পরবর্তীকালে ভয়ংকর কঠিন জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল বাক; সেই জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিল তাকে মর্গানের হাতের মুগুর। তবে সেসব কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।
.
০২. মুগুরের শাসন
যে চারজন লোক বাক-এর খাঁচা বহন করছিল, তারা সশব্দে খাঁচাটাকে নামিয়ে রাখল ঘরের মেঝের উপর। বাহকদের মধ্যে একজন কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল, ওহে মর্গ্যান, একটা খ্যাপা জানোয়ারকে আমরা তোমার কাছে পৌঁছে দিলাম।
মর্গ্যান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর এসে দাঁড়াল বাক-এর খাঁচার সামনে। সঙ্গেসঙ্গে খাঁচার ভিতর উঠে দাঁড়াল বাক, তীক্ষ্ণদন্ত বিস্তার করে মর্গ্যানকে অভ্যর্থনা জানাল সে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রথমবার পরস্পরের মুখোমুখি হল। দারুণ আক্রোশে বিদ্যুৎ খেলে গেল বাক-এর শরীরের শিরায় শিরায়, দুর্বল দেহ নিয়েও সে ঝাঁপিয়ে পড়ল খাঁচার উপর। খাঁচার শক্ত গরাদের উপর ব্যর্থ হল আক্রমণ, খাঁচা ভাঙতে পারল না সে।
মর্গানের ওষ্ঠাধরে ফুটল নিষ্ঠুর হাসির রেখা, খাঁচার দরজা খুলে দাও।
আরে জন্তুটা খেপে গেছে, একজন প্রতিবাদ করল, ওটাকে একটু ঠান্ডা হতে দেবে তো৷
নিঃশব্দে একটা কুঠার তুলে নিয়ে খাঁচার দরজায় আটকানো তালার উপর সজোরে আঘাত হানল মর্গ্যান, তৎক্ষণাৎ তালা ভেঙে ক্রুদ্ধ কুকুরটার বেরিয়ে আসার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।
এই, সরে যাও সবাই, একজন চিৎকার করে উঠল। যে চারজন বাহক খাঁচাসমেত বাককে বহন করে এনেছিল, তার ঘরের চার কোণে ছিটকে সরে গেল। একজন আবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ল একটা খাঁচার ছাদের উপর।
তালা-ভাঙা খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে তিরবেগে মর্গ্যানকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল বাক। তার দুই চোয়ালের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিল ভয়ংকর দাঁতের সারি, কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল অবরুদ্ধ ক্রোধের গর্জনধ্বনি, কিন্তু দম্ভভয়াল দুই চোয়াল নির্দিষ্ট নিশানায় পৌঁছনোর আগেই পিঠের উপর এক প্রচণ্ড আঘাত বাক-এর সর্বাঙ্গ করে দিল অসাড়, আড়ষ্ট- পরক্ষণেই বাক লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর!
ইতিপূর্বে কখনো মুগুরের বাড়ি পড়েনি বাক-এর শরীরে, তাই ব্যাপারটা কি ঘটেছে বুঝতে পারল না সে। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর দিকে। এবারও হল আক্রমণ, মর্গানের হাতের মুগুর আঘাত হানল বাক-এর কাঁধের উপর এবং প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও বাক হল ধরাশয্যায় লম্বমান! পর পর দুবার মার খেয়েও বাক পরাজয় স্বীকার করতে চাইল না, সে আবার আক্রমণ করল শত্রুকে অন্যান্য বারের মতো সেবারও তার আক্রমণের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিল মর্গ্যানের মুগুর।
তবু বার বার শত্রুর গলা লক্ষ্য করে আক্রমণ চার্লিয়েছিল বাক, কিন্তু মুগুরটাকে এড়িয়ে একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না। অবশেষে আঘাতের পর আঘাতে সে এমন অবসন্ন হয়ে পড়ল যে, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও তার রইল না। এবার এগিয়ে এসে চরম আঘাত হানল মর্গ্যান অভ্রান্ত লক্ষ্যে বাক-এর নাকের উপর বসিয়ে দিল মুগুরের এক ঘা! সেই আঘাত সহ্য করতে পারল না বাক, দারুণ যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে গেল সে…
জ্ঞান ফিরে পেয়ে বাক দেখল তার সামনে বসে আছে মর্গ্যান, বাক-এর গলাবন্ধ আর মুগুরটা ঝুলছে মর্গানের হাতে। বাককে উদ্দেশ করে সে বলল, এখন বুঝতে পারছ তো কে তোমার মনিব?
হ্যাঁ, বাক বুঝেছে, হাড়ে হাড়ে বুঝেছে সে। মুগুরের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোনো কুকুরই যে জয়লাভ করতে পারে না, এই শিক্ষাই লাভ করল বাক মর্গানের হাতে। পরবর্তী সপ্তাহগুলির মধ্যে সে একবারও মর্গ্যানকে আক্রমণ করতে সচেষ্ট হয়নি, সুবোধ ছেলের মতো খেয়ে ঘুমিয়ে সে আবার সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করল, তার শরীর থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল আঘাতের যন্ত্রণা…
.
০৩. কেনা-বেচার বাজারে
বাক যখন আরোগ্যের পথে এগিয়ে চলেছে, সেইসময় নিত্যনতুন কুকুরের আবির্ভাব ঘটতে লাগল তার চোখের সামনে। শুধু যে নতুন-নতুন কুকুর আসছিল তা নয়, পুরোনো কুকুরদের মধ্যেও অনেকেই বিদায় গ্রহণ করছিল কুকুরদের আস্তানা থেকে। অনেক লোক এসে ভিড় করছিল মর্গ্যানের কুকুর-ভর্তি খাঁচাগুলোর সামনে কয়েকটা কুকুরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে তারা টাকা দিচ্ছিল মর্গ্যানের হাতে— তারপরই বাহকের দল পূর্ব-নির্দিষ্ট কুকুরদের খাঁচাসমেত নিয়ে যাচ্ছিল ঘরের বাইরে। ওই কুকুরদের আর কখনো ফিরে আসতে দেখেনি বাক। ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগেনি তার, তাকে যে কেউ পছন্দ করেনি সেইজন্য সে বেশ খুশি ছিল।
ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল বাক, তার শরীর আগের মতোই পুষ্ট ও বলিষ্ঠ হয়ে উঠল। সেইসময় একটি লোক এল মর্গানের আস্তানায় তার কুকুরদের পরিদর্শন করতে। কার্লি নামে একটি মেয়ে কুকুরকে পছন্দ করল পূর্বোক্ত আগন্তুক, পরক্ষণেই তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল বাক-এর দিকে।
ওহে মর্গ্যান, এটা তো দারুণ কুকুর, বাক-এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল আগন্তুক, শক্ত মাংসপেশীগুলো ওকে কঠিন পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেবে, শরীরের ঘন লোম শীত আর তুষার থেকে ওকে রক্ষা করবে– এমন চমৎকার জন্তুটাকে কোথা থেকে সংগ্রহ করলে তুমি?
মর্গানের ভ্রূ কুঞ্চিত হল, এত জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই। যদি কুকুর পছন্দ হয়, তবে টাকা দিয়ে কিনে নাও।