লাগল অরণ্যের অদম্য আকর্ষণ। তবুর আশ্রয় ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যেই সে ঘুমাত প্রতি রাত্রে। পর পর কয়েকটা দিন সে কাটিয়ে দিল অরণ্যের অন্তঃপুরে। ওই সময়ে শিকার করে সে পেট ভরাত আর খুঁজে ফিরত তার নতুন-পাওয়া নেকড়ে বন্ধুকে।
বনের মধ্যে বন্য পশুর মতোই চলাফেরা করত বাক। এমন নিঃশব্দে ছায়ার মতো সে বিচরণ করত যে, জলের ভিতর থেকে সে মাছ তুলে আনতে পারত অতর্কিতে। এর মধ্যে একটা বৃদ্ধ মুগ্ধ হরিণকে সে শিকার করল। কাজটা খুব সহজ হয়নি, দলের ভিতর থেকে তাড়িয়ে ওই হরিণটিকে আলাদা করে সে একসময়ে কোণঠাসা করে ফেলল– তারপর বেশ কিছুক্ষণ লড়াই করার পর সে হরিণটাকে হত্যা করতে সমর্থ হল। হরিণটাকে মারার পরে আবার নিজস্ব আস্তানার প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করল এবং ঘরের দিকে ফিরল।
তাঁবু থেকে তিন মাইল দূরে বাক যখন এসে পড়েছে, সেই সময়ে একটা গন্ধ তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে তাকে বিচলিত করে তুলল। গন্ধ অনুসরণ করে সে সতর্কচরণে অগ্রসর হল। কিছুক্ষণ পরেই সে উপস্থিত হল একটা ঝোপের মধ্যে, যেখান থেকে ভেসে আসছে ওই গন্ধ। সেইখানেই সে নিগ নামে কুকুরটার তিরবিদ্ধ মৃতদেহ দেখতে পেল।
তাঁবুর ভিতর থেকে বহুকণ্ঠের মিলিত ঐকতান-সংগীত ভেসে এল বাক-এর কর্ণকুহরে। বাক গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়াবহ দৃশ্য
সোনা-ভরতি থলেগুলোর সামনে পড়ে আছে হানস, তার শরীরে বিঁধে রয়েছে অনেকগুলো তির! বলাবাহুল্য, হানসের দেহে প্রাণ নেই। কাছেই অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বিজয়নৃত্যে মত্ত হয়ে উঠেছে ঈহাট নাম রেড-ইন্ডিয়ান জাতির একটা দল, মিলিত ঐকতান-সংগীতের রেশ ভেসে এসেছে তাদেরই কণ্ঠ থেকে!
বাক-এর সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে জেগে উঠল প্রচণ্ড ক্রোধ ঝোপের ভিতর থেকে নর্তকদের লক্ষ্য করে সে ঝাঁপ দিলে সগর্জনে! একটা ভয়ংকর শব্দ ভেসে এল ঈহাটদের কানে, পরক্ষণেই বাক-এর ধারাল দাঁতের একটি মাত্র কামড়েই ছিঁড়ে গেল ঈহাট-সর্দারের কণ্ঠনালী! ব্যাপারটা কি ঘটছে ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই আরও পাঁচজন ঈহাট তীক্ষ্ণ দস্তাঘাতে মৃত্যুবরণ করল। ঈহাটরা তাড়াতাড়ি তাদের ধনুক তুলে তির ছুড়ল। কিন্তু বাক এত তাড়াতাড়ি স্থান পরিবর্তন করছিল এবং ঈহাটরা এমন ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, নিক্ষিপ্ত তিরগুলো বাক-এর পরিবর্তে ঈহাটদের শরীরেই বিদ্ধ হল। বাক আক্রমণ করেছিল নির্ভুল লক্ষ্যে পর পর আরও কয়েকজন ঈহাট মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল বাক-এর ধারাল দাঁতের মারাত্মক আঘাতে। এইবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ঈহাটদের দলে, তারা পালাতে পালাতে চিৎকার করে বলতে লাগল একটা দুষ্ট আত্মা হানা দিয়েছে তাদের উপর… জঙ্গলের মধ্যে তাড়া করে আরও কয়েকজন ঈহাটকে হত্যা করল বাক…
বাক-এর আক্রমণ থেকে বাঁচতে যারা জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, এক সপ্তাহ পরে একটি উপত্যকার ভিতর তারা নিখোঁজ সঙ্গীদের খুঁজে পেল আর সেখানে দাঁড়িয়েই তারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আন্দাজ করতে পারল।
তাঁবুতে ফিরে কম্বলের মধ্যে প্রাণহীন দেহে পিটকে শুয়ে থাকতে দেখল বাক। কিন্তু তার প্রিয় প্রভু কোথায়?..থর্নটনের গায়ের গন্ধ অনুসরণ করে একটা ছোটো নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল বাক। একটা ভয়ংকর লড়াই-এর চিহ্ন ছিল নদীতীরে। থর্নটনের পদচিহ্ন নেমে গেছে নদীগর্ভে কিন্তু নদীর তীরে মাটির উপর তার ফিরে আসার চিহ্ন নেই।
বাক বুঝল, থর্নটন আর ফিরে আসবে না, তার মৃত্যু হয়েছে। সারাদিন বাক নদীর পারে বসে রইল, অথবা ঘুরে বেড়াল তাঁবুর আশেপাশে অশান্ত পদে। দুঃসহ ক্ষুধার মতো একটা যাতনাদায়ক অনুভূতি জেগে উঠেছে তার মধ্যে, কিন্তু খাদ্য দিয়ে সেই ক্ষুধার্ত অন্তরের শূন্যতাকে পূর্ণ করা সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন পায়চারি থামিয়ে সে ঈহাটদের মৃতদেহগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রিয় প্রভুকে হারানোর দুঃখ মুছে গিয়ে তার অন্তরে জেগে উঠছিল দৃপ্ত অহঙ্কার- পশুজগতে মানুষ শিকার নিষিদ্ধ, কিন্তু সেই নিষিদ্ধ জীব মানুষকেই হত্যা করেছে বাক!
.
২৪.অরণ্যের আহ্বান
এল রাত্রি। আকাশে দেখা দিল চাঁদ। অর্ধচন্দ্র নয়– সুবর্তুল আলোকপিণ্ডের মতো পূর্ণচন্দ্র। যে নদীর স্রোতের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে থর্নটনের দেহ, সেই নদীর পারে বসেছিল শোকে দুঃখে মুহ্যমান বাক।
হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। বহুদূর থেকে ভেসে এল একটা তীব্র তীক্ষ্ণ জান্তব ধ্বনি। সেই শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জাগল আরও বহুকণ্ঠের মিলিত ঐকতান। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই শব্দ আরও কাছে এগিয়ে এসে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বেজে উঠল। বাক অনুভব করল অগ্নিকুণ্ডের নৃত্যচঞ্চল অগ্নিশিখার ভিতর দিয়ে যে বন্য দুনিয়ার আভাস তার মানসপটে ভেসে উঠেছে বারংবার সেই দুনিয়া তাকে ডাকছে, ডাকছে আর ডাকছে! আদিম অরণ্যের বন্য আহ্বান তাকে টানতে লাগল দুর্নিবার আকর্ষণে…
এমন প্রচণ্ড আকর্ষণ এর আগে কখনো অনুভব করেনি বাক, সে প্রস্তুত হল অরণ্যের আহ্বানে সাড়া দিতে– জন থর্নটনের মৃত্যু নিঃশেষে মুছে দিয়েছে বাক-এর সঙ্গে মানুষের সমস্ত সম্পর্ক..